হৃদয়ের_কোনো_ঠিকানা_থাকেনা শেষ পর্ব(০৩)

হৃদয়ের_কোনো_ঠিকানা_থাকেনা
শেষ পর্ব(০৩)
জাহান আরা

আপা চলে যাওয়ার ৪ দিন পার হয়ে গেলো।সজল ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার ভয়ে কয়েকদিন আমি ভার্সিটি,টিউশন কোথাও গেলাম না।
বুকের ভিতর এক চাপা কষ্ট।

বিকেলে একটা টিউশন আছে।ছাত্রীর মা কল দিয়েছে টিউশনিতে যাওয়ার জন্য।অনিচ্ছাসত্ত্বেও গেলাম রেডি হয়ে টিউশনিতে।
আকাশ সকাল থেকে কেমন রেগে আছে,থেকে থেকে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে।
অনেকদিন বৃষ্টি নামবে নামবে করছে।কিন্তু নামছে না।

আকাশের এই গুরুগম্ভীর অবস্থা দেখে আমার মনে পড়ে গেলো বৃষ্টি কে আহবান করার কবিতা।

“কালো মেঘা নামো নামো, ফুল তোলা মেঘ নামো,
ধূলট মেঘা, তুলট মেঘা, তোমরা সবে ঘামো!
কানা মেঘা, টলমল বারো মেঘার ভাই,
আরও ফুটিক ডলক দিলে চিনার ভাত খাই!

কাজল মেঘা নামো নামো চোখের কাজল দিয়া,
তোমার ভালে টিপ আঁকিব মোদের হলে বিয়া!
আড়িয়া মেঘা, হাড়িয়া মেঘা, কুড়িয়া মেঘার নাতি,
নাকের নোলক বেচিয়া দিব তোমার মাথার ছাতি।
কৌটা ভরা সিঁদুর দিব, সিঁদুর মেঘের গায়,
আজকে যেন দেয়ার ডাকে মাঠ ডুবিয়া যায়!

দেয়ারে তুমি অধরে অধরে নামো।
দেয়ারে তুমি নিষালে নিষালে নামো।
ঘরের লাঙল ঘরে রইল, হাইলা চাষা রইদি মইল
দেয়ারে তুমি অরিশাল বদনে ঢলিয়া পড়।
ঘরের গরু ঘরে রইল, ডোলের বেছন ডোলে রইল
দেয়ারে তুমি অধরে অধরে নামো।”

কি সুন্দর কবিতা!

আবৃতি করতেই মনের গুমোট ভাব কেটে গেলো আমার মুহুর্তেই।
রিকশা করে যাচ্ছি হঠাৎ করেই সজল ভাইকে দেখতে পেলাম।
কি জানি কেনো,সজল ভাইকে দেখামাত্রই আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো।
মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো,গলা শুকিয়ে মরুভূমি।

সজল ভাই এসে আমার সামনে দাঁড়ালো।আমি ভালো করে তাকালাম সজল ভাইয়ের দিকে।সজল ভাইয়ের চোখের নিচে কালি জমে আছে,মাথার লম্বা লম্বা চুল এলোমেলো,মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি,পরনে খাদির আকাশী রঙের পাঞ্জাবি,সাদা পাজামা।
কেমন যেনো আকাশ আকাশ লাগছে সজল ভাইকে আমার কাছে এই রঙের পাঞ্জাবিতে।মেঘেডাকা আকাশ যেনো।

সজল ভাই অনেক কষ্টে টেনেটেনে জিজ্ঞেস করলো আমাকে,”আমার প্রাণটা কই পরী?”

নির্বাক আমি তাকিয়ে রইলাম সজল ভাইয়ের দিকে।কি জবাব দিবো আমি এই প্রশ্নের?

রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিলাম রিকশাওয়ালার।তারপর হাটতে শুরু করলাম।সজল ভাই ও আমার সাথেসাথে এগুতে লাগলো।
আমার থেকে জবাব না পেয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো,”পরী চুপ করে থেকো না,আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে,আমি কোনোভাবে তোমার আপার সাথে কন্টাক্ট করতে পারছি না।না পেরেছি তোমার সাথে,তুমি ক্লাসে যাও নি,টিউশনিতে না,আমি আর পারছি না,আমাকে বলো পরী।”

সত্য তো একদিন জানবেই সজল ভাই,তাই আর রাখঢাক না করে আমিই বলে দিলাম,”আপার বিয়ে হয়ে গেছে সজল ভাই,সেদিন হাসপাতালেই আপার বিয়ে হয়ে যায়।আপা আপার স্বামীর সাথে কোথায় আছে আমি জানি না,মা,খালা,খালু,মামারা ছাড়া কেউ জানে না আপার ঠিকানা।আপনি আপার অপেক্ষা করবেন না আর।”

সজল ভাই থমকে দাঁড়ায় আমার কথা শুনে।তারপর হঠাৎ করেই বসে পড়ে মাঝরাস্তায়।আকাশ এতো অন্ধকার যে এই বিকেলকে সন্ধ্যা বলে মনে হচ্ছে।শোঁশোঁ করে বাতাস বইছে,আমি জানি এখন বৃষ্টি নামবে।
যেই বৃষ্টি ধুঁয়েমুছে নিয়ে যাবে আমার ভিতরের সব জ্বালা।

সজল ভাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছে না যেনো।শুধু বিড়বিড় করে বলছে,”আমার ভালোবাসা,আমার ৬ বছরের স্বপ্ন,আমার ফাইজা,চলে গেছে!
ছিনিয়ে নিয়ে গেছে আমার কাছ থেকে ওরা!
ধোঁকা দিয়েছে আমাকে সবাই মিলে!
একবার ও ভাবলো না কেউ,কিভাবে বাঁচবো আমি?
কিভাবে বাঁচবে ফাইজা?”

সজল ভাইয়ের প্রতিটি কথা তীরের মতো এসে বিঁধলো আমার কলিজায়।আমাকে অবাক করে দিয়ে সজল ভাই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না।
কি সান্ত্বনা দিবো আমি সজল ভাইকে এখন?

বৃষ্টি নামলো ঝমঝমিয়ে মুহুর্তেই। নিশ্চুপ আমি ভিজতে লাগলাম,সেই সাথে সজল ভাইও।
কে জানে,নিশ্চয় আপাও ভিজতেছে যেখানে আছে সেখানে থেকে।
হঠাৎ করেই আমার ইচ্ছে করতে লাগলো সজল ভাইকে জড়িয়ে ধরি,খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলি,”আপনি কাঁদবেন না সজল ভাই,আমি আপনাকে অনেক অনেক ভালোবাসা দিবো,এতো বেশি ভালোবাসা দিবো যে আপনার বুকের ভিতরে হওয়া ক্ষত মুছে যাবে,কোনো পোড়া চিহ্ন থাকবে না কোথাও।”

মনে হতে লাগলো আমার আমি নিজেই সজল ভাইয়ের প্রেমে পড়ে গেছি যেনো।সজল ভাইকে প্রচন্ডভাবে ভালোবেসে ফেলেছি আমি।

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সজল ভাই উঠে দাঁড়ালো।তারপর কিছু না বলে সোজা হাটতে লাগলো উল্টো দিকে।

একা আমি দাঁড়িয়ে আছি রাস্তায়,অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি সজল ভাইয়ের চলে যাওয়া।

রাতে বারান্দায় বসে কফি খাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম আমি কেনো হঠাৎ করে সজল ভাইকে ভালোবেসে ফেললাম!
হঠাৎ করেই মায়ের চিৎকার শুনতে পেলাম মায়ের রুম থেকে।কফির মগ চেয়ারে রেখে ছুটে গেলাম মায়ের রুমে,গিয়ে দেখি মা বুক চাপড়াচ্ছে আর আল্লাহ কে ডেকে বলছে,”ও আল্লাহ,কি করলা এটা তুমি,কি হয়ে গেলো গো আল্লাহ এটা।”

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না মায়ের কথার আর কান্নার।পাশের রুম থেকে বাবা এলেন,মা বাবাকে ধরে আরো জোরে কেঁদে উঠলেন।

তারপর কাঁদতে কাঁদতে বললেন,”পরীর আব্বা গো,আমাদের ফাইজা আর নেই গো,রিশাদ ফোন করেছে ফাইজা গলায় ফাঁসি দিয়েছে ফ্যানের সাথে,কি হয়ে গেলো গো আমার ফাইজার।”

মুহুর্তের জন্য আমি যেনো পাথর হয়ে গেলাম।কি বলছে মা এসব।আমার আপা নেই আর!
না,হতে পারে না এটা।
কি করবো আমি এখন?

সজল ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেলো হঠাৎ করেই,অমনি আমি ছুটে গেলাম আমার রুমে,সজল ভাইকে কল দিলাম,৫ বার কল দেয়ার পরও কেউ ফোন তুলছে না।আবারও কল দিতেই মহিলা একজন কল রিসিভ করলো,ওপাশে খুব চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে,সেই সাথে কারো আর্তনাদ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,”সজল ভাই কই?”

ওপাশের মহিলা জবাব দিলো,”কে আপনি,সজল তো ১ ঘন্টা আগে বিষ খেয়ে মারা গেছে,ওর চেনা কেউ হলে কাল সকালে চলে আসিয়েন,৮ টায় ওর জানাজা হবে।”

আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো যেনো শুনে।
কি হয়ে গেলো এটা?
কান্না এসে গলায় আটকে আছে,আমি কান্না করতে পারছি না কিছুতেই।
মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম আমি তখনই।

জ্ঞান ফিরলো মাঝরাতে,বুকের ভিতর যেনো একটা পাহাড় চেপে বসেছে।এই পাহাড়ের ভার আমি আর নিতে পারছি না।

আপার লাশ ঢাকায় নিয়ে এলো রিশাদ ভাই ভোররাতেই,সাথে একটা চিরকুট আপার লিখা।

বড় মামা কাঁপাকাঁপা হাতে খুলতেই আমি দেখতে পেলাম আপা লিখে গেছে,”মানুষের শরীর না হয় কেউ জোর করে ভোগ করতে পারে,কেউ জোর করে স্থানান্তরিত করতে পারে কিন্তু হৃদয় কে কিভাবে পারে?
হৃদয়ের কোনো ঠিকানা থাকে না,তাকে কোথাও আটকে রাখা যায় না যতোক্ষন না সে স্বেচ্ছায় ধরা দেয়।বাবা মা আমার ভালো চেয়েছে,কিন্তু ভালো রাখার পদ্ধতি তাদের ভুল ছিলো,সারাজীবন এই ভুল মেনে নিয়ে তিলে তিলে মরার চাইতে এই পৃথিবী ছেড়ে একেবারে চলে যাচ্ছি,বাবা মা ক্ষমা করে দিও আমাকে।সজলের সাথে কথা হয় না এই ৬ দিন,৬ দিন যেনো আমার কাছে ৬০০ বছর।

সজল কে বলো আমাকে ক্ষমা করে দিতে,আমি পারলাম না তার হতে,কথা রাখতে,তাকে কথা দিয়েছিলাম একদিন,দুজন একসাথে বাঁচবো আর নয়তো একসাথে মরবো,একসাথে বাঁচতে পারি নি,একসাথে মরতেও পারি নি,আমার আয়ু দিয়ে আল্লাহ সজলকে বাঁচিয়ে রাখুক দীর্ঘদিন,এই মুহুর্তে এছাড়া সজলকে দেয়ার মতো আমার কিছু নেই।
আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
আল বিদা”

সকাল ৮ টায় জানাজা দেয়ার জন্য আপার লাশ মসজিদের মাঠে নেওয়া হয়,বোরকা পরে আমিও যাই সেখানে,গিয়ে দেখি সজল ভাইয়ের লাশ ও আনা হয়েছে সেই মাঠে জানাজার জন্য।

দুজনের জানাজা পড়ানোর পর মসজিদের কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয় কবর দিতে।পাশাপাশি দুই কবরে দুজনকে দাফন করা হয়।

সজল ভাইয়ের ছোট ভাইকে দেখলাম একটা কাগজ হাতে নিয়ে কাঁদছে মসজিদের মাঠে বসে।
আমি গিয়ে হাত বাড়াতেই আমাকে দিলো কাগজটা।
গোটাগোটা অক্ষরে লিখা সজল ভাইয়ের সুইসাইড নোট,”পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর। গায়ের রঙ দিয়ে সবাই মানুষকে মূল্যায়ন করে,অথচ কেউ কেউ যে বুকের ভিতর এক আকাশ ভালোবাসা নিয়ে ঘুরে সেটা কেউ মূল্যায়ন করে না।ফাইজার সাথে কথা না হওয়ার এই ৬ দিন কেটে গেলো।প্রতিটি মুহুর্ত আমার কেটেছে নরকের যন্ত্রণায়।বেঁচে থেকে এই নরক যন্ত্রণা ভোগ করার চাইতে মরে গিয়ে ভোগ করি,সেই ভালো আমার জন্য।
ভালো থাকুক আমার ফাইজা,আমার ভালোবাসা।কথা ছিলো এক সাথে বাঁচার,আর একসাথে মরার।সমাজ দিলো না একসাথে বাঁচতে আর ভাগ্য দিলো না একসাথে মরতে।বেঁচে থাকুক ফাইজা,সুখী হোক,আমার জীবনের সব সুখ যেনো সৃষ্টিকর্তা তাকে দেয়।
আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।”

আমার আর কান্না পেলো না,কেনো কাঁদবো আমি।মনে মনে আমি সজল ভাইয়ের নামে একটা ছোট্ট চিঠি লিখলাম,জানি কখনো তিনি আর জানবেন না তবুও লিখলাম।

“সজল ভাই,
পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে আপনাকে পায় নি বলে আপনার সাথে মরে যাওয়ার যে কথা আপা দিয়েছে সেই কথা আপা রেখেছে।এই যে আজ এই সমাজই আপনাদের দুজনকে পাশাপাশি কবর দিয়েছে।
দুজন জীবিত অবস্থায় পাশাপাশি থাকেন নি,কিন্তু মরে গিয়ে বাকী জীবনের জন্য পাশাপাশি হয়ে গেলেন।কেউ কেউ কথা রাখে সজল ভাই,ভীষণভাবে কথা রাখে,যেমন রেখেছেন আপনি আর আমার আপা।আল্লাহ দুজনকে ভালো রাখুক”

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here