হৃদপিন্ড_২,পার্ট_৭,৮

হৃদপিন্ড_২,পার্ট_৭,৮
জান্নাতুল নাঈমা
পার্ট_৭

মুসকান কেবলি পানি মুখে দিয়েছিলো। ইমনের কথা শুনে গলায় পানি আটকে গেলো তাঁর। বিষম খেয়ে নাক,মুখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এলো। কাশতে শুরু করলো সমানে। এমন অবস্থা দেখে ইরাবতী মুসকানের কাছে গিয়ে মাথায় হালকা থাপ্পড় দিতে লাগলো। সায়রী পিঠে বুলিয়ে দিচ্ছে। সকলেই ব্যাস্ত হয়ে পড়লো তাঁকে নিয়ে। মুসকানের অমন অবস্থা দেখে যেনো হৃদপিন্ড বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো ইমনের৷ মা কে টেনে সরিয়ে দিয়ে সে কাছে গিয়ে মাথায় বুলাতে শুরু করলো। ভয়ার্ত চোখ মুখে চেয়ে ব্যাস্ত গলায় বলতে লাগলো,
—- এক থাপ্পড় দিয়ে খাওয়া শিখিয়ে দেবো। এভাবে কেউ খায়। আর একটু হলেই তো মরে যেতি নে আরেকটু পানি খা। চোখ, মুখ লাল হয়ে গেছে তুই কবে বড় হবি মুসু? এখনো ঠিকভাবে খাওয়া শিখলি না।

নিজহাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে গ্লাসে পানি ভরে মুসকানের মুখের সামনে ধরলো। মুসকানের কাশি থেমে গেছে। অবাক চোখে চেয়ে আছে ইমনের দিকে। শুধু মুসকান না চেয়ে আছে ইরাবতী,সায়রী,দিহানও। সবার চোখে মুখে বিস্ময় স্পষ্ট। ইমন মুসকানের থেকে চোখ সরিয়ে আশেপাশে চেয়ে যখন দেখলো সকলের দৃষ্টি তাঁর দিকে তখন মেজাজ দেখিয়ে বললো,
—- কি সমস্যা? এভাবে ইডিয়টের মতো তাকিয়ে আছো কেনো তোমরা? একটা মানুষ বিষম খেয়ে মরার মতো অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো কোথায় পানি দেবে তাঁকে ঠিক করার চেষ্টা করবে তা না হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেনো? মুরাদ জানলে কি ভাববে ওর বোনকে এখানে আমাদের ভরসায় পাঠিয়েছে সে খেয়াল আছে কারো?
—- ঠিকই তো ঠিকই তো আল্লাহ মুসু আমিতো ভয় পেয়ে গেছিলামগো নাও পানি খাও। বললো ইরাবতী।
—- ভাই তুই ঠিক আছিস তো? বিষয়ম টা কে খেয়েছে বুঝতে পারছিনা। তোর চোখ মুখ এমন লাল হয়ে গেছে কেনো? মনে হচ্ছে সাংঘাতিক ভয় পেয়েছিস? তুই তো ভাই এই অল্পতে ভয় পাওয়ার ছেলে না। বিস্ময় চোখে চেয়ে চিন্তিত গলায় বললো দিহান।
—- হয়েছে এসব কথা বাদ দাও তোমরা মুসু পানিটা খেয়ে নে তুই। বললো সায়রী।

মুসকান গ্লাস ধরতে নিলে ইমন দিলোনা বরং মুখের কাছে নিয়ে ইশারা করলো খেতে। মুসকানও খেয়ে নিলো৷ তা দেখে সায়রী আর দিহান একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো। ইরাবতী বললো,
—- আচ্ছা ফ্রিজে দই আছে সায়রী মুসুকে বের করে দে ওটা খেয়ে নিক।
—- সায়রী বের করে রাখ আধাঘন্টা বা একঘন্টা পর দিবি। ডিরেক্ট ঠান্ডা খাবার খাওয়া নিষেধ ওর। বললো ইমন।
—- বাব্বাহ এসব আমাদের কারো অজানা নয় ইমন। আলাদা করে বলতে হবেনা। মুসু শুধু তোর একার বন্ধুর বোন না আমাদেরও। বললো সায়রী।

দিহান ভ্রু কুঁচকে ইমনকে পর্যবেক্ষণ করছে। ইমন একটু ইতস্তত বোধ করলো। নিজের জায়গায় গিয়ে বসে আবারো খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। মুসকানের মাথা ঝিম ধরে গেছে ইমনের কারবার দেখে। সায়রীর দিকে চেয়ে আস্তে করে বললো,
—- আপু আমি ওঠে যাই।
সায়রী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই মুসকান ওঠে চলে গেলো। ইমন আড়চোখে একপলক দেখে নিলো তাঁর যাওয়া।
®জান্নাতুল নাঈমা
_________________________
রাত এগারোটা বাজে। দিহান শুয়ে আছে ফোন টিপার পাশাপাশি ইমনের সাথে দুএকটা কথাও বলছে। ইমন কিছু কাগজপএ ঘাটাঘাটি করে সেগুলো আবার যথাস্থানে রেখে দিলো। তারপর দিহানের দিকে চেয়ে বিছানায় বসতে বসতে বললো,
—- সায়রীকে ফোন করে বল এখানে আসতে।
—- যাহ কিসব বলিস বন্ধু হলেও তুই তো পুরুষ মানুষ এক রুমে থাকা ঠিক হবে না৷ বন্ধুর বউ সে হিসেবে তো একটু রেসপেক্ট দে।

ইমনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো দিহানের পেট বরাবর সাজোরে এক ঘুষি দিতেই দিহান ওমাগো বলে দিলো এক চিৎকার।
—- ফালতু কথা বললে একদম উপরে পাঠাই দিব। তাই ফালতু বকা বন্ধ করে যা বলেছি তাই কর।
—- ভাইরে মাইরা ফালাবি নাকি? এতো জোরে কেউ দেয়?
—- ফোন দে সায়রীকে।
—- সিরিয়াস কিছু?
—- হুম।

দিহান ফোন করলো সায়রীকে।
—- জান,,, মুসু ঘুমিয়েছে?
—- তোর জানের খ্যাতা পুড়ি শয়তান আমার ঘুমটা নষ্ট করলি ক্যান?
—- তাহলে গায়ে দিবা কি জানু?
—- ফাইজলামি কম কর ফোন রাখ ঘুমাতে দে।
দিহান কিছু বলতে যাবে তাঁর আগেই ইমন তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ফোনটা কেড়ে নিলো। আর সায়রীকে বললো,
—- তোর এই জোকারটা কে কি করে সহ্য করিস বলতো?
—- যেভাবে তোরা করিস আমাকেও ওভাবে করতে হয়।
—- আমার রুমে আয় জরুরি কিছু কথা আছে ফার্স্ট।
—- সকালে গেলে হয়না?
—- এখন আসতে বলেছি সো এখনি আসবি খাওয়া আর ঘুম ছাড়া কি তোর লিষ্টে আর কিছু নাই? দিনদিন তো ফুটবল হচ্ছিস। দুমিনিটে চলে আয় নয়তো সকাল হতে না হতেই বিধবার খাতায় নাম বসিয়ে দেবো। ধমকে ধমকে বললো ইমন।
.
—- হোয়াট! এসব কি বলছিস তুই ইমন। আর ইউ সিরিয়াস? মুসুর প্রতি তোর ফিলিংস তৈরী হয়েছে? ইমন তোর মাথাটাই গেছে তুই কি নেশাটেশা করেছিস। বিরক্তি মুখে বললো সায়রী।
—- আমি বিশ্বাস করিনা সায়ু। ইমন মজা করছে তাইনা? তোর মনে হয় ইদানীং কাজের চাপ বেশী তাইনারে? এজন্যই চাপমুক্ত হতে ঠাট্রা করছিস।

মুসকানের প্রতি এতোদিনের অনুভব করা অনুভূতি ব্যাক্ত করতেই যা রিয়্যাক্ট দেখালো সায়রী আর দিহান তাঁর আর বুঝতে বাকি নেই মুরাদ কি করবে। মুখ লুকানোর জায়গা বুঝি তাঁর আর রইলো না। পৃথিবীতে হয়তো এর থেকে কঠিন কোন পরিস্থিতি হয় না। ইমন নতজানু হয়ে বসে রইলো। একটা টু শব্দও সে করলো না আর। যা দেখে সায়রী আর দিহান ভড়কে গেলো। সামনে বসে থাকা ইমন চৌধুরী কে যেনো চিনতেই পারছে না তাঁরা। বাঘ যদি বিড়ালের ন্যায় আচরন করে সাধারণ মানুষ তা সহজে হজম করতে পারবেনা এটাই স্বাভাবিক।

—- ইমন সত্যি বল তুই ফান করছিস তো? তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে প্রশ্নটি করলো সায়রী।

ইমন দুহাতে নিজের চুল খামচে ধরলো৷ ঘনঘন শ্বাস নিতে শুরু করলো সে। তাঁর ভিতর যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা হয়তো কাউকে বোঝাতে পারবে না। দোটনায় পড়ে মাথা কাজ করছে না তাঁর। একমন বলছে সে ভুল আরেক মন বলছে অনুভূতির ওপর কারো জোর চলে না।

—- আমার কিছু করার নেই সায়ু। যেদিন থেকে আমি এখানে এসেছি যেদিন আমি ওকে দেখেছি তাঁর পর থেকে আমার সবকিছু উলোটপালোট হয়ে গেছে। আমি জানি তোরা আমাকে ভুল বুঝবি আর সবথেকে বেশী যদি কেউ ভুল বুঝে সেটা বুঝবে মুরাদ। কিন্তু আমার কিছু করার নেই আমার ওকে চাই।
—- মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর। আন্টি ঠিক বলেছে এবার তোর বিয়ে করে নেওয়া উচিত। একাকিত্ব জীবন কাটাতে কাটাতে পাগল হয়ে গেছিস তুই। বিবেক লোপ পেয়েছে তোর। বেশ রেগে বললো সায়ুরী৷

ইমনের মাথাও গরম হয়ে গেলো। বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। পাশে থাকা টেবিলে দুটো থাবা দিয়ে বললো,
—- আমার ওকে চাই চাই এট এনিকস্ট।
—- ইমন শান্ত হো সায়ু তুইও শান্ত হো তোরা মাথা গরম করলে কিছু সমাধান হবে না। বললো দিহান।
—- কি শান্ত হবো? কি শান্ত হবো বল? ও কি বলছে শুনেছিস তুই এসব কি ধরনের চাওয়া দিহান। তুই কি ভুলে গেছিস আমাদের অতিত?

সায়রীর কথা শুনে চমকে তাকালো ইমন। মনে পড়ে গেলো সায়ুরী আর দিহানের বিয়ের আগের ঘটনাটা।
সায়ুরীর থেকে দশবছর ডিফারেন্ট ছিলো ছেলেটির। সায়ুরীর বাবা বিয়ে ঠিক করে ফেলে সায়ুরীকে না জানিয়েই। কিন্তু সায়ুরী কিছুতেই এতো সিনিয়র একজন কে বিয়ে করবেনা। এদিকে দিহানও মনেপ্রাণে ভালোবাসে সায়ুরীকে। ইমনের কাছেও বিষয়টা ঠিক লাগেনি। মনে হয়েছে সায়ুরীর বাবা ভুল। তাই দিহান আর সায়ুরীকে পালাতে সহযোগিতা করেছে সে। তারপর নিজেরা বিয়ে করেও নেয় ওরা। গত বছরই পরিবার থেকে মেনে নেয় বিয়েটা এবং পারিবারিক ভাবে আবারো বিয়ে হয় ওদের।

বসে পড়লো ইমন৷ সেদিন সায়ুরীর বেলায় ঠিকই সব বন্ধু বান্ধব মিলে সায়ুরীর হবু বরকে কতোরকম ব্যাঙ্গই করেছিলো। সায়ুরীর বাবাকেও কম বকা বকেনি। মেয়ের থেকে এতো বছর বড় বয়সী পাএ বেছে নেওয়ায়৷ আজ মনে হচ্ছে সায়ুরীর সেই না হওয়া বরের অভিশাপই তাঁর লেগেছে৷ কিন্তু তাঁর একা কেনো লাগলো? সেদিন তো সে একা কিছু করেনি যা করেছে সব বন্ধুরা মিলেই করেছে। তাঁর ভূমিকা বেশী ছিলো বলেই কি আজ ভাগ্য তাঁকে এই পরিস্থিতিতে ফেললো?

দিহান আর সায়রীও চুপ হয়ে গেছে ৷ বেশ অনেকটা সময় গড়িয়ে যায়৷ কেউ কোন কথা বলেনা৷ ইমনের ফর্সা মুখটা লালচে আভায় ভরে গেছে চোখ দুটোও অসম্ভব পরিমাণে লাল হয়ে আছে৷ বুকের ভিতর তাঁর কি চলছে তা হয়তো কেউ অনুভব করতে পারবেনা। ইমনের অমন অবস্থা দেখে সায়রী শান্ত গলায় বললো,
—- দেখ ইমন তুই আমার বন্ধু এতো বছরের বন্ধুত্বের খাতিরেই বলছি তুই ভুল করছিস। তুই অন্যায় আবদার করছিস। দেখ আমাদের জেনারেশন আর মুসকানের জেনারেশন সম্পূর্ণ আলাদা৷ এক যুগের বেশী ডিফারেন্ট আমাদের ওর সাথে। এতো কম বয়সী কাউকে জীবনসঙ্গী করে তুই না নিজে সুখী হবি আর না ওকে সুখী করতে পারবি৷ আর সবথেকে বড় কথা মুরাদ এসব জানলে তোর সাথে ওর বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। এদিকে মুসকানও খুব ছোট এসব ফিলিংসের কিছু বুঝবেনা ও। আজ কে তুই ওকে যা বুঝাবি ও সব মেনে নিবে কিন্তু নির্দিষ্ট একটা বয়সে পা দিলে তোর সব বুঝানো ফিকে হয়ে যাবে। তোর ভালো লাগবে পাহাড় ওর ভালো লাগবে সমুদ্র। তুই চাইবি মাটিতে হাটতে ও চাইবে আকাশে উড়তে।

—- আর যদি ওর সব চাওয়া পূর্ণ করি আমি? ওর জন্য আমি আবারো ফিরে যাবো চৌদ্দ বছর আগে। ওকে ভালোবেসে ওর ভালোর জন্য যা করতে হয় সব করবো। আমি ওর সাথে পা মিলিয়ে চলতে চাই। ভালোবেসে ভালো রাখতে চাই ওকে। আমার কোন চাহিদা নেই শুধু ভালোবাসার আর ভালোরাখার সুযোগ টুকু চাই। সায়ু মুরাদ এটুকু দেবেনা আমায়?

—- তুই একজন বিচক্ষণ মানুষ হয়ে এই ভুলটা কি করে করতে পারলি বুঝে আসছে না আমার ইমন। তোর স্ট্রং অনুভূতি আজ এতো নড়বড়ে ওহ গড।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ইমন। দিহান হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। রাত একটা ছুঁই ছুঁই। সায়রী ঘড়ির দিকে একবার চেয়ে আবারো ইমনের দিকে তাকালো৷ শান্ত গলায় বলতে শুরু করলো,
—- দেখ ইমন তুই সবদিক দিয়ে বিবেচনা করে দেখ। আমি কি বোঝাতে চাচ্ছি আশা করি বুঝতে পারবি। শুধু নিজের ফিলিংস কে গুরুত্ব দিয়ে স্বার্থপরের মতো তুই বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারিসনা বা একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পারিসনা।
লালবর্ন চোখে তাকালো সায়রীর দিকে ইমন। সায়রী এক ঢোক গিলে বললো,
—- আমি জানি তুই জেদ করলে মুসকানকে নিজের বউরূপেও পাবি। এটা তোর দ্বারা সম্ভব হবে। কিন্তু ভাই জোর করে কিছু আদায় করা কি ঠিক? ধরে নিলাম বিয়ে করলি পুরুষ মানুষ শারীরিক চাহিদারও একটা ব্যাপার আছে৷ ঐটুকুন মেয়ের থেকে কি পাবি? বরং একটা জীবন শেষ হয়ে যাবে।
—- ব্যাস। অনেক বলেছিস তুই আর না। ইমন চৌধুরী কে কি ভাবিস তুই? আমি এতোটাই অমানুষ? বিবেকহীন আমি? আমি ওকে ভালোবেসেছি আর ভালোবাসতে চাই এর বাইরে আর কিছু চাইনা আমার। আমার ক্যারেক্টার সম্পর্কে তোরা ভালোভাবেই অবগত আছিস৷
—- ভুল অবগত ছিলাম কিন্তু এখন নেই৷ আজ ওর প্রতি ভালোবাসার ফিলিংস এসেছে কাল যে শারীরিক চাহিদার জন্য ওর প্রতি ফিলিংস আসবেনা তাঁর কি গ্যারান্টি?

আর নিতে পারলো না ইমন। বসা থেকে ওঠে রাগে হনহন করতে করতে বেরিয়ে গেলো। দিহান বললো,
—- সায়ু তুই শান্ত হো। আমাদের ওর দিকটাও ভাবা উচিত।
—- তুই চুপ কর৷ একদিকে কথা বলবিনা। আমি দুদিক ভেবেই কথা বলছি। আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি আমি আজ ইমনকে দেখে৷ পুরুষ মানুষের আক্কেল জ্ঞান কেনদিনই হবেনা। সে যতো শিক্ষিত,জ্ঞানীবান হিসেবে লোকের কাছে পরিচিত হোকনা কেনো। ভিতরে ভিতরে সবকটা বজ্জাতের হাঁড়ি।
—- শেষমেশ ইমনকে তুই এটা বলছিস?
—- তা নয়তো কি করবো? কোন আক্কেলে নিজের থেকে এতো কমবয়সি কারো প্রতি ওর ফিলিং উতলে ওঠলো?
—- সায়ু ফিলিংস কি বয়স বিবেচনা করে আসে? সায়ু আমাদের মস্তিষ্ক আর মন কিন্তু একভাবে চলে না। দেখ ওর মস্তিষ্ক জানে মুসু ওর থেকে বয়সে অনেক ছোট, মুসু ওর বন্ধুর বোন। ওর মস্তিষ্ক এটুকুতেই সীমাবদ্ধ কিন্তু ওর মন এটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকেনি ওর মন এর থেকেও বেশী কিছু ভেবে ফেলেছে। ওর ভিতর থেকে হয়তো মুসুর জন্য ফিলিংস এসে গেছে। এখানে আমাদের কারো হাত নেই।
দিহানের কথা শুনে সায়ুরী রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে বলে গেলো,
—- আমার কথা এখন শুনলে ভালো নয়তো ভয়াবহ কিছু ঘটবে দেখে নিস তুই, মিলিয়ে নিস।
.
রুমের দরজা অবদি আসতেই চমকে গেলো সায়ুরী ইমনকে দেখে। মুসকান ঘুমিয়ে আছে আর ইমন এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তাঁর ঘুমন্ত মুখটার দিকে। দূর থেকেও স্পষ্ট বুঝতে পারলো ইমনের চোখ দুটো ঝাপসা। যে চোখে অস্বাভাবিক রাগ,জেদ,দেখে এসেছে এতোগুলো বছর সেই চোখে আজ কারো প্রতি গভীর ভালোবাসা, কাউকে পাওয়ার গভীর আকুলতা,কাউকে হারানোর ভয়, কারো জন্য কষ্ট দেখতে পারছে সে। আর আগালো না সায়ুরী ফিরে গেলো দিহানের কাছে । এতোক্ষন ধরে এতো নীতিবাক্য ছেড়ে শেষে সেও দূর্বল হয়ে গেলো কেমন। ‘ভালোবাসার অনুভূতির কাছে সমস্ত নীতিবাক্যও যে তুচ্ছ’।
.
সারারাত একভাবে বসে ছিলো ইমন। অপলকভাবে চেয়ে ছিলো মুসকানের মুখপানে। মুসকান যখন ঘুমের ঘোরে এপাশ থেকে ওপাশ ফিরেছে ইমনের মুখে যেনো অমাবস্যা নেমে এসেছে। আবার যখন এপাশ ফিরেছে নিজে নিজেই হেসেছে সে। হঠাৎই যেনো জীবনটা তাঁর পাল্টে গেছে। সামনের এই ঘুমন্ত পরীটাই যেনো তাঁর সুখ,দুঃখের একমাএ কারণ এখন। মনে মনে বিরবির করে বললো ইমন, ‘ আমার অনুভূতিগুলো কাউকে বুঝতে হবেনা শুধু আমার স্লিপিং বিউটি বুঝলেই হবে’।
.
ভোরেরদিকে ঘুম ভেঙে যায় মুসকানের। চোখ বুজেই ওঠে বসে সে। বালিশের পাশে হাতরিয়ে হাতরিয়ে চুলের ব্যান্ড খুঁজে নিয়ে চুলগুলো বেঁধে ফেলে। ওয়াশরুম যাবে বলে বিছানা ছেড়ে নামতে নেয়। নিজের বাড়ি, নিজের রুমে, নিজের বিছানা মনে করেই নামতে গিয়ে পড়ে যেতে নিতেই ইমন ধরে ফেলে।

—- আরে চোখ টা খুলে নামবিতো এখনই পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙতি। বলেই ধরে বিছানায় বসাতে যেতেই চোখ আটকে গেলো কানের নিচে ঘাড় বরাবর কালো তিলটার দিকে। কুশি কুশি চুলগুলোর ভিতর স্পষ্ট কালো তিলটা যেনো তাঁর দিকেই চেয়ে আছে। যা দেখে কিছুক্ষণের জন্য হৃদস্পন্দন থেমে গেলো তাঁর। একহাতে মুসকানের কাঁধে ধরে আরেকহাতে স্পর্শ করলো ঘাড়ের ঐ তিলটায়৷

চলবে।

হৃদপিন্ড_২
জান্নাতুল নাঈমা
পার্ট_৮

চোখের সামনে এতো কাছে তাঁকে স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে আছে ইমন? ভাবতেই বুকের ভিতর যেনো ঢেউ খেলে গেলো। পুরো শরীরে কম্পন ধরে গেলো কেমন। কি করবে কি বলবে বুঝে ওঠতে পারলোনা। তাঁর সমস্ত জ্ঞান শূন্য হয়ে গেলো যেনো৷ দুহাতে বেশ জোরে ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে দিলো ইমনকে।

দুকদম পিছিয়ে গেলো ইমন৷ ভ্রু কুঁচকে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চেয়ে রইলো মুসকানের দিকে। মুসকানও অবাক হয়ে চেয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকলো। তোতলাতে তোতলাতে বললো,
—- নানাভাই তুমি?
এটুকুন মেয়ের কতো সাহস, গায়ে কতো জোর। একেতো ধাক্কা দিয়ে চরম বেয়াদবির সাথে চরম অপমান করেছে তাঁকে তাঁরওপর নানাভাই বলে প্রেসটিজের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। আবার কেমন থরথর করে কাঁপছেও। ভয়ই যদি পাবে এতো সাহস দেখাতে কে বলেছে? ভেবেই দুকদম এগিয়ে একটানে নিজের খুব কাছে নিয়ে এলো। মুসকান কাঁদো কাঁদো হয়ে সড়ে যেতে চাইলেই ইমন খুব শক্ত করে পিঠে চেপে ধরলো৷ গলার স্বর বেশ ভারী,কঠিন করে বললো,
—- এক চড়ে সবকয়টা দাঁত ফেলে দিতাম৷ শুধু এটার জন্য সেটা পারলামনা৷ ঠোঁটের কোনার তিলটায় বুড়ো আঙুল ছুঁয়িয়ে কথাটা বললো ইমন।

মুসকান মাথা নিচু করে ফেলবে তখনি বাকি চার আঙুল থুতনির নিচে রেখে শক্ত করে ধরে রাখলো। সে আর মাথা নিচু করতে পারলো না। তবে চোখ নামিয়ে রাখলো। তাঁর শরীরের কম্পন অনুভব করতে পারছে ইমন তাঁর চোখের ঘনকালো পাঁপড়ির কাঁপতে থাকা দৃশ্যটা ইমনের চোখ জোরায় যেনো আঁটকে গেলো। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে উপভোগ করতে লাগলো সেই দৃশ্যটা সে।

অস্বস্তি, ভয়,লজ্জার মাঝে হাবুডুবু খেতে লাগলো মুসকান৷ নিজেকে ইমনের থেকে দূরে সড়াতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো খুব। কিন্তু এক ইঞ্চি ও সড়তে পারলো না৷ ইমন মৃদু হেসে ফেললো মুসকানের অবস্থা দেখে। গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
—- এই মুসু এক কাজ করিস তো তোদের মেয়েদের কিসব কেনাকাটার দোকান আছে না? ঐ যে ঠোঁটে মাখিস,চোখে মাখিস, গালে মাখিস ঐ সব যে দোকান থেকে কিনিস সেই দোকানে গিয়ে দোকানিকে জিগ্যেস করবি তিল মোছার কোন উপাদান তাঁরা দেয় কিনা, যদি দেয় তাহলে যতো টাকাই লাগুক কিনে এসব ঠোঁট তিল,ঘাঁড় তিল গুলা মুছে নিবি। তারপর শাস্তি দিব বেয়াদবির চরম শাস্তি।

ইমনের মুখে এমন অস্বাভাবিক কথা শুনে মাথা ভনভন করছে মুসকানের। বুকের ভিতর যেনো হাতুড়িপেটা শুরু হয়ে গেছে। ইমন কেমন চাহনীতে যেনো চেয়ে আছে তাঁর দিকে সে চাহনীতে চোখ রাখতে পারছেনা সে৷ মাথা নিচু করে ফেলতেই ইমন ছেড়ে দিলো তাঁকে। মুসকান জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ইমন দুকদম পিছিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
—- আগে তো এমন ভয় পেতিনা এখন কেনো এতো ভয় পাচ্ছিস? আর ভয় পাবি ভালো কথা কিন্তু চোখে,মুখে এমন মারাত্মক ভয়কাতুরে সৌন্দর্য ভর করে কেনো? তুই কি হঠাৎ করে সৌন্দর্য বাড়ানোর মন্ত্র জানিস?

মুসকানের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো৷ তাঁর বুকের ভিতর কেমন যেনো শুরু হয়ে গেছে। কেমন অনুভূতি তা না বলতে পারবে আর না কাউকে বোঝাতে পারবে বা নিজে বুঝতে পারছে। সেই শুরু হওয়া অনুভূতি সহ্য করতে না পেরে কেঁদেই ফেললো সে৷ নাক টানার শব্দে পেয়ে ঘুরতেই মুসকানের চোখের অশ্রু দেখতে পেলো ইমন। আহত হলো তাঁর হৃদয় দুকদম এগিয়ে এসে আহত গলায় বললো,
—- আরে মুসু কাঁদছিস কেনো? আরে আমি মারবো বলেছি মারিনি তো। এতে কাঁদতে হবে কেনো? যাই বলিস তোর এমন ঘনঘন অশ্রু বিসর্জন দেওয়ার স্বভাবটা ঠিক আগের মতোনই আছে। দেখি বোস কাঁদতে হবে না বোস।

ইমনের হাতটা এক ঝটকায় সড়িয়ে দিলো মুসকান। রাগি চোখে চেয়ে ভাঙা আওয়াজে বললো,
—- হ্যাঁ আমাকেই তো মারতে চাও শুধু তুমি৷ আমাকেই তো মারবে৷ সেদিনও মারতে চেয়েছিলে আজো চেয়েছো৷ সবাইকে আদর করবে সবাইকে ভালোবাসবে শুধু আমাকেই বকবে আমাকেই মারবে। বলেই গটগট পায়ে বাথরুম গিয়ে ঠাশ করে দরজা লাগিয়ে দিলো।
ইমন হা করে দাঁড়িয়ে রইলো চোখ দুটো স্থির রাখলো বাথরুমের বন্ধ দরজার দিকে। মনে মনে ভাবলো ‘হে আল্লাহ ওর স্মৃতি শক্তি একটু কমিয়ে দিও প্লিজ যেনো ঐসব দিন ভুলে যায়’।
_______________________
প্রায় পনেরো দিন চলে গেছে। এই পনেরো দিনে ইমন বেশ কয়েকবার মুসকানের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। যখনই সময় পেয়েছে মুরাদের সাথে দেখা করার বাহানায় চলে গেছে ও বাড়ি। বন্ধুকে দেখার নাম করে দেখে এসেছে বন্ধুর বোনকে। সকলের আড়ালে মুসকান কে পেয়ে যতোবারই কথা বলতে গেছে ততোবারই মুসকান তাঁকে এড়িয়ে চলেছে। নিজেকেই নিজে চেনা হয়ে পড়েছে দুষ্কর। যে ইমন চৌধুরীর সাথে একটিবার মিট করার জন্য শহড়ের নামীদামী ইন্ডাস্ট্রির মালিকদের মেয়েরা রাতদিন স্বপ্ন দেখে আসছে। ভার্সিটিতে শতশত মেয়ের প্রেম,বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এসেছে যে ইমন চৌধুরী। সেই ইমন চৌধুরী কে একদম নাকানিচুবানি খাওয়িয়ে ছাড়ছে তাঁরই বন্ধুর পুচকে বোন? তাঁর অপরাধ মিলি নামক এক ভদ্রমহিলার জন্য তাঁকে কয়েকটা ধমক দেওয়া হয়েছিলো এটুকুই? যে মিলি কিনা এখন অন্যের সংসারে গিয়ে অন্যের বাচ্চার মা হয়ে গেছে তাঁর জন্য শুধুমাএ তাঁর জন্য আজ তাঁর এই পরিণতি? কিছু ভাবতে পারছেনা ইমন আর৷ এদিকে তাঁর মাও বিয়ে বিয়ে করে কান ঝালাপালা করে ফেলছে। বাবার বন্ধুর মেয়েরা সকাল বিকাল দেখা করার জন্য প্যান প্যান করছে। শুধুমাএ মুরাদের জন্য দাঁতে দাঁত চেপে থাকতে হচ্ছে নয়তো এতোদিনে ঐটুকুন মেয়ের ত্যাজ কতোটা দেখে ছাড়তো৷ এতো জেদ এতো ত্যাজ কোথা থেকে আসে তাই দেখতো সে৷
.
বেলা এগারোটা বাজে। মুরাদ ফোন করে জানালো তাঁদের বাড়ি যেতে। গতকাল রাত বারোটার দিকে ফিরে সেই যে ঘুম দিয়েছিলো ঘুম ভেঙেছে একদম মুরাদের ফোন পেয়ে। ওঠে ফ্রেশ হয়ে মায়ের হাতের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লো সে।

মুরাদদের বাড়ির সামনের পুকুরপাড়েই মিলি আর লিলি দাঁড়িয়ে আছে৷ মিলির কোলে তাঁর দুবছরে মেয়ে ইসরাত। প্রচন্ড গরম পড়েছে কারেন্ট চলে যাওয়ায় মেয়ে আর বোনকে নিয়ে পুকুরঘাটে এসেছে। বড় বড় দুটা আম গাছ আর একটি জলপাই গাছ থাকায় পুকুর পাড়ে বেশ ছায়া থাকে সেই সাথে ঠান্ডা বাতাস৷ দুবোন এটা সেটা গল্প করছিলো তখনি লিলি গেটের সামনে দেখতে পায় ইমনকে। বেশ উত্তেজিত হয়েই বলে,
—- এই আপু ইমন ভাইয়া৷
লিলির কথা শুনে চমকে তাকায় মিলি। সত্যি ইমনকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় সে। ড্যাবড্যাব করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে ফেলে,
—- আল্লাহরে এটা ইমন? ওহ মাই গড আগের থেকে হাজারগুন বেশী হ্যান্ডসাম হয়ে গেছে রে। বাবুকে নে আমি দেখা করে আসি ওর সাথে। বলেই মেয়েকে লিলির কাছে দিয়ে বেশ দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় ইমনের দিকে।

গেটে কয়েকবার ঠকঠক করে ঘড়ির টাইম দেখে চোখের পলক ফেলতে থাকে ইমন। তখনি শুনতে পায় পরিচিত এক কন্ঠস্বর।
—- এই ইমন কেমন আছো তুমি?
—- আরে মিলি যে? ভালো আছি তুমি কেমন আছো?
—- ভালো ছিলাম। তোমায় দেখে আরো দ্বিগুণ ভালো হয়ে গেলামগো। কতোদিন পর দেখা আমাদের। শুনলাম তুমি নাকি এখন ব্যারিস্টার সাহেব?
মৃদু হাসলো ইমন মাথা চুলকে বললো,
—- ঐ আর কি।
মিলি এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ইমনের দিকে। ইমন বেশ ইতস্ততবোধ করছে। জোর পূর্বক হাসি টেনে মিলির কথার জবাব দিচ্ছে সে। তখনি গেট খুলে দিলো মুসকান। তাঁর মুখ স্বাভাবিক থাকলেও যখন ইমনের পাশে মিলিকে দেখলো শরীর জ্বলে গেলো তাঁর। দাঁতে দাঁত লাগিয়ে পিছন ঘুরে গটগট পায়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলো সে।

ইমনের সাথে মিলিও বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলো। একি ভার্সিটির একি ব্যাচ এর স্টুডেন্ট তাঁরা। তিনবছর আগেই বিয়ে হয়ে যায় মিলির৷ কিন্তু ভার্সিটি জীবন থেকেই ইমনকে সে খুব পছন্দ করে। তাঁর এই পছন্দের কথা কারো জানতে বাকি নেই। তাঁর হাজব্যান্ড পর্যন্ত জানে সে ইমন চৌধুরী কে মন থেকে ভীষণ পছন্দ করে। প্রপোজও করেছিলো কিন্তু ইমন তাঁকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছে সে রিলেশনশিপে যাবেনা। তাছাড়া বন্ধুত্বের মধ্যে এসব টেনে যেনো বন্ধুত্বকে সে অসম্মান না করে। যেদিন মিলিকে এসব বোঝায় ইমন সেদিন মুরাদদের ছাদে মিলি আর ইমন একা ছিলো। ইমনের পাশে কোন মেয়েকে ছোট থেকেই সহ্য করতে পারতোনা মুসকান। তখন তাঁর ধারনা ছিলো তাঁর নানাভাই শুধুই তাঁর একার৷ সকলের কাছে যখন শুনেছিলো মিলি ইমনকে প্রপোজ করেছে এর মানেটা ঠিক বুঝেছিলো সে। সবে ক্লাস সিক্সে ওঠেছে সে তখন। এসবে তখন নিত্য,নতুন ধারনা হতে থাকে তাঁর। ডিজিটাল যুগে এসব বুঝতে তাঁর খুব একটা অসুবিধা হয়নি। তাঁর ভালোবাসায় ভাগ বসাতে অন্য কেউ আসবে ভাবতেই রেগেমেগে ছাদে যায় সে।

ছাদে গিয়ে যখন দেখে মিলি কান্না করছে আর ইমন তাঁর হাতের ওপর হাত রেখে কিসব বোঝাচ্ছে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে সে। এক দৌড়ে তাঁদের কাছে যায় আর মিলির হাত থেকে ইমনের হাত সড়িয়ে মিলির হাতে সাজোড়ে এক কামড় দেয়। ব্যাথায় কুকিয়ে ওঠে মিলি আর ইমন মুসকানকে মিলির থেকে ছাড়িয়ে বেশ কয়েকটা ধমক দেয়। এতোটা রেগে এতো জোরে ধমকায় যে রাতের বেলা গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে মুসকানের। সেই থেকেই বড্ড অভিমান আর জেদ চাপে মাথায়। সেই অভিমান আর জেদ থেকেই দূরে দূরে থাকে সে। তাঁর সেই এক ভাবনা তাঁর নানাভাই মিলিকেই বেশী ভালোবাসে তাইতো তাঁকে ওভাবে ধমকেছিলো সেদিন। যদি তাঁকে ভালোবাসতো তাহলে তো ধমকাতে পারতো না৷
.
মিলি, মুরাদ আর ইমন বেশ অনেকটা সময় গল্প করলো। মুরাদের মা মরিয়ম আক্তার গতকাল বিকালে বাপের বাড়ি গেছে। মুরাদের নানি অসুস্থ তাই কিছু ফল কিনে নিয়ে দেখতে গেছে। বাড়িতে মুসকান আর ওপাশে চাচা,চাচি,চাচাতো বোন ছাড়া কেউ নেই। মুসকান নিজের রুমে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। এ কদিন ইমনকে তাঁর পিছনে ঘুরিয়ে যতো মজা নিয়েছে সবটায় আজ জল ঢেলে দিলো এই মিলি ভাবতেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে তাঁর।

অনেক সময় গল্পগুজব করার পর ইমন ভাবছে মুসকানের ছোটবেলার সেই জেলাসি হওয়ার কথাগুলো। তাঁর সাথে কোন মেয়ে দেখলেই মুসকান কেমন মেয়েগুলোকে মারতে যেতো। মিলিকেও তো কামড়ে দিয়েছিলো একবার৷ সেইরকম কি এখনো হবে ওর? কই আজ তো কিছু হলোনা নাকি মিলির বিয়ে হয়ে গেছে বলে কিছু বললো না? নাকি আগের বাচ্চামি করে জেলাসি হওয়াটা বড় হয়ে পরিবর্তন হয়ে গেছে? ইশ কতো ভালোই না হতো আগের মতো যদি জেলাসি হতো। কেশে ওঠলো ইমন।
—- একি ইমন বিষম খেয়েছো? পানি খাবে আমি এখনি আনছি। বলেই মিলি ওঠে বসার ঘরে গেলো।
ইমন ও কাশতে কাশতে ওঠে বসার রুমের দিকে গেলো। মুসকানের রুমের দিকে মুখ করে বেশ শব্দ করে কাশতে শুরু করলো।

মিলি গ্লাসে পানি ভরে ইমনের কাছে নিয়ে ব্যাস্ত গলায় খেয়ে নিতে বললো। ইমন আরেকটু শব্দ করে কাশতেই মুসকান রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মুসকান কে দেখেই ইমন মিলির হাত থেকে গ্লাস নিয়ে পানিটা খেয়ে নিলো৷ হাঁটু গেড়ে বসে নিচু স্বরে বললো,
—- একটু মাথায় হাত বুলাও মিলি। আমার মা হাত বুলালে বিষম থেমে যায় মা তো নেই আপাতত তুমি হেল্প করো।
বলামাএই মিলি পিঠে আর মাথায় আস্তে করে হাত দিয়ে চাপর দিতে লাগলো। মুসকান তাঁর দ্রুত হাঁটা পা থামিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থাকলো কতোক্ষন। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তাঁর। এই মিলিকে সহ্য করতে পারছেনা সে৷ আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না সেখানে ফিরে গেলো নিজের রুমে। ভয়ংকর রেগে গেছে সে। হাতের কাছে যা যা পেলো সব ছুঁড়ে ফেললো নিচে। কাচের জগ,গ্লাস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। ফুলদানী থেকে শুরু করে বই খাতা সব ছুঁড়ে ফেললো। পুরো রুম এলোমেলো করে মেঝেতে বসে দুহাঁটুতে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো।

রুমে ভাঙচুরের শব্দ শুনে মিলির ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। ইমন তো হতবাক হয়ে গেছে। এমন কিছু ঘটবে ভাবতেও পারেনি সে৷ ওদিকে মুরাদ সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। পাশের ঘর থেকে রিমি আর নিলুফা বেগম ছুটে এসেছেন। মিলি আর ইমনকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিমি প্রশ্ন করলো,
—- মিলি আপু কিসের শব্দ মুসু কাঁদছে না? হ্যাঁ তাই তো মুসু কান্না করছে তো কিন্তু কেনো? বলতে বলতেই মা মেয়ে ছুটে গেলো মুসকানের ঘরে।

মিলি হা হয়ে তাকিয়ে আছে ইমনের দিকে। মুরাদের চেঁচানোতে বিরক্ত হয়ে ইমন মুরাদের ঘরের দরজার দিকে একবার তাকালো তারপর চলে গেলো মুসকানের ঘরের দিকে।
.
মুসকান কেঁদেই চলেছে। রিমি আর নিলুফা বেগম তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে জিগ্যেস করছে, কি হয়েছে কি নিয়ে রেগে গেছে৷ কিন্তু মুসকান কিছু বলছেনা। মিলি অপরাধীর মতোন দাঁড়িয়ে আছে। ইমন কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে বিছানায় গিয়ে বসলো৷ মুসকানের সামনাসামনি বসেছে সে৷ তাঁর সামনেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে কাঁদছে মুসকান। ইমন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে মুসকানকে। যাকে বলে পা থেকে মাথা অবদি মুখস্থ করে নেওয়া। কিন্তু তাঁর মুখস্থ করতে একটু অসুবিধা হচ্ছে কারণ মেয়েটা যে কাঁদছে। খুব বিশ্রি কান্না দুনিয়ার সবচেয়ে জঘন্য কান্নাটাই বোধহয় কাঁদছে মুসকান। যা তাঁর বুকের ভিতর বিশ্রি একটা অনুভূতির সৃষ্টি করছে। তাঁর খুব বলতে ইচ্ছে করছে ‘মুসু আমার কাছে জগতের সবচেয়ে বিশ্রি মূহুর্ত হচ্ছে তোর কান্নার মূহুর্ত’। মুরাদকে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে ‘এমন বোন যেনো আর কারো বন্ধুর ঘরে না জন্মায়। কপাল পুড়েছে এক আমারই পুড়ুক এ জগতের আর কোন পুরুষের যেনো আমার মতো করে কপাল না পোড়ে’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here