হৃদপিন্ড_২,পার্ট_৩,৪

হৃদপিন্ড_২,পার্ট_৩,৪
জান্নাতুল নাঈমা
পার্ট_৩

রাত এগোটার দিকে দিহান আর ইমন বাড়ি যাওয়ার জন্য বের হলো। মরিয়ম আক্তার পিছন পিছন বের হলেন ওরা চলে গেলেই সে গেটে তালা লাগিয়ে দেবেন। গেট অবদি গিয়ে থেমে গেলো ইমন। পিছন ঘুরে মরিয়ম আক্তার কে হেসে হেসে কি যেনো বলছে। মুসকান তখন তাঁর রুমের জানালা থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে ইমন কে। রাতের আঁধারে অল্প আলোতে ইমনের মুখটা ঝাপসা দেখতে পায় সে। ইমনের হাসিতে তাঁর ঠোঁটের কোনায়ও হাসির রেখা ফুটে ওঠে। কতোগুলো দিন পর মানুষ টাকে দেখছে সে৷ নিজের অনুভূতি তে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে। যদিও তিনবছর আগের অনুভূতি তে বুকের ভিতর হৃদস্পন্দন এমন এলোমেলো স্পন্দিত হতো না। তবে আজ হচ্ছে তাঁর ঐ মানুষ টাকে দেখে ঐ মানুষ টার আশে পাশে থেকে তাঁর স্পন্দন এলো মেলো হয়ে যাচ্ছে। চোখ সরিয়ে নিয়ে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বুকের উপর হাত চেপে ধরে কয়েকবার শ্বাস ছাড়লো আর নিলো। এক ঢোক গিলে নিয়ে নিজেই নিজেকে শাসালো,’মুসু কখনোই না তুই কিন্তু ঐ মানুষ টার সামনে একদম নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করবি না। ভুলে যাস না সেদিনের কথা যেদিন টায় বাইরের একটা বেহায়া মহিলার সামনে তোকে মারাত্মক ভয়ংকর ভাবে ধমকেছিলো। ঐ বেহায়া, নির্লজ্জ মহিলার সামনে তোকে অপমান করেছিলো কি লজ্জাটাই না সেদিন তুই পেয়েছিলি। সেদিনের কথা যদি মনে না রাখিস তাহলে তুই এক ভাইয়ের একমাএ আদরের রাগি,জেদী, ত্যাড়ি বোন না’

চোখ খুলল মুসকান৷ তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তাই আবারো জানালায় ওকি দিতেই দেখতে পেলো গেটে তালা ঝুলছে। বুকের ভিতরটা হঠাৎই কেমন ধক করে ওঠলো৷ মনটাও খারাপ হয়ে গেলো ভীষণ। পরোক্ষনেই ভাবলো ‘আমি মন খারাপ করছি কেনো? বয়েই গেছে তাঁর জন্য আমার মন খারাপ করতে। তিনবছর যখন থাকতে পেরেছি সারাজীবনও পারবো’ ভেবেই এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালা লাগিয়ে দিলো। বিছানায় শুয়ে চোখ দুটো বুঝতেই ইমনের মুখটা ভেসে ওঠলো। বুঝলো ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে চলে গেছে মানুষ টা৷ তাই মায়ের রুমে গিয়ে মায়ের ফোন নিয়ে এলো। ফোনটা নামেই মায়ের কাজে শুধুই মুসুর৷ পড়ার টেবিলের একপাশে ছোট সাউন্ড বক্স ছিলো ব্লুটুথ অন করে দিয়ে নিজের পছন্দ অনুযায়ী গান খুঁজে বের করলো। গান দিয়ে আবারো চোখ বুজে শুয়ে পড়লো সে।

“এই ভালোবাসা তোমাকেই পেতে চায় ঐ দুটো চোখ যেনো কিছু বলে যায়।
কবে তুমি নাম ধরে ডাকবে কবে তুমি হাতে হাত রাখবে
হো.কবে তুমি নাম ধরে ডাকবে কবে তুমি হাতে হাত রাখবে”

গানের প্রতিটা কথা যেনো তাঁর হৃদয়ে কম্পন তুলে দেয় আর বলে “বাস্তব কেনো সিনেমার মতোন হয়না? বাস্তবে কি কখনো কোন মেয়ের জীবনে হিরোর আগমন ঘটে? আগমন ঘটে কোন প্রেমিক পুরুষের? আর সেই প্রেমিক পুরুষ কি তাঁর প্রিয়তমাকে এভাবেই মনের কথা জানায়”?

প্রচন্ড মন খারাপ হয়ে গেলো মুসকানের। এই প্রশ্নগুলো কাকে করবে সে? কে দেবে তাঁর এই প্রশ্নের উত্তর? হঠাৎই মনে পড়লো রিমির কথা। রিমিকে কল করতেই ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বললো,

— এতো রাতে ফোন দিছিস ক্যান তুই? ঘুমা যতো দরকারই থাকুক সকালে বলবি যা বলার। রাখছি।

ফোন কাটতেই রেগে গেলো মুসকান। ‘এতো বড় সাহস আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই ফোন কেটে দিলি। দাঁড়া তোর ঘুম ছুটাচ্ছি বলেই আবারো ফোন করলো। রিমি ঘুমের তালে যতোই কাটে মুসকান ততোই কল করে। রিমি কাটতেই মুসকান হেসে গড়াগড়ি খায় বিছানায় ওভাবে প্রায় ৩০মিনিট জ্বালানোর পর রিমি ফোন অফ করে আবার ঘুমিয়ে যায়৷ মুসকান ও দুষ্টুমি করতে করতে হাঁপিয়ে যায়। এবং একসময় ঘুমিয়েও পড়ে।
.
___________________
কোর্টে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিচে এলো ইমন। ইরাবতী আকরাম চৌধুরী কে খাবার দিয়ে ইমনের জন্য খাবার বাড়ছে আর কথা বলছে। ইমন গিয়ে বসলো তবুও তাঁর বাবা,মায়ের কথা বন্ধ হলো না। বুঝলো তাঁরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে৷ তাই সে আলোচনায় মনোযোগ দিলো আর খেতে শুরু করলো।

—- এতোদিন আফসোস হতো একটা মেয়ে নেই বলে। আজ মনে হচ্ছে আল্লাহ যা করে মঙ্গলের জন্যই করে৷ আল্লাহ না করুক আমাদের সাথে এমনটা ঘটলে সহ্য করতে পারতাম না৷ অন্যের সাথে ঘটেছে তাই বুকের ভিতর কেমন কামড়ে ধরেছে। বললো ইরাবতী।

আকরাম চৌধুরী সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন,

—- তুমি যে কি বলোনা ইরা। সবার সাথেই কি এমন টা ঘটে নাকি? দূর্ভাগ্যবশত ঘটে যায় আর একটু খেয়াল করলে দেখবে এসব দারিদ্র্য পরিবারের মেয়েদের সাথেই বেশী ঘটে। তবে কেসটা যখন আমার হাতে পড়েছে তখন অন্যায়কারীরা তাঁদের শাস্তি পাবেই। আর হ্যা তুমি কিন্তু পারুল কে বলে রাখবা কাজ করলে এ বাড়ি থেকেই যেনো করে রোজ রোজ যাওয়া আসা না করতে। সপ্তাহে একদিন ছুটি পাবে বাড়ির লোকদের সাথে থাকার জন্য। আইনের লোক আমি আমার বাড়ির কাজের লোক থেকে শুরু করে সকলের প্রতি আমার দায়িত্ব আছে। সবাইকে প্রটেক্ট করার দায়িত্বও আমার।

—- হ্যাঁ বলে দিয়েছি তাছাড়া নিউজটা ওকেও পড়িয়েছি আমি। মেয়েটা তো ওর বয়সীই। আহারে চৌদ্দ বছর বয়সেই জীবনটা অন্ধকারে ঠেলে দিলো কিছু মানুষ রূপী জানোয়াররা। এদের প্রত্যেককেরই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করবে ইমনের বাবা বলে দিলাম।

ইমন এতোক্ষণে বুঝলো তাঁর বাবা,মা কি নিয়ে কথা বলছে। দুসপ্তাহ আগেই দিহানদের গ্রামের এক ভ্যানচালকের মেয়েকে ধর্ষণ করেছে কয়েকজন যুবক। খাওয়ার মাঝেই হঠাৎ গলায় খাবার আটকে গেলো ইমনের যখন মনে পড়লো মুসকানও তো ঐ বয়সি৷ তাছারা মুসকানও গ্রামের দিকে থাকে। তাঁরা এক উপজেলার হলেও মুরাদ, দিহান এদের বাড়ি গ্রামের দিকে ইউনিয়নে। আর ইমনের বাড়ি পড়ে পৌরসভার মধ্যে। ইমনের মাথায় আরেকটা কথা নাড়া দিলো মুরাদ এখন অসুস্থ। তাঁর বাড়িতে সে আর বড় চাচা ছাড়া সকলেই মেয়ে। ‘তাহলে তো মুসুকেও সাবধানে রাখতে হবে। তাছাড়া মুসু এখন বড় হয়েছে। আচ্ছা ও যে স্কুলে যায় কোন ছেলে ওকে ডিস্টার্ব করে’? চোখ বন্ধ করলো ইমন ভাবতে লাগলো মুরাদের পুরো বাড়ির বাইরের দিকটা। পুরনো একতলা বাড়ি চারদিকে অর্ধেক দেয়াল করা যে কেউ সেই দেয়াল খুব সহজে টপকাতে পারবে। গেট বেয়েও ভিতরে যেতে পারবে কিন্তু ঘরের ভিতরে যেতে পারবেনা। তারপর ভাবলো মুসকানের রুম কোনদিকে। তখনি মনে পড়লো জানালার কথা। জানালায় অবশ্যই গ্রিল লাগানো আছে? সত্যি আছে তো? আজি গিয়ে দেখতে হবে না থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা করতে হবে’।

—- কিরে হা করে বসে আছিস কেনো খাবিনা? তোর না আজকে কোর্টে যেতে হবে।

চমকে মায়ের দিকে তাকালো ইমন। কিন্তু মন তাঁর ঠিক এখানে নেই মাথা ঝাঁকিয়ে মায়ের কথায় সায় দিয়ে পানি খেয়েই ওঠে পড়লো। বললো,

—- আসছি আমি।

—- আরে বাবা কিছু তো খেলিই না আর অল্প খেয়ে যা বাবা,দাঁড়া বাবা।

মায়ের কথার তোয়াক্কা না করে বেরিয়ে গেলো ইমন।
আকরাম চৌধুরী বললেন,

—- পিছু ডেকোনা তো, ছেলে কাজে বের হচ্ছে। কাজ নিয়েই হয়তো ভীষণ চিন্তিত। তুমি চিন্তা করো না। ছেলে কার দেখতে হবে না আমারই মতোন ভীষণ কাজ পাগল। বলেই হোহো করে হাসতে লাগলেন।

ইরাবতী মুখটা ভাড় করে বললেন,

—- তুমি বুঝবে কি করে মায়ের মন। সন্তান রা ঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া না করলে মায়ের মনে কতো অশান্তি হয় জানো? তবুও আমার একটা মাএ সন্তান সেই যদি ঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া না করে তাহলে এগুলো আর কে খাবে শুনি?
_______________________
—- আপু খুব মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে একটু মাথা টিপে দাও না। রিমির কোলে মাথা রেখে আল্হাদী গলায় বললো মুসকান।

রিমি বিরক্তি নিয়ে ফোন থেকে চোখ সরালো। বললো,

—- ফোন টিপছি আমি আর মাথা ব্যাথা তোর? পারিসও বটে।

—- অতো ক্যাচ ক্যাচ না করে মাথা টিপে দাও নয়তো দাদাভাইকে বলে দিবো তুমি সারাক্ষণ ফোন টিপো।

—- ওওও আচ্ছা এই ব্যাপার তা আমি কি বলবো দাদাভাইকে যে তোমার বন্ধু দ্যা গ্রেট ইমন চৌধুরী কে দেখে তোমার আদরের দুলালি, ন্যাকা ষষ্ঠীর বুকের ভিতর উথাল-পাতাল ঢেউ শুরু হয়েছে। তিনি যাকে অবুঝ শিশু, ভোলাভালা শিশু মনে করে সেই বদের হাড্ডি শিশুরানী সেই ক্লাস ফোর, ফাইভ থেকেই তোমার বন্ধুকে নানাভাই নানাভাই করে মুখে ফেনা তুলে ঠিকি অথচ মনে মনে জামাইভাই জামাইভাই করে। কানমলা দিতে দিতে বললো রিমি৷

মুসকান ন্যাকা কান্না শুরু করলো আর বললো,
—- সব মিথ্যা কথা, সব মিথ্যা কলঙ্ক দাদাভাই জানে ছোটরা মিথ্যা বলে না। মিথ্যা বললে তুমি বলবে আমি না।

রিমি হেসে ফেললো দুহাতে মুসকানের গলা জরিয়ে ধরে বললো,

—- তাহলে সত্যি কলঙ্ক কি বইনা?

মুসকান খিল খিল করে হেসে ওঠলো এই হাসির মানে হলো এ বাড়ির প্রতিটা মানুষই তাঁকে ভীষণ রকমের ভালোবাসে। প্রতিটা মানুষেরই ভীষণ আদরের সে।

—- সত্যি হচ্ছে আমি নানাভাইকে এখন দুচোখে সহ্য করতে পারিনা। ঐ বজ্জাত মহিলার সামনে আমাকে কি পরিমাণ ঝেড়েছিলো মনে আছে তোমার?

—- আহারে সোনা আমার তুমি যে ঐ বয়সে এতো জেলাসী তা কি আর সে জানতো নাকি?

—- ধ্যাত একদম রাগাবানা ছাড়ো তো। মাথা ধরেছে আমার তেল দিবো থাকো তুমি যাচ্ছি আমি। যাও যাও ফোন টিপো প্রেম করো কাউকে বলবো না। স্বাধীনতা দিলাম। বিছানা থেকে নেমে মুখ ভেঙচি দিয়ে রুম ত্যাগ করলো মুসকান। মুসকানের কথা শুনে রিমি হাসতে হাসতে বললো,’পাগলী একটা’।
.
রাত আটটা বাজে। মরিয়ম আক্তারের শরীরটা খারাপ তাই শুয়ে পড়েছেন তিনি। মুসকান তেল নিয়ে রুমে যেয়ে তেল দিয়ে দিতে বললে তিনি বলেন মুরাদের কাছে যেতে। আর খাবার বেড়ে রেখেছেন দু’ভাইবোন যেনো খেয়ে শুয়ে পড়ে। মায়ের কথা শুনে মুসকান তেল নিয়ে চলে গেলো মুরাদের রুমে।

মুসকানের হাতে তেল চিরুনি আর ব্যান্ড দেখে মুচকি হাসলো মুরাদ। ফোন রেখে বললো,

—- কিরে মাথা ব্যাথা করছে নাকি?

—- হুম খুব,,,আম্মুর শরীর ভালো নেই শুয়ে পড়েছে। তাই তোমার কাছে এলাম দিয়ে দাও। ঠোঁট ফুলিয়ে বললো মুসকান।

—- হুম আয় বোস ফ্যানের পাওয়ার কমিয়ে দে বা বন্ধ করে দে নয়তো চুল ওড়বে।

মুসকান ফ্যান অফ করে মুরাদের সামনে বসলো। মুরাদ সবেই বোতলের মুখা খুলতে যাবে তখনি ফোন বেজে ওঠলো। মুরাদ ফোন নিয়ে দেখলো ইমন ফোন দিয়েছে৷ রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ইমন বললো,

—- গেট খোলার ব্যবস্থা কর নয়তো সারারাত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো।

—- আরে শালা কস কি তুমি! তাহলে আজ আর গেট খোলা হলো না রে।

—- ফাইজলামি বাদ দিয়ে খোল আমি অফিস থেকে ডিরেক্ট এসেছি। মাথা কিন্তু খুব গরম আছে।

—- আহারে বেচারা তোর দুঃখে আমার কান্না এসে গেছে।

—- খুলবি কি না???

—- আরে আরে সিরিয়াস হচ্ছিস কেনো খুলছি ওয়েট কর।

ফোন কেটে মুসকান কে বললো চাবি নিয়ে গিয়ে গেট খুলতে ইমন এসেছে। ইমন এসেছে শুনামাএই বুকের ভিতর খুশিতে লাফিয়ে ওঠলো। মানে তাঁর হৃদস্পন্দন লাফাতে শুরু করে দিয়েছে। ইচ্ছে করছে এক ছুটে গিয়ে গেট টা খুলে দিতে। ইশ যদি এক সেকেন্ডের ভিতরে সব করা যেতো কতোই না ভালো হতো। পরোক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো আর শাসালো ‘কুল মুসু কুল। জাষ্ট কন্ট্রোল করে রাখ নিজেকে। এমন ভাব কর যেনো কেউ আসেনি। না মানে কেউ এসেছে কিন্তু তোর কেউ না। নাহ তোর কেউ কিন্তু স্পেশাল কেউ না ওকে ডান এবার চল’।

স্বাভাবিক ভাবে ওঠে দাঁড়ালো মুসকান। ধীরপায়ে চলে গেলো মায়ের রুমে চাবি আনতে। চাবি নিয়ে ধীরপায়ে চললো গেটের দিকে। পা চলছে তাঁর ধীর গতিতে কিন্তু বুকের ভিতর কি যে অসহ্য জিনিস থাকে না? সেটা চলছে প্রচন্ড স্পীডে।

চলবে।

হৃদপিন্ড_২
জান্নাতুল নাঈমা
পার্ট_৪

একজন ধৈর্য্যশীল মানুষ কিভাবে এতোটা ধৈর্য্যহীন হয়ে যেতে পারে বুঝে আসছে না ইমনের৷ এতো ছটফট তাঁর কখনো লাগেনি। মনে হচ্ছে একশত বছরের বেশী সময় ধরে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সে৷ মনটা কেমন আকুপাকু করছে তাঁর। স্কুল, কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মতোনই তাঁর মনটাও বড্ড বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে আজ।

গেট খুলতেই বেশ তারা নিয়ে ভিতরে ঢুকলো ইমন।এভাবে ঢোকায় মুসকান হকচকিয়ে গিয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো। ইমন যখন মুসকান কে দেখলো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো৷ এক মনে থম মেরে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আমতা আমতা করে বললো,
—- কেমন আছিস?
—- ভালো আছি তুমি? মিনমিনিয়ে বললো মুসকান।
—- ভালো তুই কেনো এসেছিস কাকি মা কোথায় একা একা ভয় পেতি যদি?

মুসকানের হাত,পা মৃদু কাঁপছে কোন রকমে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে ইমনের থেকে চোখ সড়িয়ে নিলো।গেটের দরজা লাগিয়ে তালা দিতে যাবে তখনি ইমন একটু ঝুকে তাঁর হাত ধরে ফেললো৷ মুসকান যেনো কারেন্টে শখড খেলো এভাবে কেঁপে ওঠে চমকে তাকালো ইমনের দিকে। চোখে চোখ পড়তেই বুকের ভিতর উথাল-পাতাল শুরু হয়ে গেলো দুজনেরই। তারাতাড়ি চোখ সড়িয়ে নিলো মুসকান। ইমন থতমত খেয়ে গেলো। টের পেলো মুসকান কাঁপছে। সাথে সাথে হাত ছেড়ে দিলো সে। শীতল দৃষ্টি তে চেয়ে নরম গলায় বললো,
—- আমি তালা দিচ্ছি তুই ভিতরে যা।

মুসকান তালা এগিয়ে দিয়ে চাবিটা হাতের মুঠোয় নিয়ে পিছন ঘুরে পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। চোখ বুজে লম্বা এক শ্বাস নিয়ে আল্লাহ, আল্লাহ করতে করতে ভিতরে ঢুকে গেলো। কি হলো কিছু বুঝে আসছে না৷ শুধু বুঝলো ইমনের পাশে কিছু সময় থেকে তাঁর পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছিলো। সেই সাথে কাঁপুনি ধরেছিলো খুব। বুকটাও ধুরুধুরু করছিলো ভীষণ। তাঁর ভিতর বাহির সবটাতেই ধুরুধুরু শুরু হয়ে গেছিলো।
.
মুরাদের রুমে গিয়ে কাঠের চেয়ার টেনে মুরাদের সামনে বসলো ইমন৷ মুরাদ ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো,
—- কোন সমস্যা?
—- কি সমস্যা হবে? মন চাইলো তাই এলাম তোর কোন সমস্যা? শার্টের হাতা ফোল্ড করে চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে বসে বললো ইমন।
—- আরেব্বাস রেগে যাস কেনো? আসছিস ভালো হয়েছে আজ থেকে যা নো প্যারা জাষ্ট চিল দোস্ত। মাছ ভাজি মুরগির মাংস, ভাত আছে খাওয়া হয়ে যাবে তিনজনের।
.
মুসকান রুমে আসতেই ইমন আড় চোখে একবার চেয়ে মুরাদ কে বললো,
—- এক গ্লাস পানি খাওয়া এখন। খুব টায়ার্ড লাগছে।
—- মুসু পানি দে তারপর এসে এখানে বোস। বললো মুরাদ।

মুসকান ইমনের দিকে এক পলক চেয়ে দেখলো সাদা শার্ট ঘেমে ভিজে গেছে একদম৷ বসে কেমন হাসফাস করছে। সারাদিন অফিস করে এই গরমে এখানে কেনো আসতে গেলো তাই বুঝে আসছে না মুসকানের। নিজ বাড়ি গিয়ে গোসল করে খেয়ে দেয়ে রেষ্ট না নিয়ে এখানে আসার মানে সত্যি অযৌক্তিক লাগছে। আবার ভাবলো হয়তো মুরাদের সাথে খুব জরুরি কথা বলতে এসেছে। এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফ্যানের পাওয়ার টা বাড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো।

ফ্যানের দিকে চেয়ে আবার পিছন দিক তাকালো ইমন৷ বুঝলো এটা মুসুর কাজ মনে মনে খুব ভালো লাগা কাজ করলো তাঁর। বিরবির করে বললো,’গুড জব ডিয়ার’।

পানি এনে সামনে ধরতেই ইমন পানিটা খেয়ে গ্লাস দিতে গিয়ে তাকালো মুসকানের দিকে। ঠোঁটের কোনায় তিলটা দেখে যেনো তাঁর হৃদস্পন্দন কিছুক্ষনের জন্য থেমে গেলো। ধীর গলায় বললো,
—- তারাতারি এটা নিয়ে সড় সামনে থেকে।

মুসকান ভ্রু কুঁচকে চেয়ে গ্লাস নিয়ে গটগট করে পা ফেলে টেবিলের ওপর গ্লাস টা বেশ শব্দ করে রেখে মুরাদের সামনে এসে বসলো। মুরাদ বললো,
—- তুই কি বসেই থাকবি? এক কাজ কর বাথরুম গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে সে অবদি আমি মুসুর মাথায় তেলটা দিয়ে নেই তারপর একসাথে খাবো।
—- নাহ তোর সাথে কথা আছে সেগুলো বলে নেই তুই তোর কাজ কর নো প্রবলেম৷ কানটা শুধু আমার দিকে রাখ। মুখে এটা বললেও মনে মনে বললো,
—- বাহ ভাইয়ের ভালোবাসার প্রশংসা না করে পারিনা। তেলও দিয়ে দিতে হয় বোনকে ? ছেলে হয়ে এসব কাজও করিস শালা।

মুরাদ মুসকানের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। চুলে বিলি কেটে কেটে খুব সুন্দর ভাবে তেল দিচ্ছে আর বলছে,
—- মুসু আরাম লাগছে?

মুসকান কেঁপে ওঠলো। কারন ইমন এক ধ্যানে তাঁর দিকে চেয়ে আছে মুরাদ তেল দেওয়ায় মনোযোগ দেওয়ায় খেয়াল করছে না। কিন্তু মুসকান ঠিকি আড় চোখে দেখেছে ইমন পায়ের ওপর পা তুলে বসে হাতে ফোন রেখেছে ঠিকই কিন্তু দৃষ্টি স্থির রেখেছে তাঁর দিকেই। মুরাদ যখন মুসকান বলে ডাকলো আর মুসকান কেঁপে ওঠলো ইমন তখন কেমন করে এক যেনো হাসি দিলো। সে হাসি দেখে মুসকানের অস্বস্তি বেড়ে গেলো দ্বিগুণ। বসে থাকাও মষ্কিল হয়ে যাচ্ছে তাঁর। কোন রকমে হুম বললো সে৷

মুরাদ এবার ইমনকে বললো,
—- ঐ তুই সাইলেন্ট হয়ে আছিস কেনো? বল কি বলবি?

ইমন হালকা কেশে ওঠলো। বিরবির করে বললো,
—- বন্ধুর বোন বোন হয় না রে দোস্ত বন্ধুর বোন হলো হার্টবিট মাপার মেশিন।
—- কি বললি? জোরে বল।

ইমন আবারো কেশে ওঠলো। বললো,
—- বলছিলাম কাকি মার বয়স হয়েছে। একটামাএ ছেলে তুই তাঁর। বিয়ে সাদি করবি না নাকি? এবার তো বিয়েটা করাই উচিত।

মুরাদ তাকালো ইমনের দিকে। ইমন মুসুর থেকে চট করে চোখ সড়িয়ে নিয়ে মুরাদের দিকে চেয়ে বললো,
—- এদিকে কি যা করছিস মনোযোগ দিয়ে কর আর আমি যা বলি তাই শোন। আর মনে মনে বললো,
—- শালা একটু দেখতে আসছি আর তুই ডিস্টার্ব করছিস? বিরবির করে গালিও দিলো কয়টা। প্রিয় বন্ধু হঠাৎই যেনো ভীষণ অপ্রিয় হয়ে গেলো তাঁর। মনে হতে লাগলো তাঁর জীবনে অনেক বড়সড় ঝামেলা পাকাতে পারে এই মানুষ টা৷ ব্যারিষ্টারি চোখ জহুরি চোখ। চোখ দেখেই বুঝে যায় মানুষ টা কোন লেভেলের। তারওপর মুরাদ হলো তার সেই স্কুল জীবনের বেষ্ট ফ্রেন্ড তাঁর পুরো ব্যাক্তিত্ব বইয়ের মতো করে পড়া শেষ ইমনের।

মুরাদ চুরুনী দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললো,
—- আমার মায়ের সমস্যা তোর মায়ের মতো জটিল না। তাঁর ছেলে,মেয়ে ভাতিজি,ভাসুর, জা সব আছে। তোর মায়ের টা আগে ভাব। সে তো একবারেই এতিম।
—- সেটাই তো বলছি তোর জন্য একটা ভালো পাএী যোগার করেই না আমার কথা ভাবতে পারবো। বেষ্ট ফ্রেন্ড কে রেখে বিয়ে করাটা কেমন দেখায় না?

ইমনের কথা শেষ হতে না হতেই মুসকান তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে বললো,
—- হ্যাঁ বিয়ে করো বিয়ে তো করতেই হবে৷ যা বয়স আর কদিন পর তো চুলে পাকন ধরবে মানুষ মেয়ে দেবে কিনা সন্দেহ এখুনি করে নাও। আমার ভাইয়ের টা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। তাছাড়া তোমার গার্লফ্রেন্ড রা বিয়ে করে বাচ্চা মানুষ করছে সে হিসেবে তুমি এখন এক বাচ্চার বাপই।

মুসকানের কথা শুনে মুরাদ কেশে ওঠলো। ফিসফিস করে বললো,
—- বোন মাফ যা, বোন চুপ যা৷

ইমন দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
—- ঐ কি বললি তুই? এই মুরাদ তোর বোন কি পাল্টাই নিছোস কোথাও থেকে? নাকে টিপি দিলে দুধ বের হবে সেই মেয়ে তড়তড় করে কথা বলে সাহস কতো? বয়স নিয়ে প্রশ্ন তুলে। হাটুর বয়সী মেয়েরা এখনো আমাকে প্রেমপএ পাঠায় তা কি তোরা জানিস না?
—- নাকে টিপি দিলে দুধ বের হয় বলেই তো আমি তোমাকে বুড়ো বলতে সাহস পাচ্ছি নানাভাই। আর যে মেয়েরা তোমায় প্রেমপএ পাঠায় ওদের চোখে রোগ আছে ঠিকঠাক চয়েজ করতে পারেনা।

মুরাদ হাসতে হাসতে শেষ। ইমন শাসানো গলায় বললো,
—- মুসু তুই কিন্তু বেশী বলছিস। আমার সম্পর্কে তোর ধারনা ভুল। তুই কিন্তু নিজেই শাক্ষী আমার নামে মাসে ঠিক কয়টা প্রেম পএ আসে।

মুসকানের রাগ যেনো দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা পড়ায় চেঁচিয়ে বললো,
—- দাদাভাই ছাড়ো আমাকে এক সেকেন্ডও এখানে বসবো না আমি।
—- আরে রেগে যাচ্ছিস কেনো এই তো শেষ বেনুনীটা করে দেই শান্ত হো মুসু মজা করছে। এমন রাগিস না শরীরে ক্ষতি হয়ে যাবে৷ এতো রাগতে নেই।

ইমন তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। তাঁর যে কি মন চাচ্ছে না নিজে বুঝছে না বোঝাতে পারছে তাই বললো,
—- দেখ মুরাদ কাল থেকেই তোর জন্য পাএী দেখা শুরু করবো।
—- তোর কি মাথায় ভূত চাপলো? নাকি কোন পাগল, ছাগলের কেস ছিলো আজ কোনটা বলতো।

ইমন ওঠে দাঁড়ালো জিগ্যেস করলো,
—- কি রান্না হয়েছে আজ? কাকি মা কোথায়?
—- এমন ছটফট করছিস কেনো? বোস এখানে মুসু খেতে দেবে আম্মার শরীর খারাপ ঘুমাই গেছে।

বেনুনী বেঁধে মুরাদ বললো,
—- মুসু যা আমার খাবার টা এখানেই দিয়ে যা। আর ইমনকে খেতে দে। হুদাই বিষয় নিয়ে রাগ দেখাস না তো৷ খেয়ে দেয়ে ঘুমা গিয়ে কাল ক্লাস আছে তো।

মুসকান কিছু বললো না চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মুরাদ ইমনকে বললো বাথরুম থেকে হাত,পা ধুয়ে আসতে৷ তাদের পুরো বাড়িতে দুটা বাথরুম একটা তারা ইউস করে আরেকটা তাঁর বড় কাকারা করে। ইমন বললো,
—- বিয়ে তো তোকে এবার করতেই হবে। বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। পাশেই বাথরুম সেখানে গিয়ে হাত,পা ধুয়ে মুরাদের রুমে না গিয়ে মুসকানের রুমে গিয়ে তয়ালে খুঁজে বের করে হাত,পা, মুখ মুছে নিলো। তারপর বেরিয়ে এসে দেখলো মুসকান খাবার বেড়ে টেবিলে রেখে আরেক প্লেটে খাবার বাড়ছে।

ইমন গিয়ে পাশে দাঁড়ালো পকেটে এক হাত দিয়ে আরেকহাতে টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করলো।
মুসকান চমকে ওঠলো ইমনকে দেখে এক ঢোক গিললো। আমতা আমতা করে বললো,
—- খেতে বসো।

ইমন মুসকানের দিকে চেয়েই চেয়ার টেনে বসলো। বললো,
—- না জানি এই বুড়ো লোকটার দায়িত্ব সারাজীবনের জন্য কাউকে নিতে হয়। বলেই চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখতে লাগলো। মুসকান কথার মানেটা বুঝলো না তবুও যেনো কেমন লাগলো তাঁর।

প্লেটে খাবার নিয়ে মুরাদকে দিয়ে আরেক বাটিতে মাছ ভাজি, আর মুরগির মাংসের তরকারি দিয়ে এলো। এসে দেখলো ইমন বসেই আছে। তাঁর মধ্যে কেমন ছটফট ছটফট ভাব। মুসকানের নিজেরও ভীষণ অস্বস্তি লাগছে তবুও গিয়ে বসলো। বললো,

—- খাচ্ছো না কেনো?

ইমন চোখ মেলে তাকালো মুসকান চোখ সরিয়ে নিজের প্লেট সামনে নিয়ে তরকারি বেড়ে নিলো। তা দেখে ইমনও খেতে শুরু করলো। আর প্রশ্ন করলো,
—- মাছ নেই আর?
—- আছে।
—- তাহলে শুধু তরকারি দিয়ে খাবি কেনো? সত্যি করে বল তোর টা দিয়ে দিছিস?
—- না আমি মাছ খাইনা।
—- কেনো খাস না? ইমন জানে মুসকান কাটা দেখে খুব ভয় পায়৷ একবার গলায় কাটা ফুটে গেছিলো। তখন থেকেই মাছে তাঁর ভীষণ ভয়। কেউ বেছে না দিলে খেতেই পারেনা তবুও প্রশ্ন করলো।
—- জানিনা৷
—- বল?
—- ধ্যাত এতো প্রশ্ন করো কেনো? বলেই রেগে তাকাতেই ইমনের চাহনী দেখে চুপসে গেলো। কেমন জড়োসড়ো হয়ে বসে ভাত মাখতে শুরু করলো। ইমন বাঁকা হেসে বললো,
—- বেশ রাগতে পারিস এখন। শুনেছি খুব নাকি জেদীও হয়ে গেছিস?

মুসকান কিছু বললো না ওঠে দাঁড়িয়ে প্লেট হাতে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো বাম হাতে রিমুট নিয়ে টিভি অন করলো। ইমনও প্লেট নিয়ে গিয়ে মুসকানের পাশে বসলো এক হাতের ওপর প্লেট রেখে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। গা ঘেঁষে বসায় মুসকান খানিকটা সড়ে গিয়ে ওঠতে নিবে তখনি ইমন কঠোর গলায় বললো,
—- বেশী তিড়িং বিরিং করছিস তুই। খুব বেশী বড় মনে করছিস নিজেকে ব্যাপার না। এইসব ভাবের ধার আমি ধারিনা৷ চুপচাপ বসে খাবি আর যদি কথা না শুনিস আজ রাতে এখানেই আছি দেখিস কি করি।

মুসকান আগুন চোখে তাকালো ইমনের দিকে।

—- ওভাবে তাকাস কেনো? চোখ দিয়েই মেরে ফেলবি নাকি?

চোখ ফিরিয়ে নিলো মুসকান। পাশে থাকতে ভালোই লাগছে কিন্তু বুঝতে দিলো না। খুব, লজ্জা আর অস্বস্তি কাজ করছে তাঁর। হাত,পায়ে কেমন কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বুকের ভিতর ডিপডিপ শব্দ টা যেনো ইমনও শুনে যাবে।

টিভিতে চোখ রেখে ভাত অল্প মুখে দিয়ে বসে আছে। কিন্তু গলা দিয়ে খাবার নামছে না৷ ইমন মাছ বেছে বেছে মুসকানের প্লেটে দিচ্ছে আর নিজে খাচ্ছে। মুসকান সেদিকে খেয়াল না করে অল্প অল্প করে খেয়ে যাচ্ছে। যখন খেয়াল হলো চমকে তাকালো ইমনের দিকে। ইমনও তাকালো চোখে চোখ পড়তেই মুসকান চোখ সড়িয়ে নিলো। ইমন বললো,
—- তুই যখন ছোট ছিলি তখনও তো এভাবেই মাছ বেছে দিতাম ভুলে গেছিস? মুরাদের থেকে তো আমার কাছেই বেশী থাকতি। একসাথে খাওয়া,একসাথে গোসল করা সেসব আজ ভুলে বড়লোক হয়ে গেছিস না? বাড় লোকের বোন৷

ইমনের কথা শুনে লজ্জা পেয়ে গেলো মুসকান। তাঁর সে লজ্জা পাওয়া দেখে ইমন ওঠে দাঁড়ালো। ধমকে বললো,
—- ফাইজলামি কম করে করবি৷ এতো লজ্জা পেতে কে বলেছে তোকে? আমি বলছি? ফাজিল কোথাকার খাওয়াটাই নষ্ট করে দিলি। বলেই খুব রাগ নিয়ে টেবিলে প্লেট রেখে হাত ধূয়ে ফেললো।

মুসকানের চোখ দুটো টলমল করছে। ছোট থেকেই সে একটু ধমকও সহ্য করতে পারেনা। ইমন ভালো করেই জানে তবুও ধমকায়৷ ভালো লাগে না তাঁর। চোখের পানি টপটপ করে প্লেটে পড়তে লাগলো।

ইমন হাত ধুয়ে মুরাদের রুমে যেতে নিয়েও থেমে গেলো৷ নাক টানার শব্দ শুনে। ভ্রু কুঁচকে বাম দিকে তাকাতেই দেখলো মুসকানের চোখের জলে নাকের জলে একাকার অবস্থা। ট্রি টেবিলের ওপর ভাতের থালা রেখে মহারানী কান্নায় ব্যাস্ত।

—- হয়ে গেলো। আল্লাহ এই একটুতে এভাবে কাঁদার কি হলো? মুরাদ জানলে নিশ্চিত বাঁশ দেবে। দ্রুত পায়ে মুসকানের কাছে গিয়ে পাশে বসলো। চোখে পানি,কান্নার মৃদু শব্দ বুকের ভিতর কেমন তীরের মতো বিধলো তাঁর। কথা বলতে যেয়ে বুঝলো গলা কাঁপছে। কি অদ্ভুত কাঁদছে মুসকান আর বুকে ব্যাথা হচ্ছে তাঁর। ধরা গলায় বললো,
—- মুসু ছোটবেলায় শুধু তুই কাঁদতি আর আমরা কান্না থামাতাম৷ আর বড় বেলা তুই কাঁদিস আর সাথে অন্যজনকেও কাঁদাস কেনো মুসু?

মুসকান চুপ হয়ে গেলো কান্নামিশ্রিত চোখে তাকালো ইমনের দিকে। ইমন অসহায় চোখ, মুখে চেয়ে বললো,
—- প্লিজ কাঁদিস না। এখানটায় কেমন ব্যাথা লাগে৷ (বুকের বাম পাশে দেখিয়ে)

মুসকান হা হয়ে গেলো ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো ইমনের অসহায় মুখের দিকে। এটা কি শুনছে সে তাঁর সামনে তাঁর নানাভাই রয়েছে নাকি অন্য কেউ। ভাবনায় ছেদ পড়লো যখন ইমন তাঁর হাতের আলতো পরশ দিলো। পরম যত্নে চোখের পানি মুছে দিচ্ছে ইমন৷ মুসকান যেনো একদম স্থির হয়ে গেছে। পুরো শরীর তাঁর আবারো অবশ হয়ে আসছে। এদিকে ইমনের হাতও কাঁপছে খুব তবুও চোখের পানি মুছে দিয়ে মৃদুুস্বরে বললো,’সরি মুসু’ তারপর মুসকানের বাম হাত উপরে ওঠিয়ে হাতের পিঠে আলতো করে ঠোঁট ছুয়িয়ে দিলো আর বললো,’সেদিনের জন্যও আমি খুব সরি মুসু আমার ভবিষ্যৎ যদি আমি জানতাম তাহলে ঐদিন ঐ ভুলটা আমি করতাম না’।

অসম্ভব পরিমাণে কাঁপতে শুরু করেছে মুসকান। মাথাটাও কেমন ঘুরছে তাঁর। যেখানে ইমন এতো স্ট্রং পার্সোনালিটির একজন মানুষ, প্রাপ্ত বয়স্ক একজন পুরুষ হয়ে বাচ্চা মেয়েটার কাছাকাছি এলেই নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে সেখানে মুসকানের এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। মুসকানের অমন অবস্থা দেখে ইমন দ্রুত সরে গেলো। চোখে মুখে ভীষণ অস্থিরতা তাঁর নিঃশ্বাস হয়ে গেলো খুব এলোমেলো। তবুও মুসকান কে শান্ত করার জন্য নরম কন্ঠে বললো,

—- এতো ভয় পাচ্ছিস কেনো? দেখ সরে গেছি শান্ত হো প্লিজ। কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বললো,
— এই দেখ চলে যাচ্ছি আরে দেখ তাকা চলে যাচ্ছিতো বাবা। ধ্যাত দেখ চলেই গেলাম আমি। বলতে বলতেই দ্রুত মুরাদের রুমে ঢুকে গেলো।

এমন ভয়ংকর অনুভূতির মাঝেও হেসে ফেললো মুসকান। সে ভাবতেও পারছে না এতোক্ষণ তাঁর সামনে ইমন ছিলো। আগের সেই মানুষ টার সাথে যেনো রাত দিন তফাৎ।

দুজনই দুজনকে নতুনভাবে চিনছে,দেখছে আর নতুন ভাবে বুঝছে। তাঁদের এই বুঝাবুঝির শেষ টা কোথায় আছে জানা নেই কারো। কিছু সময়, কিছু মূহুর্ত কিছু অনুভূতি যেনো হঠাৎ করেই এসে যায়। কিন্তু এই সময়,মূহুর্ত আর অনুভূতি ক্ষনস্থায়ী না দীর্ঘস্থায়ী তা নির্ভর করে সম্পূর্ণ ভাগ্যের ওপর।

চলবে।
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন৷ ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here