হাইওয়ে-১,২,৩,৪

হাইওয়ে-১,২,৩,৪
শানজানা আলম
পর্ব:১

সকাল সকাল পরোটা ছিড়ে মুখে দিতেই মেজাজটা বিগড়ে গেল আকাশের। হারুণের দোকানের পরোটা একসময় ভালো ছিল, এখন রাবার হয়ে গেছে। দাঁতের সাথে লেগে আছে, সবজির অবস্থা আরো বিশ্রী। মিষ্টি কুমড়োর সাথে চিচিংগা দিয়েছে। ডাল গুলো মনে হচ্ছে হলুদ দিয়ে সিদ্ধ করা। বিরক্তির চুড়ান্ত।

মা নানাবাড়িতে গিয়েছেন দেখে এই দুর্দশা প্রায় প্রায়ই সহ্য করতে হচ্ছে৷ আব্বা মারা যাওয়ার পরে মা একা বেশিদিন থাকতে পারেন না৷ আকাশের বড় ছোটো দুই বোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে ৷ মা ছেলের সংসার হলেও বেশিরভাগ সময় বেচারার একাই থাকতে হয়৷
আম্মা হয়তো এবার শাম্মির বিষয়ে কথা বলতেই গেছেন৷ শাম্মি মায়ের চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে, আম্মার ইচ্ছা আকাশের বউ করে নিয়ে আসবেন৷ আকাশের নিজের পছন্দ নেই বলে অমত নেই এখানে।

পরোটা ইস্যু থেকে শাম্মির কথা চলে এলো, বিয়ে হয়ে গেলে অন্তত এই রাবারের রুটি খাওয়ার হাত থেকে বাঁচা যাবে। বিয়ের জন্য বিয়ে না, এই ভয়ংকর নাস্তার হাত থেকে বাঁচতে বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে এখনি।

আকাশ নিজে রান্নাটা পারে কিন্তু নিজের দোকান ব্যবসা সব নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে, বিশেষ করে রেন্ট এ কারের গাড়ি তিনটা ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়৷ প্রায় দিনই গুছিয়ে বাসায় ফিরতে একটা দেড়টা বাজে।
এত রাতে নিজের আর ইচ্ছে করে না কিছু করতে। বুলুর মা দুপুরে রান্না করে দিয়ে চলে যায়, সকালে আর ডাকে না আকাশ৷ সকালের নাস্তাটা রেস্টুরেন্ট থেকেই আসে, তবে এখন ভাবতে হবে।

কলিংবেল বাজ ঘন ঘন কয়েকবার। আকাশ আবারও বিরক্ত হলো৷ ও কি উড়তে উড়তে যাবে নাকি দরজা খুলতে!
আসছি, বলে দরজা খুলে দিলো আকাশ।
আকাশ ভাই, খুব বিপদে পড়েছি, তুমি ছাড়া কোনো উপায় নাই, প্লিজ একটু হেল্প করো। করতেই হবে- গালিব একটানা বলে গেল।

কী হয়েছে রে? হাপাচ্ছিস কেন?

আগে বলো হেল্প করবে?

সমস্যা না শুনে কীভাবে বলব?

আচ্ছা বলছি, অনেক বড় মুখ করে আসছি কিন্তু।
আগে বল তো! শুনি!

তন্বী আপুকে ঢাকায় পৌছে দিতে হবে। মানে একটা গাড়ি, দিতেই হবে ব্যবস্থা করে।

কে তন্বী আপু?আর কবে?

সেটাই তো সমস্যা, বৃহস্পতিবারে যেতে হবে। শুক্রবার দিনটা বাদে শনিবারে আপুর একটা ভাইভার ডেট পড়েছে, প্রাইভেট ব্যাংকে। অল্প কয়েকজনকে ডাকছে, চাকরি হতে পারে।

আচ্ছা, তন্বী আপুটা কে?

তন্বী আপু হচ্ছে আমার বড় আন্টির মেয়ে। অনেক আগে আমাদের বাড়িতে আসত, দেখেছ তখন। এই সপ্তাহ খানেক আগে বেড়াতে এসেছে, এখনি এই ডেট পড়তে হলো।

আকাশ ফোন বের করে শিডিউল দেখে বলল, ওই দিন তো বাস মালিক সমিতি ধর্মঘট ডেকেছে। এখান থেকে মাওয়া অবধি সব বাস চলাচল বন্ধ থাকবে। আর গাড়ি যে দুটো ঢাকায় যায়, বাগেরহাটে এক বিয়েতে ভাড়া হয়ে গেছে বৃহস্পতিবার হলুদ, শুক্রবার বিয়ে।
বাকি আছে আমার প্রাইভেট, সেটা তো লক্কর ঝক্কর, খুলনা নিয়ে যেতেই ভয় লাগে, সেটা নিয়ে ঢাকায় যাওয়া অসম্ভব মোটামুটি।

আমি এত কিছু জানিনা ভাই, ম্যানেজ করো! আমি বড় মুখ করে বলে এসেছি, আকাশ ভাই আছে কোনো চিন্তা নেই। তুমি আমার মুশকিল আসান ভাইজান, কিছু একটা করো।

আচ্ছা, একা যাবে?

হু, আর কে যাবে!

ড্রাইভারও তো নাই, গাড়ির সাথে তারাও বুকড। কি করব, অন্য উপায় দেখ! আমার হাত পা বাঁধা। এডভান্স নিয়ে টেলিকমের মাল উঠিয়ে ফেলছি৷ আর বিয়ের প্রোগ্রাম থেকে গাড়ি কিভাবে আনব!

আকাশ ভাই প্লিজ, চাকরিটা খুব ভালো। একবার হলে, ভালো স্যালারি, ওর জীবনটা সেট হয়ে যাবে।

আকাশ হেসে বলল, কোনো উপায় নাই রে, আমি গাড়িটা আছে, এটা নিয়ে বের হতে হবে আমাকেই। অন্য কারো হাতে দেওয়া যাবে না। গাড়ির কন্ডিশন দেখে পছন্দ হবে না যাত্রীর। এসি নাই, তার উপর জায়গায় জায়গায় থেমে বসে থাকলে তো আরো বিপদ। একটা মেয়েকে নিয়ে এভাবে বের হওয়া কোনো কাজের কথা না।

আমি কিছু জানি না ভাইজান, তুমি কীভাবে কী করবা একটু ভেবে দেখো।

আচ্ছা দেখি।

ভাড়া কেমন পড়বে?

ঢাকা পর্যন্ত অন্য গুলো পনের নিই, এটা যে কন্ডিশন, ভালো ভাবে পৌছালে সাড়ে এগার দিলেই চলবে।

আচ্ছা কোনো সমস্যা নাই, এই নাও, পকেট থেকে বের করে দশ হাজার টাকার বান্ডেলটা দিলো গালিব।

কি রে, টাকা পকেটে নিয়ে আসছিস!

ভাইজান, গুরুত্ব বুঝতে পারতেছ না। তন্বী আপাও একটু অস্থির, আব্বাই বললেন তোমাকে এডভান্স করে দিতে। আমি তাহলে সিওরিটি দিয়ে দিলাম, টেনশন করতেছে সকলে!!

আকাশ একটা সিগারেট ধরালো। এডভান্স করে দিয়েছে, খ্যাপটা খারাপ না, গাড়িটাও ঢাকায় নিয়ে সার্ভিসিং করানো দরকার এমনিতে। এই সুযোগে টাকাটা কাজে লেগে যাবে। এই গাড়ি এমনিতে ভাড়া হবে না ঢাকা পর্যন্ত।।

আকাশ নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জা পেল৷ ব্যবসা করতে করতে আজকাল খালি লাভ লসের চিন্তা মাথায় ঘোরে। মেয়েটারও জরুরি কাজ বোঝাই যাচ্ছে। দেখা যাক, কী আছে কপালে!

গালিবের তন্বী আপা অস্বস্তি বোধ না করলেই হয়। এত দূর একটা মেয়ের সাথে জীবনেও যাওয়া হয়নি, তাও এইরকম রিস্ক নিয়ে। কেমন অবস্থা হয়, কে জানে!

চলবে

শানজানা আলম

হাইওয়ে-২

খুব সকালে উঠে পড়েছে আকাশ। প্রথম লোকাল ফেরীটা ধরতে হবে। তাহলে আশা করা যায় ধীরে সুস্থে গেলেও বারোটা একটার দিকে মাওয়া পৌছে যাওয়া যাবে৷ গালিবদের বাড়ির সামনে থেকে তন্বীকে পিক করতে হবে। তাই সেদিকে রওনা হয়ে গেল আকাশ।

বিদায় পর্ব বেশি দীর্ঘ হলো না। গালিবের আব্বা বললেন, আকাশের সাথে যাচ্ছ, মানে আমি নিশ্চিন্ত, ও দায়িত্ববান ছেলে। তোমাকে ঠিক মতো পৌছে দেবে।

তন্বী আঁড়চোখে আকাশকে দেখল। একটা নীল রঙচটা জিন্সের সাথে চেক শার্ট পরেছে। নীল ক্যাপ নিচু করে পরায় চোখ ঢাকা, ড্রাইভার মনে হচ্ছে না। অবশ্য গালিব তো বলল, এই গাড়ির মালিক।আগে দেখেছে হয়তো কিন্তু আলাপ হয়নি। এত দূরের পথ আলাপ করে নিলে ভালো হতো। এত দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব না।

আকাশ ডিকিতে তন্বীর লাগেজ তুলে দিলো। হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ আছে, সাথে মাঝারি সাইজের ভ্যানিটি ব্যাগ। সে দুটো সাথে নিয়ে পেছনের সিটে বসল, ড্রাইভারের সিটের সাথে আড়াআড়ি পজিশনে। আর কথা না বাড়িয়ে আকাশ একটানে ফেরীতে গিয়ে উঠল। জোয়ার আছে, ফেরীর চারপাশ কচুরিপানা ভাসছে। একটা সিগারেট খাওয়া যায় এখানে। আকাশ তন্বীকে বলল, আপনি গাড়িতেই বসবেন? আমি একটু আসছি?

-না, আমিও একটু বের হই। সকাল সকাল, ওয়েদার চমৎকার।
তন্বী উত্তর দিলো।

-হ্যা, সিওর। সেটাই ভালো, আসুন।

দরজা খুলে তন্বীকে বের করে নিলো আকাশ। তন্বী ভেবেছিল আকাশের সাথেই দাঁড়াবে কিন্তু আকাশ একটু তফাতে গিয়ে সিগারেট ধরালো। সকাল বেলায়ই সিগারেট, চেইন স্মোকার মনে হয়!! তবে তন্বীকে একা রেখে আলাদা দাঁড়ানোর বিষয়টা ঠিক ভালো লাগল না তন্বীর। আর মুখটা পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে বা। মানুষের মুখ দেখা খুব জরুরি, প্রথম ইম্প্রেশন তৈরি হয় মুখ দেখে।

জোয়ারে পানি খুব কাছে, ফেরী চলতে শুরু করেছে, কয়েকটা লোকাল ইজি বাইক ছাড়া তেমন কিছু ফেরীতে ওঠেনি। একটা লোক কিছু মাছ নিয়ে বসেছে এক কোণে। দুটো মটর সাইকেল আছে।ফেরীর দোকানটা এখনো খোলেনি। চিপস বা কোল্ড ড্রিংকস কিনে নিলে ভালো হতো। সকাল বলে কোনো ফেরীওয়ালাও নেই, নারকেল চিড়া মাখা, চানাচুর ভাজা বা মুড়ি মাখা কিছুই ওঠেনি এখনো। ছোটো আন্টি মানে গালিবের মা পরোটা, টিকিয়া কাবাব, ডিম সেদ্ধ, দানাদার মিষ্টি দিয়েছেন নাস্তা করার জন্য। পানিও আছে৷ আন্টি দুজনের জন্যই দিয়েছেন, তন্বীর এসব কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। পথে কোনো রেস্টুরেন্টে নাস্তা করে নিলেই হবে।

আকাশ সিগারেট শেষ করে পাশে এলো না। ফেরীর রেলিংয়ে দু হাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তন্বী একবার তাকিয়ে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। সকাল বলে নদীর জল টলটলে, তার ইচ্ছে করছে কাকচক্ষু জলে পা ভিজিয়ে বসতে। জিন্স পরা হলে সহজেই গুটিয়ে নিয়ে বসে পড়ত কিন্তু সুতি সালোয়ার কামিজ ভেজা হলে সমস্যা। পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়সটা একটু অদ্ভুত৷ মনে ছেলেমানুষি চলে এলেও সহজে করা যায় না কিছুই, যুক্তি তর্ক এসে ভীড় করে।

এত রিস্ক নিয়ে নেমে পড়েছে তন্বী, চাকরিটা জরুরি খুব। বাসা থেকে অদ্ভুত সব বিয়ের প্রস্তাব আসছে, চাকরি হয়ে গেলে নিজের মত থাকা যাবে। বাসা থেকে টাকা নিয়ে আসলে নিজের মতামত জাহির করা যায় না। মাস্টার্স শেষ করার পরে পরিচিত সম্পর্ক গুলোই কেমন অচেনা আচরন শুরু করে।

আকাশ বলে ছেলেটির অনেক প্রশংসা করেছে খালু আর গালিব। অনেক কম বয়সে বাবার ব্যবসার হাল ধরেছে, পাশাপাশি দুই তিন এলাকার মধ্যে রেন্ট এ কারের সবচেয়ে ভালো সার্ভিস আকাশ রেন্ট এ কারের। মোবাইল এক্সেসারিজ নিয়ে আছে আকাশ টেলিকম। বাবার ঠিকাদারি ব্যবসাও দেখছে। অদ্ভুত একটা কনফিডেন্স দেখা যাচ্ছে ছেলেটার মধ্যে, কত বয়স হবে, তন্বীর আসেপাশেই হওয়ার কথা, ছোটো বোধহয় হবে না, খুব বড়ও নয়। এই বয়সের ছেলেরা দিনরাত এক করে চাকরির পড়া পড়ছে, এই ছেলেটা নিজে ব্যবসা করে অলরেডি দাঁড়িয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তন্বীর মনে হয়, মাস্টার্স পর্যন্ত পড়া শেষ করার জন্য অপেক্ষা করা তার বোকামী হয়েছ। আগে থেকেই ক্যারিয়ারের বিষয়ে ভেবে নেওয়া উচিৎ ছিল।

ফেরী ঘাটে চলে এসেছে। তন্বী নিচু হয়ে দুটো টগর ফুল ছিড়ে নিলো। আকাশ দেখল মেয়েটা ফুল ছিড়তে নিচু হয়েছে, এক মুহুর্তে মনে হলো, যদি পড়ে যায়!!

কিন্তু পড়ল না, ফুল নিয়ে গাড়ির সামনে চলে এলো। আকাশ এসে লক খুলে দিলো।

তন্বী বলল, আমি সামনেই বসি বরং!

প্রশ্ন নয়, সিদ্ধান্ত জানানো হলো। আকাশ ঘুরে এসে নিজের পাশের দরজাটা খুলে দিলো।
তন্বী ঢুকে বসে পড়ল।

ফেরী থেকে উঠে গাড়ি চলতে শুরু করল হাইওয়েতে।

(চলবে না)

শানজানা আলম
হাইওয়ে-৩

ঢাকা মাওয়া সড়ক শুরু হয়ে নওয়াপাড়া থেকে। তার আগে সাইনবোর্ড বাজার যেটা একটা চৌরাস্তার মোড়। একদিক দিয়ে মোড়েলগঞ্জ, যেখান থেকে আকাশ আর তন্বী আসছে। মোড়েলগঞ্জের উল্টোদিকে কচুয়া। একটা রাস্তা পিরোজপুরের দিকে গিয়েছে৷ আরেকটা বাগেরহাট হয়ে খুলনা। মোটামুটি পঁচিশ কিলো পরে সাইনবোর্ড বাজার পড়বে।

আকাশ চুপচাপ ড্রাইভ করছিল। তন্বী গলা খাকারি দিয়ে বলল, উহুহুম!

আকাশ তাকিয়ে বলল, কিছু বলবেন?

-বলছিলাম, ব্রেকফাস্ট কোথায় করতে চান?

-সাইনবোর্ড গিয়ে নিয়ে নিই? আপনার খিদে পেয়েছে?

-নাহ, খালামণি আমাকে খাবার দিয়ে দিয়েছেন।

-তাহলে আপনি খেয়ে নিন।

ভারী অদ্ভুত লোক তো, দুজন মোটে মানুষ, তাও একা একা খেতে বলছে।

তন্বী আর কথা বলল না কিছুক্ষণ। একটু পরে আবার জিজ্ঞেস করল, সাইনবোর্ডে কী কী নাস্তা পাওয়া যাবে?

আকাশ বলল, বাসস্ট্যান্ড তো, সবই পাওয়া যাবে, ভাত ডাল আলুভর্তা, পরোটা ভাজি, খিচুড়ি ডিম, যা খেতে চান!

মিষ্টি পাওয়া যাবে না? পরোটা মিষ্টি?

যাবে না কেন! ওখানে একটা দোকান আছে, সেখানকার মিষ্টি পরোটা মোটামুটি ফেমাস!

ইয়েস, আমি ওটার কথাই বলেছি! অনেক আগে বাবার সাথে খেয়েছিলাম। এখন তো আর আসা হয় না।

আচ্ছা, আজ তাহলে ওখান থেকেই পরোটা, মিষ্টি আর নিমকি নিয়ে নিব।

আচ্ছা। ওখানে বসে খাওয়া যাবে না?

যাবে কিন্তু ওখানে আসলে বাসের ড্রাইভার হেল্পারদের ভীড় থাকে, আপনার খুব একটা স্বস্তি হবে না।

আচ্ছা। তাহলে নিয়ে নিলেই হবে।

হ্যা। সেটাই করব। আচ্ছা আমার এই গাড়িটা কিন্তু বেশ ট্রাবল দেয়, দুয়েকবার থেমে গেলে নার্ভাস হয়ে যাবেন না যেন!

তন্বী হেসে বলল, আমাকে এত নরম মনে হলো আপনার?

না, তা মনে হয়নি!

আপনাকে আগে দেখেছি?

সেটা তো ঠিক বলতে পারব না! আমার মনে নেই আপনাকে কখনো দেখেছি কিনা!

আপনি ফুটবল খেলতেন?

হ্যা! আপনি জানলেন কিভাবে? গালিব বলেছে?

নাহ, একটা ম্যাচের সময় আমি ছিলাম এখানে, তখন আপনার নাম শুনেছি।

সেও তো অনেক আগের কথা!

হুম, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির আগে, তারপরে প্রায় ছয় সাত বছরেরও বেশি আসা হয়নি।

এখানে বেড়াতে এসেছিলেন?

একটু রিলাক্স হতে এসেছিলাম! ঢাকায় ভালো লাগছিল না। তা রিলাপআর হতে পারলাম কই, যেদিন আসলাম, ওইদিনই ডাকল, আর বাস ধর্মঘটও শুরু হলো।

হুম। যাক, আপনার চাকরি হয়ে গেলে একবার এসে বেড়িয়ে যাবেন নিরিবিলি।

হ্যা, সেটাই ভাবছি।

একটানা বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। তন্বীর একটু হালকা লাগছে। ভারিক্কি পরিবেশটা পালটেছে। তবে পালটাতেই হতো। এত দূরের পথে সহযাত্রী, একটু আলাপ না জমালে ভোতা হয়ে বসে থাকা যায় না৷

আকাশেরও একই অনুভূতি। মেয়েটা সহজ প্রকৃতির। একদম স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। কোনো ভণিতা নেই। মুখখানা তাকিয়ে দেখা হয়নি, সরাসরি অল্প পরিচিত কোনো মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে কেমন অস্বস্তি হয়। গাড়ির মিররে আঁড়চোখে তাকিয়ে আকাশ দেখে নিলো তন্বীকে। খুব আহামরি সুন্দর নয়, সাজগোজের বহরও নেই, চুলগুলো চূড়া করে পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আটকানো। বেগুনি গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজ পরা, হুট করে চোখে পড়বে না কিন্তু স্নিগ্ধ!

পুরুষালী চোখে তাকিয়ে আকাশ নিজেই লজ্জা পেলো। কি দরকার একে দেখার! মনের কথা গুলো শুনতে পাওয়া যায় না, বা চোখের দৃষ্টির ভাষা অপাঠ্য বলে মানুষ অনেক অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে বেঁচে যায়। এই মুহুর্তে এই মেয়েটা যদি বুঝত, আকাশ তাকে খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছে, কী না কী ভেবে বসত!

সাইনবোর্ড চলে এসেছে। আকাশ সাইড করে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ল

চলবে
শানজানা আলম

হাইওয়ে-৪

আকাশ বলল, আপনি বসুন, আমি নিয়ে আসছি৷ ঘাড় নেড়ে সায় দিলো তন্বী। সকাল আটটা বাজে। আকাশ একটু পরেই ফিরে এসে বলল, দোকানটা ফাঁকা আছে, আপনি বসে খেতে চান?
তন্বী নেমে পড়ল।
দুটো করে পরোটা, একটা কালোজাম আর দানাদার মিষ্টি অর্ডার করে ওরা বসে পড়ল। ছোটো ছোটো কাঠের বেঞ্চ দেওয়া, রেস্তোরার মেঝেটা কাঠের। এক কোণ থেকে একটা পাকুর গাছ ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে। পেছনেই খাল, খালের কিনারে নিচে গাছের গুড়ি দিয়ে কাঠের মেঝের ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে।

নাস্তা চলে এসেছে।

-আপনি তো আমার পছন্দে অর্ডার করলেন, আপনার কী খেতে ইচ্ছে করছে বললেন না তো!

তন্বী সৌজন্য মূলক ভাবে জিজ্ঞেস করল আকাশকে।

আকাশ হেসে বলল, আমার সব কিছুতেই অভ্যাস আছে। সকালের নাস্তা আমি এমনিতেই রেস্টুরেন্ট থেকে নিয়ে সারি৷

-আচ্ছা, কেন, বাসায় কেউ নেই?

-আম্মা গেছেন আমার মামাবাড়িতে।

-ওহ আচ্ছা। আপনি তাহলে একা থাকেন?

-সেটা কিছুটা বলতে পারেন। বুয়া রান্না করে দিয়ে যায়। আমি তো ফিরি রাতে।

-আচ্ছা, পরোটাটা বেশ নরম, ভাবি নি এত সফট পরোটা এখানে পাবো।

-আপনার আন্টির দেওয়া খাবার তো পড়ে রইল!

-এখনো আড়াইশ কিলো বাকি, সারা পথ খাওয়া যাবে।

আকাশের খাওয়া শেষ। ও বিল দিয়ে এসে বলল, আপনার কিছু লাগবে? চিপস বা কোল্ড ড্রিংস?

-হু, সেভেন আপ থাকলে নিন। ফান্টাও নিতে পারেন। আর পটেটো ক্রাকার্স।

আকাশ বের হয়ে আরো টুকটাক ডালভাজা, বিস্কুট সহ এগুলো কিনে নিলো। তন্বী বের হয়ে দেখল স্টান্ডের ব্যস্ততা। এতক্ষণ সানগ্লাস লাগেনি, এবারে সানগ্লাস বের করে চোখ ঢেকে নিলো। আকাশও ড্রাইভিং সিটে বসে ক্যাপ খুলে রোদচশমা পরে নিলো। খিরা, গাজর আমড়া নিয়ে ছোটো ছোটো বাচ্চারা বাসের আসে পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাদাম বুট, লেবু লজেন্সের হকারের ডাক শোনা যাচ্ছে।
এসব শব্দের সাথে একটা নস্টালজিয়া মিশে আছে, খুব ছোটোবেলায় এসব শব্দ এক অদ্ভুত আনন্দ তৈরি করত। বেড়াতে যাচ্ছি এই অনুভূতি তৈরি হতো। আহা সময়!

তন্বী গাড়িতে বসতে বসতে বলল, এসব হকারের ডাক আমার খুব চেনা লাগছে। অনেক ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছে। আমরা তখন খুলনায় থাকতাম। এসব আওয়াজ রূপসা ফেরী, বাগেরহাট ফেরীতে পাওয়া যেত।

আকাশ উত্তর না দিয়ে স্মিত হাসল। তন্বী আলগোছে খেয়াল করল, আকাশের চুলগুলো ক্যাপ থাকার কারনে এলোমেলো হয়ে আছে, কপালের উপর এসে পড়ছে, হয়তো বিরক্তও করছে, কিন্তু ভালো লাগছে দেখতে। আরে অদ্ভুত তো, এই লোকটাকে ভালো লাগার কি আছে! সাময়িক সহযাত্রী মাত্র৷ আচ্ছা আকাশ না হয়ে অন্য কোনো ড্রাইভার হলেও কি এমন মনে হতো!!

আকাশের একটা ফোন এসেছে, কোনো ব্যবসা সংক্রান্ত বোধহয়! আকাশ কাউকে বলল৷ আগামীকাল ইসলামপুরে থাকবে। সে যেন সময় মতো এসে দেখা করে।

-আপনার ঢাকায় কাজ আছে?

আকাশের কথা শেষ হতেই তন্বী জিজ্ঞেস করল।

-কাজ ছিল না, এখন যাচ্ছি যখন, কাজ সেরে আসি।

-আপনি তো পুরোপুরি ব্যবসায়ী মনে হচ্ছে।

-তা বলতে পারেন।

-কবে থেকে শুরু করেছেন?

-আসলে আমি কখনো ছাড়িইনি। মানে, আব্বার তো ব্যবসা আগেই ছিল, সব সময়ই আব্বার সাথে সাথে কাজ করতাম। ফাঁকে ফাঁকে স্কুল কলেজ শেষ করেছি।

-ওহ আচ্ছা। বিষয়টা কিন্তু ভালো জানেন! এই যে আপনি নিজেই স্টাবলিসড হয়ে গেছেন, এত কম বয়সে, আপনার মতো অনেকেই এখনো চাকরি খুঁজে চলেছে।

-হ্যা, সেটাই তো স্বাভাবিক, আমার কেস আলাদা।
আকাশ চলতে শুরু করে বলল, আপনার কেন মনে হলো আমার বয়স কম!

তন্বী একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আপনার কি বয়স বেশী, আপনি আমার দুয়েক বছরের বড় হতে পারেন।

আকাশ হেসে জিজ্ঞেস করল, আপনার এসএসসি কততে?

তন্বীর উত্তর শুনে আকাশ বলল, হ্যা, আপনার থেকে আমি একটু বড়, মাত্র ছয় বছরের!!

তন্বী চোখ বড় বড় করে ফেলল, বলে কি!!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here