হঠাৎ হাওয়া,পর্বঃ০৫,০৬

হঠাৎ হাওয়া,পর্বঃ০৫,০৬
সুমনা ইসলাম
পর্বঃ০৫

পরেরদিন সকাল এগারোটার দিকে নিরু আর ফারহান ফারিয়াদের বাসায় চলে এল। ওদের বাসা থেকে আসতে চল্লিশ মিনিটের মতো সময় লেগেছে। নিরু চেয়েছিল রাস্তাটা যেন দীর্ঘ হয় কারণ ওর জার্নি করতে অনেক ভালো লাগে। সতেজ লাগে নিজেকে কিন্তু রাস্তা ফুরিয়েই গেল।

ওরা ফারিয়া আর আতিকের (ফারিয়ার হাসবেন্ড) সাথে কথা বলে সোফায় গিয়ে বসলো। ওরা বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে এমন সময় সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো রাত্রি। সে ফারিয়ার ননদ। এবার অনার্স শেষ করেছে।

রাত্রি নিচে এসে ফারহানের পাশে নিরুকে বসে থাকতে দেখে মুখটা কালো করে ফেললো। পরমুহূর্তেই ঠোঁটের কোণে মিথ্যা হাসি ফুটিয়ে ফারহানকে উদ্দেশ্য করে বললো, “কেমন আছেন ভাইয়া?”

ফারহান অবাক হলো কিছুটা কেননা এর আগে রাত্রি কখনো তাকে ভাইয়া বলে ডাকেনি। হাজার বারণ সত্ত্বেও নাম ধরেই ডেকেছে। অবশ্য গত দুমাস ধরে কথা হয় না বলেই হয়তো এত পরিবর্তন। ফারহান অবাক ভাবটা কাটিয়ে মৃদু হেসে বললো, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো রাত্রি?”

“আমিও ভালো।” তারপর নিরুকে উদ্দেশ্য করে বললো, “ও নিশ্চয়ই নিরু? কেমন আছো তুমি?”

নিরু ওকে চিনতে না পারলেও সৌজন্যমূলক হেসে বললো, “জ্বি, ভালো।”

রাত্রি পুনরায় হেসে বললো, “বয়সে তুমি আমার থেকে প্রায় চার বছরের ছোট তাই নাম ধরেই ডাকলাম। তোমাকে তো আমার পরিচয়টাই দেওয়া হয়নি। আমি রাত্রি। ভাবীর একমাত্র ননদ। অসুস্থতার কারণে তোমাদের বিয়েতে যেতে পারিনি তাই আগে দেখোনি।”

নিরু বিনিময়ে কিছু না বলে হাসলো। তার কাছে রাত্রির হাসিটা ঠিক ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে জোর করে হাসছে কাউকে দেখানোর জন্য।

নিরু ওর পাশের সোফায় ইশারা করে বললো, “আপু আপনিও বসুন আমার সাথে।”

রাত্রি তাড়াহুড়ো করে বললো, “না, নাহ। আমার একটা জরুরি দরকার আছে। বাইরে যেতে হবে। থাকো তোমরা। দোয়া করি যাতে অনেক অনেক সুখী হও।”

আর কেউ না বুঝলেও ফারহান ঠিকই বুঝতে পেরেছে যে রাত্রি তার চোখের আড়াল হওয়ার জন্যই এভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। হয়তো তারা না যাওয়া পর্যন্ত আর বাসার ভেতরে পা দেবে না। কিন্তু তারও যে কিছু করার নেই শুধু দেখা ছাড়া।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে রুমে এসে বসে আছে নিরু। ফারহান তার পাশেই শুয়ে আছে। ওদের জন্য আলাদা রুম পরিষ্কার করে রেখেছে ফারিয়া। বাড়ির বেশিরভাগ রুমগুলোই খালি থাকে কেননা মানুষ বলতে বাড়িতে শুধু তিনজনই। ফারিয়া, আতিক আর রাত্রি। ফারিয়ার শ্বশুর-শাশুড়ি অনেক আগেই মারা গেছেন।

ফারহান নিরুকে তার পাশে শুতে ইশারা করতেই নিরু শুয়ে পড়লো। ফারহান তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললো, “কী এত ভাবছো নিরু?”

নিরু না সূচক মাথা নেড়ে বললো, “না, তেমন কিছু না।”

ফারহান ভ্রু খানিকটা উঁচিয়ে বললো, “কিছু একটা তো ভাবছো। সেই কখন থেকে দেখছি শুধু ভেবেই যাচ্ছো।”

নিরু একটু সংকোচ বোধ করছে। কথাটা বলা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছে না। তার দেখা তো সঠিক না-ও হতে পারে। তবুও সংকোচ নিয়েই বললো, “আসলে রাত্রি আপুর সম্পর্কে ভাবছিলাম। সকালবেলা উনার হাসিটা আমার ঠিক লাগেনি। কেমন যেন লোক দেখানো। ভেতর থেকে হাসছিলেন না উনি। তাছাড়া সে-ই যে বেরিয়ে গেলেন এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো কিন্তু এখনো আসলেন না। সকালে উনার যাওয়া দেখে মনে হলো পালিয়ে যাচ্ছে।”

ফারহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নিল। নিরুকে একটু শক্ত হাতেই জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা ভীষণ বিচক্ষণ। মানুষের চালচলন দেখেই কী সুন্দর অর্ধেক কাহিনীটা বুঝে গেছে। ফারহান চোখ খুলে নিরুর দিকে তাকিয়ে বললো, “ওর এভাবে পালিয়ে যাওয়ার পেছনে অবদানটা কিন্তু সম্পূর্ণই আমার।”

নিরু কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “মানে?”

“মানে হলো- আজ থেকে ঠিক দুই মাস আগে রাত্রি আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। ও বেশ চটপটা স্বভাবের তাই হয়তো মেয়ে হয়েও আগে আগেই প্রপোজ করেছিল মানে মেয়েরা তো সাধারণত প্রপোজ করে না তাই আরকি বললাম। সে যাই হোক আমি ওকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বারণ করে দিয়েছিলাম কারণ তার আগেই তুমি আমার জীবনে এসেছিলে। তাছাড়া ওকে আমি সবসময় আপুর ননদের নজরেই দেখেছি। আলাদা কোনো ফিলিংস ছিল না কখনো। তারপর থেকে ও আমাকে এ বিষয়ে কখনো কিছু বলেনি ঠিকই কিন্তু চুপচাপ হয়ে গেছে। আগে কারণে-অকারণেই কথা বলতো কিন্তু ঐ ঘটনার পরে আর কথা হয়নি। আর আজকে দেখেই ওমন করে বেরিয়ে গেল।”

“এরকমটাই তো স্বাভাবিক তাইনা? কেউ চাইবে না ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারোর পাশে সহ্য করতে।”

ফারহান কিছুটা অবাক হয়ে বললো, “তোমার রাগ হয়নি?”

নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “কেন?”

“ওইযে রাত্রি আমাকে প্রপোজ করেছিল শুনে।”

“প্রথমে হয়েছিল একটু কিন্তু আপনি তো আর রাজি হননি।”

ফারহান দুষ্টুমির ছলে বললো, “রাজি হলে কী করতে?”

নিরু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, “রাজি হতেন ই না আপনি। কারণ আপনি নিজেই বলেছেন আমি আপনার জীবনে আগে এসেছি।”

ফারহান নিরুকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো, “নিরু?”

নিরু নরম স্বরে উত্তর দিল, “হুম?”

“কবে ভালোবাসবে আমায়?”

নিরু কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো। কী উত্তর দেবে সে? তার কাছে তো কোনো উত্তরই নেই। এটা ঠিক যে ফারহানের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার পর থেকেই তার প্রতি ভালোলাগা কাজ করেছে। কিন্তু সেটা কী ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে? এত তাড়াতাড়ি কী কাউকে ভালোবাসা যায়? অবশ্য এত তাড়াতাড়িও নয়। প্রথম দেখা, বিয়ে ঠিক হওয়া, বিয়ে সবমিলিয়ে মাসখানেক পার হলো বলে। কোনো কিছুর উত্তর স্পষ্টভাবে পায় না নিরু। কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতিরা মনের মাঝে উঁকি দিতে থাকে।

নিরু কথা ঘোরাতে বললো, ” আমরা বাসায় যাব কখন?”

নিরুর প্রশ্নে ফারহান আলতো হাসলো। সে বুঝতে পেরেছে যে নিরু তার প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গেল। যাক, অনুভূতি প্রকাশ করতে পর্যাপ্ত সময়টা নিক। একদিন হয়তো সে নিজ মুখেই বলবে। এ আশায়ই আছে ফারহান। স্বাভাবিক ভাবেই বললো, “একটু পরে বের হবো। আপু তো আজকে যেতে দিতে রাজি-ই হচ্ছিলো না। খুব কষ্টে রাজি করিয়েছি। কাল থেকেই তো আবার অফিস জয়েন করতে হবে।”

নিরু একটু মন খারাপ করে বললো, “হুম।”

সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে ফারিয়াদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো ওরা। একটা সিএনজি নিয়েই রওনা হয়েছে। সিএনজি অন্য দিকে যেতেই নিরু ফারহানের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

ফারহান স্বভাবসুলভ হেসে বললো, “গেলেই দেখতে পাবে।”

“এখন বললে কী হবে?”

“কিছুই না। কিন্তু বলবো না।”

নিরু মুখ ফুলিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। এখন বললে কী এমন হবে? ধৈর্য ধরতে মোটেও ইচ্ছা করছে না তার।

প্রায় আধঘন্টা পরে ওরা ওদের গন্তব্যস্থলে এসে পৌঁছালো। নিরু তড়িঘড়ি করে সিএনজি থেকে নেমে গেল। কোথায় এসেছে দেখতে হবে তো তাড়াতাড়ি!

নিরু সিএনজি থেকে নেমে দেখলো ওরা একটা পার্কে এসেছে যা একবারে নদীর তীর ঘেঁষে বানানো। আশেপাশে গুটিকয়েক দম্পতির দেখা মিলছে। নদীর কলকল ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বর্ষাকাল হওয়ায় নদী পানিতে ফুলেফেঁপে উঠেছে। হালকা বাতাসও আসছে। নিরুর মনটা নিমিষেই ক্লান্তি ভুলে সতেজ হয়ে উঠলো। সে নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়ালো।

ফারহান ওর পিছুপিছু গিয়ে ভয়ার্ত স্বরে বললো, “সাবধানে, পড়ে গেলে কিন্তু রক্ষা নেই।”

নিরু মৃদুস্বরে হেসে বললো, “আমি একটু দূরেই আছি। পড়বো না। শুধুশুধুই ভয় পাচ্ছেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।”

ফারহান ভ্রু কুচকে বললো, “কেন?”

“এইযে এত সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে এলেন। কত্ত সুন্দর আবহাওয়া। আমার না অনেক খুশি খুশি লাগছে।”

ফারহান অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে তার নিরুর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা। একটুতেই কত খুশি হয়ে গেছে।

ফারহানও হেসে বললো, “এত খুশি যখন হয়েছো তখন তো শুধু ধন্যবাদে কাজ হবে না নিরুপাখি।”

“নিরুপাখি!” নামটা শুনে কেমন যেন অনুভূতি হলো নিরুর। তবে তা লুকিয়ে রেখেই ভ্রু কুচকে বললো, “তাহলে আর কী লাগবে?”

ফারহান অসহায় মুখ করে বললো, “খুশি হয়ে তো একটু জড়িয়েও ধরতে পারতে। শুধু ধন্যবাদে কী আর মন ভরে?”

নিরু নিচুস্বরে বললো, “আমার লজ্জা করবে না বুঝি?”

“একটু লজ্জা করলে কিছু হবে না।”

“কত মানুষ এখানে দেখেছেন?”

ফারহান ভ্রু উঁচু-নিচু করে বললো, “তাহলে মানুষ না থাকলে ধরতে?”

নিরু চোখ পাকিয়ে ফারহানের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনি কী জানেন যে আপনি অনেক দুষ্টু?”

“বউয়ের সাথে সবাই-ই দুষ্টুমি করে। তুমি আমার দশটা না পাঁচটা না একটামাত্র বউ। তোমার সাথে তো দুষ্টুমি করবোই।” বলেই চোখ মেরে দিল ফারহান।

নিরু লজ্জা পাচ্ছে ভীষণ। লোকটা করছে কী এখানে? নিরু তার পাশের একটি বসার বেঞ্চিতে বসে পড়লো। ফারহানও তার পাশে গিয়ে বসলো। নিরু প্রশ্ন করলো, “হঠাৎ করে এখানে নিয়ে এলেন যে?”

ফারহান তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো, “বিয়ের পরে তোমাকে নিয়ে তো দূরে কোথাও ঘুরতেই যাওয়া হলো না। দাওয়াত খেতে খেতেই ছুটি শেষ। কাল থেকেই আবার অফিস জয়েন করতে হবে। আরেকটু বেশি ছুটি হলে ভালো হতো দূরে কোথাও যেতে পারতাম। তোমার তো জার্নি করতে ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু সাতদিনই তো অনেক বেশি। তাই আপাতত এখানে নিয়ে এলাম। একান্তে কিছু সময় কাটাতে। ঘুরতে না যেতে পারায় তোমার মনটাও খারাপ লাগবে না। কয়েকদিন যাক। এরপর ছুটি নিয়ে দূরে কোথাও যাবো। চলবে তো?”

নিরু খুশি হয়ে বললো, ” অনেক চলবে।”

কিছুক্ষণ নিরব হয়ে বসে রইলো দুইজন। ফারহান নিরুর হাতটা আঁকড়ে ধরে আছে। নিরুও হালকা করে ধরেছে। অস্বস্তি হচ্ছে না তার বরং ভীষণ ভালো লাগছে। দিন দিন ফারহানের মায়ায় জড়িয়ে পড়ছে সে। তার প্রতিটা কাজেই মুগ্ধ হচ্ছে।

নিরবতা ভেঙে নিরু প্রথমে বললো, “আচ্ছা আমরা বাসায় ফিরবো কখন? রাত তো হয়েই গেছে।”

“আরেকটু থাকি। ভালো লাগছে এভাবে থাকতে।”

নিরু-ও সায় জানালো।

পার্কের ভেতরে আরো কিছুক্ষণ হেঁটে ওরা বাইরে বেরিয়ে আসলো। বাইরে বেরোতেই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু ছেলে নিরুকে বাজে ইঙ্গিত করে কিছু কথা বললো। ফারহান তো রেগে আগুন। নিরুর ওদের কথা শুনে রাগ হলেও এখন ফারহানের এমন চেহারা দেখেই ভয় হচ্ছে। এত সুন্দর হাসি-খুশি লোকটা আবার রাগতেও পারে না-কি? কী করবে এবার কে জানে?

চলবে__??

হঠাৎ হাওয়া
সুমনা ইসলাম
পর্বঃ০৬

যে ছেলেটা বেশি বাজে কথা বলছিল সেই ছেলেটার কাছে গিয়ে ফারহান ঠাটিয়ে এক চড় কষে দিল গালে। ছেলেটা গালে হাত দিয়ে হতবম্ভ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। ভাবেনি যে ফারহান এমন কিছু করতে পারে। আশেপাশে দাঁড়ানো ছেলেগুলোও বেজায় ভয় পেয়ে গেছে। ফারহান ওদের দিকে এগিয়ে যেতেই ওরা দৌঁড়ে পালিয়ে গেল। রয়ে গেল শুধু ওই ছেলেটা। তারও চেহারায় রাগের আভাস ফুটে উঠেছে। কিন্তু ফারহানের রাগের কাছে তা অতি নগন্য।

ফারহান ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়ে ধমকে বললো, “সাহস কী করে হয় ওসব কথা বলার? বউ হয় আমার। বউ। বয়সে ছোট বলে শুধু একটা চড়েই সীমাবদ্ধ রাখলাম। এরপর যদি দেখি আর কোনো মেয়েকে কোনোদিন বিরক্ত করেছিস তাহলে সেদিন আর ছোট বলে মাফ করবো না।”

ছেলেটা ভয়ে ভয়ে বললো, “স…সরি ভাই। আর কখনো এমন হবে না।”

“আমাকে সরি বলছিস কেন?”

ছেলেটা এবার নিরুর দিকে তাকিয়ে বললো, “সরি আপু। এবারের মতো মাফ করে দিন প্লিজ।”

নিরু এতক্ষণ একপাশে জড়সড় দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেটার এমন আচরণে এবার বেশ অপ্রস্তুত বোধ করলো সে। তবুও অস্পষ্ট স্বরে “ইট’স ওকে” বলে ফারহানের হাত ধরে হাঁটা ধরলো।

ফারহান নিরুর সাথে চলতে চলতে রাগত স্বরে বললো, “তুমি ওরকম ভয় পেয়ে গিয়েছিলে কেন? না-হলে ছেলেটাকে আরো দু ঘা লাগিয়ে দিতাম।”

“ও বিষয়ে কথা বাদ দিন না। চলুন বাসায় যাই।”

“না, আগে ডিনার করবো। তারপরে বাসায় যাব।”

“আচ্ছা চলুন।”

নিরু আর ফারহান কাছের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ডিনার করে তারপরে বাসায় ফিরলো। বেশ রাত হয়ে গেছে।

নিরু ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে আছে। ফারহান ফ্রেশ হয়ে এসে বললো, “চলো বারান্দায় গিয়ে বসি। তোমাকে আজকে আমার প্রথম বিয়ের কাহিনী শোনাবো।”

নিরু অবাক হয়ে বললো, “প্রথম বিয়ের কাহিনী মানে? আপনি কী সত্যিই আগে একটা বিয়ে করেছিলেন না-কি?”

ফারহান বারান্দার দিকে যেতে যেতে বললো, “আরে আগেই এত কিছু ভেবো না। শুনলেই সব বুঝতে পারবে।”

নিরুও মাথা নাড়িয়ে তার পেছন পেছন গেল। ফারহান রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।

নিরু উৎসুক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

নিরুকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারহান মৃদু হাসলো। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো, “আজ থেকে প্রায় মাস ছয়েক আগের ঘটনা। আমি তখন সবেমাত্র চাকরি পেয়েছি। তাতেই মা পাত্রি দেখার জন্য বিভিন্ন ঘটক লাগিয়ে দিলেন। আমিও মায়ের কথার বিরুদ্ধে যেতে পারিনি। অবশ্য না করার কোনো কারণও ছিল না। তাই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। অনেক পাত্রি দেখা হচ্ছিলো। কিন্তু মায়ের কাউকেই পছন্দ হয়নি। অবশেষে একজনকে দেখে পছন্দ হলো মায়ের। আমাকে দেখানোর পর আমিও অমত করিনি। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিলো। বিয়েও ঠিক হয়েছিল। বাড়ির একমাত্র ছেলের বিয়ে তাই গায়ে হলুদের দুই দিন আগেই বাড়ি-ঘর সব সাজানো হয়েছিল।”

ফারহান একটু থামায় নিরু চটজলদি প্রশ্ন করলো, ” তারপর?”

ফারহান আবারো বলতে শুরু করলো, “কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো গায়ে হলুদের আগের দিন। মেয়ের বাড়ি থেকে খবর এল, মেয়ে না-কি অন্য ছেলের সাথে পালিয়েছে। বিষয়টাকে গোপন রাখা হয়েছিল তখন। মান-সম্মানের ব্যাপার ছিল। যাদের যাদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল তাদের সবাইকে না করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আগে থেকেই সাজানো হয়েছিল বলে কযেকজন মানুষ মনে করে যে আমি আগেও একটা বিয়ে করেছিলাম। সেই গুটিকয়েক মানুষের কথাই তোমার কানে এসেছিল সেদিন। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার কী জানো?”

নিরু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “কী?”

“সে পালিয়েছিল আমার এক বন্ধুর সাথে। আমার বন্ধু জানতো না যে তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল আর সেও জানতো না যে তার প্রেমিকই আমার বন্ধু। ইমন বললো, মাসখানেক আগেই না-কি তাদের বিয়ে ভেঙে গেছে। নিয়মিত অশান্তির কারণেই এ পরিণতি। তার চাহিদা না-কি অনেক বেশিই ছিল। ইমন যথাসম্ভব দেয়ার চেষ্টা না-কি করেছে। সবটাই শোনা। আমি নিজের চোখে কিছু দেখিনি। তাই নির্দিষ্ট একজনকে দোষও দিতে পারি না।”

“আপনার সাথে তার আর দেখা হয়েছিল? নাম কী উনার?”

“নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না। আর তারপরে কখনো দেখাও হয়নি। তুমিই আমার ভাগ্যে লেখা ছিলে তাই হয়তো বিয়ে হতে গিয়েও হয়নি। তোমার দেখা পাওয়ার পরেই মনে হয়েছে যে, ভালোই হয়েছে যে বিয়েটা তখন হয়নি।”

“আচ্ছা ওসব কথা বাদ দিন। চলুন ঘুমাবো।”

“এত তাড়াতাড়ি ঘুম পেয়ে গেছে তোমার?”

নিরু ফারহানের হাত ধরে বললো, “হুম। আপনিও চলুন।”

ফারহান মুচকি হেসে বললো, “আচ্ছা, চলো। পরশু থেকেই তো তোমার ভার্সিটি শুরু। কালকের দিনটাই রেস্ট করার জন্য পাবে।”

“হুম, আপনার অফিস পরশু থেকে হলে ভালো হতো।”

“কেন? আমাকে মিস করবে বুঝি?”

নিরু হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো, “একটু একটু।”

ফারহান নিরুর মতো করেই বললো, “সত্যিই একটু একটু?”

নিরু মেকি হেসে বললো, “আরেকটু বেশি।”

ফারহানও এবার হেসে ফেললো।

__________________

পরেরদিন সকাল সকাল ফারহান অফিসের জন্য তৈরি হতে লাগলো। নিরু সবকিছু তাকে হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছে। ফারহান একবার বলছে টাই বেঁধে দাও, তো একবার বলছে হাতে ঘড়ি পড়িয়ে দাও। নিরুও তাই করছে। বিবাহিত জীবনের নতুন নতুন বিষয়গুলো বড্ড ভালো লাগছে তার। নতুন নতুন অনুভূতি হচ্ছে। ফারহান নিরুর কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে ওকে বিদায় জানিয়ে, মাকে বিদায় জানিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে চলে গেল।

সারাটা দিন শুয়ে বসেই কেটে গেল নিরুর। ফারহানকে বড্ড বেশিই মিস করছে।

সন্ধ্যা প্রায় হয়েই এসেছে। নিরু অপেক্ষা করে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ফারহান চলে আসবে। সারাদিনে ফারহান কাজের ফাঁকে দু’বার কল করেছিল। কিন্তু নিরুর তো ওকে দেখতে মন চাইছে। এ কয়দিন তো দিনের বেশিরভাগ সময় তারা একসাথেই কাটিয়েছে তাই মিস করার পরিমাণটা একটু বেশি। আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে। তাছাড়া কাল থেকে তো নিরুরও ভার্সিটি শুরু।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে বাসায় ফিরলো ফারহান। মেইন দরজা খোলাই ছিল। হয়তো তার বাবা কিছুক্ষণ আগে বাইরে গেছে। ফারহান ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই দেখলো নিরু আর ওর মা একসাথে সোফায় বসে কী নিয়ে যেন কথা বলছে আর কিছুক্ষণ পরপরই চায়ে চুমুক দিচ্ছে। কথা বলার মাঝখানে হঠাৎ করে হেসে উঠছে।

ওদের এভাবে হাসতে দেখে ফারহানের ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠলো। সব ছেলেই হয়তো এমন একটা বউয়ের আশাই করে যে তার মা-বাবাকে নিজের মা-বাবা ভেবে আপন করে নিবে। ফারহানের সে আশাটাও যে পূরণ হয়েছে।

ফারহানকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে যেতে দেখে ওর মা নিরুকেও উপরে পাঠিয়ে দিল।

নিরু ওদের রুমে গিয়ে দেখলো ফারহান রুমে নেই। ওয়াশরুম থেকে আওয়াজ আসছে। হয়তো ফ্রেশ হচ্ছে। তাই নিরু রান্নাঘরে গেল ফারহানের জন্য এক কাপ চা আনতে।

নিরু চা নিয়ে রুমে আসতেই দেখলো ফারহান বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। নিরু ওর কাছে গিয়ে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বললো, “একটা কথা বলি?”

ফারহান চায়ের কাপটা নিয়ে বললো, “অবশ্যই। জিজ্ঞেস করে নিতে হবে না-কি? তোমার যখন যা ইচ্ছা তাই জিজ্ঞেস করবে।”

“আপনি সিগারেট খান?”

ফারহান একটু আমতা আমতা করে বললো, “ঐ আরকি বন্ধুদের সাথে একসাথে হলে দু একটা খাওয়া হয়। তবে নিয়মিত নই।”

“ওহ আচ্ছা।”

“হুম, তুমি কী রাগ করলে?”

“না, রাগ করবো কেন? সিগারেট খেতেই পারেন। সেটা সম্পূর্ণ আপনার ইচ্ছা। তবে একটা কথাই বলবো, আমি আপনার সাথে বেশিদিন বাঁচতে চাই।”

ফারহান নিরুর কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে বললো, “আচ্ছা, আর খাবো না।”

অজান্তেই নিরুর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। হাসিমুখ বজায় রেখেই বললো, “আচ্ছা, এবার চা টা খান। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।”

“হুম। সারাদিন অনেক মিস করেছি তোমাকে।”

“আমিও।”

চা শেষ করে ফারহান কাপটা পাশের চেয়ারে রেখে নিরুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। নিরু চোখ বন্ধ করে আছে।

ফারহান নরমস্বরে বললো, “ভালোবাসি নিরু।”

“ভালোবাসি” শব্দটা শুনে নিরুর কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে। ভালোলাগা কাজ করছে মনের মাঝে। এই প্রথম ফারহান তাকে ভালোবাসার কথা বললো।

নিরু নিশ্চুপ হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো। কোনো উত্তর দিল না।

ফারহান শুধু মুচকি হাসলো। কোনো উত্তরের আশায় তো সে কথাটা বলেনি। শুধু নিজের অনভূতিটা প্রকাশ করেছে।

__________________________

পরেরদিন সকালবেলা নিরু ফারহান দুজনেই তৈরি হয়ে একসাথে বেরিয়ে গেল। ফারহান নিরুকে ভার্সিটির সামনে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যাবে।। বাড়ির সামনে থেকে একটা রিকশা নিয়ে দুজনে রওনা হলো।

ফারহান নিরুকে কলেজের সামনে নামিয়ে দিয়ে অফিসে চলে গেল। ভেতরেই যেত কিন্তু এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে তাই নিরু-ই মানা করে দিয়েছে। তবে বলে গেছে ছুটির সময় এসে নিয়ে যাবে।

ভার্সিটিতে সারাদিন ভালোই কেটেছে নিরুর। নতুন দু-একজন বান্ধবীও হয়েছে। প্রথমদিন তাই পরিচয় পর্বেই ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। নিরু এখন গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ফারহান কল করে একটু অপেক্ষা করতে বলেছে। ও রাস্তায় আছে।

পাঁচ মিনিট বাদেই ফারহান নিরুর সামনে এসে রিকশা থামালো। নিরু রিকশায় উঠে বললো, ”আপনি কী আবার অফিসে যাবেন? না-কি একেবারের জন্যই এসেছেন?

“লাঞ্চ করতে এসেছি। আবার চলে যাবো।”

চলবে__

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here