হঠাৎ হাওয়া,পর্বঃ০৩,০৪

হঠাৎ হাওয়া,পর্বঃ০৩,০৪
সুমনা ইসলাম
পর্বঃ০৩

নিরুরা ওদের বাড়িতে এসে পৌঁছেছে বেশ খানিকক্ষণ হলো। নিরু ওর বাবা-মায়ের সাথে স্বাভাবিক থাকলেও ওর ভাই কথা বলছে না ওর সাথে। পুরোদমে এড়িয়ে চলছে। তবে ফারহানের সাথে স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছে। যেহেতু ফারহানের সাথে তার কোনো মনোমালিন্য নেই তাই তার সাথে কথা না বলার কোনো প্রশ্নই উঠে না। নাহিদের রাগ তো তার বোনের উপরে। তারাই মিটিয়ে নেবে। এখানে ফারহানকে টেনে আনা নেহাতই বোকামি নাহিদের কাছে। তাই সে একদম স্বাভাবিক।

সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষে ফারহানকে নিয়ে রুমে এলো নিরু। একে একে দুজনেই ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিয়ে নিল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কালো আঁধার নেমে এসেছে চারদিকে। নিরু ফারহানকে রেখেই রুমের বাইরে চলে গেল আর ফারহান বিছানায় বসে বসে ফোনে কী যেন করছে।

নিরু বাইরে গেলেও ওর মা আবার ওকে ঠেলে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। বলে দিয়েছে, “নতুন বিয়ে হয়েছে এখন তো সবসময় জামাইয়ের আশেপাশেই থাকবি। তাছাড়া বিয়ের পরে সে প্রথমবার এবাড়িতে এসেছে খাতিরযত্নের কোনো ত্রুটি রাখা যাবে না। তার সাথেই থাকতে হবে। কখন কী দরকার পড়ে যায় বলা যায় না তো।”

নিরুও বাধ্য মেয়ের মতো রুমে এসে ফারহানের পাশে এসে বসে পড়লো।

নিরুকে আবারো আসতে দেখে ফারহান ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বললো, “কী হলো? এইমাত্রই না বাইরে গেলে। মিস করছিলে না-কি? ইশ… কী ভাগ্য আমার! বউ আমাকে ছাড়া এক মিনিটও থাকতে পারে না।”

নিরু ভেংচি কেটে বললো, “মোটেও না। মা জোড় করে রুমে পাঠিয়ে দিল আপনার সাথে থাকার জন্য। কখন কী দরকার পড়বে তা জানাতে বললো।”

“মাকে জানাতে হবে না। আমার তো বউকে দরকার ছিল। বউ যখন এসেই পড়েছে তখন আর কিছুর দরকার নেই।”

নিরু অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, “বউকে দরকার বলেই তো এতক্ষণ বউ রেখে বসে বসে ফোন টিপছিলেন।”

ফারহান নিরুকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো, “বউ অভিমান করেছে বুঝি?”

নিরু মাথা নেড়ে না জানালো। মূলত লজ্জা লাগছে তার। লোকটা ভীষণ বেহায়া।

কিছু একটা মনে পড়তেই নিরু চটপট উত্তর দিল, “আমি যাই। মা রান্না করছে সাহায্য করতে হবে।”

ফারহানকে কিছু বলতে না দিয়েই নিরু উঠে চলে গেল। ফারজান মুচকি হেসে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। নিরুর লজ্জা পাওয়া মুখটা দেখে বড্ড বেশিই ভালো লাগে। তাই তো হঠাৎ করেই লজ্জা দিয়ে বসে।

কিছুক্ষণ পরেই নিরু ফারহানকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এল। খাবার টেবিলে শুধু নিরুর বাবা আর ভাই বসে আছেন। নিরুর মা আর নিরু খাবার বেড়ে দিচ্ছে। নিরুর মা ও মেয়েকে জোড় করে খেতে বসিয়ে দিলেন। নিরু ওর মা কে সাহায্য করতে চেয়েছিল।

খাওয়ার পরে ফারহান কিছুক্ষণ নিরুর বাবার সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে রুমে চলে এল। নিরু ওর মাকে সব গোছাতে সাহায্য করছে। নিরুর মা বারবার বলছে, “নিরু তুই রুমে যা। আমি একা পারবো। জামাই রুমে একা আছে।”

তবুও নিরু জেদ করে বলছে, “একা আছে তো কী হয়েছে? আমি তোমাকে সাহায্য করি। এতকিছু তোমার গোছাতে হবে না৷ কত রান্নাবান্না করলে এখন একটু রেস্ট নাও গিয়ে।”

নিরুর মা মেয়ের জেদের কাছে হার মেনে রুমে যেতেই নিরু ওর ভাইকে ডাকলো, “ভাইয়া?”

নাহিদ নিরুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বললো, “কাল সকালে কথা বলি।”

নিরু খানিকটা মন খারাপ করে ফেললো। কী এমন দোষ করেছে সে যার জন্য এমন করতে হবে? নিরু খানিকটা অভিমান নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমের দিকে যতই যাচ্ছে ততই একটু একটু ভয় লাগছে নিরুর।

তার অবচেতন মন ভাবছে, “উনি যদি আমার সাথে জোড় করেন। উনাকে দেখে, উনার কথাবার্তায়, আচার-আচরণে কখনো সেরকম মনে হয় না। যথেষ্ট ভালো মানুষ উনি কিন্তু পাশের বাসার লিমা যে আরেকদিন বললো, ওর স্বামী না-কি ওকে অনেক জোড় করেছে। সব স্বামীরাই কী এমন হয়?”

এসব ভাবতে ভাবতেই নিরু বেশ সংকোচ নিয়ে রুমে এলো। ফারহান তখন বিছানায় বসে ছিল। নিরুর সংকোচ আর চোখে ভয় দেখে বিষয়টা আন্দাজ করতে বেশি সময় লাগেনি ফারহানের। ও উঠে নিরুর দিকে এগিয়ে যেতেই নিরু পিছিয়ে গেল। একপর্যায়ে দরজার সাথে ঠেকে গেল। ফারহান ওর দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে বেশ শান্তস্বরে বললো, “তুমি কী আমাকে ভয় পাচ্ছো নিরু?”

কণ্ঠটা বেশ করুণ শোনালো নিরুর কাছে। কিন্তু কোনো উত্তর দিতে পারলো না। কাচুমাচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।

ফারহান আবারো বললো, “তুমি কী এটা ভাবছো যে আমি তোমাকে জোড় করবো? অবশ্য ভাবারই কথা। তোমাকে হয়তো এসব বিষয়ে আগে বলা হয়েছে তাই ভয়টা একটু বেড়ে গেছে। তবে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো আমি তোমাকে জোর করবো না কখনো। কাপুরষ হতে পারবো না। শুধু পুরুষ্যত্ব ফলানোতেই কেউ সুপুরুষ হয়ে যায় না। ধর্ষণকারী হতে পারবো না। নারী যতই আমার স্ত্রী, প্রেমিকা হোক না কেন তাকে জোর করাটাও একধরনের ধর্ষণের সামিল। বুঝেছো?” বলেই নিরুর নাক টেনে দিল।

ফারহানের কথা শুনে নিরুর মনের ভয়টা পুরোপুরি কেটে গেছে। বেশ স্বস্তি অনুভব হচ্ছে।

ফারহান এবার একটু দুষ্টু হেসে বললো, “তবে তুমি যখন আমাকে ভালোবাসবে তখন কিন্তু আমি কোনো বাঁধা শুনবো না। তাছাড়া একটু আধটু ভালোবাসা তো থাকবেই তাইনা?”

নিরু বেশ বুঝতে পারছে কথাগুলো ফারহান তাকে লজ্জা দিতেই বলেছে। লজ্জাও পাচ্ছে বেশ।

ফারহান নিরুর থেকে একটু সরে এসে মুচকি হেসে বললো, “চলো, ঘুমাবো এখন। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুম পাচ্ছে প্রচুর। আবার এটা বলো না যে, আমাদের আলাদা ঘুমাতে হবে। এটা কিন্তু মানতে পারবো না।”

নিরু মুচকি হেসে বললো, “আচ্ছা মানতে হবে না। এখন চলুন ঘুমাবো। আমারো প্রচুর ঘুম পেয়েছে।”

নিরু আর ফারহান পাশাপাশি শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে আগে ঘুম ভাঙলো ফারহানের। নিরু তার এক হাত জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। চুলগুলো মুখের উপরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ফারহান অন্য হাত দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে আলতো স্বরে নিরুকে ডাকলো। নিরু একটু নড়েচড়ে হাতটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ফারহান আরো বেশ কয়েকবার ডেকে ওকে ঘুম থেকে তুললো। আযান দিয়েছে নামায পড়তে হবে। দুজনে ওযু করে একসাথেই নামায পড়ে নিল।

নিরু বারান্দায় গিয়ে দাড়াতেই ফারহানও তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

নিরু কিছু চিন্তা করে প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা আপনি আমার সম্পর্কে এতকিছু জানেন কীভাবে? আমাকে আগে থেকে চিনেন?”

ফারহান অানমনে উত্তর দিল, “হুম।”

নিরু বিস্ময় নিয়ে বললো, “কবে থেকে?”

এবার ফারহানের টনক নড়তেই বললো, “একদিনে এত কিছু বলবো না।”

নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “কেন?”

“এমনি।”

নিরু মুখ ফুলিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বললো, “না বললেন। বলতে হবে না।”

ফারহান সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই বললো, “অভিমান করলেও কিন্তু বলবো না। আগে তোমার মনে আমার জন্য অনুভূতির সৃষ্টি হোক, ভালোবাসার সৃষ্টি হোক তারপরে বলবো। আগে বললে সেসব শুনে তোমার মনে হয়তো একটু হলেও ভালোবাসা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু আমি সেটা চাই না।”

নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “কেন? বেশিরভাগ মানুষই তো এটাই চাইবে।”

ফারহান নিরুর দিকে ঘুরে বললো, “কারণ আমি চাই আমার সাথে থেকে, মিশে, আমার সম্পর্কে জেনে তারপরে তুমি আমাকে ভালোবাসো। কোনো কথার ভিত্তিতে নয়।”

নিরু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। লোকটাকে প্রতিনিয়ত নতুন করে চিনছে সে। তার সাথে থাকার দুইদিনও এখনো পূর্ণ হয়নি অথচ মনে হচ্ছে কত আপন।

নিরুকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারহান আলতো হেসে বললো, “চলো একটু বাইরে থেকে হেঁটে আসি। আবহাওয়াটা বেশ লাগছে।”

নিরুও হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়িয়ে ফারহানের সাথে চললো। বাড়ির সামনে পুরোদমে শহরের ছাপ থাকলেও পেছনের দিকে রাস্তাটা একটু গ্রাম্য ধরনের। হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। নিরুর প্রথমে অস্বস্তি লাগলেও এখন বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। কথা বলতে বলতে শুনশান রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা।

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি শেষে আটটার দিকে বাড়ি ফিরে এল ওরা। নিরুর মা রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছেন। বাবা বসে বসে পেপার পড়ছেন আর নাহিদ তার পাশে বসে ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিচ্ছে।

নিরুর ওর ভাইকে দেখামাত্রই রাতের কথা মনে পড়লো। মনে মনে ভাবলো, “ভাইয়া তো বলেছিল সকালে কথা বলবে। তাহলে কী এখন কিছু বলবো?”

ফারহান গিয়ে নিরুর বাবার পাশে বসে পড়লো।

নিরু নাহিদকে ডাকতে নাহিদ ওকে নিয়ে নিজের রুমের দিকে চললো। বলে গেল কীসের যেন জরুরী কথা আছে। ফারহানও আর সেদিকে কেমন মাথা ঘামালো না। ওদের ভাই-বোনের মাঝে ঢোকাও উচিত নয়। নিজেরাই না-হয় মনোমালিন্য মিটিয়ে নিক।

নিরু নাহিদের রুমে প্রবেশ করেই বললো, “ভাইয়া তুমি কথা বলছো না কেন আমার সাথে?”

নাহিদ বিছানায় বসে বললো, “আমি কিন্তু তোর ভালোর জন্যই বলেছিলাম নিরু। কিন্তু তুই শুনলি না আমার কথা।”

নিরু ওর পাশে বসে শান্তস্বরে বললো, “হ্যাঁ, মানছি। তুমি আমার ভালোর জন্যই বলেছো। কিন্তু টাকা দিয়েই কী সব সুখ পাওয়া যায়? তুমি দেখো উনি আমাকে ঠিক সুখী রাখবে।”

নাহিদ পাশ ফিরে হেসে বললো, “একদিনেই এত বিশ্বাস?”

নিরু নিচুস্বরে বললো, “বিশ্বাস করার মতোই মানুষ উনি। তুমি প্লিজ আমার সাথে আর রাগ করে থেকো না।”

নাহিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আমি তোর সুখের কথা চিন্তা করেই সিদ্ধান্তটা জানিয়েছিলাম। এখন তুই যদি এভাবেই সুখে থাকিস তাহলেই আমি খুশি। তোর সুখে থাকাটাই আমার কাছে প্রধান।”

নিরু হেসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো, “থ্যাংক ইউ সো মাচ ভাইয়া।”

বিনিময়ে নাহিদও আলতো হেসে বোনকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো।

চলবে__??

হঠাৎ হাওয়া
সুমনা ইসলাম
পর্বঃ০৪

আরো একদিন নিরুদের বাসায় থেকে পরেরদিন ফিরে এল ওরা। ফারিয়ার শ্বশুরবাড়ি থেকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে সেখানে যেতে হবে। তবে দু-তিন দিন পরে।

সকালবেলার নাস্তা করছে সকলে। সকলে বলতে ফারহান, নিরু আর ওর শ্বশুর-শাশুড়ি। ফারহানের আর কোনো ছোট ভাই-বোন নেই। তাছাড়া সব আত্মীয়-স্বজনরাও যার যার বাড়িতে চলে গেছে তাই বাড়ি এত ফাঁকা।

নিরু বসে বসে খাচ্ছে আর আনমনা হয়ে ভাবছে, “ভার্সিটিতে এডমিশন নেওয়ার ডেট তো প্রায় পেরিয়েই যাচ্ছে। ভর্তি হবো কবে? উনি তো আগে থেকেই রাজি কিন্তু বাবা-মা কী পড়ালেখা করার অনুমতি দেবেন?”

নিরুর ভাবনার মাঝেই ওর শশুরমশাই রায়হান সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, “নিরু মা, তুমি কী পড়ালেখা করতে চাও?”

নিরু প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পেরে অতিদ্রুত মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। নিরুর এমন কান্ডে মুচকি হাসলো সবাই।

নিরু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে উত্তর দিল, “জ্বি, বাবা।”

রায়হান সাহেব উনার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মুক্তা তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?”

ফারহানের মা মিসেস মুক্তা ভ্রু কুচকে বললেন, “আমার আবার কিসের আপত্তি থাকবে? আমার মেয়েকেও তো আমি অনার্স অবধি পড়ালেখা করিয়েছি। সেখানে আমার বউমা কেন করবে না? সবাই যখন জিজ্ঞেস করবে আমার বউমা কোন ক্লাস অবধি পড়েছে তখন কী বলবো যে ইন্টার পাশ করেছে শুধু? অবশ্যই উচ্চ শিক্ষিতা হতে হবে। আর মেয়েদের পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো অনেক বেশি জরুরী। আমি নিজে পড়ালেখা করেছি তাই আমি বুঝি। এখন তো এই বয়স বাড়ার কারণেই চাকরিটা ছাড়তে হয়েছে।”

নিরু তো মনে মনে ভীষণ খুশি। পরিবারের সবাই কত্ত ভালো। অবশ্য তাদের সাথে না থাকলে, না মিশলে সহজে বোঝার উপায় নেই যে এই গুরুগম্ভীর মানুষগুলোও কতটা খোলামেলা স্বভাবের। বাইরে থেকে বাবা-মা দুজনেই বেশ গম্ভীর। তাই নিরুর প্রথমে ভয় লাগতো মানিয়ে নিতে পারবে না-কি এই ভেবে।

রায়হান সাহেব ফারহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ফারহান, কালই গিয়ে ভার্সিটিতে এডমিশনের জন্য ফর্ম পূরণ করে আসবে।”

ফারহান সম্মতি জানাতেই আবার সবাই খাওয়ায় মনোযোগ দিল।

খাওয়া শেষে সব গুছিয়ে নিরু রুমে এসে ফারহানকে উদ্দেশ্য করে বললো, “অফিসে যাবেন আজ?”

ফারহান না সূচক মাথা নেড়ে বললো, “উঁহু, সাতদিনের ছুটি নিয়েছি। আরো দুইদিন আছে।”

“ওহ, তাহলে ফারিয়া আপুদের বাসায় যাবো কবে?”

“পরশু দিনই যেতে হবে। নাহলে আর সময় হবে না। আমি আপুকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি।”

নিরু বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বললো, “ওহ, আচ্ছা।”

“হুম,আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। লাঞ্চের আগেই চলে আসবো।”

“কোথায় যাবেন?”

“মেহেদি বাড়ির সামনের দোকানটায় অপেক্ষা করছে। ওর সাথেই দেখা করতে যাবো। অনেকদিন পর দেশে এসেছে। এতদিন আমেরিকা ছিল। আবারো চলে যাবে।”

“ওহ, আচ্ছা।”

“হুম, বাই।” বলেই ফারহান মানিব্যাগটা পকেটে গুঁজে বেরিয়ে গেল।

নিরুও তার শাশুড়ির কাছে চলে গেল। উনি সোফায় বসে বসে সিরিয়াল দেখছেন। রায়হান সাহেবও বাড়িতে নেই।

ফারহানের মা ওকে দেখে বললেন, “আমার পাশে এসে বসো। ঘরে একা একা কী-বা করবে।”

নিরু মুচকি হেসে বললো, “মা, চা খাবেন? চা নিয়ে আসি?”

“আচ্ছা যাও।”

নিরু রান্নাঘরে গিয়ে দুই কাপ চা নিয়ে এসে ওর শাশুড়ির পাশে বসলো।

চায়ে চুমুক দিয়ে ওর শাশুড়ি বললেন, “বাহ, তুমি তো বেশ ভালো চা বানাতে পারো।”

বিনিময়ে নিরু শুধু হাসলো।

ওর শাশুড়ি আবারো বলতে শুরু করলেন, “বুঝেছো বউমা, মেয়েদের জীবনে পড়ালেখার গুরুত্ব অনেক। তোমার শ্বশুর আর আমি ক্লাসমেট ছিলাম। কলেজ থেকেই অনেক ভালো বন্ধুত্ব ছিল আমাদের। একপর্যায়ে সেই বন্ধুত্ব ভালোবাসায় পরিণত হয়। দুজনে একসাথে একই ভার্সিটি থেকে অনার্স শেষ করি। তারপর যখন ও একটা ছোটখাটো চাকরি পায় তখন বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ওর বাড়ি থেকেও কেউ রাজি ছিল না বলে ও নিজেই যায়। কিন্তু আমার বাবা-মাও রাজি ছিলেন না। অনেক বোঝানোর পরেও রাজি হয়নি কেউ। তাই দুজনে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের পরেও কেউ মানেনি। তাই বাড়ি ভাড়া নিয়ে আলাদা সংসার শুরু করলাম।”

উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো বলতে শুরু করলেন, “তখন তোমার শ্বশুরের অত কম বেতনে সংসার চলতে চাইতো না। ভীষণ অভাবের মধ্যে পড়তে হয়েছিল। তাই আমিও চাকরির জন্য চেষ্টা করতে থাকি। একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হয়েও যায়। দুজনে মিলে সংসার চালাতে শুরু করি। তারপর তোমার শ্বশুর চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করে। তারপর থেকে সংসারের উন্নতি শুরু হয়। আরো বেশ কয়েকবছর পরে সবাই আমাদের মেনে নেয়। তাই পড়ালেখা বাদ দিও না। দেখবে এক পর্যায়ে না এক পর্যায়ে ঠিকই কাজে আসবে। তাছাড়া মেয়েদের আত্মসম্মানবোধ বজায় রাখতে পড়ালেখা করা অনেক জরুরী।”

নিরু এতক্ষণ একমনে শুনছিলো ওর শাশুড়ির কথা। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো, “আমি পড়ালেখা ছাড়বো না মা। প্রতিষ্ঠিত হবো। শুধু আপনাদের দোয়ার প্রয়োজন।”

“আমরা তো দোয়া অবশ্যই করবো। তুমি এখন আমাদের বাড়িতে বউ হয়ে এসেছো। আমার মেয়ের মতোই। বাড়িতে তো আর কেউ নেই। ফারিয়া তো সেই কবেই পরের বাড়ি চলে গেছে। বাড়িতে সারাদিন আমাদেরই থাকতে হবে মিলেমিশে। মা-মেয়ে হয়েই থাকবো। আমার একটা ছোট মেয়ের শখ ছিল ভীষণ। এখন পেয়েছি। ফারহানের পছন্দ করা মেয়ে তুমি তাই আমাদেরও ভীষণ পছন্দের।”

নিরুর শেষের কথাগুলো শুনে কেমন যেন সন্দেহ হলো। তাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “মা, উনি কী আমায় আগে থেকে চিনতেন?”

“সে তো আমি বলতে পারবো না মা। ফারহান নিষেধ করেছে। সে না-কি নিজেই তোমাকে বলবে। এ ছেলের মতিগতি বুঝি না বাপু।”

নিরু খুব ভালো করেই বুঝতে পেরে গেছে ফারহান ছাড়া আর কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দেবে না। তাই নিজেও চিন্তা করা বাদ দিয়ে দিল।

আরো কিছুক্ষণ বিভিন্ন কথা বলে নিরু আর ওর শাশুড়ি রান্নাঘরে চলে গেল। দুপুরের রান্না আজ নিরু করবে সাথে ওর শাশুড়িও সহযোগিতা করবে।

রান্নাবান্না শেষে নিরু রুমে এসে গোসল করে নিল। ঘেমে-নেয়ে অস্থির হয়ে গেছে। গরমও পড়েছে বেশ। নিরু গোসল করে বেরোতেই দেখলো ফারহান রুমে ঢুকছে। ফারহান নিরুকে দেখে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে বললো, “তোমাকে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে নিরু।”

ফারহানের এভাবে তাকিয়ে থাকায় আর কথা বলায় লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো নিরু। ফারহান মৃদু হেসে বললো, “প্রচুর খিদে পেয়েছে আমি গোসল করেই আসছি।”

দুপুরের খাওয়া শেষে নিরুর সবকিছু গুছিয়ে রুমে এল। ফারহান বিছানায় বসে আছে। নিরুকে আসতে দেখেই বললো, “এখানে এসে বসো।”

নিরু ওর পাশে গিয়ে বসতেই ফারহান ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ক্লান্তস্বরে বললো, “প্রচুর ঘুম পেয়েছে। একটু ঘুমাবো।”

নিরু ফারহানের মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে আর ফারহান এতক্ষণে ঘুমিয়েও পড়েছে। একপর্যায়ে নিরুও বালিশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

বিকেল পাঁচটার দিকে ঘুম ভেঙেছে নিরুর। ফারহান এখনো ঘুমাচ্ছে। নিরু ওর মাথাটা বালিশে রেখে উঠে পড়লো। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গেল চা বানাতে। বাবা-মা এসময়ে উঠানে বসে চা খান।

নিরু উনাদের চা দিয়ে এসে ওর আর ফারহানের জন্যও রুমে চা নিয়ে এল। ফারহান ঘুম থেকে উঠে গেছে। নিরু ওর হাতে চা দিয়ে বললো, “কখন উঠলেন?”

“তুমি যখন উঠেছো তখন।”

সারাটা বিকেল ওরা বারান্দায় বসেই কাটিয়ে দিল। পরিবেশটা বেশ সুন্দর। একটু একটু রোদ আবার বাতাসও আছে। যার ফলে রোদটা বেশি প্রভাব ফেলছে না। পাশের গাছে দুটো নাম না জানা পাখি খড়কুটো দিয়ে বাসা বাঁধছে। নিরু গভীর মনোযোগ দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে।

___________________

পরেরদিন সকাল সকাল নিরু আর ফারহান ভার্সিটিতে গিয়ে ফর্মপূরণ করে এসেছে। বেশ ভীর ছিল তাই বাসায় আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেছে।

নিরুকে বাড়ির সাসনে নামিয়ে দিয়ে ফারহান কী যেন জরুরি একটা কাজে গেছে। বলেছে ফিরতে দেরি হবে। তাই নিরুও এসে ফ্রেশ হয়ে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে নিল। তারপর শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে একসাথে লাঞ্চ করে কাল ফারিয়াদের বাসায় যাওয়া নিয়ে কথা বলছে। ফারিয়া না-কি নিজে আসতে চেয়েছিল ওদের নিতে কিন্তু বাড়িতেও তো কম-বেশি আয়োজন করতে হবে তাই আসতে পারেনি।

বিকাল চারটার দিকে বাসায় ফিরলো ফারহান। নিরু তখন আলমারি খুলে বসে আছে। কালকে কোন শাড়ি পড়বে সেটা ঠিক করতে পারছে না। বিয়েতে কেনা, মায়ের দেয়া, শাশুড়ি মায়ের দেয়া সব শাড়িতে আলমারির একপাশ ভর্তি হয়ে আছে। এত শাড়ির কারণে মূলত সিলেক্ট করতে অসুবিধা হচ্ছে নিরুর।

ফারহান ফ্রেশ হয়ে এসর নিরুর এমন অবস্থা দেখে হেসে ফেললো।

নিরু একটু রাগীস্বরে বললো, “আমি সিলেক্ট করতে পারছি না। কোথায় আপনি সিলেক্ট করে দেবেন। তা বাদ দিয়ে উল্টো হাসছেন। এটা কিন্তু মোটেও ঠিক হচ্ছে না।”

ফারহান হাসি থামিয়ে বললো, “কী করবো বলো? তোমার রিয়্যাকশন দেখেই হাসি পেয়ে যাচ্ছে।”

“হয়েছে আর হাসতে হবে না। এবার আমাকে একটু সাহায্য করুন।”

ফারহান একটু ভেবে বললো, “তোমাকে হালকা গোলাপি রঙের শাড়িতে বেশি মানায়। ওই কালার দেখে একটা পড়ো।”

“হালকা গোলাপি রঙের দুটো শাড়ি আছে। কোনটা পড়বো?”

“আগে দেখাও, তারপরে বলছি।”

নিরু আলমারি থেকে হালকা গোলাপি রঙের দুটো শাড়ি বের করতেই ফারহান একটা শাড়ি সিলেক্ট করে দিল। নিরুরও বেশ পছন্দ হয়েছে শাড়িটা।

নিরু শাড়িটা আলাদা করে রেখে বললো, “আচ্ছা কালকে আমরা কখন যাবো?”

“আপু তো সকালেই যেতে বলেছে। কিন্তু একটু দেরি তো হবেই।”

চলবে__??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here