#স্বর্নাভ সুখানুভূতি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
#নিবেদন। (পর্ব -৩)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
শেষ বিকেলের কোমল আলো গায়ে মাখিয়ে সুদর্শন যুবক যখন পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছিল তখন হৃদস্পন্দন থেমে আসছিল মুশরাফার। দৃষ্টি সরছিলই না। স্থবির চেয়ে থাকার মাঝে চোখে ভিড়েছে অশ্রুদল। আহ্! কতদিন বাদে চেনা মানুষটার মুখদর্শন হলো! বিয়ের আগে দেখা হয়েছিল, সেই ছিল শেষবার। তারপর এক ঝলক ও দেখা হয়নি আর। কোন একটা সময় কত ভালো সম্পর্ক ছিল তাদের, স্মৃতির পাতা উল্টালে এখনো হাজারটা চমৎকার মুহুর্ত ফ্রেমবন্দী পাওয়া যাবে। কত খুনসুটি ছিল একসাথে! কালে আবর্তে সব যেন ধুয়ে মুছে নিঃশেষ হয়ে গেছে। মানুষটা কি ওর কাছেই আসছে! এত দূর থেকে দেখে চিনেছে!
জাওয়াদ ঘাড় ঘুরিয়ে পূর্ণচোখে মুশরাফার মুখভঙ্গি পরখ করল। ফোন তখনো ওর কানে, তবে কথার খেয়ালটি নেই। মন তো পড়ে আছে পেছনের সিটে, সে কি আর কথায় থাকে! মুশরাফার ওমন চাহনি দেখে জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল, আগ্রহী চোখে তাকাল ছেলেটার দিকে। রাস্তা পেরুচ্ছে ছেলেটা। জাওয়াদের ঘাড় ঘুরানো দেখে নাজমুল সাহেব ও ঘাড় ঘুরিয়ে উঁকি দিলেন। এক ঝলক দেখে বিস্ফোরিত চোখে স্ত্রীর পানে চাইলেন। বিপরীতে বাইরে তাকাতে ভুললেন না ফরিদা। যুবককে দেখে চমকাতে দেখা গেল তাকে, আতঙ্ক মিশলো চোখের রেখায়। ভীত চোখ তাকালেন স্বামীর পানে। মনে মনে দোয়া করলেন, ‘আল্লাহ! জামাইর সামনে কোন বিশৃঙ্খলা না হোক।’
কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন না হতে সোজা হয়ে বসলেন। ঝেড়ে কেশে বললেন,
‘গাড়ি স্টার্ট দাও, জাওয়াদ।’
বাইরে তাকিয়ে থেকেই তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করে উঠল মুশরাফা, ‘নাহ, প্লিজ!’
জাওয়াদ আবার ভ্রু কুঁচকাল। সোজা হয়ে বসে ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘ছেলেটা কে, মামা?’
‘ তারিফ ।’ ছোটো করে উত্তর দিলেন তিনি। জাওয়াদ আবার প্রশ্ন করল, ‘এই তারিফটা কে? রাফার সাথে কী সম্পর্ক?’
নাজমুল সাহেব তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে থেমে বললেন, ‘আনফরচুনেটলি রাফার….
উনাকে থামিয়ে আনমনে কথাটা সম্পন্ন করল মুশরাফা। তারিফ নামের ছেলেটা রাস্তা পেরিয়ে, মুশরাফাদের গাড়ির কাছাকাছি এসে গেছে। মুশরাফা স্ফুট স্বরে ডেকে উঠল, ‘ভাইয়া!’
ন্যানোসেকেন্ডে ঘাড় ঘুরাল জাওয়াদ। এটা তবে ওর ভাই! স্বস্তির নিঃশ্বাসটা চাপাভাবে ফেলল। পরপরেই তীক্ষ্ম চোখে পরখ করল শ্যালককে। চোখ রাগ এসে ভীড় জমিয়েছে। দেখতে ভদ্র মনে হচ্ছে, এই ছেলে তো পারত, মায়ের থেকে রাফাকে বাঁচাতে। সে করল না কেন! সবাই একই দলে! জাওয়াদ দেখল তারিফ পাশ কাটছে। এবার পরিষ্কার হলো, সে মুশরাফাকে দেখেনি, অন্যকাজে এদিকে আসছিল। কথাটা বুঝতে পারলে কারো মুখে হতাশা যেন না ছেয়ে যায় সেই ভয়ে আগবাড়িয়ে নিজেই গাড়ি টান দিল।
‘গাড়ি থামান!’ কেমন চেঁচিয়ে উঠল মুশরাফা। জাওয়াদ নিজেকে ধাতস্থ করে অবাক হওয়ার ভান করল, ‘কেন? কিছু লাগবে? ‘
মুশরাফা থমকাল। ‘আমার ভাইকে লাগবে ‘ কথাটা বলতে পারল না মুশরাফা। গলাতেই আটকে রইল। ভাই যে তার জন্য নয় অন্য প্রয়োজন আসছিল তা ঢের বুঝতে পারল। ভাইয়ের চোখে সে পড়েছিল, কিন্তু সে চিনেনি। চোখ সরিয়ে পাশ কেটেছে, এ কথা জানার পর স্বামীকে কিভাবে বলত ভাইয়ের কথা! কান্নার ঢোক গিলে বলল, ‘কিছুনা।’
তিনটা দীর্ঘশ্বাস আচঁড়ে পড়ল এরপরেই। গাড়ির পরিবেশ কেমন গুমোট হয়ে গেল। মুশরাফা গুরুগম্ভীর হয়ে বসে আছে, খানিক পরপর মোজা হাতে চোখের কোণা মুছছে। মিররে সেই দৃশ্য দেখে চোয়ালে ছায়া নামল জাওয়াদের। চোখ সরিয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলল,
‘কিছু খাবে? গাড়ি থামাব?’
উত্তর এলো না। নিরবতায় পার হলো পথ। জাওয়াদ নামিয়ে দিয়ে ফেরার কথা থাকলে ও ফিরতে সে পারল না। অদৃশ্য এক সুতো তাকে বেধে রাখল।
•
চার ভাইবোনের মধ্যে মুশরাফার স্থানটা ছিল তৃতীয়। বড়ো বোন সাফার সাথে খুব একটা সখ্যতা না থাকলেও ভাই তারিফের সাথে খুব ভাব ছিল। মুশরাফার তখন বুঝ হয়েছে তখন তারিফ হাইস্কুলে উঠেছে সবে। বোনটা তার বড্ডো আদরের ছিল, স্কুল থেকে ফেরার সময় বোনের জন্য চকলেট আনতে ভুলতো না। আদর করে ডাকতো মুশি।
মুশরাফা কত আবদার জুড়ে দিতে ভাইয়ের কাছে। তা হাসিমুখেই পুরণ করার চেষ্টা থাকত তারিফের।
একবার মুশরাফার হাত কেটে গিয়েছিল, রক্তারক্তি অবস্থা। যন্ত্রণায় মুশরাফা যতটা না কান্না করছিল, ওর রক্ত দেখে তারিফ তার দ্বিগুণ কান্না করছে। রক্ত বন্ধ করার জন্য লায়লা নিজের ওড়না চেপে রেখেছেন মেয়ের হাতে। চাপ পড়তেই মুশরাফা কান্নার বেগ বাড়ল। তা দেখে কান্না থামিয়ে ধমকে উঠল তারিফ, ‘এত জোরে ধরছো কেন? মুশি ব্যাথা পাচ্ছে না? সরাও এটা!’
এত ভালোবাসার অটুট বন্ধনটা বছর কয়েকেই ঝরে গেল। মুশরাফা বড়ো হলো। প্রখর বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মুশরাফা অল্প বয়সেই ম্যাচিয়ুর হয়ে গিয়েছিল। ক্লাস সিক্স অবধি পারিবারিক সংস্কৃতি মেনে চললেও সেভেনে উঠতেই রক্ষনশীল পরিবারের এক ধার্মিক সহপাঠীর সাথে বন্ধুত্ব হলো। তার কাজ দেখেই ইসলামের প্রতি আগ্রহ এলো। এইটে উঠার পর ইসলামিক বই পড়ে ধীরে ধীরে নিজেকে ধর্মে অনুশাসনে নিয়ে এলো। নামাজ ধরল, পর্দা ধরল। স্কুল ছেড়ে মাদ্রাসায় ভর্তি হলো জেদ ধরে। পশ্চিমা সংস্কৃতি মেনে চলা পরিবার ওর ধার্মিকতা মানতে পারল না কিছুতেই। প্রথমে আদেশ, তারপর শাসন, মার পড়ল। বোরকা পরে বের হলেই বোরকা ছিঁড়ে ফেলত মা। উপরিলাভ হিসেবে মারতো, খাওয়া বন্ধ করে দিতো, রুমবন্দী করে রাখতো, বের হলেই নাকি সবার নাক কাটা যাবে। একেকদিনের মারে জ্ঞান হারাত ও। মা থেকে রূপকথার কোন এক হিংস্র পিশাচের রূপ ধারণ করছেন।
তারিফ তখন মদের নেশায় আসক্ত। ভালো মন্দের বাচবিচার করবার বা বোনকে দেখার সময় কই তার, সে তো গার্লফ্রেন্ড, বার নিয়েই ব্যস্ত। দিনের পর দিন বাসার বাইরে থাকতো। ফুরসতে এলে মায়ের কাছে বোনের বিচার শুনতো। বাকি সবার মতো মুশরাফার পরিবর্তন সে ও মানতে পারল না। তার বোন কি না এমন জঙ্গিদের মতো ঘুরে! চারকান হলে মুখ দেখানোর জো থাকবেনা। মুশরাফাকে কড়াভাবে শাসাল সে। মুশরাফা ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝানোর চেষ্টা করল। মুশরাফা ভাইকে বলেছিল, মদ ছেড়ে দিয়ে ইসলামের পথে আসতে। মদ্যপ তারিফ তা আমলে তো নিল না, উলটো ক্ষিপ্ত হলো। মায়ের কাছে গিয়ে গজরাতে গজরাতে বলল, ‘ তোমার মেয়ে জঙ্গি হয়ে যাচ্ছে। শাসন করো ওকে। ‘ ‘মুশি’ ডাকের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে ‘তোমার মেয়েতে গিয়ে ঠেকতেই ভাইকে হারিয়েছে মুশরাফা। যেই ভাই ওর সামান্য ব্যাথায় বাড়ি মাথায় তুলেছিল সেই ভাই মায়ের সাথে মিলে ওকে ব্যাথার ভাগি করল। মুশরাফাকে বোরকায় দেখে খুব মেরেছিল। ভাইহীনতা টের পেয়ে নির্বাক চেয়েছিল মুশরাফা। বাকি সবার সাথে ভাইটাও পর হলো তবে! তারপর কতগুলো বছর কেটে গেল, পরিবার থেকে আঘাত ছাড়া ভালোবাসা পেল না। সেই কৈশোরের পর আর কেউ আর সাথে নরম গলায় কথা বলেনি,মা আদর করে ডাকেনি, কাছে টানেনি। ভাইটা বিয়েতে আসেনি। মামার চাপে সৌজন্যতাবোধে মা বাবা এসেছিল কেবল। বিয়ের পরদিন যে মামাবাসা ছেড়েছেন আর সে বাসা মুখো হননি। খোঁজ ও নেননি। ছ’মাস হয়ে গেল একটা মানুষ জানতে চাইল না, ও বেঁচে আছে? ভালো আছে?
মাগরিবের নামাজ শেষে জায়নামাজে বসে উদাসমনে ভাইয়ের স্মরণে ডুবেছে মুশরাফা। ভাবনার গহিনে যাবার পর কখন আপনাআপনি চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল সে টের পেল না। ধ্যান ভাঙল জাওয়াদের আলতো ডাকে।
‘ রাফা!’
মুশরাফা নড়ে উঠল। মলিন চোখে চাইল স্বামীর পানে। ওর থেকে কিছুটা দূরে জায়নামাজে বসা জাওয়াদ। একসাথে নামাজ পড়তে বসেছে। জাওয়াদ মোনাজাত শেষ করে ওকে অন্যমনস্ক আবিষ্কার করেই ডাকল। মুশরাফা আনমনে জবাব দিল,
‘হু!’
‘ কত স্ট্রং ছিল তোমার পার্সোনালিটি। অল্পতে তো তুমি ভেঙে পড়তে না। আল্লাহর কাছে ছাড়া কারো কাছে কাঁদতে না। এখন কী হলো তোমার? এত দুর্বল হয়ে গেলে কেন?’ প্রশ্নবোধক চাহনি জাওয়াদের, স্বরটা নিচুই।
মুশরাফা পলক ঝাপটিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল,
‘আসোলে কী জানেন? একটা মানুষ যতই শক্ত মনের মানুষ হোক, তার জীবন এমন কিছু মানুষ থাকে যাদের জন্য তার শক্ত মনটা ও যখন তখন নড়ে উঠে, শক্ত বুক কেঁপে উঠে। একটা মানুষ যতই কঠোর হোক, প্রিয়জনের কথা আসলে সে দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রিয়জনহীনতার কষ্টটা খুব ভয়ানক জানেন? কোন যুক্তি মানে না। তখন ইগো কাজ করে না। কেবল মনে হয়, এই মানুষগুলোকে আমার প্রয়োজন, ভীষণ প্রয়োজন। যে কোন উপায়ে তাদের যেন পাই। আসোলে আপনতত্বে ব্যক্তিত্ব, অহং সব দুমড়েমুচড়ে যায়। ‘
ওর ভারি ভারি কথায় কত আকুলতা ঝরে পড়ল!ঢের টের পেল জাওয়াদ। তাও সে প্রশ্ন করল না। কিছু ব্যাপার মেলতে নয়, ঢাকতে হয়। ও কেবল ভরসা দিল। এক কদম পিছিয়ে স্ত্রীর পাশে বসে মাথায় হাত রাখল,
‘ আল্লাহ আছেন, যা তোমার জন্য ভালো, তিনি অবশ্যই তোমার ভাগ্যে দিবেন। উপরে আল্লাহ আছেন তোমাকে ভালোবাসার। নিচে ও তো মানুষ আছে। আর কেউ লাগবে না। তারাই তোমার শক্তি এই ভেবে দুর্বলতাকে ভুলে যাও।’
জাওয়াদের কথাটায় কী ছিল কে জানে, মুশরাফার মনের কালো মেঘ সরে গেল। একঝাঁক আশা, একরাশ আশা, সাহস এসে ভর করল। চোখ মুছে, নাক টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেলল মুশরাফা। একবারে স্বাভাবিক। তারপর ভ্রু নাড়িয়ে বলল,
‘নিচে কে আছে?’
‘তোমার মামা, মামি, ফাবিহা আপু, শ্বশুর মশাই, শ্বশুর মশাইয়ের মেয়ে, সবাই তোমাকে ভালোবাসার দলে।’
মুশরাফা ঠোঁট চেপে হেসে বলল, ‘শ্বশুর মশাইয়ের ছেলে নেই?’
জাওয়াদ সে কথার উত্তর দিল না। বলল,
‘ আজকে দুইবেলা কান্না করা হয়ে গেছে। আর যেন কাঁদতে না দেখি। ‘
মুশরাফা স্পষ্ট টের পেল ওর বিষন্নতা কেটে যাচ্ছে। প্রফুল্লতা ফিরে আসছে, ‘তাহলে কাল আবার কান্না করব?’
‘সেটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে বলে রাখা ভালো, কাঁদলে তোমাকে ভূতের মতো লাগে। একটু ও ভালো দেখায় না।’
মুশরাফা হেসে ফেলল, সেই হাসির শব্দ না হলে ও ভীষণ উচ্ছ্বাস প্রকাশ হলো। হাসতে হাসতেই বলল,
‘ ভূতেরা ও কান্না করে না কি !’
জাওয়াদ ঝলমলে হাসল। সেই হাসিতে মিশে আছে সার্থকতা। উঠে দাঁড়াল, এখন আর কাজ নেই। বারান্দার দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
‘ অনেকদিন বারান্দায় বসা হয়না। মোনাজাত শেষ করে বারান্দায় আসো তো।’
এক কাপ কফিতে তারা দেখে, গল্প করে রাত পার করার স্মৃতি ভাসতেই মুশরাফা মনখারাপের ঝাপটা একবারেই দূর হয়ে গেল। আহ্! কতদিন পর।
চলবে…
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা