স্বর্নাভ সুখানুভূতি।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব- ২৪-খ)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
তারিফের চোয়ালে গম্ভীর্যে ভরপুর। জাওয়াদের মুখ ও গুমোট। রিলিজ প্রসেস গম্ভীরতার সাথে সারছে দুজন। দৃশ্যপটটা ঝড়ের পরবর্তী সময়কার মতো লাগল নাজমুল সাহেবের। মনে প্রশ্ন জাগল, এদের কি আবার ঝগড়া হয়েছে? কেবিনভর্তি মানুষ থাকায় প্রশ্নদের উন্মুক্ত করতে পারলেন না। নিজের রুগ্নতার ব্যাথা ভুলে মনো ভাবনায় মজলেন তিনি। বাসায় ফিরবার সময় সুযোগ বুঝে জাওয়াদকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘তারিফের সাথে তোমার দ্বন্দ্ব বেধেছে আবার?’
মামা শ্বশুরের কপালে পড়া চিন্তার ভাজে চোখ পড়তেই হাসি স্মিত হাসল জাওয়াদ। মুখ থেকে গম্ভীরতা সরে গেছে তার। কৌতুকের সুরে বলল,
‘ ঘটনা তো ঘটে গেছে মামা।’
‘কী ঘটনা?’ নাজমুল সাহেবের স্বরে আতঙ্ক।
জাওয়াদ কৌতুকের সুতো টেনে ধীর স্বরে বলল, ‘ ভদ্রলোক তার বোনের কাছে যাবার জন্য আমাকে কনভেন্স করতে চাইছেন। পটাপটির কোন উপায় বাদ রাখছেন না। ‘
নাজমুল সাহেব অবিশ্বাস্য চোখে তাকালেন। জাওয়াদ হেসে বলল, ‘আমি কিন্তু এত তাড়াতাড়ি পটছিনা।’
নাজমুল সাহেব কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ চেয়ে রইলেন, তারপর হেসে উঠলেন। সেই হাসিতে যোগ দিল জাওয়াদ ও। নাজমুল সাহেবকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে অফিসে চলে গেল জাওয়াদ। যাবার কালে ফরিদা জিজ্ঞেস করলেন,
‘রাফা আসবে না?’
লায়লা আর তারিফের উপস্থিতি লক্ষ করে জাওয়াদ গম্ভীরমুখে জবাব দিল, ‘না।’
উনারা রুম থেকে যেতেই ধীরে বলল, ‘আপনার ননাশ গেলে কল দিয়েন, রাফাকে নিয়ে আসব আমি।’
•
বাতায়নের ধারে বসে আছে মুশরাফা। হাতে ফোন ধরা থাকলেও দৃষ্টি নেই ফোনের পর্দায়। দৃষ্টিতে উদাসীনতা নিয়ে তাকিয়ে আছে দূর আকাশে। রৌদ্রজ্জ্বল নীল আকাশে কী দেখছে কে জানে! কী এমন পড়ছে যা তার মনকে উদাস করছে! প্রশ্নগুলো মায়মুনার মনে উঁকি দিল, তড়িৎ তার জবাব ও মিলে গেল। এক অক্ষরের ‘মা’ শব্দটা তার জবাব। পৃথিবীটা সোনায় মুড়িয়ে দিলেও ‘মা’ এর জায়গাটা কাউকে দেয় যায় না। তার জায়গা তারই থাকে, মায়ের অভাব পোড়ায়। কারণ বুঝে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মায়মুনা। কিছু বললেন না। চুপচাপ উঠে গিয়ে গেলেন। তেলের হাতে নিয়ে দাঁড়ালেন পুত্রবধূর পাশে। ধীর স্বরে বললেন,
‘ তুমি না আমার মাথায় তেল লাগিয়ে দিচ্ছো?’
ধ্যান ভাঙল মুশরাফার। শ্বাশুড়ির পানে চেয়ে বলল, ‘স্যরি মা, মাথা থেকে সরে গিয়েছিল। বসুন।’
শ্বাশুড়ির মাথায় আলতো হাতে তেল মালিশ করছে মুশরাফা। আবেশে চোখ বুজে আছেন মায়মুনা। চোখ বন্ধ থাকলেও মুখ বন্ধ নেই। বউ শ্বাশুড়ির আলাপ চলছে। মায়মুনা বললেন,
‘তোমার মামার কী অবস্থা এখন?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। সকালে রিলিজ দিয়েছে। এখন বাসায় আছেন।’
‘তুমি যাবে না?’
‘বিকেল যাব ইন শা আল্লাহ। ‘
মায়মুনা কী যেন ভেবে বললেন, ‘ ইফতারের আগে ফিরবে। আজ আমি আর তোমার শ্বশুর এখানে ইফতার করব।’
‘আচ্ছা।’
সেই ক্ষণে জিহান এলো বাসায়। উৎফুল্লতার সাথে বলল, ‘চাচ্চি, আমি আজ রোজা রেখেছি।’
ভীষণ খুশি দেখাচ্ছে ওকে। ওর খুশি দেখে মুশরাফা নিজের দুঃখ ভুলে গেল। হেসে ফেলল। উৎসাহী সুরে বলল, ‘মা শা আল্লাহ। চমৎকার কাজ করেছো। আল্লাহ তোমাকে এর জন্য অনেক পুরষ্কার দিবেন।’
জিহানের খুশি বাড়ল। মুশরাফা ওর গাল টেনে বলল, ‘এই চমৎকার কাজের জন্য তোমার জন্য গিফট আছে। ‘
জিহান খুশিতে আটখানা। কৌতুহলী সুরে বলল, ‘কী গিফট? দাও।’
মুশরাফা রহস্য করে বলল, ‘সারপ্রাইজ। তোমার রোজা পূর্ণ হবার পর পাবে।’
‘সেটা কখন?’
‘ইফতারের পর।’
জিহান খুশির খবরটা পেটে চেপে রাখতে পারল না। মাকে জানানোর জন্য বাসায় চলে গেল। সে যেতেই মুশরাফা জাওয়াদকে কল দিল। ধরতেই বলল,
‘অফিস থেকে ফেরার সময় একটা কেক, অনেক গুলো চকলেট আর জিহানের পছন্দের সবচেয়ে দামী খেলনা নিয়ে আসবেন। সেই সাথে ইসলামিক গিফট প্যাকেজ ও আনবেন। কুরআন শরীফটা যেন আকর্ষণীয় হয়।’
ফোনের অপাশ থেকে জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল, ‘ কী উপলক্ষে? ‘
মুশরাফা উচ্ছ্বসিত হেসে বলল,
‘ জিহান আজ প্রথম রোজা রেখেছে। আর হ্যাঁ, সব কিন্তু র্যাপিং পেপার মুড়িয়ে আনবেন। ‘
‘ রোজা রাখার জন্য এত উপহার!’
মুশরাফা হেসে বলল, ‘আল্লাহ তো আরও বেশি দিবেন। আমরা অল্পখানি দিই। জিহান আজ কত মহৎ একটা কাজ করছে! আজ ওর উন্নতির দিন। ওর এই উন্নতিতে আপনজন হিসেবে আমাদের ও কর্তব্য দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখার, একে বাহ্বা দেয়ার। ‘
জাওয়াদ প্রসন্ন হাসল, ‘ আমাদের দেশে বাচ্চাদের প্রথম রোজায় একটা হাসি ছাড়া আর কিছুই দেয়া হয়না।’
মুশরাফা বলল, ‘ আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের একাডেমিক শিক্ষা কিংবা ভালো রেজাল্টের জন্য এপ্রিশিয়েট করা হয়, ধর্মীয় কাজের জন্য নয়। একটা বাচ্চার ভালো রেজাল্ট যেভাবে উৎযাপন করা হয়, তেমনি যদি তার জীবনের প্রথম নামাজ রোজার দিনটাকে উৎযাপন করা হতো তবে বাচ্চারা ধর্মের বিধানের প্রতি বেশি আগ্রহী হতো। শিশু জীবনের প্রথম রোজা রাখবার পর যদি পরিবারের পক্ষ থেকে উৎসাহ পায় তবে ভবিতব্যে সে এ কাজের প্রতি আগ্রহী হবে। অবুঝ হবার দরুন ধর্মীয় গভীর বাণী তাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে না, তাই তাকে দুনিয়াবি বিভিন্ন জিনিস দিয়ে ধর্মের দিকে ফেরাতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে এটা ভালো কাজ, ভালো কাজ করলে পুরষ্কার পাওয়া যায়। ‘
থেমে বলল,
‘মামাকে দেখতে সন্ধ্যার পর যাব। জিহানের এই অবিস্মরণীয় দিনে আমি ওর পাশে থাকতে চাই। আমি কী পরিমাণ খুশি লাগছে, ইচ্ছে করছে ওকে দুনিয়ার সবচেয়ে দামী উপহার দিই। বাচ্চাটা কত ভালো কাজ করেছে!’
মুশরাফার কথার ভান এমন যেন জিহান তারই সন্তান। সে দুনিয়া জয় করেছে। জিহান তার সন্তান নয়, তবে জিহানকে সন্তানের মতোই স্নেহ করে।
ফোনের ওপাশে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে জাওয়াদ। কী চমৎকার ভাবনা এই মেয়ের! এপাশে প্রজ্বল্যমান মুখে পুত্রবধূর পানে তাকিয়ে আছেন মায়মুনা। মা ছেলের চোখে মুগ্ধতা। মনে শ্রদ্ধা। প্রতিটা পরিবারে এমন মহৎপ্রাণ এক নারী থাকলে ঘরটা সুখে ভরে উঠবে। জাওয়াদ প্রশ্রয়ের সুরে বলল,
‘ ভাসুর ছেলের রোজা রাখায় এত খুশি! নিজের ছেলেমেয়ে রোজা রাখলে কী করবে? ‘
প্রফুল্লতায় মুশরাফা বলে ফেলল, ‘আমার ছেলেমেয়ে হলে তো…
বলবার সময় শ্বাশুড়ির দিকে নজর গেল। মায়মুনা তার পানে চেয়ে আছেন। অভ্যন্তরীণ কথা বলা টের পেয়ে থেমে গেল সেখানেই। অস্বস্তিতে গলা কাঁপল, লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। চোখ ঘুরাল অন্যদিকে। খু খু করে কেশে উঠল। জাওয়াদ হেসে বলল,
‘থামলে কেন? বলো?’
মুশরাফা চোখ মুখ খিঁচে নিশ্চুপ বসে আছে। কী বিব্রতকর পরিস্থিতি! মায়মুনা চাপা হাসলেন। কিছু মনে করবার ভান করে বললেন,
‘জাহিন গেছে যে দরজা লাগানো হয়নি, আমি দরজা লাগিয়ে দিয়ে আসি।’
মায়ের উপস্থিতি টের পেয়ে জাওয়াদের হাসির মাত্রা বাড়ল। রগড় করে বলল, ‘ দাদী হিসেবে মায়ের ও অধিকার আছে শুনবার। মাকে ও শুনাও।’
ষোড়শী কিশোরীর মতো লজ্জায় নেতিয়ে পড়ে মুশরাফা বলল, ‘যাহ্! ‘
‘হায় হায়! বউ তো লজ্জা পেয়ে গেছে।’ জাওয়াদ শব্দ করে হেসে ফেলল। মুশরাফা ফোন রেখেই দিল।
শুধু শুধু এ রুম ও রুম ঘুরলেন মায়মুনা। মিনিট দশেক বাদে বাইরে থেকে ডাকলেন। স্বাভাবিকতার ভান করে বললেন,
‘ মুশরাফা, কিচেনে তো অনেক পিপড়া।’
বলতে বলতে রুমে প্রবেশ করলেন। আগের জায়গায় বসে পড়লেন। মুশরাফা কিছুটা স্বাভাবিক হলো। শ্বাশুড়ির মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ।’
মায়মুনা পরামর্শ দিলেন, ‘জাওয়াদকে আসার সময় পিঁপড়া মা/ রা র ওষুধ আনতে বলো। রাতে দিয়ে ছিটিয়ে দিবে, সকালে উঠে দেখবে সব মা/রা গেছে।’
মুশরাফা বিস্ময় নিয়ে তাকাল। তারপর ধীর স্বরে বলল, ‘ আল্লাহ মাফ করুক। এই কাজ আমার দ্বারা না হোক।’
মায়মুনা ভ্রু কুঁচকালেন, ‘এভাবে বললে কেন? ‘
‘পিঁপড়া মা/রা র ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে।
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চার প্রকার প্রাণী হ/ ত্যা করতে বারণ করেছেনঃ পিঁপড়া, মধুমক্ষিকা, হুদহুদ পাখি এবং চড়ুই সদৃশ বাজ পাখি।’
মায়মুনা বিস্ময় নিয়ে চাইলেন। এই হাদিস শুনেন নি তিনি। কৌতুহলী হয়ে বললেন, ‘ পিঁপড়ার মতো ক্ষুদ্র একটা প্রাণী কী এমন করে যে তাকে মা/ রা যাবে না!
শ্বাশুড়ির মাথায় বিলি কাটতে কাটতে মুশরাফা বলল,
‘ আল্লাহ প্রতিটি প্রাণীকে কোনো না কোন বিশেষত্ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। যার দ্বারা মানবকূলের কোন উপহার হয়। পিঁপড়া পৃথিবীকে ঠান্ডা রাখে। প্রাণীকুলের মধ্যে আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকা প্রাণীর অন্যতম হলো পিঁপড়া। এরা সারাক্ষণ আল্লাহ জিকির করে। পিঁপড়া মা/ রার নিয়ে হাদিসে এসেছে,
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ একদা একটি পিঁপড়া এক নাবীকে কা/ মড় দিলে তাঁর নির্দেশে সব পিঁপড়া জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আল্লাহ ঐ নাবীর নিকট ওহী পাঠালেনঃ তোমাকে একটি মাত্র পিঁপড়া কামড় দিয়েছে। অথচ তুমি তাসবীহ পাঠরত একটি উম্মাত ধ্বং/স করে দিলে! (আল হাদিস)’
মায়মুনা শুনলেন, মুগ্ধ হলেন। তারপর আবার প্রশ্ন করলেন, ‘পিঁপড়া আমাদের অনেক বিরক্ত করে, জিনিসে বসে, আশপাশ ঘুরে। কাজে ব্যাঘাত ঘটায়, তবে তাদের সরাতে পারব না?’
মুশরাফা ভেবেচিন্তে বলল, ‘পারবেন। ধরুন, কিচেনে এখন অনেক পিঁপড়া দেখলেন। আপনার পছন্দ হচ্ছে না, তাহলে তাদের না মে/ রে হালকা পানি ছিটিয়ে দিন দেখবেন তারা অন্যত্রে চলে যাবে। তবে ভালো হবে তাদের এড়িয়ে গেলে। তারা তাদের মতো থাকুক, চলুক। আপনি আপনার মতো থাকুক। জিকিররত একটা উম্মতকে ঘরে রাখতে পারাও তো সৌভাগ্যের কাজ।’
মায়মুনা তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলেন না। খানিক বাদে বললেন, ‘না জেনে কত পিঁপড়া মে/রে ফেলেছি। আল্লাহ আমাকে মাফ করবে না?’
তার স্বরে আফসোস, চোখে অনুতাপ। এই ক্ষণে মায়মুনার চেহারার সাথে জাওয়াদের চেহারা মিল খুঁজে পেল। ও হাদিস বলবার পর জাওয়াদের মুখভঙ্গি ও এমন হয়। মুশরাফা হাসল। উৎসাহী গলায় বলল, ‘না জেনে গুনাহ করলে ক্ষমা আছে, জেনে গুনাহ করলে ক্ষমা নেই। আপনি না জেনে ভুল করেছেন, আল্লাহ কাছে মাফ চেয়ে নিবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল। ‘
তেল দেয়া শেষ। মুশরাফা বেনুনি করে দিল। উঠে দাঁড়াবার সময় মায়মুনা পুত্রবধূর মাথায় হাত বুলালেন। মন থেকে দোয়া এলো তার।
•
প্রচলিত ধ্যানধারণা থেকে কাকনের তেমন কোন পরিকল্পনা ছিল না। মুশরাফা গিয়ে জা’কে নিজের পরিকল্পনার কথা জানাল। নিজের ছেলেকে নিয়ে জা’য়ের উৎফুল্লতা দেখে খুশি হলো কাকন। সেই সাথে শ্রদ্ধা জন্মাল। মুশরাফার ভাবনায় মুগ্ধ হলো। স্বামীকে ফোন দিয়ে ছেলের জন্য উপহার আনতে বলল। দু’জা মিলে ইফতারকে বিশেষ করবার পরিকল্পনা করে ফেলল। বাবা চাচা উপহারের পাহাড় নিয়ে ফিরল। বাসায় জাঁকজমক আয়োজনে ইফতার করা হলো। জাওয়াদ খেলনা, চকলেট দিল। মুশরাফা দিল ইসলামিক বক্সটা। জিহান বেজায় খুশি। রোজা রাখার ক্লান্তিবোধ চলে গেছে। সার্থকতা হাসি টেনে বলছে, আমি কালও রোজা থাকব।
ইফতার করে মুশরাফাকে নিয়ে নাজমুল সাহেবের বাসায় গেল জাওয়াদ। লায়লা বিকেলে ফিরে গেছেন। রাত থেকে সকাল ফিরল বাসায় ওরা । আসবার কালে তারিফের সাথে দেখা হলো। কথা না বলে স্ত্রীকে নিয়ে পাশ কেটেছে জাওয়াদ। অফিসে যাবার পর তারিফের নাম্বার থেকে কল এলো জাওয়াদের নাম্বারে। জাওয়াদ তুলেনি। বেজে কেটে গিয়েছি। তারিফ ম্যাসেজ করেছে, ‘ কিছু কথা ছিল। সময় হবে?’
ম্যাসেজ দেখে জাওয়াদ বলল, ‘কেমন প্রেমিক প্রেমিক ধরণের কথা বলে এই লোক। সময় হবে না আমার।’
রিপ্লাই করল না সে। এড়িয়ে গেল। ব্যাপারটা এখানেই থেমে রইল না। সময় বাড়ার সাথে সাথে তারিফের ফোনকল, ম্যাসেজের পরিমাণ বাড়তে লাগল। তার বিনীত অনুরোধ, জাওয়াদ যেন তার ফোন তুলে। জাওয়াদ তুলল না। কেবল ম্যাসেজ করল,
‘ আমি ব্যস্ত আছি।’
সেই ক্ষণে ওর ব্যস্ততা বলতে বন্ধুর জন্য কেনাকাটা করা। আড়ং এ গিয়েছে জাওয়াদ। গভীর মনোযোগ দিয়ে পাঞ্জাবি দেখছে। কালো পাঞ্জাবি। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বেছেবেছে সবচেয়ে সুন্দর পাঞ্জাবিটা নিল বন্ধুর জন্য। তারপর গেল অনিকের বাসায়। ওকে দেখে অনিক বলল,
‘ বিয়েশাদির পর আজকাল তো কালেভদ্রে ও এমুখো হোস না। আজ কী মনে করে? ‘
জাওয়াদ হাতে ধরা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘নে, ধর।’
‘কী?’
‘নিজেই দ্যাখ।’
কৌতুহল নিয়ে হাতে নিল অনিক। ভেতরে পাঞ্জাবি দেখে বিস্মিত চোখে চাইল বন্ধুর পানে। জাওয়াদ হেসে বলল, ‘তোর টাকা বাঁচাই দিছি। এই পাঞ্জাবির লোভে পড়েই তো আমার বিয়ের উকিল বাবা হয়েছিলি। নে, তোর লোভের ফল।’
অনিক বিরক্তিভরে বলল, ‘আমি মজা করছিলাম শা লা। তুই সিরিয়াসলি নিয়া নিলি?’
জাওয়াদ সে কথার উত্তর দিল না। আকস্মিক বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল। তুষ্ট, কৃতজ্ঞ স্বরে বলল, ‘ থ্যাঙ্কিউ। জাযাকাল্লাহু খায়রান। তোর একটা পদক্ষেপে জন্য আমি একটা জীবন পেয়ে গেছি। এর বিনিময়ে এক পাঞ্জাবি না আমি যদি সারাজীবনের অর্জিত সম্পদ ও দিয়ে দিই তবে কম হবে। যে রত্ন আমি পেয়েছি তা যে অমূল্য। এর পুরষ্কার আমি দিতে পারব না, আল্লাহ থেকে নিস তুই। আমি দোয়া করি, আল্লাহ তোকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পুরষ্কার দিক
‘
এতক্ষণে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা গেল অনিকের। একটা সফল কাজের পুরষ্কার পেল যেন। বিয়ের দু’দিন বাদে বিয়ে করানোর জন্য দোষারোপ করা বন্ধুর মুখে আজ এতকাল বাদে কৃতজ্ঞ, তুষ্টতা দেখে অনিকের প্রাণ শীতল হয়ে এলো। সার্থক, সার্থক, সব সার্থক। অনিক হাসল। বন্ধুর পিঠ চাপড়ে বলল,
‘এবার তুই উকিল বাবা হয়ে আমার জন্য রত্ন খুঁজে দে। আমি ও সুখী হই।’
‘ আল্লাহ তোর জন্য চমৎকার কাউকে রেখেছেন। সে এসে যাবে ইন শা আল্লাহ। আমি মাধ্যম হতে পারলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করব। ‘
•
হতাশার শ্বাস ফেলে জাওয়াদের নাম্বারে আবার ডায়াল করল তারিফ। আজকের দিনে এটা তার পঁচিশতম কল। কদিন যাবত অনবরত কল ম্যাসেজ দিচ্ছে জাওয়াদকে। কিন্তু জাওয়াদ আশানুরূপ সাড়া দিচ্ছে না। তারিফের হতাশার পাল্লা করবার পায়তারা করছে যেন সে। এই সম্পর্কের টানাপোড়েনে হাঁপিয়ে গেছে তারিফ। ওর মনে হচ্ছে এতকাল সে বেহুশ ছিল। হুশ ফিরতেই দেখল তার পুরো জীবনটা এলোমেলো হয়ে আছে। তার জীবনে তার আদরের বোনটি নেই, যেন কিছুই নেই। এত বছর বাদে ছোটোবেলার সেই টান অনুভব করছে বোনের জন্য।
বোনের সাথে কথা অন্যায়ের জন্য ভেতরে ভেতরে পুড়ে ছাই হচ্ছে। কতদিন শান্তির ঘুম হয়না, চোখ বন্ধ করলেই তার চোখের সামনে তার আদরের মুশিকে মারার দৃশ্য চোখে ভাসে। নিজের প্রতি ধিক্কার জাগে, আমি কেন এগিয়ে গেলাম না। আমি থাকতে আমার মুশি এত কষ্ট পেল কিভাবে? আমি কিভাবে দিলাম? আমার আদরের ছোট্টো মুশি! বাবার বাড়িটায় ফিরলেই পুরনো স্মৃতি স্মরণে আসে। আজকাল বাবার বাড়িতে ফেরা হয়না। নিজের ফ্ল্যাটেই থাকে। আক্ষেপ, অনুতাপ, অনুযোগ, ব্যর্থতা, হতাশায় ধুকে মরে। আজকাল কেমন উদাস হয়ে থাকে সবসময়। কোন কিছুতেই শান্তি পায় না। পাবে ও না যতক্ষণ অবধি না মুশির থেকে মাফ না চাইছে। কিন্তু সে অপারগ। মুশির স্বামী পথ আগলে রেখেছে। এত চেষ্টা করছে, ছেলেটা ধরাই দিচ্ছে না। এই ইদটা বোনের সাথে করবার ইচ্ছে তারিফের। মেয়েটা পরিবারহীনতায় ভুগছে। ওর সঙ্গ পেয়ে কিছুটা কমবে। এতগুলো বছর বাদে বোনকে ফিরে পাবার আকাঙ্ক্ষায় মন উতলা হয়ে আছে। কিন্তু সেই আকাঙ্খাকে আক্ষেপে পরিনত করছে বোনের স্বামী। কল ম্যাসেজে না পেয়ে তারিফ জাওয়াদের অফিসের দিকে রওনা হলো।
তখন অপরাহ্নের দ্বিতীয় প্রহর। অফিস ছুটির পর সবে অফিস থেকে বেরিয়েছে জাওয়াদ। অফিস এরিয়া পার করবার সময় কোথা থেকে তারিফ এসে দাঁড়াল সামনে। কোন ভণিতা ছাড়াই বলল,
‘ঠিক কী করলে তুমি আমাকে আমার বোনের সাথে দেখা করতে দিবে? বলো, আমি সব করতে রাজি। তবুও আমার বোনের সাথে দেখা করতে দাও। ‘
এই অবেলায় শ্যালককে দেখে অবাক হলো জাওয়াদ। বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ল তার কথায়, তার চোয়াল দেখে। দ্বিতীয় সাক্ষাতের সেই তারিফের সাথে মেলাতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। আকাশ পাতাল ব্যাবধান। সেইদিনকার মত আজ তারিফের চোয়ালে দাম্ভিকতা নেই, স্বরে রাগ নেই, অহং নেই। আজকের তারিফ কোমল, অনুতপ্ত। সেদিন যে ছিল সে শুধুই তারিফ ছিল, আজ যে আছে সে শুধু ভাই। একজন ভাই। যার কাছে তার বোন সবার আগে। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। নিজের অহং, দাম্ভিকতা সব ঠেলে তারিফ হাত জোর করল।নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে বলল, ‘প্লিজ!’
জাওয়াদ স্তম্ভিত, স্তব্ধ, বিস্মিত, হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল তার সামনে দাঁড়ানো এক ভাইয়ের দিকে।
চলবে…
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা