#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি
#দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-২১)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।
ছাদের রেলিঙে ঠেস দিয়ে আরাম করে দাঁড়াল জাওয়াদ। আনন্দে আটখানা হয়ে বলল,
‘ আলহামদুলিল্লাহ! অবশেষে আপনার মনে পড়েছে রাফা আপনার বোন। আ’ম সারপ্রাইজড! মসজিদে মিষ্টি বিতরণ করার মতো খুশি লাগছে আমার।’
এরপরেই ওর স্বর গম্ভীর হলো। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
‘ তা এই সুপ্ত ভ্রাতৃত্ব কোথায় ছিল এতদিন? তখন কোথায় ছিল, দিনের পর দিন রাফা যখন অত্যাচার হচ্ছিল? কেমন ভাই আপনি, জ্যান্ত বোনটাকে মারার পথে ঠেলে দিয়ে এখন ভাতৃত্ব দেখাতে আসছেন! তখন যদি এভাবেই জোর গলায় ওর পক্ষ হয়ে একটা কথা বলতে পারতেন তবে ওর গায়ে আজ এত আঘাতের চিহ্ন থাকতো না। ‘ভাই’ শব্দের মানে বুঝেন? উড়ে এসে যে কেউ ভাই পরিচয় দিলেই তার সাথে আমার স্ত্রীকে দেখা করতে দিব? এতই সোজা? ‘
জাওয়াদের এতসব কথা কানেই তুলল না তারিফ। বিরক্তিমাখা ভরাট স্বর,
‘ আমার বোনের সাথে আমি দেখা করব, তুমি বাধা দেয়ার কে?’
‘আমি ওর হাজবেন্ড, ওর অভিভাবক। যে ওকে অনিরাপদ জীব থেকে আগলে রাখতে জানে। আপনাদের কাছে আমার স্ত্রী নিরাপদ নয়, মানুষ খুন করার মতো পা/ষণ্ড স্বভাব আছে আপনাদের। আপনারা মানুষ হলে আমি নির্দ্বিধায় দেখা করতে দিতাম। ‘ জাওয়াদের স্বর গম্ভীর থেকে গম্ভীর হচ্ছে। তারিফ রেগে গেল। চেঁচিয়ে বলল,
‘ আমরা অমানুষ! হাউ ডেয়ার ইউ টক টু মি লাইক দেট?’
জাওয়াদের স্বর উঁচু হলো। এ যাবত কালে জমিয়ে রাখা সব রাগ ঢেলে দিল স্বরে,
‘ একটা মেয়েকে সামান্য পর্দা করার জন্য তাকে পি/টিয়ে জখম করে ফেলেছেন, খাওয়া দেননি, ভালো ব্যবহার টুকু ও করেন নি কখনো, গৃহবন্দী করে রেখেছেন দিনের পর দিন। পুরো পরিবার থেকেও একাকীত্বের মাঝে গুটে ম*রেছে মেয়েটা। সারা শরীরে মা*রের দাগ নিয়ে ও আপনাদের সাথে সদ্ব্যবহার করে গেছে, একটা ভালো ব্যবহারের আক্ষেপ করেছে, তাও করেন নি। রাস্তার কুকুরের চেয়ে ও খারাপ ব্যবহার করেছেন। আজ ওকে বোন ভাবলেও তখন ওকে মানুষই ভাবেন নি, বোন তো দূরে থাক। একজন মা, একজন বাবা, ভাই এমনটা কিভাবে করতে পারে? মানুষের দ্বারা সম্ভব বলে তো মনে হয়না। আপনাদের মানুষ হওয়া নিয়ে আমার মনে শঙ্কা জাগে।’
এই বেয়াদব ছেলের সামনে ছোটো হতে রাজি নয় তারিফ। রাগে হুঙ্কার ছাড়ল,
‘ আমার বোনের হাসবেন্ড না হলে আমি তোমাকে খু/ন করতাম।’
ওর রাগের বিপরীতে হেসে উঠল জাওয়াদ, ‘ গায়ে লাগছে, তাই না? আমারও এমন গায়ে লেগেছিল, যেদিন রাফাকে হাসপাতালের বেডে কাতর হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। বিয়ের পর সত্যটা জানার পর ইচ্ছে করছিলো আপনাদের সবগুলোকে খু/ন করি। রাফার গায়ের দাগগুলো যতবারই চোখে পড়ে ততবারই আমার ইচ্ছে করে খু/ন করে আসতে। সাতখু/ন মাফ হলে এখন আপনি আমার সাথে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলার জন্য এই দুনিয়ায় থাকতেন না। রাফা ভুলোমন হলেও আমি ভুলোমন না। সব হিসেব কষতে জানি। কথাটা মাথায় রাখবেন।’
তারিফ জেদী স্বরে বলল, ‘ তোমার যা ইচ্ছে ভাবতে পারো, আই ডোন্ট কেয়ার। বাট মনে রেখো, ওকে মানাতে আমার বেশিক্ষণ লাগবে না। এক দেখাতেই আমি ওকে আমার বোন হিসেবে পেয়ে যাব।’
জাওয়াদ হাসল ভীষণ, ‘ আমি পুরো প্যাটার্ন এঁকেই নেমেছি। রাফাকে অলরেডি সেই প্যাটার্নের মাঝে আঁকড়ে ধরেছি। এখন দেখা হলে আমার অনুমতি ছাড়া রাফা আপনাকে চিনবে ও না। কথা বলা তো দূরে থাক। বলে রাখা ভালো, আমি এখন অনুমতি দেয়ার মুডে নেই। ফোন ছাড়ছি। দয়া করে বিরক্ত করবেন না।’
তারিফ আবার চেঁচিয়ে উঠল। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে নিজের স্বরূপে ফিরে এলো, ‘ ইউ ব্লা…..* আমার সাথে এভাবে কথা বলার সাহস কোথায় পাস তুই? জানিস আমি কে? আমি চাইলে তোকে এখুনি জেলে পুরে ফেলতে পারি। নেহাৎ আমার বোন তোর কাছে আছে বলে চুপ আছি নয়তো এদ্দিনে তোকে মে/রে লা/শ গুম করতে দুইবার ভাবতাম না আমি। তোর মতো ছেলেকে গুড়িয়ে দেবার জন্য আমার একটা ফোনই যথেষ্ট। কালকের মধ্যে আমার বোনকে আমার কাছে দিয়ে যাবি। ‘
তারিফ কয়েকটা বিশ্রী গালি দিল। জাওয়াদের মুখ লাল হয়ে গেল। রাগে, অপমানে। ঘাড়ে হাত বুলিয়ে রাগ সংবরণের চেষ্টা করল। হাজারখানেক গালি মনে আসছে। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে দিতে চাইছে না। বিড়বিড় করে বলল, ‘হাম শারিফ কেয়া হুয়ি, সারি দুনিয়া বাদমাইশ হো গায়ি। ‘
তারপর দাঁত চেপে বলল, ‘ আপনার ধারণা ও নেই, আমি আপনার কী করতে পারি?’
আত্ম অহংকারী তারিফের চোখে জ্বলজ্বল করছে,
‘ কী করবি তুই? আমার সাথে টাক্কা দেয়ার ক্ষমতা আছে তোর?’
‘ ভার্সিটি লাইফে আপনার মতো এক’শটা তারিফকে আমি একাই হ্যান্ডেল করতে পারতাম। রাতের আঁধারে হাসপাতালে পাঠালে দিনে কাক ও টের পেত না। এখন করলে ও টের পাবেনা। কিন্তু আমি এত পরিশ্রমের কাজ করব না। আমি শুধু ছোট্টো একটা কাজ করব। এই যে একটু আগে আপনি আমাকে যত গালি দিলেন, বাজে কথা বললেন তা রাফাকে শুনাব। বিষয়টা এমনভাবে উপস্থাপন করব যে, এতদিন না আসা ঘৃণা এবার আসতে বাধ্য হবে। করব?’
তারিফ জব্দ হয়ে চুপ হয়ে গেল। এই ছেলে তো দেখি ভারি ডে/ঞ্জারাস।
জাওয়াদ বলল, ‘ আমি রাফার জীবনে আসার আগে ওর লাইফে নিজের পরিবার বলতে কেউ ছিল না। আপনাকে দরকার ছিল ওর, কিন্তু আপনি ছিলেন না। এখন আমি ওর লাইফে আছি, এখন আর আপনাকে প্রয়োজন নেই। আমার সাথে টাক্কা দিতে আসবেন না। আমি মানুষটা খুব একটা সুবিধার না। নিজের মতো থাকুন, আমার স্ত্রীকে বিরক্ত করবেন না।’
তারিফ দাম্ভিক হয়ে বলল, ‘ভালোয় ভালোয় বলছি আমার বোনকে ফেরত দে। নাহলে আমার বোনকে আটকে রাখার অপরাধে আমি তোর নামে অপহরণ মামলা দিব। লাইফ ক্যারিয়ার সব খেয়ে সারাজীবন জেলে পার করবি।’
ওর দাম্ভিকতা দেখে জাওয়াদ অবাক হচ্ছে। এত অন্যায়ের পর ও লোকটার মাঝে নম্রতা নেই, অপরাধবোধ নেই। কোথায় তাকে অনুরোধ করে বোনের সাথে যোগাযোগ করতে চাইবে। তা না, শক্ত হয়ে ওকে হুকুম করছে। এ লোক ভাঙবে তবু মচকাবে না। জাওয়াদ ও ভাঙতে জানে। সে রাগ রাগ নিয়ে বলল,
‘ একটা মানুষের সাথে এত অন্যায় করার পর ও আপনার এই দাম্ভিকতা আসে কোথা থেকে? জোর গলায় কথা বলতে লজ্জা করছে না? একটু ও বিবেকে বাধছে না? পাপবোধ হচ্ছে না? আপনাদের পুরো পরিবারের এই অহংকার যদি আমি চূর্ণ না করেছি তো আমার নাম ও জাওয়াদ না। সাত ঘাটের পানি খাওয়ানোর আগে আমার স্ত্রীর নাগাল পাবেন না আপনারা, কথাটা মনে রাখবেন। ঠিক যতটা আকুতি ও আপনাদের স্নেহ পাওয়ার জন্য করেছে, তার চেয়ে দিগুণ আকুতি আপনাদের করতে হবে ওর ক্ষমা পাওয়ার জন্য। ‘
জাওয়াদের শাসানিতে তারিফ হুঙ্কার ছাড়তে গেল, ‘ইউ ব্লা….
জাওয়াদ হিসহিসিয়ে বলল, ‘ডোন্ট ইউ ডেয়ার রিপিট দিস ওয়ার্ড। সাহস করবেন না। আমি রাফা নই, যে কেউ এসে আমাকে শুনিয়ে যাবে, পিটিয়ে যাবে আর আমি চুপ থাকব। আমি ইটের বদলে পাটকেল ছুঁড়তে জানি। সুতারাং নেক্সট টাইম আমার সাথে কথা বলার সময় সাবধানে কথা বলবেন। দাম্ভিক নয় নত হবেন, নিবেদন করবেন। রাফার কাছে অনেক বড়ো হয়েছেন, এবার আমার কাছে ছোটো হবেন। আদেশ নয়, অনুরোধ করবেন। রাফা আর আপনাদের মাঝে আমি আছি, আমাকে টপকে রাফার নাগাল পাবেন না। মাইন্ড ইট।’
তারিফ গমগমে গলায় বলল,
‘আমার সাদাসিধে বোনকে এভাবে আটকে রাখার অধিকার নেই তোর। আমি গাড়ি পাঠাবো। ভালোয় ভালোয় ওকে পাঠিয়ে দিবি। নয়তো আমি পুলিশ নিয়ে হাজির হবো। ওকে আমার বাসায় আর তোকে জেলে পাঠাব। মনে রাখিস।’
জাওয়াদ বিরক্তির ভান করল, ‘বারবার আটকে রাখা আটকে রাখা বলছেন কেন? ওটাকে আটকে রাখা বলে না, বরং সংসার করা বলে। রাফা আমার লিগ্যালি ওয়াইফ। এডাল্ট মেয়েকে ওর পরিবারের উপস্থিতিতে বিয়ে করেছি, এখন সংসার করছি। এখানে ঠিক কোন আইনের ভিত্তিতে মামলা করবেন আমি জানি না। তবে হ্যাঁ, আপনি বিরক্ত করলে আমার স্ত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগে একটা মামলা আমি ও করতে পারি। রাফার শরীরে দাগ আছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে সহজ মামলা হলো নারী নির্যাতন মামলা। এদিক ওদিক হলেই হিট। আমাকে আটকাতে গিয়ে আপনারাই আটকে যাবেন। তাই এসব লেইম পরিকল্পনা বাদ দিয়ে নিবেদনের প্র্যাকটিস করুন। কাজে লাগবে।’
তারিফ যেন পেরে উঠছে না জাওয়াদের সাথে। রাগ, হুমকি, শাসানো কিছুতেই দমানো যাচ্ছেনা এই ছেলেকে। একটা বললে দশটা শুনিয়ে দিচ্ছে। রাগের বিপরীতে ক্ষোভ ঝাড়ছে। এই ছেলে আসোলেই সুবিধার না, ভয়ংকর। রাফা কিভাবে সংসার করছে ওর সাথে? মেয়েটা তো একবারে সাদাসিধে, এই রাগী, ধূর্ত ছেলের সাথে পেরে উঠতে পারছে তো? আবারও বোনের চিন্তা এসে হানা দিল তারিফের মনে। সে আর কথা খুঁজে পেল না। ফোন ছাড়ার পরিকল্পনা নিয়ে বলল, ‘ আমি তোকে দেখে নিব।’
জাওয়াদ বলল, ‘আপনাকে দেখানোতে আমি ইন্টারেস্টেড নই। আপনি অন্য কাউকে দেখুন। ‘
তারিফের কান ঝাঁঝাঁ করে উঠল। তড়িৎ ফোন কেটে দিল। স্ত্রীর বড়ো ভাইয়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে! ম্যানারস নেই, বেয়াদব।
ফোন রেখে বিস্তর হাসল জাওয়াদ। অনেক দিনের জমানো ক্ষোভ ঝাড়তে পেরে শান্তি লাগছে। আর একটু লায়লার উপর ঝাড়তে পারলে শান্তির ষোলকলা পূর্ণ হতো। জাওয়াদ আকাশের দিকে তাকিয়ে অনুতপ্ত হয়ে বলল,
‘ জাস্ট রাফার ফ্যামিলি ইস্যু সলভ হোক আমি পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবে, প্রমিজ। এখন একটু বেয়াদবি করব, প্লিজ মাফ করে দিও আল্লাহ।’
বাসায় পৌঁছতেই রাফা বলল, ‘ ঘুমের মাঝে কোথাও উধাও হয়ে গেলেন। আমি খুঁজেই হয়রান।’
জাওয়াদের মন ভালো। মেয়েটার চোখ ওর চিন্তায় অস্থির। জাওয়াদ ওর চিন্তা দেখে চমৎকার হেসে বলল, ‘ পুরনো হিসেব চুকাতে গেছি।’
মুশরাফা ভ্রু কুঁচকাল, ‘কী হিসেব?’
‘এখন বলা যাবে না।’
‘কেন!’
‘পরে একবারে সুসংসাদ দিব বলে।’
মুশরাফা বাঁকা স্বরে বলল, ‘ সুসংবাদ আমার দেয়ার কথা ছিল না? আপনি দিচ্ছেন? যাক, আমি কষ্ট থেকে বাঁচলাম। থ্যাঙ্কিউ। আপনাকে সুন্দর লাগবে।’ উদাস হয়ে কী যেন কল্পনা করল মুশরাফা। তারপর হেসে ফেলল। থামলই না। হাসতে হাসতে বিছানায় বসে পড়ল।
অর্থবহ কথার মর্মার্থ বোধগম্য হতে পাক্কা দুই মিনিট লাগল জাওয়াদের। বুঝে উঠতেই চকিত চাইল। ওর কান ঝাঁঝাঁ করে ওঠল। খু খু করে কেশে ওঠল। কী পাজি মেয়ে! আর ভাই বলে না কি বোন সাধাসিধে, এটা সাধাসিধের নমুনা!
•
দিনটা ছিল শুক্রবার। সতেরো রমজান। সবাই বাসায়। মুশরাফা সকাল সকাল গোসল সেরে কুরআন নিয়ে বসেছে। আজ সুরা কাহফ পড়বে। শুক্রবারে সুরা কাহফ পড়ার বিশেষ ফজিলত আছে।
“আবু সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমআর দিন সূরা কাহফ পাঠ করে, সে ব্যক্তির জন্য দুই জুমআর মধ্যবর্তী সময় নুরময় হয়ে যায়।’ (হাকেম, বাইহাক্বী, সহীহুল জামে)’
মুশরাফা এর কিছু অংশ মুখস্থ ও করেছে। এটি মুখস্থ করলে দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচা যায়।
“আবূ দার্দা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সুরা কাহফের প্রথম দিক থেকে দশটি আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের (ফিৎনা) থেকে পরিত্রাণ পাবে।’ অন্য বর্ণনায় ‘কাহফ সূরার শেষ দিক থেকে’ উল্লেখ হয়েছে। (মুসলিম)
শুক্রবারে যত ব্যস্ততা থাকুক কাহফ পড়তে ভুলে না মুশরাফা। আজ ও বেশ সময় নিয়ে ধীরেধীরে, অর্থ বুঝে কুরআন পড়ল। ওর বসার খানিক বাদে আরেকটা কুরআন শরীফ নিয়ে এসে পাশে বসল জাওয়াদ। মুশরাফার প্রচেষ্টায় কুরআন বেশ আয়ত্তে এসেছে ওর। এখন দেখে পড়তে পারে। ধীরে ধীরে সে ও কাহফ পড়ল। শেষ পাতায় আসতেই মায়মুনা ডেকে উঠলেন,
‘জাওয়াদ, এদিকে আয় তো? জরুরি কথা আছে।’
আর কয়েক লাইন বাকি। জাওয়াদ ভাবল শেষ করে একবারে উঠবে, তাই জবাব না দিয়ে পড়া শেষ করায় মন দিল। মায়মুনা আবার ডাকলেন। জাওয়াদ জবাব দিল না।
মুশরাফার কুরআন বন্ধ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। জাওয়াদ কুরআন শেষ করে জবাব দিল, ‘আসছি মা।’
মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘একটা হাদিস শুনাই?’
জাওয়াদ কুরআন বন্ধ করতে করতে ভ্রু নাড়াল। মুশরাফা বলল,
“আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেন, এক মহিলা তার ছেলেকে ডাকল। তখন তার ছেলে গীর্জায় ছিল। বলল, হে জুরাইজ! ছেলে মনে মনে বলল, হে আল্লাহ্! এক দিকে আমার মা (এর ডাক) আর (অন্য দিকে) আমার সালাত! মা আবার ডাকলেন, হে জুরাইজ! ছেলে বলল, হে আল্লাহ্! আমার মা আর আমার সালাত! মা আবার ডাকলেন, হে জুরাইজ! ছেলে বলল, হে আল্লাহ্! আমার মা ও আমার সালাত! মা বললেন, হে আল্লাহ্! পতিতাদের সামনে দেখা না যাওয়া পর্যন্ত যেন জুরায়জের মৃত্যু না হয়। এক রাখালিনী যে বক্রী চরাতো, সে জুরায়জের গীর্জায় আসা যাওয়া করত। সে একটি সন্তান প্রসব করল। তাকে জিজ্ঞেস করা হল- এ সন্তান কার ঔরসজাত? সে জবাব দিল, জুরায়জের ঔরসের। জুরাইজ তাঁর গীর্জা হতে নেমে এসে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় সে মেয়েটি, যে বলে যে, তার সন্তানটি আমার? (সন্তানসহ মেয়েটিকে উপস্থিত করা হলে) জুরায়জ বলেন, হে বাবূস! তোমার পিতা কে? সে বলল, বক্রীর অমুক রাখাল। (সহিহ বুখারী) ‘
জাওয়াদ মুশরাফার হাদিস বলার উদ্দেশ্য ধরতে পারল। সে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। চোখে বিস্ময়, অবিশ্বাস। সে বলল,
‘এটা জানতাম না। মায়ের জবাবের এত গুরুত্ব! ‘
মুশরাফা বলল, ‘হ্যাঁ। মায়ের ডাকে নফল ইবাদাত ছাড়ার অনুমতি আছে। নফল ইবাদতের চেয়ে মায়ের ডাককে প্রাধান্য দিয়েছেন ইসলাম। মায়ের কত সম্মান!’
জাওয়াদ তড়িৎ উঠে দাঁড়াল। অনুতপ্ত হয়ে বলল, ‘ মা আমাকে বদদোয়া না দিক।’
‘মা, মা’ ডাকতে ডাকতে ছুটল জাওয়াদ। আবার ফিরে এসে বলল, ‘মা রাগ করেনি। জাযাকি-আল্লাহু খায়রান।’
বলে আবার ছুটে গেল। মুশরাফা কুরআন মেলতে মেলতে হাসল।
•
খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন মায়মুনা। গম্ভীর চোয়াল, কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পাশে বসে আছেন জয়নাল আবেদীন। তিনি ও সিরিয়াস। খাটের পাশে চেয়ারে বসে আছে জাওয়াদ। ভ্রু কুঁচকানো তার। ঠিক কী বিষয়ে আলোচনা হবে, তার অনুসন্ধানে নেমেছে। খাটের এক কোণে বসে আছে যায়েদ, তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে জিশান। দুজনের চোয়াল প্রশ্নবিদ্ধ। আকস্মিক বাবা মা তিন সন্তানকে জরুরি তলব করলেন কেন এটা ভাবনা সবার। জিশান জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাড়াল। যার অর্থ, বাবা মা কী বলবেন, জানিস কিছু? জাওয়াদ হালকা মাথা নাড়াল, যার অর্থ, সে জানে না। অনুসন্ধানী চোখে তাকাল বাবা মায়ের দিকে। কথা শুরু করলেন জয়নাল আবেদীন,
‘ আগে আমাদের পরিবারটা ছোটো ছিল। মানুষ বলতে তোমরা চারভাইবোন আর আমরা দুজন। আমাদের তখন তিন রুমের একটা বাসা ছিল। জেরিন একরুমে থাকতো। আর তোমরা তিনভাই আড়াআড়ি করে একরুমে থাকতে। এ নিয়ে সে কি ঝগড়া তোমাদের! প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরলে বিচার নিয়ে বসতে হত আমার।’
আনমনেই হেসে উঠলেন জয়নাল সাহেব। ছেলেরা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে। মূলত তারা কথা যোগসূত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ ডেকে এনে ছোটোবেলার কাহিনি শুনানোর কথা নয় বাবা। নিশ্চয় অন্য কথা বলতে চাইছেন। জয়নাল সাহেব আবার বলে উঠলেন,
‘ একটু বড়ো হলে তোমরা, আলাদা রুমের বায়না ধরলে সবাই। তারপর আমরা পাঁচ রুমের এই বাসায় ওঠলাম। নিজস্ব রুম পেয়ে তোমাদের যেন ইদ লেগেছিল সেদিন। তোমরা আরেকটু বড়ো হলে, বিয়ে করলে, কিন্তু সংসার হলো না। কারণ এক ঘরে এত সংসার হয়না। সংসারে সবার আলাদা নিজস্বতা থাকে, যৌথ পরিবারে সেই নিজস্বতা থাকে না। তোমাদের হয়তো সমস্যা হবে না, কিছু বউমাদের মনের আক্ষেপ থেকে যাবে। প্রতিটা মেয়ে চায় তার আলাদা একটা সংসার হোক। এক সংসার এক কর্তীতেই সুন্দর। তিন কর্তীতে সুন্দর থেকে সমস্যা হবে বেশি। আমার এতকালের সুন্দর সংসারে না আবার বিবাদের চাপ পড়ে! তা ছাড়া সময়ের সাথে সাথে সদস্য বাড়ছে। এখন আটজন, কদিন বাদে নজন কিংবা দশজন হবে। এই পাঁচ রুমের ফ্ল্যাটে এত লোকের বাস কষ্টকর হয়ে যাবে। জাহিন বড়ো হচ্ছে, ওর ও রুমের দরকার। জেরিন স্বামী নিয়ে বেড়াতে এলে মেঝেতে বিছানা পাতানো লাগে। এই দৃশ্য দেখতে ভালো লাগে না আমার। আমি যতদিন বেঁচে আছি, আমার সন্তানদের উপরেই দেখতে চাই, সুন্দর, সুখী আর স্বাধীনভাবে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে তোমাদের সবাইকে আলাদা করে দিব। আমরা দুজনে গিয়ে বাসা দেখে এসেছি। তিনটি বাসাই সুন্দর। আশা করি সংসার সাজাতে অসুবিধা হবেনা তোমাদের। ‘
বাবার দীর্ঘ বয়ান শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল তিনভাই। আলাদা হবার কথা দুঃস্বপ্নে ও ভাবতে পারে না তারা। প্রাইভেসি দরকার ঠিক, তাই বলে আলাদা হতে হবে! বিয়ের পর ভাই ভাইয়ে কত ঝামেলা হয়, অথচ আজ অবধি জাওয়াদ যায়েদের মন মালিন্য ও হয়নি। এখনো ফিরতে দেরি হলে স্ত্রীর সাথে সাথে ভাইয়ের নাম্বার থেকেও কল যায়, কীরে বাড়ি ফিরবি না? সেই ভ্রাতৃত্ব ভেঙে যাবে? মানতে পারল না যায়েদ। ধীর স্বরে বলল,
‘ হঠাৎ করে আলাদা হওয়ার কথা কেন এলো?’
উত্তরটা মায়মুনা দিলেন,
‘হঠাৎ না, বেশ কিছুদিন যাবত এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি আমি। পর্দা সম্পর্কিত একটা বই পড়েই জানতে পারলাম বেপর্দা ভয়াবহতার ব্যাপারে। পুরুষের চোখের পর্দা আর নারীর শরীরি পর্দার বিধান জানার পর আমার মাথায় কেবল একটা কথাই আসছে। আমার বাসায় আমার তিনটা ছেলে, দুইটা বউ। দেবর-ভাবি একে অপরের গায়রে মাহরাম। দেখা দেয়া জায়েজ নেই। এক বাসায় থাকলে দেখা তো হয়েই যায়, তারউপর আমরা এক টেবিলে খাবার খাই। এতে গুনাহ কেবল একজনের হচ্ছে, তা না। পাঁচটা মানুষ সবার গুনাহ লেখা হচ্ছে। আর এ ব্যাপারটা পরিচালনা করায় গুনাহের এক ভাগ আমার কাধে ও এসে পড়ছে। জীবনে কম তো পাপ করিনি। সেই হিসেব কিভাবে দিব এ চিন্তাতে ঘুম আসে না। আর নতুন করে গুনাহের ভাগি হতে চাইছিনা। সবাই আলাদা বাসা নিলে নিজস্ব একটা সংসার হবে, প্রাইভেসি হবে। এত রাখঢাক করে চলতে হবে না। তাই আমি ভেবেছি আলাদা করে দেয়াই ভালো হবে। এতে তোরাও সুখে থাকবি, আমার ও গুনাহ কম হবে।’
আর কেউ না বুঝলে ও মায়ের কথার পেছনে যে জাওয়াদের পর্দা সংঘটিত অনুরোধ জড়িত আছে তা বেশ বুঝতে পারল জাওয়াদ। মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল মুগ্ধ চোখে। তারপর বলল, ‘আমরা চাইলে তো অনিকদের বাসার মতো সেপারেট সিস্টেম করতে পারি।’
মায়মুনার জবাব যেন তৈরিই ছিল, ‘ একজনের উপস্থিতিতে পুরো ঘরের মানুষ আটকা পড়বে এই নিয়ম আমার পছন্দ নয়। তাছাড়া আমি চাইছি না আমার বাসায় এত বিভেদ হোক। তারচেয়ে ভালো আলাদাই হ সবাই।’
জাওয়াদ খানিক চুপ থেকে বলল, ‘ আমি আগেই বলে দিচ্ছি, তোমরা আমার বাসায় থাকবে।’
যায়েদ রাগী চোখে প্রতিবাদ করল, ‘বাবা মা তোর একার? তোর বাসায় কেন থাকবে? আমি বড়ো ছেলে, উনাদের দায়িত্ব আমার। আমার বাসায় থাকবে। ‘
জিশান বলল, ‘তোমাদের স্ত্রী আছে, সংসার আছে। আমার কেউ নেই। একলা মানুষকে সামলানোর জন্য বাবা মাকে প্রয়োজন। তোমরা স্ত্রী নিয়ে থাকো, আমি মা বাবাকে নিয়ে থাকি।’
ছেলেদের কথায় জয়নাল আবেদীন নিঃশব্দে হাসলেন। আজকালকারযুগে ছেলেরা বাবা মায়ের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে ঝগড়া করে। আর তার ছেলেরা বাবা মায়ের দায়িত্ব নিতে ঝগড়া করছে। কী সুন্দর, প্রশান্তিদায়ক, তুষ্টিদায়ক দৃশ্য! ছেলেগুলো মানুষ হয়ে গেছে। আর চিন্তা নেই, বৃদ্ধ বয়সটা খারাপ যাবে না। মায়মুনার চোখে পানি, এই চমৎকার দৃশ্য তাকে কাঁদাচ্ছে। তিনি কান্না হেসে বললেন,
‘ হয়েছে আর ঝগড়া করতে হবে না, আমরা তিনজনের সাথেই থাকব।’
তিনভাইকে খুশি দেখাল ভীষন। উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘ কীভাবে?’
জয়নাল আবেদীন হেসে বললেন,
‘ তিনটা বাসার এক ফ্লোর ভাড়া করে এসেছে তোর মা। পাশাপাশি তিন বাসায় থাকবি তিনভাই।’
মায়মুনা বললেন, ‘আর আমরা দুধভাত। তিন সংসারে নজর থাকবে আমাদের। এখনকার মতো। ‘
সবাই একসাথে থাকবে ভেবে খুশি হলো তিনভাই। জিশান বলল, ‘তাহলে আর আলাদা কই, আমরা তো একসাথেই আছি। ‘
‘ তিন সংসার আলাদা। তোরা সেখানে স্বাধীন, সুখী জীবন যাপন করবি। কোন রাখঢাক করতে হবে না।’
জাওয়াদের দিকে চাইলেন না মায়মুনা। জাওয়াদ গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। মায়েরা সব বুঝে যায়, তাদের কাছে সব সমস্যার সমাধান থাকে। কী সুন্দর আলাদা হয়ে এক করে রাখলেন সংসার।
বাসা খালি ছিল বিধায় পরদিন থেকেই শিফটিং এর কাজ শুরু হলো। বিনা নোটিশে বাসা ছাড়তে গিয়ে জরিমানা গুণতে হলো অবশ্য। মায়মুনা চাইলেন না এত লুকোচুরিতে ছেলের ইদ নষ্ট হোক। নতুন সংসার সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কাকন। সীমিত পরিসরে শুরু করল মুশরাফা ও। রোজা রেখে রান্না বান্না। জিনিস কেনা, সাজানো সব সামলাতে গিয়ে হিমসিম খেল বেশ। এর মাঝে আবার আরেক বিপদ এসে বসল। নাজমুল সাহেব স্ট্রোক করে হাসপাতালের বিছানা নিলেন। সেখানে ছুটে দেখা হলো পরিবারের সাথে। জীবনের সমীকরণ ঘুরে আবার সেই আগের জায়গায় নিয়ে গেল।
চলবে…