স্বর্ণাভ সুখানুভূতি। #দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-২৬)

#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি।
#দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-২৬)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

ঘড়ির সেকেন্ডের কাটা’টা বারোর ঘর হয়ে গিয়েছে দু’বার। তবুও মুশরাফার পলক ফেলবার নামটি নেই। বিস্ময়, অবিশ্বাস্য নিয়ে তাকিয়ে আছে চৌকাঠে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে। ভ্রম-বাস্তবের মাঝে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার মন। কূল হারানো পথিকের মতো চেয়ে আছে দিশেহারা চোখে। তার শৈশব রাঙানো মানুষটা সত্যিই এসেছে তার দুয়ারে, না কি এ শুধুই ভ্রম? ভ্রম হলে কাটছে না কেন? আর বাস্তব ও হবে কিভাবে? তাকে ঘৃণা করা মানুষটা আসবে কেন তার দুয়ারে? তাও শৈশবের সেই আদরটি নিয়ে? ভাবনা সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে মুশরাফা। ওর দ্বিধার দেয়ালে সমাধান ঝুলাতে এগিয়ে এলো জাওয়াদ। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,
‘ আজ কোন ঘৃণা নিয়ে নয়, ভাইয়া এসেছে একরাশ ভালোবাসা নিয়ে। এটা স্বপ্ন নয়, এটা বাস্তব। ঘোর থেকে বের হও, রাফা।’

মুশরাফার কানে বাজল কথাগুলো। ঘাড় ঘুরিয়ে অবিশ্বাস্য চোখে চাইল স্বামীর পানে। চোখ বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। ওর চোখে চোখ রেখে হাসল জাওয়াদ। আশ্বাসের সুরে বলল,
‘সারপ্রাইজ পেলে চমকাতে হয়। কাঁদতে হয়না, পাগলী। কান্না থামিয়ে ভাইয়াকে বরণ করে নাও। সেই কখন থেকে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে।’

জাওয়াদ পাশ কাটল। বাসায় এখনো আসবাবপত্র কেনা হয়নি। আকস্মিক বাসা পরিবর্তন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, ইদ শপিং এর বাসার দামী আসবাবপত্র কেনবার মতো অর্থ অবশিষ্ট রইল না জাওয়াদের কাছে। সবে সংসার শুরু করেছে ধীরে ধীরে টুক টুক করে সাজাবে এই মনন তাদের। যে সব আসবাব না হলেই নয় তা কেনা হয়েছে। কালেভদ্রে ও আসা অতিথিদের জন্য বসার ঘর সাজানো হয়নি এখনো। আগের বাসায় জাওয়াদের রুমে একটা কাউচ আর বারান্দায় কয়েকটা বিন ব্যাগ ছিল সেগুলোই রাখা হয়েছে কেবল। মাঝে একটা কাউচ আর পাশে দুটো করে চারটা বিনব্যাগ অর্ধবৃত্তাকার করে রাখা, মাঝে একটা সেন্টার টেবিল। বাদবাকি পুরোরুম খালি। বিন ব্যাগের দিকে আগোবার সময় সৌখিন জাওয়াদের মুখে লজ্জার ছটা পড়ল। অতিথি হিসেবে তারিফ একবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। জাওয়াদের কস্মিনকালেও ভাবনা ছিল না তারিফকে বাসায় আনবার। জানা থাকলে হয়তো কিছু আসবাবপত্রের ব্যবস্থা করা যেত, আর কিছু না হলেও অন্তত কয়েকটা শো-পিস, আর ইন্ডোর প্লান্ট রাখলেও রুমটা কিছুটা ভারি লাগতো। এখন এই খালি ঘরে তারিফের আগমনে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করল জাওয়াদ। ফ্যান ছেড়ে বসে চোখ ফেলল দরজায় দাঁড়িয়ে ভাই বোনের দিকে। এই সুখের গল্পটা সে কাছ থেকে পড়বে।

তারিফ এক পা এগিয়ে এসে বোনের মাথায় আলতো হাত রাখল। আদুরে সুরে বলল, ‘মুশি! কেমন আছিস?’
বাস্তবতার তীর বিঁধল মুশরাফার বুকে। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল ভেতরটা। পুরনো ঘা জেগে উঠল। স্মৃতিরা মাথাচাড়া দিল। যেই ডাক শোনার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষায় করছিল, যেই স্নেহের তৃষ্ণায় চাতক পাখির মতো চেয়েছিল, সেই স্নেহ আজ ধরা দিয়েছে। এখনো স্বপ্ন লাগছে, ঘোর লাগছে মুশরাফার। চিৎকার করে কান্না আসছে, ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাল। গলা কাঁপল, কথা বেরুলোই না। সে টইটম্বুর চোখে তাকাল ভাইয়ের দিকে, তারপর মাথা নাড়াল কেবল। অর্থ্যাৎ ভালো আছে।

বোনের চোখে হাজার অভিযোগ, অভিমান দেখতে পেল তারিফ। ছোটো বেলায় যেদিন স্কুল থেকে ফিরবার সময় বোনের জন্য কিছু না এনে খালি হাতে ফিরত, সেদিন মুশরাফা এমন অসহায় আর অভিযোগ নিয়ে তাকাত, সেই দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখলে বুক কাঁপত তারিফের তৎক্ষনাৎ গিয়ে আবার চকলেট এনে দিত। আজ ও তারিফের ইচ্ছে করল বোনের অভাব দূর করতে, কিন্তু সে অপারগ। ওতগুলো বছরে ভাইয়ের অভাবটা নিজেই দেখিয়েছে সে, এই ক্ষণে সে কিভাবে পূরণ করবে, এতগুলো বছরের কষ্ট গুলো কিভাবে ভুলাবে! মুশরাফা হাফ হাতা ব্লাউজ পরেছে। এক হাত আঁচলে ঢাকা, অন্য হাত দৃশ্যমান। আগে আঁচলে ঢাকা ছিল, বাসায় আসবার পর আচঁল ছেড়েছে।
হাত ভেদ করে ওর ফর্সা হাতের কালসিটে দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এই দাগগুলো চোখে পড়ল তারিফের। তার মন ধারণা করে নিল, এগুলো মুশরাফার বিভীষিকাময় অতীতে তার পরিবারের দেয়া আঘাত। ন্যানোসেকেন্ডে আন্দাজ করে নিল, তার বোনের জীবনে কী হয়েছিল। ইশ! কী কষ্টটাই না পেয়েছে আমার মুশিটা! প্রতিটা দাগ তারিফকের ভাইমনকে ক্ষতবিক্ষত করে দিল, অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগল তারিফের। সে কিভাবে হতে দিল এমনটা, সে থাকতে তার বোনের উপর এত অত্যাচার কিভাবে হলো! মাদক নামের সর্বগ্রাসী সব শেষ করে দিল, তার বোনের জীবন থেকে এতগুলো বছরের ভাইয়ের আদর কেড়ে নিল। ভেতরটা ভেঙে এলো তারিফের। সে কাঁপা স্বরে বলল,
‘ ভাইয়া তোকে খুব ক/ষ্ট দিয়ে ফেলেছি, তাই না ? আগলে রাখতে পারিনি আমার মুশিটাকে। আমার উপর হাজার অভিযোগ, না তোর? ‘

মুশরাফা উত্তর দিল না। কেবল কান্নার ঢোক গিলল। তারিফ করুণ স্বরে বলল, ‘ সব ভাইবোনের থেকে তুই আমার সবচেয়ে আদরের বোন ছিলি। তোর সামান্য কষ্ট ও আমার সহ্য হতো না। সেই তোকে কিভাবে আমি ক/ষ্ট দিলাম, তোর কষ্ট আমি কিভাবে সহ্য করলাম? যে আমি সবসময় তোকে আগলে রাখতাম সেই আমি থাকতে কিভাবে তোর উপর এত অ/ ত্যা/ চার হলো! হাউ ডিড আই ডু ইট! কেন ছিলাম আমি, কেন আছি আমি। আমার তো মরে যাবার কথা। আমি কিভাবে ভুলে গেলাম আমার মুশিকে? হাউ ডিড আই ফরগেট, ড্রেসাপ নয় আমার মুশিই আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি!
কী ভীষণ পাপ করেছি আমি! কী করব আমি? কিভাবে ক্ষমা চাইব তোর কাছে? কীভাবে ক্ষমা চাইলে তুই ক্ষমা করবি?’ অনুতাপ ঝরে গেল তারিফের স্বরে। কী আর্তনাদ ছিল সেই কথায়!

মুশরাফার কী যেন হলো, নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। ভাইকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে উঠল। আটকে রাখা কান্নাটা বেরিয়ে এলো। কান্নার সুর কী বিষাদ! কান্নার মাঝে বিষাদী সুরে বলল,

‘এতগুলো বছর একবার আমাকে ‘মুশি’ বলে ডাকলে না কেন ভাইয়া? আমি শুধুমাত্র তোমার আর মায়ের জন্য ওই বাসায় পড়ে ছিলাম। সবাই যখন মা/ রতো তখন আমি আশায় থাকতাম, তুমি আসবে। ‘মুশি’ ডেকে সবার থেকে আমাকে আগলে নিবে, ঠিক ছোটোবেলার মতো। কিন্তু তুমি আসতে না। আমার গায়ে মলম লাগাবার কেউ থাকতো না, আমি আশায় থাকতাম অন্তত তুমি এসে আমার গায়ে মলম লাগিয়ে দিবে। আমি চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতাম, কিন্তু তুমি আসতে না। এতগুলো বছরে একটাবার ও আসলে না। তুমি তো সবার থেকে আমার আপন ছিলে তবে তুমি কিভাবে এতটা পর হয়ে গিয়েছিলে ভাইয়া? ‘

মুশরাফার মনে জমানো কষ্টগুলো বেরিয়ে এলো এই কথায়। তার কষ্টের বহরতায় যেন ঘর কেঁপে উঠল। তারিফ কষ্টের মাত্রা শতগুণ বেড়ে গেল। ব্যা/থায় জর্জরিত হলো বুক। চোখ মুখ খিঁচে ফেলল। চোখ ভিজল তার। বোনকে স্নেহের আলিঙ্গনে আগলে নিল। প্রেমিক এবং ভাইয়ের আলিঙ্গন এক নয়, একটায় প্রেম থাকে আরেকটায় স্নেহ। মা পাখি যেমন এক ডান দিয়ে ছানাকে ঢেকে নেয়, ঠিক সেভাবে তারিফকে বোনকে আগলে নিল, আলতো হাতে, পরম মমতায়। অস্ফুট স্বরে বলল, ‘স্যরি। স্যরি! ড্রা/ গ আমার সব শেষ করে দিয়েছে। আমাকে প/ শুতে পরিণত করে ফেলেছিল। আমার সব শেষ.. আমি…স্যরি… স্যরি..

তারিফের কথারা সব তালগোল পাকিয়ে গেল। এলোমেলো জড় হয়ে কেবল শোনা গেল ‘স্যরি ‘শব্দটাই। কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল মুশরাফার মাথায়। মুশরাফার চোখের পানিতে ভিজছে তারিফের কালচে নীল ইদের পাঞ্জাবির বুক পকেট। ভাই বোন দুজনেই কাঁদছে, কেউ ডুকরে, কেউবা চাপা স্বরে।

নীড় হারা পাখির নীড়ে ফিরবার চমৎকার দৃশ্য পরখ করছে জাওয়াদ। তারিফের চেহারাটা তাকে মুগ্ধ করছে, ভাইয়ের সংজ্ঞা ফুটে উঠেছে তার চোখেমুখে। দাম্ভিক পুরুষদের চোখের জল যে নারীর জন্য গড়ায় সে নারী ভাগ্যবতী। নিঃসন্দেহে মুশরাফা ভাগ্যবতী।
স্ত্রীর কান্নায় জাওয়াদের বুকে জ্বালা ধরেছে। কত কষ্ট জমা পড়েছিল মেয়েটার মনে, এতখানি তো সে আন্দাজ করেনি। আজ যেন কান্নায় সব উগড়ে বেরিয়ে আসছে। হরিণ শাবকের মতো অসহায় লাগছে তাকে। জাওয়াদের সহ্য হলো না। মুশরাফার কান্না তার সহ্য হয় না, না তার বুকে আর না কারো বুকে। জাওয়াদ এই কান্নার সমাপ্তি ঘটাতে মৃদু কাশল। এতেই ধ্যান ভাঙল মুশরাফার। ভাইয়ের বুক থেকে সরে গেল। চুপটি করে দাঁড়াল সামনে।

তারিফ এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মুখে হাত চেপে রাখল কিছুক্ষণ। ভীষন বিব্রত, অসহায় দেখাচ্ছে ওকে। জড় গলায় বলল, ‘ তোর এত অভিযোগ আমি মুছব কিভাবে? কীভাবে ক্ষমাই চাইব তোর কাছে? শিট! কী করেছি আমি!’

মুশরাফা ধীর গলায় বলল, ‘ভাইয়া, জানো? আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, সেই ছোটোবেলার মতো। এতকিছুর পর ও যখন আমি ছোটোবেলার স্মৃতি আওড়াই তখন তোমার প্রতি সব অভিযোগ মুছে যায়, প্রতিবারই ইচ্ছে করতো তোমার কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু পারিনি।’
‘ জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল। এখন স্যরি বলা ছাড়া কিছু বলার বা করার ও নেই। ‘ তারিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনুতাপে জর্জরিত তার মন। নাকের ডগা লাল, রক্তিম চোখের কোণে তখনো পানি।

মুশরাফা ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘তোমার প্রতি আমার ক্ষোভ বা ঘৃণা ছিল না কোনকালেই। তাই স্যরি বলতে হবে না।’
তারিফ কোমল স্বরে বলল, ‘ তোকে দেয়া খারাপ সময়গুলো ভালো করে দিতে পারব না। তোর অভিযোগ মুছে দিতে পারব না। বিগত সময় আমি তো এক ব্যর্থ ভাই হয়ে ছিলাম। একটাবার সুযোগ দিবি ছোটো বেলার সেই মুশির ভাই হবার? পুরনো স্মৃতি রিপিট করবার সুযোগ দিবি?’

ভাইয়ের সরল নিবেদনে মুশরাফার মনে শীতল স্রোত বয়ে গেল। এতকালের অভিযোগ অনুযোগ সব ঝরে গেল। মনের কালো মেঘ সরে গেল। জীবন কী চমৎকার সময়ে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাকে! সে যা চেয়েছে তা পেয়ে যাচ্ছে। সুখ প্রবাহ বয়ে গেল মনে। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখে ফুটল, বিজয়ী হাসি। চেহারায় খুশির ঝিলিক দিল। বিড়বিড় করে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। সে ভাইয়ের কথার উত্তর দিল না, কেবল প্রসন্ন হাসল। চোখ মুছে বলল, ‘ আহ্! কতদিন পর তুমি আমার সাথে কথা বলছো! কতদিন না, কতগুলো বছর! আমি এই দিনের অপেক্ষার প্রহর গুনেছিলাম কতকাল! ‘

মুশরাফার সুপ্রতীভ ব্যাবহারে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল তারিফ। প্রাণবন্ত হাসল সে। বলল,
‘তুই তখন এইটুকুনি বাচ্চা ছিলি। দুই ঝুটি বেধে পুতুলের মতো টুকুর টুকুর হাঁটতি, আমার কাছে কত কী বায়না ধরতি! কিছু থেকে কিছু হলেই গাল ফুলাতি। সেই তুই কত বড়ো হয়ে গেছিস!’
ভাইয়ের কথায় মুশরাফা হেসে ফেলল। ধীরে বলল, ‘ তোমার সেই বাচ্চাবোন আর বাচ্চা নেই, বড়ো হয়ে গেছে, বিয়ে ও হয়ে গেছে তার। মাঝে কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল!’

পুনরায় বিমর্ষ হয়ে গেল মুশরাফা। অভিযোগের সুরে বলল, ‘আমার বিয়েতে এলে না কেন তুমি!’

তারিফ ও বিমূর্ত হলো। মলিন স্বরে বলল, ‘ আমি তখন তুর্কি ট্রিপে ছিলাম। তোর বিয়ের কথা শুনিনি। ফিরে তোকে না দেখে ভেবেছিলাম, তুই একবারে মামার বাসায় চলে গিয়েছিস। সেভাবে ঘেটে দেখিনি। মামার বাসায় দেখা হবার পরেই জেনেছি, তোর বিয়ে হয়েছে। ‘

মুশরাফা মলিন হাসল। কেমন দুঃখী গলায় বলল, ‘ আমাকে নিয়ে বাসায় কোন কথাই ওঠে না,তাই না?’

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তারিফ। কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘ ফ্রেন্ডস, ট্যুর, বিয়ার, ক্লাব এসব নিয়েই দিন কাটতো আমার। চারপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে কিছুর খেয়াল ছিল না, মা ছাড়া কারো সাথে নিয়মিত কথাও হতো না। দেখা হলেই কেবল দুটো কথা হতো। ‘

মুশরাফা উত্তর খুঁজে পেয়ে নিশ্চুপ রইল। মর্মবেদনা, অনুতপ্ততা, করুণতা ঘিরে ধরল তারিফকেও। কী ভীষণ অসহায় লাগল তার! যদি পিছন ঘুরে জীবনটাকে ঠিক করা যেতে, তবে কতই না ভালো হতো! যদি এমনটা হতো! চাপা শ্বাস ফেলল তারিফ। আর এগিয়ে এলো বোনের দিকে। মাথার ঠিক পেছনে হাতে রাখল। আশ্বাসের সুরে বলল,
‘ ওসব দিকে যাস না আর। ভুলে যা ওসব। আমি আসছি না ফিরে? এভাবে দেখবি মা বাবা, সাফা, জায়ফা সবাই ফিরবে। আমরা সবাই আবার এক হবো, সেই আগের মতো। ‘

মুশরাফা চোখ তুলে তাকাল। তারিফ কোমল সুরে বলল,’ ভাইয়া আছি না?’

ছোট্টো একটা কথায় কত ভরসা, কত আবেগ, কত আশা জড়ানো ছিল! মুশরাফা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে প্রশ্ন করল, ‘থাকবে তুমি? ‘
‘সবসময়। তোর জীবনের বাকি সময়ের সুখে দুঃখে আমাকে পাশে পাবি। ‘ মাথায় রাখা হাতটা নাড়াল তারিফ।
ভাইয়ের উত্তর শুনে আশায় ভাসল মুশরাফা, কী ভীষণ ভালোলাগা ঘিরে ধরল তাকে! সে হাসল, প্রাণবন্ত। তারিফ বলল, ‘তুই ভালো আছিস তো?’

এই কথায় যেন মুশরাফার বৈবাহিক জীবনে সুখের নিশ্চয়তা চাচ্ছে তারিফ। ইঙ্গিতটা ধরতে পারল মুশরাফা। একবার তাকাল জাওয়াদের দিকে। তারপর চোখ ফেরাল। প্রসন্ন, প্রফুল্ল, তুষ্ট স্বরে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। ‘

একটা শব্দের উত্তরে অদ্ভুত এক শক্তি ছিল, ইঙ্গিত ছিল, নিশ্চয়তা ছিল, স্বস্তি ছিল, শান্তি ছিল, যা তারিফের ভাইমনে প্রশান্তির জোগান দিল। প্রাণ ভরে এলো। তারিফ ধীর স্বরে বলল, ‘ভালো থাক সবসময়। ‘
‘ তোমাকে কেমন রোগা লাগছে। মামার বাসায় দেখছিলাম যে, তখনকার থেকে বেশ শুকিয়ে গেছো। অসুস্থ তুমি!’ উদগ্রীব হয়ে বলল মুশরাফা।

বোনের চোখে চিন্তা দেখে হাসল তারিফ। বলতে পারল না, তোর চিন্তা, অনুতাপে পুড়ছি আমি। মামার বাসায় দেখা হবার পর থেকে একটা দিন আমি শান্তিমতো কাটাতে পারিনি। একটা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। তোর দুঃখের কথা ভেবে আমি দুঃখে ভেসেছি। নিজের কাছে নিজেই হেরে গেছি। কী ভীষণ কষ্টে দিন পার করছি! বেঁচে যে আছি, এটাই তো অনেক। এভাবে আর কদিন থাকলে হয় পাগল হয়ে যেতাম, নয়তো মরে যেতাম।
মনের কথা মনে চেপে তারিফ হেসে বলল, ‘ কাজের চাপ খুব। ‘
‘কী করছো আজকাল?’
‘ বাবার ব্যবসাতে হাত দিয়েছি মাস দুয়েক আগে। ‘

মুশরাফা ক্ষীণ, কাঁপা স্বরে বলল, ‘মা? মা ভালো আছে?’
তারিফ অবিশ্বাস্য চোখে চাইল, যেন সে এটা আশা করেনি। তারপর ধীরে বলল, ‘ ইয়াহ।’

মুশরাফা আরও কিছু বলতে গেল, জাওয়াদ থামিয়ে দিল। ওরা তখনো খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। এতকাল বাদে ভাইকে ফিরে পেয়ে মুশরাফার ভাইকে বসানোর বা খোলা দরজার কেউ প্রবেশ করার খেয়ালটি নেই। জাওয়াদ দরজার দিকে এগিয়ে বলল, ‘ রাফা, ভাইয়াকে দাঁড়িয়ে রাখবে না কি! বসতে দাও!’

মুশরাফার এবার খেয়াল হলো। সে বেশ বুঝতে পারল জাওয়াদ চাচ্ছেনা মুশরাফা তারিফ বাদে তার পরিবারের কাউকে নিয়ে কনসার্ন হোক। সে চাপা শ্বাস ফেলে দুঃখিতের ভান করে বলল, ‘ ইশ! ভুলে গিয়েছিলাম। বসুন, ভাইয়া।’

তারিফ গিয়ে কাউচে বসল। জাওয়াদ দরজা বন্ধ করে বলল, ‘সবে বাসা চেঞ্জ করেছি। এখনো ফার্নিচার কেনা হয়নি। আপনার বসতে অসুবিধে হচ্ছে? ‘
ভগ্নিপতির বিব্রতভাব দেখে সুপ্রতিভ হাসল তারিফ। বলল, ‘ না। নতুন হলেও ভালো সাজিয়েছো। ‘

‘আপনারা কথা বলুন, আমি নাস্তা নিয়ে আসি।’
মুশরাফা ভেতরের দিকে পা বাড়াল। তারিফ বলল, ‘ লাগবে না, বস। কথা বলি। অনেক কথা জমা আছে তোর সাথে।’

‘ পায়েশ আনি একটু?’ কেমন করে বলল মুশরাফা।
‘তুই করেছিস?’
মুশরাফা মাথা নাড়াল। তারিফ স্মিত হাসল। ওর মন বলে উঠল, ‘তোর হাতের পায়েশ খাব বলে, সারা সকাল খালি পেটে কাটিয়েছি। ইদের দিনের প্রথম মিষ্টি মা, বোন, কিংবা বউ এই তিন নারীর একজনার হাতের ছাড়া জমে না। বউ নেই, মা পায়েশ করতে পারেন না। বোন ও কাছে ছিল না বলে এই ইদে খালিমুখেই নামাজ পড়তে বের হয়েছি। ভেবেছি এসেই খাব।’
মুখে বলল, ‘ নিয়ে আয় তবে। ‘

মুশরাফা চটজলদি পায়েশ আনতে গেল। খানিক বাদে ফিরে এলো। ভাইয়ের হাতে পায়েশের বাটি তুলে দিয়ে ভাইয়ের পাশেই বসল। ধীরে বলল,
‘এবার বলো, তুমি হঠাৎ এখানে কিভাবে এলে? ‘
থেমে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কিভাবে…

ইঙ্গিতটা দুজনেই বুঝল। তারিফের ভয় হলো, ভরা রাস্তায় ভগ্নিপতির কাছে ছোটো হবার গল্প শুনিয়ে দিবে না তো জাওয়াদ! বোনের কাছে ছোটো হয়ে যাবে সে। কিন্তু জাওয়াদ তা করল না। হেসে বলল,
‘ ভাইয়া তোমার সাথে দেখা করতে চাইছিলেন কদিন ধরে। আমি আজকের দিনের জন্য আটকে রাখছিলাম। কাল রাতে দাওয়াত দিয়েছি, দাওয়াত পেয়ে এসেছেন ভাইয়া।’

তারিফ বিস্মিত ভ্রু নাড়াল। মনে মনে বলল ‘কী বলে এই ছেলে! সব এত সোজা! পুরো নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে আমায়। অনুতাপে পুড়িয়েছে, নিবেদন করিয়ে ছেড়েছে, মুশিকে দেয়া কষ্টটা হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিয়েছে। কিসের দাওয়াত, মাঝ রাস্তায় হাত জোড় করে একপ্রকার বাধ্য করে দাওয়াত নিয়ে আমি বাসায় এসেছি। এতসবের পর বলছে, দেখা করতে চাইলে আমি দাওয়াত দিয়ে আনিয়েছি! এই যে এখন ভাইয়া ভাইয়া করছে, এটা ও তো কদিন আগে ছিল না। এই ছেলে মা /রার হুম/ কি ও দিয়েছে। কী রূড হয়েছে! এখন স্ত্রীর সামনে বিনম্রতায় ভেসে যাচ্ছে। কী সাংঘাতিক এই ছেলে! নিজে আমাকে গোলা পানিতে ডুবিয়েছে, এখন ভান করছে যেন সে পানি দেখেইনি!

মুশরাফা সন্দিহান চোখে তাকাল জাওয়াদের পানে। এত সহজে মানার তো কথা না। নিশ্চয়ই অন্য ঘটনা আছে। জাওয়াদ হাসল, কিছুই বলল না। মুশরাফা কথা বাড়াল না, জাওয়াদকে একান্তে জিজ্ঞেস করা যাবে। সে হেসে বলল,
‘তুমি আমার বাসায় এসেছো, আমার সাথে কথা বলছো, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। সব স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। ‘ কী উৎফুল্লতা তার চেহারায়! তারিফ হাসল। হাসল জাওয়াদও। কোমল স্বরে বলল,
‘ শীঘ্রই তোমার রব তোমাকে এত বেশি দিবেন যে তুমি খুশি হয়ে যাবে। (সুরা দোহা-৫)

তোমার খুশির ভান্ডার বোধহয় খুলে গেছে, রাফা।’

মুশরাফা স্বামীর পানে চেয়ে চমৎকার হাসল। বলল, ‘আমি আজ দুইরাকাত নামাজ পড়ব।’

পায়েশ মুখে দিয়ে তৃপ্তি শ্বাস ফেলল তারিফ। এই তো আপনতত্ব। ধীরে বলল,
‘ ও হ্যাঁ আগামী সপ্তাহে তো বিয়ে, তুই কবে যাবি?’
‘কার বিয়ে?’ ভ্রু কুঁচকাল মুশরাফা।
‘ আমার। কেন, তুই জানিস না?’
‘না। তুমি বিয়ে করছো!’ চমকাল মুশরাফা।

তারিফ জাওয়াদের দিকে তাকাল। জাওয়াদরা যে তারিফের বাগদানের সময় নাজমুল সাহেবের বাসায় ছিল তা ফাইজা থেকে শুনেছে তারিফ। সে এই ভেবে বেশি অনুতপ্ত হয়েছিল যে, তার বাগদানের সময় মুশরাফা দাওয়াত না পেয়ে কী কষ্ট পেয়েছিল। কিন্তু এখন বুঝল, জাওয়াদ তাকে জানতেই দেয়নি। তারিফ বিস্মিত হলো। কিন্তু প্রকাশ করল না। বলল,
‘ হ্যাঁ। কদিন আগেই তো ঠিক হলো। কাল থেকে এরেঞ্জমেন্ট শুরু হবে। তুই বরং আজ আমার সাথে বাসায় চল। ‘

স্বাভাবিক স্বরে বলল তারিফ। যেন এটা হওয়ারই ছিল। মুশরাফা চট করে জাওয়াদের দিকে তাকাল। জাওয়াদ তাকাল। চোখে চোখে কথা হলো, জাওয়াদ যেন শর্তের কথা মনে করিয়ে দিল। মুশরাফা কথা এড়াতে উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘চায়ের পানি দিয়ে এসেছিলাম। দেখে আসি।’

মুশরাফা চলে যাবার পর তারিফ জাওয়াদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘তুমি কি মুশিকে আমাদের বাসায় যেতে নিষেধ করেছো?’
জাওয়াদ কোন নির্দ্বিধায় বলল, ‘ হ্যাঁ। ‘
‘কেন?’
‘আপনার মা, বাবা, বড়ো বোনের চোখে সম্মান এবং স্বরে নিবেদন না দেখা অবধি আমি চাইছি না রাফা ওই বাসায় যাক। আমার স্ত্রী কোথাও গেলে, সম্মানের সহিতই যাবে। যেখানে তাকে মাথায় তুলে রাখা হবে। শুধু ভাই নয় সবার কাছে তার সম্মান থাকবে। বোন তাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলবে না, মা তাকে দেখলে মুখ ফেরাবে না, বাবা তার দেখলে হেসে কথা বলবে। এমনটা হবার আগে আমি ওকে আপনাদের বাসায় যেতে দেবার অনুমতি দিতে পারব না। মূলত, আমি ওই বাসাকে রাফার জন্য নিরাপর মনে করছি না। দুঃখিত। ‘

‘আমি থাকতে কেউ ওকে কিছু বলার সাহস পাবে না।’
‘হাসপাতালে আপনি ও ছিলেন কিন্তু। ‘

তারিফ চুপ হয়ে গেল। আটকে গেল সে। আর জোর দিয়ে কিছু বলতে পারল না। জাওয়াদ বলল,
‘ আপনি যদি আপনার বাসায় রাফাকে নিয়ে যেতে চান, তবে আমি আপত্তি করব না। কিন্তু আপনাদের বাসায় নিয়ে যেতে চাইলে অনুমতি দিতে পারব না। যতক্ষণ না ওই বাসার কর্তা, কর্তী, বড়ো মেয়ে এসে রাফার কাছে নিবেদন করে, সসম্মানে মেয়ের অধিকার দিয়ে নিয়ে যেতে না চায়। ও বাসায় রাফার সম্মান পাকাপোক্ত হলে তবেই ও যাবে, এর আগে না। ‘

তারিফের চেহারায় মলিনতা ছেয়ে গেল। সে অধিকার দিয়ে কিছু বলতে পারল না, কারণ তার পরিবারের উপর তার বিশ্বাস নেই। মুশরাফার উপস্থিতি এখনো তাদের পছন্দ না, তারা মেনে নিবেন না, কথা শুনাবেন না। কনভেনশন হলে হাজার মানুষ থাকবে, সে স্টেজে বসা থাকবে, তার অগোচরে বিভীষিকাময় অধ্যায় হয়ে যাবে সম্ভাবনা নেহাৎ কম নয়। তারিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিরবতায় কাটল কিয়ৎক্ষণ। জাওয়াদ উঠে গেল। মুশরাফার না আবার সাহায্যের প্রয়োজন হয়। গিয়ে দেখল মুশরাফা চায়ে চিনি গুলছে। জাওয়াদ বলল,
‘ আমার সাহায্য লাগবে?’
‘না।’
মুশরাফা আকস্মিক বলল, ‘আপনাদের মাঝে ভাব হলো কিভাবে?’

জাওয়াদ স্মিত হাসল। সেদিন অফিসের পর তারিফ লোকসম্মুখে ওভাবে হাত জোর করবার পর জাওয়াদের রাগ পড়ে গেল। দাম্ভিক তারিফের কোমল রূপ দেখে বিস্ময়ের সাগরে ডুবে ছিল। বোনের জন্য অহংকারী তারিফ নিজের অহং ভুলে নিজেকে কতটা নিচে নামাতে পারে তা দেখেছিল। তারিফ যখন হাত জোড়া করছিল তখন তার হাত কাঁপছিল, আত্মসম্মান যে ঠিকরে পড়ছিল! অহং চুরমার হচ্ছিল, জীবনে প্রথম কারো কাছে যে সে নত হচ্ছিল তা স্পষ্ট ধরতে পেরেছে জাওয়াদ। একটা পুরুষের জন্য তার আত্মসম্মান সব। একটা ভাই তার বোনকে কতটা ভালোবাসলে নিজের সবচেয়ে মূল্যবান আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে পারে, তা পরিমাণ করতে পারেনি জাওয়াদ। তার ধারণা পাকাপোক্ত হয়েছে, তারিফ মুশরাফাকে ভালোবাসে, ভীষণ ভালোবাসে। তাদের ভ্রাতৃত্বে দেয়াল টানা উচিত হবে না। হঠাৎ ধারণা বদলে গেল, ক্ষোভ, রাগ জন্মে থাকা তারিফের উপর শ্রদ্ধা জন্মাল। সে গলে গেল। নিজেকে হারিয়ে দিল সে, জিতিয়ে দিল একটা ভাইকে। সেইক্ষণে কিছু বলল না, কেবল বলল, ‘আমি ভেবে জানাব।’
বলে চলে এলো।

চাঁদ রাতে হঠাৎ মুশরাফার মলিন মুখ দেখে সিদ্ধান্ত নিল এবারে মুশরাফার ইদ রাঙানো মানুষটা তার ভাই হবে। ইদের দিনই ভাই বোনকে এক করে দিবে। সেই ক্ষণে কল দিয়ে বসল শ্যালককে। বিনম্র সুরে ইদের দিন বাসায় আসবার দাওয়াত দিল। বিস্ময়ে কথাই বলতে পারছিল না তারিফ। কেমন আমতা আমতা করছিল। তা ভেবে হাসল জাওয়াদ। বোনের জন্য ভাইয়ের আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দেবার গল্পটা শুনাল না জাওয়াদ। ভাইটা বোনের কাছে বড়ই থাকুক, ছোটো না হোক। সে না জানুক তার জন্য তার ভাই কতটা সম্মান হারিয়েছিল, সে না জানুক তার জন্য তার স্বামী কতটা কঠোর হয়েছিল। জাওয়াদ প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল,
‘তোমার ভাই তোমাকে অনেক ভালোবাসে।’

‘বলুন না!’
জাওয়াদ আবার হাসল, ‘ তোমার জীবনের মাহররম পুরুষগুলো তোমাকে কতটা ভালোবাসে তুমি কখনো আন্দাজ ও করতে পারবে না, রাফা।’

মুশরাফা বেশ বুঝতে পারল, জাওয়াদ বলবে না। সে চাপা শ্বাস ফেলল। কেতলিতে চা ঢালতে ঢালতে প্রসঙ্গ ঘুরাল, ‘ ভাইয়া আসবে বলবেন না? আমি আরও আপনাকে চমকে দেবার জন্য সেজেগুজে দরজা খুলে..

থেমে গেল মুশরাফা। জাওয়াদ মুখচেপে হাসল, ‘ আমাকে চমকে দেবার জন্য পরী সেজেছিলে, ভাইকে দেখে চমকে গিয়ে ভূত হয়ে গেছো। ‘
‘ভূত হয়ে গেছি মানে?’
জাওয়াদ ওর হাত থেকে কেতলি নিল, তারপর বলল, ‘ কেঁদেকেঁটে তোমার চেহারা ভূতে মতো হয়ে গেছে। যাও, মুখ ধুতে আসো। আমি চা ঢেলে নিয়ে যাচ্ছি। ‘

মুশরাফা কৌতুহলী হয়ে যেতে নিল। আবার ফিরে এলো। কৃতজ্ঞ সুরে বলল, ‘ আপনার দেয়া এই সারপ্রাইজটা সারাজীবন আপনার কাছে আমাকে কৃতজ্ঞ করে রাখবে। জাযাক-আল্লাহু খায়রান। ‘

জাওয়াদ চা ঢালতে ঢালতে বলল, ‘ শর্তখানা মনে রাখলে আর না কাঁদলে আমি ও আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। ‘

চায়ের ট্রে হাতে জাওয়াদের বসার ঘরে আসবার দৃশ্যখানা দেখে অবাক হলো তারিফ। বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘মুশি কোথায়?’
জাওয়াদ হাসল, ‘ও মেকাপ ঠিক করতে গিয়েছে। আপনি চা নিন।’ নিজেই চায়ের কাপ তুলে দিল। সৌজন্যতাবোধে তারিফ বলল, ‘তুমি ও নাও।’
‘ নিব।’ বসে যুতসই বসল জাওয়াদ। ধীরে বলল,
‘ আমি বোধহয় আপনার সাথে একটু বেশিই রুড হয়ে গিয়েছিলাম। আপনি মনে কিছু রাখবেন না। ‘

জাওয়াদকে সত্যিই অনুতপ্ত দেখাচ্ছে। ওর পরিবর্তিত রূপ দেখে আবার চমকাল তারিফ। তার কাছে জাওয়াদ আস্ত একটা বিস্ময়ের প্যাকেজ। একবার একেকভাবে ধরা দেয়। তারিফ স্মিত হেসে বলল, ‘ ডোন্ট বি স্যরি, আই ডোন্ট মাইন্ড।’

জাওয়াদ আত্মপক্ষ সমর্থনে বলল, ‘ একচুয়েলি রাফার অতীত শুনে, হাতের দাগ আর ওর নিত্যকার কষ্ট দেখে আপনাদের প্রতি আমার অনেক ক্ষোভ জন্মে গিয়েছিল। আই কান্ট কনট্রোল মাই এংগার বিকজ অফ হার পেইন। ‘

শেষ লাইনটা শুনতে চমৎকার লাগল তারিফের। জাওয়াদকে এই ক্ষণে ‘প্রেমিক পুরুষ’ ঠেকছিল। ওর কষ্টের কথা আসলে আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা। কী সুন্দর কথা! তারিফ হেসে ফেলল, ‘ আই আন্ডারস্ট্যান্ড। ‘

থেমে রয়েসয়ে বলল, ‘রুড বোধহয় আমি ও হয়ে গিয়েছিলাম। কিছু মনে করো না।’

মুশরাফা এলো। দেখল তারা স্বামী আর ভাই চুপিচুপি কথা বলছে। এই সুন্দর দৃশ্যখানা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখল, অথচ ওরা টের পেল না। দুই আপন পুরুষকে একসাথে দেখে আনন্দিত হলো। কৌতুহল বাড়ল, এরা শত্রু থেকে মিত্র হলো কিভাবে জানবার।
এক পর্যায়ে মুশরাফা মৃদু কাশল। শালা-দুলাভাইয়ের কথা থেমে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। মুশরাফা ভাইয়ের পাশে বসতে বসতে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বলল,
‘আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহি ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ দুই ব্যক্তি যেন তাদের অপর (তৃতীয়) সঙ্গীকে (একা) রেখে চুপি চুপি কথা না বলে। কারন তা তাকে দুঃশ্চিন্তায় ফেলতে পারে
(সুনানে আবু দাউদ)’

জাওয়াদ প্রশ্রয়ের সুরে বলল, ‘ সুন্দর হাদিস তো! আমি হাদিসটা জানতাম না, এটাও জানতাম না যে তুমি এসেছো। ট্রাস্ট মি! ‘ জাওয়াদের স্বরে স্পষ্ট সমর্থন। মুশরাফা ভাইয়ের পাশে বসে হাসল। ওর হাতে চায়ের কাপ তুলে দেবার পরেই জাওয়াদ নিজের হাতে আরেকটা কাপ তুলে নিল। এই দৃশ্যখানা পরখ করল তারিফ। বোন-ভগ্নিপতির মধ্যকার চমৎকার একটা সম্পর্কে আঁচ পেল। ভালো লাগল ভীষণ।

চায়ের কাপে চুমুক দেবার পরেই জয়নাল আবেদীন ফিরলেন। যাবার সময় পুত্রবধূর সাথে দেখা করে যেতে পারেন নি। এসে প্রথমে এ ঘরে এলেন। কুশল বিনিময়ের পর মুশরাফা ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, ‘বাবা, আমার ভাইয়া।’

ভাইকে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় মুশরাফার স্বরে গর্ব, প্রফুল্লতা টের পেল জাওয়াদ। এতকাল বাদে পরিবারের কাউকে পরিচয় করিয়ে দেবার সুযোগ পেয়ে কী খুশি মেয়েটা! ওর ভাগ্য কঠিন, দেবার সুযোগ পেয়ে মেয়েটা কী খুশি। মেয়েটা ভাগ্য কঠিন, এটা কত সাধারণ বিষয়, সে কত দেরিতে পেল!

কুশল বিনময়ের পর জয়নাল আবেদীন বললেন, ‘তোমাকে বিয়েতে দেখলাম না কেন ?’

তারিফ বিব্রত চোখে তাকাল বোনের দিকে। মুশরাফাও তাকাল। জাওয়াদকেও বিব্রত দেখাল। ‘কেন’ এর উত্তর দেবার ক্ষমতা নেই কারো। আকস্মিক মুশরাফা বলল, ‘ভাইয়া দেশের বাইরে ছিলেন। আসতে পারেন নি। ‘
ভাইকে ছোটো হতে দিতে নারাজ সে। তারিফ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

দুপুরবেলা সবাই গেল নাজমুল সাহেবের বাসায়। প্রস্তাবটা জাওয়াদই দিয়েছে। বাবা যাবার পর ওরা তিনজন যখন গল্পে বসেছে তখন জাওয়াদ বলল, ‘ মামী কল দিচ্ছেন, বাসায় যেতে। না গেলে মনে কষ্ট নিবেন। আমরা যাব, ভাইয়া আপনি ও চলুন। আপনাদের ভাই বোনকে দেখে মামাদের চমকে দেয়া যাবে।’

প্রস্তাব মন্দ নয়। রাজি হয়ে গেল তারিফ। একটা নাগাদ পৌঁছল নাজমুল সাহেবের বাসায়। দরজা খুললেন ফরিদা। মুশরাফা জাওয়াদেরর সাথে তারিফকে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারলেন না। হুশ ফিরতেই প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইলেন, ‘তোমরা একসাথে? ‘

উত্তরে সবাই হাসল। কেউ খোলাসা করল না। ভেতরে বসবার পর জাওয়াদ তারিফের হাস্যরসী আলাপ দেখে মনে একটাই প্রশ্ন জাগল, ‘ এদের ভাব হলো কিভাবে? কদিন আগেও জাওয়াদ তারিফকে চিরশত্রু ভাবতো।’

উত্তর পেলেন না। মুশরাফাকে একান্তে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এদের ভাব হলো কিভাবে?’
‘ সকালে নামাজ থেকে ফেরার সময় ভাইয়াকে নিয়ে ফিরেছে জাওয়াদ। কিভাবে কী হলো, কিছুই বলে নি। আমার ভাবনা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ‘

কতগুলো বছর বাদে মুশরাফা আজ ভাইয়ের পাশে বসে ভাত খেল, এক টেবিলে পাশাপাশি। মুশরাফাকে মাছ খেতে দেখে তারিফ বলল,
‘তুই তো আগে কাটার ভয়ে মাছ খেতি না। এখন খাওয়া শিখে গেছিস!’

‘আমি তখন ছোটো ছিলাম ভাইয়া!’ হেসে বলল মুশরাফা। তারিফ ও হাসল, ‘ একটু লন্বা হয়েছিস, এই যা। নাহলে এখনো ছোটোই আছিস। সাবধানে খা, গলায় কাটা বিঁধবে।’

নাজমুল সাহেব চোখে বিস্ময়, মুখে হাসি দেখলেন দৃশ্যখানা। তার অসুস্থ মন ভাই বোনের মিলন দেখে ভালো হয়ে গেছে যেন। পূর্ণতা তবে হানা দিল!

বিকেলে বাড়ি যাবার পর তারিফ মাকে বলল, ‘আমি না হয় মাতাল ছিলাম, হুশজ্ঞান ছিল না। কিন্তু তুমি তো সজ্ঞানে ছিলে, তাও মুশির সাথে এমনটা কিভাবে করলে মা?’

চলবে…

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here