স্বর্ণাভ সুখানুভূতি। #দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-২৫)

#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি।
#দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-২৫)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

অন্য দিনের তুলনায় আজকের সকালটা ভিন্ন। । হবে নাই বা কেন? ইদ যে কড়া নেড়েছে দুয়ারে। রবের সন্তুষ্টি লাভের জন্য ত্রিশটা রোজা রাখবার পর খুশির পেয়ালা নিয়ে মুসলমানের দুয়ারে হানা দিয়েছে ‘ইদ’।
কাকডাকা ভোরে নাক ডেকে ঘুমানো মানুষ আজ চোখ থেকে ঘুম ঠেলে উৎসবে মেতেছে ঘরে ঘরে সাজ সাজ কলরব, খুশির আমেজ সারা দেশে। সেমাই, জর্দা, পায়েশের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে চারপাশ। গৃহিণী ব্যস্ত হাতে মিষ্টান্ন বানাচ্ছেন। ছেলে বুড়ো পাঞ্জাবি পরে আঁতর মেখে ছুটছে ইদগাহে। মেয়েরা প্রসাধনী মেলে সাজতে বসেছে আয়নার সামনে ছোটো ছোটো মেয়েরা সেজেগুজে বড়োদের সালাম করে সালামী জন্য হাত পেতে আছে। হাসি সরছে না কারো মুখ থেকে। কী চমৎকার পরিবেশ!

মুশরাফা কেবিনেট থেকে সেমাইয়ের প্যাকেট নামিয়ে এক পলক তাকাল জানালা দিয়ে। বাবার হাত ধরে মসজিদে যাওয়া বাচ্চা দলকে চোখে পড়ল। স্মিত হাসল সে। নিজের বাবার কথা স্মরণে এলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুলোয় নজর দিল। বলয় আসা দুধের পাতিলে চোখ ফেলতেই স্মরণে এলো মা ও।
বাবা মাকে ছাড়া এই প্রথম ইদ তার। সম্পর্ক যেমনই হোক প্রতিবছর ইদটা নিজ বাড়িতেই করত সে। ইদের দিন সকাল সকাল উঠে পায়েশ রাঁধত নিজ হাতে। তারপর নিজে বেড়ে টেবিলে নিয়ে ডাকত বাবা মাকে। মুশরাফার সাথে বাবা মা’র সম্পর্ক যতটা খারাপ ছিল মুশরাফার হাতের রান্নার সাথে ততটা খারাপ ছিল না। অন্তত ইদের দিন খারাপ করতেন না তারা। পায়েশটা খেতেন তারা। বলা বাহুল্য, মুশরাফার রান্নার হাত চমৎকার। তার হাতের পায়েশ অমৃত। মনের টানে নয়, পেটের টানেই খেতেন। তা বুঝেও মুশরাফা তুষ্ট হতো। আজ পেটের টানে ও খাওয়ানোর জন্য সে নেই কাছে। অদৃশ্য এক শূন্যতা এসে ঝেঁকে বসেছে মুশরাফার মাঝে। সেই বিষাদলগ্নে হাজির হলেন দ্বিতীয় মা, ফরিদা। ফোন দিলেন। ধরতেই হেসে বললেন,
‘ইদ মোবারক, মা। তোর পছন্দের জর্দা করেছি। কখন আসবি? এসে সব শেষ করে দিয়ে যাবি।আর হ্যাঁ, প্রতিবারের মতো দুপুরের খাবার কিন্তু এখানে এসে খাবি বলে দিলাম।’

মামীর প্রশ্নবাণে হেসে ফেলল মুশরাফা। তার মন খারাপ লগ্নে ফরিদার উপস্থিতি যেন বাধ্যতামূলক। মামীর মমতায় মুশরাফা কোমল স্বরে বলল, ‘ ইদ মোবারক মামী। তোমার ভুললে চলবে না আমার জীবনটা আগের মতো নেই। বিয়ে হয়েছে, স্বামী, সংসার শ্বশুরালয় আছে। প্রতিবারের নিয়ম বদলেছে।’
ফরিদা অভিমানী সুরে বললেন, ‘ বিয়ে হয়েছে বলে আমাকে ভুলি যাবি? আসবি না? বাসাটা কেমন খালি খালি লাগছে। ইদের দিন তুই না এলে ইদের আমেজ থাকে না। ‘

মুশরাফা হেসে বলল, ‘তুমি আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছো মামী!’
‘করলে করছি। আমি এত কিছু বুঝিনা। দুপুরে জামাইকে নিয়ে এখানে এসে খাবি, ব্যাস। ‘

মামী-ভাগ্নির কথার মাঝে জাওয়াদের ডাক পড়ল, ‘রাফা? রাফা?’

সংক্ষেপে কথা শেষ করে রুমে গেল মুশরাফা। দেখল জাওয়াদ সবে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। মুশরাফাকে দেখে বলল, ‘আমার পাঞ্জাবিটা বের করে রাখো তো।’
মুশরাফা পাঞ্জাবি বের করে রাখল। রান্নাঘরে এসে চুলো বন্ধ করল। ইদের দিনের সুন্নত এবং মুস্তাহাব কাজগুলোর একটি হচ্ছে গোসল করা। মুশরাফা সকাল সকাল গোসল সেরে নিয়েছে আজ। ইদের শাড়ি পরা হয়নি। বাসায় পরার সুতি থ্রি-পিস পরে ছিল। পাশের রুমে গিয়ে দেখে ঝটপট চেঞ্জ করে শাড়ি জড়াল গায়ে। জাওয়াদের দেয়া কালো শাড়ি। হালকা কাজল ও লাগাল চোখে। আধভেজা চুল ছেড়ে দিল, কক্সবাজারের সেই দিনকার মতো। তারপর আবার রান্নাঘরে ফিরল। তিনটা খেজুর ধুঁয়ে মুঠোয় গুজে নিল। তারপর রুমের দিকে গেল। জাওয়াদ পাঞ্জাবি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে বোতাম লাগাচ্ছে। মুশরাফা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল স্বামীর দিকে। জাওয়াদ তার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। মুগ্ধময় চোখে তাকিয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। আকস্মিক হেসে ফেলল। কোমল সুরে বলল, ‘মাশা আল্লাহ। সুন্দর লাগছে। ‘

মুশরাফা স্মিত হাসল। কিছুই বলল না। ড্রেসিংটেবিল থেকে আঁতরের শিশি নিয়ে জাওয়াদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জাওয়াদ ভ্রু নাড়াল। যার অর্থ কী? মুশরাফা উত্তরে আরও কাছ ঘেঁষল। জাওয়াদের বুকের কাছে দাঁড়াল। আঁতরের শিশি খুলে বুকে আঁতর ঘষল আলতো হাতে। কোমল স্বরে বলল, ‘ইদ মোবারক। ইদের দিন সুগন্ধি মাখা সুন্নত।’

এত রোমান্টিকভাবে কেউ কাউকে ইদের শুভেচ্ছা জানায়! সুন্নত পালন করছে সেখানেও। জাওয়াদ বিস্মিত, মুগ্ধ। আলতো হাসি তার ঠোঁটে। বোতাম থেকে হাত সরিয়ে স্ত্রীকে আগলে নিয়ে দু’হাতে। কপালে অধর পরশ দিয়ে বলল, ‘ইদ মোবারক। তাক্বাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম। (অর্থ : ‘আল্লাহ তাআলা আমাদের ও আপনার নেকা আমল তথা ভাল কাজগুলো কবুল করুন।)’

মুশরাফা হাসল। মুঠো থেকে একটা খেজুর নিয়ে জাওয়াদের মুখের সামনে ধরল। জাওয়াদ প্রশ্রয়ের সুরে বলল, ‘ ইদ দেখি শুধু আনন্দ নিয়ে আসেনি, রোমান্টিকতা নিয়েও এসেছে। আজ এত রোমান্টিকতা! নট বেড।’

বলে খেজুর মুখে নিল। মুশরাফা ধীরে বলল, ‘আমি কেবল আপনাকে ইদের সুন্নত আর মুস্তাহাব কাজ জানিয়ে দিচ্ছি।’
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল, ‘খেজুর খাওয়ানোর মাঝে ও ফজিলত আছে?’

মুখের খেজুর শেষ হতেই মুশরাফা আরেকটি খেজুর মুখে তুলে দিল। হেসে বলল, ‘খাওয়ানোর নয়, খাওয়ার। ইদের দিন মিষ্টান্ন খেয়ে ইদগাহে যাওয়া সুন্নত। রাসূল (সাঃ) খেজুর খেয়ে যেতেন।
আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদুল ফিতরের দিন কয়েকটি খেজুর না খেয়ে বের হতেন না। অপর এক বর্ণনায় এসেছে, “তিনি বিজোড় সংখ্যক খেজুর খেতেন।” (বুখারী)’

বলে আরেকটি খেজুর মুখে তুলে দিল। তিনটা খেজুরেই ইতি টানল। মুশরাফার হাদিস এবং হাদিস মোতাবেক বেজোড় খেজুর খাওয়ানো দেখে জাওয়াদের মুগ্ধতার মাত্রা বাড়ল। এত চমৎকার পদ্ধতিতে যদি কেউ শরীয়তের বিধান শেখায় তবে কে না মানবে? মুশরাফা ছোট্টো কাজে রোমান্টিকতা, সুন্নত দুটোই পালন করছে। এতে ভালোবাসা ও বাড়ছে, সাওয়াব ও হচ্ছে। কী চমৎকার! এমন একজন সঙ্গী থাকলে আর কী লাগে? জাওয়াদ প্রফুল্লতায় আবার অধর ছোঁয়াল স্ত্রীর কপালে। আলতো হাতে গাল টেনে বলল,
‘ সালামী চাই না তোমার?’

মুশরাফা কপালে হাত ঘঁষে বলল, ‘আমি তো সালামী পেয়ে গেছি।’
জাওয়াদ হাসল। ওয়ালেট ঘেটে হাজার টাকার পাঁচটা নোট নিল। স্ত্রীর হাতে দিয়ে বলল, ‘ ওই সালামী দিয়ে খুশি ছাড়া কিছু কেনা যায় না। নাও, এগুলো নিয়ে চকলেট খেয়ে নিও।’

মুশরাফা নিতে চাইল না। প্রতিবাদী সুরে বলল, ‘আমি কি ছোটো বাচ্চা না কি!’
জোর করে হাতে গুজে দিয়ে জাওয়াদ বলল, ‘ স্ত্রীকে সালামি দেয়া স্বামী কর্তব্য। নাও। আর ড্রয়ারে নতুন টাকা আছে। জিহান আসবে দেখা করতে। সালামি চাইলে দিও। ‘

মুশরাফা এবার ফেরত দিল না। রেখে দিল। জাওয়াদ চুল ব্রাশ করে তৈরি হয়ে নিল। এর পর মুশরাফা
ধীর স্বরে বলল, ‘আপনি মায়ের কাছে গিয়ে পায়েশ চাইবেন।’

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল, ‘ তুমি পায়েশ করো নি!’ জাওয়াদের চোখে বিস্ময়। পায়েশটা জাওয়াদের পছন্দের। ইদের দিন পায়েশ খেয়ে ইদগাহে যায় জাওয়াদ। এ কথা অজানা নয় জাওয়াদের। তার ধারণা ছিল মুশরাফা তার জন্য পায়েশ করবে। মুশরাফা বলল, ‘না। ‘
‘কেন?’
‘ মা যতদিন আছে, ইদের দিন পায়েশ রান্নার দায়িত্বটা তার। এত বছরের একটা রীতি, মায়ের হাতের পায়েশ খেয়ে আপনারা ইদগাহে যান। বিয়ের পর এখন আপনি যদি আমার হাতের পায়েশ খেয়ে ইদে চলে যান। তবে জিশান ভাইয়ার জন্য পায়েশ বাড়তে গিয়ে মায়ের মনে হবে মেজো ছেলেটা সত্যিই আলাদা হয়ে গেছে। পুরনো স্মৃতি মনে পড়বে তার, কিছুটা দুঃখ হবে। আমি চাইনা মায়ের এমনটা মনে হোক। তার ছেলে তারই থাকুক। আমি মিষ্টান্ন হিসেবে খেজুর খাওয়াব আপনাকে, পায়েশের দায়িত্ব মায়েরই থাকুক। আপনি গিয়ে মায়ের কাছে পায়েশ চাইবেন। দেখবেন মা কেমন খুশি হয়।’ হেসে বলল মুশরাফা।

আজ জাওয়াদের মুগ্ধ হবার দিন। স্ত্রীর উপর ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ হচ্ছে। একটা মানুষের ধ্যান ধারণা এত সুন্দর হয় কী করে! ছেলে হয়ে এই বিষয়টা তার মাথায় আসেনি, অথচ পুত্রবধূ হয়ে ও শ্বাশুড়ি মনটা ঠিক পড়ে নিয়েছে। জাওয়াদ প্রসন্ন হাসল। বলল,
‘পায়েশ করে রেখো, এসে খাবো।’
‘আচ্ছা।’
‘ বাই দ্যা ওয়ে, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।’
‘কী সারপ্রাইজ! ‘
‘ফিরে এসে দিব। আসি। ফি আমানিল্লাহ। ‘
‘ এক পথ দিয়ে ইদগাহে যাবেন, অন্য পথ দিয়ে ফিরবেন। এটা রাসূলের সুন্নত। ‘

হেসে বেরিয়ে গেল জাওয়াদ।

জিশানের বাসায় গেল। সদর দরজা ভেজানো। জাওয়াদ ভণিতা ছাড়া ডুকল ভেতরে। বহুপরিচিত দৃশ্য চোখে পড়ল। মায়মুনা পায়েশ রান্না করে টেবিলে এনে রেখেছেন সবে। হাক ছাড়ছেন, ‘কোথায় তোমরা? পায়েশ হয়ে গেছে, এসো। জিশান? জাও…
বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। চাপা শ্বাস ফেললেন। জাওয়াদ দূর থেকে পরখ করে দেখল মায়ের চোয়ালে ভাসা চাপা কষ্ট। মেলাল মুশরাফার কথার সাথে। তারপর এগিয়ে গেল মায়ের দিকে। আগের নিয়মে হেসে বলল,
‘ আমি এসে গেছি, মা। পায়েশ ঠান্ডা হয়নি? আমি কিন্তু গরম খেতে পারব না।’

মায়মুনা চমকালেন। অবিশ্বাস্য চোখে চাইলেন! ‘তুই পায়েশ খাবি?’
জাওয়াদ স্বাভাবিকভাবে চেয়ার টেনে বসল, ‘হ্যাঁ। ‘
‘মুশরাফা পায়েশ করেনি? তুই ওর হাতের পায়েশ না খেয়ে এখানে এলি!’
‘ এত বছর তোমার হাতের পায়েশ খেয়ে ইদে গেলাম, বউ আসতেই নিয়ম বদলে যাবে? তা হবে না। ইদটা মায়ের হাতের পায়েশ দিয়েই হবে আমার। দাও, পায়েশ।’

মায়মুনা প্রাণবন্ত হাসলেন। চোখে জল ভিড়ল তার। হাসিমুখে আরেকটা বাটি নিলেন। জাওয়াদ মায়ের হাসিমাখা মুখ দেখে হাসল। মেলাল স্ত্রীর কথার সাথে। শ্রদ্ধা জন্মাল স্ত্রীর প্রতি। হাক ছাড়ল, ‘জিশান? আর কতক্ষণ লাগাবি? আয় তাড়াতাড়ি। ‘

জিশান এলো সেই ক্ষণে। ভাইকে টেবিলে বসা দেখে বলল, ‘ এখানে খেতে বসেছিস? বউ খাওয়া দেয়নি?’

জাওয়াদ হেসে বলল, ‘ বউ টউ হাজার এলেও মায়ের হাতের পায়েশ কেউ বানাতে পারবে না। বস। ‘

জয়নাল আবেদীন তৈরি হয়ে এলেন। জাওয়াদ সালাম দিল। ছেলেকে দেখে কিন্তু বললেন না তিনি, হাসলেন। দুই ছেলে আসায় বড়ো ছেলের কমতি চোখে পড়ছে। সে এলে টেবিলটা পূর্ণ হয়ে যেত।

মায়মুনা পায়েশ বাড়লেন খুশিমনে। খাবার মাঝে খালি চেয়ারটায় এসে বসল যায়েদ। অনুতপ্ত হয়ে বলল, ‘স্যরি মা, জিহানকে রেড়ি করাতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে। ‘
থেমে জিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একা একা খেতে বসে গেলি। আমাকে একটাবার ডাকবি না!’

কত অভিযোগ তার চোখে! জিশান অবাক হয়ে বলল,
‘আমরা ভেবেছি, তোমরা বউয়ের হাতের পায়েশ খেয়ে বেরুবে।’
যায়েদ বলল, ‘ আমি মায়ের হাতের পায়েশ খেয়ে নামাজে যেতে অভ্যস্ত। ‘
এক চামচ পায়েশ মুখে তুলে বলল, ‘মায়ের হাতের পায়েশের সাথে কারো হাতের পায়েশের তুলনা নেই। থ্যাঙ্কিউ মা।’

পুরনো আমেজ, পুরনো স্মৃতির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। টেবিলটা ভরে যাবার সাথে সাথে মায়মুনার মন ও ভরে গেল। কে বলে বিয়ের পর ছেলেরা পর হয়? এইতো তার ছেলেরা তারই আছে। তারা আলাদা, তবুও তারা এক। জিহান ও এসে বসেছে। সেও বলল, ‘আমি ও খাব এট্টু।’

মায়মুনা প্রাণোচ্ছল হেসে আরেকটা বাটি নিলেন। জীবনটা সুন্দর।
খেয়ে হৈচৈ করে নামাজের জন্য বেরিয়ে গেল সবাই। তারা যেতেই এ বাসায় এলো মুশরাফা। মায়মুনা তখন পেঁয়াজ কাটছেন নুডলস ভাজবেন বলে। নামাজ থেকে ফিরে জিশান খাবে। তার পরনে বাসার কাপড়। মুশরাফা বলল,
‘কী করছেন মা?’
‘নুডলস বসালাম। জিশান এসে খাবে।’

‘ আপনার রান্না করতে হবে না। আমি রেঁধেছি সবার জন্য। ইদগাহ থেকে ফিরলে দিব বলে। আপনি গোসলে যান। ‘

মুশরাফা শ্বাশুড়ি গোসলে পাঠাল। যাবার কালে বলল, ‘বেরিয়ে আপনার কাছে থাকা সবচেয়ে সুন্দর শাড়িটা পরবেন।’

মায়মুনা ভ্রু কুঁচকালেন, ‘কেন? কোথায় তো যাব না।’
মুশরাফা হেসে বলল, ‘ ইদের দিন নিজের সামর্থ্যের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম পোশাক পরিধান করা উত্তম। এটি ইদের সুন্নত ও মুস্তাহাব কাজের একটি। ‘

মায়মুনা বিস্মিত হলেন। এ কথা জানতেন না তিনি। মেয়েটার মাধ্যমে কত কী জানতে পারছেন তিনি।


শ্বাশুড়ির সাথে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে রুমে ফিরল মুশরাফা। আগে চোখে সুরমা ছাড়া কোন প্রসাধনী মাখেনি। এবার সাজতে বসল। ইদের দিন সুন্নত সম্মত সাজগোজ করার কথাও বলা হয়েছে। তার সাজ যেহেতু মাহররমই দেখবে তাই মুশরাফা নির্দ্বিধায় সাজল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাল। ব্লাশনে গাল রাঙাল। শ্যাডো, মাশকারায় সাজাল চোখ। কানে পরল ঝুমকো, দুই হাত ভরতি চুড়ি, আঙুলে রিং। আধভেজা চুল ব্রাশ করে ছেড়ে দিয়ে সাজগোজের ইতি টানল। তারপর দেয়াল ঘড়িতে চোখ ফেলে অপেক্ষায় বসল স্বামীর। বাসায় আসলে জাওয়াদকে চমকে দেবার পরিকল্পনা তার। তাকে এই সাজে দেখে জাওয়াদ চমকাবে নিশ্চিত। জাওয়াদের চমকানো মুখ দেখতে ভালো লাগে মুশরাফার।

অপেক্ষার প্রহর শেষে কলিংবেল বাজল। প্রফুল্ল হয়ে উঠল মুশরাফা। আয়নায় নিজেকে আরেকবার দেখে নিল। চুল ঠিক করে পা বাড়াল দরজার দিকে। প্রতিদিন লুকিং মিররে দেখে কে এসেছে। আজ তাও দেখেনি, সে নিশ্চিত জাওয়াদ এসেছে। ঠোঁটের কোণে চওড়া হাসির রেখা টেনে দরজা খুলল। আদুরে সুরে বলল,
‘আসসালাতু আলাইকুম। আমা..

সম্মুখে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে স্বর অবরুদ্ধ হলো। কথা বেরুল না, থেমে গেল ওখানেই। বিস্মিত, অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল চৌকাঠে দাঁড়ানো তারিফের দিকে। এখানে তো জাওয়াদের থাকার কথা ছিল, ভাইয়া কিভাবে এলো! ভাইয়া এসেছে! তাও তার বাসার দরজায়! এটা কি সত্যি? না কি সে স্বপ্ন দেখতেছে! মুশরাফার ভ্রম মনে হলো। সে চোখ পিটপিট করে চাইল। সেই ক্ষণে কানে একটা শব্দ বাজল, বহুপরিচিত শব্দ, ডাক। ‘মুশি?’

মুশরাফার বিস্ময় চূড়ায় উঠল। ভাইয়া তার দুয়ারে এসে তাকে ‘মুশি’ বলে ডাকছে! এটা সম্ভব! নিশ্চিত তার চোখের ভ্রম এটা।

এতকাল বাদে বোনকে দেখে বুক কাঁপল তারিফের। বড়ো হবার পর তো বোনের প্রতি বেখেয়ালি ছিল। মামার বাসায় প্রথম দেখায় খেয়াল করেনি সেভাবে, হাসপাতালে তো বোরকার আড়ালে থাকায় চোখ ছাড়া দেখেনি। আজ দেখল। কত বড়ো হয়ে গেছে তার ছোট্টো বোনটা! কিশোরী থেকে এখন পূর্ণ নারী। তবুও তারিফের মনে হলো মুশরাফা এখনো ছোটোই রয়ে গেছে। ছোটো বোন বড়ো ভাইয়ের কাছে কখনো বড়ো হয়না। সবসময় ছোটোই থাকে। তারিফের চোখে জল ভীড় করল। এ জল আনন্দের, বোনকে ফিরে পাবার আনন্দ। সে কিছু বলতে চাইল, পারল না। স্বর আটকে এলো। তাও কাঁপা স্বরে বলল,
‘আ…মা..র ছোট্টো মুশি কত বড়ো হয়ে গেছে! ‘

মুশরাফা তখনো নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। রা নেই তার মুখে। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না তার ভাই এসেছে। সেই ক্ষণে জাওয়াদ এসে দাঁড়াল তারিফের পাশে। স্ত্রীকে দেখে চমকাল বটে। মুশরাফা যে তাকে চমকে দিতে গিয়ে নিজেই চমকে গিয়ে তা টের পেল। মুখ চেপে হাসল সে। তারপর অভিযোগের সুরে বলল, ‘ একি রাফা, তুমি এখনো ভাইয়াকে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখেছো! এ কেমন কথা!’
তারপর শ্যালকের উদ্দেশ্যে বিনীত স্বরে বলল, ‘আসুন ভাইয়া।’

জাওয়াদের মুখে ‘ভাইয়া ‘সম্বোধন শুনে মুশরাফার অজ্ঞান হবার জো। শত্রুভাবাপন্ন তারিফকে এত সম্মান দিচ্ছে জাওয়াদ! তার আচরণে বুঝা যাচ্ছে জাওয়াদই এনেছে তাকে! এটা ও সম্ভব! সে আবার বাস্তব আর কল্পনার দ্বন্দ্বে পড়ল। স্বামীর অবয়বের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ভা..ই..য়া সত্যি এসেছে!’

জাওয়াদ হাসল। শ্যালকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখুন ভাইয়া, আপনাকে এখানে আনার দায়িত্বটা আমার ছিল। আমি এনেছি। আমার দায়িত্ব শেষ। এবার আপনার বোনকে বিশ্বাস করানোর দায়িত্ব আপনার। ‘
বলে সামনের দিকে পা বাড়াল।

চলবে…

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here