সেই_চিরচেনা_তুমি,পর্ব_২

#সেই_চিরচেনা_তুমি,পর্ব_২
#Alisha_Anjum

নয়নতারা বামের রুমের পঞ্চাশ নম্বর বেডের পাশে দাড়িয়ে আছে । দূর্বল, আধবোজা চোখে দেহ নিয়ে বেডের সাথে লেগে আছে সমুদ্রের মা। নয়নতারা বুঝে উঠতে পারলো না উনি ঘুমে আচ্ছন্ন কিনা। দ্বিধা নিয়ে ঠাঁই মিনিট দশেক দাড়িয়ে থেকে নয়নতারা বসে পরলো বেডের এক কোণে। পাশে থাকা ঝুড়ি থেকে হাত বাড়িয়ে একটা ফাইল নিলো। আসলেই সমুদ্রের মায়ের কি হয়েছে? রিপোর্টের পাতা উল্টালো নয়নতারা। সেই সাথে পরখ চালালো সমুদ্রের মায়ের দিকে। হাত, পা, মুখ বেশ ফুলো ফুলো। রিপোর্ট থেকে নয়নতারা বুঝে নিলো লিভারের সমস্যা। কিডনি একটা একেবারে বিকল। সরাতে হবে তাকে নিশ্চয়ই। আবারও চোখ রাখলো নয়নতারা নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে রিপোর্টে। ভাবনায় সে দারুণ ডুবন্ত। শান্ত সহ্য করতে পারলো না এ দৃশ্য। মাত্রই সে মায়ের কাছে এসেছে। নয়নতারাকে মায়ের পাশে দেখে তার ঝট করে রাগ হলো। হঠাৎ তেড়ে এলো নয়নতারার নিকট। নয়নতারার অজান্তে আচমকা এক টানে রিপোর্টের ফাইল ছিনিয়ে নিলো। আকস্মিক ব্যাপারে নয়নতারা হতভম্ব। মুখ উচিয়ে সামনে তাকাতেই চোখে ভেসে উঠলো শান্তর অশান্ত মুখচ্ছবি। নয়নতারা মিনিট দুয়েক সময় নিলো ঘটনা মস্তিষ্কে গাধার। তার বুঝতে বেশ বেগ পেতে হলো শান্তর রূঢ় আচরণ। তবুও এই ঠান্ডা মেয়ে মুখে ফুটিয়ে তুলল মুচকি হাসি। ভীষণ স্নেহ ভরাট কন্ঠে শুধালো

— কেমন আছো শান্ত? ঝিনুকের কি খবর? আমার বোনটা ভালো আছে? কতদিন ওকে দেখি না।

পরপর তিনটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো নয়নতারা। শান্ত কাপট্য হাসলো। প্রত্তুরে এক ঝাঁক ঘৃণা নিয়ে বলে উঠলো

— আল্লাহ যেমন রেখেছে।

— ঝিনুকের যত্ন নিও। ও একটু জেদি সামলে রেখো একটু ওকে।

শান্ত নয়নতারার এবারের কথায় আর রাগ দমিয়ে মিঠে কথা বলতে পারলো না। তার কাছে নয়নতারার কথাগুলো যেন নিতান্তই ন্যাকামি মনে হচ্ছে।

— বন্ধ করেন আপনার ঢং। বোনের প্রতি যখন এতোই যখন দরদ নিয়ে আসলেই পারেন আমার বাড়ি থেকে। আর আপনি এখানে কি করছেন? আমার মায়ের পাশে কেন আপনি? শান্তি হয়নি আপনার আমার ভাইয়ের জীবন খেয়ে? এখন কি চান? পুরো সংসার কি এখন ভেঙে ধুলোয় মেশাতে চান?

নয়নতারা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। শান্ত এসব কি বলছে? সমুদ্রের জীবন খেয়েছে মানে? কথাটা ভীষণ শ্রুতিকটু লাগলো নয়নতারার। সে সহ্য করতে পারলো না। নিজের নম্রতা বিসর্জন দিয়ে নয়নতারা হঠাৎই উচ্চ স্বরে বলে উঠলো

— ব্যাস! অনেক বলেছো শান্ত। ছোট হয়ে অনেক বড় কথা বলে ফেলেছো। আমি তোমাদের সংসার কিভাবে খেলাম? তোমাদের উচ্চবিত্ত সংসারে কি এমন হয়েছে যা আবার আমর জন্যই হয়েছে? তোমার ভাইয়েরই বা জীবন খেলাম কিকরে?

— আপনার জন্য ভাইয়া…..

তিনটা শব্দ উচ্চারণ করতেই থামতে হলো শান্তকে। থামানো হলো তাকে। হুট করে কোত্থেকে যেন আগমন ঘটেছে সমুদ্রের। সে ঝড়ের বেগে এসেই খপ করে হাত ধরে ফেলেছে শান্তর। থেমে যাওয়ার পরক্ষ এক সংকেত পেয়ে অগত্যা মুখের কঠিন কথাগুলো গিলে ফেলল শান্ত। ভাইয়ের পানে এক কড়া দৃষ্টি তাক করলো সে। তার চোখের ভাষা যেন এমন ছিল ‘তুমি বেশি খারাপ ভাইয়া। তোমার জীবন শেষ করা এই মেয়েকে তুমি আজও ঘৃণা করতে পারলে না।’

নয়নতারা সরু চোখে তাকিয়ে আছে দুই ভায়ের দিকে। সমুদ্র শান্তকে ছেড়ে এগিয়ে এলো নয়নতারার দিকে। ততক্ষণে সমুদ্রের মায়েরও ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি উঠে বসে পরেছেন বেডে। সমুদ্র দৃষ্টিতে কাঠিন্য এনে নয়নতারার উদ্দেশ্যে বলল

— তোমাকে না বলেছি আমার কোনো কিছুর আশপাশে না ঘেষতে? কথা শুনতে পাওনি তুমি? কিসের এতো মায়া দেখাতে এসেছো তুমি?

সমুদ্রের কথায় নয়নতারার রাগ হলো। অভিমান যেন সব ছুটে পালিয়ে রাগের জায়গা করে দিলো। নয়নতারা ব্যাপক চড়াও হয়ে বলে উঠলো

— কি সমস্যা আপনাদের? আমি হসপিটালে ট্রেনিং নিতে এসেছি। পুুরো হসপিটাল ঘুরে বেড়ানোর অধিকার আমার আছে। প্রত্যেকটা রোগীর সুবিধা অসুবিধা দেখতেই পারি আমি।

নয়নতারা কথাগুলো বলে সমুদ্রকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল শান্তর কাছে। একই তেজ বজায় রেখে বলল

— তুমি কি বলছিলে? আমি তোমাদের সংসার নষ্ট করেছি? এটা জোক্স হয়ে গেলো না? আমি তোমাদের পরিবারে না কখনো পা ফেলেছি, গিয়েছি। তাহলে আমি কিভাবে নষ্ট করলাম সংসার? বরং এটা বলতে পারো যে তুমি আমার বোনকে কেড়ে নিয়েছো আমার পরিবার থেকে। একটা চঞ্চল, সুখের কারণ তুমি নিয়ে নিয়েছো। ঠিকই তো পালিয়ে নিয়ে গেছো আমার বোনকে। কখনো আমরা কিছু বলেছি তোমাদের?

নয়নতারার কথার প্রত্তুতরে শান্ত হাশফাশ করে উঠলো। বলতে চাইলো অনেক কিছুই। কিন্তু ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলো না। সে কি ঝিনুককে তুলে এনে বিয়ে করেছে? নাকি ঝিনুক নিজেই ভালোবেসে হাত ধরেছে শান্তর। পালিয়ে বিয়ে করার প্রথম পদক্ষেপ তো ঝিনুকই নিয়েছে।

🍁
বেশ কিছু শক্ত কথা বলে বেড়িয়ে গেছে নয়নতারা। সমুদ্র অবজ্ঞার হাসি ছুড়ে দিয়েছে গোপনে। শান্তও তাকে রেগে কথা বলে চলে গেছে। সমুদ্র একাই বসে আছে মায়ের পাশে। মাকে কিছু ওষুধ খাইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। হঠাৎ পেছন থেকে আনার শান্তর কন্ঠ

— ভাইয়া আম্মুর অপারেশনের কি হলো? কত টাকা লাগবে?

সমুদ্র পেছন ফিরে চাইলো। মায়ের থেকে দূরে চলে এলো দুভাই। সমুদ্র বলল

— দুই লাখ।

শান্ত চমকে উঠলো। হতাশা নিয়ে আতঙ্কে বলল

— কিহ? এতো টাকা কেন?

— আমিও ভেবেছিলাম এক লাখের মতো লাগবে। কিন্তু….

— এতো টাকা কিভাবে জোগাড় হবে?

শান্তর কথায় সমুদ্র মাথা তুলে চাইলো। ছোট ছেলে শান্ত। কতই বয়স হবে। মাত্র অনার্স শেষ করলো ছয়মাস হলো। অনার্সে থাকতেই আবার বিয়ে করেছিল ঝিনুককে। দুজনেই সমবয়সী। অথচ এই বাইশ তেইশ বছরের ছেলে মেয়ে দুইটাই কত ধৈ ধৈ করে সংসারের জন্য। বড় ভাই হয়ে এসব মানতে কষ্ট হয় সমুদ্রের। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়।

— টেনশন নিস না। কিছু একটা ব্যাবস্থা হবেই।

শান্ত সমুদ্রের কথায় কিছুতেই ভরসা পেলো না। তার অবগতর বাইরে নয় অভাবী সংসারের ক্ষেত্র। শান্ত অস্থির চিত্তে পকেট থেকে সেই পঁচিশ হাজার টাকা বের করলো। সমুদ্রের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল

— এগুলো আমার জমানো ছিল ভাইয়া। আমার তো চাকরি যাওয়ার পর আমি নিঃস্ব।

মুখখানি অধঃকৃত শান্তর। টাকা না থাকলে পুরুষ কুলহারা হয়ে যায়। সমুদ্র আলতো করে হাত রাখলো শান্তর কাঁধে। পরম স্নেহ নিয়ে বলল

— এই টাকা দিয়ে আমাকে লজ্জা দিস না। আমরা তো ভাইয়ের বাইরে বন্ধুও। তুই নিঃস্ব তোকে কে বলেছে? বড় ভাই থাকতে এমন কথা বললে কিন্তু মন খারাপ হয়।

সমুদ্রের কথার পিঠে শান্ত মুচকি হাসলো। তবুও পুনরায় বলল

— না ভাইয়া এই টাকা নাও। তাছাড়া তুমি টাকা কোথায় পাবে। এমনিতেই অনেক টাকার ঋণ আছে।

সমুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শান্ত ঠিকই বলেছে। বাবা বিদায় নেওয়ার পর তাদের সবদিক থেকে যেন দুর্যোগ আবিষ্ট করে নেয়। সমুদ্র ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল

— একটা ট্রাক বেচে দেবো।

— মানেহ? আছেই মাত্র দুইটা ট্রাক। ভাইয়া তুমি বুঝতে পারছো? ট্রাক দুইটাই আমাদের সম্বল।

ভীষণ উৎকন্ঠা শান্ত। বর্তমানে ট্রাক দুইটা ছাড়া তাদের আর কিছু নেই। তাও আবার মামার থেকে ধার করে টাকা নিয়ে ট্রাক কেনা হয়েছে। সমুদ্রর কোনো ভাবান্তর হলো না শান্তর কথায়। বরং তার নিজেকে বড্ড বোকা মনে হলো। ছোটদের সব বিষয় বলতে নেই।
সমুদ্র কথা ঘোরানোর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো

— আজকে সোহানের স্কুল, প্রাইভেটের বেতন দেওয়ার কথা। যা তো একটু। বেতন গুলো দিয়ে আয়। মাকে একা রেখে তো আমি যেতে পারছি না। টাকা নিয়ে যা।

কথাগুলো বলে সমুদ্র পকেটে হাত দিলো। ওয়ালেট বের করে টাকার দিকে নজর করতেই তার বুক কেঁপে উঠলো। মাত্র তিন হাজার টাকা উঁকি দিচ্ছে। সমুদ্রের হাত থমকে গেলো। কি করে এবার সে সংসার চালাবে? সোহানের মোট বেতনই লাগে মাস ব্যাপি পাঁচ হাজার।

শান্ত স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। চোখে তার তীব্র রাগ। সে রাগে দুঃখে হনহন করে চলে যেতে লাগলো সমুদ্রের সম্মুখ থেকে। ভালোলাগে না আর এই অভাব। তীব্র বিতৃষ্ণা আসে জীবনের প্রতি। সবসময় তার এসবের অভিমুখে নয়নতারাকে দায়ী করতে ইচ্ছে করে। ভীষণ ঘৃণা করে সে নয়নতারাকে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here