সেই_চিরচেনা_তুমি,পর্ব:০১

#সেই_চিরচেনা_তুমি,পর্ব:০১
#Alisha_Anjum
#উষা_কথা

বিবিধ চিন্তাধারা বইছে যেন উথাল পাতাল ঢেউয়ে। মনটা বড়ই বিক্ষিপ্ত সমুদ্রের। মায়ের আজ অপারেশন করাতে হবে। ডাক্তার বলেছে গুরুতর অপারেশন। কিডনি প্রতিস্থাপনের ব্যাপার। সমুদ্র চড়া গরমে হাঁটতে গিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে গেলো। তারচেও বড় জ্বালা দিচ্ছে বুকের চিনচিন ব্যাথা। মাথার ঝাঁক ঝাঁক চিন্তা। কম করে হলেও তো তাকে এক লাখ টাকা হাতে নিতে হবে। অপারেশন যদি হয় পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে বাকি টাকা তার ওষুধ, বেড ব্যায়ে খরচ করতে হবে। সমুদ্র হাতের রিপোর্ট দিকে চলতি দশায় ক্ষণকাল তাকিয়ে রইল। কেন অভাবীদের এমন রোগে আঁকড়ে ধরে? এমন ব্যায়বহুল রোগ কি তাদের জন্য? সমুদ্র কোথা থেকে টাকা আনবে তার দরদী মায়ের জন্য? বাবা তো চলে গেছে চিরতরে তার উপর দায়িত্ব অর্পণ করে। দুটো ভাই আর মায়ের জীবনটা যে তার কাছে অনেক বেশি দামী।

অনিমেষ খেইহীন ভাবনার মাঝে সমুদ্র ভুলেই গেছে সে হসপিটালের ভীরের মাঝে হাঁটছে। মন তার একাগ্রতার সাথে চিন্তায় নিমগ্ন। নয়নতারা আসছিল সে পথেই। গতি তার দ্রুততম। আর্জেন্ট ডাক পরেছে তার। সমুদ্র তার সম্মুখে। নয়নতারার নজর দেখেনি তাকে। চিরচেনা মানব মানবি যে যার পথে হাঁটতেই নিয়তি যেন ভীষণ রেগে লাগিয়ে দিলো এক ধাক্কা। এ কেমন বেয়াদবি? সমুদ্রের মনের মানুষ সম্মুখে বিচরণ করবে আর সমুদ্র দেখা পাবে না? যতোই থাকুক দুঃখ, ব্যাস্ততা। পাঁচ চোখের তৃষ্ণার আজ একটু হোক না ছুটি। ধাক্কা খেয়ে ছিটকে দু হাত দূরে সরে গেছে নয়নতারা। দূরে গিয়ে আবার সংঘর্ষ পাকিয়েছে তার পিছু আসা তুরানের সাথে। আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত ধাক্কায় সমুদ্র অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। তার হাতের বেশকিছু পেপার মুঠো ছাড়া হয়ে গাড়াগড়িতে মেতেছে মেঝেতে। সমুদ্র সব ভুলে তড়িঘড়ি করে পেপার কুড়াতে ব্যাস্ত হলো। যেন পেপাারগুলোই তার সব। নয়নতারা বরাবরই শান্ত মেজাজের। তার ধাঁচে নেই কোনো বিশৃঙ্খলা বা রাগের ছোঁয়া। সে ধাক্কা সামলে নিয়েছে। ভীরের মাঝে আকস্মিক ধাক্কা লাগতেই পারে। সে বন্ধু তুরানের দিকে ফিরে হাসতে হাসতে সরি বলল। তুরান মুখ কুঁচকে রেখেছে। বেচারার বাম পা নয়নতারার জুতোর শক্ত উচু গোড়ালির কবলে নাজেহাল। নয়নতারা জানে না এখবর। সে নতুন উদ্দ্যমে ছুটতে লাগলো। ছোটার আগে একবার চাইলো অনাগত ব্যাক্তিটার দিকে। সাথে সাথে যেন তার থমকে গেল পা, রোধ হলো মুখের হাসি। সেই মানুষটা! পাঁচ বছর আগের সেই প্রিয়টা। নয়নতারা হঠাৎ দ্রুত হাঁটতে চাইলো। দু পা সমুদ্রের দকে অগ্রসর করতেই আবার থমকে গেলো। দৃষ্টির সমস্ত প্রসারণ ঘটিয়ে চাইলো সমুদ্রের দিকে। খা খা মরুভূমি বুকটায় যেন ঝড় উঠলো। চোখ ভেজা ভেজা হয়ে এলো। কেমন নেতিয়ে পরেছে যেন সমুদ্র। শ্যামলা রংটায় জমেছে যেন আধার। শুকিয়ে গেছে চোখ মুখ। নয়নতারার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। কি অবস্থা তার প্রিয়টার!

— কেমন আছেন ?

ধীর গলার প্রশ্ন নয়নতারার। সমুদ্র তড়িৎ গতিতে চাইলো সম্মুখে। নয়নতারার সাথে দেখা! এ যেন তার ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। ভীষণ বিভিষিকাময় মুহূর্ত। নয়নতারাকে দেখে তার বুকের ভেতরটা ছটফটিয়ে উঠলো। ঠিক যেমন দারুণ আহত পাখিকে শেষ মুহূর্তে আঘাত করলে দাপিয়ে উঠে। সে ঝটপট চোখ সরিয়ে নিলো। বাকি কাগজ হুলস্থুল করে গুছিয়ে সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল

— ভালো।

নয়নতারা চিত্ত প্রফুল্ল কিন্তু মনে অগাধ অপরাধবোধ, দ্বিধা। সে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে এবারও নরম সুরে শুধালো

— হসপিটালে যে? কারো কিছু হয়েছে?

সমুদ্র আড় চোখে একবার তাকালো নয়নতারার দিকে। তার গায়ে জড়ানো এপ্রোন। গলায় দেখা যাচ্ছে স্টেথোস্কোপ। সমুদ্র চোখ ফিরিয়ে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো

— ইন্টার্নি করা হচ্ছে নাকি?

— হ্যা।

— ওহ।

ছোট শব্দটা উচ্চারণ করেই সমুদ্র পা বাড়াতে চাইলো। ঠিক সেই মুহুর্তে নয়নতারা বাঁধা হয়ে সমুদ্র কে বলে উঠলো

— একটু কথাও কি বলা যাবে না আমার সাথে? এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন?

মনের কথা ফাঁস হওয়ায় সমুদ্র কিছুটা কেঁপে উঠলো। তবুও ধরাকে সরা জ্ঞান করে বলে উঠলো

— আমার কাজ আছে।

সমুদ্রের কথায় নয়নতারার মনটা বড্ড খারাপ হলো। তাকে বিস্তর এড়িয়ে যাওয়ার ব্যাস্ততা।

— ঠিক আছে। কিন্তু হসপিটালে কেন আপনি? আমাকে কি একেবারেই বলা যাবে না?

সমুদ্র দৃষ্টি ভূমিতে তাক করলো নয়নতারার প্রশ্নে। একটু সময় নিয়ে বলে উঠলো

— মা অসুস্থ। তাই হসপিটালে।

নয়নতারা চমকে উঠলো। সে শঙ্কিত গলায় বলে উঠলো

— কি হয়েছে আন্টির? কোথায় উনি?

— বামের ঘরের পঞ্চাশ নাম্বার বেডে।

নয়নতারা সমুদ্রকে আর কিছু বলতে চাইলো না। এ বেচারার মুখ চাপলেও আর একটা তথ্য দিবে না। নয়নতারা পা বাড়ালো সমুদ্রের মায়ের উদ্দেশ্য। তুরানকে বলে দিলো

— সাতাশ নাম্বার বেডে তুই যা। আমি যেতে পারবো না।

তুরান নয়নতারার কথায় আড়চোখে একবার দেখলো সমুদ্রকে। তারপর নয়নতারার উদ্দেশ্যে বলল

— এটা আর্জেন্ট ছিল নয়া। আমার মনে হয় গেলে…

— আমি যাবো না।

তুরানের অসম্পূর্ণ কথার মধ্যে নয়নতারার ঝাঁঝালো কন্ঠ। তুরান চুপ হয়ে গেল। সে আর একটা বাক্য অপচয় না করে হাঁটা দিলো নিজের গন্তব্যে। গমন পথে সে আরো একবার সমুদ্রকে দেখার থেকে বিরত হয়নি। সমুদ্রর বেশ বিব্রত লেগেছে।

— দেখি রিপোর্ট গুলো?

সমুদ্রের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল নয়নতারা। সমুদ্র পলকহীন তাকিয়ে রইল কেবল। তার চোয়াল ধীরে ধীরে শক্ত হলো। মাথায় রাগের আবির্ভাব ঘটলো। নয়নতারা কি তাকে মায়া দেখাচ্ছে? নাকি নতুন করে ফাঁসাতে চাইছে নব অনুভূতির জালে। সমুদ্র দু পা এগিয়ে নয়নতারার ঠিক মুখোমুখি দাঁড়ালো। নয়নতারা অবাক হলো বেশ। সমুদ্রের মুখ থেকে সে কড়া গলায় শুনতে পেলো

— যেমন হঠাৎ করে দেখা হয়েছে। ঠিক এভাবেই হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাও। আমাকে মায়া দেখাতে এসো না। আমার পোড়া হৃদয় আর পুড়িয়োও না নয়ন।

কথাগুলো বলে সমুদ্র হাঁটা দিলো নয়নতারাকে পিছনে রেখে। সে চায় না এই মায়াময় মেয়েকে দেখতে। তার নিকট আর ফিরে নিজেকে কষ্ট দিতে চায় না। নয়নতারা এক কুহকিনী, সম্মোহিনী। সে আশপাশে থাকলে সমুদ্র পারে না মায়ায় না পরে। মন যতোই ছটফট করুক নয়নতারার জন্য। সমুদ্র আর নয়নতারাকে তার ত্রি সীমানায় রাখবে না। সে বেশ আছে। মানিয়ে নিয়েছে সব। এই তো সে সব বুকে তালাবদ্ধ করে সংসারের ভার বইছে বেশ সুখে।

🍁
— শান্ত, আমার কছে এই সাড়ে সাত হাজার আছে। এটা নিয়ে যাও। আর এই যে আমাদের বাবুর জন্য তুমি একটা সোনার চেইন বানাতে চেয়েছিলে তার পঁচিশ হাজার। এখানে তো মোটামুটি তেত্রিশ হাজার হলো। এগুলো নিয়ে যাও। সমুদ্র ভাইয়া অনেক টেনশনে আছে নিশ্চয়ই।

ঝিনুকের চুপসে যাওয়া মুখের নিরস, চিন্তিত বাণী। বউয়ের এহেন কথার পিঠে, কাজের বিপরীতে শান্ত স্তব্ধ। এমনিতেই সে ঝিনুককে বিলাসিতা দিতে অক্ষম। হঠাৎ ঝড়ে পরিবার যেন একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। তার চাকরিটাও গেছে তিন মাস হলো। শান্ত বুঝে উঠতে পারছে না মায়ের অপারেশনের অর্থের একাংশ ঝিনুকের থেকে নেওয়া ঠিক হবে কিনা। নিশ্চয়ই মেয়েটার টিউশনির জমানো টাকা। তার ছয়মাসের বচ্চা পেটে নিয়ে ঝিনুক টিউশনি করিয়েছে। শুধু মাত্র কুৎসিত অভাবের তাড়নায়।

— কি হলো কি ভাবছো? নাও টাকা। দেড়ি হয়ে যাচ্ছে যাও তাড়াতাড়ি। যত তাড়াতাড়ি অপারেশন করা যায় ততই ভালো।

শান্তর ভাবনায় ছেদ পরলো ঝিনুকের কন্ঠে। শান্ত হাত বাড়িয়ে ঝিনুকের দুহাত নিজের মুঠোয় নিলো। কেমন চোখ জ্বালা করছে তার। বুকের মধ্যে চাপা কষ্ট যেন গুমড়ে উঠছে। আক্ষেপের সুরে শান্তর মুখে ফুটে উঠলো বাঁক

— আমি একজন ভালো প্রেমিকও হতে পারিনি। আজ একজন ভালো স্বামীও হতে পারলাম না তাই না? সবার মতো আমি তোমাকে সুখে রাখতে পারি না।

স্বামীর হৃদয়স্পর্শী কথায় বুকটা হু হু করে উঠলো ঝিনুকের। নারী মন আবেগে নয়ন নীর বিসর্জন দিলো। শান্ত ঝিনুকের পেটের উপর এক হাত রেখেছে। এই তো সাত মাস চলে। কিছুদিন পর নতুন অতিথি আসবে। তাদের কি অভাব ঘুচবে না এতোদিনে?

— ঝিনুক, বাবু আসার আগে আমরা সচ্ছল হতে পারবো না? আমাদের আগের বিলাসবহুল জীবন ফিরে আসবে না?

ঝিনুক কাঁদছে। শান্তর কথায় ঢোক গিলে আটকে দিলো কান্না। চোখ ভর্তি জল আর গাল ভর্তি হাসি নিয়ে বলে উঠলো

— ইনশাআল্লাহ। সব ঠিক হয়ে যাবে। বড় ভাইয়া আর তুমি মিলে অনেক বড় ব্যাবসা খুলবে। দেখে তুমি, আমরা অনেক ভালো থাকবো তখন।

শান্ত মুচকি হাসলো। উৎফুল্ল দেখালো তার চোখ। আত্মবিশ্বাস তার বুকে নতুন উদ্যমে জাগ্রত হলো। সামনের মেয়েটার কথায় সে প্রচুর ভরসা পায়। ভেঙে যাওয়া মন হুট করে গড়ে উঠে। এটাই বুঝি নারীদের ক্ষমতা। পুরুষ হৃদয় তারা নিমিষেই জোরা লাগিয়ে দিতে পারে। শান্ত ঝিনুকের হাত থেকে টাকা নিলো। শুধু পঁচিশ হাজার নিলো। সাত হাজার সে নিলো না। ঝিনুকের কপালে ছোট একটা চুমু এঁকে বলে উঠলো

— ওটা তুমি নিজের কাছেই রাখো। আমার নেওয়া সম্ভব না। আমি নিতে পারবো না ঝিনুক।

কথাটা বলে আর ঝিনুককে একটাও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে প্রস্থান করলো শান্ত। ঝিনুক পিছু ডাকতে গিয়েও থেমে গেলো। তার মন খারাপ হলো। তার টাকা কি শান্তর টাকা না? আর এখানে আবার নিজস্ব টাকা কিসের। যেখানে দুজনে মিলেই এক ঘর গড়া হয়। জেদী লোক!

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here