শেষ_বিকালের_আলো (পর্ব ৪)

#শেষ_বিকালের_আলো (পর্ব ৪)

রিকশায় যেতে যেতে অবনী তার ফেলে আসা দিনগুলোকে হাতড়ে বেড়াচ্ছে…অরণ্যের সাথে বিয়ের বছর দু’য়েক ভালো কাটলেও এর পরের দীর্ঘ বছরগুলোতে ধীরে ধীরেই অরণ্য পরিবর্তন হতে থাকে।অবনী আর সংসারের প্রতি অরণ্যের উদাসীনতা বাড়তে থাকে।

লিনসা হওয়ার পর অরণ্যর সাথে অবনীর দূরত্ব আরও বাড়তে থাকে।লিনসাকে নিয়ে কিছুটা সময় কাটালেও অবনীর জন্য অরণ্যর কোন সময় বরাদ্দ ছিলোনা।

লিনিয়ার জন্ম হওয়াটা ছিলো আরো কষ্টকর অধ্যায়।এই যুগের স্মার্ট ছেলে হওয়া সত্ত্বেও অরণ্য ২য় বার অপ্রকাশ্যভাবে কণ্যা সন্তান আশা করেনি।যেটা একমাত্র অবনী বুঝতে পেরেছিলো।এটা জানার পর থেকেই অবনী লিনিয়ার ব্যাপারে অরণ্যকে বেশি জড়ায়নি।তাতে অবশ্য অরণ্যেরও তেমন কোন আপত্তি ছিলোনা।তাই লিনসা খুব বাবা ভক্ত আর লিনিয়াটা মা ঘেঁসা হয়েছে।

অথচ স্বামী,সন্তান আর সংসারকে সময় দেয়ার জন্য অবনী তার চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে কাপড়ের অনলাইন বিজনেস শুরু করেছিলো।যাতে অরণ্যের উপরে তার পুরোপুরি ডিপেন্ড করতে না হয়।
অরণ্য বাসায় ফিরলে অবনী ইচ্ছে করেই মোবাইলে সময় কাটাতো না।নানা রকম বাহানায় অরণ্যের পাশে বসে গল্প জমানোর ট্রাই করতো। একবার কোন ফল বা নাস্তা নিয়ে আসতো তো আর একবার অরণ্যের অনুপস্থিতিতে ঘটে যাওয়া বাচ্চাদের বা বাগানের কোন ঘটনা বলতে আসতো। কিন্তু সে আশায় সেগুরে বালি। একতরফা গল্পে আসর জমে উঠতোনা কখনো।অবনীর কথা কিছু না শুনেই হুঁ হাঁ করতো অরণ্য।

বাইরে থেকে এসেই অরণ্য মোবাইল,ল্যাপটপ আর টিভি নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়তো।আর কোন ফোন আসলে যে কত সদালোপী ছিলো সে তার হাসিতেই বোঝা যেত।অবনী ভুলে গিয়েছে অরণ্য লাস্ট কবে তার সাথে এভাবে হেসে হেসে কথা বলেছিলো।

অবনী পরোক্ষভাবে প্রত্যক্ষভাবে অরণ্যকে বিভিন্নভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছে যে আগের দিনগুলো সে ভীষণভাবে মিস করে।অবনীর মাঝেমধ্যে খুব ইচ্ছে হয় দু’জন একটু হাত ধরে হাটতে।মাঝেমধ্যে একটু একসাথে বসে গল্প করতে।

খুব বেশি তো অবনীর চাওয়া পাওয়া ছিলোনা।কিন্তু কোনভাবেই অরণ্যকে বোঝাতে পারেনি।অবনীর চোখের কোল ভিজে যাচ্ছে, হঠাৎই রিকশাওয়ালার ডাকে অবনী সৎবিৎ ফিরে পেলো। “আফা আইয়া পড়ছি” অবনী ওড়না দিয়ে আলতো করে চোখ মুছে নিলো।

লিনসা তার মায়ের এত নিস্তব্ধতা দেখে আর কোন প্রশ্ন করেনি এখন পর্যন্ত।সে বুঝতে পেরেছে খুব খারাপ কিছু একটা হয়েছে।কিন্তু লিনিয়া বেবি খুব খুশি সে আম্মুর সাথে ঘুরতে বের হয়েছে।

অবনী তাকিয়ে দেখলো চারিদিকে টিনের বেড়া দেয়া একটা গেটের সামনে রিকশা থামলো।অবনী ঠিকানা মিলিয়ে দেখলো ঠিকই আছে। ফোনের কথা অনুযায়ী ইটের রাস্তার শেষ মাথার বাড়িটি। বাড়ির নাম লেখা আছে “বাগান বাড়ি”

অবনী রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ধীর পায়ে নামলো। টিনের গেইট ভিতর থেকে আটকানো।কয়েকবার দরজায় শব্দ করার পরে একজন ষাটোর্ধ ভদ্র মহিলা দরজা খুলে দিলেন।

অবনী সালাম দিয়ে ভদ্র মহিলাকে বলল “আমি অবনী”
ঘন্টা খানিক আগে বাসা ভাড়ার ব্যাপারে কি আপনার সাথে কথা বলেছিলাম?
ভদ্রমহিলা হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে ভিতরে আসতে ইংগিত করলেন। ভদ্রমহিলার পিছনে পিছনে অবনী ঢুকেই তার চোখ স্থির হয়ে গেলো।

বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই টিনের বেড়ার ভিতরে এত সুন্দর ছবির মত একখানা বাড়ি।
বাড়ির সামনের দিকটায় ফুলের বাগান,ফুলে ফুলে ভরে আছে।বাড়ির ঝুল বারান্দায় উঠে গেছে তিন রঙা বাগানবিলাসের ঝাড়।

বাড়ির ডানদিকে শান বাঁধানো ঘাট দেয়া স্বচ্ছ পানির পুকুর। পুকুর ঘাটে বাঁশ দিয়ে ছাউনি দেয়া।ছাউনির নিচে দু’পাশে দুটো কাঠ দিয়ে বেঞ্চ করা।ছাউনির উপরে দু’দিক দিয়ে বেয়ে উঠেছে মাধবীলতা।পুকুরে অজস্র শাপলা ফুটে আছে। অবনী বাড়ির নামের স্বার্থকতা খুঁজে পেলো।

এত মায়াময় নিরিবিলি পরিবেশ যে অবনী মন্ত্রমুগ্ধের মত স্থির দৃষ্টিতে দেখছিলো।হঠাৎই অবনীর তার আর অরণ্যের ভালোবাসায় আর যত্নে গড়া ছাদ বাগানের কথা মনে পড়ে গেলো।অবনীকে ছাড়া ছাদবাগান আজকাল অচল হয়ে পড়েছে।অরণ্য এখন আর একদমই সময় পায়না বাগান দেখাশোনার।

একটা সময় এই বাগান জুড়েই কিছুটা হলেও অরণ্যের সাথে সময় কাটতো।অবনী দীর্ঘ নি:শ্বাস ছাড়লো।
ঠিক এই সময়ে ভদ্রমহিলা কথা বলে উঠলো…
কি মা! তোমার বাড়ি পছন্দ হয়নি? অবনী অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর করলো না না কাকীমা…আপনার বাড়ি তো অসম্ভব সুন্দর। পছন্দ না হওয়ার প্রশ্নই আসেনা।

ভদ্রমহিলা এক গাল হাসি দিয়ে বলল, আসো মা তাহলে তোমাকে বাড়িটস ঘুরে দেখাই তুমি তোমার ব্যাগগুলো আপাতত নিচে রাখো।
ব্যাগগুলো বলতে অনেক ব্যাগ নয়।অবনীর বড় একটা ট্রাভেল ট্রলি ব্যাগ,লিনসার স্কুল ব্যাগ রাতে গুছানো ছিলো সকালে স্কুলের জন্য,সেই ব্যাগটা লিনসার কাছেই ছিলো এতক্ষণ আর তার একটা ভ্যানিটি ব্যাগ।

ব্যাগগুলো রেখে অবনী লিনসা আর লিনিয়াকে নিয়ে ভদ্রমহিলার পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলো।
ভদ্রমহিলা বলতে লাগলেন,আমি নিচতলায় থাকি আমার ছেলেকে নিয়ে,তোমার চাচা বছর পাঁচেক হলো আমাকে ছেড়ে ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন।
অবনী এই পর্যায়ে দু:খ প্রকাশ করল।ভদ্রমহিলা আবার বলতে লাগলেন, তুমি এই বাড়ির উপরতলায় থাকবে যদি তোমার পছন্দ হয়।
ভদ্রমহিলা অবনীকে প্রশ্ন করলেন তোমরা কে কে থাকবে মা?
অবনী বলল,আমি আর আমার এই ২ মেয়ে।ভদ্রমহিলা ভ্রু-কুঁচকে তাকালো অবনীর দিকে। বলল, তোমার স্বামী কোথায়?

অবনী কি উত্তর করবে ইতস্তত করতে করতে বলে ফেললো উনি দেশের বাইরে থাকে।কথা বলতে বলতে বাইরের সবুজ রঙের রডের সিঁড়ি বেয়ে ওরা উপরতলায় উঠে গেলো।গাছের সবুজে সিঁড়িটা হঠাৎ তাকালে চোখে পড়েনা।

ভদ্রমহিলা মনে হয়না অবনীর কথা বিশ্বাস করলো কিন্তু এই নিয়ে আর প্রশ্ন না করে ঝুল বারান্দায় ঢুকে ঘরের দরজার শিকল খুলল,কোন তালা নেই ঘরে।

ভদ্রমহিলা আবার বলতে লাগলেন, এই ঘরে আমার ছেলে আর তার বউ থাকতো,এখন ছেলে আমার সাথে নিচের ঘরে থাকে তাই এটা খালি পড়ে রয়েছে কয়েক মাস যাবৎ।

অবনীর খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিলো তার বউ কোথায় কিন্তু উনি যেহেতু নিজে থেকে বলেনি তাই অবনী আর আগবাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো না।

অবনী রুম ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো…প্রথমে ড্রয়িং আর ছোট ডাইনিং স্পেস,হাতের ডানেই শোবার ঘর।এই ঘরের জানালা থেকে পুকুরটা দেখতে একটা মায়াবতী হ্রদের মত লাগছে। পুকুর পাড়ে মাচা দিয়ে লতানো সবজি গাছ লাগানো।চমৎকার লাগছে দেখতে।শোবার ঘরে বিছানা ছাড়া একটা খাট দেখতে পেলো।এই ঘরের পাশেই ওয়াশরুম।আর পিছন দিকটায় কিচেন।

সবচেয়ে ভালো লাগলো বাসার পিছন দিকটা।কারণ কিচেনের সাইডে একটা কর্ণার বারান্দা।বারান্দা দিয়ে নিচে নেমে গিয়েছে একটা সিঁড়ি।
ভদ্রমহিলার পিছু পিছু সিঁড়ি দিয়ে নামলো অবনী।
পিছনে ফলের বাগান,মাঝে মাঝে সবজি আছে আর এক পাশে একটা টিউবওয়েল দেখতে পেলো অবনী। এটা দিয়ে হয়তো খাবার পানি সংগ্রহ করেন(অবনী মনে মনে ভাবলো)

অবনী চিন্তা করতে লাগলো এত কাজ কে করে এই বাড়িতে।সব কিছু গুছানো, এলোমেলো কিচ্ছু নেই।এমন একটা বাড়ি সবার স্বপ্ন থাকে।

অবনী হঠাৎ খেয়াল করলো লিনসা আর লিনিয়া পাকা পেয়ারা খাচ্ছে।অবনী রেগে গিয়ে বলল এগুলো না বলে ছিঁড়লে কেন গাছ থেকে!

লিনসা মাথা নিচু করে সরি বলে বলল: আম্মু খুব ক্ষুধা পেয়েছে!
অবনী হাতের ঘড়ি দেখলো…সকাল ১১ টা বাজে,এত চিন্তার মাঝখানে একদমই বাচ্চাদের খাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিলো।

ভদ্রমহিলা পরিবেশ সহজ করে দিলেন,অবনীকে বলল আরে ওরাই তো খাবে এগুলো এখন,এতদিন কাকপক্ষী খেয়েছে ফলগুলো। আমিতো পিছন দিকটায় তেমন আসিনা।আসো এবার আমার ঘরে চলো, নাতনীদের কিছু খেতে দেই, বলে ভদ্রমহিলা হাঁটতে লাগলেন বাড়ির সামনের দিকটায়।

বসার ঘরে অবনীদের বসতে বলে উনি ভেতরে চলে গেলেন।১০-১৫ মিনিট পরে পাউরুটি,কলা আর ডিম পোজ নিয়ে ফিরে আসলেন।
অবনীর একটু লজ্জা লাগলো…
অবনী: এগুলো কষ্ট করে আনতে গেলেন কেন কাকীমা!
কাকীমা: খাও খাও আর লজ্জা পেয়োনা মেয়ে! যেই ভোরে আমাকে ফোন দিয়েছো তাতেই বোঝা গেছে বাড়ি থেকে কিছু না খেয়ে বের হয়েছো!
অবনী: মনে মনে ভাবছে উনি কি সব বুঝে ফেলল নাকি! যাক! বুঝলে বুঝুক।

অবনী লিনসা আর লিনিয়াকে খাওয়াতে লাগলো আর ভাবতে লাগলো এত সুন্দর বাসা মাত্র তিন হাজার টাকা ভাড়া কেন! আর এই কয়েক মাসে ভাড়াই বা হলোনা কেন!

কিন্তু অবনী এখন অন্য কোথাও যাওয়ারও চিন্তা করতে পারছেনা। অবনীর মনের কথা মনে হয় ভদ্রমহিলা পড়তে পারলো! তিনি বললেন তাহলে বাসায় কি এখন থেকেই থাকতে শুরু করবে? ব্যাগ তো দেখি সাথে করেই নিয়ে এসেছো।

অবনী : জ্বী না…..মানে কাকীমা….আসলে কি হয়েছে!
কাকীমা: ঠিক আছে মা…সমস্যা নেই, তুমি আস্তে ধীরে তোমার মালপত্র নিয়ে এসো।
অবনী : মনে মনে খুশি হয়ে গেলেও মুখে তা প্রকাশ করলো না। ধন্যবাদ দিয়ে ব্যাগ নিয়ে উপরে তাদের ঘরে উপরতলায় উঠতে লাগলো….

চলবে….
লেখনী #নুসু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here