শেষ_বিকালের_আলো(১১ তম পর্ব)

#শেষ_বিকালের_আলো(১১ তম পর্ব)

এই বাগান বাড়িতে অবনীর ১ সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। অবনীর হাতের টাকা,সুটকেসে আনা টাকা সব শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন ব্যাংকের টাকায় হাত দিতে হবে।

বাসায় যে বাজার আছে তাতে আর ১ সপ্তাহের মত চলবে। যেহেতু অবনী ব্যাংকে যাবেনা তাই মোবাইল বের করে সেটা ওপেন করলো,তারপর ব্যাংক থেকে বিকাশে টাকা ট্রান্সফার করলো। আবার দ্রুত মোবাইল অফ করে রাখলো।

আসলে বসে বসে খেলে রাজার গোলাও ফুরিয়ে যায় এই প্রবাদ এখন অবনীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

অবনীর এই বাড়িতে অনেক কিছুই কিনতে হয়না। শাকসবজি আর ফল তো একদমই কিনেনি। কিন্তু গ্রোসারি,বাচ্চাদের এক্সট্রা খাবার কিনতে হচ্ছে।

অবনী এর মধ্যে একবারও তার বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে বের হয়নি শুধুমাত্র কেউ তাকে খুঁজে না পাক এই কারণে।

যত কিছু প্রয়োজন হয়েছে সবকিছু সুমন মিয়া আর নিলুফা বেগমের মাধ্যমেই ব্যবস্থা করেছে।

এই ১ সপ্তাহের মধ্যেই কাকিমার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছে। অবনী ভালো কিছু রান্না করলেই কাকিমাকে দেয়। কাকিমাও তার নাতনীদের না দিয়ে ভালো কিছু খাননা।

কাকিমা গল্পে গল্পে তার জীবন কাহিনী শুনিয়েছে। তার স্বামী তাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু তাদের মত ভালোবাসার সংসার তার একমাত্র ছেলের জীবনে ঘটেনি। এটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস।

এই বয়সে কাকিমা তার নাতি নাতনী নিয়ে কাটাবে এমন শখ ছিলো।কিন্তু সে সুখ তার কপালে নেই।

সেজন্যই অবনী আর তার বাচ্চাদেরকে কাকিমার অনেক পছন্দ হয়েছিলো।সে এরকম একজন ভাড়াটিয়াই মনে মনে খুঁজছিলেন নাকি!

কাকিমা তার ছেলের জীবনের কাহিনীও বাদ রাখলেন না বলা। তার একমাত্র সন্তান। বাবার থেকে একটু দূরে থাকলেও মাকে সব কথা বন্ধুর মত শেয়ার করতো।

ভার্সিটি জীবনে এক মেয়েকে খুব ভালোবাসতো তার ছেলে কিন্তু সেই মেয়ে আবার ভালোবাসতো অন্য এক ছেলেকে। বিয়ে করলে সে ওই মেয়েকেই করবে নাহলে কাউকেই করবেনা এমন পণ করে বসে রইলো ছেলে।

অবশেষে তার ছেলে একদিন মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো সে যে মেয়েকে ভালোবাসে সেই মেয়ে তার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে ফেলেছে।

ছেলের কষ্ট দেখে ছেলেকে কিছুদিন পর কাকিমা বিয়ে দেয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করলেন,কাকিমা ভেবেছিলো বিয়ে দিলে হয়তো ছেলে আগের কষ্ট ভুলে যাবে কিন্তু ফল হলো উলটো। কাকিমার বিয়ের জোরাজোরির কারণে তার ছেলে দেশের বাইরে পা রাখলো।

ছেলে বিদেশ থেকে ফোন দিলেই কাকিমা ইনিয়ে বিনিয়ে ছেলের কাছে বিয়ের কথা বলতো।তার এ বাড়িতে একা লাগে এসব বলতে বলতে…অবশেষে ছেলে কথা দিলো এবার বিদেশ থেকে এসে বিয়ে করবে।মেয়ে দেখতে বললো তার মাকে।

কাকিমা মহাখুশি হয়ে মেয়ে দেখতে লাগলো তার ছেলের জন্য।অনেকগুলো মেয়ের মধ্যে থেকে অবশেষে এক সুন্দরী মেয়েকে পছন্দ করলেন তিনি।

ছেলে বাইরে থেকে আসার পর ধুমধাম করে বিয়ে হলো।কিন্তু ছেলে বিয়ের রাতেই নতুন বউকে তার আগের ভালোবাসার কথা বলে দিলো এবং ছেলে আর বউ এর মধ্যে বিভিন্ন সমস্যার কারণে বিয়ে ৩ মাসের বেশি টিকলোনা।

ছেলে তার আবার বিদেশ পাড়ি জমালো।কাকিমা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলো এই বিয়ে জোর করে করানো ঠিক হয়নি ছেলেকে। কারণ বিয়ে ভাঙার পিছনে দোষ ছিলো তার ছেলের।

কাকিমাকে অবনী জিজ্ঞেস করেছিলো এই বাগান বাড়ি কার আইডিয়াতে করা? কাকিমা বলল,বাড়ি তার স্বামীর করা কিন্তু বাগানের আইডিয়া,গাছ লাগানো আরো যা যা অবনী দেখছে আশেপাশে তা সব তার ছেলের করা।

অবনীর মনে হচ্ছে যেন কত বছর ধরে এই বাড়িতে আছে। দুপুরবেলা অবনী রান্না করছে। লিনসা আর লিনিয়া গিয়েছে নিচে। তারা সুমন মিয়াকে দিয়ে বড়শি কিনিয়ে এনেছে।বড়শি দিয়ে পুকুরে মাছ ধরবে তাই।

অবনী ভাবতে লাগলো তার অনলাইন বিজনেস টা অফ হয়ে আছে।এটা চালু করা দরকার।কিন্তু অনলাইন বিজনেস চালু করতে গেলে তার খোঁজ পেয়ে যাবে সবাই।

আবার এ দিকে লিনসার পড়াশোনার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।লিনসার স্কুল ব্যাগ সাথে করে আনা হয়েছিলো তাই লিনসাকে অবনী বাসায় পড়াতে পারছে কিন্তু এভাবে আর কতদিন!

অবনীর মন দিনে দিনে এত বিক্ষিপ্ত আর খাপছাড়া হয়ে গিয়েছিলো যে অবনীর কোন পরিচিত মানুষের সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করেনা,কথা বলতে ইচ্ছে করেনা,কিছুই ভালো লাগেনা অবনীর।পরিবার-পরিজন, প্রকৃতি সব কিছুর উপরে বিষিয়ে আছে অবনীর মন।

শুধুমাত্র মেয়েদুটোর জন্য অবনীকে এখনও কর্মচঞ্চল থাকতে হচ্ছে। এই একটা মাত্র মানুষ অরণ্য, তার জন্য আজ কতগুলো মানুষকে অবনী কষ্ট দিচ্ছে।কিন্তু অরণ্য কি আসলে কোন কষ্ট পাচ্ছে!

অবনী হঠাৎ মেয়েদের চিৎকার শুনে বাইরে বেড়িয়ে এলো…অবনী ভয় পেয়ে গিয়েছিল কিন্তু এসে দেখে তার বড়শিতে একটা মাছ গেঁথেছে তাই খুশিতে লিনসা আর লিনিয়া চিৎকার করে চলেছে।

অবনী লিনসা আর লিনিয়াকে নিয়ে উপরে যাবে এই সময়ে কাকিমার সাথে দেখা হতে বলল, আগামীকাল তার ছেলে আসবে বাড়িতে। কাকিমাকে খুব খুশি খুশি লাগছে। তিনি খুব ব্যস্ত হয়ে পরেছেন তার ছেলে আসবে তাই।

সুমন মিয়া আর নিলুফাকে ডাক দিয়ে পুরো বাগান খুব ভালো করে পরিস্কার করতে বলল। বাগানের কোন অবহেলা দেখলে নাকি তার ছেলে খুব রেগে যায়।

বড় বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দিলো সুমন মিয়াকে। তার ছেলে যা যা পছন্দ করে সেগুলো বাজার থেকে দ্রুত নিয়ে আসতে বলল।

কাকিমাকে বলে অবনী বাচ্চাদের নিয়ে উপরে চলে গেলো।
অবনী কাজ করতে করতে ভাবেতে লাগলো…

কাকিমার এই আনন্দ উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক। এই একটি মাত্র ছেলে ছাড়া তার জীবনে কাছের আর কেই বা আছে। অবনীরও হয়তো ভালোলাগা উচিৎ যে যার গল্প এতদিন ধরে শুনেছে,যে এত সুন্দর বাগান করেছে তাকে দেখতে পাবে।

কিন্তু নাহ্… অবনীর মোটেও ভালো লাগছেনা,বরং খুব অস্বস্তি লাগছে। এতদিন ছিলো এক রকম।এখন বাড়ির মধ্যে একটা অপরিচিত পুরুষ আসবে সেটা তার ভালো লাগছেনা।

যদিও এটা ওনারই বাড়ি, অবনীরাই বরং পরগাছা তাওতো এতদিন নিজের বাড়ির মতই ছিলো। কাকিমার ছেলে এমনিতেই ভাড়াটিয়া দিতে রাজি হয়নি।এখন এসে তাদের দেখে কি বলবে সেটা নিয়েও অবনী একটা ভাবনায় পড়লো।এসে কতদিনই বা থাকবে কে জানে!

সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পরে অবনী তার বাচ্চাদের নিয়ে ১০ টার মধ্যেই শুয়ে পরে। এখানে তো রাহেলা খালা নেই যে সবকিছু গুছিয়ে দেবে।সব কাজ নিজের করতে হয়।তাই কর্মক্লান্ত শরীর শুয়ে পড়লে ঘুমাতে আর বেশি সময় লাগেনা।

অবনীর এখানে অনেক ভোরে ঘুম ভেঙে যায় পাখির ডাকে।এমনিতেই তার সকাল বেলায় ওঠার অভ্যাস তারমধ্যে রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরার কারণে অনেক ভোরবেলাতেই ঘুম ভেঙে যায়।

অবনী ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বাড়ির পিছন দিকটায় নামলো। পাখির মধুর কলকাকলিতে বাগান মুখোর হয়ে আছে। সব পাখিরা তাদের সকালের আহারে ব্যস্ত।কেউ অবনীকে খেয়াল করছেনা।

অবনী ঘাস মাড়িয়ে মাড়িয়ে সবজি বাগানের দিকটায় চলে গেলো। কিছু কাঁচা মরিচ আর ধনেপাতা তুলল বাগান থেকে ডিম মামলেট করার জন্য।

তারপর সামনের দিকটায় চলে গেলো হাঁটতে হাঁটতে…পুকুর পাড়ের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলো কিছুক্ষণ। মৃদুমন্দ বাতাসে পুকুরের পানির সাথে
শাপলা ফুলগুলো দুলছে। অবনী এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে….

হঠাৎ একটা পুরুষ ভরাট কন্ঠ অবনীর নাম ধরে ডেকে উঠলো….অবনী ঘুরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো….

চলবে…
লেখনী: #নুসু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here