শেষ_পেইজ #পর্ব_9(শেষ পর্ব)

#শেষ_পেইজ
#পর্ব_9(শেষ পর্ব)

বন্যা আপু বলে উঠলেন, সত্যিই? তুই পারবি আমার সন্তান দের আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে?

আমি মাথা নেড়ে সায় দিতে আপু আবার আমাকে ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরে। মনে হচ্ছিলো এই জীবনে বন্যা আপুর ঋণ আমি শোধ করতে পারবো বন্যা আপুর এই সুখ ফিরিয়ে দিয়ে।

কিন্তু সেদিনে সে আলিঙ্গনেও আমি বুঝতে পারি নি। আমি কি ভুল করতে চলেছিলাম। আমিই ছিলাম একটা দাবার গুটি।

বন্যা আপুকে আমি প্রমিজ করেছিলাম তাকে তার সুখ ফিরিয়ে দেবো।

আজ আমি তা করতে পেরেছি।

বন্যা আপুর কেইসের শেষ দিন আজ, বন্যা আপুর শাস্তি হয় নি।
আত্মরক্ষা ব্যাক্তিগত অধিকার
দন্ডবিধি 97 ধারা আর 98 ধারা বন্যা আপু আত্মরক্ষার জন্য করা আঘাত মওকুপ করা হলো।
আর বন্যা আপু তার সন্তানদের ফিরে পাওয়ার জন্য অনুমতি পেল।

আমার মনে হচ্ছে আমি এখন নিজেকে সর্বোচ্চ সুখী মনে করছি, কোর্ট চত্বরে বসে খুব কম মানুষ সুখী মনে করতে পারে নিজেকে।

কেইস হারার কষ্ট যে পায় আবার যে জিতে যায় সেও একটা ভোতা অনুভূতি নিয়ে যায়। যে ভাইয়ের সাথে আট বছর কেইস লড়ে জায়গায় উদ্ধার করে সেও সেদিন ভোতা একটা অনুভূতি নিয়ে ঘরে ফিরে।

ছয় মাস বাচ্চার কাস্টেডি নিয়ে যে দম্পতি কেইস লড়লো, যে হারলো সে যেমন হারলো যে জিতে গেল সেও হারলো। সবচেয়ে বেশি হারে সন্তানেরা।
সন্তানরা সবচেয়ে করুণ মুখ করে ফিরে।

এই মূহুর্তে বন্যা আপুকে দেখে তাকে জেতানোর জন্য নিজেকে সুখী লাগছে আমার। বিশাল কোর্ট চত্বরে আজ বন্যা আপুর হাসি শোনা যাচ্ছে। তার সন্তানদের তিনি ফেরত পেয়েছেন।

সেদিনের পর প্রায় ছয় মাস কেটে গেল। যে হাসি খুশি নির্মল বন্যা আপুকে আমি চিনতাম, রক্তাক্ত ভীত বন্যা আপুকে আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।

আজ সে হাসি খুশি আপুকে দেখে আমার ভীষণ খুশি লাগছে।

আমি বসে আছি। হাতে লাল চায়ের কাপ। বন্যা আপু দাঁড়িয়ে আদর করছেন তার দুই সন্তান কে।

মেয়েটা সত্যিই বন্যা আপুর মতো দেখতে। অর্পিতা শাস্তি হোক বন্যা আপু চায় নি। তিনি শুধু তার সন্তান কে ফেরত পেতে চেয়েছেন।
বাচ্চাগুলো বুঝতে পারছে না। কি থেকে কি হয়ে গেল, এত দিন যাকে মা ডেকে এসেছি সে তাদের ফুফু?
আর মামী তাদের মা।

মামাকে তারা ভীষণ ভালোবাসত। কিন্তু সে মামা বিছানায় পড়ে থাকা একটা মানুষ ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না।

আবীর ভাইয়া এখনো বেঁচে আছে। হয়ত তার পাপের শাস্তি ভোগ করতে। তবে তিনি কথা বলতে পারেন না। বললেও তা বুঝা যায় না।

অর্পিতার এক কথা, আবীর বন্যাকে ড্রাগ দিতো না। অর্পিতাকে ড্রাগ নেওয়া থেকে আটকাতো আবীর, ড্রাগ না পেয়েই এই অবস্থা করেছে বন্যা। বন্যাকে সে কিছুতেই বাচ্চা দেবে না। সেই কেইস করেছে। লড়ছিল এত দিন।

আমি সেরা উকিল ঠিক করেছি বন্যা আপুর কেইস লড়ার জন্য। আর রায়হান ভাইয়া টাকা ঢেলেছে।

রায়হান ভাইয়ার ডির্ভোস হয়ে গিয়েছে। উনি এখন পুরোপুরি বন্যা আপুর সাথে।
কিন্তু তাও আমার কেমন যেন ওদের একসাথে দেখলে একটা অদ্ভুত জ্বলুনি হয়।
মনে হয় আমি আবীর ভাইয়ের সাথেই বন্যা আপুকে এইভাবে সুখী দেখতে চেয়েছি।

বন্যা আপু ডি এন এ টেস্টের অর্ডার নেওয়া হলো হাই কোর্ট থেকে। তার শুনানী ছিলো আজ।

অর্পিতাকে দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো আজ। বাচ্চাগুলো মলিন চোখে বার বার তাকাচ্ছিলো।
অর্পিতাকে যতই আমি দোষী ভাবি না কেন, অর্পিতা মা হয়েই লড়েছে। আজ মা হয়েই হেরেছে।

আমি চায়ের কাপ টা কাঠের বেঞ্চে রাখলাম। কোর্ট চত্বরে খাঁ-খাঁ রোদ।

আমার সামনে অর্পিতা এসে দাঁড়ালো কালো সিল্কের শাড়ি এলোমেলো চুল, চোখের নিচে কালি, শুকিয়ে যাওয়া কান্নার দাগ। সব মিলিয়ে আমি তাকাতে পারছিলাম না।

আমি অন্য দিকে তাকালাম। এখন মানুষের খুব একটা শোরগোল নেই।

অর্পিতার ভেজার ন্যাতায় মোড়ানো গলার স্বরে বলে উঠলো।

– আমার বাচ্চাগুলোর পড়াশোনার অসুবিধা হচ্ছে। বার বার এই আদালতে আসাও অসুবিধা। ওদের মনে অনেক ধকল যাচ্ছে।

আমি মানলাম আমি ওদের মা না। কিন্তু আমিই তো ওদের মা ছিলাম। আছি,থাকবো।

ওদের মুখের দিকে তাকিয়েছেন আপনি?

বন্যা কিছু জানে ওদের সর্ম্পকে?কার কি খেতে ভালো লাগে? কার কিসে এর্লাজি?

বলতেই বলতেই আঁচল খানা মুখে তুলে দিলো৷ তারপর সময় নিলো।

এইবার কান্না জড়ানো কষ্ট টা পরিস্কার হয়ে গেলো৷ আর চোখ দিয়ে কান্না ঝড়ে পড়ছে।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

-বিশ্বাস করুন লাবণী, আমার ছেলেমেয়েদের যদি কখনো কোন ক্ষতি বন্যা করার চেষ্টা করে দেখবেন আমি আপনার কি অবস্থা করি। এই ইউনিফর্মের জোরে বন্যাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন তো। দেখবেন এইটায় আমি খুলে নেব।
আর আপনি নিজেও কোন দিন আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি পাবেন না।

আমি একটাও শব্দ করলাম না। এই প্রথম আমার বন্যা আপু হেল্প করার জন্য একটু খারাপ লাগলো। আমার ছেলের চেহেরাটা মনে পড়লো। ওকে আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। একবার থানায় এনেছিলো এক ভোরে কোন এক মহিলা।

দাবী করতে কেউ আসে নি।খুব অসুস্থ ছিলো সে তাই কেউ দত্তক নিতেও এলো না।
ডিউটি ডিউটি করে আমিও বিয়ের চার বছর পর ও বেবি নেওয়ার প্লান করতে পারছিলাম না। তাই আমিই নিয়ে নিলাম।

আমার ছেলে হয়েই বড় হয়েছে সে৷ সারাদিনের ক্লান্তি শেষে একটুকরো সুখ সে আমার। আমাদের।

কিন্তু এখন যদি কেউ এসে তার মা দাবী করে আমার ছেলেকে কেড়ে নেয় আমিও বোধহয় অর্পিতার জায়গায় দাঁড়াবো।

অর্পিতা নেমে যাচ্ছে, আমি উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম, বললাম,

– জানি কষ্ট হচ্ছে। আমিও একজন মা। আমিও অন্য কারো সন্তান বড় করেছি। যদি কেউ এসে এত দিনের জমানো মায়া কেড়ে নিতে চায় আমি হয়ত তোমার চেয়ে বেশি কিছুই করব।

আমি জানি না আমার ছেলের মা কে ছিলো।কিন্তু তুমি জানতে। তাও তুমি জানাও নি। এইটা অন্যায় ছিলো।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে, অর্পিতা দুই পা দুই সিঁড়িতে দিয়ে আমার দিকে দৃঢ় চোখে ফিরে তাকালো।

বলল,

– তুমি যে অন্যায় আজ করেছো, তুমি কি মনে কর এই অনুতাপ তোমায় বাঁচতে দেবে?

যে বন্যায় জন্য আমার আর আমার ভাইয়ের জীবন বারো বছর আগের মোড়ে এসে দাঁড়ালো।

চিন্তা করো না, আমি আগের মতো ভেঙ্গে পড়ব না। কারণ আমি জানি, আজ না হয় কাল, একবছর হোক আর দশ বছর আমার সন্তানেরা আমার কাছে ফিরে আসবে। যদি বেঁচে থাকে। আমি ওদের অপেক্ষায় করব।

অর্পিতা নেমে গেল৷ আর একবার ও পেছন ফিরে তাকালো না। হয়ত আগুন জ্বলা কান্নাটা একান্তেই তার।

আমি কেমন যেন চুপ হয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ পর বন্যা আপু আর রায়হান ভাইয়া এসে দাঁড়ালেন সামনে৷ রায়হান ভাইয়া আর পরিপাঠি ড্রেস ছেড়ে টিশার্ট আর জিন্সে। চশমাও নেই আজ।

ছেলেমেয়ে গুলো এখনো শকে আছে। ওদের বুঝতে সময় লাগছে। লাগবে।

বন্যা আপু আমাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলেন।

-তোর এই ঋণ আমি আমার এই জীবনে শোধ করতে পারবো না।

আমি হাসার চেষ্টা করলাম,

-একে তো এইটা আমার দায়িত্ব, আর তোমার প্রতি আমার কর্তব্য ছিলো।

বন্যা আপু আমাকে আবার জড়িয়ে ধরলেন।
ওরা সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল। বন্যা আপুর কাঁধে হাত দিয়ে নামছে রায়হান ভাইয়া।

আমার চোখ বেড়ে পানি পড়তে লাগল। একদিন এইভাবে বন্যা আপুর কাঁধে হাত দিয়ে নেমেছিলো আবীর ভাইয়া।

সেদিন চোখে মুখে যে খুশি আর উজ্জ্বল সুন্দর সুখী প্রেম নিয়ে তারা ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে এই সিঁড়ি নেমেছিলো। সে স্বপ্নের স্থায়িত্ব কাল ছিলো দুইদিন।

সময়ের সাথে সাথে মানুষের সুখের সংজ্ঞা কীভাবে পাল্টে যায়?
গল্পের প্রথম পেইজে সেদিন যে মানুষ টার হাত ধরে সব ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সুখ ছিলো, আজ শেষ পেইজে এসে সে মানুষ টার কবল থেকে বের হতে পারাটা সুখ।

আমি আবীর ভাইয়ার জায়গায় রায়হান ভাইয়াকে মেনে নিতে পারছিলাম না।

বন্যা আপুর গল্পে সবাই নিজের দিক টা বর্ণনা করেছে। শুধু পারে নি আবীর ভাইয়া।

এই মানুষ এত নৃংশহ ছিলো উনার চোখেতর দিকে তাকালে আমার এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

রায়হান ভাইয়া আর বন্যা আপু গাড়িতে উঠে গেলেন। আমাকে হাত নেড়ে বাই বললেন। আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম।

তখন কনেস্টেবল হেমা এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,

– তুমি খুশি হয়েছো আমার মতো ওদের মিল দেখে?

হেমার ভারী শরীর সে চুপ করে তাকিয়ে আছে। আমি কাঠের বেঞ্চ থেকে আমার টুপিটা তুলে নিচ্ছিলাম, তখন হেমা বলে উঠলো,

– এই ছেলেটাকে আমি কোথায় যেন দেখেছি।

আমি মুচকি হেসে বললাম, এক শহরে থাকো। কোথাও না কোথাও দেখেছো।

হেমা আঙ্গুল মুখে নিয়ে চুপ করে থেকে আবার বলে উঠলো,
-এত দিন উনাকে আমি চিনতে পারি নি। আজ কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। আজ গেঞ্জি পরা দেখেছি তাই।

-কোথায় দেখেছো?

– থানায় দেখেছি।

আমি এইবার হেমার দিকে ফিরে তাকালাম।

– থানায়? কবে? কিসের জন্য?

– মনে নেই তবে চার পাঁচ মাস আগে বোধহয়। এমন টিশার্ট আর গেঞ্জি তে। একবার এসে অনেক ক্ষন বসে ছিলো৷ তারপর কোন কিছু না বলে চলে গিয়েছিলো৷

-আমি ছিলাম তখন?

– হ্যাঁ। আপনার সাথেই দেখা করতে এসেছিলো৷ কিন্তু আবার চলে গেলো। আপনি আসার পরেই উনি অনেকক্ষন বসে ছিলেন তারপর চলে যান। এরপর আরো একবার আসে বাইক হারিয়ে গিয়েছে বলে কমপ্লেইন করতে।

আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম। আমি থানায় আছি রায়হান ভাইয়া কি জানতো? তাই কি রায়হান ভাইয়া সেদিন অবাক হয় নি আমাকে দেখে?

তবে বন্যা আপু কেন চিনতে পারে নি সেদিন আমায়?

হেমা অন্যদিকে চলে গেল।
আমি দ্রুত বন্যা আপু আর রায়হান ভাইয়ার নাম্বারে কল দিতে শুরু করলাম। আশ্চর্য মাত্র পাঁচ মিনিটে ওদের নাম্বার বন্ধ।

আমি অর্পিতাকে কল দিলাম, রিং হচ্ছে বাট ফোন ধরছে না।

অনেকক্ষন পর একজন ফোন ধরে বলল,
– হ্যালো, আমি ট্রাফিক পুলিশ সাজ্জাত বলছি।
যার মোবাইল তার তো একটু আগে এক্সিডেন্ট হয়েছে। আপনি চলে আসুন।

আমি কোন কথা বলতে পারলাম না, দ্রুত ছুটলাম গাড়ি নিয়ে। হেমা ডাকতে লাগলো, ম্যাডাম কি হয়েছে?

পাঁচ মিনিটের রাস্তা। আমি যেতেই দেখলাম জট বেঁধে আছে, আমাকে দেখে সবাই সড়ে গেল।

অর্পিতা কালো সিল্কের শাড়িটা চিনতে আমার অসুবিধা হচ্ছে না।

উত্তপ্ত রাস্তায় উপুর হয়ে আছে অর্পিতা। মাথার বাম দিক থেকে কালচে রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

এত চাকরির বছরে এত এক্সিডেন্ট কেইস দেখলাম । প্রথম দেখায় নিজেকে অর্পিতার খুনী মনে হলো নিজেকে।

কি নিখুঁত খুন।

সাজ্জাদ এসে বলল,

– এই আপা টা সি এন জি দেখার জন্য রাস্তায় নামছিলো তখনিই একটা ট্রাক দ্রুত কোন দিকে যে এলো। কিছু বুঝতে পারার আগেই-
শালা আমি আসার আগেই পালিয়ে গেল। পেলে প্যাদানি দিতাম আর টাকাও হাতাতে পারতাম।

আমি ওর দিকে ফিরে তাকাতেই জিব কেটে মাথা নিচু করে সড়ে গেলো সে। বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে সড়তে বলছে।

আমি স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। সব কিছু যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

সাজ্জাদ এসে বলল,
-উনার মোবাইলে কল আসতেছে বার বার। এর আগেও একটা আসছে আমি উনার স্বামীকে বলেছি।

আমি হাত বাড়াতেই আমাকে ইস্তহস্ত করে মোবাইল টা দিলো সাজ্জাদ।
আমি কল টা রিসিভ করে কানে দিতেই, অন্য প্রান্ত থেকে কান্নার স্বর ভেসে এলো।

– অর্পিতা আপা, তাড়াতাড়ি আসেন৷ আবীর ভাইয়া কথা বলে না। জানি না। আমি একটু বাথরুমে গেসিলাম। কোথায় আপনি?

আমি আর কিছু যেন শুনছিলাম না। কানে বাজতে লাগলো ডাস্টবিনের পাশে ভীড় করে বসা কাক গুলো কর্কশ কা কা শব্দ।

অনেকক্ষন পর হেমা ছুটে এলো। হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলল,
– ম্যাডাম, এইটা আপনার জন্য মনে হয়।

আমার ফাইলের ভেতর কে যেন ঢুকিয়ে দিয়েছিলো।

কথা বলতে বলতে অর্পিতা কে দেখে আঁতকে উঠলো সে।

নিচু হয়ে বসে নিশ্বাস পরীক্ষা করছে। আমার হাতে হেমার দেওয়া হলুদ খাম টা।

গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে, প্রিয় লাবণী।

আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। আমি বসে পড়লাম, মনে হতে লাগলো আমি কি সত্যিই কোন ভুল করে ফেললাম?

হেমা দৌড়ে এসে আমায় ধরে গাড়িতে বসালো। বলল,
আপনি অফিসে যান এইদিক টা আমি সামলে নিচ্ছি।

আমি চুপ হয়ে রইলাম। খাম টা হাতেই ধরা। খুলতে যেন হাত কাঁপছে।

খুললাম, বিশাল একটা চিঠি। বন্যা আপুর হাতের লেখা। একসময় অনেক নোট করে দিতো আমায় আপু। তাই চিনতে না পারার কোন কারণ নেই।
গত কাল লেখা চিঠি, কালি গুলো কেমন যেন জীবন্ত।

প্রিয় লাবণী,

এই চিঠিটা যখন তোর হাতে যাবে তখন হয়ত আমি অনেক দূরে। তোর কাছে আমি আর তোর প্রিয় বন্যা আপুও হয়ত থাকবো না। কিন্তু তোকে না বলেও আমি যেন শান্তি পাচ্ছি না।

জানিস আমি যদি এইজীবনে কোন পূন্য করে থাকি তা হলো তোকে বোন বানিয়ে। পুলিশের চাকরিতে দিয়ে। তাই তুই আর আমাকে ধরার চেষ্টা করিস না।

তুই আমার জীবনের যেমন পূন্য, জীবনের পাপ ছিলো আবীর।

হ্যাঁ, যাকে ভালোবেসে আমি সব ছেড়েছি, ক্যারিয়ার মা বাবা এই পৃথিবীর সব সুখ সে আবীর আমার ভালোবাসা কখনো বুঝে নি।

এই পৃথিবীতে মেয়েদের বড় অভিমানী বলা হয় জানিস। কারণ মেয়েরা কাউকে ভালোবেসে থাকতে পারে। কিন্তু যে মেয়ে একবার তীব্র ভাবে ভালোবাসা পেয়েছে সে আর অল্প ভালোবাসা মেনে নিতে পারে না।
তাই বোধহয় বলা হয়,
মেয়েদের ভালোবাসতে না পারলে ছেড়ে দাও
অল্প ভালোবাসায় তার ভয়ংকর হয়ে উঠে
নিতে পারে না।

আমার হয়েছিলো তাই। আর জানিস তো যারা সবটা দিয়ে ভালোবাসে তারা চায় অপর জন ও সেভাবে ভালোবাসবে। কিন্তু তখন মেয়েদের বলা হয় তোমার কাছে ভালোবাসা মানে 24 ঘন্টা কথা বলা। সারাক্ষণ পাশে চাওয়া।

আমি আবীরকে এইভাবে ভালোবাসতে গিয়ে ওর কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছি।

আমি আবীরের জন্য বাবাকে খুন করেছি। আমার মাকে করেছি। ওর মাকেও।ওর মাকে আমি বালিশ চাপা দিয়ে খুন করেছি। কেউ বুঝে নি৷
আমি শুধু চাইতাম আবীর আমার হয়ে থাকবে।

কিন্তু আবীর সে টা বুঝেনি। কিংবা বুঝেছে৷

একসময় আমি ভাবতাম সন্তান হলে আবীর আমার আরো কাছে আসবে৷ কিন্তু না। আবীরের চিন্তা সারাক্ষন বাচ্চা নিয়ে। কাছে আসা যাবে না। ভালোবাসা যাবে না। বাচ্চার ক্ষতি হবে।

আবীরকে কাছে পাওয়ার জন্য আমি সব করতাম। কিন্তু না ওর কাছে আমি আরো অসহ্য হয়ে উঠতাম। হয়ত স্বাভাবিক হয়ত স্বাভাবিক নয়।

আমার মনে হতো কেন আমাকে ভালোবাসার জন্য আবীর কে অন্য কিছুর দোহাই লাগবে?
আমি তো আমিই।

কিন্তু না৷ আমাকে ভালোবাসার জন্য আবীরের কারণ লাগবে। নতুনত্ব লাগবে। যে সর্ম্পকে নতুনত্ব দরকার আর যাই হোক সেখানে ভালোবাসা থাকে না।

আবীরের এই গা ছাড়া ভাব। সারাদিন বাইরে থাকা আমি জাস্ট নিতে পারতাম না। তাই আমি ড্রাগস নেওয়া শুরু করি।

তখন আমার সাথে রায়হানের আবার যোগযোগ হয়। আমার মনে হলো যে ভালোবাসাটা আমি আবীরের কাছে চাইছি সেটা কখনোই আবীর ছিলো না। ছিলো রায়হান।

কিন্তু তাও আমি পারছিলাম না আবীর কে ছাড়তে। রায়হান আমাকে ভালোবাসলেও আমি তো বাসি আবীরকে।

আমি আবার চেষ্টা করলাম। আবীর আমি আর আমাদের সন্তান।

কিন্তু না,যেদিন জানতে পারলাম আবীর আমার সন্তান অর্পিতাকে দিয়ে রেখেছে সেদিন আমি ঠিক করলাম এদের আমি তিলে তিলে মারবো।

রয়হানেই আমাকে ড্রাগস এনে দিতো মাঝেমধ্যে। এই নিয়ে আমার আর আবীরের ঝগড়া হতো। মারধোর করতো আমাকে।

কিন্তু সেদিন আবীর আমাকে জানালো সে আমাকে ছেড়ে দেবে। তার নতুন প্রেমিকা হয়েছে। মিচুয়েল ডির্ভোস চায় সে। আমার সাথে থাকলে সে মারা যাবে।

যার জন্য নিজেকে এত কষ্ট দিয়েছি, এত আপণ মানুষ কে নিজের হাতে খুন করেছি সে আমায় ছেড়ে যেতে চায়?
আমি জাস্ট নিতে পারছিলাম না।

সেদিন আমি একা আবীরের হাত পা কাটি নি। রায়হান সহ ছিলো। রায়হান ধরেছে আমি কেটেছি।
ওকে সব বলেছি আমি যা যা করেছি। রায়হান ওর জিব কেটেছে। আমি চাই নি ও মারা যাক। আমি সবাইকে ওর আমার সাথে করা অন্যায় গুলো জানাতে চেয়েছি।
আর অর্পিতার থেকে আমার সন্তান দের ফেরত চেয়েছি।

আজ সব পেয়েছি। শুধু তোর জন্য। কীভাবে জানিস?

আবীর যখন আমাকে মারধর করতো তখন রায়হান যায় থানায় রিপোর্ট করতে। তখন রায়হান তোকে দেখে। তুই থানায় আমার আর আবীরের প্রেমের গল্প শোনাচ্ছিস।
তুই এখনো আমাকে এইভাবে মনে রেখেছিস সেটা আমি বিশ্বাসেই করতে পারছিলাম না। তখন রায়হান আবার গিয়ে তোর ছবি আনে।

আমি হয়ত কেইস করতে পারতাম কিন্তু এতে কি হতো বড়জোর আবীরের সাথে আমার ডির্ভোস হতো। এতে আমার খুন গুলো তো সামনে আসতো।
তাই আমি এই প্লান টা করেছি।

আমিই যেনে বুঝে প্লান করে আবীর কে এইভাবে যন্ত্রনা দিয়েছি।

তুই নিজেকে কখনো দোষী ভাবিস না। আমি সত্যিই ভালো মা হয়ে দেখাবো। রায়হানের সাথে ভালোভাবে সংসার করবো।
আমার কোন অফসোস নেই। আমি কাল যা করব তার জন্য। এরা দুইজন এইটারেই প্রাপ্য।

ইতি
তোর বন্যা আপু।

চিঠিটা আমি দুইবার পড়লাম, এরপর ছিড়ে কুচিকুচি করে উড়িয়ে দিলাম। চাই না এইটা আর কেউ পড়ুক।

চোখ বেয়ে পানি পড়ছে আবার। আমার মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে ভালোবাসা বিষয় টা এত কঠিন কেন? এত জটিল কেন? নেই কোন সমীকরণ।

বন্যা আপুকে দোষী ভাববো নাকি সাইকো? আমি জানি না। আমি ভুল করেছি নাকি ঠিক? আমি তাও জানি না।

শুধু একটা শিক্ষা নিলাম প্রফেশনাল লাইফে পারসোনাল মিলানো উচিত নয়।

আমি চাইলে হয়ত অর্পিতা বেঁচে থাকতো আজ। আর কেউ থাক না থাক।

ড্রাইভার থানার সামনে এনে দাঁড় করালো। ওকে বললাম, আমায় বাসায় দিয়ে আসো। আজ আর ডিউটিতে যাবো না।

সেদিনের পর আমি আর ডিউটিতে যাই নি কোনদিন।

অনেক দিন পর পত্রিকায় রায়হান ভাইয়ের ছবিতে চোখ আটকে গেলো।

বাকিটা পড়ার আর আগ্রহ জমে নি। জানি কি আছে? কি হয়েছে এই গল্পের শেষ পেইজে?

-সমাপ্ত।

অনেক ধন্যবাদ সবাইকে এত ধর্য্য ধরে এই গল্প টা পড়ার জন্য। আমি এত দেরীতে গল্প দিয়েছি। তাও সবাই এত আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেছেন। আপনাদের এই ভালোবাসায় লেখার অনুপ্রেরণা জোগায়।

#দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here