শিউলিবেলা,পর্বঃ ১২,১৩

শিউলিবেলা,পর্বঃ ১২,১৩
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ১২

মুচকি হাসে পিথিউশা, অরিত্রীর নির্বুদ্ধিতায় কিঞ্চিত অবাকও হয়। হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে,

-“আপনি যতোটা সহজ ভাবছেন সবটা অতোটাও সহজ নয়। ছোটবেলা থেকে অবহেলায় বড় হয়েছি আমি, হক পরিবারের মানুষজন যদি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতো তবে তা গ্রহণ করা আমার জন্য সহজ ছিলো কিন্তু তারা প্রথমদিন থেকেই আমাকে মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসতে লাগলো। তাদের কেবল একটাই চিন্তা, কিভাবে আমাকে একটা ভালো এবং নিরাপদ জীবন উপহার দেয়া যায়। আমি তাদের ভালোবাসা সাদরে গ্রহণ করতে পারছিলাম না, কারন আমার সবসময় মনে হতো আমার আপন বাবা-মা যদি আমার মায়া ত্যাগ করে জন্মের পরপরই আমাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলতে পারে তবে এ মানুষগুলোর জন্য আমাকে নিজেদের জীবন থেকে সরিয়ে দেয়া খুব বেশি কষ্টের হবে না। প্রতিনিয়ত ভয় হতো, মনে হতো এ মানুষগুলো আমাকে বের করে দিলে আমি নিরাপদ আবাসস্থল হারাবো, শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবো, পরিবার হারাবো, আবার না খেয়ে দিন পার করতে হবে, অন্যের কাছে হাত পাততে হবে। তাই ওনারা যা বলতেন চুপচাপ মেনে নিতাম এবং করার চেষ্টা করতাম। চতুর্থ শ্রেনী পর্যন্ত যা পড়া তা মা আমাকে বাসায়ই পড়িয়েছে। আমি যখন প্রথম স্কুলে যাই তখন দাদু তার পরিচিত এক বন্ধুর স্কুলে আমাকে পঞ্চম শ্রেনীতে ভর্তি করে দেন। ভর্তির সময় বাবা-মা আমার নাম পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমার মুখের দিকে একপলক তাকিয়েই আমার অমতের কথা বুঝতে পেরে দাদু বলেছিলেন, “পিথিউশা হক, ওর নামটাকে একটু ঘষামাজা করে ভর্তি ফর্মে এটা দিলেই হবে। ওর নাম পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই, এ নামটাই ওকে ভবিষ্যতে মনে করিয়ে দেবে ওর শেকড়ের কথা, অতীতের কথা। এতে করে জীবনে চলার পথে ও কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।” সত্যিই এ নামটা আমাকে আমার অতীত স্মরণ করিয়ে দেয় এবং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।”

হঠাৎ একগুচ্ছ বিষন্নতা এসে অরিত্রীকে চেপে ধরলো, বরাবরই তার মনে হতো সে বড্ড দুঃখী। কিন্তু আজ পিথিউশার অতীত জানার পর মনে হচ্ছে অরিত্রী ভাগ্যবান। অন্তত সে জন্মের পর পিতা-মাতাকে পেয়েছে, স্থায়ি আবাসস্থল পেয়েছে, অমিত আর অতসীর মতো সহোদর পেয়েছে, সুশিক্ষা পেয়েছে। পরমুহূর্তে মনে হয়, সব পেয়েও অরিত্রী ভীষণ একা, তার নিজের একজন মানুষ নেই। যে পিথিউশাকে সে তার অবচেতনে নিজ মনে ধারন করেছে সেই মানুষটা তার নয়, অতসীর… আবেগ সংবরণ করে অরিত্রী জিজ্ঞেস করলো,

-“আপনার পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কটা স্বাভাবিক হলো কি করে? সময়ের সাথে সাথে? নাকি এখানেও অন্য ব্যাপার আছে?”

পিথিউশার দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে যায়, উন্মুক্ত আকাশের দিকে দৃষ্টব স্থাপন করে বলে,

-“সময়ের সাথে সাথে কিছুই ঠিক হয় না, কেবল মানুষ মানিয়ে নিতে শিখে যায়। কিন্তু আমার গল্পটা অন্যরকম, আমি স্বাভাবিকভাবে সবটা গ্রহণ করতে শিখেছিলাম ঈশানের আগমনের পর। ওর আগমন আমাকে আগাগোড়া সম্পূর্ণ বদলে দিলো, আমার ভয়, অনিশ্চয়তা, সংকোচ সবটা কাটিয়ে সেখানে ভালোবাসা আর দায়িত্বের বীজ বপন করে দিলো। আমি যখন সপ্তম শ্রেনিতে তখন ঈশানের জন্ম হয়। মা তখন হাসপাতালের বিছানায় অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন, বাবা সদ্য জন্মগ্রহণ করা ছোট্ট ঈশানকে আমার কোলে দিয়ে বলেছিলেন, “পিথিউশা, তুমি এখন আর ছোটটি নও, তুমি এখন বড় ভাই। তুমি যে পথে যাবে তোমার সহোদরও তোমায় অনুসরণ করে সে পথে যাবে। ওকে আগলে রাখার দায়িত্ব আজ থেকে তোমার…” সে মুহূর্তে ছোট্ট ঈশানকে কোলে নিয়ে আমি অনুধাবন করলাম এতোদিন যে ভালোবাসা হারানোর ভয়ে আমার মন সংকীর্ণ হয়ে থাকতো সেখানে জন্ম নিয়েছে দায়িত্ববোধ। ভালোবাসার বাঁধন ছোটানো যায়, দায়িত্বের বাঁধন নয়। প্রথমবারের মতো কোনো দায়িত্ব এসে পড়েছিলো আমার উপর, আর তার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতরকার সকল সংকোচ নিঃশেষ হতে লাগলো। ঈশানের জন্মের পরও মা সবসময় আমার ভালো-মন্দ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, আর আমি ব্যস্ত থাকতাম ঈশানকে নিয়ে। সম্পর্কে আমারা ভাই হলেও আমার গুরুত্ব ওর জীবনে সবচেয়ে বেশি। এই যে আমি বিয়ের কথা ভাবছি, ঈশান পাগলটা এখনই নৃত্য করতে আরম্ভ করেছে, বাবা আর দাদু উপদেশ দিচ্ছেন, আর মা? মা ভয় পাচ্ছেন…”

অরিত্রী অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

-“ভয় পাচ্ছেন, কেনো? কিসের ভয়? ছেলে বিয়ে দেয়া তো ভালো কাজ, ভয়ের কি আছে?”

পিথিউশা মুচকি হেসে বলে,

-“তার আদরের ছেলে হাতছাড়া হবার ভয়। মায়ের ধারনা আমার অতীত জানার পর কোনো মেয়ে আমাকে বিয়ে করলেও যৌথ সংসারে থাকতে চাইবে না। যেহেতু তারা আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ নয় সেহেতু আমার স্ত্রী আমার সঙ্গে একাই সংসার বাঁধতে চাইবে। ব্যাপারটা মায়ের জন্য শঙ্কার, কারন মা আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। আমাকে ছাড়া উনি থাকতে পারবেন না… তাছাড়া আমিও ভেবে দেখেছি, যারা একদিন আমাকে নিজের পরিবার হিসেবে গ্রহণ করেছিলো তারা আজ আমার বড্ড আপন। তাদের ছেড়ে স্বার্থপরের মতো আলাদা থাকা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তাই আমাকে যে বিয়ে করবে তাকে আমার অতীত এবং বর্তমান জেনে আমার পরিবারের সঙ্গেই থাকতে হবে।”

অরিত্রী মুচকি হেসে বলে,

-“আপনার মাকে ভয় পেতে বারন করবেন, সঙ্গে এটাও বলবেন যে, উনি পৃথিবীর সেরা মা এবং একজন স্বচ্ছ হৃদয়ের মানুষ। যে মেয়ে ওনার পুত্রবধূ হয়ে আসবে সে হবে সৌভাগ্যবতী।”

পিথিউশার চোখেমুখে দুষ্টুমি ফুটে ওঠে, কিছুক্ষণ আগের থমথমে পরিবেশের রেশ কাটাতে বলে,

-“বলছেন? তাহলে সুযোগটা আপনি নিচ্ছেন না কেনো? আপনার সামনে তো সুযোগটা পড়েই আছে…”

অরিত্রীকে বোকার মতো চুপ করে বসে থাকতে দেখে উঠে দাঁড়ায় পিথিউশা, হালকা কেশে বলে,

-“ভাবুন আপনি, আমি আপনাকে দ্বিতীয়বার কিছু জিজ্ঞেস করবো না। আপনার উত্তর হ্যাঁ বা না তা আপনার ভাবনা শেষ হলে জানাবেন। তাতে যত সময় লাগে লাগুক, আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।”

অরিত্রী হঠাৎ যন্ত্রচালিত মানবের মতো বলে,

-“আমার সঙ্গে আমার বাসায় যাবেন? আমার পরিবারের মানুষগুলোর সঙ্গে পরিচিত হলেন…”

অরিত্রীর জানামতে আজ অতসীর দ্রুত বাড়ি ফেরার কথা, সে চাচ্ছে পিথিউশা একত্রে তাদের দু’বোনের মুখোমুখি হোক। নিজে থেকে সবটা খুলে বলার তুলনায় প্রশ্নের মুখে পড়ে জবাবদিহিতা করা তার কাছে সহজ মনে হলো। তাছাড়া সব যেনে যদি পিথিউশা অতসীর বদলে তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চায়, ঝুঁকি থাকলেও সুযোগটা নিতে চাইলো সে… তার মন জানে, সে পিথিউশাকে ভালোবাসে, সবটা জানলে হয় সে পিথিউশাকে সারাজীবনের জন্য হারাবে বা বাকি জীবনের জন্য পিথিউশা তার আপন মানুষ হবে! ভালোবাসা পেতে ঝুঁকি নিতে হয়, জানে অরিত্রী, তাই অনেক ভেবে ঝুঁকিটা নেবার সিদ্ধান্ত নিলো। মিথ্যে বলে আর ঠকাতে চায় না সে পিথিউশাকে, আজ সকল মিথ্যের অবসান ঘটুক…

অরিত্রীর প্রস্তাবে কিছুটা অবাহ হলো পিথিউশা, বিস্ময় কাটিয়ে উত্তর দিলো,

-“আপনার পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হতে তো দোষ নেই, তবে যাওয়া যাক?”
-“জ্বী, চলুন।”

১৭
অতসীর সঙ্গে পিথিউশার দেখা হয়েছে এবং কথা অনেকদূর এগিয়েছে ব্যাপারটা ঈশানের কাছে যেমন আনন্দের তেমন চিন্তারও। সে যতটা অতসীকে দেখেছে তাতে এতো সহজে কারো প্রতি দুর্বল হবার মতো মেয়ে না অতসী, তাছাড়া সে নিজেতে মত্ত থাকতে পছন্দ করে, আশ্রমের ব্যাপারটা তাই মানতে কষ্ট হচ্ছে ঈশানের, তাছাড়া কেনো যেনো অতসীকে পিথিউশার পাশে কল্পনা করতেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে ঈশানের। বাড়ির ছোট ছেলে সে, সর্বদা সবার আদরের পাত্র, বন্ধুমহলেও তার সুখ্যাতি আছে, কিন্তু অতসীর কাছে সে নিতান্তই গোবেচারা মানুষ। কেনো যেনো অতসীর সঙ্গে কথা বলতে, আগে পিছে ঘুরতে ভালো লাগে ঈশানের, মনে হয় কেউ তো আছে যে তাকে অন্যসবার চেয়ে আলাদা চোখে দেখে… ভাবতে ভাবতেই অতসীর নাম্বারে কল দিলো ঈশান, খুব কথা বলতে মন চাইছে তার। সাতবার কল করার পরও অতসী ফোন তুললো না, হঠাৎ ঈশানের দুশ্চিন্তা হতে লাগলো… অতসী ঠিক আছে তো! যা বেপরোয়া মেয়ে, কিছু হলো না তো আবার। নিজের অজান্তেই বাইরে যাবার জন্য পা বাড়ালো ঈশান। তার মাথার ঠিক নেই, সে জানে না সে কি করতে যাচ্ছে বা এর পরিণতি কি। সে কেবল জানে অতসীকে একবার সুস্থ অবস্থায় নিজের চোখে না দেখলে, একবার ওর গলার স্বর না শুনলে সে শান্তি পাবে না। অতসীর প্রতি এ বিশেষ অনুভূতির কোনো ব্যাখ্যা ঈশানের মন ও মস্তিষ্কে নেই, সেদিকে তার খেয়ালও নেই। সে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে, যেনো একটু দেরী হলেই তার প্রাণপাখি উড়ে যাবে…

চলবে…

শিউলিবেলা
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ১৩

হঠাৎই একটা পার্টিতে যেতে হয়েছে অতসীকে, সেট থেকে ফেরার সময়ই তাকে জানানো হয়েছে পার্টির কথা। তাড়াহুড়ায় সেভাবে জুতা নির্বাচন করা হয় নি। এখন হাঁটতে গেলেই গাউনে জুতার পাথর আটকে যাচ্ছে, যখন তখন পড়ে যাবার আশঙ্কা আছে ভেবে চুপচাপ এককোনায় বসে আছে সে। মনে মনে নিজেকে বকে দিচ্ছে বারংবার… এমন সময় ফোনের স্ক্রিনে “জোকার” নামটা ভেসে উঠতে দেখে মুচকি হাসলো সে। গতদিন ঈশানের অদ্ভুত সাজপোশাক দেখে এ নামটাই দিয়েছে তাকে অতসী। তার নাম্বারটা খুব কম মানুষের কাছেই আছে, ঈশান সে নাম্বারটা জোগাড় করেছে ব্যাপারটা তার জন্য বেশ অবাক করা। প্রথম যেদিন কল দিয়েছিলো সেদিন কল রিসিভ করার পরই এক নিঃশ্বাসে ছড়ার মতো করে বলেছিলো,

ভাবী, ভাবী, ভাবী-
চাই আমার ভাবী,
ওগো সুন্দরী,
হবে নাকি আমার প্রিয় ভাবী”

অতসী রাগ করতে গিয়েও রাগ করতে পারে নি, ফিক করে হেসে দিয়েছিলো। তারপর থেকে প্রায়ই ঈশান কল করে তাকে, কখনো রিসিভ করে তো কখনো করে না। এ মুহূর্তে একা বসে বিরক্ত হবার চেয়ে ঈশানের মজার মজার কথা শোনা উত্তম ভেবে ফোন রিসিভ করলো অতসী। ওপাশ থেকে ইশানের উদ্বিগ্ন কন্ঠ শুনে কিছুটা অবাক হলো অতসী, চটজলদি প্রশ্ন করলো,

-“আপনার গলার স্বর এমন শোনাচ্ছে কেনো? কাঁদছেন নাকি?”

ঈশান ধমকে বলে,

-“কাঁদবো কেনো মিস আতসবাজি, আপনার চোটপাটে কাঁদার সুযোগ আছে? সামনে গেলে কাঁমড়াতে আসেন, দূরে গেলে মাথা নষ্ট করে দেন। সমস্যা কি আপনার? কোথায় আপনি?”

অতসী মুচকি হেসে প্রশ্ন করে,

-“যাকে ভাবী বানানোর পণ করলেন তার প্রেমে পড়ে গেলেন বুঝি ঈশান বাবু?”
-“মোটেই না।”
-“তবে আমি কোথায় তা দিয়ে আপনার কাজ কি? আপনার ভাই কি নিজের হবু বধূর খোঁজ খবর রাখতে ব্যর্থ?”
-“মোটেই না।”
-“মোটেই হ্যাঁ, তাই তো আপনি কাজকর্ম ফেলে আমার পেছনে ছুটছেন। কোনো লাভ নেই, আমি না আপনার, না আপনার ভাইয়ের। আমি আমার… আর এ মুহূর্তে আমি আমাকে সময় দেবো, বিদায় মি. জোকার।”

ঈশান হতবম্বের মতো কিছুক্ষণ কানে ফোন চেপে দাঁড়িয়ে থাকলো। একজন মানুষ তাকে এভাবে মুখের উপর জোকার বলে কল কেটে দিবে ভাবতে পারে নি সে। নেহাত পিথিউশা অতসীকে পছন্দ করে, নতুবা ঈশান কখনোই অতসীর কাছে যেতো না, মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দেয় ঈশান। ক্ষণিক বাদে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, আসলেই কি সে অতসীর কাছে যেতো না! কোথায় যেনো একটা কিন্তু লেগেই থাকে…

১৮
অরিত্রীদের বাড়িতে পিথিউশার আগমন যেনো অতি সামান্য ব্যাপার। আতিকুর রহমান ও মিনতি রহমান খুব স্বাভাবিকভাবেই তাকে বাড়িতে স্বাগতম জানিয়েছে। এছাড়া অমিতও অল্প সময়ে পিথিউশার সঙ্গে মিশে গেছে। যে পিথিউশা সর্বদা চুপচাপ থাকতো আজ তার নতুন রূপ দেখলো অরিত্রী। সবার সঙ্গে বসে বেশ উৎসাহ নিয়ে গল্প করছে এবং শুনছে। অরিত্রীর ছোটবেলার গল্প। যতো দেখছে ততোই মুগ্ধ হচ্ছে অরিত্রী, বাবা-মা যদি অরিত্রীর ছোটবেলার গল্প করতে করতে অতসী প্রসঙ্গে চলে আসে! বাড়িতে এসে অতসীকে পাবে ভেবেছিলো, সকল মিথ্যের অবসান ঘটবে ভেবেছিলো, কিন্তু বিধাতার পরিকল্পনা বোঝা দায়। এ মুহূর্তে অরিত্রী ভেতর ভেতর ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে, আর যা’ই হোক পিথিউশার চোখে ছোট হতে চায় না সে। এ যাত্রায় বেঁচে গেল অরিত্রী, ডিনারের পর পিথিউশাকে বিদায় জানালো। যেতে যেতে পিথিউশা একদিন তার বাড়িতে যাবার প্রস্তাব জানাতে ভুলেন নি। অরিত্রী মুচকি হেসে পরে জানাবে বলে প্রসঙ্গ পাল্টালো। পিথিউশাকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই মিনতি রহমানের প্রশ্নের মুখে পড়লো অরিত্রী। পিথিউশা কে, তার পরিবার কেমন, বিস্তারিত জানতে চাইলো। পিথিউশার অতীত গোপন করে বাকিসব ঠিকঠাকভাবেই মাকে জানালো অরিত্রী। সঙ্গে এটাও বললো, পিথিউশা চায় তার পরিবারের সঙ্গে অরিত্রী দেখা করুক। এছাড়া অতসী এবং অরিত্রীকে নিয়ে পিথিউশার যে কনফিউশন তা’ও জানালো মাকে। সব শুনে মিনতি রহমানের কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো, অরিত্রীকে নিয়ে তার বরাবরই চিন্তা। তার এই মেয়েটা এমনিতেই আবেগী, এ আবার নতুন কোন ঝামেলায় জড়ালো! অনেক ভেবে তিনি অরিত্রীকে পিথিউশার পরিবারের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দিলেন, বললেন,

-“ওদের বাড়ি যা, কথা বল বাড়ির সবার সঙ্গে। যদি মনে হয় ওদের পরিবারের সবাই তোর জন্য পারফেক্ট তবে ছেলেটাকে সবটা খুলে বলিস নতু্বা নিরবে সরে আসিস।”

এখন অবধি পিথিউশার পরিবার সম্পর্কে যা শুনেছে তাতে পরিবারটার প্রতি অরিত্রীর আগ্রহ কম না। প্রথমবারের মতো মায়ের পরামর্শ পছন্দ হলো তার, অতি আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরলে মা ঝারি দিয়ে বললো,

-“এসব ঢং বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়…”

অরিত্রীর পরবর্তী দিনগুলো কাটলো নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখে। কিভাবে পিথিউশার পরিবারের সামনে যাবে, সবার সঙ্গে কথা বলবে, কিভাবে পিথিউশার কনফিউশন দূর করবে আরো কতো কি। অবশেষে বহু প্রতিক্ষীত দিনটি এলো। পিথিউশার বাড়ির সদস্যদের অমায়িক ব্যবহারে অরিত্রীর পিথিউশাকে পাবার লোভ এবং ওকে এতো কাছ থেকে জানার পর হারাবার আশঙ্কা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। অরিত্রী এসেছে বলে আরজু হক যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। নিজ হাতে যত্ন করে নানা পদের সুস্বাধু খাবার রান্না করে খাইয়েছেন। মঈনুল হক অরিত্রীকে ঈশানের জন্য পছন্দ করলেও পিথিউশার পাশে ওকে দেখে খুব একটা নারাজ হলেন না, বরং ছেলের পছন্দকে সাদরে গ্রহণ করলেন। মহসীনুল হক অবশ্য বরাবরই পিথিউশাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন, তাই প্রথম প্রথম তিনি অরিত্রীকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। পরবর্তীতে অরিত্রীর ব্যবহারে তিনিও মুগ্ধ হয়েছেন। তবে অদ্ভুতভাবে আজকের এই আয়োজনে ঈশান অনুপস্থিত। অরিত্রীর আগমনের কথা শুনেই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছে সে। দুপুরে খাবার পর পিথিউশা অরিত্রীকে নিজের সঙ্গে ছাদে নিয়ে যায়। বেশ আগ্রহ নিয়ে নিজের ছাদ বাগান দেখায়, পিথিউশার উচ্ছসিত চেহারা দেখে অরিত্রী বুঝে নেয় মানুষটা গাছ ভালোবাসে, সে প্রকৃতিপ্রেমী। অরিত্রীর মনে হয়, এটাই সুযোগ পিথিউশাকে সত্যটা খুলে বলার… ছাদের এক কোনে ঝুলানো দোলনায় গিয়ে বসে অরিত্রী, তার থেকে কিছুটা দুরত্বে বসে পিথিউশা। অরিত্রী আকাশের পানে চক্ষু স্থির করে বলে,

-“একটা গল্প বলবো, শুনবেন?”
-“জ্বী শুনবো, আপনার প্রতিটি কথাই আমার কাছে জরুরি।”
-“আমরা দুই বোন এক ভাই। আপনি সেদিন আমার বড় বোনকে দেখেন নি, আপু বাহিরে ছিলো। আপুর আর আমার অনেক মিল, বিশেষ করে পছন্দে। আপুর যা পছন্দ কিভাবে যেনো আমারও তা’ই পছন্দ হয়ে যায়। কিংবা আপুকে যারা পছন্দ করে তারা আমায় পছন্দ করলো না বলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। হিংসে হয়, তা’ও বলতে পারেন। সেই আপুর প্রথম প্রেম ছিলো আয়ান। অদ্ভুতভাবে আমার প্রথম প্রেমও আয়ান। হুম, আমি আয়ান নামের একজনকে ভালোবাসতাম। কিন্তু আয়ানের চোখে আমি ছিলাম আপুর কাছে পৌঁছানোর একমাত্র মাধ্যম! ওদের সম্পর্ক হলো, আবার ভেঙেও গেলো। ওদের সম্পর্ক ভাঙায় আমার খুশি হবার কথা ছিলো, অদ্ভুতভাবে আমি খুশি হতে পারলাম না। আয়ানের কষ্টে আমার কষ্ট হলো, আপুর উপর রাগ হলো। সেই রাগ এতোদূর গড়ালো যে, আপুর আর আমার সম্পর্কে দূরত্ব বেড়ে গেলো। কিন্তু যার জন্য এ দূরত্বের সৃষ্টি সে এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে, এইতো কিছুদিন পর তার বিয়ে। তার এক খালাতো বোনের সঙ্গে, দাওয়াত করেছে আমাকে…”

পিথিউশা কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিলো, ও কিছু বলার আগেই অরিত্রী ওকে ইশারায় থামিয়ে দিলো। মুচকি হেসে বললো,

-“সান্তনা দেবার কিছু নেই, আয়ান বিয়ে করছে, ব্যাপারটা আমার জন্য আনন্দের। আমি চাই ও ভালো থাকুক। তারপর শুনুন…”
-“বলুন…”
-“এই এতোগুলো বছরে আমার জীবনে দ্বিতীয় প্রেম আসে নি, একদিন হুট করে চলে এলো। তাও কিভাবে জানেন? আপুর মাধ্যমে… আমি আবারও এমন একজনের প্রেমে পড়লাম যে কি না আমার বড়বোনকে ভালোবাসে। এবারের প্রেমটা আগেরবারের মতো না, এটা গভীর প্রেম। আমি তাকে ছাড়া নিজের ভবিষ্যত কল্পনা করতে পারি না, তাকে ছাড়া সবকিছু এলোমেলো লাগে। কি করি বলুন তো? তাকে বলে দেব মনের কথা? নাকি সে আপুকে ভালোবাসে বলে সরে আসবো? কিন্তু কি করে সরে আসবো? তাকে ভালো না বেসে যে আমি থাকতে পারবো না…”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here