শিউলিবেলা,পর্বঃ ১০,১১

শিউলিবেলা,পর্বঃ ১০,১১
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ১০

অনেক ভাবনা-চিন্তার পর পিথিউশা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো অরিত্রীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার কিন্তু শেষমেশ আর বের হওয়াই হলো না। পিঠের ব্যথায় সারাটা দিন বিছানায় শুয়েই কাটাতে হলো। রাতেও খুব একটা ভালো ঘুম হলো না তার, বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে রাতটা পার করে দিলো। ফজরের আযান শুনে নামাজ পড়লো, ছাদে গিয়ে সূর্যোদয় দেখলো, তারপর সিদ্ধান্ত নিলো গতদিন যে কথা বলা হয় নি, তা আজ নিশ্চয়ই বলবে পিথিউশা। এই দোটানার ইতি ঘটা জরুরি। মনে মনে পিথিউশা আরো একটা সিদ্ধান্ত নিলো, আজ যতো যা’ই হোক না কেনো ঈশানের মুখদর্শন করবে না সে…

১৫
মাথায় হ্যাট পরা ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে যখন গার্ড শুটিং স্পটে এসে পৌঁছালো অতসীর চোখ তখন কোটর থেকে বের হয়ে আসবার অবস্থা। ডিরেক্টর সাহেব যখন ছেলেটার মাথার হ্যাট সরালেন অতসী তখন শব্দ করে হেসে ফেললো, বহুবছর পর সে এমন মন খুলে হেসেছে। সেট এর অনেকেই তা তার দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলো। একটা শর্ট ব্রেক নিলো অতসী, তারপর ঈশানের হাত ধরে সবার আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-“নিউ প্রফেশন বুঝি? কি প্রফেশন? চুরি করা?”

একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করলো,

-“তা এখান থেকে কি চুরি করবেন বলে ঠিক করেছেন? লিপস্টিক? মেকাপ আইটেম? কস্টিউম?”

হাসির দমকে কথা বলার সময় বারংবার কাঁপছিলো অতসী, ঈশান অনেক চেষ্টা করেও রাগ সংবরন করতে পারছিলো না। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো,

-“চুরি করতে যাবো কেনো? প্রথমবার কাউকে জ্যাকেট পড়তে দেখছেন?”

অতসী হাসে, হাসির রেখা পূর্বের তুলনায় ক্রমশ প্রশস্ত হয়। তার সঙ্গে প্রথমবারের মতো ঈশান লক্ষ্য করে অতসীকে হাসলে দারুণ লাগে। তার চারিত্রিক কাঠিন্য তখন মেঘের মতো উড়ে যায়, তাকে পুষ্পকড়ির মতো সতেজ বোধ হয়। ঈশানকে নিজের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে অতসী কিছুটা লজ্জা পায়, লজ্জা ঢাকার জন্য পূর্বের গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বরে বলে,

-“মানছি শেষরাতের দিকে একটু ঠান্ডা পড়ে, এই মৌসুমে মাঝে মাঝে একটু বৃষ্টিও হয় কিন্তু তাই বলে এই রোদের মধ্যে কেউ এমন জ্যাকেট পরে, গলায় মাফলার আর মাথায় হ্যাট পরে ঘুরে না। আপনাকে দেখে দুটো জিনিস মনে হচ্ছে। এক, চোর-বাটপার… দুই, কোনো সাংবাদিক, যে কি না শুটিং সেট এর আশেপাশে ঘুরঘুর করে রগরগে কিছু মশলাদার খবরের জন্য।”

ঈশান হতাশ গলায় বললো,

-“আমি দুটোর একটাও নই, সত্যি বলতে এসব পরে অনেক গরম লাগছে। কিন্তু…”

অতসী হাসি চেপে আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে,

-“কিন্তু কি?”

ঈশান মাথা থেকে গলা পর্যন্ত পেছানো মাফলারটা খুলে অতসীকে নিজের মাথার ফোলা জায়গাটা দেখালো, তারপর নিস্তেজ গলায় বললো,

-“আপনার হবু বরের সুনাম করার পুরষ্কার। মাথায় এমন আলু নিয়ে রাস্তায় বের হই কি করে বলুন? আমার মতো বেকারের আছে বলতে তো এই ফাস্টক্লাস চেহারাটাই তাই না? সেটাও যদি চলে যায় তবে কপালে বউ জুটবে বলুন?”

ঈশানের গলার স্বরে হতাশা স্পষ্ট, অতসী ঠোঁট টিপে হাসে, রসিকতা করে বলে,

-“আপনার যাবতীয় কথাবার্তায় আমার মনে হচ্ছে আপনার পরিবার অতি নিরীহ একটা পরিবার। আপনাদের পরিবারের ছেলেরা বিয়ে করার জন্য মেয়ে পায় না। তাইতো আপনি এখানে সেখানে মেয়ে খুঁজে বেড়ান। যেমন কিছুদিন আগে আপনার ভাইয়ের জন্য আমাকে ঠিক করতে চাইলেন আর এখন মাথা সামান্য ফুলে গেছে বলে নিজের বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হচ্ছেন।”

ঈশানকে বোকার মতো নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মায়া হলো অতসীর। জিজ্ঞেস করলো,
-“কেনো বলুন তো? জীবনে বিয়েই সব? বিয়ে না করলে আপনার জীবন চলবে না? নিজের কদর করতে শিখুন, আপনি নিজেকে সম্মান করতে না শিখলে অন্য কেউ আপনাকে সম্মান করবে কেনো?”

ঈশান অতসীর কথার প্রসঙ্গের পাশ কাটিয়ে বলে,

-“আমার ভাইয়াকে বিয়ে করবেন না আপনি? সেদিন যে বললাম, কিছু তো জানালেন না…”

অতসী বেশ বিরক্ত হয়, বিরক্তি চেপে স্বাভাবিক স্বরে বলে,

-“শুনুন জনাব, আপনার ভাইয়ের প্রতি আমার বিন্দুপরিমান আগ্রহ নেই। আমার যতো আগ্রহ সব আপনার উপর, তবে বিয়ে করার মতো আগ্রহ এখন অবধি জন্মায় নি। ভবিষ্যতের কথা বলতে পারছি না, ভবিষ্যতে এই সেক্টরে আগ্রহ জন্মাতেও পারে। যাই হোক, আমার ব্রেক শেষ… আমি আসছি।”

যাবার জন্য সামনে পা বাড়ায় অতসী। যেতে যেতে পেছন ফিরে তাকায়।,মুচকি হেসে বলে,

-“একটা জরুরি কথা, এসব ফালতু জিনিস দ্রুত খুলুন তো। একেবারে সার্কাসের জোকার মনে হচ্ছে। আপনি এমনিতেই যথেষ্ট সুদর্শন…”

অতসীর প্রশংসায় ঈশানের মনে প্রফুল্লতা ফিরে এলো, গা থেকে জ্যাকেট খুলে হাতে নিলো, মাফলার সুন্দর করে গলায় প্যাঁচালো, হ্যাটটা উঁচু করে রে গুণগুণ করে গান ধরলো। এতোকিছুর মাঝে ঈশান খেয়ালই করলো না, অতসী নামক মানুষটার সামান্য একটা মন্তব্য তার মনের মেঘ কাটানোর জন্য যথেষ্ট…

১৬
বেগুনী পাড় সাদা শাড়ীতে অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু বেশিই উজ্জল মনে হচ্ছে অরিত্রীকে। পিথিউশার আগমনে তার চেহারার চাকচিক্য পূর্বের তুলনায় দ্বিগুন বেড়ে গেলো। অরিত্রীর ঠিক এক হাত সামনে এসে থামলো পিথিউশা, সাদা পাঞ্জাবীতে তাকেও আজ বেশ উজ্জ্বল লাগছে, কেমন একটা পবিত্র পবিত্র ভাব। পিথিউশা মুচকি হেসে শান্তস্বরে বললো,

-“আপনাকে আমার অনেক কিছু জানানোর আছে অতসী, দয়া করে আপনি আজকের পুরোটা সময় আমাকে দেবেন?”

অরিত্রী বেশ কিছুদিন ধরে চাইছিলো পিথিউশাকে একান্তে সবটা খুলে বলতে, যেহেতু সুযোগটা আপনাআপনি চলে এলো তাই আর হাতছাড়া করলো না। সম্মতি জানাতে বললো,

-“এদিকটায় বাচ্চারা খেলা করছে। আশ্রমের পেছনে একটা পুকুর আছে, পুকুরপাড়ে লোকসমাগম কম। সেখানে গিয়ে বসা যায়…”

অরিত্রীর সম্মতি পেয়ে আর অপেক্ষা করলো না পিথিউশা, মুচকি হেসে হাঁটতে শুরু করলো। তার পাশাপাশি হাঁটছে অরিত্রী, মন চাইছে দুই ইঞ্চি দূরত্ব গুছিয়ে অরিত্রীর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিতে কিন্তু অরিত্রীর মনোভাব নিশ্চিত না হয়ে এই ঔদ্ধত্য প্রদর্শণের কোনো মানে হয় না। তাই মনের ইচ্ছাকে মনেই চাপা দিলো পিথিউশা…

পুকুরপাড়ে বসে বসে পানিতে ঢিল ছুঁড়ছে অরিত্রী, তার বা পিথিউশা কারো মুখে কোনো কথা নেই! অথচ দু’জনেরই বলার আছে অনেক কথা… পিথিউশাই প্রথম কথা শুরু করলো। পকেট থেকে একমুঠো শুকনো শিউলি ফুল অরিত্রীর মুখের সামনে তুলে ধরে বললো,

-“কিছু মনে পড়ে অতসী? এমনই কিছু ফুল আপনার বাড়ির বাহিরে রেখে এসেছিলাম কিছুদিন আগে, সঙ্গে চিরকুট। আসলে ব্যাপারটা ছেলেমানুষি হলেও অন্তর্মুখী ব্যাক্তিত্বের অধিকারী আমার মতো মানুষের দ্বারা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এর থেকে ভালো কোনো উপায় মাথায় আসছিলো না। আমার আচরনে আপনি বিরক্তিবোধ করে থাকলে দুঃখিত।”

মুহূর্তে অরিত্রীর বুকটা ধক করে উঠলো, যা কথা গুছিয়ে রেখেছিলো সব গুলিয়ে গেলো, কাজের ব্যস্ততায় সে বেনামী চিরকুটদাতাকে ভুলেই গিয়েছিলো। পিথিউশাই যে সে ব্যক্তি, এ ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয় নি। কিন্তু এ মুহূর্তে অতসীর প্রতি পিথিউশার একনিষ্ঠতা উপলব্ধি করে অরিত্রী সত্য প্রকাশ করার মনোবাসনা ত্যাগ করলো। নিরবে শুনতে লাগলো সামনে বসে থাকা মানুষটার কথা।

পিথিউশার চোখের ইশারায় ফুলগুলো নিতে বললো অরিত্রীকে, অরিত্রী আঁচল পেতে ফুলগুলো গ্রহণ করলো। মুচকি হেসে পিথিউশা বললো,

-“আপনাকে আমি পছন্দ করি এটুকু বুঝতে নিশ্চয়ই এ মুহূর্তে কোনো সমস্যা হচ্ছে না আপনার? আপনি হ্যাঁ বললেই সম্পর্কটা শুরু করা যায়, কিন্তু আমার মতে একজন মানুষকে পছন্দ করা আর সারাজীবন একত্রে কাটানোর মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। তাই আজকে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে আপনাকে আমার ব্যাপারে জানাতে এসেছি। আমি বলছি না যে, সবটা শুনার পর আপনাকে আমার প্রস্তাবে রাজি হতে হবে, আমি কেবল অনুরোধ করছি ধৈর্য্য ধরে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা শুনুন। সবটা শোনার পর হ্যাঁ বা না বলার অধিকার একান্ত আপনার। আপনি আমার সম্পূর্ণ কথা শুনবেন, আমি কি আপনার কাছ থেকে এটুকু আশা করতে পারি?”

অরিত্রী উপর-নিচ মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। সে জানে সামনে বসে থাকা মানুষটা তার নয়, মানুষটা যে কথাগুলো বলছে তা’ও তাকে উদ্দেশ্য করে নয়। তবুও অবাধ্য মনের কাছে মস্তিষ্কের সকল যুক্তি হার মানে, মন জানতে চায় সামনে বসে থাকা মানুষটার মনের কথা। পিথিউশাকে কাছ থেকে জানবার লোভ সামলাতে ব্যর্থ হয় অরিত্রী, নিরবে অতসী হবার অভিনয় অব্যাহত রাখে সে…

চলবে…

শিউলিবেলা
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ১১

অরিত্রীর সম্মতি পাবার পর পিথিউশা বললো,

-“আপনি হয়তো আমার পরিবার সম্পর্কে টুকটাক জানেন, যেহেতু আমরা দুজনেই আশ্রমের ফান্ডের সঙ্গে যুক্ত আছি… কি, জানেন তো?”

অরিত্রী আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বললো,

-“জ্বী, জেবুন্নেসা আন্টির কাছে আপনার এবং আপনার পরিবারের ব্যাপারে কিছুটা শুনেছি।”

মুচকি হাসে পিথিউশা, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

-“আপনি বাইরের মানুষের কাছে যা শুনেছেন তা আমার বর্তমান, নিঃসন্দেহে বলা যায় আমার বর্তমান পুষ্পাচ্ছাদিত বাগানের চেয়ে কম মনোরম নয়। কিন্তু ফুলের অগোচরে যেমন কাঁটা থাকে তেমনি আমার এই গুছানো বর্তমানের আড়ালে একটা অতীত আছে, অন্ধকার অতীত… এ দুর্বিসহ অতীতের পাতা সকলের সম্মুখে উম্মোচন করা যায় না। আপনাকে আমি আমার জীবনের একাংশ বানানোর ইচ্ছা পোষণ করছি বলেই সাহস করে আপনার সামনে অতীত হাতড়াতে বসলাম। কারন আমি চাই না আমার জীবনের সঙ্গে জড়ানোর পর আমার অতীত সম্বন্ধে আপনি অন্য কারো কাছ থেকে কোনো তথ্য পান। আমি চাই আমার যা তথ্য তা আমার দিক থেকেই সরাসরি আপনার কাছে সরবরাহিত হোক।”

গড়গড় করে একটানে কথাগুলো বলে থামলো পিথিউশা, তার চেহারা থমথমে। যেনো চেহারাজুড়ে এক টুকরো ঘন কালো মেঘের ছায়া… অরিত্রী একমনে পিথিউশার কথা শুনছিলো, তার মনে একত্রে কৌতুহল এবং শঙ্কা দু’টোই কাজ করছে। কি আছে মানুষটার অতীতে! অরিত্রীর কৌতুহল টের পেয়ে পিথিউশা বলে,

-“পি. টি. উষা, নামটা শুনেছেন?”

অরিত্রী অতি বিস্ময়ে পিথিউশার দিকে তাকায়, এতো গুরুতর মুহূর্তে এ কেমন প্রশ্ন! নিজেকে সামলে বলে,

-“হ্যাঁ… কথার মাঝে হঠাৎ এ প্রশ্ন?”

পিথিউশা গম্ভীরস্বরে বলে,

-“প্রশ্ন যখন করেছি তার পেছনে কারনতো নিশ্চয়ই আছে। কারন ছাড়া প্রশ্ন হয়?”

অরিত্রীর উত্তরের অপেক্ষা না করে পিথিউশা আবার বলে,

-“আমার জন্ম কোথায়, কার গর্ভে আমার বেড়ে ওঠা, আমার জন্মদাতা কে? এর একটা প্রশ্নের উত্তরও আমার জানা নেই। আমার স্মৃতিতে কোনো সুখকর শৈশব নেই, পিতামাতার দেয়া নিজস্ব কোনো নাম নেই।”

অতি বিস্ময়ে পিথিউশার দিকে তাকায় অরিত্রী, তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে এমন অদ্ভুত কথা সে আগে কখনো শুনে নি! অরিত্রীর প্রতিক্রিয়াকে উপেক্ষা করে পিথিউশা তার কথা অব্যাহত রাখে…

-“এখনো মনে পড়ে, স্টেশনে ভিক্ষা করতাম আমি। এর ওর কাছে খাবার চাইতাম, দু’বেলা খাবার জুটাতে মানুষের সামনে হাত পাততে হতো, পা ধরতে হতো, কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে চড়-লাথি মারতো। পরার জন্য কোনো জামাকাপড় ছিলো না… আমার জন্ম এমন এক সমাজে যেখানে আমাকে জন্ম থেকেই চুপচাপ সহ্য করতে শেখানো হয়েছে। আমাকে কেউ ভালোবেসে কোলেপিঠে করে বড় করে নি, মানুষের লাথি উষ্টা খেয়ে আমার বেড়ে ওঠা, আমার শিক্ষক নির্মম বাস্তবতা। অল্প বয়সেই অনেকটা বুঝতে শিখেছিলাম আমি, আস্তে আস্তে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতার কৌটা ভারী হতে লাগলো। কমলাপুর রেলস্টেশন ছিলো আমার আবাসস্থল, আর ওখানকার একটা ঝুপড়ি চায়ের দোকানের দোকানদার ছিলেন আমার একমাত্র অভিভাবক।”

কথা বলতে বলতে একটু থামে পিথিউশা, দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করে,

-“ওনার সঙ্গেও আমার রক্তের সম্পর্ক নেই তবে আত্মার সম্পর্ক আছে। একবার স্টেশনের এক কোনায় জ্বরে কাতরাচ্ছিলাম, চাচা আমাকে তুলে নিয়ে তার দোকানে থাকতে দিলো। জ্বর সারার পর আমাকে আর স্টেশনের মেঝেতে শুতে দিতেন না, রাতে দোকান বন্ধ করার পর তার ঝুপড়ি দোকানের মাচার উপরে আমরা দুজনে ঘুমাতাম। অতিবাহিত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা যেনো বাপ-ছেলে হয়ে উঠলাম। চাচা খুব ভালো দৌঁড়াতেন, স্কুলে পড়াকালীন ন্যাশনাল লেভেলে দৌঁড়ানোর ভীষণ ইচ্ছে ছিলো কিন্তু অর্থাভাবে সে সুযোগ পান নি। একদিন আমাকে দৌঁড়ে এক পকেটমারকে ধরতে দেখে উচ্ছসিত হয়ে বললেন, “বাবু, তুই তো দেখি জুনিয়র পি.টি. উষা। কি ভালো দৌঁড়াস রে! আমার টাকা থাকলে তোকে নিশ্চিত ন্যাশনাল লেভেলে দৌঁড়াতে পাঠাতাম।” তারপর থেকে মানুষটা আমাকে আর কখনো বাবু ডাকেন নি, জুনিয়র পি. টি. উষা ডাকতেন। আস্তে আস্তে স্টেশনের সকলে আমাকে এ নামেই চিনতে লাগলো।”

পিথিউশার দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে যায়, অরিত্রী ক্ষীণস্বরে প্রশ্ন করে,

-“কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে হক পরিবার, জার্নিটা নিশ্চয়ই সহজ ছিলো না? জুনিয়র পি.টি. উষা থেকে আজকের ফটোজার্নালিস্ট পিথিউশা, কি করে এতোদূর এলেন?”

পিথিউশার থমথমে চেহারার দিকে তাকিয়ে মায়া হয় অরিত্রীর, যার চেহারায় এতো মায়া তার জীবনে এমন একটা অধ্যায় কি না থাকলে হতো না! পরক্ষণে ভাবে, বিধাতার পরিকল্পনা আমাদের চিন্তাধারার পরিসীমার বাহিরে, তাইতো আমরা কেবল অভিযোগ করি, আগে পরে দেখি না, বিবেচনা করি না। হয়তো পিথিউশার জীবনে এমন তিক্ত অতীত ছিলো বলেই বর্তমানটা মসৃণ। অরিত্রী হালকা কেশে জিজ্ঞেস করে,

-“চুপ করে আছেন যে? প্রশ্নটা করে অনধিকার চর্চা করলাম বুঝি?”

পিথিউশা অরিত্রীর দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়, মুচকি হেসে বলে,

-“অনধিকার চর্চা কেনো হবে, আমি তো আজ আপনাকে এ তথ্যগুলো জানাতেই এসেছি। আসলে আমার অতীত এতোটাই তিক্ত যে, এ নিয়ে কথা বলতে গেলে গলায় কথা আটকে যায়, দম বন্ধ লাগে।”

অরিত্রী ইতস্তত করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু দাঁড়ানোর আগেই তার হাত ধরে বসিয়ে দেয় পিথিউশা। শান্ত অথচ গম্ভীরস্বরে বলে,

-“যাবেন না, আমার কষ্ট হলেও আমি আপনাকে সবটা জানাতে চাই। এতোবছরে আমার ভেতরে জমানো কথাগুলো একমাত্র আপনাকেই বলতে পারি আমি… জানি না কেনো, তবে আপনাকে আমি ভীষণ ভরসা করি।”

মুহূর্তেই অরিত্রীর নিজেকে পাপী মনে হতে লাগলো, সে প্রথমদিন থেকে সামনে বসে থাকা মানুষটা সঙ্গে মিথ্যাচার করছে অথচ মানুষটা অকপটে বলে দিলো সে অরিত্রীকে ভরসা করে। অরিত্রী সত্যটা বলার জন্য মুখ খুলবে তখনই পিথিউশা বললো,

-“আমি ভালো দৌঁড়াতাম, বললাম তো। স্টেশনে প্রায়ই পকেটমাররা টাকা মারতো, আমি অনেকবার দৌঁড়ে ধরিয়ে দিয়েছিলাম কয়েকজনকে। এভাবেই একদিন এক পকেটমারকে ধরিয়ে দেবার সময় পরিচয় হয় আমার দাদু মহসীনুল হকের সঙ্গে। অন্য সবার মতো তিনি আমাকে রাস্তার ছেলে ভেবে ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে দেন নি, কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তোমার নাম কি বাবু? এখানে কোথায় থাকো?” আমি হাতের ইশারায় রহমত চাচার ঝুপড়ি দোকানটা দেখিয়ে বলেছিলাম, “আমার চাচার সঙ্গে থাকি।” উনি এরপর চাচার সঙ্গে কথা বললেন, আমাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন। চাচা যখন আমাকে সবটা জানালো তখন আমি সরাসরি মানা করলাম। একটা অযাচিত জীবন চাচ্ছিলাম না, তাছাড়া চাচাকে ছেড়ে আসতেও মন চাইছিলো না।”
-“তারপর?”

পিথিউশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, চোখের কোণে জমা জল মুছে বলে,

-“আমি স্টেশন ছেড়ে, চাচাকে ছেড়ে আসতে না চাইলেও চাচা চেয়েছিলেন আমি ওই জায়গাটা ছেড়ে দেই। তখন উপলব্ধি করতে না পারলেও বর্তমানের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমি অনুধাবন করেছি, রক্তের সম্পর্কের কেউ না হয়েও চাচা আমার জন্য উত্তম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। রাতে ঘুমানোর সময় চাচা আমাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, “শোন বাবা, এ জীবনটা কোনো জীবনই নয়। তোর মেধা আছে, শারিরীক সামর্থ্য আছে, একটা ভালো পরিবেশ পেলে তুই সফল হবি। আমার কোনো পরিবার নেই, তুইই আমার একমাত্র পরিবার। তুই বড় কিছু হলে আমি গর্ব করে বলতে পারবো আমার ছেলে বড়মাপের মানুষ। তাছাড়া ওই বাড়িতে গেলে তুই মা-বাবা পাবি, দাদু পাবি, তোর একটা সম্পূর্ণ পরিবার হবে। আমি তো কোথাও যাচ্ছি না বাবা, তুই গিয়ে দেখ একবার, ভালো না লাগলে আমার কাছে ফিরে আসবি।” অনেক বোঝানোর পর চাচার কথায় রাজি হলাম, হক পরিবারে আমার আগমন যেনো উৎসব বয়ে আনলো। বাবা-মা, দাদু প্রত্যেকে আমার গ্রুমিং নিয়ে ব্যস্ত। আমার তখন হাতেখড়ি হয় নি, মা আমার পড়াশুনা, খাওয়া-দাওয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ব্যস্ত। বাবা আমার পোশাক, চলাফেরা এসবের তত্ত্বাবধান করতেন। আর দাদু আমার সৎ ও সুন্দর চারিত্রিক গঠণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন।”

অরিত্রী মুচকি হাসলো, প্রফুল্ল স্বরে বললো,

-“বাহ, আপনার একটা ভালো কাজ আপনাকে একটা পরিবার এনে দিলো। কি রোমাঞ্চকর জীবন আপনার…”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here