শব্দহীন_অনুভূতি,পর্ব_২
পলি_আনান
-দোস্ত মেয়েটা তোকে আদু ভাই বলেছে!মানে কি এত্তো বড় অপমান।
নাফিসার কথা শুনে রাগে কটমট করে তাকায় আরাফ।নিজের ভেতরটায় জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।নেহার বোন না হলে এতোদিনে এই মেয়েকে টাইট দিয়ে ছাড়তো সে।নেহাত বন্ধুত্বের খাতিরে বেঁচে গেছে।
-আমাকে আদুভাই বলেছে তাতে কি?তুই ছাড়া লিবান আর শাকীল ওরাও আদুভাইয়ের কাতারে পড়ে। তারাও আমার সাথেই প্রত্যাক ক্লাসে ড্রপ করেছে।
আরাফের কথা শুনে ফিক করে হেসে দেয় নাফিসা।অপমানে গর্জে উঠে শাকীল।
-খবরদার এমন কথা বলবি না আরাফ। আদুভাই হওয়াও একটা আর্ট যেটা সবাই পারেনা সব কথা বাদ তুই সত্যি সত্যি মেয়েটার কাছে পড়বি কিন্তু কেন?পরিচিত এত ভালো টিচার থাকতে ওই মেয়ের কাছে কেন পড়বি তুই?ক্লাস টেস্টে টপার হয়েছে বলে?
শাকীলের দিকে তড়িৎ গতিতে তাকিয়ে আরাফ শার্টের স্লিভটা কনুইর উপরে উঠিয়ে অধরটা জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নেয়।
-সে অনেক কাহীনি মাম্মা।সেদিন রাগের মাথায় ইচ্ছে করছিল মেয়েটাকে খুন করে গুম করে দিতে নেহাত রাগটা সংযম করেছিলাম নাহলে সেদিন কি যে হতো, আল্লাহ মালুম।
কথাটা শেষ করেই ফস করেই মুখের হাওয়া ছাড়ে আরাফ।লিবান এগিয়ে এসে বলে,
-আমরাও যানতে চাই সেদিন কি হয়েছিল যার কারনে তুই হৃদিতার বিষয়ে আমাদের খোঁজ লাগাতে বলেছিলি।
-তাহলে শোন..
সেদিন,বেশ গভীর রাতে পার্টি শেষ করে বাড়ি ফিরে আরাফ। লিভিং রুমের সামনে দাড়াতেই পরিবারের সবাইকে এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কে যায় সে। আমতা আমতা করে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে নিলেই তার মুখের সামনে কয়েকটা কাগজ ছুড়ে মারে আরাফের বাবা জহির এনায়েত।আরাফ কাগজ গুলো ভালো করে চেক করে বুঝতে পারে এগুলো তার ক্লাস টেস্টের কাগজ যেখানে তার প্রাপ্ত নাম্বার মাত্র দুই।
– এত ভালো ভালো টিচার দিয়ে তোমাকে পড়িয়েও তোমার কোন উন্নতি করতে পারলাম না এইসবের মানে কি?
আরাফ চকিতে তাকায় জহিরের দিকে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে কয়েকটা ঢোক গিলে বিড়বিড় করতে থাকে তার বুঝতে বাকি নেই আজ এখানে নিশ্চই যুদ্ধ ক্ষেত্র পরিনত হবে।
-ভার্সিটির তোমার সাথে আমার পরিচিত বন্ধুর ছেলে মেয়েরাও পড়ে। তাদের সাথে গিয়ে তোমার খোঁজ করতেই সবাই তোমার সম্পর্কে অভিযোগের দোকান খুলে বসেছিল; সবার সামনে আমার ইচ্ছে করছিল গলায় দড়ি দিয়ে মরি।ছিহহ!আর কত ফেল করবে তুমি?তোমার থেকেও গরীব ঘরের মেয়েটা আরো ভালো রেজাল্ট করেছে ক্লাসে টপার হয়ছে।শুনেছি মেয়েটার কোন টিচার নেই,নিজের পড়া নিজেই পড়ে। পড়া লেখার খরচ চলে কয়েকজন বাচ্চাকে প্রাইভেট পড়িয়ে অথচ তোমার কি সে কমতি দিয়েছি আমি?অতিরিক্ত আদরে বাদর পরিনত হয়েছো।আমি সিধান্ত নিয়েছি তোমাকে যে ফ্লাটটা দেওয়ার কথা ছিল আপদত তুমি সেই ফ্লাটটা পাবেনা
-কিন্তু বাবা…
-আগে পড়ালেখা করে আমাকে দেখিয়ে দাও, আর কতবার ফেল করবে তুমি।এবার যদি ফেল করেছো তবে বাইকটাও নিয়ে নেবো।
আরাফকে অপমান সূচক কথা গুলো বলেই জহির সহ বাড়ির প্রত্যকে নিজ নিজ রুমের দিকে বা বাড়ায়। এদিকে আরাফের সব রাগ গিয়ে পড়ে ক্লাস টপার মেয়েটার উপর।দ্রুত ফোন করে বন্ধুদের খবর নিতে বলে এই মেয়েকে যে আরাফের স্বাধীনতায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।পরবর্তীতে জানতে পারে টপার মেয়েটি হৃদিতা। কিন্তু তার সাথে উলটা পালটা কিছু করলেই নেহার মনে প্রহার হবে তাই তাকে উলটো ভাবে শাস্তি দিতে গিয়ে এত হিমশীম পোহাতে হচ্ছে আরাফকে।
গল্পটি লেখনীতে পলি আনান।
সম্পূর্ণ কথা শেষ করে থামলো আরাফ। তার চোখে মুখে এখনো রাগ আর প্রতিহিংসার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।।
-আরাফ ভাই আমার তোর সাথে আমিও পড়বো না মানে এমন সুন্দরী যদি টিচার হয়ে আসে তবে ফেল করার আর চান্স নেই।
লিবানের ঔৎসুক্য কথা শুনে রুষ্ট হয়ে যায় আরাফ। নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
-নো নিড ।শুধু আমি পড়বো।তোকে মাঝখানে না ডুকলেও চলবে। গুড বাই।
আরাফের এমন সোজাসাপটা উওরে বেশ গায়ে লাগে লিবানের।আগে থেকেই সে হৃদিতার প্রতি ক্ষীণ, কিন্তু হৃদিতার একঘেয়েমি নিরবতায় কখনো তার সাথে কথা বলার সাহস হয়ে উঠে নি তার।
চোখে সানগ্লাস পরে বাইক স্টাট দিয়ে দ্রুত বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয় আরাফ।
তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফিরতেই মাঝ রাস্তায় জুতো জোড়া ছিড়ে যায় হৃদিতার। মাসের মাঝামাঝি সময় এই সময় তার কাছে কোন হাত খরচা নেই আর যা আছে তা ভার্সিটির কিছু কাজে প্রয়োজন বর্তমানে বাড়তি কোন হাত খরচ নেই তার কাছে। এবার জুতা কিনবে কি করে? ভাবতেই ভীষন কান্না পাচ্ছে তার। অতীতে হৃদিতার বাবা ছিলেন জমিদার। গ্রামের বেশ অর্ধেক জমি ছিল তার বাপ চাচার।কিন্তু এই জমিদারিত্ব আর স্থায়ী হলো না। বিরোধী দলের কূটকচালে একে একে সব জমি হাত ছাড়া হয়ে যায় তাদের। এইভাবে সৃষ্টি হয় একের পর এক দেনাপাওনা।পরিশেষে কিশোরী হৃদিতাকে রেখেই বিরোধী দলের নাশকতায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে পুরো পরিবার।
তারপর থেকেই নিজের আপন খালার কাছে মানুষ হচ্ছে সে।এতে তার খালামনি হামিদা,খালুজান ওয়ালীদের কোন মাথা ব্যথা নেই বরং তারা তাদের মেয়ের মতো করেই হৃদিতাকে মানুষ করছে।খালাতো বোন হলেও নেহা যেনো হৃদিতার আপন বোন। বাধাবিপত্তি ঘটলো ওয়ালীদের মায়ের কাছে তিনি হৃদিতাকে কিছুতেই সহ্য করেন না এই বাড়িতে থাকা নিয়ে সুযোগ পেলেই খোটা দিতে ছাড়েন না তিনি।দাদীর এমন আচরনে নেহা বেশ ক্ষুব্ধ তবুও বাড়ির মুরব্বি হিসেবে কোন বদানুবাদে জড়ায়না সে।
দুইহাতে স্যান্ডেল ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরছে হৃদিতা তাকে দেখেই আপন মনে বকতে শুরু করে নেহার দাদী সুফিয়া খানম।হৃদিতা সেদিকে চোখ না দিয়ে দ্রুত রুমে ডুকে যায় এখন এইসব কথা শুনতে মোটেও তার ভালো লাগছে না। আগে একটু বিশ্রামের প্রয়োজন তার।
গুন গুন গান গাইতে গাইতে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায় আরাফ। তখনি নাকে আসে একটা বিশ্রী উটকো গন্ধ।কয়েক সেকেন্ডে বুঝতে পারে এটা বিড়ি এবং মদের গন্ধ।তার পাশের রুমের বড় জেঠুর ছোট ছেলে নিয়াজের রুম । সারাদিন নেশাবুদ থাকাই তার একমাত্র কাজ।বেশির ভাগ সময় বাড়িতে থাকেনা বললেই চলে তবে যে কয়েকদিন বাড়িতে থাকে সেই কয়েকদিন রুমের দরজা বন্ধ করে নেশায় মগ্ন থাকে সে।রুমের দরজা ফাঁক করে আড়াল থেকে নিয়াজকে একবার দেখে নিয়ে বিরক্তে মুখ কুচকে নিজের রুমে পা বাড়ায় আরাফ।এই বাড়িতে থাকতে তার মোটেও ভালো লাগে না ইচ্ছে করে সব ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে।অবশ্য মনে মনে সিধান্ত নিয়ে নেয় তার বাবা জহির যদি ফ্লাটটি তার নামে করে দেয় তবে সেখানেই সেটেল হয়ে যাবে সে।কিন্তু মাঝ পথে কাল হয়ে দাড়ালো হৃদিতা। নিম্ন মধ্যেবিত্ত ঘরের একটি মেয়ে কষ্ট করে কিভাবে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে তা দেখে জহিরের পৈশাচিমনে হিংসার বার্তা দেয়।আর সেই রাগ মেটানো হয় আরাফের উপর। বর্তমানে আরাফ নিজেও ক্ষুব্ধ হৃদিতার উপর।
“এনায়েত মঞ্জিল” এলাকায় এক নামে সবার পরিচত।আরাফের বাবারা তিন ভাই। বড় ভাই জাবেদ এনায়েত সে ছেলের বড় ছেলে নোমানের সাথে রাজনীতিতে মেতে আছে। ছোট ছেলে নিয়াজ।আর নোমানের মা গৃহীনি।পুরো বাড়ি জুরে যদি কোন ভালো মানুষের সন্ধান করা হয় তবে নিঃসন্দেহে আরাফ নোমানের মা তার জেঠিমা হুমায়রাকে বেছে নেবে।
জাবেদের পরেই আরাফের বাবা জহির এনায়েত আর মা মায়মুনা দুজনেই পারিবারিক ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। নিজেদের ছেলে আরাফের খোঁজ হয়তো খুব জোরে দিনে একবার নেওয়া হয়।জহিরের পরেই ভাই জসীম এনায়েত তার এক ছেলে এবং এক মেয়ে। আদীব এবং আইদা, স্ত্রী গৃহীনি। জসীম তার ভাইয়ের সাথে ব্যবসার কাজেই আছে।এই তিন ভাইকে নিয়েই জয়েন্ট ফ্যামিলি।পুরো বাড়িতে আচার চরিত্র স্বভাবের দিক থেকে উওম আদীব,আইদা এবং সর্বশেষে আরাফ। বাকিরা মেতে থাকে মানুষ হত্যা, মদ, আর নারীর নেশায়।
পরের দিন সকালে দ্রুত ভার্সিটির উদ্দেশ্য রওনা হয় আরাফ।মনে মনে জমে আছে হৃদিতাকে নিয়ে হাজারো প্লানিং।সবার সাথে ভার্সিটির ক্লাস শেষে হৃদিতাকে খুঁজতে থাকে। ক্লাসেই মেয়েটাকে দেখেছিল তবে কোথায় গেল এখন।চারিদিকে উৎসুক দৃষ্টিতে এদিক সেদিক পায়চারি করছে আরাফ তাকে দেখেই নাফিসা ভ্রু নাচিয়ে বলে,
-কিরে আরাফ কি খুঁজচ্ছিস এই ভাবে?
-আমার মিস কোথায়? আমাকে পড়াবেনা? কোথায় গেলো মেয়েটি?
-মেয়েটাকে দেখলাম পিছনের গেট দিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে।
লিবানের কথায় চমকে তাকায় আরাফ।
– চলে গেছে মানে?সে চলে গেলো কেন?আমাকে কি পড়াবেনা!
-দেখ আরাফ, নোমান ভাইকে দেখে মেয়েটা ভয়ে রাজী হয়েছে সে তোকে পড়াবে মন থেকে তো আর রাজি হয়নি তাই পালিয়ে গেছে।
শাকীলের কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আরাফ।রাগে গজ গজ করতে করতে এদিক থেকে সেদিক আবারো পায়চারি করতে থাকে।তীব্র অপমান আর অবজ্ঞা যেন তাকে অদৃশ্য ভাবে প্রহার করছে।শাটের কলারটা দুই বার ঝারা দিয়ে রাগে দাঁত চেপে বলে,
-দেখ শাকীল,নোমান ভাই আমাকে যতটা পছন্দ করে আমি ঠিক ততটাই তাকে অপছন্দ করি। আর এই কথা তোরা জানিস।নোমান ভাইয়ের কাজ কর্ম, চলন-বলম মোটেও আমার পছন্দ নয়। এই জীবনে যা চাওয়া পাওয়া আছে আমি নোমান ভাইকে বললে সে পায়ের কাছে এনে হাজির করবে কিন্তু এবার বিষয়টা অন্যরকম । হৃদিতা মেয়ে, তার সাথে নেহার বান্ধবী তাকে আমি কিছুতেই ফোর্স করতে পারবো না। তাই যা করার নোমান ভাইকে দিয়ে করিয়েছি এবার যেহেতু মেয়েটা আমাকে ভালো থাকতে দিলো না তবে আমি আমার রাস্তায় চললাম।
আরাফ কথা শেষ করে আর এক সেকেন্ড ও দাড়ালোনা দ্রুত হেলমেট মাথায় দিয়ে বাইক নিয়ে চললো তার গন্তব্যে।
দ্রুত লিবান,শাকীল,নাফিসা এগিয়ে আসলেও আরাফকে আর বাঁধা দিতে পারলোনা।
-এবার কি হবেরে নাফিসা রুক্ষ মেজাজি আরাফ তো এই মেয়েকে তুলে আছাড় দেবে, হাইট দেখেছিস মেয়েটার? আরাফের বুকের শেষ প্রান্তে মেয়েটির মাথা গিয়ে ঠেকে এবার বুঝ তাহলে।
শাকীলের কথায় ফিক করে হেসে দেয় নাফিসা।লিবান ঠোঁট বাকিয়ে দৃঢ় সুরে বলে,
-তবে যাই বলিস তোরা, হৃদিতার পাশে আমি দাড়ালে কিন্তু হেব্বি দেখতে লাগে!
লিবানের এমন অযুক্তিযুক্ত কথা শুনে বিমূঢ় হয়ে যায় শাকীল আর নাফিসা।
দ্রুত বাইক নিয়ে পেছনের রাস্তাটায় হৃদিতাকে খুঁজতে লেগে যায় আরাফ।কয়েক মিনিট চাতক পাখির মতো সন্ধান করে দূর থেকে থেকে দেখতে পায় হৃদিতাকে। লেডিস ব্যাগ কাধে নিয়ে দ্রুত গতিতে রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে সে।
গল্পটি লেখনীতে পলি আনান।
-আমার সাথে লুকোচুরি খেলতে এসেছে এই মেয়ে এমন খেলা খেলাবো জীবনে এই আরাফ এনায়েতের নাম ভুলবিনা।
হৃদিতা তড়িঘড়ি করে হাটছে তখনি তার সামনে বেশ ক্ষিপ্র গতিতে একটা বাইক দাড়ায়।হৃদিতা তৎক্ষনাৎ দুই পা পিছিয়ে যায় বাম হাত বুকে আবব্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে তার বুঝতে বাকি নেই এটা আরাফ।
– কিরে পিচ্চি পালাচ্ছিস কেন?
হৃদিতাকে পিচ্চি বলায় ক্ষুণ্ণমনা হয় সে। তবুও ভয় আর রাগটা বাইরে প্রকাশ না করে দৃঢ় ভাবে তাকিয়ে থাকে আরাফের দিকে।
– কথা বলছিস না কেন?কোথায় যাচ্ছিস তুই? আমাকে পড়াবে কে?
– আ…আমি আপনাকে খুঁজেছি পাইনি তাই উপায়ন্তর না পেয়ে চলি যাচ্ছি।
কথাটা শেষ করেই গোপনে শ্বাস ছাড়লো হৃদিতা।
তার উওরের প্রত্যুত্তর করলো না আরাফ।বরং কথার প্যাচ ঘুরিয়ে বলে,
– চল এবার যখন পেয়ে গেছিস তাহলে পড়া শুরু কর।
– রাস্তায় পড়াবো আমি আপনাকে?
– ডাফার একটা রাস্তায় কেউ পড়ে? সামনে একটা ছোট্ট কফি শপ আছে সেখানেই বসবো।তাছাড়া খিদে পেয়েছে আমার কিছু খেতে হবে।
আরাফের কথা শেষ হতেই আকুল কন্ঠে হৃদিতা বলে,
– আজ যেহেতু দেরি হয়েই গেছে সেহেতু আজ আমার সময় নেই আমার অন্য টিউশনি গুলো আছে আমাকে এখন যেতে হবে। কাল আপনাকে পড়াবো।
আরাফের কথার উওর শুনতে আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করলো না হৃদিতা বরং তড়িঘড়ি করে হাটতে শুরু করে।তার এমন নির্ভয় আচরনে বেশ অবাক হয় আরাফ। এই মেয়ে এমন কেন? সবসময় নিজের কথার গুরত্বটাই তার কাছে।ভয় ডর নেই নাকি?
হৃদিতা দ্রুত হাটতে নিলেই বিকট শব্দে ডেকে উঠে আরাফ।
– ওই দাড়া কই যাচ্ছিস, দ্রুত কফি শপে যা আমি বাইক নিয়ে আসছি।আমার কথার হেরফের হলে নোমান ভাইকে ডাকতে আমি দুই সেকেন্ড ও সময় নেবো না।
নোমানের কথা শুনেই থমকে যায় সে। তাকে দাড়াতে দেখেই আরাফ সাই করে বাইক নিয়ে তার পাশ কাটিয়ে চলে যায় এদিকে হৃদিতা দাঁড়িয়ে আছে ক্ষুণ্ণ মনে।
কফি শপে এক গাদা খাওয়ার নিয়ে বসে আছে আরাফ। সব ফাস্টফুড আইটেম।পাশের দোকান থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট এনে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই প্যাকেটের দিকে একটু আগেই বার্গার, ফ্রাই,সব শেষ করে এবার বিরিয়ানির উপর হামলে পড়েছে।আরাফের এমন কুৎসিত কান্ড গুলো দেখে বিরক্তে মুখ কুচকে যায় হৃদিতার তাকে খাওয়ার জন্য ইশারা করলে সে নাকচ করে দেয়।কিন্তু খাওয়ারে আবারো মন দেয় আরাফ।
– আরাফ ভাই আমি আর বসে থাকতে পারবো না। অলরেডি দুইটা বেয়াল্লিশ বাজে।তিনটা থেকে আমার টিউশনি শুরু। আপনি এমন নির্বোধের মতো আচরন করছেন কেন?
– এই পিচ্চি শোন তুই আমাকে বেলা দুইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত পড়াবি এটাই ফাইনাল।টাকা কম দেবো না মাসে পনেরো হাজার। আশা করি এতে তোর অন্য টিউশনির প্রয়োজন হবে না।
– আপনার মতো গাধাকে পড়িয়ে পনেরো হাজার টাকার চাইতেও আমার মিষ্টি জ্ঞানী বাচ্চা গুলো পড়াতে অনেক ভালো লাগে তারা অন্তত ভদ্রতা যানে, আচার ব্যবহার যানে নিয়মিত পড়াশোনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে।
হৃদিতার কথা শুনে বেশ রাগ লাগলো আরাফের। দ্রুত সামনে থাকা শপের কর্মচারির দিকে তাকিয়ে সব কিছু পরিষ্কার করতে বলে।তারপর বই নিয়ে হৃদিতার দিকে এগিয়ে দেয়।হৃদিতা বই খুলে বেশ কিছুক্ষন ভেবে চিনতে আরাফকে কয়েকটা সূত্র মুখস্থ করতে দেয়।এইভাবে কেটে যায় প্রায় দেড় ঘন্টা কিন্তু আরাফের সূত্র মুখস্থ হয়নি।ঘরির কাটা চারটার ঘরে পৌছে গেছে। মাত্র চারটা সূত্র মুখস্থ করতে একটা মানু্ষের এতটা সময় কি করে লাগে ভেবে পায়না হৃদিতা। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে চুপচাপ।ঘড়ির কাটা যখন চারটায় ছুয়ে যায় তখনে আরাফের সামনে থেকে বইটা টেনে নেয় হৃদিতা।
– এবার শুরু করুন প্রথম সূত্রটা বলুন।
– ইয়ে মানে! বলছিলাম কি আমার মুখস্ত হয় নি রে।
-বেশ কয়টা পারেন আপনি?
-একটাও না।
আরাফের কথা শুনে চমকে যায় সে।অবাক চাহনী স্থির রাখতেই আরাফ কাচুমাচু হয়ে বলে,
– বিশ্বাস কর একটাও পারিনা, পারি পারি ভাব আসে তবে হুট করেই ভুলে যাই।
– কি বলছেন এইসব ২ ঘন্টার বেশি সময় আপনি মাত্র চারটা সূত্র পারছেন না।আমার তো মনে হয় আমার স্টুডেন্ট যে ক্লাস ফাইভে পড়ে সে মাত্র আধা ঘন্টায় মুখস্থ করে আমায় তাক লাগিয়ে দেবে আর আপনি কি না?
-সত্যি পারি না। আচ্ছা তুই সন্ধ্যা পর্যন্ত পড়া তবে পারলেও পারতে পারি।
আরাফের শেষ কথাটা শুনেই রাগ দমাতে পারেনি হৃদিতা।তার কাছে চব্বিশ ঘন্টার প্রতিটা সেকেন্ড অনেক দামী। অনেক কষ্টে তার জীবন যাপন আর সেখানে কি না এই ছেলে তার সময়, মূহুর্ত গুলো নিয়ে লুডু খেলছে।রাগের মাথায় হাতে থাকা বইটা আরাফের দিকে ছুড়ে মারে হৃদিতা। শান্তশিষ্ট মেয়েটা সহসা রেগে যাওয়ায় অবাক হয় আরাফ।নির্বাক ভঙ্গি কাটিয়ে কিছু বলার আগেই টেবিলের উপর থাবা মেরে সে বলে,
– আমার সাথে কি ফাজলামো হচ্ছে।এত হাঁদা গন্ডমুর্খ স্টুডেন্ট আমি জিবনে দেখিনি।এই তুই কি আমার সাথে এখানে আমার দৈর্য্যর পরিক্ষা নিতে এসেছিস। আমার কাছে পড়ার শখ তোর তাই না;ঠিক আছে তবে তাই হবে আসার সময় একটা কঞ্চি বেত নিয়ে আসবো তখন পড়া না পারায় পায়তারা শুধু করিস তুই তবে এই হৃদিতা কি জিনিস তুই বুঝবি।
দ্রুত লেডিস ব্যাগ হাতে নিয়ে শপ থেকে বেরিয়ে যায় সে।এতোক্ষন কান্ড গুলো শপের সেই কর্মচারি আর মেনেজার নির্বাক দর্শক হয়ে দেখছিল।এত অপমানের পরেও আরাফের মনে যেন লাড্ডু ফুটেছে। হৃদিতা তাকে তুই করে সম্মোধন করেছে বকার ছলে হোক রাগের ছলে হোক হৃদিতার মুখে তুই সম্মোধনটা অতি মিষ্টি।দ্রুত চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে হাসতে থাকে আরাফ তার দিকে জোর কদমে এগিয়ে আসে সেই কর্মচারী।
– আরাফ ভাই নোমান ভাইকে কি জানাবো এই মেয়ে আপনার সাথে উচু গলায় কথা বলছে!
-খবরদার না।নোমানের চামচা তুই নোমানের থাক আমার বিষয়ে গোয়েন্দাগিরি করলে ফল কিন্তু ভালো হবে না।আর আজকের মতো আমরা যতক্ষন থাকবো ততক্ষন যেন কোন কাস্টমার না আসে। তুই তোর কাজে যা!
কর্মচারী ঘাড় কাত করে চলে যেতে নেয়।তখনি আবার কি মনে করে যেন ফিরে তাকায়,
– কিছু মনে করবেন না আরাফ ভাই মেয়েটার রেগে যাওয়া কিন্তু স্বাভাবিক। এতটা সময় ধরে মাত্র চারটা সূত্র মুখস্থ করতে পারলেন না ধিক্কার দিলাম।
ছেলেটার কথা শুনে আরাফ তার সামনে থাকা বইটা ছেলেটার দিকে ছুড়ে মারে ছেলেটাও কেচ নেয় বইটি, ঠোঁট বাকিয়ে আরাফ বলে,
– দেখতো মিলে কি না।দ্রুত বইয়ের দিকে ফোকাস কর।
ছেলেটি বইয়ের দিকে তাকাতেই আরাফ ঝরঝর করে চারটি সূত্র এক নাগাড়ে মুখস্থ চোখ বন্ধ করে বলে দেয়।তার কান্ড দেখে রীতিমতো ভড়কে যায় ছেলেটি।
– একি ভাই আপনি তো বেশ ভালো করেই পারেন তবে একটু আগে মেয়েটাকে রাগালেন কেন?
– শোন যতটা নিরেটমূর্খ ভাবিস আমি ততটা মূর্খ নই। তাছাড়া মেয়েটাকে জ্বলাতে এমন করেছি।যতদিন না আমার জালায় অতিষ্ঠ হয়ে যাবে তত দিন এমন পাগলামো করেই যাবো।এবার যাই আল্লাহ হাফেজ।
এদিকে ভয়ে রীতিমতো অসাড় হয়ে গেছে হৃদিতা রাগের মাথায় নোমানের ভাইকে তুই করে সম্মোধন করেছে,বই ছুড়ে মেরেছে নিশ্চই আজ তার কপালে শনি আছে।হৃদিতার ভাবনার মাঝেই মেসেজের টোন বেজে উঠে। হাতে থাকা বাটন ফোনটির দিকে নজর দিতে লক্ষ্য করে অপরিচিত নাম্বারের মেসেজ,
“শোন পিচ্চি কাল থেকে আমায় “তুই” তুই করে সম্মোধন করবি।যদিও আমরা একই ক্লাসে তুই বলে সম্মোধন করাই যায়।আর যদি না করিস, তবে তোকে দু-চোখের তৃপ্তি নিয়ে আবার দেখবো একদম সেদিনের মতো।সেদিনের কাঠফাটা রোদের মাঝে একটু মেঘ হয়ে এসে তুই যে ভাবে হৃদয়ে আমার বর্ষনের জোয়ার নামিয়ে দিয়েছিলি সেই জোয়ারের বাঁধ তো তোকেই গ্রন্থন করতে হবে।তাই “তুই” করে বলাটাই তোর জন্য আপদত একমাত্র শাস্তি।মনে রাখিস “সুহৃদ”❤️
বার্তা গুলো পড়েই ভেতরটা নড়ে উঠে হৃদিতার। শান্ত হৃদয়ের ধড়াস ধড়াস শব্দ যেন বিপুল পরিমানে বেড়ে গেছে তার হৃদয়ে।এই ছেলেটা চাইছে কি সামনে থেকে আগুনের উত্তাপ আর পেছনে সুহৃদ্বরেষু!হচ্ছেটা কি তার সাথে!
চলবে…..