রাগি বউ,পর্ব_৫
শামিয়া খানম জিনিয়া ✍️🌺
“এই আপনি আমাকে থাপ্পড় কেন দিলেন…….???
আর একি আপনার হাতে রক্ত কেন………???”
” কি আর করবো। মশা বসেছিল তোমার কপালে। তাই তো থাপ্পড় টা দিতে হলো…….!!!”
“ওও। এতক্ষণ এ ঘোর কাটল আমার।”
ও আমাকে গালে উঠিয়ে ভাত খাইয়ে দেয়। রান্না যাই হোক না কেন আমার শাশুড়ি মায়ের রান্না মাশ আল্লাহ খুব ভাল লেগেছিল। এভাবেই ও আমাকে প্রতিটা মুহুর্ত সাহায্য করতো। ওকে যতই দেখতাম ততই মুগ্ধ হয়ে যেতাম আমি।
ও আমাকে এত ভালবাসা দিত। তবু ও আমি আমার ভালবাসা কখনওই ওর সামনে প্রকাশ করতাম না। ওই যে আমায় ব্লক করেছিল সেই অভিমানেই ওর সাথে আমি কখনো ওর সাথে ভাল ব্যবহার করতাম না। ইসলাম তো স্বামীর সাথে ভাল ব্যবহার করতে বলেছে। কিন্তু নিজেকে কালো কাপড়ে আবদ্ধ করলে ও ইসলাম সম্পর্কে পুরা ধারনাই আমার ছিলনা। মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছা হত কেন সেদিন আমায় ব্লক করেছিল ও। কিসের একটা জড়তা এসে আমায় বার বার থামিয়ে দিত।
হটাৎ ই ভাবনার জগৎ কে ছুটি দিতে হয়েছিল বাইরের থেকে একটা কান্নার আওয়াজ পেয়ে। আওয়াজ শুনে দুজন-ই বাইরে ছুটে যায়। গিয়ে দেখি ___
একটা জীর্ণ শীর্ণ চেহারার ছেলে সেখানে বসে কাঁদছে। মাহাদি ছেলেটার কাছে গিয়ে বলে,
” কি হলো বাবা তুমি কাঁদছ কেন………???”
” কাকু, কাকু আমার বাবা রিকশাচালক। কিন্তু রিকশা চালাতে গিয়ে বাসের সাথে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে যায়।বাবা এখন হাসপাতালে ভর্তি। ডাক্তার বলেছে টাকা না হলে চিকিৎসা হবেনা।
সেই মুহুর্তে মাহাদির হাতের দামি ঘড়িটা খুলে মাহাদি ছেলেটাকে দিয়ে বলল,
” এই নাও বাবা! এটা বিক্রি করে তোমার বাবার চিকিৎসা করায়ো।”
ছেলেটা একটা তৃপ্তির হাসি দিয়ে ওখান থেকে চলে যায়…………
আমি তখন ওকে বলি,
” আপনার নিজের ই তো অবস্থা ভাল না। অন্যকে সাহায্য করার কিই বা এত প্রয়োজন ছিল????
তাছাড়া ওটা তো আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড আপনাকে দিয়েছিল। যার দাম ছিল ৩০,০০০ টাকা। এত দামি ঘড়ি আপনি ওকে দিয়ে দিলেন!!!”
” হ্যা। ওটা আমার কাছে অনেক দামি ছিল। কিন্তু একটা অসহায় ছেলের মুখের হাসির থেকে তো ওটা দামি ছিলনা। ঘড়িটা যদি আমি এমন অবস্থায় হাতে রাখতাম তাহলে ওই মহান বিচারকের সামনে কি জবাব দিতাম!!!!
এই ধণ সম্পদ তো একদিন ফুরিয়েই যাবে!!!
আমার মহান রব তো বলেইছেন,
“যারা রাতে ও দিনে গোপনে ও প্রকাশ্যে নিজেদের ধন সম্পদ ব্যয় করে তাদের রবের নিকটে তাদের পুরস্কার রয়েছে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবেনা।
(সূরা আল- বাক্বারাহঃ২৭৪)।
মাহাদির কথা শুনে মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানিয়েছিলাম এমন একজন জীবন সঙ্গীনি পেয়ে।
এদিকে বিয়ের তিন দিন পেরিয়ে গেল। আমরা দুইজন বাবার বাড়ি যাবো বলে রেডি হলাম।
মাহাদির দেওয়া একটা শাড়ি পরেই তার উপর বোরকা পরে আমি রেডি হলাম। আর ওকে বললাম,
” আচ্ছা মাহাদি আমি তো এতদিন বাইরে অনেক লোকের সামনে বের হতাম বলেই পর্দা করতাম। কিন্তু আজ তো গাড়ির মধ্যে আছি। তাছাড়া যে ড্রাইভার আছেন ওনি তো অনেক বয়স্ক। তাহলে পর্দা করার কি ই বা দরকার ছিল।”
” না তুমি ভুল ভাবছো। পর্দা তো শুধু বাইরে করতে বলা হয়নি। পর্দা তো ঘরের ভিতরেই করতে হবে যদি সেখানে কোন গায়রে মাহরাম থাকে। আল্লাহ কি বলেছেন সে সম্পর্কে কি তুমি অবগত নও?????
তিনি বলেছেন,
“★ ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।
—-সূরা আন নুর-৩১……..!!!!
বাবার বাড়িতে গিয়ে বাবা মা আমাদের দেখে অনেক খুশি হল। কিন্তু বুঝেছিলাম ভাবি আমাদের দেখে মোটেই খুশি হয়নি।
বুঝছিলাম যে কয়টা দিন ওখানে থাকতে হবে। অনেক ধৈর্য ধরেই থাকতে হবে………!!!
ভাবলাম মায়ের সাথে গিয়ে একটু গল্প করি। তাই মায়ের ঘরের দিকে এগুতে থাকি……..
ঘরে ঘরে যেতে না যেতেই মা আমাকে মাহাদির কথা জিজ্ঞাস করে। ওর কথা বলতেই আমি মা’কে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করি………!!!!
“এই কি হলো কাঁদছিস কেন রে পাগলি মেয়ে?????”
“মা আমাকে ওরা সবাই খুব যত্ন করে। কিন্তু জান মা ওরা অনেক গরিব। বিয়ের প্রথমদিন সকালেই ওরা আমাকে কচুশাক খেতে দিয়েছে!!!
তুমি তো জান মা আমি যে কষ্ট সহ্য করতে পারিনা একদম।
” তাতে কি হয়েছে রে মা! ছেলেটা যে অনেক ভাল। একদিন ঠিক মানিয়ে নিতে পারবি দেখিস! এই জীবন তো শেষ নয়…..!!!”
“ধ্যাত তোমার সাথে একটু মনের কথা বলতে এসেছিলাম। আর তুমি ও বড় বড় লেকচার দিচ্ছ???”
” মা তুই কি জানিস না। আমাদের প্রিয় নবী কন্যা আদরের দুলালী কত কষ্টের মধ্যে দিয়ে জীবন যাপন করেছে। ঠিক মত খাবার ই যাদের প্রতিদিন জুটতনা। কিন্তু ভালবাসার কন কমতি কিন্তু ছিলনা তাদের মধ্যে।”
“মা ফাতেমার কষ্টের কথা শুনে আমার মন টা অনেক নরম হয়ে যায়……….!!!!
পরেরদিন সকালে মাহাদির দেওয়া একটা শাড়ি পরে আমি নিজেকে সাজিয়ে নিলাম। মাহাদি আমাকে দেখে বলে রাগি বউ শাড়িটা তে তোমায় বেশ মানিয়েছে। আসলে জীবনে কোনদিন কোন মেয়ের দিকে তাকায়নি তো এজন্য বোধ হয় জানি না মেয়েরা কেমন সুন্দর হয়………!!!”
আমাদের কথোপকথন এর মধ্যেই আমার ভাই মাফুজ চলে আসে আমাদের ঘরে। আমাদের নিচে খেতে যাওয়ার জন্য ডাকতে আসে ছোট ভাইটি…….
খেতে নিচে গেল আমার ভাবি আমায় বলে,
“এই তামান্না! শাড়িটা কি মাহাদিই দিয়েছে তোকে!”
” হ্যা ভাবি!!!”
” কি ক্ষ্যাত মার্কা শাড়ি ওটা। ওমন শড়ি তো আজকাল ভিক্ষারিরা ও পরেনা।”
” ভাবি আপুর শাড়ি অনেক সুন্দর।। মিথ্যে কেন বলছ????”
” এই মাফুজ! বড় মানুষের কথার মধ্যে কথা কেন বলিস। চুপ কর!”
আমি তখন রাগে গজগজ করে বলতে লাগলাম,
” মা! আমার শাড়ি আর আমার স্বামী কোনটাই যখন ভাবির পছন্দ না। তখন এক টেবিলে বসে খাওয়াটা ও না আমার পক্ষে পসিবল না।আমি ঘরে গেলাম মা।”
“এক পা এগোতে না এগোতেই মাহাদি আমাকে বলল,
” আমার কোন অসুবিধা নাই তামান্না। আমি একসাথে বসে খেতে পারবো। আমার সাথে কেউ একজন খারাপ ব্যবহার করবে আর আমি ও তার সাথে খারাপ ব্যবহার করবো???
বরং শত্রুকে ও ভাল ব্যবহার দ্বারা বন্ধু করে নেওয়াই উত্তম। যে ব্যক্তির প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ নেয়না সেই কি উত্তম নয়……..???”
মাহাদির কথা শুনে আমার বিবেক নাড়া দিয়ে উঠেছিল। তাই নিজের রাগ কে কন্ট্রোল করে এক টেবিলে খেয়ে নিই ঠিকই।
কিন্তু পরক্ষনে ঘরে এসে ওকে বলতে থাকি,
“এমন একটা স্বামী জুটেছে আমার, একটা ভাল শাড়ি ও দিতে পারেনা।”
আমার কথা শুনে মাহাদি একটু কষ্ট পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু নিজের কষ্ট কে আড়াল রেখে বলল,
” আমাদের রাসূল সাঃ অনেক দারিদ্র্য ছিলেন। নিজ স্ত্রী দের খাওয়া পরা ঠিক মত দিতেই পারতেন না। কিন্তু তার স্ত্রী রা অল্পতেই তুষ্ট থাকত। আর ভালবাসা তার তো কোন কমতিই ছিলনা।তারা দুনিয়ার কষ্টগুলোলে হাসি মুখে মেনে নিয়েছিল জান্নাতি সুখ পাবার আশায়……!!!!!
আমাদের কথোপকথন এর মধ্যে হঠাৎ ই মাহাদির ফোন বেজে উঠল।
ওর কথার ধরনে বুঝলাম,
“আমার বড় ননদ সাদিয়া ফোন করেছে। যাকে কিনা কোন দিন চোখে দেখিনি।শুধু নাম ই শুনেছি।ওর কাছ থেকে ফোন নিয়ে আমি সাদিয়ার সাথে কথা বলা শুরু করি,
“আসসালামু আলাইকুম…”
“ওয়া আলাইকুম সালাম…।কেমন আছ ভাবি?”
“আলহামদুলিল্লাহ। সাদিয়া তুমি আমাদের বিয়েতে আসোনি কেন????”
” আসলে ভাবি এত ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে সময় কাটায়। যে কারনে যেতে পারিনি। প্লিজ ভাবি রাগ কোরোনা। আমি সময় করে যাবো ইনশাআল্লাহ। ”
কেন জানিনা সেদিন সাদিয়ার কথায় সন্তুষ্ট হতে পারিনি।জানিনা ও কেমন আছে??
ওর কথায় বড্ড সন্দেহ হয়েছিল আমার।
ও আমাকে পাশ থেকে বলল,
” রাগি বউ! আবার কি হলো???”
“না আসলে ওর কথায় কেমন জানি সন্দেহ হচ্ছে আমার।”
” ও তো এমন ই।”
আমার মনে হচ্ছে বড় কোন ঝড় আমাদের সবার জন্য অপেক্ষা করছে! আল্লাহই জানে কি বড় পরিক্ষা আমাদের জন্য আসতে চলেছে……….
চলবে????