রাগি_বউ,পর্ব_৭

রাগি_বউ,পর্ব_৭
শামিয়া খানম জিনিয়া ✍️🌺

আমার জ্বর একটু কমতে থাকে……..

মাহাদি আমাকে যে কথা বলেছিল, তা শুনে সত্যিই বড় লজ্জিত হয়েছিলাম আমি। ও আমাকে বলল,
“রাগি বউ! আল্লাহর জন্য তোমাকে অনেক ভালোবাসি। এমন কথা ও আমাকে এর আগে কখনো বলিনি। ও আবার ও বলা শুরু করলো,
” বিয়ের প্রথম রাত্রেই আমি তোমাকে এ কথা বলে দিতে পারতাম। কিন্তু কেন বলিনি জানো???
যদি কাউকে ভালোবাসতেই হয় সেটা আল্লাহর জন্য। কিন্তু তুমি তো তখন পরিপুর্ন ইসলামের পথে ছিলেইনা। আলহামদুলিল্লাহ এখন আমি তোমার মধ্যে পরিপুর্ন দ্বীনদারিতা দেখেছি। আমার মনের মতোই তোমাকে আমি পেয়েছি……

আল্লাহর রহমতে আমি পুরাপুরি সুস্থ হয়ে যায়……….

একদিন ঘর বাড়ি ঝাড়ু দিতে দিতে যখন সাদিয়ার ঘরের সামনে গিয়ে উপস্থিত হয় তখন দেখি,
সাদিয়ার চোখে পানি, আমায় দেখে সাথে সাথে তার আচলের মধ্যে কিছু একটা লুকিয়ে ফেলে, জানিনা কি লুকিয়েছিল।
আর সাথে তার চোখের জল ও মুছে ফেলে দেয়…….
আমি ওকে বললাম,
” কি হয়েছে তুমি কাঁদছ কেন বোন????”

” না ভাবি, মা……মা……মানে কিছু হয়নি তো আমার???”

” কই দেখি হাতের মধ্যে কি ওটা???”

আমার পিড়াপীড়িতে সাদিয়া একটা আংটি বের করে।
” ভাবি আসলে এটা ওর দেওয়া গিফট তো এজন্য এটা দেখলে ওর কথা মনে পড়ে অনেক বেশিই।”

কথা বলতে বলতেই আমাকে জড়িয়ে ধরব সাদিয়া অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। হারিয়ে ফেলে কথা বলার শক্তি।

কান্না থামিয়ে আবার ও বলতে শুরু করে,
” জানো ভাবি ও আমাকে একদম ভালোবাসেইনা। ও খুব ভাল ছিল। আগে খুব ভালবাসত আমায়। ইসলামের সব নিয়ম কানুন মেনে চলতো। কিন্তু যেদিন থেকে ঘরে Android ফোন ঢুকলো সেদিন থেকেই
সংসারে আগুন লেগেছে।
ও সারাক্ষণ ফোন নিয়ে পড়ে থাকত। আমি ওকে বলতাম,
” মেয়েদের সাথে চ্যাট করোনা।”তার বদলে আমায় বলত,

“আমি তো বোন হিসাবেই চ্যাট করছি।”

” কিন্তু তুমি কি জানোনা, ইসলামে গায়্রে মাহরাম মেইন্টেন করতে বলা হইছে।”

“আরে সোনা বউ, এসব নিয়ে টেনশন করে নাকি???”

আমায় সান্ত্বনা দিয়ে ও আমায় রেখে দিত। কিন্তু হঠাৎ ই একদিন ওর ফোনটা বেজে ওঠে। ও পাশে না থাকায় ওর ফোন টা আমি রিসিভ করি।

“আসসালামু আলাইকুম…”
“ওয়া আলাইকুম সালাম..,কে বলছেন?”
“আমি নাহিদের স্ত্রী।”

“ও, আচ্ছা তার মানে তুমিই সেই গুণধর স্ত্রী?
আমি নাহিদের গার্লফ্রেন্ড!”

“এই মেয়ে নাহিদের কোন গার্ল ফ্রেন্ড থাকতে পারেনা। ও খুব ভাল ছেলে।”

” এ বাবা বড্ড বিশ্বাস দেখছি তোমার নাহিদের উপরে। তো মেসেঞ্জার টা ওপেন করে দেখো তো। তাহলেই সব কিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”
মেয়েটার কথা মত নাহিদের মেসেঞ্জার চেক করি আর দেখি মেয়েটার কথা সত্যি………

জানো ভাবি! কথাটা বিশ্বাস করতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি স্বপ্ন দেখছি। নাহিদ ওমন করার ছেলেইনা। কিন্তু নিজের চোখে দেখা জিনিস মিথ্যা তো আর হতে পারেনা……….

নাহিদ বাড়ি আসলে ওকে সব বলেছিলাম। আমার কাছে ও ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল। ব্লক করে দিয়েছিল সব মেয়েদের……..

কিন্তু না জানি আবার ও সেই ব্লক ও খুলে দিয়েছিল। আর তারপর আর লুকিয়ে নয় প্রকাশ্যেই ও কথা বলতো মেয়েদের সাথে। শুধু চ্যাট না, ফোনে ও কথা বলতো। আর ওকে কিছু বললেই আমায় মার খেতে হতো। দিন দিন আমার উপর ওর অত্যাচার বেড়েই যাচ্ছিল……

মেনে নিয়েছিলাম সব কিছু। আর ওকে বারবার নিষেধ করতাম মেয়েদের সাথে কথা বলতে শুনতইনা। আমাকে উলটে আরো বলত তোমার ইচ্ছা থাকলে তুমি ও কথা বলো……..

” সাদিয়া তুমি টেনশন করোনা। সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। ”

” ঠিক আর কি হবে ভাবি যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে”

“মানে কি???”

” আর কিছু ঠিক হবার নেই ভাবি। ও আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে।”

কথাটা শুনে যেন মনে হলো আমার ই পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছিল। ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা যখন হারিয়ে ফেলেছিলাম। তখন ই আমার রব আমাকে স্বরণ করিয়ে দেয় কুরআনে বর্ণিত সেই আয়াত……..
‘আর তোমরা নিরাশ হয়োনা এবং দুঃখ কোরোনা। যদি তোমরা মুমিন হও তাহলে তোমরাই জয়ী হবে।
(সূরা আল-ইমরান ১০৯)’

হ্যা সত্যিই তো আল্লাহ মানুষকে হতাশ হইতে নিষেধ করেছেন। সাদিয়াকে সান্ত্বনা দিলাম রবের বলা কথা দ্বারাই। ওকে বললাম,
” আল্লাহ যাকে পছন্দ করেন তাকেই বিপদ দিয়ে পরিক্ষা করেন। নিশ্চয় তুমি উত্তম কোন প্রতিদান পাবে।”

সাদিয়ার সাথে কথা বলার পর বুঝেছিলাম যে শয়তান কত বড় চালাক। সে মানুষকে কিভাবে ধোকা দেয়। সেদিন মাহাদি কেন আমায় ব্লক করেছিল, আর কেনইবা ও সব গায়্রে মাহরাম দের এড়িয়ে চলতো তা আর বুঝতে বাকি রইলনা আমার………..!!!

সাদিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে সকাল ১০ঃ০০ বেজে যায় তা খেয়াল ও করিনি। বেচারি মাহাদি টা বোধ হয় নিজে নিজেই খাবার বেড়ে খেয়ে চলে গেছে……….

তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে মাহাদির কাছে ফোন করি। ওকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসতে বলি। কারন আমি নিজের পাপের প্রতি বড়ই অনুতপ্ত ছিলাম। মাহাদি আমার ফোন টা রিসিভ করে বলে,
” আমি গাড়ির মধ্যেই আছি, একটা জরুরি কাগজ বাড়িতে রেখে এসেছি।”

মাহাদির সাথে কথা বলতে বলতেই একটা অপ্রীতিকর শব্দ কানে এসে ফোন টা কেটে যায়। কানের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর শব্দ বাজতে থাকে……..!!!!

আল্লাহর কাছে সাহায্য চাচ্ছিলাম, আল্লাহ কে বলছিলাম হে আল্লাহ! ওকে তুমি ভাল রেখো……….!!!

নিজের করা ভুলগুলোর জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। মাহাদির ফোন অফ বলছে………
কি যে করি বুঝতে না পেরে ঘরে এসে রাসূল সাঃ এর জীবনী পড়া শুরু করি………!!!

কত অভাব, অনটনের মধ্যে আমাদের নবী দিন কাটিয়েছেন। আবার তিনিই ছিলেন মুসলিমজাতির নেতা, শুধু মুসলিম নয় সব ধর্মের মানুষের নেতা ছিলেন। স্বভাবতই শাসকরা হয় আরামপ্রিয়, কিন্তু এ যে আমার প্রিয় নবী, আলাদা ছিল তার জীবনকাহিনী।

অত্যাচার, শাসন, জুলুম, আর রক্তমাখা সেই ইতিহাস। যা পড়লে কোন মানুষ নিজের অশ্রুকে লুকিয়ে রাখতে পারবে না। আমি কেঁদে ফেলি প্রিয় নবীর সেই রক্তমাখা ইতিহাস পড়ে। লজ্জিত হয় নিজের করা বিলাসিতার কথা ভেবে। ধিক্কার জানায় নিজের বিবেক কে,
‘বলি, এই নাকি আমি নবীর উম্মাত? এই নাকি নবীর অনুসারী? ‘

হৃদয় দুয়ার খুলে যায় আমার। শাশুড়ি মা’কে গিয়ে সাদিয়ার সব কথা খুলে বলি। ভাবনা তে ছিল সব কথা শোনার পর কান্নায় ভেঙে পড়বেন। কিন্তু নাহ! আমার ভাবনা কে মিথ্যে করে দিলেন আমার শাশুড়ি মা। বুকের মধ্যে কষ্ট লুকিয়ে আমায় বললেন,

” মা রে জানিস আকাশের মালিক তার বান্দাদের কষ্টে ফেলে, দুঃখে ফেলে পরিক্ষা করেন। আমাদের উচিত তার পরিকল্পনা কে মেনে নিয়ে ধৈর্য ধারন করা।”

ওনার কথা শুনে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রই। পাশ থেকে পিচ্চি ননদ টা এসে আলতো করে ছুয়ে বলে,
“ধৈর্য কি গো ভাবি???”

” ধৈর্য তো এমন ই জিনিস। যা হাজার কষ্টের মাঝে মানুষকে সান্ত্বনা দেয়। ও তুমি বুঝবেনা, বড় হও নিশ্চয় বুঝবে……….!!!

মায়ের দিকে অনুসুচনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,” মা গো! আমায় কি ক্ষমা করা যায়না???”

” এমন কথা কেন বলছো? তুমি তো কোন অন্যায় করোনি”

” না মা অনেক কষ্ট দিয়েছি। আজ পর্যন্ত রান্নাঘর এ পর্যন্ত আসার প্রয়োজন ই মনে করিনি কখনো। এটা তো আমার করা উচিত হয়নি।”

” আরে পাগলি মেয়ের কথা শোন। তুমিই তো সব করবে। এখন তো তোমার বয়স কম। সময় হলে করবে ইনশাআল্লাহ। ”

আমাদের কথোপকথন এর মধ্যেই বাইরে থেকে অচেনা দুই লোকের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে কানে………..

শিউলিকে পাঠায় বাইরে তারা কি চায় জানার জন্য। শিউলি বাইরে থেকে এসেই আর স্বাভাবিক থাকতে পারিনি। ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদে আর ভাইয়া, ভাইয়া করে………!!!!

নিজেকে কালো কাপড়ে আবৃত করে ছুটতে থাকি বাইরে। এক অজানা ভয় নিয়ে বাইরের দিকে এগোতে থাকি………….

চলবে????

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here