রাগি বউ,পর্ব_৪

রাগি বউ,পর্ব_৪
শামিয়া খানম জিনিয়া ✍️🌺

ছেলের দিকে একবার তাকিয়েই আমি আশ্চর্য হয়ে যায়। এ যেই সেই মাহাদি। জানিনা বাবা একে আবার কোথ থেকে পেলো……….

ইচ্ছে করছিল গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিই। আবার আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিল……..

ওরা চলে গেলে মাফুজ আমায় এসে বলে,
“আপু জানো মাহাদি ভাইয়া আর মাহাদি ভাইয়ার আম্মু তোমাকে খুব পছন্দ করেছে।”
অনেক রাগ হচ্ছিল সেই মুহুর্তে মাফুজের কথা শুনে। আমি বাবাকে গিয়ে বললাম, বাবা এই বিয়ে আমি করতে পারবনা।
বাবা তখন আমায় ঠাস করে একটা চড় দিয়ে বলল,
“ছেলেটা ধার্মিক ভদ্র। ওকে বিয়ে করতে তোর সমস্যা কি? নাকি কাউকে পছন্দ আছে, পছন্দ থাকলে বল আমার সাথে, আর তা না হলে তোর যা খুশি মন চাই তুই তাই কর।”

সত্যি বলতে কাউকে তো আর পছন্দ নেই আমার। খুব রাগ হচ্ছিল মাহাদির ওপরে……..
বাবা কোনদিন আমার গায়ে হাত তুলেনি, আজ ওই ছেলেটার জন্য আমায় মার খেতে হয়েছে…….

হঠাৎ ই মাফুজের চিৎকারে বাবার ঘরের দিকে ছুটে গেলাম……

গিয়ে দেখি বাবা স্ট্রোক করেছে। বাবাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো। বাবার অবস্থা খুব সিরিয়াস। কষ্টে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল।……….

আল্লাহ কে বলছিলাম, হে আল্লাহ আমার বাবা কে তুমি সুস্থ করে দাও। আমি আর বাবার কথার অবাধ্য হবোনা। বাবা যা বলবে তাই শুনবো আমি।………

আল্লাহর রহমতে বাবা সুস্থ হয়ে গেল। পুরাপুরি সুস্থ আর হলো কই?
বাবা প্যারালাইজড হয়ে যায়,কোন কথা বলার শক্তি পর্যন্ত থাকেনা বাবার।
বাবা হাসপাতাল থেকে ফিরে আসলে বাবার পায়ে ধরে ক্ষমা চায় আরর বাবাকে বলি,
“বাবা আমি তোমার পছন্দ করা ছেলের সাথেই বিয়ে করবো। বাবার চোখ দিয়ে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম সে কান্না আনন্দের ছিল……..

সবকিছুর জন্য নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। যদি আজ বাবা হাটতে চলতে পারতো, তাহলে কতই না আনন্দ করতো…….

অবশেষে মাহাদির সাথে আমার বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে যায়। হুযুর রা অহংকারী হয় এই চিন্তা যে আমার ভুল ছিল তা বিয়ের দিন রাত্রেই ও প্রমান করে দেয়।

মাহাদি আমাকে যে গিফট দিয়েছিল তা ছিল পৃথীবির মধ্যে সব থেকে মহামুল্যবান গিফট। যা কিনা টাকা দিয়ে হিসাব করা যাবেনা।

আমার হাতে একটা কুরআন শরীফ তুলে দিয়ে ও আমাকে বলে,
” রাগি বউ। এই ছাড়া যে আর আমার সামর্থ্য নেই। অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে এই গিফট টা তোমার জন্য কিনেছি।”

কুরআন শরীফ দেখে ওর প্রতি সব রাগ আমার মুছে গিয়েছিল।

ওর দেওয়া নাম খুব ভাল লেগেছিল ‘রাগি বউ’। আমার রাগ সম্পর্কে ওর ভালোই ধারনা ছিল। এজন্য বোধ হয় এমন একটা নাম দিয়েছিল আমার।

এলোমেলো স্বপ্ন গুলা মনের মধ্যে উকি দিয়ে যাচ্ছিল। কি ভেবেছিলাম আর কি হয়ে গেল। ভেবেছিলাম বেনারসি শাড়ি পরে কনের আসরে বসে থাকবো, এমন এক ধনী বাড়ির বউ হবো, যারা কিনা আমাকে দিবে গা ভর্তি গহনা। কিন্তু তা আর হল কই এমন গরীব জায়াগায় চলে এসেছি ভাগ্যের জোরে……..

তবে হ্যা বেনারসি পরানো হয়েছিল ঠিক ই কিন্তু তার ওপরে কালো বোরকা ও পাঠিয়ে দিয়েছিল। নিজের চাচাতো, মামাতো ভাইদের পর্যন্ত মুখ দেখাতে দেয়নি এই ছেলেটা। বলেছিল মেয়েরা ঝিনুকের মধ্যে থাকা মুক্তা। আর সেটা তো সব সময় সুরক্ষিত রাখতে হবে। কেনই বা একদিনের জন্য সেই রূপ প্রকাশ করতে হবে। আমার বাবাকে এই সব কথা গুলাই ও বলে দিয়েছিল আগে থেকে, তাই বাবা বিয়ের দিন ঠিক ওর কথা মতোই আমার পর্দার ব্যবস্থা করেছিল।

কথাগুলা ভাবতে ভাবতে যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা টের ও পাইনি।

হঠাৎ ই ঘুম ভাঙল পানির ছিটায়। ভোরে উঠে দেখি আমার চোখে মুখে পানি ছিটানো। বুঝলাম এটা ওর ই কান্ড। ”
কি ব্যাপার আপনি আমার চোখে পানি কেন দিলেন?”

” তো কি করবো? ঘুম থেকে উঠছোনা কেন? কখন ধরে তোমায় ডাকছি। দেখো মসজিদ এ কি সুন্দর আজান হচ্ছে? পৃথীবির সব সুর থেকে এটাই যেন সুখময় সুর। মোয়াজ্জিন আজানে কি বলছে শুনছ না? ‘ঘুম থেকে নামাজ উত্তম’।
আর এত কিছু শোনার পর কি ঘুমিয়ে থাকা যায় নাকি????”

মাহাদির কথা শুনে আর ঘুমিয়ে থাকতে পারিনি।
এক অজানা সুখের সন্ধ্যানে ওযু করে এসে প্রভুর দরবারে দাঁড়ায়। জায়নামাজে বসে
অনেক্ষন কেঁদেছিলাম। কিন্তু কেন কেঁদেছিলাম সেটা জানিনা।

যাই হোক সকাল সকাল আমার পিচ্চি ননদ টা ঘরে প্রবেশ করলো আমাদের খেতে যাওয়ার কথা বলতে।

আমরা দুজন রান্নাঘরে গেলাম খেতে। খাওয়ার ঘরে গিয়ে ঘরটা নতুন ভাবে আবিষ্কার করলাম। একটা টেবিল নাই সেখানে।

ও আমাকে ফিসফিসিয়ে বলে রাগি বউ দস্তরখানায় খাওয়া যে সুন্নাত। জেনে শুনে একটা সুন্নাত মিস করার কি কোন মানে হয়।

আমার শাশুড়ি,ননদ আর শশুর খেয়ে উঠে গেলে আমরা খেতে বসলাম।

খাওয়ার সময় দেখি কচুশাক আর মসুর ডাল। যা আমি কোনোদিন ও খাইনি। খাবারের অবস্থা দেখে আমি ঘরে চলে যায়। মাহাদি আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে খাবার ঘরে নিয়ে আসে আর বলে তুমি কি জানোনা আমার আল্লাহ সবাইকে পরিক্ষা করেন। তিনি বলেন,
“এবং আমি তোমাদিগকে পরিক্ষা করবো কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল–ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।
(সূরা বাকারাহ ২ঃ১৫৫)।”

তুমি বিশ্বাস করো যদি মাংস কেনার মত সামর্থ্য আমার থাকতো তাহলে আমি কিনতাম। কিন্তু সেই সামর্থ্য যে আমার নাই। ইদানীং ব্যবসা যে খুব একটা ভাল যাচ্ছেনা। আমি টাকা ধার করলে করতে পারতাম। কিন্তু আমার যা আছে আমি তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাই। আলহামদুলিল্লাহ।
আচ্ছা তোমার কাছে কোনটা দামী। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের সুখ সাচ্ছন্দ্য! নাকি জান্নাতের ওই বিশাল সুখ সাচ্ছন্দ্য! যেখানে কিনা কারোর কোন আশা অপুর্ন থাকবেনা। যদি এই ক্ষণস্থায়ী পৃথীবির ধণ সম্পদ তোমার কাছে দামী হয়, তাহলে যে জান্নাত পাওয়ার আশা বৃথা। আর আমি কখনওই ওসব বড় বড় চাকরির আশা করবোনা ইনশাআল্লাহ। যাতে কিনা হারাম মেশানো আছে। আমি চাইনা এই অল্প কয়দিনের দুনিয়ার প্রেমে পড়তে। আমি চাইনা এই পৃথীবির লোভ লালসা আমার মনে বাসা বাঁধুক। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের ব্যস্ততা আমাকে আমার প্রভুর স্বরণ থেকে গাফেল রাখুক, এটা আমি কখনওই চাইনা।
চেয়ে দেখো ওই পথশিশুদের দিকে।যারা ঠিক মত খেতে পারেনা। সামান্য নুন ভাত ই যাদের জোটেনা। রাস্তার ধারের কোন এক পাশে তারা শান্তির স্থান খুজে পাই। আমি দেখেছি তাদের একদল যারা আনন্দ করে মসজিদে যায় সালাত আদায় করতে।
তাদের থেকে কি তুমি ভাল নেই। তাহলে শুকরিয়া আদায় করো। মনে রেখ আমাদের নবী অনেক গরীব ছিলেন। তবুও তিনি তাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। তাহাজ্জুদ পড়তে যেয়ে যার পা ফুলে যেত। দিনের পর দিন যার চুলায় আগুন জ্বলতনা। আরামের কোন বিছানা তার ছিলনা……..!!!!!

মাহাদি কথাগুলা একবাক্যে বলেই চলেছিল। ওর কোথা গূলো শুনে আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম কত ভালো ও। নানান প্রশ্ন নিজের মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ ই ওর একটা থাপ্পড়ে আমার হুশ ফিরল। অবাক হলাম। ও তো এমন করার ছেলে না। খুব সুন্দর করেই তো কথা বলছিল এতক্ষণ এ। তাহলে থাপ্পড় কেন দিল আমায়……………?????

চলবে????

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here