মেঘের_উল্টোপিঠ,০৮,০৯

#মেঘের_উল্টোপিঠ,০৮,০৯
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
[পর্ব-০৮]

পূর্বের ফোন স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে আমার এবং আপুর একটা ছবি। ছবিটা বেশ পুরোনো! আমি কলেজে পড়াকালীন ছবি। আপু এবং আমি সাজেক ভ্যালিতে ট্যুর দেয়ার সময়কার ছবি এটা! এই ছবিটা পূর্বের কাছে? নিশ্চয়ই আপু দিয়েছে। আপু আর পূর্বের রিলেশন ছিলো ২,৩ বছর আগে। রিলেশনের সময়কাল নিতান্তই অতি স্বল্প! মাত্র ১ মাস তারা রিলেশনে ছিলেন।

সকল ভাবনা ঠেলে আমি এক চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ি। পূর্ব আসলে দেখছেন কাকে ছবিতে?আমায় নাকি আপুকে? আপুকে দেখছেন না তো?হতেই পারে। তারা এককালে প্রেম নামক বন্ধনে আবদ্ধ ছিলো। আমাকে কেনো দেখবে? আমার সাথে তার বিয়েটা ছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত! আমাকে সে পছন্দ করেন কিনা তা সম্পর্কেও অবগত নই আমি। হুট করে চোখের কার্নিশে পানি এসে জমলো! খারাপ লাগছে কেনো? চটপট দৃষ্টি আশপাশে দেই। তারই মাঝে পূর্ব ভরাট কন্ঠে বললেন,

‘ তুমি পড়ো! আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। কোনো কিছুতে হেল্প লাগলে আমি এসে দেখিয়ে দিবো। ‘

নতজানু হয়ে নিম্ন কন্ঠে বললাম, ‘ জি আচ্ছা! ‘

ভাঙা স্বর! পূর্ব আঁড়চোখে আমার পানে দৃষ্টিপাত স্থাপন করলেন। নম্র কন্ঠে বললেন, ‘ আর ইউ ওকে?’

কন্ঠনালি দ্বারা জবাব না দিয়ে ইশারায় ‘ হ্যা ‘ বলি। পূর্ব এক পলক তাকিয়ে তার ফোনটা সোফায় রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কাবার্ডের কাছে গিয়ে হাতে তুলে নিলেন শুভ্র রঙের টাওয়াল। তারপর তার যাত্রা শুরু হলো ওয়াশরুমের পথে। দরজা বন্ধ করতেই আমি চোখের কার্নিশে জমে থাকা অশ্রুজল মুছে ফেলে তার ফোনটা সন্তপর্ণে হাতে তুলে নেই। কৌতূহল বশত ফোন ওপেন করে লক খুলি। পূর্ব যখন প্রথম ফোন খুলেছিলেন তখন আঁড়চোখে পাসওয়ার্ড রপ্ত করে নিয়েছিলাম। অতঃপর ‘ ‘ ‘ ‘Gallery Lock ‘ এ্যাপ্সটাতে লগইন করেই পড়লাম বিপত্তিতে। এটার পাসওয়ার্ড আমার জানা নেই! তবুও চোখের সামনে যা ভেসে উঠেছিলো তাই দিয়ে দিলাম দু’বার! কাজ হলোনা! আর একবার বাকি। এটাতে বিফল হলে আমার ছবি উঠে যাবে অটোমেটিকলি। তখন নিশ্চিত পূর্ব জেনে যাবেন আমি তার ফোন ধরেছি। তার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে নিশ্চিত! তখন কি জবাব দিবো?

শুষ্কো ঢোক গিলে মনে করার চেষ্টা করি পাসওয়ার্ড। ‘ স্নিগ্ধপরী ‘ বা ‘ স্নিগ্ধময়ী ‘ টাইপ পাসওয়ার্ড ছিলো। দু’টোই ট্রাই করা শেষ। কাজ হয়নি! এ্যালফাবেট এ গড়বড় হয়েছে বোধহয়। পরিশেষে ফোনটা রেখেই দিতে হলো! বই কোল থেকে কাঁচের টেবিলেটার ওপর শব্দ করে রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম! অস্থির অস্থির লাগছে খুব। হেঁটে সামনে যেতেই পায়ের তলায় তীব্র ব্যাথা অনুভব হলো। মাথা নিচু করে তাকাতেই খেয়াল হলো রক্ত! পাশেই কাঁচের কিছু সুক্ষ্ম কণা পড়ে রয়েছে। এই কাচ দ্বারা যে ‘ পা ‘ আমার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তা বুঝতে আর বেগ পেতে হলো না।

ফ্লোরে ধীরেসুস্থে বসে ক্ষতস্থান হতে কাঁচের টুকরো বের করার সাহস হলোনা। কাচ বের না করলে ড্রেসিং করাও সম্ভব না! ব্যাথায় দাঁত মুখ খিঁচে বন্ধ করতেই পূর্বের সেই রাশভারী কন্ঠস্বর কর্ণপাত হলো। তিনি বললেন,

‘ ফ্লোরে বসে কি করছো?’

চোখজোড়া চটপট খুলে নেই। ওয়াশরুমের দিকে পিঠ দিয়ে বসে তাই বোধহয় তিনি আমার রক্তাক্ত পা দেখতে পারছেন না। খানিকক্ষণ বাদে পদধ্বনির শব্দে স্পষ্টত বুঝতে পারলাম পূর্ব আমারই দিকে আসছেন। মাথা তুলে তাকাতেই দৃশ্যমান হলো তার নিস্তব্ধ চাহনি! চমকে পায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন, তার এতোটা চমকে যাওয়াতে ভড়কে গেলাম। ধীর কন্ঠে কোনোরকম ব্যাথা দমন করে বলি,

‘ ফাস্ট- এইড বক্সটা একটু দিবেন প্লিজ?’

পূর্ব নড়লেন না! উত্তর দিলেন না। এমনকি কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখালেন না। তার বর্তমান অবস্থা সে প্রাণ ছাড়া কেও! বর্তমানে তার বিহেভে বড্ড বিরক্ত হলাম। ব্যাথাতুর কন্ঠে ফের বললাম,

‘ আপনি কি আমার কথা শুনতে পেরেছেন? ‘

পূর্ব চটজলদি আমার পাশে বসলেন। আঘাতপ্রাপ্ত পা টেনে নিয়ে তার পায়ের ওপর রাখলেন। ক্ষত স্থানটা একটু বেশিই। কাচটা আকারে বড় ছিলো। পূর্ব তা দেখে ব্যাকুল হয়ে বললেন,

‘ ব্যাথা কি করে পেলে? চোখ কি তোমার মাথার ওপরে? দেখে চলতে পারো না তুমি? রুমে কাচ-ই বা আসলো কি করে? ‘

তার কথার উত্তর দেয়া হলো না। ব্যাথায় চোখের কার্নিশে অশ্রুরা এসে ভীড় করেছে। আর এই লোক এ মূর্হতে আমায় এসব জিজ্ঞেস করছে? পূর্ব আমার পা সন্তপর্ণে ধীরে মাটিতে রেখে কাবার্ড থেকে ফাস্ট এইড বক্স আনলেন। কাঁচের টুকরো চতুরতার সাথে বের করায় অতোটা ব্যাথা অনুভূত হলোনা। শুভ্র ব্যান্ডেজ দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত স্থান মুড়িয়ে দেন। তার চেহারায় ফুটন্ত অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আঘাত আমি নই তিনি পেয়েছেন! তার কাজ শেষ হতেই তিনি গলার কন্ঠস্বর উঁচু করে তার মা, ভাবীসহ আরো কয়েকজন কে ডাকলেন।

ক্ষনিক বাদে তাদের আগমন ঘটে রুমে। মামনি আমার পায়ে ব্যান্ডেজ দেখে এগিয়ে আসতে নিলেই পূর্ব হাত উঁচু করে রুষ্ট কন্ঠে বললেন,

‘ এখন দরদ দেখাতে হবেনা! রুমে কাচঁ ফেলে রেখেছিলো কে? আমি বারবার করে বলে দিয়েছি যাতে কোনোরূপ ত্রুটি দ্বারা ওর ক্ষতি না হয়। কথাটা রাখলেনা! আমাকে কষ্ট দিতে তোমার এতো ভালো লাগে কেনো মা?’

মামনি আহত দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাই পূর্বের পানে। মামনির সাথে এভাবে কথা বলছেন কেনো তিনি? এতো রুষ্ট কন্ঠে! মামনি কিছু বলতে তার আগেই পিছন হতে একটা মেয়ে এগিয়ে আসলো। বেশ-ভুষায় মনে হলো মেয়েটা এ বাড়িতে কাজ করে। কাচুমাচু করে মাথা নুইয়ে মেয়েটি বলল,

‘ আমারে মাফ কইরা দেন ভাই। বউমনি আইবো তাই আপনে কইছিলেন পুরা বাড়ির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ময়লা, ধুলবালি পরিস্কার করতে। বউমনির ধুলাবালিতে হাঁচি আহে তাই। তহনই এই রুম পরিস্কার করার সময় ময়লার ব্যাগ থেকা মনেহয় কাঁচের টুকরা পড়ছে। আমি খ্যাল (খেয়াল) করিনাই। মাফ কইরা দেন ভাই! ‘

পূর্ব রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করলেন। নিজেকে ধাতস্থ করে মামনির পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,

‘ কি টাইপ লোকদের কাজে নিয়োগ করো? দেখে- শুনে তো করা উচিত না আম্মু? ক্ষতিটা তো দিনশেষে আমাদেরই হয়। ‘

পূর্ব আর কিন্তু বললেন না। নিঃশব্দে সবার সামনেই এক অদ্ভুত কাজ করে বসলেন তিনি। হুট করে কোলে তুলে নিয়ে আমায় বেডে আধশোয়া হয়ে বসিয়ে দিলেন। পুরো সময় আমি ছিলাম নির্বাক! এবার সোফার কাছে গিয়ে বই এনে আমার হাত বই ধরিয়ে দিয়ে নম্র কন্ঠে বললেন,

‘ এভাবেই বসে পড়ো। নিচে নামবেনা একদম। দরকার হলে আমায় বলবে! ‘

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই। লজ্জায় কথা বলার শক্তি লোপ পেয়েছে! মা, ভাবীর সামনে এভাবে কোলে তুলে নিলো? ইশশ! কি লজ্জাকর মূর্হত! ক্ষনেই রুমে শূন্যতা বিরাজমান হয়! পূর্ব ফোন নিয়ে বেলকনিতে কথা বলছেন। আমি বসে পড়া ফাঁকি দিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো ভাবছি আর সমীকরণ মেলানোর চেষ্টায় আছি। পরিশেষে অন্তরালে একটা প্রশ্নই জাগ্রত হলো,

‘ পূর্ব কি আমায় পছন্দ করেন? তার কর্ম দ্বারা তো তাই প্রকাশ পাচ্ছে। এটা কি আদও সম্ভব হওয়া যায় না?’

_______________________

রাতে মামনি এসে হাসিমুখেই আমায় নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে গিয়েছেন। ভাবী এসে বেশ কয়েকবার খোঁজ – খবর নিয়ে গিয়েছেন। সেই কাজের মেয়েটা, তাহিরা নাম! সেও বারংবার এসে আমায় উঁকি, ঝুঁকি মেরে দেখে গিয়েছেন। পূর্ব বাহিরে গিয়েছেন। যাওয়ার আগে বাড়ির সবাইকে বলে গিয়েছেন আমায় দেখতে! রুমের দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে নিচু কন্ঠে পূর্ব কথাটি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললে আমি তা শুনতে পাই যতই নিচু কন্ঠে হোক!

পূর্ব মানব কোথাও উধাও হয়েছে জানা নেই। তবে যাওয়ার আগে আমায় সে পাইপাই করে বলে গিয়েছে যেনো ‘ বেড থেকে আমি না নামি! ‘ তার কথামতো তাই করা হয়েছে। অমান্য করার সাহস হয়নি।

এখন রাত ১২ টা ছুঁই ছুঁই!
অবিন্যস্ত রূপে রুমের পর্দাটা উড়ছে। বাহিরে নিকষ কালো আঁধার বিরাজমান। হিম বায়ু এসে বারংবার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। নিঃশব্দে পড়াকালীন পদধ্বনির শব্দ কর্ণপাত হয়! খানিক বাদে সামনে দৃষ্টিপাত মেলতেই দেখা মিললো পূর্বের মুখশ্রীর! নীল রঙের টিশার্ট ঘামে ভিজে তার সুঠাম দেহের সাথে মিশে আছে। তাকে দেখা মাত্র আমি বলি,

‘ আপনি কোথায় ছিলেন?’

পূর্ব রুমে প্রবেশ করে তার ঘন কুচকুচে কালো চুলে হাত গলিয়ে বললেন,

‘ হসপিটালে! ইমার্জেন্সি এসেছিলো। ‘

প্রতুত্তরে ‘ অহ! ‘ বলে চুপ হয়ে যাই। পূর্ব ওয়াশরুম ঢুকে আরেকদফা সাওয়ার নিয়ে এসে ক্ষ্যান্ত হয়ে বসলো আমার পায়ের কাছটায়। হাত এগিয়ে ক্ষত স্থান দেখে বললেন,

‘ ব্যাথা আছে? ‘

‘ উঁহু! ‘

‘ রাতে খেয়েছো?’

আমি তপ্তশ্বাস ফেলে বলি, ‘ জি। মামনি খাইয়ে দিয়ে গেছেন। ‘

পূর্ব এবার রাশভারী কন্ঠে বললেন,

‘ অনেক পড়েছো। আজ আপাতত আর পড়ার দরকার নেই। ঘুমিয়ে পড়ো! ‘

আমি ইতস্তত বোধ করে বলি, ‘ কোথাও ঘুমাবো?’

‘ কেনো এখানেই। বেডে! ‘

আমি চট করে বলি, ‘ তাহলে আপনি কোথায় ঘুমাবেন?’

পূর্ব কপালে সুক্ষ্ম ভাজ ফেলে বললেন, ‘ তোমার পাশে। ‘

পূর্বের কথার বিপরীতে আর কিছু বললাম না। তবে অস্বস্তি হচ্ছে! তার সাথে এক বেডে ঘুমাতে হবে ভাবতেই লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। বই হাত হতে রেখে দিয়ে শুয়ে পড়তেই পূর্ব উঠে গিয়ে লাইট অফ করে দিলেন। সেকেন্ড খানিক পর তিনি আমার পাশে এসে বসে আমাদের দু’জনের মাঝে কুশন রেখে শীতল কন্ঠে বললেন,

‘ এবার আর অস্বস্তি নেই তো? ‘

আমি চমকে বললাম, ‘ আপনি বুঝলেন কি করে?’

পূর্ব জবাব দিলেন না। টানটান হয়ে একহাত তার মাথার নিচে দিয়ে নিঃশব্দে শুয়ে পড়লেন! আমি কিছুক্ষণ তার পানে তাকিয়ে থেকে চোখজোড়া বন্ধ করে নেই। পূর্ব মানবের প্রতি শ্রদ্ধাটা দিনদিন বাড়ছে।

_________________________

হলদেটে রৌদ্দুরের আমাগোনা রুম জুড়ে! পূর্বের উঁচু কন্ঠ শুনে হকচকিয়ে উঠে বসি। ঘুমুঘুমু চোখে চটজলদি বেড থেকে নেমে করিডরে এসে নিচে দৃষ্টি দিতেই চোখ আমার ছানাবড়া! দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পায়ে পুনরায় আঘাত পেয়ে পা ধরে ফ্লোরে বসে পড়লাম! অতঃপর দৃশ্যমান হলো শুভ্র ফ্লোরে ফের রক্তের আনাগোনা। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই আমার। বিষ্ফোরিত চাহনি নিক্ষেপ করে সামনে আমার দৃষ্টিপাত!

চলবে…

#মেঘের_উল্টোপিঠ
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
[পর্ব-০৯].

রুমের এপাশ হতে ওপাশ! পূর্ব একনাগারে পাইচারি করে যাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে আঁড়চোখে আমার পানে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। তবে তার ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে দেখে আমার বিন্দুমাত্র ভয় কাজ করছে না। বরঞ্চ স্বাভাবিকতা নিয়েই বইয়ের মাঝে দৃষ্টি এলিয়ে রেখেছি। খানিকক্ষণ বাদে পূর্ব ধৈর্যহারা হয়ে বললেন,

‘ তোমাকে নিচে যেতে বলেছিলো কে? কেনো ভুলে যাও বারবার তোমার রক্তক্ষরণ শুরু হলে বন্ধ করা কতোটা জটিল হয়ে পড়ে! ‘

হাত হতে বই পাশে রেখে আমি অবলোকন করি পূর্বের মুখশ্রীর প্রতি। ধীর কন্ঠে বলি,

‘ আপনি নিচে আয়াফ ভাইয়াকে ওভাবে থাপ্পড় মারলেন কেনো? ইভেন আপনি তার কলার ধরে বাসা থেকে বের করে দিতে নিচ্ছিলেন! নিজের বাড়ি বলে এমন অভদ্র আচরণ করে কেও মানুষের সাথে? ‘

পূর্ব তপ্তশ্বাস ছাড়লেন! ত্রস্ত পায়ে হেঁটে এসে আমার পাশে নিঃশব্দে বসে তিনি ফিচেল কন্ঠে বললেন,

‘ অভদ্রতা করিনি আমি দোল! যে যেমন আচরণ প্রাপ্য তাই করেছি। তুমি জানোনা আয়াফকে।চিনোনি! চেনারও দরকার নেই। আমি ওর ছায়া তোমার আশপাশে কখনো পড়তে দিবোনা। ‘

‘ মানে?’

‘ কিছুনা। আমি তোমার ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসছি। স্থির হয়ে বসো! নড়বেনা এখান থেকে। ‘

প্রতুত্তর করেই পূর্ব উঠে চলে গেলেন। এ মূর্হতে মনে হলো তিনি কিছু লুকাতে চাইছেন আমার থেকে। আয়াফের ব্যাপারে! এমন কি হয়েছে যে পূর্ব আয়াফের সাথে এমন উগ্র ব্যাবহার করেন? মেডিকেলে তাকে রুষ্ট ব্যাবহার করতে দেখলেও আজ পর্যন্ত দেখিনি সে কারো দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে কথা বলেছেন। হয়তো তার নিভৃতের রূপটা আলাদা। যা আমি দেখিনি! খেয়ালে আসেনি!

_________________________

পায়ের ক্ষত নির্মূল হওয়ার আগ দিয়েই আজ পূর্বের কথার খেলাপ করে, তাকে না জানিয়েই মেডিকেলে এসে পড়েছি। আমি যখন আসছি তখন পূর্ব গভীর ঘুমে মগ্ন! তখনই ফাঁক দেখে বেড় হয়ে গিয়েছি। যাওয়ার পথে যদিও মামনি বারংবার আমায় মানা করেছিলেন কিন্তু শেষে তাকে ভুলিয়ে – ভালিয়ে চলে এসেছি। প্রায় ২ দিন ধরে ঘরে বন্দী ছিলাম। আমার মতো চঞ্চল প্রকৃতির মানুষদের ঘরে বন্দী থাকাটা অনেকটা শ্বাসরুদ্ধকর ব্যাপার!

ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেই অরিনের সাথে দেখা আমার! ওষ্ঠাধর কোণে হাসির শ্লেষাংশ মাখিয়ে কাছে এসে গমগম কন্ঠে বলল,

‘ হ্যান্ডসাম জামাই পেয়ে আমাকে ভুইলা গেছোস?’

অত্যান্ত বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমি বিরস গলায় বলি, ‘ চুপ কর! যত্তসব ফাউল কথাবার্তা। বাকি দু’জন কই?’

‘ নীরব, আদ্রাফ আজকে আসবে না। ওরা বাইক কিনছে জানস না? বাইক নিয়া গুলশানে গেছে। কি জানি কাজ আছে! কাজ আর কি? নিশ্চিত কারো সাথে লাগালাগি করতে গেছে! চল ক্লাসে যাই। ‘

ক্লাসের পথে যাওয়ার মধ্যে হটাৎ-ই অরিন থেমে গিয়ে বলল, ‘ এতো ভয় পাচ্ছিস কেনো?কিছু হইছে?’

‘ পূর্বকে না জানিয়ে এসেছি। আমার পায়ের ক্ষতটা তো অনেকটা ঠিক হয়ে গিয়েছে। তিনি আরো ক’দিন আসতে মানা করেছিলো। ‘

‘ ভালো করছস! পূর্ব স্যারের যেই রাগ। দেখিস, ‘

_______________

প্রথম ক্লাস শেষে বটতলায় বসে ছিলাম। পরবর্তী ক্লাস হবে দুই ঘন্টা পর! একবার মনে হলো চলে যাবো। পূর্বকে না বলে এসেছি এমনিতে নিশ্চয়ই সে প্রচন্ড রেগে। কিন্তু পরবর্তীতে আর যাওয়া হলো না। পূর্ব আসেনি এখনো হসপিটালে। সে সর্বদা ৭ টার মাঝেই উপস্থিত থাকে কিন্তু এখন ৯ টা বেজে ১০ মিনিট পূর্ব মানবের দেখা নেই! অরিন আমায় ভয় দেখাতে মাঝেমধ্যে খোঁচা দিচ্ছে পূর্ব এলে আমায় ইচ্ছে মতোন বকবে। আমি ওর কথা এড়িয়ে অন্য টপিকে মশগুল হলেও অন্তরালে যেনো বিন্দু ভয়ের রেশ রয়েই যায়!

১০ টা বাজতেই বটতলার সম্মুখে তীব্র রোদের আগমন ঘটে। সাথে মানুষেরও! তারজন্য সেখান থেকে চলে যেতে উদ্যক্ত হতেই ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে আগমনী বার্তা ছাপায় পূর্বের গাড়ি। পার্কিং লটে গাড়ি থামতেই পূর্ব নেমে পড়লেন! সঙ্গে সঙ্গেই তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমাতে এসে নিক্ষিপ্ত হয়! আমি খানিক ভড়কে সেই দৃষ্টি এড়াতে চারপাশে অবলোকন করি। পরমূর্হতে পূর্ব চলে যান! লম্বা শ্বাস টেনে অনত্রে যাওয়ার তাগিদে পা ফেলতেই এহসান এসে হাজির। হাসিমুখে সালাম দিয়ে বলল,

‘ ম্যাম! স্যার ডাকছেন। আর্জেন্ট যেতে বলেছে আপনাকে। ‘

তৎক্ষনাৎ আশপাশ হতে কিছু স্টুডেন্ট বিড়বিড় করে বলল, ‘ আহা..ভালোবাসা! ‘ আবার কেও কেও তো হিংসার অনলে জ্বলপুড়ে ক্ষুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। অরিন ইশারায় তাড়া দিলো জলদি যাওয়ার জন্য। শেষে আতংক কাটিয়ে পূর্বের চেম্বারের দিকেই যেতে হলো। মনে মনে দোয়া – দরুদের বাহার খুলে বসেছি যাতে পূর্ব মানবের কড়া কথাগুলো না শুনতে হয়।

দরজার সামনে গিয়ে দরজাটা হালকা খুলে নিয়ে মৃদু কন্ঠে বলি,

‘ স্যার আসবো?’

অপর পাশে নিশ্চুপতা! ঘোর নিস্তব্ধতা! কেও নেই নাকি? পূর্ব রাউন্ডে গিয়েছেন ভেবে যেই না দরজা হতে হাত সরিয়ে নিবো তৎক্ষনাৎ ভিতর হতে এক জোড়া বলিষ্ঠ হাত আমার হাতের কব্জি ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা টা এত দ্রুতই ঘটলো যে বুঝে ওঠার সময় নেই আসলে কি হয়েছে? হৃদপিন্ডের অস্বাভাবিক স্পন্দন নিয়ে বদ্ধ নেত্রযুগল উন্মুক্ত করতেই দেখা মিললো পূর্ব মানবের! ফর্সাটে মুখ তার রক্তিমতা ধারণ করেছে। চোয়াল শক্ত করে আমার দু’হাতের বাহু জোরে চেপে ধরে রুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।ভড়কে গিয়ে বলি,

‘ কি হয়েছে? এভাবে টেনে আনলেন কেনো? আপনার কেনো আইডিয়া আছে আমি কতটা ভয় পেয়েছি? এখন যদি হার্ট অ্যাটাক করে বসতাম তাহলে আমার মৃত্যুর দায়ভার কি আপনি নিতেন?’

খানিক রুষ্ট কন্ঠ আমার! কিন্তু পূর্বের মুখশ্রীর রাগান্বিত আভাসটা এতে কমলো না। বরঞ্চ আগের মতোই রইলো! তিনি আমার মুখশ্রীর দিকটাতে কিছু টা ঝুঁকে রুষ্ট কন্ঠে বললেন,

‘ আমাকে না জানিয়ে এখানে এসেছো কেনো?সাহস বেড়েছে? ‘

শুষ্ক গলদেশ সিক্ত রূপে প্রদানের প্রয়াসে ঢোক গিলে বলি, ‘ সাহস বাড়বে কেনো? যেমন ছিলো তেমনই তো আছে। ‘

পাশে থাকা শুভ্র রঙের দেয়ালে পূর্ব আমায় আলত করে চেপে ধরলেন এবার। রাশভারী কন্ঠে বললেন,

‘ একদম কথা ঘোরাবে না! আই ডোন্ট লাইক ইট! তোমাকে মেডিকেলে আসতে নিষেধ করেছিনা আমি? কথা কেনো শুনোনা? তার ওপর আবার আমায় না জানিয়ে চোরের মতোন পালিয়ে এসেছো! ‘

‘ চোরের মতো কই পালিয়ে আসলাম?মামনিকে বলে এসেছি তো। না জানিয়ে এসেছি কারণ আপনাকে বললে আপনি কখনোই আমায় আসতে দিতেন না। বাসায় থাকতে দমবন্ধ লাগছিলো। ‘

পূর্ব তার হাতের বাঁধন কোমল করলেন। কিন্তু হাত সরালেন না আমার বাহু হতে। পরিশেষে নম্র কন্ঠে বললেন,

‘ কে বলেছে আসতে দিতাম না? একবার বলেই দেখতে। তোমায় কষ্টে রাখার সাধ্য আমার নেই। ‘

মিনমিন সুরে বললাম, ‘ আচ্ছা সরি! আর এমন হবেনা। ‘

পূর্ব আমার থেকে অনেকটা দূরত্ব সৃষ্টি করলেন। পিছন গিয়ে রাশভারী কন্ঠে বললেন,

‘ এমন কিছু ভবিষ্যতে করবেনা যাতে তোমার ‘সরি’ ওয়ার্ড’টা ইউজ করতে হয়! গট ইট?’

‘ জি! ‘

‘ সকালে খেয়ে এসেছিলে?’

‘ খেয়ে আসিনি কিন্তু এখানে এসে খেয়েছি। ক্যান্টিনে! ‘

পূর্ব পিছনে তাকালেন। আমার পানে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, ‘ ক্যান্টিনের খাবার স্বাস্থ্যকর নয়! ফারদার যেনো আর এখান থেকে খেতে না দেখি। ‘

আমি ‘ আচ্ছা ‘ বলে চটজলদি বেড়িয়ে পড়ি তার চেম্বার থেকে। উফ! এই পূর্ব মানব পাশে থাকলে শ্বাস রুখে আসতে চায় কেনো? তার দৃষ্টি এতোটা ঘায়েল করা কেনো হয়? প্রতিবার তার নেত্রে দৃষ্টি দিলেই মনে হয় এই নেত্রযুগল আমায় সম্মোহন করতে চাচ্ছে। কিছু বলার জন্য আকুলতা প্রকাশ করছে। কিন্তু সেটা কি? তা আর বোধগম্য হয়না। পূর্ব অদ্ভুত! সাথে অদ্ভুত তার নজরকাড়া পারসোনালিটি!

________________________

ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে পাশের রাস্তা দিয়ে অরিনের সাথে হাঁটতে হাঁটতে টিএসসি এসে পড়ি! পূর্ব ফোন করে বলেছিলো এখানে আসতে। অরিন আমায় এখানে পৌঁছে দিয়েই চলে যায়। তার দুই, তিন মিনিট পর পূর্ব মানবের আগমন! গাড়ি সাইড করে রেখে আমার পাশে এসে বললেন,

‘ গাড়িতে উঠো ‘

বিনাবাক্যে গাড়ি উঠে পড়ার পর পূর্ব গাড়ি স্টার্ট দেন। তবে গাড়িটা বাসার দিকে না গিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে চলা শুরু করতেই আমি কৌতূহল নিয়ে বলি,

‘ বাসার রাস্তা তো ঐদিকে না? আমার এদিকে কোথায় যাচ্ছি? ‘

পূর্ব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, ‘ গেলেই দেখতে পাবে। ‘

মুখশ্রী কুঁচকে নিয়ে অন্যত্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি। বললে কি হতো? সবসময় ত্যাড়া উত্তর! ঘাড়ত্যাড়া লোকটা। হুহ্! পূর্ব এক নির্জন রাস্তা ধরে খোলামেলা এক পার্কে এসে গাড়ি থামালেন। জায়গাটা সুন্দর! পার্কের পাশে নদী তার চারদিকে সবুজ গাছপালার সমারোহ। আশপাশ মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে পূর্বের পানে দৃষ্টি দিতেই তিনি নেমে পড়লেন। অতঃপর হেঁটে আমার পাশে এসে গাড়ির দরজা খুলে ইশারায় বললেন আমায় নেমে পড়তে। আমি নামতেই তার প্রশ্ন,

‘ পায়ে কি ব্যাথা আছে?’

আমি ধীর কন্ঠে বলি, ‘ নাহ! ‘

‘ হাঁটতে পারবে?’

‘ জি পারবো। ‘

পূর্ব সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে নিরবে আমার একহাত কোমল ভাবে আঁকড়ে ধরে বললেন,

‘ তাহলে আসো! ‘

পার্কের ভিতরে প্রবেশ করে পূর্ব আমায় নদীর কাছে নিয়ে গেলেন। হাত ছেড়ে দিয়ে তিনি দু’কদম সামনে এগিয়ে গিয়ে ফিচেল কন্ঠে বললেন,

‘ এক্সাম সামনে তোমার! রিফ্রেশমেন্ট দরকার। তাই এখানে আনা। কিছুক্ষণ কাটাও এখানে ভালো লাগবে। চাইলে চারপাশ ঘুরে দেখতে পারো। তবে খেয়াল রেখো যেনো আঘাত না পাও! তোমার তো এক কদম চললেই হাত – পা কেটে বেহাল দশা তৈরি করো। কেয়ারলেস মেয়ে একটা! ‘

শেষোক্ত কথাটি ব্যাঙ্গ করে বললেন তিনি। আমি ফুঁসে উঠে বলি, ‘ আমি মোটেও কেয়ারলেস নই! আপনার চোখে প্রবলেম। আমি আমার নিজের প্রতি কতটা যত্নশীল তা আপনার চোখে পড়েনা। ‘

পূর্ব মনে হলো হাসলেন! উল্টোপিঠ হওয়াতে তা দেখা হলো না। তবে মিষ্টি হাসির সুর ঠিকই কানে এলো। ভাগ্যিস দেখতে পাইনি তার হাসি! নয়তো নিশ্চিত বেহায়ার মতো আর চোখ সরাতে পারতাম না। তার হাসিটা অন্যরকম! চমৎকার বেশ! নেশাতুর! দৃষ্টি রুখে দিতে পারে। ছেলেদের হাসিও যে এতোটা সুন্দর হয় তা পূর্ব মানবকে খেয়াল না করলে হয়তো জানতামই নাহ্!

কিয়ৎক্ষন পর পূর্ব এসে তাড়া দিয়ে বললেন,

‘ অনেক হেঁটেছো। পা ব্যাথা করবে! বাসায় চলো এখন। ‘

আমি খানিক আহ্লাদী কন্ঠে ঠোঁট উল্টে বলি,

‘ আরেকটু থাকি প্লিজ? জায়গাটা খুব সুন্দর। যেতে ইচ্ছে করছেনা। ‘

পূর্ব মৃদু হেঁসে বললেন, ‘ আর জাষ্ট পাঁচ মিনিট। এর পর বাসায় যাচ্ছি আমরা। ‘

‘ ওকে! আচ্ছা শুনুন, এই জায়গাটা খুব সুন্দর। বিয়ের ফাংশনের পর আমরা এখানেই থাকবো। আপনি এখানে চটপট একটা বাংলো তৈরি করে ফেলুন তো। আমার কথাই কিন্তু ফাইনাল! মামনি’সহ আমরা সবাই এখানে থাকবো। ‘

কথাটা সমাপ্ত হওয়ার পরই চুপ হয়ে যাই। কি বলেছি মনে করতেই লজ্জায় ক্রমশ চুপসে গেলাম।আঁড়চোখে পূর্বের পানে দৃষ্টি দিতে দৃশ্যমান হলো সে ঠোঁট বাকিয়ে হাসছে। কিয়ৎক্ষন পর বিড়বিড় করে বললেন,

‘ এজ ইউর উইশ! তুমি চাইলে আমি তোমায় মেঘের উল্টোপিঠেও সুন্দর এক বাংলো তৈরি করে দিবো ম্যাজিকালি! সেখানে থাকবো আমি, তুমি এবং আমাদের অজস্র প্রণয়ের অনুভূতি। ‘

.

গাড়িতে বসার পর মাঝরাস্তাতেই ঘুম কাবু করে আমায়। হিতাহিত জ্ঞান ফেলে পূর্বের কাঁধে মাথা এলিয়ে ঘুমে বিভোর হতেই অনুভব করি পূর্বের এক হাত আমার কাঁধ আঁকড়ে নিয়েছে। ক্ষনিক বাদে কপালে শীতল স্পর্শ অনুভূহ হয়! সেই শীতল, কোমল, আদুরে স্পর্শটা কিসের তা আর দেখতে ইচ্ছে হলোনা। তবে মনকোণে কৌতূহলেরা ভীড় জমালো ‘ এই আদুরে স্পর্শটার সৃষ্টি কোথা থেকে?’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here