#মায়াবন_বিহারিনী🖤
#পর্ব_৩১,৩২
#আফিয়া_আফরিন
৩১
ফাইনালি নীলা আর নিলয়ের বিয়ের দিন তারিখ ও ঠিক করা হলো। বেশি না, আর মাত্র এক মাস পরেই তাদের বিয়ে। আর সপ্তাহখানেক পর তাদের আকদের অনুষ্ঠান।
মায়া, ইমন, মিমো পনেরো দিন আগেই এ বাড়িতে চলে এসেছে, নীলার বায়নাতে। ও জুড়াজুড়ি করেই ওদেরকে নিয়ে এসেছে আজকে।
.
.
আজকের আকদের অনুষ্ঠানটাও সম্পূর্ণভাবে হলো, শুধু সম্পূর্ণভাবেই নয়, খুব ভালোভাবেই হলো। রাতের বেলা মায়া মিমো আর নীলা বেলকনিতে বসে গল্প করছিলো। চাঁদের আলোয় আচ্ছা অন্ধকারেও একেকজনকে স্পষ্ট দেখাচ্ছে।
ইমন অনুষ্ঠানের পর বাড়ি চলে গেছে। কাল হয়তো আসবে।
নীল আর বিয়ে উপলক্ষে তার গ্রামের বাসা থেকেও অনেকেই চলে এসেছে। ওরা যখন বসে গল্প করছিলো, নিলার দাদি তখন ওদের সাথে এসে বসলো।
দাদিকে দেখেই নীলা বায়না করে বললো, “দাদি একটা ভূতের গল্প শোনাও, প্লিজ!” নীলার সাথে মায়া আর মিমো ও সায় দিলো।
দাদি বললেন, “এই রাতের বেলা ভূতের গল্প শুনলে ভয় পাবি না?”
মায়া মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “একদম না বলোনা প্লিজ।”
দাদি হেসে বললেন, “এহ রে, নাত বউ যে আবদার করছে, ফালাই কি করে?”
মিমো উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “বাতি জালায়া দেই। ভয় লাগবে।”
দাদি বললেন, “তাহলে ভূতের গল্পের মজা কোথায়? বাতি অফ থাকুক। তোরা শুধু চুপচাপ বস।”
চারিদিকে শুনশান নীরবতা। ব্যাঙের ঘুঙর ঘুঙর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দাদি বলতে শুরু করলেন, “গল্পটা অনেক আগের। অবশ্য গল্প না, একটা সত্যি কাহিনী। তবে এটার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঘটনাটা ঘটে একটা মেয়েকে কেন্দ্র করে। মেয়েটির নাম ছিল অহনা। তোরা ব্লা’ডি মে’রি’র কাহিনী পড়েছিস না? কিছুটা সেই রকম। ওই মেয়েটার ভূত-প্রেতের দিকে প্রচুর আগ্রহ ছিল। প্লা’ন’চে’ট করতো প্রায়। একদিন একাই সিদ্ধান্ত নিল ব্লা’ডি মে’রি’র আ’ত্মা’কে ডাক দেবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রাত তিনটায় তিনবার চোখ বন্ধ করে ব্লা’ডি মে’রি’র নাম নিতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তাই করলো। পাশের ঘরেই তার মা-বাবা ঘুমানো। হালকা করে দরজাটা ভিজিয়ে দিয়ে লাইট অফ করে মোমবাতি নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নিজেকে দেখতে কেমন অ’শ’রী’রী লাগছে। মৃদুস্বরে তিনবার ব্লা’ডি মে’রি’র নাম উচ্চারণ করলো। তারপর চোখ খুললো, কই? কিছুই তো হল না।
অহনা শ্লে’ষে’র হাসি দিয়ে বসে পড়লো। তার ঠিক দশ মিনিট পর, উরো হাওয়া বইতে শুরু করলো। সে অ’তি’প্রা’কৃ’তি’র মত কাঁপছে। হঠাৎ করেই অজানা আতঙ্কে অহনার চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। কিছু না বোঝার আগে অহনার সারা শরীরে খি’চু’নি হতে থাকলো। সারা শরীর মচোড় দিতে থাকে। দেখে মনে হবে কেউ তার পলকা শরীরটা মুছরে দিচ্ছে। ভ’য়ং’ক’র যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে। পাশের রুমে ওর মা বাবার কানেও সে আ’র্ত’না’দ পৌঁছায়। তারা সাথে সাথে ছুটে এলো। এসে চোখে অন্ধকার দেখলো। সমস্ত শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো। ঘরটা ভ’য়ংক’র রকমের ঠান্ডা। অহনা থরথর করে কাঁপছে। বাবা এসেছে দেখেই অহনা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো ‘এসো না আব্বু, ও এসেছে।’
ঘরের মধ্যে মনে হয় প্রচন্ড তান্ডব চলছিলো। অহনার মা এসব দেখে জ্ঞান হারালেন। অহনার বাবা তাকে ধরে সোফায় নিয়ে বসালেন। আপাতত থাকুক এখানে, তার আদরের মেয়েটাকে আগে বাঁচাতে হবে। ঘরে কেউ নেই, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কেউ একজন আছে!
এমন সময় একটা বি’দ’ঘু’টে চাপা হাসির শব্দ শোনা গেলো। অহনা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ‘ও এসেছে আব্বু। আমিই ওকে আয়নার মধ্যে থেকে ডেকে নিয়ে এসেছি। আয়না ভেঙে ফেলো।’
মেয়ের কথা শুনে শফিক আর দেরি করলো না। এগিয়ে গেল আয়নার দিকে। ওমনি সামনে একটা জমাট বাঁধা অন্ধকার পথ আটকে দিলো।”
এতোটুকু বলে দাদি থামলেন। মায়া, নীলা, মিমো ভয়ে জড়াজড়ি করে বসে রইলো। এতক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ করে ছিলো।
দাদি বললেন, “আর শুনবি?”
“পুরোটা শেষ করো।”
“আচ্ছা। তারপর শফিক সাইড দিয়ে এগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। মেয়ের জীবনের কাছে কোনো কিছু পরোয়া করলো না। ড্রয়ারের উপর থেকে কাঁচের ফুলদানি টা নিয়ে স্বজোরে আয়নায় আঘাত করলো। সাথে সাথেই আয়নাটি ঝনঝন শব্দে ভে’ঙ্গে গেলো। জমাট বাঁধা অ’ন্ধ’কা’র থেকে চাপা আ’র্ত’না’দ স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছিলো। তার মিনিট দুয়েক পর সেটা মিলিয়ে গেলো।
ঠিক তখনই অহনা অস্ফুট স্বরে ‘আব্বু’ বলে ডাক দিলো। শফিক এগিয়ে এলো মেয়ের দিকে। কপালে হাত রাখলো। কপাল প্রচন্ড রকমের গরম। ততক্ষণে অহনা স্বাভাবিক ই ছিলো। কিন্ত, চোখ মুখে অদ্ভুত কিছু একটা ছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই অহনার মায়ের জ্ঞান ফিরে এলো এবং ঠিক ৪০ মিনিট পর অহনা ও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। ভয়ে সে হা’র্ট অ্যা’টা’ক করেছিলো সম্ভবত। এখন দেখ অহনার আ’ত্না তোদের আশেপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে কি না?”
বলেই দাদি নিঃশব্দে উঠে চলে গেলেন।
দাদির কথা শুনে মায়া, নিলা আর মিমো ভয়েতে আশেপাশে তাকালো। কি অন্ধকার চারিপাশ! দাদি চলে গেল ঠিকই। কিন্তু ওরা ওখানেই বসে রইলো। ওঠার সাহস অনেক আগেই চলে গেছে। উঠে যে বাতি জ্বালাবে সেই সাহসও নেই। দিনের আলো ফোটার আগে কোনো ওঠা ওঠা নেই। কানের কাছে বারবার শুধু একটা শব্দ বাজছে, ‘ঘরে কেউ নেই, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কেউ আছে!’
দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। মায়ার ঘুমটা ভেঙে গেলো, আগে আগেই। কাল রাতে কে কখন কিভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলো, নিজেরাও জানে না! ঘুম ভাঙতেই কাল রাতের ভূতের কথাটা মনে পড়ে গেল। মায়া নিজের মনে হাসলো কিছুক্ষণ। রাতের বেলা কি ভয়টাই না পেয়ে ছিল, এখন হাস্যকর মনে হচ্ছে! নীলা আর মিমো মেঝেতেই শুয়ে আছে। রাতের বেলা কেউ আর ওখান থেকে উঠার সাহস পায়নি। মায়া উঠে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে নীলা আর মিমোর মাথার নিচে বালিশ দিয়ে নিজেও এসে শুয়ে পড়লো। এখন ঘুম ধরতেছে, কিন্তু শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমটা উড়ে গেল। আবার মনে পড়ে গেল কাল রাতের কথা।
এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। হঠাৎ ফোনের আওয়াজে চমকে উঠল মায়া। ফোন হাতে নিয়ে দেখল ইমন ফোন করেছে।
মায়া ফোন রিসিভ করতেই ইমন বললো, “ঘুম আগেই ভাঙছে নাকি, ফোনের আওয়াজে ভাঙলো?”
“আগেই। কাল সারারাত তো ঘুমাতেই পারলাম না।”
“কেন? আমার শোকে?”
“হ্যাঁ গো। একদম। খুব করে তোমার শোক পালন করছিলাম। তুমি নাই, তোমায় ছাড়া ঘুম আসে বলো?”
ইমন হাসতে হাসতে বললো, “সত্যিই করে বল তো, কাহিনী কি?”
“আরেহ কাল রাতে দাদী একটা ভুতের গল্প শুনাইছিলো। ভয়ের ঠেলায় ঘুমাতেই পারিনাই।”
“ওহ তাই বল। দাদী ছোটো থাকতে আমাদের ও অনেক ভুতের গল্প শুনাতো, রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার মতো। গা ছমছমে টাইপের। আরেকটা শুনবি নাকি?”
“এই নাহ। একটা শুনেই ঘাম ছুটে গেছিলো।”
“তাহলে থাক।”
“আচ্ছা শুনো, তুমি আসবা না এখানে?”
“আসবো। তোকে নিতে। মা বলছিলো, তোকে নিয়ে আসতে। একা একা নাকি বাসায় ভালো লাগছে না।”
“ফুপি চলে এলেই তো পারে।”
“মা আবার তার সংসার ছেড়ে কোথাও থাকতে পারে না। আচ্ছা যাইহোক, তোর না আসতে ইচ্ছা হলে থাকতে পারিস। মজা কর, ইনজয় কর।”
“আরে আমি বলেছি নাকি আমি যাবোনা। আমি তো জাস্ট ফুপির আসার কথাটা বললাম। তুমিও না? বিয়ের তো এখনো ১৫\৬ দিন বাকি। আমিই এখানে থাকতে থাকতে বোর হয়ে গেছি। বাই দ্যা ওয়ে, কখন আসছো?”
“বিকালে বা সন্ধার পর আসবোনি।”
.
.
সন্ধার আগেই ইমন চলে এলো। শুধু মায়াকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। মায়া চলে যাবে শুনে, মিমো ও বায়না ধরলো। অগত্যা ইমন দুজন কে নিয়ে ই ফিরে এলো।
.
.
.
সন্ধা থেকে আকাশ মেঘলা ছিলো। রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো। আশেপাশের কিছুই ঠিকভাবে দেখা যাচ্ছে না। তার উপর রাতের অন্ধকার। যদিও রাস্তায় সোডিয়াম বাতি জ্বলছে। তবুও ঝাপসা। বৃষ্টি পড়া দেখতে ভালোই লাগছে। মায়া খাটের উপর বসে জানালার দেওয়ালে হেলান দিয়ে বৃষ্টি পড়া দেখছিলো। ইমন পাশেই হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। বৃষ্টির কারণে আজ আর বাহিরে যেতে পারে নাই।
ইমন এগিয়ে গিয়ে মায়ার হাতের উপর নিজের হাত টা রাখলো। মায়া চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিয়ে বড়ো বড়ো চোখে ইমনের দিকে তাকালো। ইমন বেশ অবাক হলো।
“কি হলো? এমন করার কি আছে? আমি কি ভুত? নাকি আমার হাতে কারেন্টের শক দেওয়া আছে।”
“আরেহ, হঠাৎ হাত ধরলে, তাই ভয় পাইছিলাম।”
“বৃষ্টির ছিটা গায়ে আসছে তো। ভিজে যাচ্ছিস না? জানালা বন্ধ করে এইদিকে উঠে আয়।”
মায়া আর না করলো না। ইমনের কথামতো চলে এলো।
ইমন হ্যাচকা টানে মায়া কে বুকের মধ্যে নিয়ে এলো। গায়ে হাত রাখতেই বললো, “বৃষ্টির মধ্যে বসে থেকে একদম ভিজে গেছিস। যা গিয়ে কাপড় বদলে আয়।”
“লাগবে না থাক।”
বলেই ইমন মায়া কে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
মায়া তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “মতলব কি তোমার?”
ইমন মায়ার চোখে চোখ রেখে বলল, “তোকে ভালোবাসার সম্মোহনে, সম্মোহিত করার মতলব এঁটেছি!”
মায়া হেসে ইমনের বুকে মুখ লুকালো।
.
.
এমনি করেই দিন কাটতে কাটতে নীলার গায়ে হলুদের দিনটাও অতি শীঘ্রই চলে এলো। ওদের বাড়ির ছাদে প্যান্ডেল টানানো হয়েছে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটা ওখানেই করা হবে। সবাই ম্যাচিং করে শাড়ি পড়েছে, পাতা এবং গাড় হলুদ রংয়ের।
গায়ে হলুদ শেষে সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে। মোটামুটি সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ। ভাবতেই কেমন অবাক লাগছে ‘কাল নীলার বিয়ে!’
.
.
.
.
চলবে…..
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ]
#মায়াবন_বিহারিনী🖤
#পর্ব_৩২
#আফিয়া_আফরিন
আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা চলছে। নীলার বিয়ে উপলক্ষে সবাই কমিউনিটি সেন্টারে পৌছে গেছে। এখনো বাসায় কয়েকজন বাকি রয়েছে। ভাগে ভাগে সাজগোজ কমপ্লিট করছে সবাই। নীলাকে সেই বেলায় পার্লারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওরা মাএই কমিউনিটি সেন্টার এ পৌঁছালো। বাসায় ইমন, মায়া, মিমো আর ও কয়েকজন কাজিন আছে।
মায়া রেডি হচ্ছিল। এমন সময় বলা নেই, কওয়া নেই; ইমন হুট করে কোথা থেকে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
“এখন তুমি কি কাজে এসেছো, এখানে?”
“খুন করে দেওয়া মিষ্টি ঠোঁটের হাসি দেখতে এলাম।”
মায়া কিঞ্চিত লজ্জা পেয়ে বললো, “ইশশশ, যাও। আমি রেডি হচ্ছি এখন, একদম বিরক্ত করবা না।”
মায়ার সাজগোজ প্রায় শেষ হয়েই গেছিল। শেষ মুহূর্তে শুধু ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়া বাকি ছিলো। এমন ওর হাত থেকে লিপস্টিক টা নিয়ে বলল, “এটা আমি দিয়ে দেই।”
মায়া কড়া চোখে তাকিয়ে বললো, “দিতে পারবে? পুরো মুখ মাখাবে না তো?”
“যাহ। আমার উপর এই সামান্য বিশ্বাস টুকু নাই তোর?”
মায়া ইমনের গলা জড়িয়ে ধরে হেসে বলল, “আছেই তো। শুধুমাত্র তোমার হাতের উপর বিশ্বাস নাই। আচ্ছা যাই হোক, দেরি না করে লাগিয়ে দাও।”
ইমন খুব যত্ন করে লিপস্টিক দিয়ে দিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ঠোঁটের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল। মায়া হেসে উল্টো দিক ফিরে বলল, “ওয়াও! আমাকে দেখতে বাঁদরের মতো লাগতেছে। এভাবেই চলে যাই কেমন?”
ইমন ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ফাজলামি করিস না। মুছে নে।”
মায়া ঠোঁটের আশপাশ থেকে লিপস্টিক মুছে, চুল ঠিক করছিল। এমন সময় ইমন ওকে সামনের দিকে ঘোরালো।
ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলল, “চুমু খেলে তো লিপস্টিক নষ্ট হয়ে যাবে, তাই না?”
মায়া সরে গিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল। ইমন হাসতে হাসতে বলল, “থাক থাক। ওভাবে পালাতে হবে না। আমি কিছু করছি না, আপাতত। এইটা পরের জন্য তোলা থাক।”
মায়া দৃঢ় কন্ঠে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ। এখন যাও তো তুমি প্লিজ। আমায় খুব বিরক্ত করছো কিন্তু। এবার পৌঁছাতে পৌঁছাতেই দেরি হয়ে যাবে। দেখো, শেষমেষ আমাদের ছাড়াই বিয়েটা হয়ে গেল।”
ইমন বললো, “আচ্ছা তাড়াতাড়ি কর। আমি বাইরে আছি।”
কিছুক্ষণ বাদে মিমো এলো, ‘মায়া আপু’, ‘মায়া আপু’করে ডাকতে ডাকতে। মায়াকে দেখেই চমকালো। কিছুক্ষণ তো চোখের পলক ই পড়ছিল না। মায়া গিয়ে ওর চোখের সামনে হাত নাড়া দিয়ে বলল, “কিরে? ওরকম ভ্যাবলার মত চেয়ে আছিস কোন দুঃখে?”
মিমো মায়ার দু কাঁধে হাত রেখে বলল, “জাস্ট ওয়াও আপু! কি জন্য লাগতেছে তোমায়! ইশশশ, একদম আ’গু’ন সুন্দরী। দেখো, আমার একটা মাত্র ভাই যেন আবার এই আ’গু’নে পুড়ে না যায়!”
“ধুরু মেয়ে, তোর শুধু বাজে কথা। তো কেও কি কম সুন্দর লাগছে নাকি?”
“লাগুক। কিন্তু এই পাতা কালার শাড়িতে তোমাকে অন্যরকম লাগছে। দাঁড়াও, ভাইয়াকে ডাক। সে ও তার বউয়ের এই আগুন ঝরা রূপ দেখুক।”
“উফ মিমো, মাইর খাবি কিন্তু।”
“দুটো মাইর খাইতে হলে খাব। আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ভাইয়াকে যে ডাকতেই হবে।”
বলেই মিমো দৌড়ে চলে গেল।
.
.
ইমন মায়া কি দেখে, কিছুক্ষণ চোখের পলক না ফেলেই তাকিয়ে ছিল। এইমাত্র তো তাকে দেখেছি, তখন তো এতটা সুন্দর লাগে নাই? তবে সৌন্দর্য কি ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়! কে জানে, হয়তোবা!
ইমনের এরকম ড্যাবড্যাবে চাহনিতে মায়া লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিল। সঙের মতো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে কেমন অস্বস্তি লাগছে।
তাই ইমনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “কি হচ্ছে কি? দেরি হয়ে যাবে না আমাদের? পরেও তো দেখার অনেক সুযোগ পাবা। এখনই একেবারে চোখ দিয়ে গি’লে খাচ্ছে!”
ইমন হাসলো। মায়ার দুই চোখে, গালে, কপালে আলতো করে চুমু খেলো।
তারপর যন্ত্রের মতো বলল, “চল। বাহিরে সবাই ওয়েট করছে।”
.
.
ওরা যখন কমিউনিটি সেন্টারে এসে পৌঁছালো, তখনো বরপক্ষ এসে পৌঁছায় নাই। সবাই মিলে হই হই করছে, মজা করছে। সেই সময় বরপক্ষের সবাই চলে এল। শুরু হলো গেট ধরা। মায়া অবশ্য এসবের মধ্যে ছিল না। সে সর্বক্ষণ নীলার আশেপাশেই ছিল। আজকে নীলা কেউ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। বিশেষ করে তার চোখে মুখে এক ধরনের প্রশান্তির হাসি বিরাজ করছে। সেই হাসিটাই চেহারায় শুভ্রতা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
রাত ঠিক নয়টা দশ মিনিটে সুষ্ঠুভাবে নীলা এবং নিলয়ের বিয়েটা হয়েই গেল। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে সবাই নিউ কাপলকে অভিনন্দন জানালো। তারপর একেবারে বিদায়-পর্ব শেষ করে, যে যার বাড়ি ফিরে এলো।
বিয়ে বাড়িতে সারাদিনে প্রচুর ক্লান্তি গেছে। সারা শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে। মায়া শুয়ে পড়েছিল। ইমনও অনেকক্ষণ আগেই শুয়ে পড়েছে। মায়া ভেবেছিল, ও হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু না, মায়াকে ভুল প্রমাণিত করে টুক করে চোখ খুলে উঠে বসলো।
বলল, “দেখলি, এই নীলার জন্য আমাদের বিয়েটা যেরকম সেরকম ভাবে হয়ে গেল। আর ওর বেলায়? এসব কি কখনো মানা যায়? আমি কখনোই এসব মানবো না।”
“আজব? বিয়ে করলো ওরা, সংসার করে খাবে ওরা। তুমি মাঝখান থেকে না মানার কে?”
“কেউ হই বা না হই, কিন্তু আমি মানিনা। ঘোরতর অ’ন্যা’য়! আচ্ছা, চল আমরাও আরেকবার বিয়েটা করে ফেলি।”
“আহা, আহ্লাদের যেন আর শেষ নেই। শখ কতো? আরেকবার বিয়ে করবেন উনি!”
“আরে, অন্য কাউকে নাকি? তোকেই তো।”
“দরকার নাই। পারলে অন্য কাউকেই বিয়ে করো। আমি এসবের মধ্যে নাই। রেহাই পাবো একটু।”
ইমন ভুরু নাচিয়ে বলল, “সিরিয়াসলি? আবার আরেকটা বিয়ে করবো? আচ্ছা, পাত্রী খোঁজার দায়িত্বটা তোকে দিলাম।”
“হুহ ঢং! আমাকে কেন দিতে হবে? নিজ দায়িত্বে খুঁজে নিতে পারো না? তোমাদের ভার্সিটিতে কি অভাব আছে নাকি?” গাল ফুলিয়ে বলল মায়া।
ইমন হাসতে হাসতে ওর হাত ধরে বলল, “পাগলী একটা!”
“এই কি বললে? আমি পাগলী?”
“হ্যাঁ অবশ্যই। পাগলী ই তো, শুধুমাত্র আমার। আপাতদৃষ্টিতে পাগলীদের মতো জটলা রুক্ষ চুল না থাকলেও, আমাকে পাগল করে দেওয়ার জন্য লম্বা, ঘন, কালো, ঘ্রাণে মাতোয়ারা চুল তো আছেই।”
মায়া বাকা হেসে ইমনের দিকে তাকালো। তা দেখে ইমন ফের বলল, “এমন বক্র চোখের চাহনি দিও না, জান! একদম বুকের বা পাশে লাগে তো!”
মায়া উল্টো দিক ঘুরে মুখে হাত চেপে হেসে ফেলল।
ইমন মায়ার এক হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে এলো। বলল, “সকালের তোলা জিনিসটা ফেরত পাব কখন? আমার জিনিসটা আমার এখনই ফেরত চাই।”
“হুহ। যত পাই, তত চাই; তাই না? এত শখ কেন, হুমম? রাক্ষস কোথাকার, যতই দেই মন ভরে না একদম!”
“আসলেই মন ভরে না।”
“যাও ভাগো। আহ্লাদের সময় নেই। চুপচাপ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কাল তো সারারাত ঘুম হয়নি। আড্ডা দিতে দিতে সময় শেষ হয়ে গেছে। ঘুম নাই তোমার? যাও।”
মায়া ধমকে বলল।
এমন কোন কথা না বলে বাধ্য ছেলের মত শুয়ে পড়লো। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে ও পড়ল।
.
.
.
.
জীবনটা নদীর স্রোতের মতোই বহমান। স্রোত যেমন কারো জন্য অপেক্ষা না করে নিজ গতিতে এগিয়ে চলে, জীবনও ঠিক তেমনি। কখনো অনুকূল তো কখনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। ইমন আর মায়ার জীবনেও মাস ছয়েক পেরিয়ে গেল এভাবেই। সেদিন মহুয়ার কথা মাথায় রেখে দুজনে সামনে এগিয়ে চলছে। ঝগড়া, মান অভিমান তো হবেই, সেটা কে খুব সন্তর্পণে কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়।
যতই দিন যাচ্ছে, দুজনের ভালোবাসার সম্পর্কটা গভীর থেকে গভীর হয়ে উঠছে। এতো ভালোবাসা, এতো ভালোবাসা, যে মাঝে মাঝে নিজেদেরকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়।
.
.
.
অনেকদিন পর আবার ইমন আজ রাতেও ফিরতে দেরি করছে। বারোটা বেজে পার হয়ে গেছে, কিন্তু ফেরার কোন নামগন্ধ নেই। এই কয়েকদিন তো ঠিকই চলছিল। আজ আবার কি হলো?
মায়া ফোন করলো ইমনকে। ইমন প্রথমবার রিসিভ করল না, কেটে দিল। দ্বিতীয় বার, তৃতীয়বার ও কেটে দিল। মায়া এবার চিন্তায় পড়ে গেল। দরজা খুলে বাহিরে এসে দাঁড়ালো। মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে থেকে আবার ঘরে এলো। তখনই দরজা খোলার আওয়াজ এ পিছন ফিরে দেখে, ইমন আসছে।
মায়া ইমনকে দেখে কোমরে হাত দিয়ে বলল, “কই ছিলে? এত দেরি হল কেন ফিরতে? কার সাথে কোথায় গিয়েছিলে?”
“আরে আরে! এত প্রশ্ন করলে উত্তর দিব কোনটার?”
“কোথায় ছিলে এতক্ষন?”
“বন্ধুদের সাথে ক্লাবে ছিলাম।”
মায়া সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “সত্যি তো?”
“কেন, অবিশ্বাস হচ্ছে?”
“ছেলেমানুষ দিয়ে বিশ্বাস নেই তো হতেও পারে, কত কিছু!”
“লে হালুয়া! মাথা আউলা ঝাউলা হয়ে গেছে নাকি? কি বলতে কি বলছিস, বুঝতে পারছিস?”
“এই চুপ থাকো তো। আজকে ভীষণ রেগে আছি আমি। একদম কথা বলতে আসবে না। যাও, বন্ধুদের সাথে গিয়ে বসে থাকো। আসতে কে বলেছে তোমাকে?”
“আমার বউ আমাকে আসতে বলেছে। আমার বউ আমার আসার অপেক্ষায় দরজা পর্যন্ত খুলে রেখে দিয়েছে। দেখেছো, কত ভালোবাসে আমাকে আমার বউ।”
“খবরদার, ভাব জমানোর চেষ্টা করবে না। আমার কিন্তু ভীষণ রাগ লাগছে।”
মায়া এত দিনের রাগ আজকে জমিয়েছে। এখন ইমনের উপর রাগ ঝারার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।
ইমন অবাক বিষ্ময়ে লক্ষ্য করলো মায়ার মুখের দিকে। মুখে বলছে, ও রাগ করে আছে; উল্টো দিকে মুখটাই আবার হাসি হাসি।
মায়ার হাসি হাসি মুখ দেখে ইমন একটু প্রশ্রয় পেয়ে গেল। সামনে এগিয়ে এসে মায়ার গালে নিজের এক হাত রাখল।
ভাইয়া এখন হুট করে হেসে নিজের পজিশন টা নষ্ট করতে চায়না, তাই ইমনের হাতটা নামিয়ে দিয়ে বজ্র কন্ঠে বলল, “কি মতলব আটঁছো তুমি? এসব করে আজ আর আমায় গলানো যাবে না। ভীষণ রেগে আছে তোমার উপর। আজকে যদি খবরদার উল্টাপাল্টা কিছু করো, রক্ষে নেই। এই বলে দিলাম।”
তখন ইমনের মাথায় এক দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। মূলত মায়ার ধমকেই বুদ্ধিটা মাথায় এসেছে।
আচমকা মায়ার এই ছেলেমানুষি অভিমান ভাঙ্গাতে, ইমন ওকে কোলে তুলে নিয়ে কপালে আলতো করে ভালবাসার মিষ্টি ছোঁয়া এঁকে দিল।
মায়া হাসতে না চেয়েও, ফিক করে হেসে দিল। তারপর ইমনের গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো।
হঠাৎ করে জীবনটাকে ভীষণ সুন্দর মনে হতে লাগলো। আসলেই তো, জীবনটা কত সুন্দর!
.
.
.
.
চলবে…..
|আগামীকাল থেকে গল্পের নতুন মোড় শুরু হচ্ছে|
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]