#ভুলে_থাকা_গল্প
#পর্ব_১
#লেখা__ইয়ানা_রহমান
একই সোসাইটিতে দুই বিল্ডিংয়ে দুজনের বাস। মেয়েটির নাম প্রিয়া আহমেদ আর ছেলেটির নাম ইমন চৌধুরী।
ইমন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স ভর্তি হয়েছে। আর প্রিয়া হলিক্রস কলেজে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।
ইমনরা দুই ভাই। ওদের বাবা মা অনেক আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। ইমন আর ওর বড় ভাইয়ের বয়সের তফাৎ অনেক প্রায় এগার বছরের ছোট বড়। ইমনের বড় ভাই বিজনেস করে, নাম লিমন চৌধুরী আর ওর ভাবি কলেজ টিচার। নাম লিজা চৌধুরী। ইমন ভাই ভাবির সাথেই থাকে। তাদের কোন ছেলে পুলে নেই। ইমনকে তারা তাদের ছেলের মতই মনে করে। খুব ভালোবাসে ওকে।
প্রিয়া বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। প্রিয়ার বাবা একটা প্রাইভেট ব্যাংকের ম্যানেজার। নাম রায়হান আহমেদ।মা ডক্টর, নাম জোবায়দা আহমেদ। দাদা নেই, দাদী আছে। দাদীর নাম জমিলা খাতুন। দাদী ওদের সাথেই থাকে। দাদী অন্য ছেলেদের কাছে থাকতে কমফোর্ট ফিল করে না, তাই সে প্রিয়াদের সাথেই বেশি থাকে। আর প্রিয়া তার বড় নাতনী ওর প্রতি তার টান ও বেশি। প্রিয়া নিজেও দাদীকে খুব ভালোবাসে। সে নিজেও চায় দাদী সারাবছর তাদের বাসায়ই থাকুক।
নভেম্বরের দিকে শীতের শুরু। হালকা হিমেল হওয়া বইতে শুরু করেছে। শীতের কাপড় গায়ে পড়তে না হলেও ঠান্ডা হাওয়া শীতের আগমনী বার্তা জানিয়ে দিচ্ছে। এই সময় গ্রামগঞ্জে মাঠে, শহরের রাস্তায়, খোলা জায়গায় ব্যাডমিন্টন খেলতে দেখা যায় ছোট বড় অনেককে।
নিজেদের বাসার সামনে দুই দিকে দুটো ব্যাডমিন্টন কোট কাটা হয়েছে। একটা কোটে ছেলেরা অন্যটাতে মেয়েরা ব্যাডমিন্টন খেলবে বলে। চাঁদা তুলে যার যার কোট তারা লাইটিং করে আনুসঙ্গিক সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করে নিয়েছে।
মেয়েদের কোটে বিল্ডিংয়ের চারজন মেয়ে মিলে ব্যাডমিন্টন খেলছিল। সাইডে বসে অনেকেই খেলা দেখছে। একদল আউট হলেই অন্য কেউ ঢুকবে।
কয়েকদিন যাবত খেলা চলছে। ভালোই লাগছে। সবাই ট্র্যাক স্যুট পড়ে খেলছে।
ছেলেদের গ্রুপে খেলায় সবসময় লিড দেয় ইমন। ইমনকে ছাড়া যেনো খেলা একেবারেই জমে না। ইয়ানার গল্প পড়তে প্রিয় গল্প কুটিরে যোগ দিন।শুধু খেলা কেনো এলাকার কোন গ্যঞ্জামেও ইমনকে ডাকা হয় সবার আগে। ইমনকে দিয়ে সব গা/ন্ডুদের পি/টি/য়ে সাইজ করা হয়। এলাকায় কারো কোন ধরনের মাস্তানী করা চলবে না। মোটামুটি ভালই সমাজ সেবাও করে ইমন আর ওর বন্ধুরা। রাতবিরেতে কেউ অসুস্থ হলে হসপিটালে পৌঁছে দেয়া, কেউ মা/রা গেলে রাতভর লা/শ পাহারা দেয়া, লা/শের দাফন কাফনের ব্যবস্থা করা, কোন গরীব বাবার মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা সংগ্রহ করে দেয়া ইত্যাদি।
ইমনরা প্রতিদিন তাদের কোটে খেলে। ইমন খুব ভালো খেলে। ইমনকে হারানো ইম্পসিবল।
মেয়েরা মেয়েদের কোটে খেলে কিন্তু চাঁদা দিয়েও প্রিয়া কোনদিন খেলায় অংশ নেয়নি। ও একটু লাজুক প্রকৃতির মেয়ে। নিজেকে নিজের মধ্যেই গুটিয়ে রাখে। কলেজ টাইমের পর সেই যে বাসায় ঢোকে আর বের হয় না। সারাক্ষণ নিজেকে পড়ায় ডুবিয়ে রাখে।
ওর বান্ধবীরা ওকে জোর করে বাসা থেকে বের করে আনে খেলার জন্য। কিন্তু ও খেলে না বসে ওদের খেলা দেখছে।
ইমনের হঠাৎ নজর পরে প্রিয়ার দিকে। মনে মনে ভাবে এই সুইট পুতুলটা আবার কে? কোথায় থাকে? আগে তো কখনো দেখিনি! মেয়েটি কি আমাদের সোসাইটিতেই থাকে নাকি কারো বাসায় বেড়াতে এসেছে? আর এলেও কাদের বাসায় এসেছে। ওর যেনো প্রিয়ার দিক থেকে দৃষ্টি সরছেই না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল মেয়েটির দিকে।
ওর এই তাকিয়ে থাকতেই প্রথমবারের মত আজ খেলায় হেরে গেলো। কারণ খেলায় ওর মনোযোগ ছিলো না, ওর মনোযোগ ছিলো ওই মেয়েটির ওপর।
প্রিয়াকে ওর বান্ধবী নীপা জোর করে খেলতে নামালো। ওর হাতে রেকেট ধরিয়ে দিলো। (কিছুতেই র্যাকেট বানানটা আমার কি বোর্ডে আনতে পারছি না তাই রেকেট লিখতে হলো স্যরি)
প্রিয়া বাধ্য হয়ে খেলতে নামলো। না খেললে ওরা সবাই ভাববে আমি বুঝি ব্যাডমিন্টন খেলা জানি না। তাই আর কি করা খেলতে শুরু করলাম। প্রথম প্রথম একটু সংকোচ হচ্ছিলো। কিছুক্ষণ যেতেই খেলা দারুন জমে উঠলো।
ভালোই লাগছে ডানে বামে হেলে কিছুটা ওপরে লাফিয়ে শাটল কর্ক বা ফেদারে বারি মেরে নেটের ওপর প্রান্তে ফেদার পাঠিয়ে খুব মজা করে খেলছে প্রিয়া।
এদিকে প্রিয়া জানতেই পারলো না কেউ ওকে পলকহীন চোখে দেখে চলেছে। তার অন্য কোন দিকে হুশ নেই।
হাই ওয়াটের তীব্র আলোর বাল্বে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মেয়েটার রূপ লাবণ্য। স্বাভাবিক উচ্চতা, ফর্সা গায়ের রং, পুতুলের মত মিষ্টি চেহারা, পটল চেরা চোখ, বাঁকানো ভ্রু, কোমর অব্দি ঘন কালো চুলে একটা বেণী করা। মেয়েটি ট্র্যাক স্যুট পড়ে নি। সে সালোয়ার কামিজ পরেই খেলছে। কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে গিঠ দিয়ে নিয়েছে।
ঘর্মাক্ত ফর্সা গলায় লকেট সহ চিকন একটি স্বর্ণের চেইন চকচক করছে। এতে মেয়েটিকে আরো মোহনীয় লাগছে।
ইমনের এক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতে আর কেউ লক্ষ্য না করলেও ইমনের সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড রাশেদ ঠিকই খেয়াল করেছে। রাশেদ আর ইমন একই সাথে পড়াশুনা করে। একই ভার্সিটিতে।
ওর পাশে বসে বললো, মামা ওই দিকে কি দেহ এমন কইরা? মাইয়াগো দিকে দেহনের মানুষ তো তুমি না? কারে দেইখ্যা আজকে খেলায় হারলা। এতো দিনের ইমেজ খুয়াইলা, কইয়ালাও। আর লুকাইয়া লাভ নাই মামা।
ঝাইরা কাশো দেহি এইবার। বলেই একটা বাকা হাসি দিলো রাশেদ।
ইমন বললো, ঐযে সালোয়ার কামিজ পরে মেয়েটি খেলছে ও কেরে? চিনিস নাকি মেয়েটিকে? মেয়েটি কি এখানেই থাকে নাকি কারো বাসায় বেড়াতে এসেছে? আগে তো কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
অনেকক্ষণ ভালোভাবে দেখে রাশেদ বললো, আমিও ঠিক চিনতে পারছি না দোস্ত। আগে কখনো এই মেয়েকে আমাদের সোসাইটিতে দেখিনি। নতুন এসেছে বোধয়।
তোর গার্ল ফ্রেন্ড তো আছে ওই গ্রুপে, খবর লাগা তো, জেনে আমাকে বলবি। নাম ধাম সব বলবি।
হুম আমি নীপার কাছে থেকে জেনে তোকে বলবো, টেনশন নিস না। আমার তো মনে হচ্ছে প্রথম দেখাতেই তুই মেয়েটির প্রেমে পরে গেছিস।
আরে ধুর কি যে বলিস, ওর সম্পর্কে কিছুই জানি না চিনি না, প্রেম কি এতই সহজ নাকি?
মেয়েটি কারো বউ হতে পারে, কারো বাগদত্তা হতে পারে। অথবা কারো সাথে এনগেজড ও তো হতে পারে।
আগে তুই সব খবর এনে দে। তারপর দেখা যাক।
রাশেদ হেসে ইমনের পিঠে একটা চাপড় মেরে বললো ওকে দোস্ত কালকের মধ্যেই খবর জোগাড় করে দিবো।
প্রিয়াকে সোসাইটির অনেকেই তেমন করে চিনে না কারণ ওর কলেজ মর্নিং শিফট। তাই ওকে অনেক ভোরে বেরিয়ে যেতে হয়। মায়ের গাড়িতে কলেজে যায় প্রিয়া। ওকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে এলে গাড়ি নিয়ে ওর মা হসপিটালে যায়। রায়হান সাহেব অফিসে যায় তার অফিসের গাড়িতে। আবার দুপুর আড়াইটায় প্রিয়ার কলেজ ছুটি হয় তখন ওকে কলেজ থেকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গাড়ি আবার হসপিটালে চলে যায়।
বাসায় ফিরেই প্রিয়া ঘর বন্দী হয় তাই ওকে তেমন করে কেউ চিনে না। সোসাইটির দুই চারজন বান্ধবীর সাথে ওর মেলামেশা।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে রাশেদ নীপাকে কল করে নিজেদের প্রেমালাপ করতে করতে এক ফাঁকে ওই অজানা মেয়েটির কথা জানতে চাইলো।
নীপা আজকে তোমাদের সাথে সুন্দর একটা মেয়ে খেলছিলো না, সেই মেয়েটি কে? কি নাম ওর, কোথায় থাকে বলতো একটু।
নীপা তো রেগে আগুন হয়ে গেলো। ওই মেয়ের খবর দিয়ে তুমি কি করবে? ও বুঝেছি আমি এখন পুরনো হয়ে গেছি তাই না? তাই এখন নতুন করে গার্লফ্রেন্ড খুজছো!? নীপা কেঁদেই ফেললো।
তুই আর আমার সাথে কথা বলবি না বদ/মাইশ। তোর চোখ খারাপ। তোর চরিত্র খারাপ। তুই নিজেও মানুষ হিসেবে খারাপ। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে।
রাশেদ বোঝানোর অনেক চেষ্টা করছে যে আমার এক বন্ধু ওর সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে কিন্তু নীপা বুঝতেই চাচ্ছে না।
তোর সাথে আমার আর কোন কথা নেই। তুই আমাকে আর কল দিবি না বলে দিলাম। তোর সাথে আমার ব্রেকআপ।
নীপা রেগে ফোন কেটে দিলো।
রাশেদের তো এদিকে প্রাণ যায় যায়। হায় হায় এখন আমার কি হবে বন্ধুর উপকার করতে গিয়ে নিজের গফ যে ব্রেকআপ করলো। নিজেই নিজের মাথার চুল ছিরছে এখন।
এই মেয়েটাও না পুরোটা না শুনেই রেগে গেলো।
প্রেমের গুষ্ঠি কি/লাই। আগে জানলে কোনদিন প্রেম করতাম না। জীবনটা ঝালা পালা হয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পর সবটা লিখে নীপাকে মেসেজ করলো। বললো তুমি হুদাই আমারে ভুল বোঝ। আমি একমাত্র তোমারেই পেয়ার করি, সে কথা তুমি ভালো করেই জানো। তবুও আমারে প্রেশারে রাখনের লাইগা আজাইরা ঝগড়া করো। আমারে ছাইড়া যদি তুমি ভালো থাকতে পারো তাইলে ভালো। আমিও আর তোমারে কোনদিন কল দিমু না। আমিও তোমার সাথে ব্রেকআপ করলাম।
এমন হাস্যকর ব্রেকআপ প্রতি মাসেই হয় ওদের।
মেসেজ পড়ে সাথে সাথেই নীপার কল এলো,
কিন্তু রাশেদ ইচ্ছে করেই কল রিসিভ করলো না। সব সময় শুধু সন্দেহ আর শাসন। এবার বুঝুক কেমন লাগে। ওর একটু বোঝার দরকার আছে। আমাকে গাধা পেয়েছে আরকি।
রাশেদ আরামে সাইড বালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো।
আর এদিকে নীপা থেমে থেমে কল করেই যাচ্ছে। সে তো রাশেদকে অনেক ভালোবাসে। রাশেদকে হারানোর কথা কল্পনাতেও ভাবতে পারে না। তাই তো একটুতেই সন্দেহ করে বসে। মেয়েটা কাদঁছে আর কল করছে। কল করতে করতে ফোনের চার্জ শেষ হয়ে ফোন বন্ধ হয়ে গেছে তাও টের পায়নি।
সকাল নয়টায় ঘুম ভাঙ্গলো রাশেদের। অভ্যাস মত চোখ খুলেই ফোন হাতে নিলো, দেখলো নীপার একশ ছাপ্পান্ন টা মিস কল উঠে আছে।
হায় আল্লাহ এ আমি কি করলাম, তার মানে নীপা সারা রাত না ঘুমিয়ে তাকে কল করে গেছে।
সাথে সাথে নীপার নাম্বারে কল করলো। নীপার ফোন বন্ধ। রাশেদ ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো আর সুযোগ পেলে নীপার একটা খোঁজ নিবে ভাবলো।
চলবে…..