ভুলে_থাকা_গল্প,১২,১৩

#ভুলে_থাকা_গল্প,১২,১৩
#লেখিকা_ইয়ানা_রহমান
#পর্ব_১২

বছরের পর বছর পেরিয়ে গেছে প্রিয়ার প্রতি যেই রাগ নিয়ে সে অস্ট্রেলিয়া গেলো সেই রাগের ধরন ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে থাকে। নিজেই নিজেকে বদরাগী, রগচটা, গম্ভীর করে তোলে। মনের মধ্যে কাঠিন্য এসে বাসা বাঁধে। নিজের চারপাশে একটা শক্ত প্রাচীর তুলে দিয়েছে। সেখানে ভালোবাসা নামক কোন জিনিসের অস্তিত্ব সে রাখেনি। মনটাকে করেছে পাথর। প্রিয়াকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট, মা বাবার মত ভাই ভাবিকে ছেড়ে আসার যন্ত্রণা, নিজের দেশ নিজের বন্ধু বান্ধব চিরপরিচিত পরিসর ছেড়ে এসে মনের ওপর বিরূপ প্রভাব পরে ইমনের। প্রিয়াকে হারিয়ে নিজের ওপর প্রতিশোধ ও কম নেয় নি। অনিয়ম করা নিজের প্রতি যত্ন না নেয়া, খাওয়া দাওয়া না করা সব কিছু মিলিয়ে কেমন উদভ্রান্তের মত হয়ে গেছিলো ইমন।

আজ এতো বছর পর নিজের ভালোবাসার মানুষকে চোখের সামনে দেখে ইমনের সব রাগ যেনো বাঁধ ভাঙ্গা নদীর জোয়ারে ভেসে গেলো। প্রিয়ার ওপর রাগ দেখাতে পারছে না।
প্রিয়ার ওকে ভুল বোঝাতে মনের মাঝে বিক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জন্মেছিল। এক পলকের দেখায় সব রাগের বরফ গলে পানি হয়ে গেলো।

কিন্তু সমস্যা হলো প্রিয়া আমাকে ইগনোর করছে। ফিরেও তাকাচ্ছে না। যেনো সে আমাকে চিনেই না। দেখেনি কোনদিন। আমার এতো বড় একটা অ্যাকসিডেন্ট ও প্রিয়াকে নাড়া দেয়নি। এ প্রিয়া কোন প্রিয়া!? আগের প্রিয়া হলে ইমনের ব্যথায় ঘন ঘন মূর্ছা যেতো। প্রিয়া এতো কঠোর হলো কিভাবে?

নিজের প্রিয় মানুষটাকে কাছে পেয়েও তার কাছ থেকে দূরে থাকা কতটা কষ্টের সেটা ইমন হারে হারে টের পাচ্ছে।

এতগুলো বছর দূরে থেকে প্রিয়ার প্রতি ভীষন রাগ ও ছিলো আবার বিরহ ব্যথায় অন্তরও পুড়িয়েছে। আর এখন চোখের সামনে দেখে অন্তরের সাথে সাথে চোখও পুড়ছে। এ দহন কি কখনো শেষ হবে?

প্রিয়ার হাত ধরে বলতে পারছে না আমি শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি। আমি আজও তোমার অপেক্ষায় আছি। আমার জীবনে তুমি ছাড়া অন্য কোন নারী কোনদিন ছিলো না আর আসবেও না।
প্রিয়াকে এতো সামনে দেখেও নিজের ব্যক্তিগত কথাগুলি বলতে পারে না ইমন। এতে যে কত যন্ত্রণা সেটা কেউ বুঝবে না। নিজের মনকে মানাতে পারছে না। সারাক্ষণ ভিতরে একটা অস্থিরতা কাজ করে, দিবানিশি বুকের ভিতর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কতটা হেল্পলেস সে সেটা ইমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে টের পাচ্ছে।

মনে মনে পাগলের মত আওড়াতে থাকে, আমি তো একমাত্র প্রিয়াকে ভালোবেসেছিলাম। আমার মনের গহীনে শুধু একজনই ছিলো, সে হলো প্রিয়া। তাহলে আমার ভালোবাসা কেনো সার্থকতা পেলো না।

চোখের কোনা ভিজে আসে ইমনের। আড়ালে নিজের চোখের পানিটুকু মুছে নেয় সে।

এদিকে প্রিয়া নিজেও ইমনের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। যতটা সম্ভব ওয়ার্ডের বাইরেই থাকছে। ইমন এখান থেকে চলে গেলেই বাঁচে। ওর সামনে থেকে নিজেকে কন্ট্রোল করা অসম্ভব লাগছে। অ্যাক্সিডেন্টের পর প্রথম যেদিন ইমনকে দেখেছিলো সেদিন নিজেকে সামলাতে পারেনি, সহ্য করতে পারেনি ইমনের কষ্ট। তাইতো শরীর অসুস্থ বলে চলে গিয়েছিল। রাগের কথাটা মনে হতেই ঠিক করেছিল একটা লম্বা ছুটি নিবে। ইমন হসপিটাল থেকে চলে গেলেই আবার কাজে যোগ দিবে। কিন্তু ইমনকে এক নজর দেখার লোভ সামলাতে পারেনি। চেয়েছে সামনাসামনি জিজ্ঞেস করতে কেনো ওকে ধোঁকা দিলো? কি ক্ষতি করেছিলাম তোমার? তুমি সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমার মনটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিলে।

ইমনের ওপর রেগে আছি, ওর প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছি তাই বলে তো আমার ভালোবাসা মিথ্যে ছিলো না।
আমার প্রথম আর শেষ ভালোবাসা ইমন। আমি তাকে একমুহুর্তের জন্যও ভুলে যাইনি। ইমন আমার সাথে বেইমানী করেছে, ধোঁকা দিয়েছে, আমার সাথে প্রতারণা করেছে, আমি তো করিনি। আজও ওকে দেখলে বুকের ভিতর ভালোবাসারা আহাজারি করে। খচখচ করে মন, হাহাকার করে বুকের জমিন। সেই সুন্দর মুহূর্তগুলি মনে পড়ে। কেনো এমন করলে ইমন?
আমার ভালোবাসায় কিসের অভাব ছিলো। যেই তুমি আমাকে পাওয়ার জন্য সকাল বিকাল পিছনে লেগে থাকতে আর সেই তুমি আমাকে পাওয়ার পর তোমার সব প্রেম উবে গেল? তবে কি মিথ্যে ছিলো তোমার ভালোবাসা?

তোমার চোখের সামনে থেকে নিজেকে ধরে রাখা অসম্ভব মনে হচ্ছে। আর পারছিনা নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে।

প্রিয়া নিজে অন্য ওয়ার্ডে গিয়ে নিজেকে কাজ ব্যস্ত রাখে আর নিজের ওয়ার্ডে অন্য ডিউটি ডক্টর পাঠিয়ে নিজে কিছুক্ষণের জন্য হলেও দূরে থাকে।

টুইংকেল সব বেডের পাশে গিয়ে দাড়িয়ে দেখছে কে কি করছে। প্রিয়া ওয়ার্ডে নেই। সেই যে তখন ধ্রুবর সাথে ওয়ার্ড ছেড়ে বাইরে গেছে এখনও আসে নি।

রাশেদ হাত দিয়ে ইশারা করে টুইংকেলকে ডাকলো। টুইংকেল ইমনের বেডের পাশে আসতেই রাশেদ ওকে ইমনের বেডের ওপর বসিয়ে দেয়।

ইমন টুইংকেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, তোমার নাম কি মা মনি?

তুমি আমার নাম জানো না?

উহু

আমার নাম টুইংকেল। বাবাই আদর করে পরী ডাকে। আর মাম্মাম ডাকে টুই বলে।

বাব্বাহ তোমার এতো নাম? সবগুলো নাম তোমার মতই খুব মিষ্টি।

তোমাকে সবচেয়ে বেশি কে ভালোবাসে বাবাই নাকি মাম্মা?

আমাকে কেউ ভালোবাসে না ঠোট ফুলিয়ে বললো টুইংকেল।

একথা কেনো বলছো?

বাবাই সারাদিন কাজ করে। আমার সাথে একটুও খেলে না, ঘুরতেও নিয়ে যায় না। রাতে আমার মাম্মামের জন্য কত মন খারাপ হয়, মাম্মাম ছাড়া আমার ঘুম আসে না। বাবাইকে কত বলি মাম্মামের কাছে যাবো, বাবাই তবুও নিয়ে যায় না।

রাশেদ বললো, কেনো মাম্মাম তোমার সাথে থাকে না?

না তো, মাম্মামের বাসা তো দূরে, তাই আমি যেতে পারি না, বাবাই বলে এখন এতো দূরে যেতে হবে না, পরে নিয়ে যাবো।

রাশেদ ইমনের দিকে তাকিয়ে বলে, কাহিনী কি?
কিছু বুঝলি?

ইমন একটু নড়ে চড়ে বসলো, বললো কিছুই তো বুঝতে পারছি না, সব কেমন যেনো ঘোলাটে লাগছে।

সিস্টার বললো, টুইংকেল তুমি বেড থেকে নামো। মাম্মা দেখলে খুব রাগ করব।

এদিক সেদিক না ঘুরে তোমার মাম্মামের চেয়ারে এসে বসো। না হলে মাম্মা এসে অনেক রাগ করবে। বকা দিবে।

মাম্মাম আমাকে কখনো বকা দেয় না, এত্তোগুলো ভালোবাসে।

হইছে আর পাকামো করতে হবে না। এখানে এসে বসো। না হলে আমি ইনজেকশন দিয়ে দিবো।

টুইংকেল এবার ভয় পেলো। সুরসুর করে প্রিয়ার চেয়ারে এসে বসলো।

ইমন টুইঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে আছে, খুব কিউট বাচ্চা। ওর দিকে না তাকিয়ে থাকা যায় না।

ইমন সিস্টারকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, দিদি টুইংকেল এসব কি বলছে, মাম্মা অন্য বাসায় ও অন্য বাসায় থাকে, এর মানে কি?

সিস্টার হাসে বাদ দেন এসব কথা।

প্লিজ দিদি বলেন,

সিস্টার বললো, টুইংকেল প্রিয়া ম্যাডামের মেয়ে না তার খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর মেয়ে। টুইংকেলকে জন্ম দিতে গিয়ে ওর মা মারা যায়। ওর মা মারা যাওয়ার পর ওর বাবা খুব ভেঙ্গে পড়ে। তখন প্রিয়া ম্যাডাম এই বাচ্চাটার দায়িত্ব নেয়। ধ্রুব ভাইয়া একটু সামলে উঠলে টুইংকেল কে নিজের কাছে নিয়ে যায়। তখন অবশ্য টুইংকেল বেশ বড় হয়ে গেছে। ওর আসা যাওয়া আছে ম্যাডামের কাছে। ও জানে ম্যাডামই ওর মা। প্রিয়া ম্যাডাম বাচ্চাটাকে খুব ভালোবাসে। তার আব্বু আম্মু ও ওকে খুব স্নেহ করে। ঢাকা থেকে আসার সময় ওর জন্য গিফট আনতে ভুল করে না।

প্রিয়া ম্যাডামের বাসা কোথায়? তার বিয়ে হয়নি?

না, ম্যাডাম এখনও বিয়ে করেনি। বাসা বেশি দূরে না সামনেই।

সিস্টার তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রোগী তো আর কম না। ওয়ার্ডে কয়েকজন সিস্টার কাজ করছে, তারপর ও ডাকা ডাকি লেগেই থাকে। রোগী ভর্তি হচ্ছে, রিলিজ নিজে চলে যাচ্ছে, এসব নিত্যদিনের ঘটনা। কে রাখে কার খবর?

প্রিয়াকে আসতে দেখে টুইংকেল ছুটে গেলো প্রিয়ার কাছে। প্রিয়া কোলে তুলে নিলো টুইংকেলকে। নিজের টেবিলের কাছে এসে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে ব্যাগ থেকে একটা কিটক্যাট বের করে টুইঙ্কেলের হাতে দিলো। বললো
এটা ফিনিশ করে বাসায় যাবে। এখানে আর থাকা যাবে না।

মাম্মাম আমি বাসায় যাবো না। বাসায় ভালো লাগে না। আমি তোমার কাছে থাকবো।

তুমি কি চাও আমি রাগ করি?

টুইংকেল কিটক্যাট টেবিলে রেখে গাল ফুলিয়ে দুই হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে বসে রইলো।

প্রিয়া টুইংকেলের রাগ দেখে ওর গাল টিপে দিলো। হেসে ফেললো নিজেও।

খাচ্ছো না কেনো? কিটক্যাট তো তোমার ফেভ্রেট চকলেট।

খাবো না আমি রাগ করেছি বলে ঠোঁট বাকালো।

প্রিয়া টুইংকেলের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।

হাতের কাজ শেষ করে নিজের শিফটিং ডিউটি শেষ হলে অন্য ডিউটি ডাক্তারকে রোগীদের ফাইল বুঝিয়ে দিয়ে টুইঙ্কেলের হাত ধরে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেলো।

খুব মন চাইছিলো যাওয়ার আগে ইমনকে একবার মন ভরে দেখতে। কিন্তু নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পেতে পারে ভেবে সেদিকে আর ফিরে তাকায়নি। পরীক্ষার কথা বলে প্রিয়া এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছে। ইমনের মুখোমুখি হতে চায় না। মনে মনে যতই বলুক সে দুর্বল হবে না, অন্য দশজন রোগীর মতই ট্রিট করবে আদতে সেটা পারছে। ইমনের উপস্থিতি ওকে ভীষন কষ্ট দিচ্ছে। জীবনের শুরুতে ভুল মানুষটাকে ভালোবেসে নিজের হৃদয়ের ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছে। সেখানে ভিড় করেছে বেদনার নীল ঢেউ।

চলবে……

#ভুলে_থাকা_গল্প
#লেখনী__ইয়ানা_রহমান
#পর্ব_১৩

জীবনের শুরুতেই ভুল মানুষটাকে ভালোবেসে হারিয়ে ফেলেছে হৃদয়ের ঠিকানা। বন্ধ করেছে মনের দুয়ার। সেখানে এসে ভিড় জমিয়েছে বেদনার নীল ঢেউ।

প্রিয়া ব্যালকনির গ্রিলে দাড়িয়ে ভাবছে পুরনো সেই ব্যাথাতুর দিনের কথা।
চাওয়াটা তো আমার সৎ ছিলো, তাহলে পাওয়াটা কেনো হলো না। আমি চিরতরে হারিয়ে ফেললাম তোমাকে। কেনো এমন করলে আমার সাথে। আমার ভালোবাসায় কিসের অভাব ছিলো?

চিটাগং আসার পর থেকেই কান্নাই ছিলো প্রিয়ার একমাত্র সঙ্গী। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে কান্না, ঘুম থেকে উঠে কান্না, নাস্তা খেতে বসে কান্না, পড়তে বসলে কান্না, ক্লাসে যেতো মন মরা হয়ে মলিন মুখে। এভাবেই কাটতো ওর সারাদিন রাত। কোন কিছুই ভালো লাগতো না, কারো সাথে মিশতে ইচ্ছে করতো না। কারো সাথে ফ্রেন্ডশীপ করতে ইচ্ছে করতো না। কোথাও যেতে ইচ্ছে করতো না। সব কিছু থেকে নিজেকে আড়াল করতে করতে দিন পার করতো। অনেকেই ফ্রেন্ড হতে চেয়েছে, সঙ্গ দিতে চেয়েছে কিন্তু প্রিয়ার এসবে তেমন আগ্রহ ছিলো না। এক সাথে পড়তে গেলে সবার সাথেই একটু মিলেমিশে থাকতে হয় ওই পর্যন্তই।

প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে ঢাকা ছেড়ে আসার পর প্রবলভাবে বুঝতে পেরেছিল প্রিয়া সে একা একা বাইরে থাকতে পারবে না। কোনদিন একরাতের জন্যও আব্বু আম্মুকে ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকেনি, সে এখানে বছরের পর বছর থাকবে কিভাবে? তারপরও তাকে সব ছেড়ে এখানেই থাকতে হবে। এ যে তার সেচ্ছা নির্বাসন।

বাবা মা দাদীর কথা প্রতি মুহূর্তে মনে পড়তো। বাবার আদর মায়ের ভালোবাসা দাদীর বন্ধুত্ব প্রতি নিয়ত মিস করতো। নিজের পরিচিত পরিবেশ আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সব কিছুকে মিস করতে থাকে।
নিজের পছন্দ মত সাজানো ঘর, নিজের বিছানা, নিজের পড়ার টেবিল সব কিছু কেমন যেনো টানতো।

ইমন নামের যন্ত্রণাটা থেকেও বেরিয়ে আসতে পারছিলো না। শান্তিতে থাকতে দিচ্ছিলো না সেই ক্ষণিকের দেখা ভয়ংকর স্মৃতিটা।

ভুলতে পারেনি সেই ভুল মানুষটাকে। ভালোবাসা আর ঘৃণার মিশ্রণের একটা অদ্ভুত অনুভূতি মনকে গ্রাস করে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেখান থেকে কোনভাবেই বেরিয়ে আসতে পারেনি প্রিয়া।এসব থেকে প্রবলভাবে মুক্তির রাস্তা খুঁজেছে, কিন্তু কোন রাস্তাই খুজে পায়নি সে।
কখনো কখনো ইমনকে প্রচণ্ড মিস করতো। ওর কাছে ছুটে যেতে মন চাইতো। ওর চোখে চোখ রেখে বলতে ইচ্ছে করতো আমার মন নিয়ে খেলাটা কি খুব জরুরী ছিল? নাকি বাজি জিততে এসেছিলে কেনো ভাবে। আবার পরক্ষণেই ইমনের প্রতারণার কথা মনে আসতেই নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করতো।
ধিক্কার দিতো নিজেকে, কেমন করে আমি এতবড় ভুল করলাম। একটা ভুল মানুষকে জীবনের সাথে মিশিয়ে নিজের জীবনটাকে ধ্বংস করে দিলাম।একটা ক্যারেকটার লেস ছেলেকে কেমন করে ভালোবাসলাম? সে তো আগেই নীপার কাছে শুনেছিল ইমন আর ওর বন্ধুরা ভার্সিটিতে রাস্তাঘাটে মারামারি করে। গুন্ডামি মাস্তানী ছিলো যার নিত্যদিনের কাজ। তখন কেনো এগুলি ইগনোর করেছে। তখন কেনো নিজেকে সামলে নেয়নি? যে ছেলে গুন্ডামি মাস্তানী করে বেড়ায় তারজন্য মেয়ে ঘটিত ব্যাপার তো অসম্ভব কিছু না। বরং স্বাভাবিকের চেয়েও স্বাভাবিক ব্যাপার।

একটা নষ্ট ছেলেকে ভালোবেসে তার বিনিময়ে এখন আমি মা বাবা ছাড়া,একা একা এতদূরে এসে কেঁদে কেঁদে বিনিদ্র রাত পার করে চলেছি।
তারপরও কেনো ইমনকে ভুলতে পারছি না। ওর বিরহ দহনে মন প্রাণ জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। এ কেমন ভালোবাসা?

প্রিয়া একটা ডায়রীর প্রত্যেক পাতায় বাকা করে শুধু ইমন নামটা লিখে রেখেছে তার নিচে একটা লাভ সাইন এঁকে রেখেছে। যখন ইমনের বিরহ খুব কষ্ট দেয়, তখন প্রিয়া সেই ডায়রিটা নিয়ে বসে। প্রতিটা পাতা উল্টাতে থাকে আর ইমন লেখাটার ওপর হাত বুলাতে বুলাতে কেঁদে একাকার হয়।
প্রতিবারই এই কাজটি করে প্রিয়া নিজে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করে

কোন কারণে বা কলেজে যাওয়ার সময় ব্যস্ত রাস্তার মানুষগুলোর দিকে চেয়ে চেয়ে ইমনের চেহারা খুজে বেড়ায়, বড় বড় চোখের সেই শ্যামলা ছেলেটিকে আড়াল থেকে যদি একটিবার দেখতে পেতো। কোথাও দেখে না সেই প্রিয় মুখটি। হতাশ হয়। নিরাশ হয়।

নিজের জীবনে ইমনকে আর ফিরে চায় না। শুধু চুপি চুপি একটিবার প্রাণ ভরে দেখতে চায়। বেহায়া মন তো মানে না। সে কারো কথার ধার ধারে না, সে চলে নিজের আপন ভঙ্গিতে।

এতো নিয়মের মধ্যে চলেও আমার কপালে দুঃখই বাধা রইলো। ভেবেছিলাম পৃথিবী উল্টে গেলেও, সব ধ্বংস হয়ে গেলেও,মহা প্রলয় আসলেও ইমন আর আমার ভালোবাসা সফল হবেই। আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না কিন্তু বিধি বাম আমাদের গভীর প্রেমের পাল তোলা নৌকাটা একটু ঝড়ো হাওয়ার বেগে উল্টে গেলো। সব শেষ হয়ে গেলো।
আমার চাওয়াটা তো মিথ্যে ছিলো না তাহলে আমি কেনো তোমায় পেলাম না।

এরই মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। প্রিয়া এখন অনেকটা স্বাভাবিক। অনেক ম্যাচিউর। সেই আঠারো বছরের বাচ্চাটি নেই। এখন কোন কিছুতেই কেঁদে বুক ভাষায় না। ওর ডাক্তার স্যারেরা ওর ব্যচমেট ডাক্তার বন্ধুরা নার্স দিদিরা সবাই প্রিয়াকে খুব ভালোবাসে। সর্বোপরি আছে টুইংকেল। সেতো প্রিয়ার জান। বাচ্চাটা জন্ম লগ্ন থেকেই প্রিয়ার কাছে বড় হয়েছে।

টুইংকেল মা নওমি ছিলো প্রিয়ার ব্যাচমেট। প্রিয়া শুরুতে সবাইকে এড়িয়ে চলতো। কিন্তু নওমিকে কিছুতেই এড়িয়ে চলতে পারেনি। নওমি আঠার মত লেগে থাকতো প্রিয়ার সাথে।
নওমীরা চিটগাংয়ের স্থানীয় বাসিন্দা ছিলো। খুব ধনী পরিবারের মেয়ে ছিলো নওমী। মনটা ছিলো বিশাল। প্রিয়া মন খারাপ করে থাকতো সেটা নওমী সহ্য করতে পারতো না। ওর কাছে খারাপ লাগতো। ও সব সময় চেষ্টা করতো কিভাবে ওর মন ভালো করা যায়। জোর করে প্রিয়াকে নিয়ে নিজেদের গাড়িতে করে শহর ঘুরতে বেরিয়ে যেতো। সপ্তাহ শেষে কলেজ ছুটি হলে কখনো কক্সবাজার বীচে কখনো পতেঙ্গা বীচে আবার কখনো মেরিন ড্রাইভের লম্বা রাস্তা ধরে ঘুরে বেড়াতো। সাথে থাকতো ধ্রুব।
নওমীর কল্যাণে প্রায় পুরো চিটাগাং দেখে ফেলেছে। প্রিয়া শুরুতে শুরুতে হসপিটালের হোস্টেলে থাকতো।সেখানকার থাকা খাওয়া অনেক কষ্টের ছিলো। তাই মাঝে মাঝে নওমী প্রিয়াকে ওদের বাসায় নিয়ে যেতো। প্রিয়া যেতে না চাইলে জিদ করে নিজেই ওর সাথে থেকে যেতো।
কখনো প্রিয়ার জন্য বক্সে করে খাবার নিয়ে আসতো। এইভাবে চলতে চলতে একসময় নওমী প্রিয়ার মাঝে খুব ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বাবা মা ঘন ঘন এসে প্রিয়াকে দেখে যায়। তখন প্রিয়া আব্বু আম্মুর সাথে হোটেলেই থাকে। একমাত্র মেয়েকে ছেড়ে তারাও ভালো নেই।
মেয়ের জেদের কাছে হেরে গিয়ে মেয়েকে এখানে থাকতে অনুমতি দিয়েছে।

নওমীর সাহায্যে প্রিয়া ধীরে ধীরে ডিপ্রেসন কাটিয়ে উঠে। ওরা দুজন হয়ে ওঠে বেস্ট ফ্রেন্ড। ওদের আরেকজন বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল সেটা হলো ধ্রুব।

ধ্রুব নওমীর মাঝে একটা সম্পর্ক আছে এটা প্রিয়া বুঝতো। কিন্তু কোনদিন জিজ্ঞেস করেনি। বলার হলে নওমী নিজেই বলবে। বলেছিলো সে ওর প্রেম কাহিনী। আর আমার দুঃখ গাঁথা ও শুনে নিয়ে কেঁদে ফেলেছিল।

ধ্রুব যখন মেডিকেল থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট তখন নওমী ফার্স্ট ইয়ারে নতুন ভর্তি হয়েছে। নিউ স্টুডেন্টদের ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে নওমী আর ধ্রুবর পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে প্রেম। ধ্রুব নওমী কে সব সময় নিজের পাশে দেখতে চাইতো বলে ইচ্ছে করে ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা ফেল করতো প্রতিবার। ধ্রুব ভালো স্টুডেন্ট ছিলো ওর ফেল করার কারন কেউ না জানলেও আমি আর নওমী ঠিকই জানতাম।
এনিয়ে নওমী আর ধ্রুবর মাঝে ঝগড়াও হতো। নওমী বলতো আমার বাসায় জানলে তোমার মত ফেলটু ছেলের সাথে কোনভাবেই বিয়ে দিবে না। সব বাবা মাই স্টাবলিস্ট পাত্র চায় তাদের মেয়ের জন্য। আর সেখানে তুমি আমার ক্লাসে পড়ছো।
ধ্রুব কিছুই বলতো না, শুধু একটু হাসতো।

সত্যি সত্যি একদিন এমনটাই হলো। নওমীর মা আমাকে ফোন করে ডেকে নিলেন। আমি বাড়িতে ঢুকে দেখি বাড়িটাকে বিয়ে বাড়ির মত করে সাজানো হয়েছে।আণ্টি বললেন,
আমরা জানতে পেরেছি ও নাকি ওর কোন ক্লাসমেট কে পছন্দ করে। কিন্তু এটা তোমার আংকেল কিছুতেই মানতে পারছে না। শুনেই তার প্রেসার হাই হয়ে গেছে। এখন সে তার মেয়েকে তার বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দিবে ঠিক করেছে। ছেলেটি আমাদের স্ট্যাটাসের দিক দিয়ে একদম পারফেক্ট।

খুব সাহস করে বললাম আণ্টি ধ্রুব ভাইয়ারা ও কিন্তু অনেক ধনী। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে দেখতে শুনতে বেশ। আপনারা একবার ধ্রুব ভাইয়ার সাথে কথা বলে দেখতেন।

তোমার আংকেল তার পছন্দের বাইরে যাবে না। সে তার কথায় বজায় রাখবে। সে এক কথার মানুষ।

ওকে বোঝাও আর রেডি করো। ওকে দেখতে পাত্রপক্ষ আসছে। আজই ওকে আংটি পরাবে।

আমার তো মাথায় হাত। কি শুনছি এসব? নওমী কিছুতেই এ বিয়েতে রাজি হবে না।

আমি ওকে এখন কি বোঝাবো? এখানে আমি কে? নওমী বলবে, তুই সব জেনেও এসব বলছিস কিভাবে?
ওদের বিশাল বাসাটা একটা দুর্গ। সেখান থেকে পালানোর কোন পথ নেই। বিশাল পাচিল ঘেরা বাড়ি, গেটে কালো পোশাকে বন্দুক ধারি দারোয়ান। সাথে আছে জার্মান শেফার্ড কুকুর।
এবাড়িতে আসা যাওয়া এতো সহজ না।
নাটক সিনেমার মত বয়ফ্রেন্ড পাঁচিল টপকে পাইপ বেয়ে ওপরে এসে গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে পালাবে সেটা এখানে কল্পনার বাইরে।

নওমী বসে বসে কাদছে। সে কিছুতেই ধ্রুবকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না।

যত কান্নাকাটিই করুক কোন কাজ হলো না। নওমী আর জিহাদের আংটি বদল হয়ে গেলো।

নওমী বাসার সবার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করছে। সবাই ভেবে নিয়েছে জিহাদকে নওমীর পছন্দ হয়েছে।
জিহাদ নওমীকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গেলে নওমী ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে সেখান থেকে পালিয়ে যায় ধ্রুবর কাছে। তারপর ধ্রুব আর নওমী বিয়ে করে ফেলে।

ধ্রুবর বাড়িতে নওমীকে মেনে নেয় না। কারণ নওমীর বাবা ওদের নামে মামলা করেছে। ওরা বলে এই মেয়ে এখানে থাকলে সবার কোমরে দরি পড়বে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় ধ্রুব নওমী।

তিন রুমের একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় ধ্রুব নওমী। শুরু হয় ওদের নতুন জীবন। ধ্রুব ক্লাস শেষে পার্ট টাইম একটা চাকরি জোগাড় করে নেয়। তাতে ওদের সংসারের টানাটানি লেগেই থাকত। ওরা দুজনেই স্টুডেন্ট।

আমি মনে প্রাণে ওদের হেল্প করার কথা ভাবছিলাম। বললাম নওমী হোস্টেলে আমার থাকতে অনেক সমস্যা হচ্ছে, খাওয়া ভালো না, মশা ছারপোকা তেলাপোকা তো আছেই। তোদের তো তিন রুমের ফ্ল্যাট। একটা রুম আমাকে সাবলেট দিবি?

নওমী বললো এভাবে বলছিস কেনো? সাবলেট ভাড়াটিয়া হতে হবে না তুই এমনিতেই আমার সাথে থাক। তুই থাকলে আমার খুব ভালো লাগবে।

না ভাড়া না নিলে থাকবো না। আমার তো টাকার সমস্যা নেই আমি কেন ফ্রীতে থাকবো?

আচ্ছা আচ্ছা তাও তুই হোস্টেল থেকে বের হ।

হুম বের হবো কিন্তু ভাড়া হাফ হাফ নিতে হবে আর খাওয়া বাবদও টাকা নিতে হবে।

সব পরে দেখা যাবে আগে তুই সব গুছিয়ে বাসায় ওঠ। আমি আর নওমী মিলে আমার সব গুছিয়ে হোস্টেল ছেড়ে নওমীর বাসায় এসে উঠলাম। ওয়ার্ডবয় মামাকে দিয়ে লিস্ট করে একমাসের জন্য বাজার করলাম। হারিকুরি বাসন কোসন সব কিনলাম। আব্বুকে ফোন করে আসতে বললাম। আব্বু নেক্সট ফ্লাইটে চলে আসলো। এসে আমাকে নওমীর সাথে দেখে খুব খুশি হলো। দুই বান্ধবীর মিলে একসাথে পড়বো কলেজে যাবো, হাসি আনন্দে থাকবো।
বাবা ফার্নিচার মার্কেটে গিয়ে আমার জন্য প্রয়োজনীয় সব ফার্নিচার কিনলো। বিছানা বালিশ সব নিয়ে এলো। নওমীর জন্যও একটা খাট বিছানা বালিশ আর একটা ড্রেসিং টেবিল কিনে আনলো।

ধ্রুব নওমী একটু রাগ করলো, বললো আমরা আস্তে আস্তে সব কিনে নিতাম।

আব্বু বুঝিয়ে বলতে ওরা আর রাগ করেনি।

হসপিটালের এক খালাকে ঠিক করলাম। সে তার ডিউটির শেষে এসে ঘরের সব কাজ রান্না করে যাবে।

এভাবে ভালোই কাটছিল ওদের দিন। ধ্রুব কোনদিন আমাকে ভাইয়া বলতে দেয় নি। সে বলতো আমি তোমাদের ব্যচমেট আমাকে অন্য বন্ধুদের মত ট্রিট করবে।

অ্যাকসিডেন্টলি নওমী প্রেগনেন্ট হয়ে গেলো। প্রেগন্যান্সিতে সমস্যা থাকার কারণে নওমী ডেলিভারির সময় মারা যায়। ধ্রুব শোকে পাথর হয়ে যায়। ডিপ্রেশনের কারণে কয়েকবার সু/ই/সা/ই/ড করতে যায়। ধ্রুবকে ওর বাবা মা মেন্টাল অ্যসাইলামে ভর্তি করে। সেখানে চিৎকার চেঁচামেচি করতো। নওমী নওমী বলে ডাকতো আর কাদতে থাকতো। একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলতো।

সেই থেকে নওমী আর ধ্রুবর মেয়ে আমার কাছেই বড় হয়। আমি বাচ্চাটার নাম রেখেছি টুইংকেল।দাদা বাড়ি নানা বাড়ি কোথাও ওর জায়গা হয়নি।

জন্মলগ্ন থেকে আমিই ওর মা। টুইংকেল আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। আমি মা হয়েছি। পড়াশুনা আর টুইংকেলই ছিলো আমার একমাত্র সঙ্গী। পড়তে বসলেও টুইংকেলকে কোলে নিয়েই পড়তাম। কখনো ওকে কাছ ছাড়া করতে সাহস পেতাম না। ওকে খুব ভালোবাসি।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here