ভুলে_থাকা_গল্প,০৮,০৯

#ভুলে_থাকা_গল্প,০৮,০৯
#লেখা__ইয়ানা_রহমান
#পর্ব_৮

দেখতে দেখতে ছয় বছর পেরিয়ে সাত বছরে পড়েছে। দীর্ঘ একটা সময়। এই দীর্ঘ সময়টা প্রিয়া একাই কাটিয়েছে। নিজের ভিতরের কষ্টগুলো কারো কাছে প্রকাশ করেনি। নিজে নিজেই হজম করেছে নিদারুণ কষ্টের সেই দিনগুলির যন্ত্রণাময় মুহূর্তের পাহাড়। নিজের বাবা মাকেও বুঝতে দেয়নি ওর হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউয়ের গোঙানি।

প্রিয়া এখন পরিপূর্ন একজন ডাক্তার। ডাক্তারী পাশ করে এখন চিটাগাং মেডিকেল কলেজে মেডিকেল অফিসার পদে কাজ করছে। এখানেই সে ডাক্তারী পড়েছে, ইন্টার্নশীপ করেছে।

প্রিয়ার রেজাল্ট ভালো ছিলো বিধায় এডহক ইন্টারভিউ দিলে এখানেই ওর চাকরি হয়ে যায়।

প্রিয়ার মা বাবা চেয়েছিলো প্রিয়া বাসায় বসে পড়াশুনা করুক, বিভিন্ন জায়গায় কোচিং করে
বিসিএস আর
এমএস পরীক্ষায় অংশ নিবে। পড়াশুনা কমপ্লিট করবে এটাই ভেবেছিলো তারা। চাকরিতে ঢুকলে পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটবে।

জোবায়দা বললেন, আমাদের তো কম নেই, তুই আমাদের একমাত্র সন্তান। এই বয়সেই তুই কেনো চাকরিতে ঢুকবি? আমরা ভেবেছি বিসিএস পরীক্ষার পর রেজাল্ট যাই হোক একটা ভালো ছেলে দেখে তোর বিয়ে দিবো। মেয়ের বিয়ের বয়স হলে বাবা মায়ের মাথায় অনেক চিন্তা থাকে। সেটা কি তুই বুঝিস? তারপর থাকিস আমাদের থেকে অনেক দূরে। চাইলেই দৌড়ে চলে আসতে পারি না। এখন তোর বিয়ের বয়স হয়েছে, তোকে বিয়ে দেয়া উচিত। একজন সৎপাত্র দেখে তোর বিয়ে দিয়ে তার হাতে তোর দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাই।

প্রিয়া বাবা মায়ের কোন কথাই শোনেনি। বলেছে ইন্টারভিউ টা আগে দেই, যদি না টিকি তাহলে তোমাদের কথামত ঘরে বসে পড়বো।

আর আমার বিয়ে নিয়ে ভেবো না এখন। সময় হলে আমি তোমাদের বলবো। আমি এখন বিয়ে নিয়ে ভাবছি না। আগে নিজের ক্যারিয়ার স্টাবলিস করবো তারপর বিয়ে নিয়ে ভাববো।

বিয়ে করতে চাস না কেন? তোর কি কাউকে পছন্দ করা আছে, তারজন্য কি অপেক্ষা করছিস?

কি যে বলো না মা। সেসব কিছুই না আমি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে ফোকাস করতে চাই। বিয়ে হলো পিছুটান। যেটা আমাকে সামনে এগুতে দিবে না হয়তো। তাই আপাতত বিয়ের বন্ধনে জড়াতে চাই না।

কেন আমি ডাক্তারী পাশ করতেই তোর আব্বুকে বিয়ে করিনি? সংসার সামলে পড়াশুনা করেছি, বাচ্চা জন্ম দিয়েছি, তোর লালন পালনও করেছি। কই আমি তো পিছিয়ে পড়িনি। আমার ডিগ্রীও কিন্তু কম না।
মা তুমি অনেক যোগ্য ছিলে। আব্বু তোমাকে সাপোর্ট করেছে অনেক। সংসারে বাড়তি কোন ঝামেলা ছিলো না। আমার বেলায় তেমনটা না ও হতে পারে। সব হাসবেন্ড আব্বুর মত সাপর্টিভ হয় না। তখন আমার সব স্বপ্ন ধুলোয় মিশে যাবে। ক্যারিয়ার গড়া আর হবে না। তাই এই চিন্তা এখন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও।

জোবায়দা আর কিছু বললো না। এক দিকে মেয়ের কথাও ঠিক, ওর কথাটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মত না। আবার বিয়েটাও জরুরী। সময় থাকতেই মেয়েদের বিয়ে দিতে হয়। একটু দেরি হলেই সবাই বলবে মেয়ের বয়স বেশি। তখন উপযুক্ত পাত্র পেতে অনেক সমস্যা হয়।
যাক আবার কদিন পর বিয়ের কথা আবার তুলবো। এখন বেশি ঘ্যানঘ্যান করলে প্রিয়া ক্ষেপে যাবে।

ভাগ্যক্রমে প্রিয়ার চাকরি হয়ে যায়। প্রথম অবস্থায় বেতন খুব বেশি না। তারপরও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর খুশি আর গর্বই আলাদা। প্রিয়া ভীষন খুশি চাকরি পেয়ে।
আসলে ও নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখতে চায়। একটু অবসর পেলেই অতীতের সেই কষ্টের স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

আমি সব ভুলে যেতে চাই। তবুও কেনো বারবার চোখের সামনে স্মৃতিরা এসে ভিড় করে। কি ভুল ছিল আমার ভালোবাসায়। আমি তো মনে প্রাণে একজনকেই ভালোবেসেছিলাম।
তাহলে আমি কেনো সত্যিকারের ভালোবাসা পেলাম না। দুচোখের কার্নিশ বেয়ে লোনা পানি গড়িয়ে পড়ে। নিজের কষ্টগুলো নিজের বুকের ভিতর দাফন করে রেখেছে। কাউকে জানতে দেয়নি ওর বুকের জ্বালা।

হসপিটালের ডিউটি শেষ হলে বাসায় গিয়ে বিসিএস গাইড নিয়ে বসে। অনেক পড়াশুনা করে। সবসময় একটা জেদ কাজ করে ওর ভিতর। নিজেকে কষ্ট দিয়ে কারো ওপর প্রতিশোধ তোলে।
কিন্তু কার ওপর এতো রাগ, এতো ঘৃনা। সেই বেঈমান টার জন্য। সেতো আমার ঘৃণার ও যোগ্য না।

এখন প্রিয়া পুরোদমে রোগী দেখছে। প্রফেসর স্যারদের সাথে রাউন্ডে যাচ্ছে। খুব পরিশ্রমী একজন মেডিকেল অফিসার হিসেবে পরিচিত ড.প্রিয়া।

পেশেন্টের কাছে ড.প্রিয়া আহমেদ নামটাই যেনো এন্টিবায়োটিকের কাজ করে। সবাই প্রিয়াকে খুব পছন্দ করে। সবার সমস্যা সে খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে, তারপর সেটার সমাধান করে।
সব পেশেন্টের বেডের পাশে গিয়ে আপনজনের মত আচরণ করে, তাদের কথা শোনে। তাদের সময় দেয়।তাতে পেশেন্টরা মনে জোর পায়। বেচেঁ থাকার আশা জাগে তাদের মনে।
তারা প্রিয়াকে অনেক দোয়া করে।

যদিও বাচ্চাদের ওয়ার্ডে প্রিয়ার কোন কাজ নেই তবুও সে যায়। ছুটির সময় প্রতিদিন যায়। ওখানে গেলে তো কোন কথাই নেই। ড.প্রিয়া নিজেও একটা বাচ্চা হয়ে যায়। অসুস্থ বাচ্চাগুলো দেখলে ওর কষ্ট হয়। ছোট ছোট চিকন চিকন হাতে ক্যাণুলা করা, সেখান দিয়ে স্যালাইন চলছে, ক্যানুলার ভিতর দিয়ে ইনজেকশন দেয়া হয়। এসব দেখলে ওর ভালো লাগে না। ব্যথায় কোন কোন বাচ্চা কাদতে থাকে। এসব দেখে প্রিয়ার খুব কষ্ট হয়। তাই ওদের মুখে হাসি ফুটাতে, কিছুক্ষণের জন্য হলেও বাচ্চাদের শারীরিক কষ্ট ভুলিয়ে দিতে ওদের সাথে খেলে, গল্প বলে শোনায়, কারো সাথে বসে ড্রইং করে, কালার করে।কোন কোন বাচ্চাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। এতে বাচ্চারা খুশি হয়। বাচ্চাদের মা বাবাও খুশি হয়। প্রিয়া সব বাচ্চাদের জন্য চকলেট নিয়ে আসে। কখনো চিপস নিয়ে আসে।
ওদের হাসি মুখ দেখলে প্রিয়ার সারাদিনের ক্লান্তি দুর হয়ে যায়। মনে হয় জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই। সব পাওয়া হয়ে গেছে।
_____

হসপিটালে রোজ কোন না কোন অ্যাক্সিডেন্টের রোগী আসবেই। বিভৎস সে দৃশ্য। চোখে দেখা যায় না সে দৃশ্য। ডাক্তারদের তো এমন ভয় পেলে
চলবে না। তাদের তো সব ধরনের রোগীর ট্রিটমেন্ট করেই যেতে হবে। সেবাই যে ডাক্তারের ধর্ম।

আজও একটা অ্যাকসিডেন্ট কেস আসে হসপিটালে। প্রাইভেট কার অ্যাকসিডেন্ট। ড্রাইভার স্পট ডেড। পেশেন্টের অবস্থা খুব খারাপ, মাথা ফেটে রক্তে সারা শরীর মুখ মাখামাখি হয়ে আছে। প্রফেসর স্যারদের সাথে প্রিয়াও ওটিতে প্রবেশ করলো। স্যারদের অ্যাসিস্ট করছে প্রিয়া আরো কয়েকজন প্রিয়ার সমপর্যায়ের ডাক্তার। নার্সরা ছুটোছুটি করে একটার পর একটা জিনিষ এগিয়ে দিচ্ছে। রক্ত ব্যান্ডেজ দিয়ে মুছে দিচ্ছে। পেশেন্ট কে এক ব্যাগ রক্ত দেয়া হলো। প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গেছে শরীর থেকে। স্যালাইন চলছে খুব ধীরে ধীরে।

ওটি শেষ করে সবাই বেরিয়ে গেলো। লোকটা এযাত্রায় বেচেঁ যাবে। রোগীকে পোস্ট অপারেটিভ এ রাখা হয়েছে। আজকে সে ওখানেই থাকবে। কালকে বেডে দেয়া হবে।

পরদিন প্রিয়ার ছুটি, সে আব্বু আর দাদীর সাথে ভালো কিছু সময় কাটাতে চায়। কারণ ওর বাবা ঢাকায় থাকে। একদিন দুদিনের জন্য তারা প্রিয়ার কাছে এসে থেকে যায়। মেয়েকে প্রাণ ভরে দেখে যায়। অনেক কিছু রান্না করে নিয়ে আসে প্রিয়ার জন্য।

প্রিয়া চিটাগাং মেডিকেলের পাশেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা ওর দেখাশোনার জন্য আছে। সেই সব কাজ করে। প্রিয়া শুধু ডিউটি করে আর বাসায় ফিরে বইয়ে মুখ গুজে দেয়। আর কোন দিকে তাকানোর সময় নেই ওর কাছে।

প্রিয়া এই ছয় বছরের মধ্যে একবারের জন্যও ঢাকায় যায়নি। আব্বু আম্মু অনেক বলেছে ছুটি হলে কদিনের জন্য তাদের কাছে গিয়ে থাকতে।

প্রিয়া আর ঢাকা মুখী হয়নি কখনো। প্রচণ্ড একটা অভিমান ওকে আর ঢাকামুখী হতে দেয়নি। একবুক যন্ত্রণা নিয়ে ঢাকা ছেড়েছে। সেখানে আর ফেরার ইচ্ছে নেই।

চট্টগ্রাম আসার পর প্রিয়া ঢাকার সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। পুরনো সিম ফেলে নতুন সিম নিয়েছে। ফেইসবুক ডিয়েকটিভেট করে দিয়েছে। সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।

বাবা মাকে বলেছে কাউকে যেনো কোনভাবেই নতুন নাম্বার না দেয়। আর আমি কোথায় আছি সেটাও যেনো কেউ না জানে। এই পাঁচ বছর আমি একটু নিরিবিলিতে পড়াশুনা করতে চাই।

মিসেস জোবায়দা প্রথমে প্রিয়ার এমন সিদ্ধান্তে একটু অবাকই হয়েছে। পরে ভেবেছে মেয়েটাতো তার এমনই। খুবই আত্মকেন্দ্রিক টাইপের। নিজের কাজিনদের সাথেও খুব একটা মিশতো না।

মিসেস জোবায়দার কাছে ওর বিল্ডিংয়ের বান্ধবীরা, কলেজের বান্ধবীরা ওর ফোন নাম্বার আর ঠিকানা চেয়েছে। তিনি প্রিয়ার কথামত সবাইকে এড়িয়ে গেছে। কাউকেই প্রিয়ার বর্তমান ঠিকানা ফোন নাম্বার দেয়নি।

কিছুদিন পর তারা ওই বাসা ছেড়ে বসুন্ধরায় নিজেদের ফ্ল্যাটে গিয়ে ওঠে।

প্রিয়ার মা জোবায়দা আহমেদ একটা কোর্স করতে লন্ডনে চলে যায় এক বছরের জন্য। এই কোর্সটা শেষ হলে তার অনেক ডিগ্রীর সাথে আরেকটা ডিগ্রী যোগ হবে।

রায়হান সাহেব আর তার মা জমিলা খাতুন বসুন্ধরায় নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে যায়।

দুই একজন খুব কাছের মানুষ প্রিয়ার অনেক খোজ করেছে কিন্তু খুঁজেও কোথাও পায়নি। কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারেনি। কারণ রায়হান আহমেদ একজন ব্যাংক ম্যানেজার। তার মাথার ওপর অনেক দায়িত্ব। তাই অফিস শেষ করে শুধু মাত্র ব্যাগ গুছিয়ে মাকে নিয়ে চলে গেছে। যাবার আগে আশেপাশের ফ্ল্যাটের দুই চারজনকে বলেছিলো তাদের বাসা শিফটের কথা। সবাই খুশি মনেই বিদায় দিয়েছিলো। নতুন ফ্ল্যাটে সব নতুন আসবাব নতুন ফার্নিচার দিয়ে সাজিয়েছে। এই ফ্ল্যাটের সব জিনিস একজন ব্রোকার দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। এমনটাই মিসেস জোবায়দা বলে গেছিলো।

চলবে….

#ভুলে_থাকা_গল্প
#লেখিকা__ইয়ানা_রহমান
#পর্ব_৯

প্রিয়া প্রফেসর স্যারের সাথে রাউন্ডে বেরিয়ে যায়। একেকটা ওয়ার্ড অনেক বড়। সেখানে প্রচুর পেশেন্ট। বেডে পেশেন্ট ফ্লোরে পেশেন্ট এমনকি করিডোরে ও অনেক পেশেন্ট। একেকটা প্যাসেজ বিশাল বড়। সব পেশেন্টের সাথে ভিজিটর আছে। কারো কারো সাথে আছে বাচ্চা। কান্নাকাটি হৈচৈ লেগেই থাকে সারাক্ষণ। কত রকম রোগ নিয়ে যে মানুষ এখানে আসে, কত যে তাদের কষ্ট সেগুলো দেখলেও কষ্ট লাগে।

রাউন্ড শেষে দুদিন আগের অ্যাকসিডেন্ট থেকে বেঁচে যাওয়া সেই পেশেন্টের বেডের পাশেও যায়। সেখানে গিয়ে পুরাই হতভম্ব হয়ে যায়। প্রিয়ার বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো। প্রিয়া দাড়ানোর শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে যেনো। শরীর কাপছে। পাগুলি ফ্লোরের সাথে আটকে গেছে, সেখান থেকে সরে যেতেও পারছে না।

কেমন যেনো একটা কষ্টের অনুভূতি গলা চেপে ধরেছে। নিঃশ্বাস নিতেও খুব কষ্ট হচ্ছে। মেরুদন্ড বেয়ে অস্থিরতার ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। কেউ যেনো নতুন করে কষ্টের রশি দিয়ে পুরো শরীরটাকে বেধে ফেলছে। শরীর অসার হয়ে আসছে। প্রচণ্ড শীতে যেমন গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে তেমনি গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। নিজেই নিজের হাত দিয়ে বাহুতে স্লাইড করছে। শরীরে উত্তাপ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। পেশেন্ট সম্পর্কে স্যার কি বলছে কোন কিছুই কান দিয়ে ঢুকছে না। শুধু মূর্তির মত দাড়িয়ে আছি।

এ কাকে দেখছি আমি? এটাতো ইমন। হ্যা ইমনইতো। এটা কিভাবে সম্ভব? সেদিন অপারেশন টেবিলে আমিওতো ছিলাম। সিস্টার যখন গজ দিয়ে মুখের রক্ত মুছে দিচ্ছিলো তখন দুই একবার নজর গিয়েছিলো পেশেন্টের দিকে,তখন একবারের জন্যও তো মনে হয়নি লোকটা ইমন। অবশ্য রক্তে মুখের বেশির ভাগ অংশই রক্তিম হয়েছিলো। চেহারাটাও বেশ ফোলা ছিলো তাই হয়তো চিরচেনা মানুষটাকে চিনতে পারিনি। আর অপারেশন টেবিলে কাজ করার দিকেই মনোযোগ থাকে পেশেন্টের চেহারা দেখার সময় থাকে না তখন।

প্রায় সাত বছর হতে চললো অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে, অনেক কিছু ভুলেও গেছি। সব ভুলে গেলেও ইমনকে চিনতে ভুল হয়নি। মানুষটা আগের মত নেই, একটু মুটিয়ে গেছে। শ্যামলা গায়ের রং ছিল এখন সেই রং তামাটে বর্ন হয়েছে। শুধু সেই বড়বড় চোখ দুটি অবিকল আগের মতোই আছে। যে চোখ দেখেই একসময় ভীষণভাবে প্রেমে পড়েছিলাম মানুষটার।

কেন আবার দেখা হলো ইমনের সাথে। আমি তো চেয়েছিলাম এই জীবনে যেনো আর কখনো ইমনের সাথে দেখা না হয়। তাইতো সেচ্ছা নির্বাসনের রাস্তা বেছে নিয়েছি, নিজের পরিচিত পরিবেশ থেকে একরকম পালিয়ে এসেছি।

প্রিয়া আর এখানে দাড়াতে চায় না। ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সরতেও পারছে না। শরীরটাকে অতিমাত্রায় ভারি লাগছে। মনে হচ্ছে অশরীরী কোন বিশাল শক্তিধর কিছু ওকে চেপে ধরে রেখেছে।

ইমন একভাবে প্রিয়ার দিকেই তাকিয়েছিল।

প্রিয়ার সাথে রয়েছে আরো ডক্টর, প্রফেসর স্যার,নার্স। এদের সামনে নিজের দুর্বলতা দেখাতে চায় না। আবার ইমনের ওই চোখের দিকে তাকানোরও ক্ষমতা নেই।

ডক্টর যখন ইমনকে পরীক্ষা করছে আর স্যার ইমনের ফাইল দেখছে, তখন আমি আস্তে করে সিস্টারকে বললাম, রশ্মি দিদি স্যার আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবেন আমার শরীর হঠাৎ অসুস্থ লাগছে, তাই আমি কিছুক্ষণের জন্য রেস্ট রুমে চলে গেলাম।

সিস্টার রশ্মি বললো, খুব বেশি কি খারাপ লাগছে? স্যারকে বলবো?

না স্যারকে কিছু বলতে হবে না। একটু পর এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।
প্রিয়া ইমনের বেডের পাশ থেকে বেরিয়ে এলো।

প্রিয়া রেস্ট রুমে চেয়ারে বসে ডেস্কের ওপর মাথা রেখে শুয়ে আছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। ওই পাষণ্ডটাকে আর কোনদিন দেখবে এটা ভাবেনি। মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। আবার কেনো সেই মানুষটার মুখোমুখি হতে হলো।

প্রিয়ার ক্লাসমেট রাফি এসে জিজ্ঞেস করে, প্রিয়া তোর কি হয়েছে? রশ্মি দিদি বললো তোর নাকি শরীর খারাপ লাগছে।

হুম, একটু খারাপ লাগছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। শরীর কাপছে, চোখগুলোও জ্বালা করছে।

রাফি বলল, হাত দে তোর প্রেসারটা চেক করি। আর চোখ এতো লাল কেন? কেদেছিস নাকি?

না কাদবো কেনো, কাদার কি কোন কারণ আছে? মাথা ধরেছে তাই হয়তো চোখ লাল হয়েছে।

রাফি প্রেসার চেক করে বললো, প্রেসার সামান্য লো, এটা তেমন কোন সিরিয়াস ব্যাপার না। একটা ওরস্যালাইন খেয়ে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। রাফি এক গ্লাস ওরস্যালাইন গুলে এনে প্রিয়াকে খেতে বললো। আমার মনে হয় তুই প্রোপার রেস্ট নিচ্ছিস না, আমার ধারণা খাওয়া দাওয়াও ঠিকমত করছিস না, তাই শরীর উইক লাগছে। প্রতিদিন ডিউটি করছিস আবার বাসায় গিয়ে পড়াশুনা করতে হয়। এতো ধকল শরীর সইবে কেনো?
আমি বলি কি তুই আজ বাসায় যা রেস্ট নে। আমরা সবাই আছি তো সমস্যা হবে না।

প্রিয়া স্যালাইন খেয়ে নিলো। ও নিজেও ভাবলো এখান থেকে চলে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো হবে। এখন একটু একা থাকা প্রয়োজন। স্যারকে বলে ছুটি নিয়ে প্রিয়া বাসায় চলে আসে।

রুমের দরজা বন্ধ করে নিজের বেডে উপুর হয়ে বালিশে মুখ গুজে অনেক কাদে প্রিয়া। কাদতে কাদতে হিচকী উঠে যায়। বুকের ভিতরের কষ্ট গুলো যেনো আজ একসাথে পাল্লা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কার আগে কে বর্ষণ হয়ে ঝরতে পারে। বুকের জমাট বাঁধা কষ্টের বরফ খন্ড গলে দুচোখ দিয়ে উপচে পড়ছে।

ইমন কেনো এলো, পুরনো চাম ধরা ঘা টা আবার কাচা হয়ে গেলো। ভালোই তো ছিলাম দূরে এসে সব ভুলে ছিলাম। কেন আবার কাদাতে এলো প্রতারকটা।

সেদিনের কথা আমি কোন দিন ভুলবো না। আমার জীবনের এতবড় ট্রাজিডি আমি কি করে ভুলবো। প্রিয় মানুষটাই যে কলিজাকে কেটে টুকরো টুকরো করেছে। সেই বেঈমান একবারও ভাবেনি আমার কথা। ঠকিয়ে গেছে আমাকে।

ফ্ল্যাশব্যাক__

প্রিয়া মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার আগে কয়েকদিন পড়াশুনা নিয়ে খুব বিজি ছিলো। ইমনের সাথে মাঝে মধ্যে ফোনে হাই হ্যালো ছাড়া বিশেষ কোন কথা হতো না। প্রিয়া পড়ছে শুনলে ইমনও ডিস্টার্ব করতো না কখনো।

কয়েকদিন ইমনের সাথে কোন যোগাযোগ হয় নি।
এদিকে প্রিয়ার ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। প্রিয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে। ম্যারিট লিস্টে ওর নাম এসেছে।

আজ আমি অনেক খুশি। এতো দিনে আমার স্বপ্ন পূরণ হলো। আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের মত একটা কলেজে পড়বো এটা ভাবতেই খুশিতে গড়াগড়ি খেতে ইচ্ছে করছে।

আম্মু আব্বুকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে সুখবরটা।

ইমনকে ফোন দিল খুশির খবরটা জানাতে আর দেখা করবে বাইরে কোথাও। অনেকদিন দেখা হয় না দুজনের। ইমনকে দেখার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে। ইমন ফোন ধরলো না। প্রিয়া ঠিক করলো আজ ইমনের বাসায় যাবে। এই টাইমে কেউ বাসায় থাকে না। ইমনের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা তাই সে বাসায় বসে পড়াশুনা করে, বাইরে খুব একটা যায় না। এটা আগে একদিন প্রিয়াকে বলেছিলো।

প্রিয়া দোয়া পড়ে বুকে ফু দেয় যেনো কারো কাছে ধরা না পরে। খুব সাহস করে ইমনদের বাসায় যায়। মেইন দরজাটা লক করা ছিলো না একটু ফাঁক করা দেখে নক না করেই ঢুকে পরে প্রিয়া। কোন রুমটা ইমনের সেটা সে জানে না। সব রুমের দিকে নজর ঘোরালো। আর একটা রুম দেখা বাকি। মনে হয় ওটাই ইমনের রুম।

ইমনকে সারপ্রাইজ দিবে ভেবে পা টিপে টিপে ইমনের রুমের দরজার কাছে যেতেই প্রিয়ার চোখ কপালে উঠে যায়। হতবিহ্বল হয়ে যায়, ওর চোখের সামনে ওর দুনিয়াটা কেপে ওঠে। মুহূর্তেই ওর স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। আকাশ ভেঙ্গে পরে মাথায়। যা দেখছে সেটা বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু যা ঘটছে ওর চোখের সামনেই ঘটছে। চোখের দেখাকে অবিশ্বাস করবে কিভাবে?ওর বুক চিড়ে কান্না বেরিয়ে আসে। শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে।

এটা কি সত্যি আমার ভালোবাসার মানুষ? এই জঘন্য মানুষটাকেই আমি এতদিন যাবত পাগলের মত ভালোবেসে আসছি। এই আমার হৃদয় নিংড়ানো সত্যিকারের ভালোবাসার প্রতিদান?

প্রিয়া দেখে, একটা হ্যাংলা পাতলা মেয়ে পরনে জিন্স টপস পরা। সেই মেয়ে ইমনকে জড়িয়ে ধরে আছে।
ইমনও মেয়েটাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে রেখেছে। সেই মেয়ের পিঠে হাত দিয়ে স্লাইড করছে।

মেয়েটা আর কেউ না, চম্পা।
প্রিয়া ইমনের কাছে ভাবীমার বোন চম্পার কথা শুনেছিল।

ইমন বলেছিলো অল্প কয়েকদিন হয় ভাবিমার বোন চম্পা আমাদের সাথেই থাকে। হোস্টেলে থাকতো ভাবীমা জোর করে এখানে নিয়ে এসেছে। ওখানকার খাওয়া দাওয়া ভালো না। রুম শেয়ার করতে হয়। আরো কিছু ছোটখাট প্রবলেম ছিলো তাই এখানে নিয়ে এসেছে।

ইমন চম্পার এমন ঘৃণ্য দৃশ্য দেখে প্রিয়ার মাথা ঘুরে যায়। সে পড়ে যেতে গিয়ে দরজার পাল্লার সাথে বারি খায়। তখন দরজার আওয়াজে ইমন দেখে প্রিয়া ঘৃণার দৃষ্টিতে কান্না ভেজা চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।

ইমন চম্পাকে সরিয়ে দিয়ে ছুটে গেলো প্রিয়ার কাছে।

প্রিয়া হাত বাড়িতে থামতে বললো। কাদতে কাদতে বললো, স্যরি আমি ভুল টাইমে এসেছি। তারপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়।

ইমন পিছনে পিছনে ডাকতে থাকে কিন্তু প্রিয়া আর ফিরেও তাকায় নি।

বাসায় ফিরে কান্নায় ভেংগে পরে। কিভাবে পারলো ইমন আমার সাথে প্রতারণা করতে। তাহলে কি ওর চরিত্র খারাপ? যেটা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। আমার ভালোবাসার এমন করুন পরিনতি হবে এটা তো কখনো ভাবিনি।

চম্পাকে নিয়ে কোনদিন আমার মনে সন্দেহ হয়নি। একবারের জন্যও মনে হয়নি ওদের মাঝে ভালোবাসা কিংবা ফিজিক্যাল কোন সম্পর্ক হতে পারে।

প্রিয়া ওর আম্মুর সাহায্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে মাইগ্রেট করে চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজে গিয়ে পড়াশুনা শুরু করে। সেই যাইয়াই অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে।

বর্তমান__

ইমনের মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ব্যান্ডেজ, ডান পায়ে প্লাস্টার করা।
বেড থেকে উঠতে পারে না।
খবর পেয়ে প্লেনে করে চলে এসেছে রাশেদ আর মামুন।
দুদিন যাবত ওরা ইমনের সাথেই আছে। ওয়ার্ডে থাকতে ওদের খুব অসুবিধা হচ্ছে। বিছানা বালিশ কিচ্ছু নেই। বসে বসে সময় কাটাতে হয়। এটা সরকারি হসপিটাল,প্রাইভেট হসপিটালের মত এত হাইফাই চকচকে ঝকঝকে না। একেকটা টয়লেট অনেকজনকে ব্যবহার করতে হয়। তার ওপর অসংখ্য রোগীর চাপ।

ইমনের ভাই ভাবি ওর অ্যাক্সিডেন্টের খবর পায়নি, তারা দেশের বাইরে আছে। ইমন তাদের অ্যাক্সিডেন্টের খবর জানাতে নিষেধ করেছে। খামাখাই ভাইয়া ভাবী টেনশন করবে। কাজ ফেলে ছুটে আসবে।

রাশেদ ইমনকে ঢাকায় নিয়ে প্রাইভেট হসপিটালে ট্রিটমেন্ট করাতে চাচ্ছে। এখানে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নেই। ঢাকায় ভালো জায়গায় ট্রিটমেন্ট করলে তুই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবি। চল একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে তোকে নিয়ে যাই।

ইমন এখানেই চিকিৎসা নিবে যতদিন সুস্থ না হয় সে কথা সাফ জানিয়ে দেয়।

তোরা ঢাকায় ফিরে যা। আমার এখানে কোন সমস্যা হচ্ছে না। তোদের বউ বাচ্চা আছে। ওরা টেনশন করবে।

তুই এখানে একা একা কিভাবে থাকবি? সারা শরীর ভাংচুরে ভরা। বেডপ্যান ইউজ করতে হয়। দুজন লোক লাগে তোকে তুলতে। আর এই অবস্থায় তোকে ফেলে কি করে যাই তুইই বল।
তুই যে জন্য এখানে থাকতে চাচ্ছিস, এতে সে ফলস পজিশনে পড়তে পারে। এতদিনে তার নিশ্চয়ই ঘর সংসার হয়েছে। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখেই আছে নিশ্চয়ই।

তোদের সব কথা মানলাম তবুও আমি ওর সাথে কথা না বলে এখান থেকে যাবো না। ওকে আমার সব কথা শুনতেই হবে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here