ভুলে_থাকা_গল্প,১০,১১

#ভুলে_থাকা_গল্প,১০,১১
#লেখিকা__ইয়ানা_রহমান
#পর্ব_১০

ইমন বললো আমি প্রিয়ার সাথে কথা না বলে কোথাও যাবো না। ও আমাকে ভুল বুঝে নিজেকে সবার কাছ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছে। নিজেও কষ্ট পাচ্ছে, ওর বাবা মাও কষ্ট পাচ্ছে, আমিও এতো বছর ধরে কষ্টের সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছি। ওর ভুল ভাঙাতেই হবে।

সকাল থেকেই স্টুডেন্টদের, ইন্টার্ন ডাক্তারদের আনাগোনা চলতে থাকে। প্রত্যেক নতুন রোগীর কেস হিস্ট্রি লিখতে থাকে। জটিল কোন রোগ নিয়ে স্যার স্টুডেন্ট রোগীর সামনেই ক্লাস নেয়। সবসময় ওয়ার্ডগুলি সরগরম থাকে বিশেষ করে সকালে লোকে লোকারণ্য থাকে।

প্রিয়া একটা ওয়ার্ডের দায়িত্বে আছে। আজকে ডিউটিতে এসে দেখে ইমন প্রিয়ার ওয়ার্ডে। তাও আবার প্রিয়ার টেবিলের সবচেয়ে কাছে যেই বেড আছে সেখানে ইমন আধ শোয়া হয়ে বসে আছে। পাশে রাশেদ ভাইয়া দেয়ালে হেলান দিয়ে আধো খোলা চোখে ঘুমাচ্ছে।

প্রিয়া কিছুই বুঝলো না কিভাবে কি হয়েছে। সেদিকে মাথা ঘামালো না। যা হয় হোক আমি ওসব দিকে অদেখা করে থাকবো। অন্য সব পেশেন্ট আমার কাছে যেমন ইমন চৌধুরীও আমার একজন পেশেন্ট। এর বেশি কিছু না।

প্রিয়া প্রত্যেক বেডে গিয়ে পেশেন্টেদের খোঁজ খবর নিলো। কার কি সমস্যা জেনে নিয়ে সেগুলির মোটামুটি সমাধান করলো আর কিছু পেশেন্টের সমস্যা স্যার আসলে স্যারের কাছে বলতে বললো।

ইমনের বেডের কাছে গিয়ে হাসি মুখে ইমনকে জিজ্ঞেস করলো কেমন আছেন আপনি?আজকে শরীর কেমন বোধ করছেন? ব্যথা কি কিছু কমেছে?

ইমন প্রিয়ার দিকে অপলক চোখে চেয়ে থেকে বললো, কালকে পর্যন্ত ভালো ছিলাম না। আজকে শরীরটা ভালো লাগছে। ঝরঝরে লাগছে। ইমন মুগ্ধ চোখে প্রিয়াকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখছে।

প্রিয়া আজ হালকা ফিরোজা কালারের একটা থ্রি পিস পড়েছে। থ্রি কোয়ার্টার হাতা। বা হাতে সিলভার কালারের ব্র্যান্ডের একটা লেডিস ঘড়ি। ডান হাতে স্বর্ণের চিকন একটা ব্রেসলেট, গলায় সেই আগের চেইনটা পরা। কথা বলার সময় যখন গলা নড়ে, চেইনটা তখন আলো পরে চিকচিক করে অসম্ভব সুন্দর লাগে তখন। ঘোর লেগে যায় সেই গলার দিকে তাকালে। চোখ ফেরানো যায় না। চোখে কাজল ঠোঁটে হালকা পিং কালারের লিপস্টিক, লম্বা ঘন চুলগুলি পনিটেল করে বাধা। কামিজের ওপর হাফ হাতা সাদা এপ্রোন অসাধারণ লাগছিলো দেখতে।
প্রিয়া সেই আগের মতই আছে নাকি আরো সুন্দর হয়েছে এটা বুঝতে পারছে না ইমন। অতৃপ্ত নয়নে প্রিয়ার দিকে চেয়ে আছে।

প্রিয়া বললো গুড, নিয়ম মেনে চললে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন আশা করি।

ওদের কথার শব্দ পেয়ে রাশেদ জেগে ওঠে।

প্রিয়া ইমনের পালস্ ব্লাড প্রেসার চেক করলো। থার্মোমিটার দিয়ে গায়ের তাপমাত্রা চেক করলো।

প্রিয়া বলছে আর ফাইলে সব লিখে রাখছে একজন সিস্টার।

প্রিয়া সিস্টারকে সাথে নিয়ে ইমনের কাটা ছেড়া জায়গা গুলি ভালোভাবে ড্রেসিং করলো। নতুন করে আবার ব্যান্ডেজ করে দিলো।

একজন ওয়ার্ড বয়কে ডেকে বললো, মামা হালকা গরম পানি দিয়ে ওনার সারা শরীরটা ভালো মত মুছে দিন। হাতে পায়ের নখের কোনায় কোনায় রক্ত শুকিয়ে আছে, সেগুলি পরিষ্কার করে দিয়েন। মোছা হয়ে গেলে কাপড় চেঞ্জ করে দিয়েন।

রাশেদের উদ্দেশ্যে বললো আপনার পেশেন্টের কাপড় দেন মামার কাছে, মামা ওনাকে পরিয়ে দিয়ে যাবে। ময়লা কাপড় চেঞ্জ না করলে ইনফেকশন হয়ে যাওয়ার ভয় আছে। তিন দিন যাবত উনি একই কাপড় পরে আছেন।

রাশেদ বললো, আমি আসলে নিজের কাপড়ও আনিনি, দুর্ঘটনার খবর পাওয়া মাত্রই চলে এসেছি। আমি এখনই মার্কেট থেকে কিনে নিয়ে আসছি।

আর আপনাদের পেশেন্টকে নিয়ে এই সরকারি হসপিটালে পড়ে আছেন কেন? ঢাকায় শিফট করছেন না কেনো?
আপনাদের তো অ্যাফর্ট করার ক্ষমতা আছে। সেখানে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা নেয়া উচিত।

আমি সে কথা বলে বলে হয়রান। ইমন এখানে থেকেই ট্রিটমেন্ট করাবে। তারপর একটা কেবিনের জন্য চেষ্টা করছিলাম সেটাতেও ইমন বাধা দিয়েছে। তারপর এখানে অনেক চেষ্টার পর ব্যবস্থা করেছি। এখন মনে একটু স্বস্তি পাচ্ছি অন্তত তোমার চোখের সামনে তো থাকবে। ভালো মন্দ সব তুমি দেখবে।

আমি তো পুরো দিন থাকি না। আপনি বরং ওনাকে ঢাকায় নিয়ে যান। সেটাই ওনার জন্য ভালো হবে।

রাশেদ বললো, প্রিয়া আপু নীপার মাধ্যমে আমি তোমাকে চিনি। তুমি বয়সেও আমার ছোট তাই তোমাকে তুমি করেই বলছি কিছু মনে করো না।

না আমি কিছু মনে করিনি। নীপা কেমন আছে? কি করছে ও আজকাল?

নীপার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে চার বছর আগে। আমাদের এক বছরের একটা ছেলে আছে। নীপা ঘর সামলায় আর বাচ্চার দেখাশোনা করে। আপাততো আর কিছুই করছে না।

খুব ভালো খবর। অভিনন্দন আপনাদের জন্য।

তুমি সেই যে উধাও হলে আর তোমার দেখা পাইনি। জানো আমি আর ইমন তোমাকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোথাও তোমাকে পাইনি। নীপার মাধ্যমে তোমার অন্যান্য বান্ধবীদের মাধ্যমে তোমার খোঁজ জানার অনেক চেষ্টা করেছি সেখানেও ব্যর্থ হয়েছি। এখন এতো বছর পর তোমাকে পেয়েছি।
তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই। নিরিবিলিতে।

প্রিয়াকে একজন পেশেন্ট ডাকছিল, তখন সিস্টারকে সেই বেডে পাঠিয়ে দিলো।

আমার সাথে কথা বলবেন? কি বিষয়ে কথা বলবেন? বলেন,

ইমনের বিষয়ে কথা বলতে চাই।

ওনার শারীরিক বিষয়ে নাকি অন্য কিছু?

অন্য কিছু নিয়ে জরুরি কথা বলতে চাই।

স্যরি ভাইয়া আমার সময় হবে না।আমি ভীষন বিজি।

এরমধ্যে রাফি, রেজা, মাহির, সাদাফ, জেনিফার, ফাহিমা সবাই এলো প্রিয়ার টেবিলে।

প্রিয়া বললো, তোরা সব একসাথে এখানে কি কারণে?

তোর নাকি শরীর খারাপ করেছিলো? এখন কেমন আছিস? কি হয়েছিলো?

কে বলেছে আমি অসুস্থ?

রাফির কাছে শুনলাম। বললো মাহির।

রাফি তুই না আমার যক্ষ্মা বানিয়ে ছাড়বি।
তুই ঠিক মহিলাদের মত, কোন কথা পেটে থাকে না। আজ থেকে তোর নাম ঠোঁট পাতলা ডাক্তার।

জেনিফার বললো, তুই রাফির ওপর রেগে যাচ্ছিস কেনো? আমরা তোর ফ্রেন্ড, আমরা জানবো না তোর কোন কিছু হলে।

প্রিয়া বললো, তেমন কিছু হয়নি। এখন ভালো আছি সুস্থ আছি। সুস্থ আছি বলেই তোদের সামনে দেখতে পাচ্ছিস।

চল ক্যান্টিনে যাই কফি খেয়ে আসি। সেখানে বসে কিছুক্ষন গল্প করে আসি। সারাদিন এতো রোগীর ভিড়ে নিজেকেও অসুস্থ মনে হয়। বললো রাফি।

এখন গল্প করার সময় নেই, কালকের কিছু কাজ জমে আছে সেগুলি করতে হবে।তোরা যে যার ওয়ার্ডে যা। স্যারের আসার সময় হয়ে গেছে।স্যাররা এসে যদি দেখে ওয়ার্ডে কোন ডিউটি ডাক্তার নেই তাহলে খুব রেগে যাবে।

একটা কথা বলে তারপর যাই, সাদাফ বললো, কোম্পানি থেকে আমরা যে সবাই রয়েল টিউলিপ যাবো সেটা সবার মনে আছে তো? নাকি ভুলে গেছিস।

কবে যেনো? সত্যিই মনে নেই। বললো রেজা।

ফাজলামি করিস?আর মাত্র দশ দিন পর। একের পর এক করে কয়েকটা গ্রুপ যাবে।
আমার বলার উদ্দেশ্য হলো আমরা ফ্রেন্ডরা যেনো একই গ্রুপ থাকি সেটা লিস্ট করার সময় খেয়াল রাখিস।

প্রিয়া বললো, দশ দিন পরে আমি কোন ভাবেই যেতে পারবো না। তের দিন পর আমার একটা পরীক্ষা আছে।পরীক্ষার আগে যেতে পারবো না।

তুই না গেলে আমিও যাবো না। বললো রাফি। তোর যেদিন সময় হবে সেদিনই যাবো।

তাহলে শেষের দিকের গ্রুপে আমাদের নাম দিয়ে দে। আরেকটা কথা আমি কিন্তু কারো সাথে রুম শেয়ার করবো না। প্রয়োজনে আমি আমার টাকায় রুম ভাড়া করবো।
এটা কোম্পানিকে জানিয়ে রাখিস।

স্যার এলে রাউন্ডে চলে গেলো প্রিয়া সহ আরো কয়েকজন ডিউটি ডাক্তার।
রাউন্ড শেষ হলে প্রিয়া ওয়ার্ডে এসে নিজের চেয়ারে বসে। ইমনের দিকে চোখ পরতেই দেখলো সে আগের শার্ট চেঞ্জ করে নতুন টিশার্ট পড়েছে। কোমর পর্যন্ত চাদর টেনে শুয়ে আছে। চোখ আমার দিকেই নিবন্ধ। রাশেদ ভাইয়াও সেম।

মাম্মাম মাম্মাম আমি চলে এসেছি তোমার কাছে। বলতে বলতে একটা বাচ্চা দৌড়ে এলো প্রিয়ার কাছে।

প্রিয়া বললো, টুইংকেল তুমি হসপিটালে কেনো এসেছো?এখানে অনেক জার্মস আছে, বলেছি না? আমি নিষেধ করছি না এখানে আসতে। তবুও তুমি এখানে এসেছো? তুমি কার সাথে এসেছো? তোমার বাবাই কোথায়?

বাবাই এর সাথেই তো এসেছি মাম্মাম। বাবাই অনেক পিছনে, আমি আগে আগে দৌড়ে চলে এসেছি তোমার কাছে। তোমার জন্য আমার মন কেমন করছিলো।

প্রিয়া ওর কথা শুনে হেসে ফেলে। একটু ঝুঁকে টুইঙ্কেলের কপালে একটা চুমু দেয়।

একজন পেশেন্ট বলে এই পাকনা বুড়িটা কি আপনার মেয়ে?

কি মনে হয় আপনার?

আমার তো আপনার বাচ্চা বলেই মনে হচ্ছে। আপনার চেহারার সাথে অনেক মিল।

প্রিয়া কিছু না বলে শুধু একটু হাসলো।

টুইংকেল বলে উঠলো মাম্মাম ওই তো বাবাই এসে পড়েছে।

আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে গেলাম। ধ্রুব এসে ঢুকলো। বললো তোমার মেয়েকে কিছুতেই ঘরে রাখতে পারছিলাম না। সে কি কান্না তোমার কাছে আসবে।

বাবাই এবার তুমি যাও আমি মাম্মামের কাছে থাকবো।

ধ্রুব বললো প্রিয়া ও কিছুক্ষন তোমার কাছে থাকুক, আমি একটু কাজ সেরে আসি।

ধ্রুব এই সময়ে হঠাৎ কোথায়? বিকেলে গেলে হয় না? টুইংকেলও তখন সাথে যেতে পারতো, ওর একটু ঘুরাও হয়ে যাবে তাতে।

আমি আসলে ব্যাংকে যাচ্ছি। টাকা তুলতে হবে।
ধ্রুব আর প্রিয়া কথা বলতে বলতে বাইরে বেরিয়ে গেলো।

ইমন বাচ্চাটার প্রিয়াকে মাম্মাম বলতে শুনে শকড হয়েছে। তারপর ধ্রুব নামের লোকটাকে দেখে আরো বেশি শকড হয়েছে। বুঝে গেছে প্রিয়া আর ওর নেই। ধ্রুব নামের লোকটা প্রিয়ার হাসবেন্ড আর টুইংকেল প্রিয়ার মেয়ে। ইমনের চোখ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। এই মুহূর্তে পৃথিবীটাকে অর্থহীন মনে হচ্ছে।
সব কিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ওর প্রিয়তমা প্রিয়া আর ওর নেই। নিজের অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য হারিয়ে ফেললো ওর ভালোবাসার মানুষটাকে।

চলবে…..

#ভুলে_থাকা_গল্প
#লেখিকা__ইয়ানা_রহমান
#পর্ব_১১

চম্পা ইমনকে প্রথম দিন দেখার পর থেকেই ওর ভালো লাগতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে সেই ভালো লাগা ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে। এখন যে কোন মূল্যে ইমনকে ওর চাইই চাই। একতরফা ভাবে ইমনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে চম্পা।

ইমন এই ব্যাপারে কিছুই জানে না। সে প্রিয়ার প্রেমে মত্ত। প্রিয়া ছাড়া দুনিয়ার কোন নারী ওর চোখে মোহনীয় না। প্রেমময়ী না। বিয়ে যদি করতে হয় একমাত্র প্রিয়াকেই বিয়ে করবে না হলে চিরকুমার থাকবে।

ছলে বলে কৌশলে একটু একটু করে ইমনের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে তুলেছে চম্পা।

চম্পার ধারণা বন্ধু হতে হতে অনেকটা কাছে চলে এসেছি, এখন প্রেমের প্রস্তাবে সারা দেয়াটাই বাকি। প্রেমের প্রস্তাবেও রাজি করাবই, সেটা বাই হূক ওর ক্রুক। ডেস্পারেটলি ভালোবেসে চলেছে ইমনকে।

যখন তখন ইমনের ঘরে চলে আসা, ওর বিছানায় বসে গল্প করা, ইমন বাসায় না থাকলে ওর বিছানায় শুয়ে থাকা, ইমনের কাবার্ড খুলে ওর কাপড় বের করে বুকের সাথে জাপটে ধরে নাক ডুবিয়ে সেগুলির ঘ্রান নেয়া। নিজের পরনের জামার ওপর
ইমনের ঘাম শুকনো টিশার্ট পরে থাকা, সেই ময়লা টিশার্টের কলার টেনে নাকের কাছে এনে গন্ধ নেয়া।

পড়া বুঝে নেয়ার বাহানায় অনেক রাত অব্দি ইমনের সাথে সময় কাটানো, চা কফি বানিয়ে নিয়ে এসে দুজনে একত্রে বসে গল্প করতে করতে খাওয়া। টিকটিকি তেলাপোকা দেখে মিথ্যে ভয় পেয়ে যখন তখন ইমনকে জড়িয়ে ধরা।
এতোটাই ডেস্পারেট হয়ে গেছিলো।

ইমনের ভাবি লিজাকে দিয়ে ইমনকে বলে ওর বাইকে ভার্সিটিতে যাওয়া, কখনো কখনো ইমনকে জোর করে শপিং করতে নিয়ে যাওয়া। রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়া সব চলছিলো।

লিজা জানতো না ইমন কারো সাথে রিলেশনে আছে। কারো সাথে রিলেশনে যেহেতু নেই তাই সে চাইতো ইমন নিজের ইচ্ছায় চম্পাকে পছন্দ করুক। যেহেতু ইমনকে সে ছেলের মত দেখে তাই সে তার নিজের পছন্দ ইমনের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়নি। কিন্তু মনে মনে চাইতো ইমন আর চম্পার মাঝে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠুক।
ইমন চম্পার গভীর বন্ধুত্ব লিজার নজর এড়ায়নি। তাই সম্পর্কটাকে আরেকটু এগিয়ে দিতে সে নিজেই বলতো,
ইমন চম্পা সারাদিন একা থাকে ওকে কোথাও একটু ঘুরতে নিয়ে গেলেও তো পারিস। একটা মানুষ কতক্ষন ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে পারে। একটু শপিংয়ে নিতে যা, বাইরে কোথাও ডিনার করে আয়। আমি তো মোটের ওপর সময় পাই না। সেটা তোর চাইতে ভালো আর কেউ জানে না। সময় পেলে আমি নিজেই ওকে সময় দিতাম, ঘুরতে নিতাম। আমার কাছে এসে চম্পা ভালো নেই এটা মামা মামী জানলে আমার সম্পর্কে কি ভাববে আর কত কষ্ট পাবে ভেবেছিস একবার?

ইমন কোন কথা বলতো না শুধু
করুন চোখে ভাবিমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। ভাবিমা ওর কাছে অনেক সম্মানের অনেক আদরের বিশেষ একজন মানুষ। তার কথা অমান্য করার সাধ্য ইমনের নেই। বিনা বাক্য ব্যয়ে মাথা নিচু করে ভাবিমার কথা মেনে নিত।
একদিন লিজা ইমনকে আদেশ করলো আজ থেকে চম্পাকে তোর বাইকে করে ভার্সিটিতে নিয়ে যাবি। দুইদিন ধরে ও ক্লাস মিস করছে। আজকাল ঢাকার রাস্তায় কত জ্যাম জানিসই তো। রিক্সায় জ্যাম ঠেলে যেতে যেতে ওর ক্লাস মিস হয়ে যায়।
বাধ্য হয়ে ইমন ভাবীমার এই কথাও মেনে নেয়।
এই সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিলো চম্পা।

ইমনের বাইকে উঠে চম্পা ভয়ের বাহানা করে ইমনকে জোরে জাপটে ধরে রাখে।

ইমনের খুব অস্বস্তি ফিল হয়। ইমন ছাড়তে বলে কিন্তু চম্পা ছাড়ে না বলে আমার ভয় লাগে যদি পরে যাই তাহলে খুব ব্যাথা পাবো আর ফ্রীতে পাবলিক সিনেমা দেখবে।

ইমন হেসে বলে ভীতুর ডিম একটা। আমার গার্লফ্রেন্ড যদি তোমার আমার এই দৃশ্য দেখে সোজা হার্ট ফে/ল করবে।

চম্পা বলে দেখবে না, প্রিয়া এখন কলেজে নয় তো পড়ার টেবিলে। বা বা যেই লেভেলের ভালো স্টুডেন্ট আপনার গার্লফ্রেন্ড সে নিশ্চয়ই আপনাকে দেখতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকবে না।

এই কথার উত্তরে ইমন হো হো করে হাসতে থাকলো বললো এই কথাটা একদম ঠিক বলেছো। প্রিয়া খুব পড়াকু টাইপের মেয়ে।

ইমন আর চম্পা যেহেতু ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে তাই ইমন প্রিয়ার সাথে ওর রিলেশন চলছে এই কথা শেয়ার করেছে। মোবাইল থেকে প্রিয়ার ছবি দেখিয়েছে।

চম্পা ইমন আর প্রিয়ার প্রেমটা একদম মেনে নিতে পারেনি। সে সুযোগ খুঁজছে ওদের প্রেম পিরিতি ভে/ঙ্গে গুড়িয়ে দিতে।
ওদের আমি কিছুতেই এক হতে দিবো না। কিছুতেই না। ইমন শুধু আমার। এতো সাধনা করছি ইমনকে পাওয়ার জন্য, সেটা মিথ্যে হতে দিবো না। যেমন করেই হোক ওদের আলাদা করবোই।

ঘটনার দিন চম্পা গোসল করে এসে ওর ঘরের বারান্দায় দাড়িয়ে চুল শুকাচ্ছিলো। হঠাৎ সে দেখলো প্রিয়া এদিক সেদিক তাকিয়ে ওদের বিন্ডিংয়ের দিকে এগুচ্ছে। ধূর্ত চম্পা বুঝে গেলো প্রিয়া এই বাসায়ই আসছে। হুট করেই ওর মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল। মেইন দরজাটা লক খুলে জাস্ট ভেজিয়ে রাখলো।

সে দৌড়ে ইমনের ঘরে চলে গেল।
সেখানে গিয়ে ইমনকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।
ইমন ছাড়াতে চাইলেও চম্পাকে ছাড়াতে পারলো না। চম্পা ইমনকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

ইমন বললো কাদঁছো কেনো চম্পা,
বলো আমাকে। কিছু না বলে শুধু কেঁদেই যাচ্ছো।

চম্পা বললো, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আজকে কিছুক্ষন আগে মারা গেছে। আমি ওর মৃত্যুর কথা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।

কিভাবে মারা গেলো আর তুমি কিভাবে জেনেছো?

বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মা/রা গেছে। এই মাত্র ফোন এসেছিলো।

ইমন ওর নিরব কান্নার সহানুভূতি জানাতে ওর পিঠে স্লাইড করে যাচ্ছিলো। এ্যাট দ্যা মোমেন্ট প্রিয়া সেখানে হাজির হয়। আর এই দৃশ্য দেখে।

প্রিয়া ইমনকে ভুল বুঝে কাদতে কাদতে চলে যায়।

ইমন প্রিয়াকে ডাকতে ডাকতে ওর পিছু নেয়।

চম্পা নিশ্চিন্ত হয়ে একটা কুট হাসি দেয়। যে হাসির অর্থ যতই প্রিয়া প্রিয়া করো আর আসবে না সে। তোমাকে আমার কাছেই ফিরতে হবে। তুমি আমার শুধু আমার প্রিয়ার বা অন্য কারো না।

এরপর প্রিয়ার সাথে ইমনের আর দেখা হয়নি। প্রিয়া যেনো কোন অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।

ইমন কিছুদিন খুব ডিপ্রেশনে ছিলো। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো বিছানায়।

চম্পা কোনভাবেই ইমনের অসুস্থতার কারণ লিজাকে বা লিমনকে জানতে দেয়নি।
কারণ লিজা আর লিমনের কাছে ইমন ছেলের চেয়ে কোন অংশে কম না। তারা কারণটা জানতে পারলে যেমন করেই হোক প্রিয়াকে ইমনের জীবনে ফিরিয়ে আনবে। এটা চম্পা কোনভাবেই হতে দিবে না।

চম্পা ইমনের সেবা করে চোখের জলে ভেসে। বলে আমার ভুলের জন্য আজ আপনি এত কষ্ট পাচ্ছেন। আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। আমি নিজে যাবো প্রিয়ার কাছে। সব খুলে বলবো, প্রিয়াকে ফিরিয়ে আনবো যে করেই হোক।

ইমন খুশি হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে। বলে,
পারবে চম্পা আমার প্রিয়াকে ফিরিয়ে আনতে?
এনে দাও আমার ভালোবাসাকে। আমি প্রিয়াকে ছাড়া বাঁচবো না। বেচেঁ থাকতে চাই না। প্রিয়াকে ছাড়া আমার দুনিয়া অন্ধকার। ওকে ছাড়া জীবন আমি কল্পনাও করতে পারি না।

চম্পা মনে মনে কুটিল হাসি হাসে বলে, এতো বুদ্ধি করে সরিয়েছি কি ফিরিয়ে আনতে?
এবার এমন কিছু করবো যে ওর প্রতি ভালোবাসা আর থাকবে না। তুমি নিজে আর ওর নাম নিবে না।

একদিন চম্পা কাদতে কাদতে ইমনকে বলে, আমি ভুল করে ওই প্রিয়ার কাছে গেছি, একটা বাজে মেয়ে ওই প্রিয়া। খুব বাজে,

ইমন ঠাটিয়ে এক চ/ড় মা/র/লো চম্পার গালে। তোমার এতবড় সাহস তুমি আমার ভালোবাসার মানুষকে বাজে বলো। এতো সাহস তুমি কোথায় পেলে? যাও আমার সামনে থেকে।

চম্পা আহ্লাদী কান্না কেঁদে বলে, আগে আমার কথাটা তো শুনবেন।
আমি প্রিয়ার কাছে গিয়েছিলাম। সেখানে যাওয়ার পর আমাকে যাচ্ছে তাই বলে গা/লি দিলো, আমাকে আপনার র/ক্ষি/তা বললো। বললো আপনি নাকি চরিত্রহীন। ঘরে একজন রেখে বাইরে ওকে পটিয়ে রেখেছেন। আপনি নাকি লু/ই/চ্চা। আপনার এক নারীতে সন্তুষ্টি হয় না। আপনি যেনো কোনদিন ওর সামনে না যান। তাহলে আপনাকে খু/ন করবে। ওকে নিয়ে এতো মাস ধরে খেলেছেন।
আরো কি বলেছে শুনবেন?
বলেছে এই বাসায় কেউ থাকে না সারাদিন সবাই বাইরে থাকে তাই আপনি আমাকে হোস্টেল থেকে বাসায় এনে রেখেছেন ফু/র্তি করতে।

হুঁ হুঁ করে চম্পা ওড়নায় মুখ ঢেকে কাদতে লাগলো।
এইজন্যই আমি হোস্টেল থেকে এই বাসায় আসতে চাইনি। আপনারাই আমাকে জোর করে এখানে এনেছেন। সত্যি কিনা বলেন?
এখন বাইরের একটা মেয়ের কাছে আমার দুশ্চরিত্রের সার্টিকেট নিতে হলো।

ইমন ওকে শান্তনা দিয়ে বললো, তুমি কেঁদোনা চম্পা। তুমি আমার ফ্রেন্ড, তুমি কাদলে আমার খারাপ লাগে। বাইরের লোক কে কি বলল সেটা নিয়ে মন খারাপ করো না। আমরা তো জানি তুমি খুব ভালো। না জেনে তোমার গায়ে হাত তুলেছি স্যরি। তুমি কিছু মনে করো না। আমি আবারও স্যরি বলছি।

চম্পা তুমি এখন যাও, আমাকে একটু একা থাকতে দাও। খুব মাথা ধরেছে।

চম্পা বললো, আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেই? তাতে আপনার ভালো লাগবে।

না তুমি তোমার ঘরে যাও। চম্পা চলে গেলে ইমন বালিশে মুখ গুজে অনেকক্ষণ কাদলো। প্রিয়া আমার সম্পর্কে এতো বাজে ধারণা কিভাবে করলো? এই চিনলো আমাকে? এই তাহলে ওর ভালোবাসা? এই তাহলে আমার প্রতি ওর বিশ্বাস? আমি হৃদয় নিঃশেষ করে শুধু ওকেই চেয়েছি, একমাত্র ওকেই ভালোবেসেছি।

একপলকের একটু দেখায় যাচাই না করেই ভুল বুঝতে পারলো? ও আমার কাছে আসতো, আমাকে সব কিছুর জন্য প্রশ্ন করতে পারতো। আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিতো। আমাকে ক্লারিফাই করার সুযোগও দিলো না। একবারেই ফাঁ/সি/র রায় শুনিয়ে দিলো।

ইমন কিছুদিন প্রিয়ার ওপর রেগে রইলো। পড়াশুনায় মনোযোগ দিলো। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হলে কিছুদিন ভাইয়ের অফিসে বসলো। সেখানেও ওর মন টিকলো না।

রাশেদ বলেছিলো পরের মুখে ঝাল খেয়ে নিজের প্রেমিকাকে ভুল বোঝা টা কি তোর ঠিক হলো?

ভুল কেনো বুঝবো? চম্পা কি তাহলে আমাকে মিথ্যে বলেছে? মিথ্যে বলে চম্পার কি লাভ?
ও দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সাথে আছে, ওকে কখনো খারাপ মেয়ে বলে মনে হয়নি। তেমন কোন অবিশ্বাসের কাজ সে করেনি।

চম্পা মিথ্যে বলেছে সেটা আমি বলছি না। প্রিয়া যেমন চোখের দেখায় তোকে ভুল বুঝেছে, তেমনি হতে পারে তোর নিজের কান কোন কান কথার ওপর বিশ্বাস করে প্রেমিকাকে ভুল বুঝছে। আমার পুরো ব্যাপারটায় কেমন যেনো সন্দেহ হচ্ছে বললো রাশেদ।

সেই থেকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রিয়াকে খুজে বেড়ায় ইমন। শুধু আসল সত্যিটা জানতে।

কোথাও পায় না তার মানসীকে। প্রিয়া যেনো কর্পূরের মত উবে গেছে, হওয়া হয়ে গেলো কয়েক মাসের মধ্যে। সব জায়গা থেকে ব্লক করে রেখেছে। তারপরও অনেকভাবে খোঁজ করার চেষ্টা করেছে পারেনি। ওর ফ্যামিলির থেকেও কোন ট্রেস করতে পারেনি।

ইমনের রেজাল্ট খুব ভালো হওয়ায় ভার্সিটি থেকে পিএইচডি করতে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার স্কলারশিপ পেয়ে যায় ইমন। সে যেনো এরকম কিছু জন্যই অপেক্ষা করছিল। এখানে আর কিছুতেই মন লাগছিলো না। কিছুটা সময় ও সব কিছুর থেকে দূরে থাকতে চায়। সম্ভব হলে আর কোনদিন দেশে ফিরে আসবে না। ওখানেই একটা চাকরি যোগাড় করে নিবে।
ইমন পিএইচডি করতে অস্ট্রেলিয়া চলে যায়।

যেতে যেতে রাশেদ কে দায়িত্ব দিয়ে যায় প্রিয়ার খোঁজ নিতে। খোঁজ পেলে আমাকে সাথে সাথেই জানাবি। আমি অপেক্ষায় থাকবো।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here