ভালোবাসা_ফিরে_আসে,পর্ব ৭

#ভালোবাসা_ফিরে_আসে,পর্ব ৭
লেখা : মান্নাত মিম

অপেক্ষার প্রহরগুলো বড্ড নিষ্ঠুরতম আর অনড় হয়! তাও আবার যখন দেখে প্রিয় মানুষটার জন্য প্রহর গুনতে, তাহলে তো কথাই নেই। সময় আর অপেক্ষা’রা তখন যেন ঘুড়ির মতো আনন্দ নিয়ে এঁকেবেঁকে আকাশে-বাতাসে উড়তে থাকে। এমনই এক সময় পার করছে এখন লিলি। যখন তার প্রিয়তমর জন্য অপেক্ষা করছে, তখনই সময় শেষ হবার নাম নিচ্ছে না। সুযোগ বুঝে শাহেদের মতো তাকে একদম অপেক্ষার দাবানলে পুড়িয়ে মারছে। কিন্তু আজ যে শাহেদকে খুব সুন্দর একটা সুখবর দেবার জন্য তার মন আকুপাকু করছে, তর সইছে না তাও ভালোবাসা মিশ্রণের অনুভূতি নিয়ে সেই সংবাদ তাকে ব্যক্ত করবে লিলি। তাই তো ভেবেচিন্তে, কতো সুন্দর করে তাদের রুমটা সে সাজিয়েছে! যাকে বলে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার। ইস! নতুন অতিথির আগমনের কথা জেনে শাহেদ কি তাকেও আরো বেশি ভালোবাসবে? লজ্জায় মরমে তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল লিলি, গাল গরম হয়ে আসছে এখনই। লজ্জিত হওয়া নিয়ে কত যে কথা শুনতে হলো শাহেদের কাছে তাকে। বিয়ের এত বছর হয়ে এলো, অথচ এখনো তার লজ্জারুণ অবস্থার শেষ পরিণতি হয় না। কিছুক্ষণ পর আবারও ফোন লাগাল শাহেদের ফোনে। কারণ এর আগে ফোন দিয়েছিল। তখন শাহেদ এই আস্তে একটু দেরি হবে বলেছিল। তাই বলে রাত দশটা পার করে ফেলবে। অপরপ্রান্তে রিসিভ হলেই এক নিশ্বাসে লিলি আগে বলা শুরু করল,

‘আর কত দেরি হবে তোমার বলতে পারো? অপেক্ষায় আছি জেনেও এমনটা করছ না? মনে রেখ, এর ফল কিন্তু ভালো হবে না। আমি মা’র বাসায় চলে যাব তখন বুঝবে।’

‘আরে ভাই! আমি তো আসছি। এই তো ব্রিজে আছি। তাও তুমি এমন করবে? আসার সময়টা তো দাও।’

ফোনটা কেটে কান থেকে সরাতে সরাতেই দূর থেকে ট্রাক আসতে দেখে সে বাইক’টা নিজের আয়ত্তে আনার চেষ্টা করল। কিন্তু হায় বিধিবাম! কপালের লিখন না যায় খণ্ডন। বাইকটা উল্টে কয়েক দফা পল্টি খেয়ে ব্রিজের সাথে ধাক্কা লেগে পানিতে পড়ে যেতে লাগল। আর সে ডুবন্ত অবস্থায় কল্পনায় ভালোবাসার প্রিয়তমা স্ত্রী’র সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো চোখের সামনে দেখতে লাগল।
_________

কাল রাত অবদি অপেক্ষা করতে করতে কখন যে লিলি সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছে, তা টের পাইনি। পরে সকাল সকাল কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙে। সাথে বাইরে থাকা এম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দেও। ভাবে হয়তো আশেপাশের কেউ অসুস্থ হবে। অথচ তখন নিজেও জানে না তার জীবনের অমূল্য সম্পদগুলো হারাতে বসেছিল। একটা হাই তুলতে গেলে তার খেয়ালে আসে; শাহেদ দেখি এখনো আসেনি। তাকে একা রেখে শাহেদ কখনো দেরি করে বাড়ি ফিরে না। তাহলে? কিছু একটা ভেবেই দৌড়ে নিচে নামতে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে একবার পা পিছলাতে গেলে তাড়াতাড়ি রেলিং ধরে ফেলে। তার বুক ধকধক করছে কোন অশুভের আভাস পাচ্ছে। যা ভাবছে তা যেন সত্যি না হয়। তাহলে সে মরেই যাবে। সম্পূর্ণভাবে নিচে নেমে দরজা খুলে স্ট্রেচারে শায়িত অবস্থায় শাহেদকে দেখতে পায়। আর তখনই পাগলের মতো প্রলাপগুলো বলেছিল।
____

‘তুমি বুঝতে পারছ না কেন? সে মা হতে চলেছে। শাহেদের বাচ্চার মা। সম্পদের মালিক হবে তখন বাচ্চাটা আর লিলি। অথচ আমরা সুখে-দুঃখে, অসুখে-বিসুখে গাধার খাটুনি খেটেছি। তার প্রতিদান কী পেলাম? আর এখন কি না ক’দিনে আসা ছেমড়ি এসে ভাগ বসাবে, সন্তানসহ!’

‘তো এখন কি করব তুমি-ই বলো?’

নিজের স্বামীর কানে কানে কিছু একটা বলে ইতি-উতি করে চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলেন শাহেদের বড়ো মামী। এমনিতে দরজা ভিড়ানো কেউ দেখার মতো নেই। আর লিলি তো মানসিক ট্রমা দিয়ে যাচ্ছে। তাই তাকে তার মা সামলাচ্ছে সাথে বড়ো বোন মিলি-ও তার স্বামী-সন্তান নিয়ে এসে খেয়াল রাখছে লিলির। খাওয়াদাওয়া করছে না লিলি। সবাই জেনে গেছে যে, সে সন্তানসম্ভবা। তাই তার মা তাকে জোর করে কিছুটা খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বিফলে যায় সবকিছুই। না তো কিছু মুখে দিতে চাইছি, আর একটু মুখে দিলেও বমি করে পেট খালি করে ফেলছে। তার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে, তার মা মুখে গায়ের শাড়ির আঁচল গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে চলে যান। মিলি সামনেই ছিল কিছুদিন আগের সদ্য জন্মানো মেয়ে রিম্পি’কে কোলে নিয়ে। এগিয়ে গিয়ে তার মেয়েকে লিলির কোলে দিয়ে বলে,

‘এমন একটা শিশু তোর পেটে। তুই কি চাস তাকে মেরে ফেলতে?’

এতটুকুই ছিল লিলিকে জীবন্মৃত হয়ে থাকা থেকে ফিরিয়ে আনতে। অতঃপর বোনের হাতে অল্পকিছু খেলো সে। দুপুরের যোহরের নামাজের পর শাহেদের লাশকে নিয়ে যাওয়ার সময় হলে, লিলি দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে আসতে গেলে আগের বারের মতো পা পিছলে যায়। তবে এবার আর দ্বিতীয়বারের মতো সুযোগ পায় না নিজেকে সামলানোর জন্য। সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে একদম নিচে পড়ে যায়। নিমাংশের রক্তে প্রবাহিত হয় পুরো ফ্লোর। আর তার চক্ষুদ্বয় দেখে চারজন ব্যক্তিকে খাঁটিয়া ধরে তার প্রাণপ্রিয় স্বামীকে নিয়ে যাচ্ছে। অতঃপর চক্ষুদ্বয় মুদে আসে ঢলে পড়ে অজ্ঞানতরে।
_______

‘সত্যি করে বল তো লিলিকে কে বলছে খবরটা?’

‘বিশ্বাস যাও আমি তখন নিচে রিম্পির জন্য দুধ গরম করছিলাম। আমি বলিনি যে, শাহেদের লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’

মিলির কথা শুনে বেশ চিন্তিত হলেন তার মা মিসেস সালেহা। কে তাহলে এমন কাজ করল? তিনি মিলিকে না করেছিলেন যাতে শাহেদের মৃতদেহের নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে লিলিকে না জানানো হয়। কারণ মেয়ে এক তো পাগলামি করছে, শাহেদের সাথে নাকি বিড়বিড় করে কথা বলে আবার এই হাসছে তো এই কাঁদছে। কিন্তু যেই ভয়টা পেলেন তাই হলো সবশেষে। বাচ্চাটাকে আর বাঁচানো গেল না। অন্যদিকে লিলির অবস্থাও শোচনীয়। এক-দেড় মাসের প্রেগন্যান্সির সময়টা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার ধাক্কাটা সামলাতে পারেনি। যার কারণে বাচ্চাটা রইল না আবার লিলি-ও এখন বাঁচা-মরার মধ্যিখানে ঝুলছে।
______

দীর্ঘ পনের দিন হসপিটাল থেকে আসার পর কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গেছে মেয়েটা! শান্ত, নিরব, মন্থরতা কাজ করছে তার মধ্যে। না আগের মতো কথা বলে, না সময় মতো খায়, আর না ঘুম যায়। জীবনটা তার কাছে বেঁচে থেকেও না থাকার মতো অবস্থায় দাঁড়া করা। স্বামীর বাড়িতেই পড়ে আছে সে। তবে তার মা সাথে থাকেন এখন। মাঝে মাঝে মিলি এসে দেখে যায়। শাহেদের মামা-মামীরাও থাকে সাথে। ক’দিন ধরে একটু তর্কাতর্কি করছেন তাঁরা। কারণ লিলির মা কেন এ বাড়ি থাকবে? এখানে তার কী কাজ? মেয়ে জামাইয়ের বাড়িতে থাকতে তাঁর লজ্জা করে না? আবার বসে বসে বিধবা মেয়ের সাথে তাদের অন্ন ধ্বংস করছে। আজ বেশ উঁচিয়ে কথাগুলো বললেন শাহেদের মামী। আগে তেমন একটা উচ্চস্বরে বলেননি। কিন্তু আজ না বলে থাকলেন না। কথাগুলো ধীরস্থির হয়ে বসে থাকা লিলির কানে গিয়ে তার হৃদয়ে নাড়া দিয়ে ওঠে। তবে সব নয় শুধু বিধবা শব্দই তাকে চারদিক থেকে আচ্ছন্ন করছে। শরীরটা কেমন অসাড় হয়ে আসছে! বুক চিঁড়ে চোখ বেয়ে রক্তক্ষরণ হতে চাইছে। ঘোলা চোখ একবার শুধু ঝাঁপটালো তাতে নোনতা পদ্ম পুকুর থেকে উথলে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। নিরলসভাবে ওঠে দাঁড়িয়ে রুম ছেড়ে নিচে নেমে রান্নাঘরের দিকে গেল।

‘মামী আপনাকে আর কষ্ট করে আমাদের খাওয়াতে হবে না। আমি কোনোভাবে খাবার জোগাড় করে নেব।’

সবসময় সুন্দর আচরণ করা লিলিকে তিনি দু’নয়নেও দেখতে পারতেন না। সেটা শাহেদ থাকতেও আর আজও। তবে শাহেদ থাকাকালে নিরবতা পালন করলেও আজ আর তেমনটা রইলো না। লিলিকে তাঁর কোন কারণ ছাড়াই অপছন্দ। তাই রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলেন,

‘তা কীভাবে শুনি? বেশ্যাগিরি করে জোটাইবা?’

হতবিহ্বল চোখে তাকায় মামীর দিকে মিসেস সালেহা। মুখ রা করার জো’টুকুও নেই। এদিকে লিলির মধ্যে বয়ে গেল আগুনবিহীন উত্তাপ। কান দিয়ে যেন ধোঁয়া ছুটছে। এই সেই মামী যাদের কথা বলে শাহেদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠত! ভাবনাগুলো কেমন যেন মলিন হয়ে এলো। চোখেরা জ্বালাপোড়া করলেও সহন হয়ে গেল। কারণ সামনে থেকে এসব তার নিত্যদিনের সঙ্গী হতে চলেছে।

‘আপনি এভাবে কেন বলছেন বেয়াইন?’

নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন মিসেস সালেহা। তবে মামীর স্বর নরম হলো না। গলায় তেজের রুক্ষভাষা নিয়ে বললেন,

‘তো কীভাবে বলতাম? আপনার মেয়ে তো ঘুঁটেকুড়ানি। সে নাকি আবার খাবার জোগাড়ের বড়াই দেখায়।’

‘বড়াই দেখাল কোথায়? আপনিই তো বললেন, বসে বসে আপনাদের অন্ন ধ্বংস করছে। তাই আর বসে না থেকে নিজের অন্ন নিজেই জোগাড় করে সেগুলোই ধ্বংস করুক।’

মিসেস সালেহার হাসিমুখে শেষ উত্তর যেন মামীর গায়ে আগুন ধরিয়ে দিলো। এবার তিনি বলেই ফেললেন,

‘তাহলে বাড়ির বাইরে গিয়ে করুক। বাড়ির ভিতরে কোনো নষ্টামি চলবে না।’

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here