বৃত্তের_অন্তরালে পর্ব_৯

বৃত্তের_অন্তরালে পর্ব_৯
#পলি_আনান

চারিদিকে মানুষের কোলাহলে সমাগমে মুখরিত সরকার বাড়ি, সবাই এসেছে এই বাড়ির নতুন বউকে দেখতে। সকাল থেকে ওজিহা ব্যস্ত সময় পার করছে,সবার সাথে হাসি মুখে কুশল বিনিময় করার মাধ্যমে সবার মন জুগিয়ে চলছে। আবার নাহিয়ানের চোখ ফাকি দিয়ে মুহিবের সাথে একটু কথা বলার জন্য কাল থেকে আসফাস করছে।কিন্তু নাহিয়ান চুইংগামের মতো চিপকে আছে তার সাথে।এর মাঝে নাহিয়ানকে কেউ ডাকলে তখন সাবিহা,মিতু আর জারাকে পাহারাদার হিসেবে রেখে যায়।
“আজব তো কি হচ্ছে তার সাথে!এমন করছে কেন লোকটা, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি জেল খানার কয়দি যেকোন সময় পালিয়ে যাবো।”
কান্না গুলো দলা পাকিয়ে আসছে ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাদতে। ছোট থেকেই সে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেছে। একা থাকতে তার বড্ড ভালো লাগে কিন্তু হঠাৎ করেই এতো লোক সমাগম কিছু তেই হজম হচ্ছেনা তার।ওজিহার অসস্তি জারা বুঝতে পেরে এগিয়ে আসে,
“কি হয়েছে ওজিহা, তোর চোখ মুখে এমন কান্না কান্না ভাব কেন!
” আমার না দম বন্ধ হয়ে আসছে।তুই তো জানিস আমার এতো ভীড়ের মাঝে থাকতে ভালো লাগেনা। প্লিজ আমি রুমে যাবো ব্যবস্থা কর বোন।

এতোক্ষন বন্ধুদের সাথে একটি বিষয় নিয়ে খুব হাসাহাসি করছিলো নাহিয়ান। কিন্তু তার চোখ ছিল ওজিহার দিকে। তার চোখ মুখ দেখেই বুঝে নিয়েছে কোন একটা সমস্যা নিশ্চই হয়েছে।বড় বড় পা ফেলে ওজিহার সামনে এগিয়ে এলো সে,
“জারা কোন সমস্যা?
জারাকে প্রশ্নটি করেই ওজিহার দিকে চকিতে তাকায় সে।চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ বেশ বুঝা যাচ্ছে।
” হ্যা ভাইয়া ওজিহা রুমে যেতে চাইছে ওর এখানে অসস্তি ফিল হচ্ছে”
“আচ্ছা সমস্যা নেই তোমরা রুমে যাও এদিকটা আমি সামলে নিচ্ছি।
“হুম”
.
কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্যটা উকিঁ দিয়েছে।সরকার বাড়ি জুড়ে আজ থই থই ব্যপার। দূর থেকেও কিছু আত্নীয়- সজন চলে এসেছে।বাড়ির সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছে ওজিহার মামা-মামি।বাইরে থেকে এম সাজ সজ্জায় গড়ে তোলা বিশাল যায়গা জুড়ে বাড়ি দেখে চোখ কপালে উঠে যায় ওজিহার মামি আমেনা আর মামাতো বোন মারিয়ার।আমেনা মারিয়ার কানের সামনে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে ,
“দেখেছিস মারিয়া ওজিহা একদম বড়লোক ঘরের৷ ছেলেকে ধরেছে।ধরেছে তো ধরেছে আবার বিষয়টা বিয়ে পছন্দ গড়িয়ে নিয়েছে আর তুই কি করিস,সারাদিন গালের মধ্যে আটা ঘসা ঘসি ছাড়া তো আর কোন কাজ দেখছিনা।একটা ছেলেও পটাতে পারলি না। সব অর্কমার ঢেকীঁ”

কথা বেশ দাত কিড়মিড় করে বললেন আমেনা।কথা গুলো শুনে মারিয়ার মুখটি চুপসে যায়।মায়ের কানের সামনে মুখনিয়ে ফিসফিসিয়ে সে বলে,
“আহ, মা চিন্তা করোনা যদি ওজিহার কোন দেবর থাকে তার গলায় ঝুলে পড়বো।আর কোন চাপ নিও না তো।”
.
“জারা আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা কাল আমার সাথে এটা কি ঘটলো?(মুখে হাত দিয়ে কান্নার ভঙ্গিতে ওজিহা)
” আচ্ছা নাহিয়ান ভাইয়াকে কি সবটা জানাবো আমি!
“না না তুই কিছু বলিস না প্লিজ আমি চাইনা কেউ আমার সর্ম্পকে তেমন কিছু জানুক। আমি যেমন ঠিক তেমনি থাকতে চাই”
“কিন্তু ও…
পুরো কথাটা শেষ করতে পারলোনা ওজিহা তার আগেই কেউ জোরে জোরে দরজায় করাঘাত করতে থাকে,
জারা গুটি গুটি পা ফেলে দরজা খুলতে চলে যায় আর ওজিহা দরজার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
জারা দরজা খোলার সাথে সাথে হুড়মুড় করে ঘরে ডুকে মারিয়া আর আমেনা।তাদের দেখেই জারা মনে মনে বলে
” তোমরা এসেছো নিশ্চই ওজিহাকে এবার দুই চারটা কথা শুনাতে প্রস্তুত হবে। কিন্তু এমনটা আর আমি হতে দিবো না। অনেক সহ্য করেছে মেয়েটা ওর জন্য এবার ওর উপযুক্ত মানুষ চলে এসেছে যে তাকে আগলে রাখবে,শাসন করবে আর ভালোবাসবে।”
ওজিহা বিছানা থেকে নেমে একপ্রকার দৌড়ে আমেনা বেগমের সামনে দাড়ায়,
“কেমন আছো মামি,?
” এইতো ভালো তুই কেমন আছিস মা?অবশ্য তুই তো ভালো থাকবি তোর বড়লোক বাড়িতে বিয়ে হয়েছে, ”
কথা গুলো বেশ খুচিয়ে খুচিয়ে বললেন আমেনা। সাথে সাথে ধুপ করে নিভে গেল ওজিহা,জারা পাশ থেকে দাতে দাত চেপে সবটা হজম করছে।

মারিয়া ওজিহার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“কিরে এই ছেলেকে কিভাবে পটিয়েছিস আমাকে একটু বলতো আর তোর কোন দেবর আছে।তাহলে আমার জন্য বুকিং দিয়ে রাখিস!
তাদের বলা প্রতিটা কথা ওজিহার শরীরে কাটার মতো লাগে,ছিহহহ কবে মানুষ হবে তারা লোভ লালসা কবে তাদের ছাড়বে ভেবে পায় না ওজিহা।

লাল আর সাদা গোলাপের মাঝে সাজানো হয়েছে পুরো রুমটাকে,কিছুক্ষন আগেই নাহিয়ান তাকে খাটে বসিয়ে রেখে রুম থেকে চলে যায়। কোথায় গেছে কেন গেছে ভেবে পায় না সে।এদিকে একসাথে এতো ফুলের সুভাবে দম বন্ধ হয়ে আসছে তার।মনের মাঝে চলছে একটি ভীতকর পরিস্থিতি।কালকের পর থেকে নাহিয়ানের সাথে তার খোলামেলা কোন কথা হয় নি।নাহিয়ান কেন তাকে এইভাবে অপ্রস্তুত ভাবে বিয়েটা করলো.?কেনই বা মুহিবের কাছ থেকে তাকে দূরে দূরে রাখছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে।এদিকে বিকেল থেকে মুহিবের দেখা নেই, ওজিহার কাছে কোন ফোন নেই যে মুহিবের সাথে কথা বলবে সব কিছু তার এখন বিরক্ত লাগছে।খট করে হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হলো ওজিহা চমকে তাকায় দরজার দিকে।নাহিয়ান কে একপলক দেখেই তার লোখ দুটোতে লজ্জা ছেয়েঁ যায়।অফহোয়াইট পাঞ্জাবিতে তাকে রাজপুত্রের থেকে কম লাগছে না।ওজিহা নাহিয়ানের পা ছুয়েঁ সালাম করতে নিলেই নাহিয়ান আটকে দেয়,

” আরে কি করছো কি!
ওজিহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে এই মূহুর্তে তার এই রুমে থাকা মানেই দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার সমান।ওজিহার অসস্তি দেখে নাহিয়ান বলে,
“ছাদে যাবে ওহিজান!
চমকে তাকায় ওজিহা,মনে মনে বলতে থাকে,
“ঘটনা কি এই লোকটা ছাদে যাওয়ার অফার কেন করলো,এই রুমে একসাথে না থেকে ছাদে যাওয়াই বেটার অপশন।”
সে নাহিয়ানের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ নিচে নামিয়ে বলে,
“চলুন”
.
পূর্ণিমার আলোতে পুরো ছাদটা মূখরিতো।তার সাথে ছাদের চারিপাশে নিয়ন বাতির আলোয় পরিবেশটার সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।ছাদের এক সাইডে ছোট্ট একটি ফুলের বাগান আছে সেই ফুলের ঘ্রাণে পুরো ছাদ মৌ মৌ করছে।নাহিয়ান ওজিহার হাত ধরে একটি দোলনায় বসিয়ে দেয় আর পাশে সেও বসে পরে,
“ওহিজান!আমি জানি তুমি এখন ভাবছো তোমায় কেন ছাদে নিয়ে এসেছি তাই তো?
” হুম!
“দেখো পূর্ণিমার আলোয় পরিবেশটা কেমন মায়াময় লাগছে আর এমন একটা মূহুর্তে তোমার সাথে চন্দ্র বিলাস করবো না, তা কি হয়!তাই তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি। তোমার ভালো লাগছে পরিবেশটা?
” হুম!
ওজিহার মুখে এমন হুম, হুম উওর শুনে নাহিয়ান আশাহত হয় একটি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে সে বলে,
“তোমার জন্য একটি গিফট আছে,
ওজিহা ভ্রু কুচকে নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে পকেট থেকে একটি ডায়মন্ডের রিং বের করে ওজিহার আঙ্গুলে পড়িয়ে দেয়।আংটি টি বেশ চকচক করছে আর তা দেখে ওজিহা চমকে যায়। এ তো দামী জিনিসের যোগ্য সে না। তার সাধ্যর বাইরে কখনো সে কিচ্ছু চায় নি তাই সে রেগে যায়।
” আপনি কি করছেন?আমাকে কেন দিয়েছেন এটা আমায়। দেখুন আমি এইসব দামি কোন জিনিসের উপযুক্ত না আমি এটা নিতে পারবো না আমায় মাফ করবেন।”
ওজিহা হাত থেকে রিং খুলতে গেলে নাহিয়ান ওজিহার হাত শক্ত করে হাত চেপে ধরে ওজিহা তার দিকে তাকালে ভয়ে একটি ঢোক গিলে। নাহিয়েনের দৃষ্টি বেশ তীর্যক তার চোখ দিয়ে যেন আগুনের উল্কা বের হচ্ছে ওজিহা তার দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেয়।
“খবরদার আমার আমার দেওয়া প্রথম গিফটকে তুমি এভাবে অবমাননা করতে পারো না।তোমার উচিত সম্মানের সহিত গ্রহন করা আর তুমি কিনা অগ্রাহ্য করতে চাইছো……!দেখো আমার মাথা গরম করিও না। বন্ধুরা বলে যেদিন থেকে তোমায় দেখেছি সেদিন থেকে আমি নাকি পালটে গেছি।
নাহিয়ান কিচ্ছুক্ষণ চুপ হয়ে যায় তারপর সবচে অবাক কান্ডটা করে বসে। ওজিহার কপাল টেনে আলতো করে ভালোবাসাত পরশ একে দেয়। এইটার জন্য ওজিহা একদম প্রস্তুত ছিল না।হঠাৎ ছোয়াঁয় সে যেন অন্য জগতে হারিয়ে যায়,চোখ বন্ধ করে দাত মুখ খিচে সে বসে আছে তার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তাকে কেউ তিতা করলার জুস খাইয়েছে। নাহিয়ান ওজিহার অবস্থা দেখে মুচকি হেসে পাশ থেকে গিটার হাতে তুলে নেয়। গিটারে হাত বুলাতে বুলাতে ভাবতে থাকে কত শত পুরনো স্মৃতি।
” ওজিহা চোখ খোল!
পলকে ওজিহা তার চোখ খুলে নেয়।নাহিয়ানের হাতে গিটার দেখে বেশ অবাক হয় সে।
“আপনি গান পারেন?
” একসময় গাইতাম,ছয় বছর আগে আমি গিটার টা যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। আগে আমার গানের সঙ্গি ছিলেন দাদাজান। দুজনে মিলে গান গেয়ে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখতাম, কিন্তু দাদা মারা যাওয়ার পর,আমার গিটার টা দেখলেই দাদীজান কেদে কেদে অস্থির হয়ে পড়তেন তারপর থেকে আমি রেওয়াজ করা ছেড়ে দি সাথে গান ও।দাদীজানকে আমি বড্ড ভালোবাসি। আর ভালোবাসার মানুষের কষ্টের জন্য দুই চারটা শখ এমনিতেই বির্সজন দেওয়া যায়। তবে আজ তোমাকে গান গেয়ে শুনাতে চাই কারন আমার অতীত বর্তমান ভবিষৎ সবিই জানার অধিকার তোমার আছে।
গিটার টা কোলে নিয়ে টু টাং শব্দ করতে থাকে নাহিয়ান,ওজিহা মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখছে সত্যি ছেলেটা বড্ড ভালো,নাহিয়ান ওজিহার দিকে একপলক তাকিয়ে গান শুরু করে৷,
💝এখন অনেক রাত তোমার কাধে আমার নিশ্বাস আমি বেচেঁ আছি তোমার ভালোবাসায়। ছুয়ে দিলে হাত আমার বৃদ্ধ বুকে তোমার মাথা চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায়(২)।কেন যে অসংকোচে বন্ধ গানের কলি পাখার ব্লেডের তালে সোজাসুজি কথা বলি।
আমি ভাবতে পারিনি তুমি বুকের ভেতর ফাটছো আমার শরীর জুড়ে তোমার প্রেমের বীজ আমি থামতে পারিনি তোমার গালে নরম দুঃখ আমায় দুহাত দিয়ে মুছতে দিয়ো প্লিজ।………..💝

মোহমায়ায় ছেয়ে যায় পুরো পরিবেশটা। ভালোবাসি নামক বীজ আসতে আসতে ওজিহার মন জুড়ে ছেয়ে গেছে। ভালোভাসি নামক অধ্যয়টা হয়তো এখনি শুরু হবে তার জীবনে।বদলে যাবে দিনকাল পালটে যাবে অনুভূতি। পাশাপাশি হাতে হাত রেখে অন্যর ভরসায় হয়তো চলবে সে…!শরীর জুড়ে তীব্র শিহরন বয়ে যাচ্ছে এই শীতের রাতটি স্মৃতির পাতায় আজীবন বেচেঁ থাকবে।বেচেঁ থাকুক অপ্রত্যশিত প্রাপ্ত ভালোবাসা গুলো…!

হঠাৎ ওজিহার কানে আসে এক বিশ্রী বিদঘুটে হাসির আওয়াজ।মস্তিষ্ক নাড়া দিয়ে উঠে তার, কিসের হাসি?কে হাসছে?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here