বৃত্তের_অন্তরালে পর্ব_১০

বৃত্তের_অন্তরালে পর্ব_১০
#পলি_আনান

আকাশ জুড়ে এক ভারি মেঘ গর্জে উঠেছে, মনে হচ্ছে এখনি ঝুপ করে বৃষ্টি নামবে।ভিজবে উত্তপ্ত ঘাস, মাটি,আর মানব জীবনে নামবে একটু সস্তির ছায়া।এতো দিনের উত্তাপ্ত রোদে মানুষ ক্লান্ত হয়ে গেছে, প্রকৃতি প্রায় রুক্ষ হয়ে গেছে কিন্তু আজ যদি বৃষ্টি নামে তবে প্রকৃতি আবার তার সৌন্দর্যের ঢাল নিয়ে বসবে।খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে ওজিহা আর জারা, তারা দুজন মাঠের একটি প্রান্তে আড্ডা দিচ্ছে।তার বিপরীত দিকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে নাহিয়ান আর তার দলবল।ওজিহা আড় চোখে বার বার নাহিয়ানের দিকে তাকাচ্ছে নাহিয়ান সোজাসুজি ওজিহার দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক ভাবে।
রাকিব পাশে থেকে সাবিহাকে ইশারা করে নাহিয়া এর দিকে তাকাতে। সে নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে জোরে গলা ঝারে কিন্তু তাতেও নাহিয়ানের হেল দোল নেই।
“ভাইরে ভাই বিয়াটা শুধু একবার করতে দে আমি রুম থেকেই বের হবো না। দিন দিন মানুষের কর্মকান্ডে আমার হিংসা বেড়া যাচ্ছে।
রওনকের কথা শুনে সবাই ঠোঁট চেপে হাসে।নাহিয়ান কিছুটা আচঁ করতে পেরে গলা ঝেরে কেশে বলে,
” তো কর তোরে কি কেউ বারন করছে না কি?
“না বারন করেনাই তবে মেয়ে খুজে পাইনা। শুধু মনের মতো একটা পাই সোজা কাজি অফিস”
রওনকের দিকে তাকিয়ে সবাই হেসে উঠে।তার কথায় সবাই যেন আনন্দ পেল।সবার কথার মাঝে নাহিয়ানের ফোন বেজে উঠে, আড়ালে গিয়ে ফোন রিসিভ করে,
“হ্যালো বাবা বলো”
“একটা মিটিং ডাকা হয়েছে , তুমি কি আসতে পারবে তোমাকে কিন্তু বিশ মিনিটের মধ্যে হাজির হতে হবে,
” ওকে বাবা আমি আসছি”
ওজিহার সাথে বিয়ে হওয়ার এগারো দিন থেকে নাহিয়ান তার বাবার অফিসে যোগদান করেছে।একে একে কেটে গেল বিবাহিত জীবনের ছয় মাস।এই ছয় মাস ওজিহা সব কিছু মেনে নিয়েছে। বাড়ির প্রত্যক সদস্যকে নিজের আপন মানুষ করে নিয়েছে।পরিবার থাকলে কেমন ভালোবাসা পাওয়া যায়,মর্যাদা পাওয়া যায় তা এতো দিন ওজিহার অজানাই ছিল যতই লোক মুখ থেকে পরিবারের ভালোবাসা সর্ম্পকে যানুক,কিন্তু তার কোন অনুভূতি ছিল না।এখন সে মনপ্রাণ থেকে এই পরিবারের মানুষ গুলোকে ভালোবাসে।নাহিয়ান পকেটে ফোন রাখতে রাখতে ওজিহার দিকে এগিয়ে যায়।এই কয়েক মাস তারা পুরো বন্ধু হয়ে গেছে।তাদের স্বামী স্ত্রী সর্ম্পক ছাড়াও আরেকটি অটুট সর্ম্পক হলো বন্ধুত্ব।এই মাস গুলোতে নাহিয়ান ওজিহাকে সবসময় চোখে চোখে রেখেছে।দুজনে সবসময় একসাথে ভার্সিটিতে যাতায়াত করে।মুহিব থেকে অতন্ত সর্তক দৃষ্টি ওজিহাকে সে সরিয়ে রেখেছে।মুহিব ও কম যায় না সবসময় ওজিহার পিছনে লেগে থাকে।
“ওহিজান!
” কিছু বলবেন,
“আসলে বাবা ফোন করেছে অফিসে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ডাকা হয়েছে হঠাৎ করে এখন আমি তো অফিসে যাবো সময় ও নেই তুমি বাড়ি ফিরবে কখন চলো তোমায় এখনি পৌছে দি।”
“আরে না আমার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে সেটা শেষ করেই বাড়ি ফিরবো।”
“ক্লাসটা না করলে হয় না?
“না হবেনা আমার ক্লাস টা গুরুত্বপূর্ণ করতেই হবে আপনি যান আমি চলে যেতে পারবো””
“কিন্তু…!
” কোন কিন্তু নয় আপনি যান আমি একাই বাড়ি ফিরবো।রাস্তায় একা চলতে আমার অভ্যাস আছে।
নাহিয়ান মুচকি হেসে সম্মোধন যানিয়ে অফিসের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরে।
.
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরতে শুরু করেছে রাস্তায় তেমন লোকজন নেই।আবার খালি কোন গাড়িও পাওয়া যাচ্ছে না তাই একা একা ছাতা মাথায় হাটতে শুরু করেছে ওজিহা।আসার সময় রওনক, রাকিব তারা পৌছে দিতে চেয়েছিল। হয়তো নাহিয়ান তাদের বলেছিল কিন্তু ওজিহা এককথায় বারন করে দেয় সে একায় যেতে পারবে।বৃষ্টির ফোটা গুলো এবার বড় হতে শুরু করেছে কিছুক্ষন পরেই হয়তো ভারী বর্ষন নামবে।ছাতা হাতে খুব দ্রুত পা চালাচ্ছে সে।হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়ায় সেই চিরচেনা মুখ যাকে দেখেয় সে থমকে যায়।
“মুহিব ভাই..!
ওজিহার মুখের কথা শুনে মুহিব যেন বেশ আনন্দ পেয়েছে।
” আমি কবে থেকে তোমার ভাই হয়েছি ওজিহা।আমাকে তো মুহিব বলেই ডাকতে!
ওজিহা তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। মুহিব ভাই এমন করছে কেন আর নাহিয়ান মুহিবের থেকে তাকে কেনইবা আলাদা রেখেছে।সেইদিন সকালে নাহিয়ান হুট করে ওজিহাকে একটা শর্ত দিয়ে বসে আর সেই শর্তটা হলো সে কখনো মুহিবের সাথে কথা বলতে পারবে না।ওজিহা সেদিন আর পালটা প্রশ্ন করেনি অবশ্য করতে ইচ্ছেও হয় নি।তাই এখন যথা সম্ভব মুহিব থেকে দুরে থাকবে সে।
“এতো কথা আমি যানতে চাইনা মুহিব ভাই আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে”
ওজিহা এগিয়ে যেতে গেলেই মুহিব আবারো রাস্তা আটকায়,
“কি বিয়ে করে খুব খুশি তাইনা!কি ভেবেছো নাহিয়ান তোমায় ভালোবেসে বিয়ে করেছে!
কথাটি শুনেই ওজিহার ভ্রু কুচকে যায়। ওজিহার সন্দিহান দৃষ্টি দেখে মুহিব অবজ্ঞার হাসি হাসে।পকেটে হাত দিয়ে বলে,
“ও তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেনি, আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম আর সে তা সহ্য করতে পারেনি তাই তোমাকে জোর করে বিয়ে করে নিয়েছে। তোমাদের বিয়েটা ছিল জাস্ট একটা চেলেঞ্জএর বিয়ে আর সেই চেলেঞ্জ এ নাহিয়ান জিতে গেছে।
মুহিবের কথা গুলো কিছুতেই বিশ্বাস করতে তার মন সায় দিচ্ছে না।
” আপনি মিথ্যা বলছেন। নাহিয়ান আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসে তাদের বাড়িত সকলেই আমাকে ভালোবাসে আপনি শুধু শুধু আমাদের সর্ম্পক নষ্ট করতে উঠে পরে লেগেছেন কেন!
“হা হা হা আমি সম্পক নষ্ট করছি,আমি! তুমি একবার ভেবে দেখো সে যদি তোমায় ভালোই বাসতো তবে কেনে এই ভাবে জোর করে তোমায় হঠাৎ করে বিয়েটা করলো যদি ভালইবাসতো তবে পারিবারিক ভাবেই বিয়ে টা করা যেত।যদি সে তোমায় বিশ্বাস করতো তবে এই ছয় মাসের একটি দিন হলেও আমার সাথে কথা বলতে দিতো।এমন চিপকে থাকতো না তোমার সাথে। ভেবে দেখো ওজিহা সে তোমায় বিশ্বাস করে না।
ওজিহার কান্না পাচ্ছে ভীষন কান্না পাচ্ছে।এইসব তো সে ভেবে দেখেনি সত্যি নাহিয়ান কেন এমন করলো শুধুমাত্র একটা চেলেঞ্জ জেতার জন্য সে আমার সাথে ভালোবাসার নাটক করে যাচ্ছে।

“ভেবে দেখো ওজিহা নাহিয়ান কিন্তু আত্ন নির্ভরশীল ছেলে সে আগে প্রতিষ্ঠিত হবে তারপর বিয়ে নামক সর্ম্পকে জড়াবে।আর তার কিনা এখনো পড়ালেখাই শেষ হলো না সে বিয়ে করে নিলো।ভেবে দেখো ওজিহা ভেবে দেখো…একটু গভীর ভাবেই ভাবো…!
শেষ কথাটা ওজিহার কানের সামনে গিয়ে বললো মুহিব।ওজিহা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, তার সব কিছু উজার করে কাদঁতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সে কাদঁবে না। সব কান্না সবাইকে দেখাতে নেই।কিছু কান্না সঙ্গোপনে রাখাই ভালো।
” চলো তোমায় বাড়ি পৌছে দি ওজিহা!
“তার কোন প্রয়োজন নেই আমি একাই যেত পারবো।
বৃষ্টির দাপট বেড়ে গেছে। সাথে বাতাসের দাপট ও। ছাতা ধরে রাখতে হিমশীম খেতে হচ্ছে তাই খোলা ছাতাটা ছুড়ে ফেলে দেয় রাস্তার কিনারায় আর খোলা আকাশের নিচে কাকভেজা হয়ে হাটতে শুরু করে।ভাবতে থাকে ছয় মাস আগের জীবনের সূত্রগুলো সমীকরন মিলাচ্ছে সে। কিছুই মিলছেনা সব হ য ব র ল লাগছে মন চাইছে পিছ ঢালা রাস্তার মাঝে বসে চিৎকার করে কাদতে।কিন্তু কাদতে তার মানা। সে সারাজীবন নিজেকে লুকিয়ে বেচেঁছে, লুকিয়ে কেদেছেঁ আর লুকিয়ে হেসেছে তাই আজ পাল্টাবে কেন সে কাদবে তবে লুকিয়ে গোপনে।মুহিবের বলা কোন কথাই তো মিথ্যা নয় সব সত্য তবে কি সত্যি নাহিয়ান নাটক করছে।তার ভালোবাসায় তো ফাঁক লাগেনি আমার কাছে। কোন দিকে যাবো আমি।পিছ ঢালা রাস্তায় চলতে চলতে তার গন্তব্য এসে পরে। বাড়ির দারোয়ান ওজিহাকে কাক ভেজা দেখে চমকে যায়।
” ম্যাম আপনার এই অবস্থা কেন?ছোট স্যার কোথায়?
দারোয়ানের কথার উওর দিতে ইচ্ছে হয় নি তার তাই সোজা হেটে চলে যায়।বাড়ির সদর দরজায় ঢোকার সময় তফুরা খাতুনের সাথে দেখা হয়।ওজিহার অবস্থা দেখে তিনি চমকে যায়.
“নাত বউ তোমার এই অবস্থা কেন? কি হল ভিজে গেলে কেন?আর দাদু ভাই কই!
ওজিহার এখন কোন প্রশ্নের উওর দিতে ইচ্ছে করছেনা তাই তফুরা খাতুনের দিকে তাকিয়ে বলে,
” দাদীজান মা কোথায়?
“সে তো একটা কাজে বেরিয়েছে।
” আচ্ছা, আমি রুমে যাচ্ছি দাদীজান আমাকে ডাকবেন না আর মা আসলেও ডাকতে বারন করবেন”
“কিন্তু……!!
ওজিহা আর কোন কথা না বলে উপরে চলে যায়।
ওয়াশরুমে ডুকে ঝরনা ছেড়ে দেয় মেঝেতে বসে চিৎকার করে কাদতে থাকে।তার আতৎনাদ দেয়ালের সাথে দেয়ালে ধ্বনি হচ্ছে কিছক্ষুন পর মুখে ওরনা চেপে ধরে।কান্নার শব্দ যেন বাইরে না বের হয়।ঝরনার পানি চোখের পানির সাথে মিশে যাচ্ছে অনুভূতিরা মরে যাচ্ছে। সব কিছুর প্রতি ভালোবাসা হঠাৎ রুক্ষ হয়ে গেছে।নিজের জীবনেএ প্রতি দেখা দিয়েছে বিতিষ্ণা।

” আমাকে কেন সবাই ব্যবহার করে। জন্মের পর থেকেই কেন কাটা হয়ে আছি সবার মাঝে।সবার জীবনে বাচার অধিকার আছে কিন্তু আমার মতো মেয়ের বাচার মতো কোন পথ নেই।এই পরিবারটাকে তো নিজের থেকে ও বেশি ভালোবেসেছিলাম,আর নাহিয়ান তাকেও ভালোবাসলাম কিন্তু সেও আমায় ঠাকালো আমার জীবন কি এভাবে ঠকতে ঠকতেই যাবে। ভালোবাসি নামক অনুভূতিটাই আমার জীবনের জন্য অভিশপ্ত।আর থাকবোনা এই সাথ্যের পৃথিবিতে ভালো আর কাউকে বাসবো না।যদি বেচেঁ থাকি তবে আমি আমার।

অফিস থেকে বের হতে হতে ওজিহাকে প্রায় এগারো বার কল করে নাহিয়ান কিন্তু সে রিসিভ করেনা।ধুপ করে তার মাথায় চিন্তারা বাসা বেধে ফেলে।হঠাৎ মুহিব তাকে ফোন করে।মুহিবের ফোন দেখেই ভ্রু কুচকে যায় তার।
“এই সময় মুহিব কল করলো কেন…?
ফোন রিসিভ করে বলে,
” কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো।
“আচ্ছা বলেই ফেলি,তোর সাজানো সংসারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছি। সংসার এবার থাকে কি না তা আমিও দেখবো।
” কি করেছি বল, ওজিহার সাথে তুই কি করেছিস”
“তা তুই তোর বউয়ের কাছে গেলেই যানতে পারবি..!
মুহিব কথা শেষ করেই খট করে ফোনটা কেটে দেয়।নাহিয়ান তাড়াতাড়ি গাড়ি স্টাট দেয়,
“” ওহ শীট, জ্যামে যেন গাড়ি না পরে ওজিহা কেমন আছে,কি করছে ও,,,?

চলবে…।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here