ফানাহ্ 🖤 #লেখিকা_হুমাইরা_হাসান #পর্বসংখ্যা_২১

#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_২১

সকালের মৃদু মিষ্টি প্রভাত কিরণ উঁকি দিল মোলায়েম কাপড়ের পর্দার ফাঁক দিয়ে। এক মুঠো হলদে রবিকর ঔজ্বল্য এসে হানা দিল মোহরের চোখে। উপচে পড়া নরম আলোর তীক্ষ্ণতায় চোখে টোকা পড়তেই কুচকে তাকায়। সকাল হয়েছে বুঝতে পেরেই আড়মোড়া ভেঙে ধীরগতিতে উঠে বসে৷ জানালার স্বচ্ছ কাঁচটা দিয়ে নীলাভ আকাশের বুকে শুভ্রতার ছড়াছড়ির দৃশ্যটা ভীষণ প্রাণোহর লাগছে।
মুহুর্ত খানেক সেদিকেই তাকিয়ে রইলো প্রফুল্লচিত্তে। আজ মনটা কেমন হালকা লাগছে, যেন কালো মেঘের জমাট ছাড়িয়ে পেঁজা তুলোর ন্যায় মেঘেরা ছোটাছুটির খেলা ধরেছে অন্তঃস্থলে, বহুদিন বাদে মনের মাঝে এক পশলা শৈথিল্যের অনিল আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে, অজানা কারণেই ভেতর ভেতর শিউলির ন্যায় আনন্দানুভূতির সুগন্ধি ছড়াচ্ছে। এই বেওয়ারিশ অনুভূতি, রাঙা ফিতেয় মোড়ানো ব্যকুলতা ভরা চাঞ্চল্যর হেতু খুঁজে পেল না মোহর।
সিথান পড়ে থাকা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে বিছানা থেকে নামতে গেলে ঘরের আশপাশে নজর বুলিয়ে কোথাও মেহরাজ কে দেখতে পেল না। মেহরাজের অনুপস্থিতি মৌনতায় অবগত করে দিল মোহরকে। প্রায়ই অনেক ভোরে বেরিয়ে যায় মেহরাজ। লোকটা রাতে কখন ঘুমাই মোহর টের পাইনা, আবার হার রোজ ঘড়ির কাটার স্থানের একচুল নড়চড় হয়না তার ঘুম থেকে জাগবার। একটা মানুষ এতটা সময়নিষ্ঠবান, পাংচুয়াল কি করে হয় মোহর বুঝে পায় না।

শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে একবারে বেরোলো মোহর ওয়াশরুম থেকে। মেডিক্যালে আজ সাড়ে নয়টাতে ক্লাস। এই তো আর ক’দিন তার পরেই ইন্টার্নি শুরু হবে। স্বপ্নের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে, মনের মাঝে সযত্নে লালিত খোয়াইশকে চোক্ষের সামনে সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠার মতো করে হাতের মুঠোয় আসতে যেন মোহর সচক্ষে দেখতে পারছে। আপ্লূত হয়ে ওঠে, স্বপ্ন পূরণের কথা ভাবতেই একরাশ প্রাণোচ্ছলতা ঘিরে ধরে মোহরকে।
চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়ালো মোহর। গায়ে জড়ানো হাফ সিল্কের কাপরের একটা লং কুর্তি। আসমানী রঙের উপরে সাদা হলুদ মিশেলের ছাপ। কাবার্ডের সিংহভাগ জুড়েই মোহরের জামা কাপড়। প্রতিটি পোশাকেই আভিযাত্য আর বহুমূল্যের ছাপ। এতো দামী জামা কাপড় আগে পড়ার সৌভ
খুব কমই হয়েছে মোহরের। জামা থেকে উঠে চোখ গেল নিজ চেহারা পানে। তামাটে বর্ণের গায়ের রঙটা আরও উজ্জ্বল হয়েছে কয়েক দিনে, হলুদের রঙ যাকে বলে। চোখের নিচের বিদঘুটে কালো দাগ গুলোও মিলিয়ে গেছে । এই কয়দিনে এতো পরিবর্তন! কই আগে তো এতো সুন্দর লাগেনি নিজেকে? এসবই কি এই দামী পোশাকের কারচুপি? নাকি সে নিজেই পরিবর্তিত হয়েছে নিজের অজান্তেই!

হুট করেই পেছনে ঘুরে তাকালো, পরমুহুর্তে নিজের বোকামিতে নিজেই ফিক করে হেসে উঠলো মোহর। সেই দিনের মতো আজও হয়তো মেহরাজ পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হয়েছিল মোহরের। পরিপাটি ভাবে তৈরি হয়ে, এক পাশে ঝুলানো ব্যাগ টা কাঁধে রেখে বাইরের দিকে হাঁটা দিল মোহর। দরজা দিয়ে বের হতে গিয়েও পা দুটো থামিয়ে নিল মোহর ঘার বাঁকিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো উত্তর দিকে দেওয়াল টা জুড়ে মধ্যিখান বরাবর বিশালাকৃতির ফটোফ্রেমের দিকে।
ব্ল্যাক স্যুট পরিহিত সুগম্ভীর চেহারার মানুষটার স্পীচ দেওয়ার দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করা হয়েছে। কথার তালে ঘাড় টা সামান্য বাদিকে কাঁৎ করে ধারালো চোখের নির্লিপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে আছে। থমকে আছে চেহারা, মুহূর্ত, আর মানুষটি। সম্ভবত ছবিটা কোনো সেমিনারে স্পীচ দেওয়ার সময়কালীন। তা মেহরাজের ব্যাকগ্রাউন্ডে বিশাল প্রজেক্টের আর সামনের ডায়াস দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
মোহাচ্ছন্নের মতো ওভারে ঘাড় বাকিয়েই তাকিয়ে রইলো মোহর, মিনিট দুয়েক বাদে হুশ ফিরলে সপ্রতিভ হয়ে সামনে তাকিয়ে অগ্রসর হতে লাগলো। নিজের এমন অদ্ভুত বেখেয়ালিতে নিজের উপরেই বিরক্ত হলো মোহর।

মেডিক্যালে এসে পৌঁছে মনটা আরও প্রফুল্ল হয়ে উঠলো মোহরের। মোহরকে রেখে আবারও ধুলো উড়িয়ে হারিয়ে গেল দামী গাড়িটা নিয়ে। মেহরাজ নিজে নেই তো কি,তার উপস্তিতি প্রতি পদক্ষেপে বুঝিয়ে দেয় মোহরকে ওর প্রতিটি দ্বায়িত্ববোধ আর যত্নে। মেহরাজ নেই বলে ভেবেছিল আজ হয়তো একাই যেতে হবে কিন্তু সে ধারণাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় মেহরাজ তার উপস্থিতি ছাড়াই। বাড়ি থেকে বের হয়েই মেহরাজের কালো মার্সিডিজ টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয় মোহর, তারপর মোহরের বিস্ময়কে আরও বাড়িয়ে দিয়ে গাড়ি থেকে বের হয় সেদিনের হাস্যজ্বল চেহারার ছেলেটা, সেই অমায়িক হাসি ঝুলানো মুখেই বলে

– স্যার জরুরি মিটিংয়ে শহরের বাইরে গিয়েছেন ম্যাডাম। তাই আমাকে পাঠিয়েছে আপনাকে মেডিক্যাল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে।

যেখানে নিজে না থেকেও সহচর কে পাঠিয়েছে, তাই সেটায় নাকচ করার মতো দুর্বুদ্ধি আর দেখালো না মোহর।
মেডিক্যালের ক্যাম্পাসের এক কোণায় একটা রেইনট্রি। শরত হওয়া সত্ত্বেও শুকনো পাতায় বিছিয়ে আছে গাছের নিচটা। আদ্রতায় জড়ানো পাতা গুলো একটু বাতাসেই নড়েচড়ে উঠে, ঝমঝম করে লুটিয়ে পড়ে শুকনো হলুদাভ পাতা গুলো। সিড়ি বেয়ে উঠে সোজা ক্লাসরুমে ঢুকেই দেখা পেল অতি আকাঙ্ক্ষিত চেহারাটা, মোহরকে আসতে দেখে সরু হাস্য মুখে শ্রীতমা বলল

– আসলি তুই, আমি তো ভাবলাম দেরি করছিস যখন আসবিই নাহ।

মোহর কিঞ্চিৎ হেসে বলল

– এই আসলাম। না আসার তো কারণ নেই।

শ্রীতমা চোখ ছোট করে মোহরের দিকে তাকিয়ে আমুদে গলায় বলল

– ভাইয়ার জন্য দেরি হয়েছে তাই না!

শ্রীতমা হতে এহেন কৌতুক কস্মিনকালেও আশা করেনি মোহর৷ অপ্রস্তুত হয় অনেকটা, ক্ষুন্ন গলায় বলল

– ধ্যাত। এসব কি যা তা বলিস

– ওমা যা তা কেন বলবো। বর যখন আছে ঘর থেকে বেরোতে দেরি হতেই পারে।

মোহর কড়া নজরে শ্রীর দিকে তাকালে ও বোকা বোকা চেহারা করে বলল

– হেহে, থুক্কু মানে থুড়ি। মজা করলাম দোস্তো। রেগে যাচ্ছো কেন

ওদের আলাপচারিতার মাঝেই ড. ফায়াজ করিম ঢুকলেন ক্লাসে। আড়চোখে মোহরের দিকে একবার তাকিয়ে নিজ কাজে মনোনিবেশ করলেন। বেশ দীর্ঘ সময় ক্লাস শেষে একসাথে বেরোলো দুজনে। সিড়ি দিয়ে নেমে নিচের করিডর দিয়ে বাইরের দিকে যাচ্ছিল তখনই পেছন থেকে সুপরিচিত গলায় ঘুরে দাঁড়ালো দুজনে

– মোহর, তোমার সাথে একটু কথা ছিল। আমার কেবিনে আসতে পারবে?

মোহর দ্বিধাদ্বন্দ্বিত চেহারায় একবার শ্রী-এর মুখের দিকে তাকালো। ওর চেহারাতেও বিব্রতি থাকলেও তা সামাল দিয়ে মোহরকে চোখের ইশারায় যেতে বলে নিজে বাইরেই দাঁড়ালো।
মাঝারি আকৃতির কেবিনটার মধ্যিখানে ডেস্ক। তার সামনে কম্পিউটার, চেয়ার। মোহর দাঁড়িয়ে আছে সামনাসামনি, ফায়াজ মোহরের নিষ্প্রভ চেহারায় এক পলক চেয়ে স্বাভাবিক গলায় ই বলল

– বসো মোহর।

– ইটস ওকে স্যার, আপনি প্লিজ বলুন না কি বলতে চান

মোহরের সকপট কথায় ফায়াজের চেহারায় দুর্বোধ্য চিন্তার ছাঅ জড়ো হলো। কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই অকপটে বলল

– মোহর তুমি কি যা করছো ভেবে চিন্তে করছো?

মোহর জিগাংসুক নজরে তাকালে ফায়াজ আরও স্পষ্ট করতে সুস্পষ্ট বর্ণনায় বলল

– তুমি এই অ্যাক্সিডেন্টলি বিয়েটা মেনে নিয়ে চলতে চাও? এমনটা আমি ভাবতে পারছি না মোহর। চেনা জানা নেই একজনের সাথে পাড়ার লোক ধরে বেঁধে বিয়ে দিল আর করেও নিলে? তাও যা করেছো এখন সেই মানুষটারই বউ হয়ে আছো। এখনকার মানুষ ফ্রড, মুখোশধারী ক্যারেক্টারলেস হয়।এরা তোমার কোন ক্ষতি করে ছেড়ে দেবে ভাবতেও পারবে না। তুমি এখনো কোনো স্টেপ নিচ্ছো না কেন?

মোহর এতক্ষণের কথা গুলো চুপচাপ শুনলেও এখন বেশ সকৌতুক গলাতে জিজ্ঞাসা করলো

– স্টেপ বলতে?

– ডিভোর্স। তোমার উচিত সেই লোকটা যার
সাথে বিয়ে হয়েছে তাকে ডিভোর্স দিয়ে এই সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন সম্পর্ক থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়া

মোহর ফায়াজের কথা গুলো নিরুত্তর গলাধঃকরণ করলেও সে মনে মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হলো। কারণ টা হয়তো ও নিজেও বলতে পারবে না কিন্তু মেহরাজকে না জেনে শুনে ওর ব্যাপারে এতগুলো কটুবাক্য একেবারেই অসহ্য লাগলো মোহরের, নিজের সবচেয়ে পছন্দের আইডল, টিচারকেও ভীষণ অসহ্য লাগলো মোহরের। ননতজানু মস্তকেই অপ্রসন্ন গলায় বলল

– স্যার আপনি আমাকে ভাবেন আমার শুভাকাঙ্ক্ষী বলেই এতসব বলছেন তা আমি জানি। কিন্তু আমার কিছু করার আছে বলে আমি মনে করিনা। বাবা মা ভাই বোন কেও ই নেই আমার। হয় মরে গেছে নয় ছেড়ে দিয়েছে। পুরো লোকসমাগমে যখন মানুষ আমাকে থুথু দিচ্ছিলো। তখন যেই মানুষটা আমার সম্মান বাঁচিয়ে নিজের ঘাড়ে দ্বায়িত্ব নিয়েছে তাকে আর যাই হোক ফ্রড বলতে পারিনা। আমাকে যদি ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়ার ইচ্ছে হতো তবে এতগুলো দিন নিশ্চিন্তে কোনো সমস্যা ছাড়াই ও বাড়িতে থাকতে পারতাম নাহ।

ফায়াজ বিস্মিত হলো মোহরের জবাবে। এমনটা একেবারেই প্রত্যাশা করেনি ও। মোহরের কার সাথে বিয়ে হয়েছে সেটা এখনো জানতে পারেনি ফায়াজ। তবে ওর মনে হয়েছে কার
সাথে বিয়ে হয়েছে এটার থেকে ওকে তার থেকে আলাদা করে দেওয়াই হয়তো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে মোহরের জবাবে তার ধারণা নড়বড়ে
হয়ে উঠলো। ললাটে ভাঁজ ফেলে বলল

– তাহলে তুমি কি বলতে চাচ্ছো? তার সাথেই থাকতে চাও তুমি? এতটা বিশ্বাস করে ফেলেছো এই কদিনে?

– তাও বলিনি আমি। ডিভোর্স দিতে চাইলেও মাস ছয়েক অপেক্ষা করতে হবে আমায়। হুট করেই কোনো সিদ্ধান্তে আসতে চাইনা আমি। কিসমত আমাকে যেই মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে সেখানেই নাহয় অপেক্ষা করি, কোনো রাস্তা পেলেও পেতে পারি।

ফায়াজ ক্ষুন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মোহর উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে সবিনয়ে বলল

– স্যার আপনার কথা শেষ হলে আমি আসতে পারি? এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।

ফায়াজ মোহরের কথার পৃষ্ঠে জবাব দিল না। প্রচণ্ড অসন্তুষ্টি সত্ত্বেও ঘাড় নাড়িয়ে মোহরকে বেড়িয়ে যাওয়ার অনুমতি দিতেই দ্রুত প্রস্থান করলো মোহর। মেজাজ টা হুট করেই চড়ে গেল ওর, এমন অহেতুক রাগ হওয়ার কারণে নিজের উপরেই বিরক্ত বোধ করলো মোহর।

একদম মাঝ দুপুরের সময়। মেডিক্যাল থেকে বেরিয়েছে অনেক আগেই, তবুও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মোহর। দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল হবে, ওকে জোর ক
দাঁড় করিয়ে রেখেছে শ্রী। অরুনাভ আসবে আজ শ্রীয়ের সাথে দেখা করতে আর শ্রী মোহরের সাথে দেখা করাবে বলেই ওকে ও দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
ওদের দুজনের অপেক্ষার অবসায় ঘটিয়ে অবশেষে উপস্থিত হলো টয়োটা ইনোভার সিলভার ভার্সনের গাড়িটা। অবিলম্বেই বেড়িয়ে এলো গাড়ি থেকে শ্যাম রাঙা গড়নের, ঝাকড়া চুলের একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। পোশাক আসাক বেশ সাধারণ ধাচের হলেও গাড়িটা বেশ দামি। মোহর ভাবুক হওয়ার আগেই শ্রী কনুই দিয়ে গুতা দিল মোহরের বাহুতে, নরম গলায় বলল

– ওই যে এসে গেছে ও

শ্রীয়ের লজ্জাবরিত মুখাবয়বে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই লম্বা সরু দেহাবয়বের পুরষটা এগিয়ে এসে বিনয়ী গলায় বলল

– অনেকক্ষন অপেক্ষা করিয়ে ফেলেছি? আই আম সরি আসলে রাস্তায় খুব জ্যাম ছিল

– না না আমার কোনো সমস্যা হয়নি। সে তো ও দাঁড়িয়ে আছে সেই কখন থেকে। তোমার সাথে দেখা করাবার জন্যেই তো ওকে ধরে রেখেছি

শ্রীয়ের কথা অনুসরণ করে মোহরের দিকে তাকালো সাধারণ চেহারার শ্যামপুরুষটি। শ্রী আবারো বলল

– ওই মোহর। তোমাকে বলেছিলাম তো

– আসসালামু আলাইকুম

হুট করেই সালাম দেওয়াই চমকে উঠলো মোহর। অরুনাভ মুখার্জি নাম ছেলেটার, হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও প্রথম দেখাই সাবলীল বাংলায় সালাম দেওয়া টাই বেশ অবাক হলো মোহর। তবে মোহরের বিস্ময় কাটিয়ে ছেলেটি সহাস্য গলায় বলল

– হ্যাঁ চিনেছি তো। আপনার কথা শ্রী এতবার বলেছে যে মুখস্থ হয়ে আমার। ও পরিচয় করিয়ে না দিলেও চিনতে পারবো

বলে আবারও হেসে উঠলো অরুনাভ। এবারে মোহর ও হাসলো সৌজন্য সুলভ। ছেলেটার ব্যবহার হাসি দুটোই বেশ মিশুক স্বভাবের
একেবারে শ্রীতমার স্বভাবের মতই। মোহরের ভেতরটায় হুট করেই প্রশান্তি খেলে উঠলো। শ্রীতমার মুখের হাসিটা বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছে একটা মানুষের ভালোবাসা পেয়ে ও কতটা সুখপূর্ণ।

_____________________

বিকেল গড়িয়েছে বেশ আগে। সন্ধ্যা আর অপরাহ্নের মাঝামাঝি সময়। মোহর ঘরে বসে পড়ছিল, মেহরাজ এখনো ফেরেনি বাড়িতে। বাড়ি ফিরতে মোহরের প্রায় মাঝ দুপুর গড়িয়েছিল, অভিমন্যু নামক ছেলেটা ওকে নিতেও এসেছিল। যেহেতু শ্রীতমার সাথে আগে আগেই বেরিয়েছিল মেডিক্যাল থেকে, তাই অভিমন্যু ঠিক ওর ফেরার সময়টাতেই এসেছিল।

– ভাবী?

সাঞ্জের গলার ডাক শুনে বই থেকে মুখ তুলে তাকালো। সাঞ্জের প্রফুল্লতায় উৎসাহিত মুখ খানা হুট করেই চুপসে গেল মোহরকে পড়তে দেখে, আফসোসের গলায় বলল

– ওমা,তুমি কি গো বিকেল বেলাতেও আবার কেও পড়ে নাকি?

মোহরের অধরে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটলো। বইটা উল্টে রেখে বলল

– তাছাড়া আর কি করবো বলো

– কি করবে মানে! কি দারুণ ওয়েদার দেখেছো? এইরকম ওয়েদারে ছাদবিলাস করতে হয় জানো না?

সাঞ্জের ছাদবিলাস কথাটা শুনে মোহর ফিক করে হেসে বলল

– ছাদ বিলাসও হয়?

– অবশ্যই হয়। চলো তুমি আর আমি ছাদ বিলাস করবো

বলে মোহরের হাত ধরে হাঁটা ধরলো। সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠে আসতেই এক অস্থির প্রফুল্লতা ঝাপটে ধরলো মোহরকে। এই বাড়ির ছাদে এর আগে আসা হয়নি ওর। ঝকঝকে টাইলসের মেঝে করা ছাদটাতে ছোট ছোট এ্যাডযাস্টেড টব লাগানো আর তার ভেতরে নানারকম ছোট বড়ো চারা। বিশালাকৃতির ছাদটা কোনো মাঠের চেয়ে ছোট নয়। সাঞ্জে ছুটে এগিয়ে গেল, আস্তেধীরে রেলিঙের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো মোহর, ডানি দিকে ঘাড় ঘুরালেই তাথই কে দেখে বিস্মিত হয়ে বলল

– আপা আপনি?

ছাদের কোণার দিকটাতে একা একাই দাঁড়িয়ে ছিল তাথই, ওদের আসাটা খেয়াল করেনি এতক্ষণে। মোহরকে দেখে প্রথমে ললাটে ভাঁজ ফেললেও পেছনে লাফালাফি করতে থাকা সাঞ্জেকে দেখেই কপাল প্রসারিত করে বলল

– বাঁদরটা তোমাকেও ধরে এনেছে? এই স্বভাব ওর, ছোট থেকেই একটু মেঘ বৃষ্টি করলেই লাফাতে লাফাতে ছাদে উঠে আসবে আর আশেপাশে যে থাকবে তাকেও ধরে আনবে

– আর আশেপাশের মানুষ টা তাথই ম্যাডাম ই যে নিজেও এসে লাফাতো আমার সাথে

বলে ফিকফিক করে হেসে উঠলো সাঞ্জে। মোহর ও কিঞ্চিৎ গাল এলালো। তাথই বিরক্ত হলেও মুখে আর কিছু বলল নাহ। সাঞ্জে তাথইয়ের কাছে এসে বলল

– তুই ও বৃষ্টিতে ভিজতে এসেছিস তাই না রে আপু?

– একদমই না। আমি এমনিতেই ছাদে ঘুরতে এসেছিলাম।

– সে যাই হোক। এসেছিস যখন ভিঁজেই যা।কতদিন তোর সাথে বৃষ্টিবিলাস করিনা

তাথই ভ্রুকুটি করে তাকালো সাঞ্জের দিকে। কটমটে গলায় বলল

– তোর বৃষ্টিবিলাস তুই ই কর। আমার ইচ্ছে নেই এসবে

বলে আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে প্রস্থান করলো। সাঞ্জে ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে আবারও নিজের মতই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মোহরকে উদ্দেশ্য করে বলল

– ভাবী আমি একটা কবিতা পড়েছি বৃষ্টি নিয়ে শুনবা?

মোহরের ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দেওয়াই অবিলম্বেই ছন্দ মিলিয়ে বলল

– মঙ্গলে ভোর রাত থেকে হইলো শুরু, তিনদিন মেঘের গুরুগুরু। তারপর, বুধের সকালে নামলো জল বিকালে মেঘ কয় এবার চল।

বলেই হুহা করে হেসে দিল। পাঠ্য বইয়ের কবিতা শুনিয়ে নিজেই হেসে একাকার করলো। প্রকৃতির হয়তো সাঞ্জের অদ্ভুত কবিতা টা ভীষণ পছন্দ হলো, মিনিট দুয়েকের মধ্যেই আকাশের বুক চিরে বিন্দু বিন্দু ফোঁটায় আদ্রিত হলো ধরণী। ছোট ছোট ফোঁটা গুলো একীভূত হয়ে বৃহৎ আকারে মুষলধারে বৃষ্টি নামালো। কয়েক সেকেন্ডের অন্তরেই ভিজে কাক ভেজা হলো ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মানবী। এতদিন বাদে বৃষ্টিতে ভিজে মোহরের মনটা সানন্দে ভরে উঠলো। এর মাঝেই নাজমা সাপটের ভয়ে জুবুথুবু হয়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে বলল

– সাঞ্জে আপা, আপনেরে কাকলি ম্যাডাম এক্ষনি ডাকতাছে।

– কে আমাকে?

– হ্যাঁ, এক্ষুনি যাইতে কইছে। নাইলে খবর আছে কইছে

বলেই ভেতরে ঢুকে গেল নাজমা। সাঞ্জে প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুটি গুটি পায়ে নেমে গেল। কারণ মায়ের মেজাজ সম্পর্কে বেশ জানা আছে, কথা না শুনলে আবারও নাটক শুরু করবে।

সাঞ্জে চলে গেলেও মোহর ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো, মানুষের নিঃস্তব্ধতায় এখন শুধু প্রকৃতির গর্জন। নড়চড় হীনা তাকিয়ে রইলো একটু দূরের ওই বিলটার দিকে। কানে একটানা আওয়াজ আসছে একবার মনে হচ্ছে নদীর কলধ্বনি, কখনো বা মনে হচ্ছে পাতার মর্মর শব্দ। বাতাসের দাপট আর বৃষ্টির কলধ্বনি মিলে মিশে একাকার হয়ে সুর তুলেছে, সেই সুর শ্রবণযন্ত্র ভেদ করে অন্তঃস্থলে স্নিগ্ধতার প্রলেপ মেখে দিচ্ছে।

মোহর ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে একদম রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। অন্যমনস্ক চোখে নিমিত্তে তাকিয়ে দেখছে গাছপালা মাঠঘাট প্রকৃতির ভেতর নতুন প্রাণের হিল্লোল। প্রাণের আনন্দে নারিকেল, আম, সুপারি, কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দুলছে।পাতাগুলো কখনো ছড়িয়ে যাচ্ছে কখনো একত্রিত হয়ে যাচ্ছে গভীর আলিঙ্গনে। চোখ তুলে তাকালো সুবিশাল বিস্তৃর্ণ আকাশের পানে। যেন ধূসর বর্ণা কোনো জাল দিয়ে মেঘ গুলো তাকে আগাগোড়া মুড়িয়ে রেখেছে।
তৎক্ষনাৎ মোহর নিজের পেছনে একটা উপস্থিতি অনুভব করলো, অবচেতন মন এক লহমায় আগন্তুকের পরিচয় বার্তা মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দিল। কেমন এক ভাঙা চূড়া উৎকণ্ঠা অস্থিরতা ঘিরে ধরলো মোহরকে। তবুও অবাধ্য মনের নির্দেশনাতে হার মেনে ধীরস্থির ভাবে পেছনে ঘুরে দাঁড়ালে লম্বা চওড়া শরীরের মানুষটার কাক ভেজা চেহারাটা সফেদ পর্দার ন্যায় চোখে বিঁধে লাগলো।

– ভিজছেন কেন মোহ?

– আপনি কখন এলেন?

– এখনি। বাড়িতে ঢোকার সময় ছাদে দেখেছি আপনাকে।

মেহরাজের কণ্ঠস্বরটা বৃষ্টির ফটিকজলের চেয়েও শৈথিল্যময় ঠেকলো মোহরের নিকট। প্রশ্বস্থ বুকে লেপ্টে থাকা সাদা শার্টটায় একবার তাকিয়ে অন্যত্র ফিরে বলল

– এমনিই, ভাল্লাগছে।

মেহরাজ এগিয়ে এলো দুকদম। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ানো মোহর সরে যাওয়ার রাস্তা পেল না আর নাইবা ইচ্ছে করলো। বৃষ্টির ঝাপটাকে পুরোদমে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে এলো মেহরাজ মোহরের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে শ্রান্ত চোখে তাকালো ভিজে টকটকে হওয়া মেদুর গালে, ব্যতিব্যস্ত ভাবে কেঁপে ওঠা ওষ্ঠের পানে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়লো মেহরাজ।
ভ্রম ধরিয়ে দিচ্ছে মোহরের এই সদ্যস্নাত রূপ। মনের ভেতর কোনো ভাবনাচিন্তা আনতে পারলো না, শুরু টের পেল এমন এক অনুভূতি যার নির্দিষ্ট কোনো স্পষ্ট রূপ নেই। মনের এমন বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বেসামাল হলো চোক্ষের দৃষ্টি, হাতটা এগিয়ে মোহরের মুখে উপচে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিতেই কেঁপে উঠলো মোহর। বাদলের হীম শীতল ফোঁটার চেয়েও মেহরাজের স্পর্শ সারা গায়ে পুলক ফুটিয়ে দিল, সরে আসতে নিলেও মেহরাজকে সরাতে পারলো না, দূরত্ব বজায় রেখেই কোমরের দুই পাশ দিয়ে রেলিঙের উপরে হাত রাখলো মেহরাজ, গায়ে কাটা ফুটানোর ন্যায় মোহান্বিত গলায় বলল

– আমার সাথে ভিজবেন মোহমায়া।
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#হীডিংঃ অনেক বড়ো পর্ব, রিচেইক করার সময় পাইনি। ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন।

©Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here