ফানাহ্ 🖤 #পর্বসংখ্যা_৪২ #হুমাইরা_হাসান

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৪২
#হুমাইরা_হাসান

– এই সময় কোথায় যাচ্ছো মোহর?

মোহর ফোন থেকে মুখ তুলে তাকালো তাথইয়ের। ঘরের দিকে। তাথই গায়ে ওড়নাটা জড়িয়ে বলল

– বের হচ্ছো কোথাও? চলো একসাথেই বের হই

মোহর ভ্রু কুচকে বলল

– এখন তুমি কোথায় যাবে আপা?

– একটু কাজ আছে, আমি এসে বলছি। তুমি নিচে গিয়ে অপেক্ষা করো আমি তোয়াকে তৈরি করে নিয়ে আসছি

মোহর ঘাড় নাড়িয়ে নীরব সম্মতি দিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলো। ডাইনিং রুমের কাউচে পায়ের উপর পা তুলে আয়েশী ভঙ্গিতে পা দুটো নাচাচ্ছে। মোটাসোটা শরীর টার ভার এলিয়ে হেডবোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। ঘড়িতে সময় প্রায় দুপুর বারোটা,এই সময়ে চা? তবে তার চেয়েও বেশি অপ্রস্তুত হলো মোহর আগন্তুককে দেখে। এই মানুষ টা এমন হুট করেই চলে আসে আর হুট করেই উধাও হয়ে যায় কিভাবে! সাঞ্জের বার্থডে পার্টির দিন আসলো আবার পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখলো নেই। এই ব্যাপারটা নোমানের ক্ষেত্রেও খেয়াল করেছে মোহর। মা ছেলে যেনো একই ধাচের। তবে সাঞ্জের বার্থডে পার্টির পরদিন সকালে যেই তামাশা টা হলো তার আগেই যে ভদ্রমহিলা বাড়ি ত্যাগ করেছে এ ব্যাপারে মোহর বেশ স্বস্তি বোধ করে।
একটা ব্যাপার ওর খুব স্পষ্ট ভাবে মনে হয় যে সেদিন এই মানুষটা থাকলে হয়তো নাটক আরও দ্বিগুণ হতো। আমাদের আশেপাশে এমন কিছু মানুষ থাকে যাদের চেহারা দেখলেই বোঝা যায় এদের মাঝে কু’টনীতি ঠেসে ঠুসে ভরা, যেনো চেহারাতেই এদের ব্যক্তিত্বের ছাপ পড়ে থাকে। মোহর বিব্রতকর একটা চেহারা নিয়েই ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে আসলো। মোহরকে দেখে মুখের হাসিটা বিস্তার হলো রুকাইয়া বেগমের, যেনো ওর জন্যেই অপেক্ষা করছিলো। ঠিক হলোও তাই, জোরকৃত মেকি হাসিটা টেনে ভারিক্কি গলার স্বরটা ভেসে এলো

– আরে বউমা যে! আসুন আসুন আপনার মুখ টাও তো দেখা যায় না।

মোহর মুখে তেমন কোনো অভিব্যক্তির ছাপ পড়লো নাহ। একটা দ্বিরুক্তিকর মুখাবয়ব নিয়েই এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো। রুকাইয়া বেগম চায়ের কাপে শেষ চুমুক টা টেনে পা নামিয়ে বসলো, মোহরকে আগাগোড়া পরখ করে বলল

– বসুন না বউমা। আপনাকে তো পাওয়াই যায় না। আপনার কি কথা বলার একটুও সময় হবে না?

কথার মাঝেই সূক্ষ্ম তাচ্ছিল্যের রেশটুকু মোহর যথাযথ ভাবে উপলব্ধি করতে পারলেও কোনো রূপ প্রতিক্রিয়া দেখালো নাহ। চুপটি করে পাশের সোফাতে বসলো। রুকাইয়ার চোখে মুখে কেমন অদ্ভুত একটা দ্যুতি। চেহারার ছাপটা একেবারেই সুবিধাজনক ঠেকলো না মোহরের, তবে ওর ভাবনাতে দাড়ি বসিয়ে দিয়ে মাঝবয়স্কা হাস্যমুখে প্রশ্ন করলো

– তো বউমার পরিবার, বংশ এসব ব্যাপারে তো কিছুই বললে নাহ। কোথায় থাকতে আগে? তোমার বাপ মা কোথায়,তারা কি আসেনা তোমাকে দেখতে? অবশ্য দেখতে আসার কারণ নেই, যেই বাড়িতে মেয়েকে বসিয়েছে পায়ে পা তুলে থাকবে তা তাদের ও জানা আছে হয়তো

কটাক্ষ বাণী টা বেশ করেই বুঝতে পারলো মোহর। না তো দেখার শুরুতেই কেও এ ধরনের প্রশ্ন ও করে? তাও এতোদিন পর! ভদ্রমহিলা শুনেছে অবশ্যই তবুও ইচ্ছে করেই খোঁচাচ্ছে নিশ্চয়? মোহর মুখ ভার না করেই বলল

– বাবা মা নেই। বোন আছে, বিবাহিত

মোহরের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে পালটা প্রশ্ন ছুড়ল মহিলা। যেনো আগে থেকেই প্রস্তুত করে রেখেছে সবটা। বেশ ঔদ্ধত্যের সাথে কটা’ক্ষবাণী টা এবার ছুড়ল

– তোমার বাবা নাকি পুলিশ অফিসার ছিলো শুনেছি? একবার নাকি বড়সড় কোনো অ’নৈতিক কাজ করে ধরা পড়েছিল?

মুহুর্তেই মোহরের নির্জীব চোখ খানা কুচকে এলো। রুষ্ট একটা চাহনি মেলে ধরলো রুকাইয়ার পানে। রুকাইয়া কিঞ্চিৎ বিব্রত হলেও তা দমিয়ে আবারও তাচ্ছিল্য হেসে বলল

– তা এ বিষয়ে তোমার কি মতামত? অবশ্য পুলিশি কারবার যা তাতে ঘু’ষ আর হা’রাম টাকা ছাড়া এদের পেটে ভাত পরে না

মোহর চটে উঠলো ব্যাপকভাবে। মৃত বাবার নামে এরূপ বিশ্রী কটুক্তি কোনো ভাবেই সহ্য হলো না ওর, নিজেকে ভীষণ ভাবে সংযত রাখার প্রচেষ্টায় বলল

– আপনাকে কে বলেছে পুলিশ হলেই ঘু’ষ আর হা’রাম টাকায় চলতে হয়। এটা নিতান্তই আপনার ছোট মস্তিষ্কের সংকুচিত মনোভাব। যারা সৎ পথে চলে তাদের ঘরে নি’ষিদ্ধ পয়সার একটা সিকিও আসে না

রুকাইয়া আড়চোখে তাকালো মোহরের ক্রুদ্ধ মুখাবয়বে। খানিক গর্জে উঠে বলল

– আমাকে জ্ঞ্যান দিচ্ছো মেয়ে? কি মনে করো কোনো খবর ই রাখিনা? তোমার বাবা যে আন্ডারওয়ার্ল্ডের দূর্নীতি দলের সাথে হাত মিলিয়ে তাদের তথ্য গোপন রাখার স্বার্থে ঘু’ষ নিয়েছিলো এটা পুরো নিউস চ্যানেল জানিয়েছে। একটা ঘু’ষখোরের মেয়ে হয়ে মুখ উঁচিয়ে কথা বলতে লজ্জা করে না?

– আপনি একটু বেশিই বলছেন। গুরুজন বলে আমি এখনো ভদ্রতা বজায় রেখেছি। কিন্তু আমার পরিবার বা আপনজনের নামে কুৎসা করলে, মিথ্যে অপবাদ দিয়ে অপমান করলে আমি কিছুতেই সহ্য করবো না সে আপনি যেই হন না কেনো।

রুকাইয়া বেগম যেনো মোহরকে অবলা, শান্তশিষ্ট মেয়ে হিসেবেই ধারণা রেখেছিলেন। উনার মুখের সামনে কি না একটা মেয়ে আঙুল তুলে শাসানি দিচ্ছে! ফুঁসে উঠলো মহিলা নিমিষেই। মোহরের ডান হাত টা নিজের ভারী চর্বিযুক্ত বলিষ্ঠ হাতে চেপে ধরলেন, ফোসফাস করে বললেন

– তোমার সাহস তো কম নয়, তুমি কাকে শাসাচ্ছো? চেনো আমাকে? কি মনে করেছো ভুলে গেছি? তোমার জন্যে আমার ছ…

– আপা?

খুব পরিচিত এক নারী কণ্ঠ কানে আসতেই রুকাইয়ার হাত ঢিলে হয়ে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে আম্বির কৌতুহলী চেহারাটা স্পষ্ট হলো। মোহরের হাতটা তখনো হাতের মুষ্টিতে চেপে রেখেছে ভদ্রমহিলা, আম্বি সূক্ষ্ম চোখে একবার তাকালো সেই হাতের দিকে, রুকাইয়া পুরোপুরি না ছাড়লেই অনেকটা আলগা করে দিলো। আম্বি যেনো খুব সাবধানী চোখে মোহরকে কিছু একটা ইশারা করলেন। তার অর্থোদ্ধার করার আগেই সিড়িতে ধুপধাপ পায়ের শব্দ শোনা গেলো।

– মোহর চলো

তাথই এগিয়ে এসে মোহরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল। কিন্তু উপস্থিত তিনটা চেহারাতে কেমন সুনসান নীরবতা, মোহরের মুখ ভার দেখে ভ্রু জড়ো হলো তাথইয়ের। কৌতুহলী মুখে প্রশ্নটা করার আগেই মোহর উঠে দাঁড়ালো, কিঞ্চিৎ হেসে বলল

– চলো আপা

বলেই প্রস্থান করলো। দরজার চৌকাঠ মাড়িয়ে তাথইয়ের আগেই বেরিয়ে এলো। তাথই কিছুটা আঁচ করতে পারলেও তৎক্ষনাৎ কোনো প্রশ্ন করলো না
বাড়িতে গাড়ি থাকা সত্ত্বেও দুজনে রিকশা ডেকে চেপে বসলো। স্বচ্ছ আকাশ আর ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাসে রিকশা চড়তে বেশ লাগছে। মোহর তাথইকে জিজ্ঞেস করলো

– তুমি কোথায় যাবে বললে না তো আপা?

– কেনো তোমার সাথে গেলে কি খুব সমস্যা হবে?

মোহর স্থুল দৃষ্টিতে তাকালো। খানিক ভেবে মলিন গলায় বলল

– আমি শ্রীতমাকে দেখতে যাচ্ছি আপা। কাল রাত থেকে ওর জ্বর খুব। হোস্টেল সুপারের কাছে আমার নাম্বার টা দিয়েছিলাম উনিই ফোন করে জানিয়েছেন

– আচ্ছা মোহর, তোমার আমাকে ঠিক কেমন মনে হয় বলো তো?

মোহর প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালো বাচ্চা কোলে করে রাখা নারী চেহারার দিকে। স্নিগ্ধ মুখের একটু একটু হাসি ছোঁয়ানো মুখটাতে চেয়ে বিব্রত হয়ে বলল

– কোন ব্যাপারে?

– যেকোনো। মানে তোমার কি আমাকে ওইসব মেয়েদের মতো মনে হয় যে স্বামী অন্য কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেছে বলে আমি তাদের উপর ক্ষেপে যাবো, হিংসে করবো তাদের ক্ষতি চাইবো?

মোহর ঘন ঘন মাথা নাড়িয়ে বলল

– না না! তেমন কেনো মনে হবে?

– তাহলে আমিও যদি শ্রীতমাকে দেখতে যাই তাহলে তোমার কেনো আপত্তি হবে?

মোহর শান্ত স্বরে বলল

– আমার কোনো আপত্তি নেই আপা। আমি শুধু চাই আপনি, শ্রীতমা দুজনই ভালো থাকুন। একে অপরকে দেখে যদি..

– যদি ঘা তাজা হয়,কষ্ট হয় যন্ত্রণা দেওয়া জিনিস গুলোর কথা মনে পড়ে যায় তাই তো?

মোহর নিশ্চুপতায় সম্মতি দিলো। তাথইয়ের মুখের হাসিটা আরও প্রসারিত হলো। কিঞ্চিৎ হেসে বলল

– ঘা শুকিয়ে সেই চা’মড়া তুলে ফেলেছি অনেক আগেই। যেখানে ক্ষত ই নেই সেখানে কষ্ট কিসের? যদি তাই হতো তাহলে আমি সেদিনই শ্রীতমাকে অনেক কিছু শুনিয়ে দিতে পারতাম যেদিন ও আমার বাড়িতে এসেছিলো। আমি জানি ও আমার চেয়েও বেশি ভুক্তভোগী। আমার চেয়েও ওর যন্ত্রণা টা দ্বিগুণ। কাওকে ভালোবেসে, একবুক ভরসা রেখে ঠকে যাওয়ার চেয়ে বেশি কষ্টের কিছুই হতে পারে নাহ, যেটা ও সহ্য করছে।

মোহর অপলক তাকিয়ে রইলো শ্যামাঙ্গিনীর মুখের দিকে। এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো বুকের সমস্ত যন্ত্রণাটুকু ফুটে উঠলো তাথইয়ের কথাটির মাঝে। তবুও মুখে অদ্ভুত হাসি, যেই হাসিতে তাকালে মোহরের মনে হয় এই মানুষটার অনেক ভালোবাসা প্রাপ্য। আসলে যতটা শক্ত দেখায় নিজেকে ভেতরে ততটাই দূর্বল। এই মানুষটার আসলেই ভীষণ ভালোবাসা প্রাপ্য!

রিকশা থেকে নেমে পাঁচতলা ভবনটার দিকে এগিয়ে গেলো দুজনে। সিড়ি বেয়ে দুইতলা উঠে কাঙ্ক্ষিত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু ঠেলা দিতে খুলে গেলো স্টিলের দরজাটা। ভেতরে বিছানাতে আধশোয়া হয়ে এক নারীমূর্তি। অনড়,নিষ্প্রতিভ মুখটার উপরে এক হাত রেখে চোখ বুজে আছে। আদও ঘুমিয়ে আছে কি না মোহর বুঝতে পারলো না। এগিয়ে এসে ওর কপালে হাত ছোঁয়ালে নড়েচড়ে উঠে অপ্রস্তুত চেহারায় তাকালো শ্রীতমা। অক্ষিকোটরে দেবে যাওয়া চোখটার প্রসারিত চাহনিতে বিস্ময় ভরা, চমত্কত গলায় বলল

– তুই? তুই হঠাৎ! এখানে?

– কেনো আমি আসতে পারিনা? আমি কি কেও না?

শ্রীতমা লঘুমস্তিষ্ক পূর্ণ চাহনি মেলে বলল

– তা কখন বললাম। এভাবে হুট করেই এসেছিস তাই

– মুখে না বললেও তোর ব্যবহারে স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে। নিজেকে কি খুব বড়ো মনে করিস? কাল থেকে জ্বরে পরে আছিস অথচ আমাকে একটা বার জানানোর প্রয়োজন বোধ করলি না?

– আসলে আমি ভাবছিলাম..

এইটুকু বলেই আমতা-আমতা করতে থাকলো শ্রীতমা। মোহর ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রুক্ষ গলায় বলল

– এই ভেবেছিস যে তুই এখন খুব বড়ো মাপের মানুষ হয়ে গেছিস। আমাকে আর কিছু বলার প্রয়োজন তোর মনে হয় না তাই তো? আমি যদি হোস্টেল সুপারের কাছে নিজের নাম্বার টা না দিতাম তাহলে এখানে কেও উলটে পরে থাকলেও জানতে পারতাম না। কিভাবে জানবো মাস্টারনি হয়েছে তো, নিজেই সব বেশি বোঝেন

– আহা, বেচারি অসুস্থ তো। আর তুমিও এতো ব’কতে পারো মোহর!

এতক্ষণ মোহরের দিকে তাকিয়ে শ্রীতমা খেয়াল ই করেনি দরজাতে আরও একজন দাঁড়িয়ে আছে, নারীকণ্ঠের উৎসের দিকে তাকালে ভীষণ অপ্রত্যাশিত চেহারার উপস্তিতিতে শ্রীতমা ভীষণ হতবিহবল হয়ে যায়। ওর নিষ্পলক চোখের চাহনিতে চেয়ে তাথই এগিয়ে আসে, মোহরকে উদ্দেশ্য করে বলে

– শ্রীতমার মনে হয় আমার আসাটা পছন্দ হয়নি মোহর।

শ্রীতমা তখনও হতবুদ্ধির ন্যায় তাকিয়ে থাকে চেহারাটার দিকে। এই মানুষটার সাথে দ্বিতীয় দেখা ওর কল্পনার বাহিরে ছিলো। মোহর এগিয়ে এসে তোয়াকে নিজের কোলে নিয়ে একটা চেয়ার এগিয়ে দিলো তাথইয়ের দিকে। তাথই চেয়ার টা ছেড়ে শ্রীতমার পাশে বসলো খাটের উপর।

– সত্যিই অখুশি হয়েছো?

শ্রীতমা ঘন ঘন মাথা নাড়িয়ে বলল

– না না, কি বলছেন। আমিতো ভাবতেই পারিনি যে আপনি এখানে আসবেন, তাই অবাক হয়েছি

বলেই মাথা ঝুকিয়ে নিলো। তাথইয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছে না ও কিছুতেই। অপরাধবোধ, কুণ্ঠায় জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে। এই মানুষটার সংসার ও নিযে হাতে ভেঙেছে। দুজন স্বামী স্ত্রীর মাঝে ও তৃতীয় ব্যক্তি হয়েছে, ভাবতেই শ্রীতমার নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মতো নিষিদ্ধ ইচ্ছে টাও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাথই হয়তো বুঝতে পারলো ওর অস্বস্তি টা, অপ্রস্তুততা। নিজের হাতটা বাড়িয়ে রাখলো শ্রীতমার কাঁধে, স্নেহময় গলায় বলল

– আমি বুঝতে পারছি তোমার ভেতরে কি চলছে, যা চলছে তা যাতে সারাজীবনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় আমি সেটাই চাই।

শ্রীতমা মুখ ফিরিয়ে তাকালো তাথইয়ের দিকে। ঝাপসা চোখে তাকিয়ে নিজেই বলল

– আমাকে ক্ষমা করে দিবেন বড়দি, আমি পাপ করেছি, মহাপাপ। যেই পাপের কোনো ক্ষমা নেই। আমি নিজে একটা মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের সংসার ভাঙার কারণ হয়েছি। অন্যের মন ভা’ঙার মতো গর্হিত অপরাধ করেছি। আমি জানি আর ক্ষমা চাওয়ার কোনো মুখ নেই। তবুও আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাই

বলে হাত দুটো তুললেই তাথই এক হাতে ওর হাতটা চেপে ধরলো। একটুও বিব্রত হলো না শ্রীতমার আচরণে। বরং সাবলীল ভাবেই বলল

– এ কথা আমারও তোমাকে বলা উচিত। কারণ আমিতো জানতাম আমার স্বামী কেমন। তবুও একটা মেয়ের জীবনের ক্ষতি হতে আটকাতে পারিনি। অরুণের ফোনে আমি তোমাদের ছবি দেখেছিলাম। বিশ্বাস করো ওইদিন আমার সবচেয়ে বেশি দুঃখ লেগেছে, যে এমন ফুলের মতো মিষ্টি একটা মেয়েকেও ও ঠকাচ্ছে? আমি তো শুরু থেকেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি, বলা যায় স্বেচ্ছায় অন্যায় গুলো মেনে নিয়েছি। কিন্তু তোমার তো দোষ ছিলো নাহ। তবুও তোমাকে ঠকে যেতে হলো

মোহর এগিয়ে এসে বসলো ওদের পাশে। তাথইয়ের হাত ধরে বলল

– আপা, আপনি এভাবে কেনো বলছেন। সৃষ্টিকর্তা অনেক সময় আমাদের শিক্ষা দিতেও অনেক কিছুর সম্মুখীন করায়। আর শ্রী অনেক স্ট্রং, ও এসব ছোট খাটো ব্যাপার ধরে রাখেনা। আপনি প্লিজ আর এসব কথা বাড়াবেন নাহ

– আমি আর বাড়াচ্ছি কোথায়। তোমার বান্ধবী দেখো চোখের পানির বন্যা বইয়ে দিয়েছে

তাথইয়ের কথায় শ্রীতমা তব্দা খাওয়ার মতো হা করে রইলো চোখ ভর্তি পানি নিয়ে। তাথই মিষ্টি হেসে ওর হাত ধরে বলল

– জীবনে এমন অনেক কিছুই ঘটে যায় যার জন্য আমরা নূন্যতম প্রস্তুত থাকি না,যেসব ঘটনা আমাদের ভেতর বাহির দুটোই ভেঙে দেয়,কিন্তু তা বলে কি জীবন থেমে যায় বলো? বেঁচে থাকার প্রতিটি দিনই এক একটা নতুন জীবন। প্রতিদিনই আরেকটু করে ভালোভাবে বাঁচার জন্যে সংগ্রাম করতে হয়। সেখানে এইসব ঘটনাকে দূর্ঘটনা ভেবে ভুলে যেতে হয়। সবকিছুই তোমাকে নতুন শিক্ষা দেয়, একটা অধ্যায় খারাপ হয়েছে বলে কিন্তু সেটা ভেবে বাকি অধ্যায় গুলোকে খারাপ ভাবতে নেই, বুঝেছো?

শ্রীতমা ঘন ঘন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। আসলেই তো,ও তো শুধু প্রেমিক হারিয়েছে অথচ সামনে বসে থাকা মেয়েটা স্বামী, সংসার, নিজের সন্তানের বাবা হারিয়েও কি সুন্দর ভাবে ওকেই শান্তনা দিচ্ছে! তাথই এর মুখের দিকে চেয়েই শ্রীতমার চোখ থেকে আরেক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

– তুই এমন ছিচকাঁদুনে হলি কবে থেকে বল তো! কখন থেকে হাঁদারামের মতো কেঁদেই যাচ্ছিস

শ্রীতমা ভ্রু কুচকে নেওয়ার আগেই মোহর বলল

– একদম ভ্রু কুচকাবি না। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আই যাহ। তোর এই মরা মরা মুখটা আমার দেখতে ইচ্ছে করছে না

__________________________

আকাশের পশ্চিমাঞ্চলের লাল টকটকে আভা ধীরে ধীরে কৃষ্ণাভ বর্ণে নিকষিত হচ্ছে। আজকের দিনটা প্রফুল্ল মনে হলেও সন্ধ্যা টা কেমন নিস্তেজ লাগছে। চওড়া রাস্তার এক কোণা দিয়ে একা একাই হেঁটে যাচ্ছে মোহর, পুরোটা বিকেল পর্যন্ত শ্রীতমা আর তাথইয়ের সাথে গল্পে গল্পে কেটেছে। প্রত্যেকটা গম্ভীর, ঘরকোণাচে, অথবা রাগী মানুষ যেমন ই হোক, সবার মাঝেই লুকায়িত একটা সহজতম সত্ত্বা থাকে। যা মানুষ সবসময়, সবার সামনে প্রকাশ করতে পারেনা। এই যে আজ তাথই এতো গল্প, হাসি,করলো এমনটা তো বাড়িতেও কখনো করেনি। পরিস্থিতির যাতাকলের নিচে পড়তে পড়তে মানুষের চারিপাশে এক অদৃশ্য খোলস তৈরি হয় যা একটা মানুষকে গম্ভীর আর রাগচটার নাম দেয়, কিন্তু আদতে তো মানুষটা নিজেকে প্রকাশের সাহস বা সুযোগ পায়না।

সারাদিন বাইরে থাকায় তাথইয়ের বাচ্চাটাকে কিছু খাওয়ানো হয়নি, তাই বিকেল হতেই ও বাড়িতে ফিরে গেছে। মোহর চাইলেও ফিরতে পারেনি,ও শ্রীতমাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলো। ওকে হোস্টেলে ছেড়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। রাস্তার দুই ধারে আর মাঝখানে টিমটিমে লাইট। থেকে থেকে যানবাহনের আনাগোনা আর হর্নের শব্দে মোহরের পুরোনো দিনের কথা খুব করে মনে পড়ছে,
যখন প্রত্যেকটা দিনই ওর জন্য সংগ্রাম ছিলো। মায়ের ওষুধ, ডক্টর সব মিলিয়ে হাজারো খরচ। নিজের পড়াশোনা। হার রোজ ছুটে বেড়াতো জীবনের নিষ্ঠুরতার পেছনে। আজ কোথায় সেসব? মা বাবা নামক মানুষ গুলো আজ কতো দূরে? বুবুর সাথে দেখা হয়না সপ্তাহ খানেক হতে চলল। রোজ ফোনে কথা বললেও কাছে বসে কোলে মাথা রেখে শোয়ার ইচ্ছে টা অধরাই থেকে যায়।
আর একটা নাম নিজের অজান্তেই মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে মোহরের। মেহরাজ! ওর স্বামী। যাকে কখনো সামনা-সামনি দেখেনি কল্পনাতেও আনেনি সেই মানুষ টা ওর স্বামী! শুধুই কি স্বামী? অহর্নিশি যার কথা ভেবে ভেতরটা দগ্ধ হয় প্রেম অনিলে, যার দুইদিনের অনুপস্থিতও ভেতরটাকে অসুস্থ করে ফেলেছে। মানুষটার শূন্যতা ওকে বেদনার যন্ত্রণায় গ্রাস করে ফেলছে। না চাইতেও চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে এলো মোহরের, মুখ ফুটে উচ্চারণ করলো

– আপনি কোথায় রুদ্ধ? কবে আসবেন? আপনাকে ছাড়া এক মুহুর্ত ও আমার শান্তি লাগছে না। এ কোন মায়াডোরে বেঁধেছেন আমায়! আমার দুনিয়াটাই আপনিময় করে কেনো দূরে বসে আছেন?

হাতের উল্টো পিঠে চোখটা মুছে দাঁড়ালো। অনেকটা পথ একা একাই হেঁটে এলো। কিন্তু এখন অন্ধকার নেমেছে, মানুষের আনাগোনা একেবারেই নেই। এখন নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে। কেনো যে এই রাস্তা দিয়ে একা হেঁটে আসতে গেলো
পরমুহূর্ত টা উপলব্ধি করার আগেই পেছন থেকে একটা হাত আঅকস্মাৎ মোহরের মুখ চেপে ধরলো। ভেজা ভেজা রুমালটাতে অন্যরকম একটা ঘ্রাণ। মোহর দুহাতে ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও পারলো না। পুরুষালী শরীর টা ওকে চেপে ধরে টেনে হিচড়ে সরু একটা গলির মধ্যে নিয়ে গেলো। মোহর নিজের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে এক প্রকার ধস্তাধ’স্তি করে কনুইয়ের এক গু’তা বসিয়ে দিলো আগন্তুকের পেটের মাঝে । মৃদু শব্দে আর্তনাদ করে হাতটা আলগা হতেই মোহর এক ঝটকায় সরে এলো। দীর্ঘক্ষণ নিঃশ্বাস আঁটকে রেখে চোখ মুখ রক্তাভ হয়ে গেছে, মুখে চেপে ধরা রুমালটাতে মেশানো ক্লোরোফম থেকে বাঁচার প্রয়াসেই নিঃশ্বাস চেপে রেখেছিলো। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে হাফ ছাড়ার আগেই ঝাপসা চোখে নিজের সামনে তিনটে পুরুষ অবয়ব দেখতে পেলো।
কালো মাস্কের মতো আবরণীর দ্বারা সমস্ত মুখ ঢাকা সেই ফাঁকের হিংস্র চোখে একদৃষ্টে চেয়ে মোহরের দিকে, ঠিক সেদিনকার রাতের মতো অজানা আতঙ্কে হাড় হীম হয়ে এলো মোহরের। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত রাখার অগাধ প্রচেষ্টা করলো।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ডান পাশে, বের হওয়ার রাস্তায় দাঁড়িয়ে একজন। বাকি দুজন ওর সামনে আর বাঁয়ে। অজানা আতঙ্কে গ্রাস হলো সমস্ত মস্তিষ্ক। তন্মধ্যে সামনের জন এক পা দু পা করে এগিয়ে এলো ওর দিকে, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোতে পুরুষাবয়বের হাতের মাঝারি সাইজের কাঁচের বোতলটা স্পষ্ট দেখতে পারলো মোহর। ওর তার মাঝের রঙিন তরল দেখে আর বুঝতে অসুবিধা রইলো না ওর সাথে কি হতে পারে। মনে মনে সাত কালেমা জপ করে সূক্ষ্ম মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ ব্যবহার টা করার সর্বাত্মক প্রয়াস করলো। কিন্তু সামনের অমা’নুষিক চেহারা গুলো সেটার অপেক্ষা না করেই হাতের বোতল টার ভেতরের তরল ছুড়ে মারলো মোহরের মুখের দিকে, এক ছিটকে সরে গেলেও কয়েক ফোঁটা এসে পড়লো হাতের উপর, তীব্র জ্বলনে আর্তনাদ করে উঠলো মোহর, ডান পাশের লোকটা এগিয়ে এসে ধরতে গেলেই নাক বরাবর শরীরের সমস্ত শক্তি বসিয়ে দিলো। লোকটা ভারসাম্যহীন হয়ে গেলো আর সেই সুযোগের ব্যবহার করেই এক ধাক্কায় পথ আলগা করে ছুটতে লাগলো মোহর।

ঠিক সেদিনের মতো, একই পরিস্থিতি। রুদ্ধশ্বাস আঁটকে ছুটন্ত মোহর আর তার পেছনে কতগুলো নরখা’দক। পার্থক্য শুধু এটুকুই সেদিনের লোকগুলো রাস্তার ধারের কুকুরের ন্যায় ছিলো।আর আজকের লোকগুলো ভাড়া করা। ভীষণ পূর্বপরিকল্পিত ভাবে ছক এঁকেছে তা মোহরের মস্তিষ্ক বুঝতে সময় নিলো নাহ। ছুটতে ছুটতে পায়ের শক্তি ঝিমিয়ে এলো, এতোগুলো পুরুষের সাথে পেরে ওঠা নিশ্চয় নাটকীয় ব্যাপার নয়। মোহর একা এতগুলো পুরুষের থা’বা থেকে কিছুতেও বাঁচতে পারবে না জেনেও ছুটতে লাগলো যতদূর, যতক্ষন সম্ভব। কিন্তু আজ হয়তো ভাগ্য ওর সহায় নেই, ঠিক একদম সামনাসামনি স্পষ্ট হলো, দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটা লম্বা অবয়ব। দুহাত বুকে গুঁজে ভীষণ আয়েশী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে যেনো অপেক্ষা শুধু মোহরের। পা দুটো একাই থেমে গেলো মোহরের, সেই সাথে থেমে গেলো পেছন থেকে আসা পায়ের শব্দ। কালো প্যান্ট আর জ্যাকেটে ঢাকা সৌষ্ঠব শরীর, মুখে একটা রুমাল বাঁধা। এক হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো পেছনের ছুটন্ত দলটাকে। শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো মোহরের দিকে, কালো চশমার আড়ালের লোভাতুর চোখদুটো যে মোহরের সারা শরীরে বিচরণ করছে তা বুঝতে এতটুকু ও অসুবিধা হলো না, দু হাত ছড়িয়ে দিয়ে ইশারা করলো মোহরকে নিজের দিকে। ঘৃণায় সারা শরীর রি রি করে উঠলো মোহরের। পায়ের তালু বেয়ে শীতল স্রোত পুরো বদনে ছড়িয়ে পড়লো। সামনে,পেছনে দুটো রাস্তায় বন্ধ। পুরোটআ পরিকল্পিত, ভীষণ পূর্বপপরিকল্পিত। মেহরাজের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে মোহরের চরম সর্ব’নাশ করার জন্যেই আঁটঘাট এঁটেই এসেছে। মোহর অস্থির চোখে চারপাশ তাকালো, আড়চোখের লক্ষ্য অনুসরণ করে পা তোলার আগেই সামনের পুরুষালী গলা টা বলল

– উঁহুহু…নো ডার্লিং, নেভার। ভুল পথে যাওয়ার চেষ্টা ভুলেও কোরো নাহ। আজ তুমি আমার বন্দিনী, সম্পূর্ণরূপেই আমার
.
.
.
চলমান

©Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here