ফানাহ্ 🖤 #পর্বসংখ্যা_৩৪ #হুমাইরা_হাসান

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৩৪
#হুমাইরা_হাসান

কিছুক্ষণ আগেই এসে হাজির হওয়া মানুষটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জহুরি নেত্রে দেখছে মোহর। লম্বায় মেহরাজের মতো না হলেও বেশ অনেকটাই। চেহারা উজ্জ্বল, ভাসা ভাসা চোখ। মুখের হাসিটা অমায়িক। দেখে মেহরাজের বয়সী ই মনে হলো, কিন্তু মোহর নিজেই তো মেহরাজের বয়স জানে নাহ। তবে একটা বিষয়ে মোহর বেশ অবাক,আর তা হলো আম্বি বেগমের এই ছেলেটার প্রতি আচরণ। এতটা আদর যত্ন করছে যে বোঝাই যাচ্ছে না, লোকটা মেহরাজের বন্ধু না সহোদর।

আম্বি বেগম থাল ভরে ভরে নাস্তা এনে সামনে রেখে স্নেহমহী গলায় বলল

– পৃথক তুমি এসেছো এবার আমি নিশ্চিন্ত। তোমার এই হেয়ালিপনা ভরা বন্ধুটাকে একটু বোঝাও, আমার কোনো কথায় তো শুনতে চাইনা

মৃদু কেশে উঠলো পৃথক, মেহরাজের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল

– আমি আর কেনো আন্টি, এখন তো সাহেবের বউ এসে গেছে, সেই সামলে নেবে

আম্বির মুখটা চুপসে গেলো না, আর নাইবা কালো হলো। শুধু চুপ করে গেলেন। মোহর একটা অদ্ভুত জিনিস খুব ভালো মতো লক্ষ্য করেছে যে আম্বি খাতুন সবার সামনে যতটা খারাপ ব্যবহার করে আড়ালে ততটাও করেন নাহ। শুরুতে অনেক অহেতুক গালমন্দ করলেও এখন সে আচরণ একেবারেই ক্ষীণ, যতটুকুই বা করে সকলের সামনেই যেনো বেশি।

মোহর এক কোণায় চুপ করে দাঁড়িয়ে, সম্পূর্ণ অচেনা মানুষটার সাথে কিরূপ সম্ভাষণ করবে তা নিয়েই দ্বিধাদ্বন্দে ডুবে আছে। মোহরের বেশ রাগ হলো নিজের উপর, কেমন মাথামোটা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন আগে তো নিজের সব কাজ নিজেই করতে হতো এখন মেহরাজকে বলার আগেই সব হাজির করে ফেলে তাই হাত পা দুটো গুটিয়ে রেখে রেখে বুদ্ধি, চঞ্চলতায় ধুলোবালি জমে গেছে। মোহরের নিজের উপরে বিরক্ত হওয়ার রেশ টুকু গিয়ে পড়লো এবার মেহরাজের ওপর, মনে মনে একই কথা বারবার আওড়ালো ‘ সব দোষ এই গম্ভীর লোকটার, সবকিছুতেই বেশি বেশি আগ বাড়িয়ে প্রত্যেকটা কথায় বুঝে যায়। আমাকে না কিছু বলার নাইবা কিছু করার সুযোগ দেয়,এই করে করে আমার আলাভোলা ছকিনা করে ফেলছে দিনদিন ‘

মেহরাজ কে মনে মনে একশো বার হাবিজাবি কথাতে কটাক্ষ করে রুষ্ট দৃষ্টিতে তাকালো সোফার দিকে। যতটা বিরক্তি আর উদ্বিগ্নতা নিয়ে তাকিয়ে ছিলো ঠিক ততটাই আচ্ছন্ন হলো নান্দনিক দৃশ্য টুকু চোখে দেখে, মেহরাজকে এতো স্বচ্ছল হাসি, বা খোলামেলা গল্পগুজব করার চরিত্রে ওর আগে কখনো মনে হয়নি, সবসময় কাজ আর অফিস নিয়ে থাকা দুর্বোধ্য চরিত্রের এই প্রাণোচ্ছল হাসিটুকু একঝাঁক মোলায়েম আচ্ছাদনে পরিতৃপ্ত করে দিলো মোহরের ভেতরটা।

_________________________

বিছানাভর্তি জামা কাপড়ে স্তূপ করে ফেলেছে সাঞ্জে। ঘরে জিনিসপত্র উলটে জুবুথুবু করে ফেলেছে সব। এতক্ষণ চুপচাপ সহ্য করলেও কাকলি বেগম চটে গেলেন এবার ব্যাপকভাবে, ঘরের এলোথেলো অবস্থাটায় বিরক্তি ভরা চাহনি দিয়ে বলল

– সাঞ্জে তুই আর একটা জামাও যদি আলমারি থেকে বের করে ছিটিয়েছিস তাহলে আর একটা মাইর ও মাটিতে পড়বে না বলে রাখলাম। কি পেয়েছিস টা কি তুই, রাণী ভিক্টোরিয়া হয়েছিল যে সবাই তোর ইন্টারভিউ নিতে আসবে তাই তোকে বেস্ট লুক নিতে হবে!

– মা এমন করছো কেনো? আমারই তো জন্মদিন তাই না? আমাকে তো সুন্দর লাগতেই হবে, কতো গেস্ট আসবে বলো তো। আর আমিতো পড়ার মতো একটাও জামা খুঁজে পাচ্ছি না।

আলমারিতে অর্ধেক শরীর চিপকে ছামা কাপড় ছড়াতে ছড়াতে বলল সাঞ্জে। কাকলি বেগম ক্ষুব্ধ হয়ে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরে সরিয়ে আনলেন। বিছানায় ছড়িয়ে রাখা জামা গুলোর মধ্যে থেকে একটা গোলাপি রঙের জামা বের করে বললেন

– এইটার কি হলো? এটা না তুই নিজে গিয়ে কিনে আনলি মার্কেট থেকে, এখন কেনো পড়বি না এটা?

– এটা তো কিনেছিলাম কিন্তু এখন এটার সাথে ম্যাচিং করা কোনো স্টিলেটো নেই আমার তাই

মুখটা একেবারে ছোট করে বলল সাঞ্জে। কাকলি প্রচণ্ড বিরক্তিতে গর্জে উঠে বলল

– এক চ’ড়ে তোমার দাঁত গুলো ফেলে দেবো মেয়ে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো সব গেস্ট রা আসতে শুরু করেছে অথচ এখনো তুমি জামা নিয়ে নাটক করছো। দশ মিনিটের মধ্যে যদি তৈরি না হও তাহলে আজ তুমি আমার হাতে বেদম মা’র খাবে বলে দিলাম

সাঞ্জের চোখটা নিমিষেই ভরে এলো মায়ের এমন রূঢভাষায়। ছেলেমানুষী মনটার জন্মদিনকে নিয়ে ঘেরা চাঞ্চল্য গুলো ধপ করে নিভে গেলো। মোহর সবে ঢুকেছিলো ঘরটাতে, সাঞ্জের বিষন্ন মুখটা দেখে আর চুপ করে থাকতে পারলো না, এগিয়ে গিয়ে সাঞ্জের একটা হাত ধরে সরিয়ে বলল

– ওকে বকবেন না চাচী, ছোট তো মন খারাপ করে ফেলবে।

– মা কে আঁটকানোর কোনো দরকার নেই মোহর, ও আসলেই বেশি করে ফেলছে সবটা। এতো ঘটা করে জামা কাপড় কিনে আনলো অথচ এখন নাকি ওর একটাও পছন্দ হচ্ছে নাহ। মা ওকে বারবার করে বলেছিলো কোনটা পড়বে আগে থেকে ঠিক করে রাখতে তাও ও এখন ওই একই নাটক করে যাচ্ছে।

বিছানায় বসতে বসতে বলল তাথই। কাকলি বেগম প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে চাইলেও মোহরকে কিছু বললেন না, তাথইয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল

– ও বাড়ি থেকে মেহমান এসেছে। তোদের দেখতে চাইছে

তাথই কোলের মেয়েকে কাকলি বেগমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল

– তোয়াকে নিয়ে তুমি যাও। আমি রেডি হয়েই নামছি একবারে।

কাকলি বেগম বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে হনহন করে বেড়িয়ে গেলো। মোহর সাঞ্জের ফ্যাকাসে করে রাখা মুখটাতে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। নরম গলায় বলল

– দেখি এদিকে তাকাও তো,একদম মন খারাপ করবে নাহ। এসো আমার সাথে আমি জামা দেখিয়ে দিচ্ছি

বলে জামা কাপড়ের ভেতর থেকে একটা হালকা সবুজ রঙের গাউন বের করে সাঞ্জের গায়ের সাথে ধরে বলল

– বাহ এটা বেশ মানিয়েছে তো! আর তোমার তো এই কোয়ালিটির কালারের একটা স্টিলেটোও আছে।

সাঞ্জে উৎসুক মুখে জামাটা গায়ের সাথে ধরে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। সিল্ক কাপড়ের সাথে পাতলা নেটের সংমিশ্রণে ভারী পাথরের কাজ করা গাউন টা গায়ের সাথে মন্দ লাগছে নাহ। বরং এখন এই জামাটাই যেনো সবচেয়ে বেশি ভালো লাগলো সাঞ্জের।
উচ্ছ্বসিত হয়ে জামাটা নিয়েই পড়ার জন্য দৌড় ধরলো। মোহর মৃদু হেসে তাথইয়ের দিকে তাকালো, মোহরের সাথে চোখাচোখি হতেই তাথই বলল

– তুমি কি আজও সালোয়ার ই পড়বে নাকি? শাড়িটাও তো সেদিন তিয়াসাকে দিয়ে দিলে।

– আলমারিতে অনেক জামা কাপড় অযথাই এনে রেখেছে, ওর ভেতর থেকেই একটা পড়ে নেবো ভাবছি।

বলে আর কয়েক মুহুর্ত বাদে মোহর ও বেরিয়ে এলো। ঘরের ভেতর এলেও মেহরাজের দেখা মিললো নাহ। মোহরের রাগ হলো কিঞ্চিৎ। আজ দেখি লোকটা বন্ধু পেয়ে তাকেই ভুলে গেলো? সেই যে সকাল থেকে দুজন গল্প করছে, মাঝে শুধু একবার দেখা হয়েছিলো। মোহর নিজেও অবশ্য আজ ঘরে খুব একটা আসেনি।

ঘরে ঢুকে সোজা কাবার্ডের দিকে গেলো মোহর, কাঠের ভারী দ্বার-টা টান দিয়ে খুলতেই সুসজ্জিত ভাবে ভাঁজ করে রাখা জামাগুলোর সামনেই একটা টকটকে রঙের শপিং ব্যাগ দেখতে পেলো। সকৌতুক দৃষ্টিতে চেয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে ভেতরে হাত দিয়ে বের করে আনলো আগ্রহ ভরা জিনিসটা।
কিছুক্ষণ এক ধীমে চেয়ে রইলো পাতলা জরজেটের উপরে ছোট চকচকে পাথর বসানো বেরী ব্লু রঙের একটা শাড়ির দিকে। বিমুগ্ধ হয়ে মোহর শাড়িটার ভাঁজ খুলতেই ভেতর থেকে ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো খপ করে মৃদু শব্দ তুলে মেঝেতে পড়লোম উৎসুক চাহনিটা সেদিকে অগ্রসর হলেই অবিলম্বে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে তুলে নিলো। হাতের মুঠোয় দু’হাতের আঙ্গুলে নীলচে কাগজ টার চারটি ভাঁজ খুললে সেখানে জেল কালিতে লেখা গোটা গোটা শব্দের লেখাটি বিড়বিড়িয়ে পড়লো মোহর

-‘ বিবিজানের জন্য জানটুকু যত্নে রেখে দিয়েছি, আপাতত শাড়িটি পড়ে আমার অস্থির চোখ দুটোকে একটু শান্তি দিলে কৃতজ্ঞ হই ‘

না চাইতেও পাতলা ঠোঁট দুটো বেঁকে গেলো। স্মিত হাসিটার প্রসারণ উচ্চ থেকে উচ্চতর হতে থাকলো। একসময় কিঞ্চিৎ শব্দ বেড়িয়ে এলো ওষ্ঠভাঁজ থেকে। ফিক করে হেসে দিয়ে মোহর শাড়িটা দুহাতে জড়িয়ে ধরে ওয়াশরুমে ঢুকলো।

.

রিনিঝিনি চুড়ির শব্দে মনোযোগচ্যুত হলো মেহরাজের, তবুও সেটা অগ্রাহ্য করে ব্লুটুথ ডিভাইসটার উপরে আঙ্গুল চেপে ব্যস্ত গলায় বলল

– হ্যালো? অভি? শুনতে পাচ্ছো?

ওপাশ থেকে প্রত্যুত্তরের শব্দটা এবারও কানে পৌঁছাতে পারলো নাহ মেহরাজের৷ প্রথমত গুরুত্বপূর্ণ কথার মাঝে নেটওয়ার্ক নামক অদৃশ্য বস্তুটার ব্যাগড়া দেওয়াটাতে মেজাজ টা উচ্চমাত্রায় চটে আছে, তার উপর রিনিঝিনি শব্দটার ঝুমঝুম কলধ্বনিটা একটু বেশিই কানে বিঁধছে। বিরক্তিতে চ জাতীয় শব্দ করলো।
চড়া মেজাজে অপরপক্ষের বাক্যটুকু সম্পূর্ণ করার সুযোগ টাও অগ্রাহ্য করে পাওয়ার বাটন টার উপরে কিঞ্চিৎ ক্রোধ ঝেরে লাইনচ্যুত করলো। শব্দের উৎসটাকে উদ্দেশ্য করে ঘরের ভেতর ঢুকলো দ্রুত পায়ে।
ঠিক যতটা বিরক্তি আর ত্রস্ততা নিয়ে প্রবেশ করেছিলো ঠিক ততটা ঝটকা লেগেই থমকে গেলো। কত হবে ঠিক? শরীর জুড়ে যেনো ৪৪০ ভোল্টেজের শক-টা ঝিম ধরিয়ে দিলো।

লম্বা আঁচল টা বিছানা থেকে গড়িয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে। জানালার কাঁচের পারদের ফাঁক দিয়ে চিকন ফাল হয়ে আসা বাতাসটা দমকা হাওয়া হয়ে এলোমেলো করে দিলো যতটা না এলোকেশ গুলো তার চেয়ে দ্বিগুণ স্বয়ং মেহরাজকে। নে’শাক্তের ন্যায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে এগিয়ে যায় মেহরাজ সামনের দিকে, অটোমেটিক স্লাইডিং ডোরটা হুট করেই বন্ধ হয়ে যায়, পিঠ থেকে চুলগুলো সরে ব্লাউজ আর পেটিকোটের মধ্যবর্তী অঞ্চল টার মেদুর প্রলেপ ভ্রম ধরিয়ে দিলো মেহরাজের চোখে। পিঠের ব্লাউজের ফিতাটা হাট করে খোলা, সেই ফাঁকে উন্মুক্ত অর্ধেকাংশ উন্মত্ত করে দিলো সম্পূর্ণ মেহরাজকে। এই মানুষটার রূপে কতবার,ঠিক কতবার থমকে যায় মেহরাজ হিসেব নেই,প্রতিবারই যেনো প্রথমবার লাগে। রোমন্থন পায়ে এগিয়ে আসলো মেহরাজ।

মুখের উপর উঁপচে পড়া চুলগুলো দারুণ বিরক্তির সহিত পেছনে ঠেলে দিলো মোহর। হাতভর্তি কালো আর নীল রঙের রেশমি চিকচিক করা চুড়ি গুলো, গুচ্ছ গুচ্ছ করে কালচে নীলের মিশেলে ধারাবাহিক ভাবে সাজানোর প্রয়াসে মত্ত রমণীর নূন্যতম ধারণাও নেই তার এই অতি সাধারণ অথচ অসাধারণ রূপে কারো চামড়ায় আবৃত নরম হৃদযন্ত্রটা পু’ড়তে শুরু করেছে। লম্বা পায়ের ছোট ছোট পদক্ষেপে এগিয়ে এলো মেহরাজ, অনড় চোখ দুটি স্থির রেখেই হাঁটু ভাঁজ করে ধপ করে বসলো ফ্লোরের উপর। ব্যস্ত মুখাবয়ব টার নিমিষেই বিরক্তি পালটে একরাশ বিস্ময়ে পরিপূর্ণ হলো মোহরের। চঞ্চল চোখের বিস্মিত দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে ধূসর চোখ দুটি সবিনয়ে স্থির রইলো একটা চেহারা পানেই। হাত থেকে চুড়ি গুলো নিজের এক হাতের মুঠোতে আগলে নিলো, আরেক হাতটা সযত্নে দখল করে নিলো চিকন হাতটার কবজি। এক এক করে চুড়িগুলো পরিয়ে দিতে লাগলো হাত দুটো ভরে। মোহর তখনও স্থির নেত্রে তাকিয়ে অতিমাত্রায় সুপুরুষের সংবদ্ধ নজরে, অস্ফুটস্বরে বলল

– আ আপনি

তার আগেই লম্বা আঙ্গুলটার চাপ পড়লো পাতলা ঠোঁটে। হাঁটু মুড়ে বসে থাকা লোকটা উঠে দাঁড়ালো, ঠোঁট থেকে আঙ্গুল নামিয়ে দুবাহুতে এসে থামলো দুহাতের থাবা, কিঞ্চিৎ গাঢ় করলো স্পর্শ, চিকন শরীরটাকে নিজের আরও নিকটে টেনে আনলো, মোহরের কম্পমান ঠোঁট, ব্যকুলতা। ভয়ে আড়ষ্ট চাহনি সবটাকে অগ্রাহ্য করে ঠিক সেদিনের মতো ঘাড়ের ওপর দিয়ে হাত গলিয়ে দিলো পিঠের দিকে, দুটো শরীর একেবারে কাছাকাছি সরে এলো। ঘাড়ের দুপাশের শক্ত বেড়িবাঁধ টা পেঁচিয়ে ধরলো দারুণভাবে। পিঠের দিকে মেহরাজের শীতল হাতের বিচরণ টা ক্রমেই অস্থির, অসহ্য করে ফেললো মোহরকে। ব্লাউজের ফিতা দুটোয় টান পড়তেই মোহর চোখ খিঁচিয়ে নিলো, বুক ভরে নেওয়া শ্বাসবায়ুটায় উচ্চ তরঙ্গ খেলে আঁটকে গেলো।
মেহরাজ ঘাড়টা ঝুকিয়ে এনে কপালে কপাল ঠেকালো, ব্লাউজের ফিতাটা লাগিয়ে দিলেও বেশ রয়েসয়ে হাতটা সরালো মোহরের ঘাড় থেকে, কপালে জড়ো হওয়া একগুচ্ছ চুল তর্জনীতে ঠেলে কানের পেছনে গুঁজে দিলো। হীম অনিলে সিক্ত হলো মোহরের সমস্ত বদন, ঘাড়টা আরও ইঞ্চিখানেক নামিয়ে আনলো মেহরাজ। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শটা প্রচণ্ড অস্থির করে মোহরের পাতলা আবরণী গালটা ছুঁয়ে গেলো। তপ্ত শ্বাসটুকু বেসামাল ভাবে ফেলে মুখ তুলে নিলো নিবিড় কণ্ঠে বলল

– মোহ?

– জ্ জ্বী

রয়েসয়ে কাঁপা কাঁপা উত্তর মোহরের। অবিলম্বেই মেহরাজ একই কণ্ঠে বললো

– এই যে আপনার আপনিময় মোহে, আর আর অতল মায়ার মিশ্রণে মোহমায়ায় ডুবিয়ে মারছেন এর শাস্তিটা কতখানি ভাবতে পারছেন?

সারা পিঠ জুড়ে মেহরাজের প্রশস্ত হাতের বিচরণ, আরেকটা হাত কোমর ঝাপটে ধরে আছে । মোহরের অস্থির, কম্পমান কণ্ঠের উত্তর টাকে ছিনিয়ে মেহরাজ নিজেই বলল

– এতো সুন্দর কেনো লাগছেন মোহ? এখন যে এভাবে বাইরে যাবেন ভীড়ের সিংহভাগের দৃষ্টি আপনাকে কেন্দ্র করেই অচল রইবে আমার কেমন লাগবে বলুন তো? আপনাকে বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই কেনো বিবিজান?

মেহরাজের অনুভূতি, অনুরক্তি জড়ানো কণ্ঠস্বরটা ক্রমেই অসাড় করে ফেলছে নির্জীব একটা দেহ। অপরপক্ষের অস্থিরতার পারদটাকে একটা মাত্রায় স্থির রেখেই সরে এলো মেহরাজ। পুনরায় স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে ফিরে ভ্রু কুচকে বলল

– আপনি এতো খাটো কেনো মোহ, ঘাড়টা তো ব্যথা হয়ে গেছে আমার?

ঘাড়ের পেছনে হাত বুলাতে বুলাতে সরে গেলো মেহরাজ। বিছানা থেকে ব্লেজার টা তুলে গায়ে জড়ালো। মোহর ভীষণ অসন্তুষ্ট একটা রূঢ় চাহনিতে তাকিয়ে আছে, নিজেকেই এখন পাগল মনে হচ্ছে ওর। পাঁচ ফিট্ পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতা সমান একটা মেয়েকেও খাটো মনে হয় এই লোকটার?
তবে প্রত্যুত্তর করলো নাহ। মুখ বাকিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আঁচলটা ঠিক করতে লাগলো, মেহরাজ মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিলেও থমকে গেলো, পকেটে হাত দুটো গুঁজেই দেহটা বাঁকিয়ে বলল

– মোহ?

সেই একই ভ্রম ধরানো কণ্ঠে মোহর ফিরে তাকালো বিজড়িত নেত্রে, মুখে ঝুলানো রহস্যময়ী হাসি, চোখ দু’টোর নজর অনড়, স্বচ্ছ। সেই স্বচ্ছতার প্রগাঢ় ছাপ কণ্ঠে ফেলে মেহরাজ বলল

– স্যেনি সেভ্যিও’রুম

কথাটার অর্থ মোহরের মস্তিষ্ক ধরতে পুরোপুরি ব্যর্থ হলো। কিন্তু বিনিময়ে প্রশ্ন করার সুযোগ টা পেলো নাহ। তার আগেই দ্রুত পায়ে প্রস্থান করেছে মেহরাজ।

__________________________

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা, আব্রাহাম ম্যানসনের সামনের ইয়ার্ডে লোকসমাগমে পরিপূর্ণ। ব্যবসায়ীক, পারিবারিক, বন্ধুবান্ধবদের আসড়ে অন্যরকম চাকচিক্য আর জৌলুশময় পরিবেশ। কিছুক্ষণ আগেই কেক কেটে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছে। আপাতত সকলের আপ্যায়ন, সমাদরে ব্যস্ত মানুষের ভীড় থেকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলো তাথই।
তোয়াটা ভীষণ কান্না শুরু করেছে, সেই বিকেলের পর থেকে বাচ্চাটাকে কিচ্ছু খাওয়ানো হয়নি, বুকের সাথে চেপে দ্রুত পায়ে বাচ্চাটাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো তাথই। তোয়াকে বিছানায় শুইয়ে ফ্ল্যাক্স থেকে গরম দুধ ঢেলে ঠান্ডা করে ফিডারভর্তি করে মুখে ধরতেই চুকচুক শব্দ করে ক্ষুধার্ত শরীর টা চুষে নিলো সবটা। মিনিট খানেকের মধ্যে দুধ সম্পূর্ণ শেষ করে হাফিয়ে উঠলো নরম শরীরটা।
অবিলম্বেই তলিয়ে গেলো ঘুমে, তাথই বিছানায় তোয়াকে শুইয়ে দিলো। মানুষ জনের ভীড়ে আবারও ফিরতে একেবারেই ইচ্ছে করছে না, দুকদম এগিয়ে গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়ালো, লোকসমাগমের ভীড়৷ হরেক রকমের লাইটিং সহ আরও নানান চাকচিক্যতায় সাজানো পরিবেশ টায় চোখ বোলানো অবস্থায় পেছন থেকে দুটো হাত চেপে ধরলো তাথইয়ের কোমর, ঘাড়ের পাশ থেকে চুল সরিয়ে সেখানে মুখ ডুবিয়ে দিলো। দীর্ঘ সময় পরে মুখ তুলে বলল

– একা একা কি করছো

তাথইয়ের কোনো অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা গেলো নাহ। ঠাঁই দাঁড়িয়ে পাথরমূর্তির ন্যায়। যান্ত্রিক গলায় উত্তর করলো

– তোয়া কাঁদছিলো তাই ওকে খাওয়াতে এসেছিলাম। এখন যাবো

বলে পেছনে ঘুরে সরে এগোতে নিলেই বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো অরুন। দুহাতে তাথইকে ঝাপটে দেওয়ালের সাথে মিশিয়ে ওর গালে হাত দিয়ে বলল

– কোথায় যাবে? এখানেই থাকো। কতদিন কাছে পাইনা তোমাকে

বলে পরপর দুটো চুমু দিলো তাথইয়ের গালে। বিরক্তিতে গা গুলিয়ে এলো ওর, দুইহাত দিয়ে সরাতে গেলেও পারলো না, রুক্ষ গলায় বলল

– অরুণ বাড়িভর্তি লোকজন। নিচে ওরা হয়তো খুঁজছে, ছাড়ো আমায়

– কেও খুজছে না, চুপ করো তো

বলে শাড়ির ভাজে তাথইয়ের উন্মুক্ত পেটে হাত গলিয়ে দিলো অরুণ। ওকে বাঁধা দেওয়ার বারংবার চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। এক পর্যায়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো অরুণকে, চেঁচিয়ে বলল

– ছাড়তে বলছিলাম নাহ? এসে আর ধৈর্য হচ্ছিলো নাহ? আমি নিষেধ করছিলাম তো

মুহুর্তেই অরুণের ফর্সা মুখটা ক্রোধে লাল হয়ে উঠলো, ক্ষেপাটের ন্যায় তেড়ে এসে তাথইয়ের গাল চেপে ধরে বলল

– কিসের এতো দেমাগ হ্যাঁ? বিয়ে করা বউ তুমি আমার। আমি ধরতে গেলেই কিসের এতো ফোস্কা পড়ে যাই তোমার, আমি কাছে আসলেই যতো গাঁইগুঁই শুরু হয় তাই না, নাকি অন্য নাগর ধরেছো যে আমায় আর মনে ধরেনা

তাথই এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলো নাহ, কোনো কিছু না ভেবেই ঠাস করে থা’প্পর বসিয়ে দিলো অরুণের গালে। রাগটা যেনো এবার মাথায় চড়ে গেলো, তাথইয়ের চুলের মু’ঠি ধরে টে’নে এনে বিছানায় এক ধাক্কায় ফেললো অরুণ।

নিচে ভিড়ভাড়ের মধ্যে থেকে সরে এসেছিলো ফোনে কথা বলতে, চাপা একটা আর্তনাদ শুনেই সজাগ মস্তিষ্কে চারপাশে চোখ বুলালো। পরপর দুবার চিৎকার টা কানে আসতেই সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। আরেকটু এগিয়ে আসতে প্রথম ঘরটার সামনে এসেই থমকে গেলো পা দুটো।

অরুণ তাথইকে বিছানাতে ফেলেই প্রচণ্ড রাগে অগ্নি হয়ে দরজার দিকে এসে লাগাতে গেলেই কিসে একটা বাঁধা পড়লো বার দুয়েক ধাক্কা দিয়েও লাগাতে না পারলে দরজাটা পুরোপুরি খুললেই একটা চেহারা স্পষ্ট হলো চোখের সামনে। বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো

– কে আপনি?

– পৃথক ইয়াসির
.
.
.
চলমান

হীডিংঃ গল্প লিখার জন্য স্থির,প্রশান্ত মন আর পরিবেশ টা ভীষণ প্রয়োজন। নাহলে কখনোই পাঠোপোযোগী অথবা সুসজ্জিত করে তোলাটা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। আমি সারাদিন ব্যস্ত সময় পেরিয়ে টাইপ করার সময় টুকু সন্ধ্যার পরেই হাতের মুঠোয় পাই। এক্ষেত্রে একটু দেরী হলে আশা করি সকলে ধৈর্য ধরবেন,অথবা পরদিন সকালে পড়ে নেবেন। কেননা আমার পর্ব গুলো আপলোডের টাইমটা গননায় রাখতে হলে পর্বের পরিসর আর শব্দসংখ্যাটাও কিন্তু সেই আওতায় রাখা উচিত। আমার নিয়মিত পাঠকেরা জানেন আমি পোস্ট করি একটু দেরীতে তবে হার রোজ দেওয়ার চেষ্টা করি এবং সবার তৃপ্তির জায়গা টুকু পূরণ করাটা প্রাণপণ চেষ্টায় রাখি।

রিচেইক করিনি, ভুল ত্রুটি গুলোকে ক্ষমাসুলভ ভাবে গ্রহন করবেন আশা করি।

©Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here