সারপ্রাইজ-৪ শেষ

সারপ্রাইজ-৪ শেষ
ফারজানা রহমান তৃনা

আমি ইচ্ছা করলেই বিয়ে করতে পারি। যে পাত্র আজকে আমাকে দেখতে এসেছিলো; সে পাত্র কিছু না বলেই বিদায় হওয়ায় মোটামুটি সবাই_ই আমার প্রতি বিরুপ আচরণ দেখাচ্ছে। নিজের মা-বাবাও মনে হচ্ছে যেন, একদম না পারতেই কথা বলছে। বুঝলাম না, বোঝা হয়ে গেলাম মাত্র একুশ বছরেই? আর কিছু সময় কি দেওয়া যেত না? কিছু একটা করে দেখানোর ইচ্ছা ছিলো যে ভীষণ!
কিন্তু পরিবেশ,পরিস্থির জন্য আজ আর নিজের ইচ্ছায় জোর দেওয়ার কোনো রাস্তা নেই। আমার একটা “হ্যাঁ-তেই কিন্তু এইসব কিছু আবার ঠিক হয়ে যাবে। সবার মনমালিণ্যতা, রাগ,অভিমান সব সব কেটে যাবে। কিন্তু বিনিময়ে আমি কী পাবো? একটা বন্দী জীবন। তাও আবার নিজের মাতৃভূমির বাইরে।

আমার ফোন বেজে উঠলো।
টলমল করতে থাকা চোখের জল লুকিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেই আগুন্তকের মেসেজ,
– ” মন খারাপ? ইদানিং অনলাইনে আসেন না নাকি? কোনো সমস্যা?”
আমি উত্তর দিলাম,
– ” আগামীকাল আমার বিয়ে। বাড়ির ঠিকানা,চাঁদপুর -শাহ্-রাস্তি, আহমেদ নগর গ্রাম। চলে আসবেন। বিদায়।”
সে কিছুক্ষনের মাথাতেই একটা ছবি পাঠালো। ছবিটা লোডিং হচ্ছে কারণ গ্রামে নেটওয়ার্ক খারাপ। সাথে একটা মেসেজ ও দিলো।
” ছেলেটাকে আগলে রেখো চারু। সে তোমায় ভীষণ ভালোবাসে। ”
এই মেসেজ দেখে আমি তাজ্জব বনে গেলাম।
ছবি লোড হওয়ার পর আরেক ধাপে চমকে যাই।এককথায়,আমি ভাষাহীন হয়ে যাই।
এটাতো আমাকে দেখতে আসা সেই ভদ্রলোকেরই ছবি! কিন্তু এই অচেনা ব্যক্তি উনাকে কিভাবে চিনলো? মানে কিভাবে কী হলো?

এমন সময় নানু আসলো।
আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– একটু দেখে শুনে চলবা না আপু? দেখছো তো, তোমার জন্য কত ভালো একটা প্রস্তাব হাত-ছাড়া হয়ে গেলো।

কিছুক্ষন পর পাশের বাড়ির এক নানুও আসলেন।
এসে আমার নানুর প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন,
– কিগো আমিনা, তোমার নাতনীর নাকি বিয়া ফিইর‍্যা গেছে? সারা মহল্লায় তো কেবল এই কাহিনীই শোনা যাইতাছে। বাব্বা,কত বড়লোক পার্টি,গাড়ি হাঁকিয়ে আসছিলো এক্কেরে। আর মেয়ে কিনা পছন্দ হইলোনা! তা,তোমার নাতনীর কি কোনো সমস্যা আছে নাকি আমিনা?

আমার নানু আমার দিকে তাকিয়ে খুব অপ্রস্তুত হয়ে বললেন,
– ভাবী, এরকম তো হয়ই। প্রস্তাব একটা, দুইটা ফিইর‍্যা যাওয়া মানেই যে মাইয়্যার ত্রুটি এমন কিছু না। তাগোও কত ডিমান্ড থাহে,সব তো কানায় কানায় অয়না। তাইনা?

উনি মুখ ঘুরিয়ে বললো,
– তাও কই। মাইয়্যারে একটু বেশি কইর‍্যা খাইতে কও। বেশি কইর‍্যা খাওয়াও। আমার নাতনী তো অর ছোডো অয়। ওর তো বিয়া হই গেছে। কত বড় লোক জায়গায়!!

নানু আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
আপু,তুমি রুমে যাও।
আমি চলে আসলাম।
নিজ রুমে যেতেই প্রান্ত নামের ভদ্রলোকের ফোন আসলো।
আমি কিছু না ভেবেই রিসিভ করলাম।

উনি খুব ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
– এই তুমি কি রাজী নাকি নারাজ?কিছু একটা জানাও।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
– কেন? খুব বেশি তাড়া আছে? আপনার আম্মা নিশ্চয়ই অন্য কোথাও দেখা আরম্ভ করে দিয়েছে?
সে একটু গম্ভীর গলায় বললো,
– হ্যাঁ। কিন্তু আমি আগে তোমার উত্তর জানতে চাই। এন্সার মি। হ্যাঁ/না।
– আমি যদি হ্যাঁ বলিও, আপনার আম্মা কি আমাকে মেনে নিবে?
– সেটা দেখার দায়িত্ব আমার। তোমার না।
তুমি শুধু বলো, আমাকে বিয়ে করবে কিনা। প্লিজ! না বলো না!
– করবো। তবে দুইটা শর্ত মানতে হবে।
– কী শর্ত?
– এক, আগামীকালই বিয়ে করতে হবে।
দুই, আপনার মা যদি একান্তই আমাকে পছন্দ না করে উঠতে পারে; তাহলে আমাকে আলাদা বাসায় রাখবেন দয়া করে। আমি জীবনে আর কষ্ট পেতে চাইনা। শান্তি চাই।
– আচ্ছা। শর্ত মঞ্জুর রাণীসাহেবা!

সবার মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে অত:পর আমরা বিয়ে করে নিলাম।

বিয়ের দিন রাতে বুঝতে পারলাম,
আমার হাজবেন্ড প্রান্ত, ভীষণ বদমেজাজি। উনি বাড়িতে ঢুকেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। কাজের মেয়েটার সাথে আমার সামনেই দুর্ব্যবহার করা শুরু করলেন। সে দরজা খুলতে দেরী করলো কেন এটা তার অপরাধ। ও কিছু বলতে চাচ্ছে, চুলায় রান্না চাপিয়েছিলো বা এখানে কেউ একজন ছিলো তাই সে আর আসেনি- এমন কিছু, কিন্তু প্রান্ত সেসব তোয়াক্কা না করেই ওর গালে চড় বসালো। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো,
কার ঘর বাঁধতে আসলাম?

প্রান্তের মেজাজের মূল কারণ মূলত কেন কেউ তার বউকে সাদরে আপ্যায়ন করে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে না,এটাই। আমার শাশুড়ি বা ননদ কেউই আমার ধারে-কাছে ঘেষছেন না।
ইভেন, কাজের লোককেও আসতে দিচ্ছেন না।
ঘোমটার ফাঁকে এসব দেখে মনে মনে আরেকবার ভাবলাম,
” অভাগীর সুখ কোথাও নেই। ”
প্রান্তের ছোট ভাই পিওন, এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে, সে এগিয়ে আসলো আমাদের দিকে। হাসিমাখা মুখে প্রান্তের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ভাইয়া, বাদ দাও তো! ওরা আসবেনা। তুমি ভাবীকে নিয়ে ভেতরে চলে যাও। সব ডেকোরেশন তোমার কথামতই এরেইঞ্জ করা হয়েছে। খুব সুন্দর হইছে ভাইয়া!
প্রান্ত আর কথা না বাড়িয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে আমাকে নিয়ে ভেতরে চলে আসলেন।

রাতের খাবারের জন্য পিওন আর প্রান্ত দুজন মিলেই কাজ করা শুরু করলো।
আমাকে কিছুই বলা হলোনা।
তবুও আমি নিজে গিয়েই সব বের করে গরম করলাম। তাদের সার্ভ করে দিলাম কিন্তু নিজে কিছুই খেতে পারলাম না। কেন জানিনা খাওয়ার ইচ্ছাই নেই।

ওদের খাওয়া শেষে প্রান্ত জোর করে আমাকে একটু পোলাও আর এক পিস মুরগীর মাংস দিয়ে বলে গেলো, অল্প একটু হলেও যেন খেয়ে আসি।
তারা চলে যাওয়ার পর খাওয়া শুরু করলাম।
সারাদিনের দকলে দানা-পানিও পেটে যায়নি।
তাই আর পারলাম না, না খেয়ে থাকতে।
ঠিক তখনই আমার ননদ আসে। সে ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করতে করতে খোঁচা দিয়ে বললো,
– নির্লজ্জ্ব। যে বাড়িতে আমরা কেউ তাকে মেনেই নেইনি,সেই বাড়ির অন্নই গোগ্রাসে কিভাবে গিলছে দেখো!
শাশুড়ি মা এসে তাকে ডেকে বললো,
– থাক,খেতে দে অনু। এদের কোনো কথাই গায়ে লাগেনা। বেহায়া মেয়ে-ছেলে তো,বুঝিস না!

কি অদ্ভুত!!
আমার কি তাদের সাথে কোনো শত্রুতা আছে?
না কখনো ছিলো?
কী করছি আমি?
এত বাজে বাজে কথা কেন শুনতে হলো?

এক মাস পরে লন্ডনে যাওয়ার ডেট তাই বাধ্য হয়েই আমাকে আলাদা বাসা নিতে হলো।
কারণ শাশুড়ি আর ননদ দুজনের কেউই আমাকে সহ্য করতে পারছে না। তাই প্রান্ত বাধ্য হয়েই আমাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যায়।

★★★
আমরা আমেরিকায় এসেছি আজকে চার বছর। এতগুলো বছরে আমি অনেক কিছু জানতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি।

আমার স্বামী প্রান্ত আহমেদের এখানেও একটি সংসার ছিলো। সে বিদেশী মেয়ে। আমার আগেই তাকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই মেয়েকে তার এখন আর ভালো লাগেনা। শুধু মাসে মাসে খরচ পাঠিয়ে দেয়,এটুকুই।
ঐ মহিলা বিয়েও করছেন না।
কেন করছে না বা কী সমস্যা ইত্যাদি ইত্যাদি সব আমার অজানা। আমাকে জানানো হয়নি।
প্রান্তই জানতে দেয়নি।

তাছাড়া বিয়ের দিন রাত থেকেই বুঝতে পারি,ইনিই সেই আগুন্তক। ইনিই সেই সেলিব্রেটি। যে আমাকে অনেক আগে থেকেই ফোকাস করছে। সেই প্রিতম আহসান আর সেই শুভাকাঙ্ক্ষী আগুন্তক দুজনেই আসলে এক মানুষ। আর সেই মানুষটাই হলো আমার স্বামী। প্রান্ত আহমেদ।

তার মোটিভেশনাল ভিডিও, তার চেহারা, তার মনভোলানো হাসি দেখে তখন যেমন চমকেছিলাম; এখন তার ঘরের ঘরণী হয়ে, তাকে পরখ করে করে আরো বেশি করে চমকাচ্ছি।
নিয়তি। সবই নিয়তির খেলা।
তারপর সে_ই সবটা খুলে বললো।
তার আমার লেখা ভালো লেগেছিলো।(আর আমাকে?)
তাই ফেইক একাউন্ট দিয়ে মেসেজ করেছিলো।
কিন্তু মিরাকেল হলো সেদিন,যেদিন আমি তার পেইজে গিয়ে লাভ রিয়েক্ট দিয়ে আসি,তার মোটিভেশনাল ভিডিও দেখে।
তারপর কিভাবে কিভাবে যেন সব এরেইঞ্জ করে সে একদম আমার নানুর বাড়িতেই প্রস্তাব নিয়ে এসে হাজির!

★★★
আমি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি।
আর পরীক্ষাগুলো দেশে গিয়ে এট্যান্ড করি। অনেক কষ্টে সব ম্যানেজ করা হয়েছে। শুধুমাত্র আজ টাকা আছে বলেই সব সম্ভব হয়েছে। মাঝেমধ্যে আমি ক্লাস করার সুবাদে মাসের পর মাস প্রান্তকে ছাড়াই নিজের বাড়িতে থেকেছি। ক্লাস করেছি। প্রাইভেট পড়ে চ্যালেঞ্জ নিয়ে সব কমপ্লিট করেছি। আবার ফিরে গিয়েছি,আবার এসেছি। এই এই করে আমি আমার পড়াশোনা শেষ করেছি।

আমাদের একটি বাচ্চাও হয়েছে।
ওর আদুরে নাম তিনু। ভালো নাম তিশিকা।
বাচ্চা এখন আধো-আধো কথা বলে, হামাগুড়ি দিয়ে চলে। আছি! এইতো ভালোই।
কিন্তু সমস্যা হলো সেদিন,

একদিন আমি ছোটখাটো একটা চাকরীর(ব্যাংকে) অফার পেলাম,বাংলাদেশেই।
আমি প্রান্তকে জানালাম,
আমরা দেশে ফিরে যাবো, সেখানেই বাকি জীবন কাটাবো। এখানে আমার দম বন্ধ লাগে। ইত্যাদি সব বোঝালাম। কিন্তু প্রান্তকে কোনোভাবেই রাজী করাতে পারলাম না।
সে এক কথাতেই অটল,
– চাকরীর কী দরকার? তিনুকে সামলাও।
একদিন আমাদের মধ্যে প্রচুর কথা কাটাকাটি হলো এই নিয়ে।

আমি বললাম,
– কেন? আগের কথাই তো ছিলো এটা। আমি চাকরী করবো। যেরকম আশা ছিলো তেমন কিছুই তো করতে পারিনি তোমার জন্য। এখন ছোটখাটো একটা অফার পেয়েছি যখন, তখন করিনা। অভিজ্ঞতা তো বাড়বে এট-লিস্ট? তাছাড়া সময় ও কাটবে। এভাবে আর ভালো লাগে না!আর দেশে গিয়ে স্থায়ী হলেও বা ক্ষতি কোথায়?

তার কথা হচ্ছে, সে দেশে গিয়ে থাকবে। এরকম প্ল্যান তারও নাকি ইদানিং মাথায় ঘুরে। কিন্তু পয়েন্ট অফ ভিয়্যু হচ্ছে,চাকরী করা যাবেনা। অদ্ভুত হলেও সত্য, তার ব্যবহারেও অভাবনীয় পরিবর্তন দেখতে পেলাম।

অত:পর একদিন, আমরা দেশে ফিরে আসলাম।
আমি চাকরীতে ও জয়েন করলাম।
সে থাকে তার মায়ের সাথে তাদের নিজস্ব বাড়িতে। আমি থাকি আলাদা বাসায়,একা। বাচ্চা ছোট, এই বাচ্চা নিয়েই অনেক কষ্টে চালিয়ে যাচ্ছি। বাসায় আয়া রেখেছি বাচ্চার জন্য। এভাবেই দিন চলে যাচ্ছে।

তিশিকার দাদি,দাদা,ফুফু কেউই তাকে একবারের জন্যও দেখতে আসেনি। এমন ভাব মনে হয় যেন আমি তাদের জীবনের মহা শত্রু। কিন্তু একটা সংজ্ঞা আমার কাছে অজানা, আমার বাচ্চা তো তাদের ছেলেরও বাচ্চা। তাহলে এই বাচ্চার মুখ দেখাও কি তাদের জন্য পাপ হবে? কি এমন হয়েছিলো যে এতটা বাজে আচরণ করবে? তাদের ছেলেই তো আমাকে বাধ্য করেছিলো বিয়েটা করতে! হ্যাঁ, আমি মানি। আমিও তখন চাপে ছিলাম। কিন্তু আসল গল্পটা তো তাদের ছেলের জন্যই রটেছিলো। তাইনা?
জীবনে আমি কী পেয়েছি একজন সেলিব্রেটিকে বিয়ে করে?

একদিন শুনলাম,
প্রান্তের প্রথম স্ত্রী নাকি বিয়ে করে নিয়েছে।
দ্বিতীয় স্ত্রী ওরফে আমি, আমার সাথে তো সে যোগাযোগ_ই রাখছে না তেমন। হয়তো তার মা,বোন তাকে বুঝিয়ে সফল হতে পেরেছে, আমি খারাপ। তাই সে দেশে এসে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
এদিকে আমার ফ্যামিলিও প্রেশার ক্রিয়েট করছে, সেপারেশনের জন্য।

হয়তো, সত্যিই একদিন আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। এখন শুধু অপেক্ষা।

ক্যারিয়ার,সম্পর্ক,স্বামী,সন্তান,সংসার এবং সুখ, এসব একটা সুস্থ,স্বাভাবিক জীবনের অন্তর্ভুক্ত। এসব জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

কিন্তু অবশেষে,আমার জীবনে কোনোটাই স্থায়িত্ব লাভ করলোনা। কেন?
কারণ,
আমি মধ্যবিত্ত।
আমি অপয়া।
আমি চরম দু:খী।

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here