প্রেম_ফাল্গুন #পর্ব_৯

#প্রেম_ফাল্গুন
#পর্ব_৯
#Nishat_Jahan_Raat (ছদ্মনাম)

“কাল কেনো আঙ্কেল? আজই আমরা নড়াইল যাবো। আপনি দ্রুত বাস স্টপে চলে আসুন। আমি ও আসছি।”

কলটা কেটেই ববি ঝড়ের বেগে ছাঁদ থেকে প্রস্থান নিয়ে দুতলায় নামতেই আতিকের বোন আয়রা সদর দরজা খুলে ববির মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। ববি হাঁটার গতি কমিয়ে হঠাৎ থেমে গেলো। আয়রা লজ্জামাখা মুখে মাথাটা নিচু করে উড়নার আচল ধরে ছোট আওয়াজে বলল,,

“কোথায় যাচ্ছ ববি?”

ববি ব্যস্ত স্বরে বলল,,

“ভালোই হলো আপনার সাথে দেখা হয়ে। একচুয়েলি আমি একটা বিশেষ কাজে নড়াইল যাচ্ছি। কবে ফিরব আই ডোন্ট নো। সো বাড়ির সবাইকে কাইন্ডলি ইনফর্ম করে দিবেন আমি কোথায় যাচ্ছি। বায়।”

আয়রাকে উপেক্ষা করে ববি দৌঁড়ে দুতলার সিঁড়িতে পা বাড়াতেই আয়রা উদ্বিগ্ন হয়ে পেছন থেকে ডেকে বলল,,

“নড়াইলে তোমার কি এমন বিশেষ কাজ ববি? আর তোমাকে এতো উত্তেজিত দেখাচ্ছে কেনো? দেখে তো মনে হচ্ছে সাংঘাতিক কিছু একটা হয়েছে।”

“পরে সব ডিটেলসে বলছি। প্লিজ আর পিছু ডাকবেন না। আমাকে যেতে দিন।”

“আগামী সপ্তাহে আমাদের বিয়ে ববি। তুমি এখনো আমাকে আপনি আপনি করছ?”

ববি প্রতিত্তুর না করে এক ছুটে বাড়ির মেইন গেইটে চলে এলো। রিকশা করে সে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে নড়াইলের দুটো টিকেট কেটে অধীর আগ্রহ নিয়ে বাসস্ট্যান্ডের এদিক থেকে সেদিক পায়চারী করছে। উত্তেজনায় তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। গাঁ থেকে অবিরত ঘাম ঝড়ছে। রাগে, দুঃখে গৌরবর্ণের মুখটা রক্তিম বর্ণ হয়ে গেছে। খানিক ক্ষণ বাদে আবার ঘাড়ের রগ গুলো ও ভেসে উঠছে। সামনের চুল গুলো টেনে ববি আপন মনে বিড়বিড় করে বলল,,

“আমি আসছি ” পুতুল বউ।” তোমাকে আমি কিছুতেই অন্য কারো হতে দিবো না। তুমি ববির ছিলে, ববির আছো আর আজন্ম এই ববির ই থাকবে। ববির কাছ থেকে পৃথিবীর কোনো শক্তি তোমাকে আলাদা করতে পারবে না।”

তন্মধ্যেই জুবায়ের আহমেদকে দুঃশ্চিতাগ্রস্থ অবস্থায় বাস স্ট্যান্ডে দেখা গেলো। এলোমেলো চুল, নেতিয়ে যাওয়া শুকনো মুখ, চোখে, মুখে হতাশার ছাপ। জুবায়ের আহমেদকে দেখা মাএই ববি দৌঁড়ে গিয়ে জুবায়ের আহমেদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,

“পনেরো মিনিটের মধ্যেই বাস ছেড়ে দিবে আঙ্কেল। প্লিজ হারি আপ।”

জুবায়ের আহমেদ বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন,,

“চলো, চলো!”

বাসে উঠতেই পনেরো মিনিটের মধ্যে বাস ছেড়ে দিলো। অপেক্ষার পথ যেনো কিছুতেই ফুরাচ্ছে না। যতো সামনে এগুচ্ছে ততোই যেনো পথ আরো বাড়ছে, বলিরেখা ও বাড়ছে। প্রতীক্ষার অবসান যেনো কিছুতেই ক্ষান্ত হচ্ছে না। ববি এবং জুবায়ের আহমেদ দুজনই খুব বেশি টেনশানে এবং উত্তেজনায় আছে। দুজনের চোখে, মুখেই এক ধরনের প্রবল উত্তেজনা কাজ করছে। নড়াইলের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে জুবায়ের আহমেদ ববিকে উদ্দেশ্য করে বেশ উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন,,

“খুব চিন্তায় আছি ববি। লিলিকে নিয়ে আমরা নিরাপদে ঢাকায় পৌঁছাতে পারব তো? গ্রামের লোকদের কিভাবে সামাল দিবো? কিভাবে লিলিকে ঐ অসভ্য ছেলেটার হাত থেকে বাঁচাব?”

ববি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলল,,

“ডোন্ট ওরি আঙ্কেল। মাঝ রাতের মধ্যেই আমরা লিলিকে নিয়ে পালাবো। গ্রামের লোকজন দেখার আগেই। ঐ স্ক্রাউন্ডেলটা ও লিলির কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।”

“আমি ও তাই ভাবছিলাম ববি। মাঝরাতের দিকেই লিলিকে নিয়ে আমাদের পালাতে হবে। গ্রামের লোকজনদের আড়ালে!”

ববি মাথা নাঁড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। বাসে আর কোনো রূপ কথা হয় নি দুজনের মধ্যে।

মধ্যরাত দুটো বাজতেই ববি এবং জুবায়ের আহমেদ লিলিদের বাড়ির কাছাকাছি এসে পৌঁছালো। পাঁয়ে হেঁটে প্রায় পাঁচ মিনিট ভেতরে গেলেই লিলিদের ছোট্ট বাড়িটা। গেইটের ফাঁক দিয়ে দূর থেকে লিলিদের দুই রুম বিশিষ্ট টিন সেটের বিল্ডিং বাড়িটায় আলো, রোশনাই, রকমারি ঝাড়বাতি জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন রকমের ফুল দিয়ে সাজানো বিয়ের গেইটটা ও দেখা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে রমরমা একটা পরিবেশ। এতো জাকজমক আর চাকচিক্যতা দেখে ববির মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। বাড়ির ছোট্ট গেইটের সামনাটায় আবার গুটি কয়েক ছেলেকে দেখা যাচ্ছে। সবার হাতেই জ্বলন্ত সিগারেট। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে আর কি নিয়ে যেনো পৈশাচিক হাসিতে ফেঁটে পড়ছে। গেইটের সামনাটায় আসতেই জুবায়ের আহমেদ ছোট আওয়াজে ববিকে বললেন,,

“সামনে যে ছেলে গুলো দেখছ, সব গুলোই এই গ্রামের শীর্ষ বখাটে ছেলে। ঐ যে লাল শার্ট পড়া ছেলেটাকে দেখছ? সে হলো মেম্বারের ছেলে রিফাত। আমার মনে হচ্ছে লিলিকে পাহারা দেওয়ার জন্যই তারা গেইটের সামনাটায় অবস্থান করছে। আমাদের এখন ঠান্ডা মাথায় তাদের হ্যান্ডেল করতে হবে। কোনো রকম রাগারাগি ছাড়া!”

ববি বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে বলল,,,

“আঙ্কেল, আমি এদের চোখের সামনে সহ্য করতে পারছি না। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। রাগের বসে কি করে ফেলি আই ডোন্ট নো। প্লিজ আপনি এদের হান্ডেল করুন।”

“বি কুল ববি। আমরা এখানে হানাহানি, মারামারি করতে আসি নি। কায়দা করে লিলিকে উঠিয়ে নিতে এসেছি। এছাড়া এদের রাগালে আমরা কিছুতেই লিলিকে নিয়ে সেইফলি ঢাকা পৌঁছাতে পারব না। হীতে বিপরীত হতে পারে। বিষয়টা আরো রিস্কি হয়ে যেতে পারে৷ তাই বলছি, আমাকে পরিস্থিতিটা ঠান্ডা মাথায় কন্ট্রোল করতে দাও। তুমি কোনো কথা বলবে না। আমি যা বলব, তুমি শুধু আমার হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলাবে! ওকে?”

ববি জোর পূর্বক মাথা নাঁড়ালো। ইতোমধ্যেই ছেলে গুলোর নজর পড়ল ববি এবং জুবায়ের আহমেদের দিকে। হাতা থাকা সিগারেটটা পায়ে পিষে রিফাত প্রচন্ড ভালো মানুষ সেজে মাথা নিচু করে জুবায়ের আহমেদের সম্মুখীন হয়ে বলল,,

“কেমন আছেন চাচা?”

জুবায়ের আহমেদ জোর পূর্বক হাসি টেনে বললেন,,

“এইতো, ভালো আছি রিফাত। তুমি কেমন আছো?”

রিফাত মাথা তুলে জুবায়ের আহমেদের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ হেসে বলল,,

“ভালো আছি চাচা। এতো রাতে আপনি নিশ্চয়ই লিলির এবং আমার বিয়ের কথা শুনে এসেছেন?”

ববি রাগে গজগজ করছে। পারছে না রিফাতকে শুটিয়ে লাল করে দিতে। সামনের চুল গুলো টেনে সে প্রচন্ড রকম বিরক্তি প্রকাশ করছে৷ জুবায়ের আহমেদ হালকা হেসে বিফাতের কাঁধে হাত রেখে বললেন,,

“হ্যাঁ রিফাত। তোমাদের বিয়েতেই এসেছি। তোমাদের নতুন জীবনের জন্য প্রাণভরে দো’আ করতে এসেছি।”

রিফাত লজ্জামাখা হাসি দিয়ে বলল,,

“আপনার পরিবারের বাকিরা আসে নি চাচা?”

“না। তবে আমার একজন কাছের মানুষ এসেছে।”

ববির দিকে তাকিয়ে জুবায়ের আহমেদ রিফাতকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“এ হলো ববি। আমার কাছের মানুষ।”

রিফাত চোখ ঘুড়িয়ে ববির দিকে তাকালো। ববি তেজী দৃষ্টিতে রিফাতের দিকে তাকিয়ে আছে। রিফাত মলিন হেসে ববির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,,

“হায় আমি রিফাত।”

ববি ভীষণ রুষ্ট হয়ে জুবায়ের আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আঙ্কেল। ভেতরে চলুন। রেস্ট দরকার আমার।”

জুবায়ের আহমেদ গলাটা ঝাঁকিয়ে রিফাতকে বললেন,,

“আমরা এখন আসছি বাবা। আসলে ববি শহরের ছেলে তো, হঠাৎ গ্রামে এসেছে। তাই খুব বিরক্তবোধ করছে।”

ববির দিকে তেজী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রিফাত জুবায়ের আহমেদকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“বুঝেছি চাচা। আসুন আপনারা।”

জুবায়ের আহমেদ আমতা আমতা করে বললেন,,

“তোমরা কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে রিফাত?”

বিফাত ভীষণ রেগে বলল,,

“বিয়ের আগ অব্দি এখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকব আমরা। আগের বার তো লিলি সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে ঢাকায় আপনার কাছে আশ্রয় নিয়েছে। আমি সহ আমার পরিবারের সবাইকে সমাজের চোখে হেয় প্রতিপন্ন করেছে। এবার আমি কিছুতেই লিলিকে পালাতে দিবো না, আমাদের পরিবারের মান, সম্মান ও খোঁয়াতে দিবো না। বিয়ের আগ পর্যন্ত ঠিক এভাবেই আমি লিলিকে পাহারা দিবো। বাইরের কোনো শক্তিই এবার লিলিকে আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না।”

ববি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে রিফাতকে কিছু বলার পূর্বেই জুবায়ের আহমেদ ববিকে নিয়ে সোজা বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলেন। ববি রাগে ফুসফুস করছে। জুবায়ের আহমেদ উদ্বিগ্ন হয়ে ছোট আওয়াজে ববিকে বললেন,,

“কি করছ কি ববি? তোমাকে তো বললাম ই, এদের কিছুতেই ক্ষেপানো যাবে না। যতো সম্ভব চেষ্টা করতে হবে এদের শান্ত রাখতে। ঠান্ডা মাথায় পুরো বিষয়টাকে হ্যান্ডেল করতে হবে। তুমি যে কেনো এতো হাইপার হয়ে যাচ্ছ তাই আমার মাথায় ঢুকছে না।”

ববি ক্ষুব্ধ হয়ে পেছনের চুল গুলো টেনে বলল,,

“আমি লিলিকে ভালোবাসি আঙ্কেল। ঐ স্ক্রাউন্ডেলটার মুখে আমি কিভাবে আমার লিলির নামটা সহ্য করি বলুন? মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছিলো আমার। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না!”

জুবায়ের আহমেদ অতি আশ্চর্যিত চোখে ববির দিকে তাকিয়ে বললেন,,

“সত্যিই তুমি লিলিকে ভালোবাসো ববি?”

“হ্যাঁ আঙ্কেল। খুব ভালোবাসি। ভাষায় প্রকাশ করে বুঝাতে পারব না!”

জুবায়ের আহমেদ স্থির চোখে ববির দিকে তাকিয়ে বললেন,,

“বিয়ে করতে পারবে লিলিকে? লিলির স্বপ্ন পূরণের বিশ্বস্ত হাত হতে পারবে?”

“আমি এক পায়ে রাজি আঙ্কেল। ঢাকার পৌঁছানোর পূর্বেই আমি লিলিকে বিয়ে করব। আমার ওয়াইফ হিসেবেই লিলি আমার বাড়িতে উঠবে। লিলির সমস্ত ভরণ, পোষণ এমনকি লিলির স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব একান্তই আমার। ছাঁয়া হয়ে আমি অলওয়েজ লিলির পাশে থাকব।”

জুবায়ের আহমেদ আনন্দ অশ্রু নিয়ে ববিকে জড়িয়ে ধরে বললেন,,

“থ্যাংকস ববি। চিন্তামুক্ত করলে আমায়। লিলির ভবিষ্যত নিয়ে খুব টেনশানে ছিলাম। সেই টেনশান থেকে তুমি আমাকে এক মুহূর্তেই নিস্তার দিলে৷ আমি তোমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি ববি। লিলিকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে খুব নিশ্চিন্ত হবো আমি। তুমিই হলে লিলির জন্যে পৃথিবীর সব’চে সুযোগ্য পাএ।”

“থ্যাংকস আঙ্কেল। আমাকে এতোটা ভরসা করার জন্য। প্রমিস করছি, আমি আপনার ভরসার মান রাখব।”

,
,

আধ ঘন্টা পর। জুবায়ের আহমেদ এবং ববি খাবার টেবিলে বসে আছে। ঝুলি এবং মমতা বেগম (ঝুলির মা) খুব আদর, যত্ন করে তাদের আপ্যায়ন করছে। ববি এক দৃষ্টিতে বিছানার উপর মাথা নিচু করে বসে থাকা লিলির দিকে তাকিয়ে আছে। লিলির পাশেই লিলির বাবা (জামির হোসেন) বসে আছেন। জুবায়ের আহমেদের সাথে উনি গ্রামের জায়গা জমিন সম্পর্কিত কথা বলছেন। উনাদের কথার মাঝখানেই মমতা বেগম নিচু স্বরে জুবায়ের আহমেদকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“তোমরা এমন সময় এলে জুবায়ের, রান্না করে যে ভালো, মন্দ কিছু খাওয়াবো তার ও সময় পেলাম না। আসার হলে সন্ধ্যা রাতেই আসতে তখন ভালো, মন্দ রান্না করে খাওয়াতাম। শুকনো ডিম আর ডাল দিয়ে কি ভাত খাওয়া যায় বলো? সাথে আবার নতুন একজন মেহমান নিয়ে এসেছ। যত্ন, আত্তি করে খাওয়াতে পারলাম না। খুব খারাপ লাগছে আমার। ছেলেটা কি ভাবছে আমাদের বলো তো?”

জুবায়ের আহমেদ ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে মৃদ্যু হেসে বললেন,,

“ববি আমাদের এমন ছেলেই না ভাবি, যে মাইন্ড করবে! বরং বিষয়টাকে সে সহজ ভাবেই নিবে।”

লিলির থেকে চোখ ফিরিয়ে ববি জোর করে এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে মমতা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আন্টি। আপনি এতো ব্যস্ত হবেন না। একচুয়েলি, ডিম ডাল আমার খুবই প্রিয় খাবার। বাড়িতে মাঝে মধ্যেই আমি আম্মুর কাছে বাহানা করি ডিম ডাল রাঁধতে।”

মমতা বেগম সহ উপস্থিত বাকি সবাই মৃদ্যু হাসলেন। লিলি এতক্ষনে মুখ তুলে ববির দিকে তাকালো। ববিকে একটা পলক দেখার সাথে সাথেই লিলি চোখ জোড়া নিচে নামিয়ে নিলো৷ বুকটা ধক করে কেঁপে উঠল তার। চোখের কোণে দু ফোঁটা জল ও চিকচিক করছে। এনি টাইম জল গুলো চোখ থেকে গড়িয়ে পড়বে। এতোদিনের কাঙ্ক্ষিত প্রিয় মুখটা দেখে ক্রমশ তার অস্বস্তি বাড়ছে, শরীরটা ও ঢকঢক করে কাঁপছে৷ তাড়াহুড়ো করে লিলি বসা থেকে উঠে পাশের রুমে চলে এলো। দরজা ভেজিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে লিলি চোখের জল ছেড়ে ছোট আওয়াজে বলল,,

“আপনি কেনো এলেন ববি ভাই? আবারো কেনো আমার মনে প্রেমের শিখা জ্বালালেন? আবারো কেনো আমরা উতলা মনকে আরো ব্যাকুল করে তুললেন? এখন মনে আপনাকে রেখে কিভাবে আমি অন্য কাউকে বিয়ে করি ববি ভাই? আমি যে বেঁচে থেকে ও জীবন্ত লাশ হয়ে থাকব!”

কাঁদতে কাঁদতে লিলি ঘুমিয়ে পড়ল। ঘন্টা খানিক বাদে গাঁয়ে কারো উষ্ণ হাতের স্পর্শ পেতেই লিলি হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল। চোখে আতঙ্ক নিয়ে লিলি পাশ ফিরে তাকাতেই ড্রিম লাইটের মিহি আলোতে ববিকে দেখতে পেলো। বিস্ময়ভরা চোখে লিলি ববির দিকে তাকিয়ে ছোট আওয়াজে বলল,,,

“আআআপনি এখানে কিকিকি করছেন ববি ভাই?”

তন্মধ্যেই চারদিকে ফজরের আযান পড়ল। ববি ব্যতিব্যস্ত হয়ে লিলির দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আমরা এক্ষনি এই গ্রাম ছেড়ে পালাবো লিলি। তাড়াতাড়ি উঠো। প্রয়োজনীয় সব জিনিসপএ গুছিয়ে নাও৷ কাম অন, হারি আপ।”

লিলি কপাল কুঁচকে বলল,,

“মানে? আপনি এসব কি বলছেন ববি ভাই?”

“প্লিজ লিলি এসব কথা পরে হবে৷ আধ ঘন্টার মধ্যেই আমাদের এই গ্রাম ছেড়ে পালাতে হবে। রিফাতের ছেলেরা মেবি আধ ঘন্টার জন্য কোথাও একটা গেছে। সেই সুযোগেই আমাদের পালাতে হবে।”

“কিন্তু ববি…”

লিলিকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না ববি। তৎক্ষনাৎ লিলিকে কোলে তুলে নিলো আর লিলির কানের কাছে খানিক ঝুঁকে ছোট আওয়াজে বলল,,

“একদম চুপ থাকবে। কোনো কথা বলবে না। আমার উপর আস্থা আছে তো?”

লিলি ঠোঁটে আঙ্গুল গুজে মাথা নাড়ালো। আচমকা ববি লিলির কপালে আলতো করে একটা চুমো খেয়ে বলল,,

“ভরসা রাখো। ভালো কিছু হবে।”

তন্মধ্যেই ঝুলি হাতে করে লিলির সমস্ত প্রয়োজনীয় সার্টিফিকেট নিয়ে ববির মুখোমুখি দাঁড়ালো৷ ববি অন্য হাতে সার্টিফিকেট গুলো নিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিচ্ছে আর পিছু ফিরে ঝুলিকে বলছে,,

“দো’আ করবেন আপু। আমরা যেনো কোনো বিপদ ছাড়াই সেইফলি ঢাকা পৌঁছাতে পারি।”

ঝুলি অশ্রুসিক্ত চোখে বলল,,

“দো’আ করি ববি। দেখবে, তোমরা সমস্ত বিপদ কাটিয়ে খুব শীঘ্রই নিরাপদে ঢাকায় পৌঁছে যাবে।”

ঝুলি এবার লিলিকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“ভালো থাকিস বোন। দো’আর করি। পড়ালেখা করে অনেক বড় হ। ববি সারাজীবন তোর পাশে থাকবে। তোর সব স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করবে।”

লিলি চোখের জল ছেড়ে ঝুলির দিকে তাকালো। তবে এই মুহূর্তে তার সাথে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে বিষয়ে সে মোটে ও অবগত নয়। ঘটনার আকস্মিকতায় লিলি তব্দা লেগে আছে। সম্পূর্ণ ব্যাপার গুলো সে বিস্ময়ের সাথে দেখছে। নিজস্ব অনুভূতি থেকে নয়।

ববি তাড়াহুড়ো করে বাড়ির মেইন গেইট পাড় হয়ে এক ছুটে গ্রামের মেইন রাস্তায় উঠে এলো। জুবায়ের আহমেদ অটো নিয়ে ওখানে ববি এবং লিলির জন্য অপেক্ষা করছেন। অটো টা দেখা মাএই ববি লিলিকে নিয়ে অটোতে উঠে পড়ল। তন্মধ্যেই অটো ছেড়ে দিলো। লিলি চোখ দুটো প্রকান্ড করে পাশে বসে থাকা ববির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ঘুড়িয়ে আবার অটোর সামনে বসে থাকা জুবায়ের আহমেদের দিকে তাকাচ্ছে। ঝুলির দেওয়া ফাইলটা ববি অটোর একটা কর্ণারে রেখে এক হাত দিয়ে লিলিকে তার বুকের মাঝে চেঁপে ধরে বলল,,

“তুমি এখন পৃথিবীর সব’চে নিরাপদ জায়গায় আছো লিলি। ডোন্ট ওরি।”

লিলি চোখে কৌতুহল নিয়ে ববির দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আমরা কোথায় যাচ্ছি ববি ভাই?”

“ঢাকায়।”

“কিন্তু চাচী তো আমাকে মেনে নিবেন না ববি ভাই।”

তন্মধ্যেই জুবায়ের আহমেদ পেছন থেকে লিলিকে বললেন,,

“এবার তুই চাচীর বাড়িতে আর বোঝা হয়ে উঠবি না রে লিলি। এবার তুই অধিকার নিয়ে ববির বাড়িতে উঠবি!”

লিলি চরম আশ্চর্যিত হয়ে বলল,,,

“মানে?”

ববি লিলিকে বুকের মাঝে টাইট করে ঝাপটে ধরে বলল,,

“স্ত্রীর অধিকার নিয়ে তুমি আমার বাড়িতে উঠবে লিলি। ঢাকায় পৌঁছেই আমি তোমাকে বিয়ে করব!”

ঘটনার আকস্মিকতায় লিলি মাথা ঘুড়ে ববির বুকে লুটিয়ে পড়ল। ববি আচমকা হু হা করে হেসে বলল,,,

“আঙ্কেল। আপনার ভাতিজী জ্ঞান হারিয়েছে!”

জুবায়ের আহমেদ ও হু হা করে হেসে উঠলেন। সারা রাস্তায় লিলি অজ্ঞান অবস্থায় ববির বুকের মাঝে চিপকে ছিলো। বাস স্ট্যান্ড পৌঁছাতেই ববি পানি ছিটিয়ে লিলির জ্ঞান ফিরালো এবং বাস ধরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বাসে লিলি এবং ববি একই সিটে পাশাপাশি বসে আছে। জুবায়ের আহমেদ সামনের এক সিটে বসে আছে। বাস শোঁ শোঁ বেগে প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষকে নিয়ে তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য ছুটছে। চারদিকে ভোরের আলো ফুটে সকাল হতে চলেছে। ঘড়িতে নিশ্চয়ই সকাল ছয়টা বা তার আশেপাশে বাজছে। চারদিকে ছোট ছোট পাখির কিচির মিচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সূর্যের লাল আভা আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘন্টা খানিক বাদেই হয়তো সূর্য পরিপূর্ণ ভাবে পুরো আকাশকে দখল করে নিবে। আকাশে এখন উষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করছে। মৃদ্যু মন্দ শীতল বাতাসে বৃক্ষরাজি সব দুলছে।ঝাঁক বেঁধে পাখিরা সূর্য্যের লাল আভার আশেপাশে ডানা মেলে উড়ছে। পরিবেশটা খুব শান্ত, স্নিগ্ধ লাগছে। রাস্তায় ও যানবাহনের আনাগোনা কিছুটা কম। মাঝে মাঝে দু, একটা বড় বাস, ট্রাক চলছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই হয়তো রাস্তায় জন মানব এবং যানবাহনের কোলাহল বাড়বে। শুরু হবে ব্যস্ততায় মুখর জন মানুষদের পদচারণা। পরিবেশ আস্তে ধীরে অশান্ত হয়ে উঠবে। সকালের স্নিগ্ধ পরিবেশটা ও তখন তিক্ততায় পরিণত হবে!

জানালায় মুখ রেখে পিটপিট চোখে এসবই ভাবছে লিলি। ববি লিলির গাঁ ঘেঁষে বসলে ও লিলি কোণ ঠাসা হয়ে জানালার এক কোণায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। বিস্ময়ের ঘোর এখনো কাটছে না তার। অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে এক প্রকার আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে সে। আর ক্ষনিক বাদে বাদে জানালা থেকে মুখ উঠিয়ে আড়চোখে ববির দিকে তাকাচ্ছে। ববি বাসের সিটে হেলান দিয়ে বুকের উপর দু হাত গুজে চুপ করে শুয়ে আছে। আচমকা ববি চোখ বুজে মৃদ্যু হেসে লিলিকে বলল,,

“কয়েক ঘন্টা পরেই আমাদের বিয়ে লিলি। তোমার অনুভূতি কেমন?”

লিলি সোজা হয়ে বসে মাথা নিচু করে বলল,,

“হাতে ধরে নিজের জীবনটা এভাবে নষ্ট করে দিবেন না ববি ভাই। আমাকে বিয়ে করে আপনি কিছুই পাবেন না। উল্টে প্রতি পদে ঠকবেন। এক সময় তিক্ত হয়ে উঠবেন।”

ভীষণ রেগে ববি ফট করে চোখ জোড়া খুলে চোয়াল শক্ত করে লিলির ডান হাতটা চেঁপে ধরে বলল,,

“শাট আপ। জাস্ট শাট আপ। আমার ভালো মন্দ আমি বুঝে নিবো। তোমাকে আমার লাইফ নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি জাস্ট চুপ থাকবে। একদম চুপ থাকবে। শুধু আমি যা বলব তুমি তাই শুনবে এবং তাই করবে। আমার মুখের উপর একটা কথা ও বলবে না।”

লিলি নাক মুখ কুঁচকে ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠে বলল,,

“ব্যাথা পাচ্ছি ববি ভাই। প্লিজ হাতটা ছাড়ুন।”

ববি তাড়াহুড়ো করে লিলির হাতটা ছেড়ে হাতটার দিকে তাকাতেই দেখল লিলির শুভ্র রঙ্গের হাতটায় ববির পাঁচ আঙ্গুলের দাগ পড়ে গেছে। পেরেশান হয়ে ববি লিলির হাতটায় দীর্ঘ একটা চুমো খেয়ে বলল,,

“স্যরি পুতুল বউ। বুঝতে পারি নি হাতটা এভাবে লাল হয়ে যাবে, এতোটা ব্যাথা পাবে।”

লিলি কিছু বলল না। শুধু ছলছল চোখে ববির দিকে তাকালো। এক হাত দিয়ে ববি লিলিকে তার বুকে আগলে ধরে চোখ বুজে শান্ত স্বরে বলল,,,

“টেইক রেস্ট। ঢাকা পৌঁছাতে আমাদের আরো কয়েক ঘন্টা সময় লাগবে।”

লিলি পরম আবেশে চোখ জোড়া বুজে নিলো। কিছুক্ষণ বাদে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ল। সেই ঘুম ভাঙ্গল তার ববির ডাকাডাকিতে। পিটপিট চোখে লিলি নিজেকে ববির বুকে আবিষ্কার করল। ববি ঘুম জড়ানো স্বরে লিলির দিকে তাকিয়ে বলল,,

“উঠো লিলি। ঢাকা বাস স্ট্যান্ড পৌঁছে গেছি।”

লিলি আড়মোড়া ভেঙ্গে দীর্ঘ এক হামি তুলে ববির দিকে তাকালো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে লিলিকে নিয়ে ববি এবং জুবায়ের আহমেদ তাড়াহুড়ো করে বাস থেকে নেমে পড়লেন। সি.এন.জি করে সাভার পৌঁছে জুবায়ের আহমেদ লিলি এবং ববিকে নিয়ে উনার পরিচিত এক কাজী অফিসে গেলেন। তিন কবুল বলার পূর্ব মুহূর্তে লিলি অশ্রুসিক্ত চোখে ববির দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আপনি যা করছেন ভেবে চিন্তে করছেন তো ববি ভাই? আপনার পরিবার আমাকে মেনে নিবে তো?”

ববি স্পষ্ট স্বরে বলল,,

“আমি যা করছি, ভেবে চিন্তে করছি লিলি। প্রাথমিক পর্যায়ে পরিবার আমাদের মেনে না নিলে ও একটা সময় পর নিশ্চয়ই আমাদের মেনে নিবেন। হয়তো মাঝখানে অনেক ঝড় ঝঞ্ঝা আসতে পারে। অনেক কোলাহল তৈরি হতে পারে। তবে, তুমি পাশে থাকলে আমি সব ঝড় ঝঞ্ঝা, কোলাহল উপেক্ষা করে পরিবারকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারব লিলি।”

লিলি মাথা নিচু করে চোখের জল ছাড়ছে। ববি উদ্বিগ্ন হয়ে লিলির দু কাঁধে হাত রেখে লিলির দিকে ঝুঁকে বলল,,

“ভেবো না, বিয়ের পর তোমার স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে। ধরতে পারো বিয়ের পর তোমার সমস্ত ভাঙ্গা স্বপ্ন খুব নিঁখুতভাবে জোড়া লাগবে। ববি আর যাই করুক না কেনো তার ওয়াইফের স্বপ্ন পূরণে কোনো খামতি রাখবে না। নিজের বেস্ট দিয়ে তার ওয়াইফের সমস্ত স্বপ্ন পূরণ করবে। তার ওয়াইফকে অলওয়েজ ভালো রাখার চেষ্টা করবে।”

লিলি আনন্দ অশ্রু নিয়ে ববির দিকে তাকালো। জুবায়ের আহমেদ হাসি মুখে কাজী সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,,

“বিয়ে পড়ানো শুরু করুন কাজী সাহেব। বর, কনে দুজনই রাজি!”

ববি তিন কবুল বলার পরক্ষনেই লিলি এক নিশ্বাসে গড়গড় করে তিন কবুল বলে দিলো। লিলির মধ্যে কোনো রকম লজ্জাবোধ বা আড়ষ্টতা কাজ করে নি। চোখে, মুখে শুধুমাএ এক রাশ খুশি আর অপার সম্ভাবনার ঝিলিক দেখা গেছে।

#চলবে….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here