প্রেম_ফাল্গুন #পর্ব_৩৭

#প্রেম_ফাল্গুন
#পর্ব_৩৭
#নিশাত_জাহান_নিশি

সাহেরা খাতুন ও এখন লিলির আশেপাশে ঘেঁষতে চান না। লিলির থেকে যথেষ্ট দূরে থাকছেন, মাঝে মাঝে খুব খড়তড় ভাষায় ও কথা বলছেন, চট করে রেগে যাচ্ছেন, লিলির লেখাপড়া নিয়ে ও খোঁটা দিচ্ছেন। হেমার সাথে মিলে লিলিকে বিভিন্নভাবে অপদস্ত করার চেষ্টায় অটল আছেন। উনার এই আকস্মিক পরিবর্তন, তুখাড় রেগে যাওয়া এবং প্রচন্ড বিরক্তির একমাএ কারণ হলো লিলির প্রেগনেন্সি নিয়ে! লিলি এখনো সাহেরা খাতুনের কথা রাখতে পারে নি। দু বছর ধরে চেষ্টা করে ও সাহেরা খাতুনকে একটা নাতি বা নাতনীর মুখ দেখাতে পারে নি!

হেমা দ্বিতীয় বারের কনসিভ করেছে। ৭ মাসের অন্তসর্ত্তা সে। এইতো কিছুদিন হলো হেমা ডেলিভারির জন্য বাপের বাড়ি এসেছে। সাহেরা খাতুন চাইছেন এইবারের ডেলিভারিটা উনাদের বাড়িতেই হতে৷ হেমার শ্বশুড় বাড়ির সবাই উনার সিদ্ধান্তে সায় জানিয়ে ডেলিভারির ২ মাস পূর্বেই হেমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেই সুযোগে হেমা সাহেরা খাতুনকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে লিলির বিরুদ্ধে উসকে দিচ্ছে। বিভিন্ন ভাবে লিলিকে ভুল প্রমাণিত করে সাহেরা খাতুনের কান ভাঙ্গাচ্ছে। অযথা লিলির দোষ, ত্রুটি খুঁজে বের করছে। বিশেষ করে লিলির পড়াশোনা নিয়ে একটু বেশিই বিষ ঢালছে সাহেরা খাতুনের কানে।

লিলি এসব সাংসারিক কুটনৈতিক বিষয় গুলোতে দিন দিন খুব সাংঘাতিক ভাবে হাঁফিয়ে উঠছে। একে তো সন্তান না হওয়ার যন্ত্রণা, দ্বিতীয়ত ফাইনাল এক্সামের চাপ, তৃতীয়ত সাংসারিক কুটনীতি, কলহ্, ঝগড়া, বিবাধ, অযথা দোষ খুঁজে বের করা, কাজের চাপ, সব বিষয়ে অহেতুক রাগারাগি। মানসিক এবং শারীরিক ভাবে ক্রমাগত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। সাংঘাতিক বিমূর্ষ এক অবস্থা। চোখের নিচটায় কালি পড়ে লিলির স্নিগ্ধ, শুভ্র মুখটা একদম ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বলিষ্ঠ শরীরটা শুকিয়ে এখন রুগ্ন হয়ে গেছে। গলার ভাসমান হাড় জোড়া দূর থেকে পুরো স্পষ্ট দেখা যায়। ঘন, কালো গুচ্ছ চুল গুলো সঠিক যত্নের অভাবে যেমন রুক্ষ হয়ে গেছে তেমনি পুষ্টির অভাবে প্রায় অনেকটাই ঝড়ে গেছে!

ঘড়িতে রাত ১০ টা। লিলি মাএ হেমার রুম ঝাড়ু দিয়ে, বিছানার চাঁদর গুছিয়ে বড্ড ক্লান্ত শরীর নিয়ে পড়ার টেবিলে পিঠ লাগিয়েছে। সারাদিনে এই যে, এইমাএ একটু সময়, সুযোগ খুঁজে বের করেছে পড়ার টেবিলে বসার। সাংসারিক সমস্ত কাজ এখন লিলি একাই করছে। রান্না, বান্না হতে শুরু করে হাঁড়ি, পাতিল মাজা, সংসারের খুঁটিনাটি সমস্ত কাজ। কাজের বুয়াকে এক সপ্তাহ হলো বিদায় করা হয়েছে। জিনিয়া আহমেদের বিরুদ্ধে গিয়ে হেমা এই দুঃসাহসটা দেখিয়েছে। ববি অবশ্য এই বিষয় সম্পর্কে এখনো অবগত নয়। লিলি এই পর্যন্ত কিছুই জানতে দেয় নি ববিকে!

মিইয়ে আসা দৃষ্টি নিয়ে লিলি পড়ায় ধ্যান দিতেই হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। বইটা বন্ধ করে লিলি দ্রুত পায়ে হেঁটে সদর দরজাটা খুলতেই ববিকে দেখা গেলো শুকনো মুখে ম্লান হাসি সমেত। ববি তার কষ্ট, যন্ত্রণা, ডিপ্রেশান বা হতাশা গুলো লিলিকে এই পর্যন্ত দেখাতে বা বুঝাতে চায় নি। সবসময় লিলির সামনে খুব হাসি, খুশি থেকেছে, যথেষ্ট স্বাভাবিক থেকেছে এবং লিলিকে যথাসাধ্য শান্তনা দিয়ে গেছে। কখনো বুঝতে দেয় নি বাবা না হতে পারার যন্ত্রণায় সে মানসিক ভাবে কতোটা ভেঙ্গে পড়েছে, কতোটা অসহায় বোধ করছে, কতোটা ক্ষুদ্র মনে করছে নিজেকে।

লিলি নিষ্পলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ববির দিকে চেয়ে থেকে বিনিময়ে নিজে ও ম্লান হাসল। ববির কাঁধ থেকে অফিস ব্যাগটা নিয়ে লিলি বেড রুমে প্রবেশ করল। সদর দরজার খিল আটকে ববি বেড রুমের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে হেমা কর্কশ কন্ঠে ববিকে ডেকে বলল,,

“ববি শোন?”

ববি মৃদ্যু হেসে পিছু ফিরে তাকালো। হেমা রূঢ় স্বরে বলল,,

“আম্মু তোকে ডেকেছে। কিছু কথা আছে তোর সাথে।”

ববি গলার টাইটা খুলে ব্যস্ত স্বরে বলল,,

“আচ্ছা যাবো। ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

ববি পুনরায় জিগ্যাসু দৃষ্টিতে বলল,,

“আদিল কোথায়?”

“এইমাএ ঘুমিয়েছে।”

প্যান্টের পকেট থেকে একটা ক্যাটবেরি চকলেট বের করে ববি হেমার দিকে এগিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল,,

“চকলেট টা আদিলকে দিও।”

হেমা হাত বাড়িয়ে চকলেট টা নিলো। ববি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বেড রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। রুমের দরজাটা আটকে ববি সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। লিলি খুব ধ্যান লাগিয়ে পড়ায় মন দিলো।

আনুমানিক আধ ঘন্টা পর ববি টাওয়াল হাতে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। পড়ার টেবিলের দিকে তাকিয়ে ববি কপাল কুঁচকে দৌঁড়ে গেলো টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে থম মেরে বসে থাকা লিলির দিকে। লিলিকে দুহাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে ববি ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলল,,

“এই লিলি কি হয়েছে?”

লিলি ধরফড়িয়ে উঠে মাথা তুলে ঘুম জড়ানো চোখে ববির দিকে তাকালো। ববি ভ্রু যুগল ঈষৎ কুঁচকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে বলল,,

“ঘুমুচ্ছিলে তুমি?”

ম্লান হেসে লিলি ববির কোঁমড় জড়িয়ে চোখ জোড়া বুজে ঘুমসিক্ত স্বরে বলল,,

“হুম ববি। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে আমার।”

ক্ষীণ হেসে ববি ডান হাত দিয়ে লিলির চুলগুলো হালকা ঝাঁকিয়ে টাওয়ালটা টেবিলের উপর রেখে হুট করে লিলিকে পাজা কোলে তুলে নিলো। বিছানায় লিলিকে লম্বা করে শুইয়ে দিয়ে ববি লিলির পাশে শুয়ে লিলির চুলে বিলি কেটে জিগ্যাসু স্বরে বলল,,

“আপু খুব কাজ করাচ্ছে তোমাকে দিয়ে তাই না?”

লিলি ঢুলুঢুলু স্বরে বলল,,

“কই না তো!”

লিলির কপালে দীর্ঘ একটা চুমো এঁকে ববি লিলির কানে মিনমিন স্বরে বলল,,

“আমি জানি। কিছু বলে বুঝাতে হবে না আমাকে।”

লিলির পাশ থেকে উঠে ববি ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে তেলের কৌটোটা হাতে নিয়ে লিলির পাশে বসল। লিলিকে জোর করে শোয়া থেকে উঠিয়ে ববি লিলির পিঠের দিকটায় বসে রুক্ষ চুল গুলোর দিকে তাকিয়ে নাক ছিটকে বলল,,

“কি অবস্থা করেছ চুল গুলোর? নিয়মিত তেল লাগাতে পারো না? একটু তো যত্নশীল হতে পারো নিজের প্রতি নাকি?”

লিলি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে গলা জড়ানো স্বরে বলল,,

“যে মেয়ে কখনো মা হতে পারবে না, সে মেয়ে আবার নিজের যত্ন নিবে? নিজের অক্ষমতা ঢাকতে চাইবে?”

ফট করে ববির রাগটা মাথায় চড়ে বসল। চোয়াল শক্ত করে ববি পেছন থেকেই লিলির থুতনী চেঁপে ধরে বলল,,

“আমাকে রাগাতে তোর খুব ভাল্লাগে তাই না? এসব বলে বার বার আমার অক্ষমতা তুই আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাস তাই না?”

লিলি অশ্রুসিক্ত চোখে আধো স্বরে বলল,,

“আপনি আমাকে খুব বোকা ভাবেন তাই না ববি? রিপোর্টে আমার অক্ষমতাই ধরা পড়েছে, আপনার না!”

“অক্ষমতা যার ই হোক। দোষ কারোই না। হয়তো সঠিক সময়ে উপর ওয়ালা আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকাবেন। আই হাম্বেল রিকুয়েস্ট ইউ লিলি, এসব অপশনাল বিষয় গুলো নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের পড়াশোনায় কনসেন্ট্রেট দাও। আর মাএ ১৫ দিন বাকি আছে ফাইনাল এক্সামের। দুর্দান্ত একটা রেজাল্ট চাইছি আমি। প্রত্যাশা আছে, হয়তো এবার ও তুমি ফার্স্ট ক্লাস পাবে।”

লিলি হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে হেচকি তুলে কেঁদে বলল,,

“এই মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে আমি কিভাবে এক্সামের প্রিপারেশন নিবো ববি? কিভাবে দুর্দান্ত একটা রেজাল্ট করব? আমার যে শরীর, মন কোনোটাই কুলুচ্ছে না। নিজেকে “বাজা” মনে হচ্ছে।”

ববি ক্ষীপ্ত হয়ে বসা থেকে উঠে ড্রেসিং টেবিলের সমস্ত প্রোডাক্ট এলোমেলো করে, ছোট ডেস্কটাকে লাথ মেরে ফ্লোরে ছিটকে ফেলে উচ্চ স্বরে চেঁচিয়ে বলল,,

“তুই “বাজা” বলে শুধু নিজেকেই অপমান করিস না, আমাকে ও করিস। আমাকে ও হার্ট করিস, কষ্ট দিস। তোর সন্তান লাগবে না? ওকে ফাইন, আমি তোকে সন্তান এনে দেবো। “এডপ্ট” নিবো আমি সন্তান। তোর সন্তানের শখ আমি আজীবনের জন্য মিটিয়ে দিবো। আই টোল্ড ইউ, তোর মা হওয়ার শখ আমি মিটিয়ে দিবো।”

লিলি হাঁটু থেকে মুখ তুলে কম্পিত চোখে ববির দিকে তাকালো। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ববি দু দুটো সিগারেট সমানে ফুঁকতে আরম্ভ করল। রাগে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে তার শুভ্র মুখ। গোঙ্গানির আওয়াজ গলা থেকে বের হয়ে আসছে। সামনের চুল গুলো পারছে না সে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। লিলি শুকনো ঢোক গিলে কম্পিত স্বরে ববির দিকে তাকিয়ে বলল,,

“শাশান্ত হোন ববববি প্লিজ। আপনাকে এই রূপে দেখতে আমার ভীষণ ভয় করছে।”

সিগারেট দুটো হাত থেকে ফেলে ছুড়ে ফেলে ববি লিলির দিকে তেড়ে এসে লিলির থুতনী চেঁপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,,

“নাটক করছিস তুই? নাটক? যদি তুই সত্যিই আমার রাগকে ভয় পেতিস, আমাকে ভয় পেতিস তাহলে আমার অপছন্দের কথা গুলো দুবার আমার সামনে বলতে ভয় পেতিস। কলিজা কাঁপত তোর, কলিজা!”

লিলি চোখ বুজে অকাতরে চোখের জল ফেলছে। তাৎক্ষণিক ববি শান্ত হয়ে লিলির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে কান্নাসিক্ত স্বরে বলল,,

“প্লিজ স্টপ ক্রাইং। তোমার সাথে রুড বিহেভ করতে আমারো ভীষণ খারাপ লাগে। বার বার তুমিই আমার সহ্যের সমস্ত লিমিট ক্রস করে যাচ্ছ। কতো বার বলেছি, “বাজা” শব্দটা উচ্চারণ করবে না আমার সামনে। এরপরে ও তুমি একই কথা বারংবার আমার সামনে রিপিট করো। আমার কোনো কথাই কানে নিতে চাও না। তুমি হয়তো বুঝতে পারো না লিলি, তোমার ঐ হৃদয় ভাঙ্গা কথাটা আমার হৃদয়টাকে কতোটা পোঁড়ায়!”

লিলি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। ববির থেকে ঠোঁট জোড়া ছাড়িয়ে লিলি বিছানায় অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। ঢুকড়ে কেঁদে সে বালিশটাকে সিক্ত করে তুলছে। কতো রাত যে সে সিক্ত বালিশে বুকে জমানো কষ্ট গুলো বিলিয়ে দিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। লিলিকে শক্ত করে ঝাপটে ধরে ববি সাপের মতো লিলিকে পেঁচিয়ে নিলো। লিলির ঘাঁড়ে মুখ ডুবিয়ে সে কান্নাজড়িত স্বরে ফিসিফিসিয়ে বলল,,

“বেবি আমাদের ও হবে লিলি। খুব শীঘ্রই হবে। যখন আমরা একটা বেবি দত্তক নিবো না? তখন দেখবে ২/৩ বছরের মাথায় এসে তোমার গর্ভে ও আমার সন্তান আসবে। আল্লাহ্ ঠিক আমার মানদ পূরণ করবেন। আমাদের নিরাশ করবেন না। তোমার নামায, রোযা, দান কখনো বিফলে যাবে না লিলি। কখনো না!”

লিলি কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। এরপরে ও নিজেকে খানিক সামলিয়ে লিলি ববির পাশ ফিরে ববির অশ্রুসিক্ত দুচোখে তাকিয়ে বলল,,

“আম্মু, আপু রাজি হবেন তো? সন্তান দত্তক নিতে উনারা বাঁধা দিবেন না তো?”

লিলির চোখে, মুখে অজস্র চুমো খেয়ে ববি লিলিকে বুকের পাজরের সাথে মিশিয়ে বলল,,

“সেই দায়িত্ব আমার ওকে? আমি সব বুঝে নিবো। তুমি শুধু হিম্মত রাখো। পড়াশোনায় ফোকাস করো। ভালো একটা রেজাল্ট উপহার দাও আমায়। তোমাকে নিয়ে অনেক আশা, ভরসা আমার। অফিসের কলিগদের কতো বড় মুখ করে বলি জানো? আমার ওয়াইফ একদিন আমার সিটটা দখল করে বসবে, হয়তো আমার চেয়ে ও বড় কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারে বসবে, তার কথায় কর্মচারীরা উঠবে এবং বসবে। ঐ দিন আমার খুব অহং হবে লিলি। না চাইতে ও চোখ থেকে আনন্দ অশ্রু বাহিত হবে। তোমার জয়েই আমার জয় লিলি। তোমার সফলতার পেছনে সব’চে বড় একটা অংশ জুড়ে আমি থাকতে চাই। হয়তো, তোমার স্বপ্ন পূরণের সাথে কোথাও না কোথাও আমি ও অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে পড়েছি লিলি।”

কান্না ভুলে লিলি ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলল,,

“ছাড়ুন আমায়। পড়তে হবে৷ কতো পড়া বাকি আছে আমার। আমি জানি, আমার স্বপ্ন গুলো এখন আপনার ও স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনার বড় মুখকে কিভাবে অত্যধিক বড় করা যায় সেই চিন্তা হরদম আমার মাথায় থাকবে ববি। আমার ভবিষ্যত সফলতার পেছনে আপনার ভূমিকা থাকবে সব’চে বেশি। আমার সফলতার হকদার একমাএ আপনি হবেন ববি।”

ববিকে ছেড়ে লিলি চোখে, মুখে পানি ছিটিয়ে মনযোগের সহিত পড়ার টেবিলে বসে পড়ল। ববি মৃদ্যু হেসে নিষ্পলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ লিলির দিকে চেয়ে থেকে গাঁয়ে একটা ব্লু শার্ট জড়িয়ে সাহেরা খাতুনের রুমের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

রাত ১১ টা।
সাহেরা খাতুন এবং হেমা সোফার এক পাশে ভীষণ রাগান্বিত ভাব নিয়ে বসে আছে। তাদের সামনের সোফাটায় ববি কৌতুহলী চোখে ভ্রু কুঁচকে সাহেরা খাতুন এবং হেমার দিকে তাকিয়ে আছে। ১০ মিনিটের ব্যবধানে মৌণতা ভেঙ্গে সাহেরা খাতুন কর্কশ স্বরে ববিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“তোর এই মাসের স্যালারির টাকা কোথায়?”

ববি কপাল কুঁচকে বলল,,

“মাসের আজ মাএ ১ তারিখ৷ তোমার নিশ্চয়ই জানা আছে ৫ তারিখে আমার একাউন্টে টাকা ঢুকে।”

“শ্বশুড় বাড়িতে এই পর্যন্ত কতো টাকা সাপ্লাই করেছিস? মান্থলি নিশ্চয়ই ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা শ্বশুড়ের একাউন্টে ট্রান্সফার হয়?”

ববি চোয়াল শক্ত করে বলল,,

“মান্থলি আমার ইনকাম ই আছে ৪০ হাজার। তোমার কথা মতে, আমি পুরো স্যালারির টাকাটাই শ্বশুড়ের একাউন্টে ট্রান্সফার করি? তার’চে বড় কথা হলো আমার শ্বশুড়ের তো কোনো একাউন্ট নাম্বারই নেই। তাহলে এতো টাকার লেনদেন হবে কিভাবে?”

“কেনো? বিকাশ নাম্বার তো আছেই। ভাগ ভাগ করে পাঠাতেই পারিস।”

“তোমার কানে এসব আজগুবি কথা আপুই ঢুকাচ্ছে তাই না? আপুর প্ররোচনায় পড়েই তুমি তোমার ছেলেকে সন্দেহ করছ? আমার শ্বশুড়কে নিচে নামাচ্ছ?”

হেমা বাঘিনীর মতো গর্জে উঠে বলল,,

“শাট আপ ববি৷ জাস্ট শাট আপ। শ্বশুড় এবং বউয়ের এতোটাই ভক্ত হয়ে গেছিস যে, নিজের আপন বোনের উপর আঙ্গুল তুলতে দ্বিধা বোধ করছিস না? নিজের মায়ের উপর আঙ্গুল তুলতে ও দুবার ভাবছিস না?”

ববি ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু বলার পূর্বেই সাহেরা খাতুন প্রখর রেগে বললেন,,

“আমাকে তুই কি ভেবেছিস ববি? খুব বোকা আমি না? খুব সহজেই আমাকে বোকা বানানো যায়? শ্বশুড় বাড়িতে মাসে মাসে এতো গুলো টাকা ট্রান্সফার করবি আর আমি মা হয়ে টের পাবো না? আমার কানে নিউজ গুলো আসবে না? হেমা আমাকে সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিবে? আমি নিজে থেকে কিছু বুঝতে পারব না?’

ববি উত্তেজিত হয়ে উচ্চ স্বরে বলল,,

“ওকে ফাইন, প্রমাণ দেখাও৷ প্রমাণ ছাড়া নিশ্চয়ই তোমরা আমার দিকে আঙ্গুল তুলছ না। ইমিডিয়েট আমার প্রমাণ চাই। তোমরা বাধ্য আমাকে প্রমাণ দিতে।”

সাহেরা খাতুন চোয়াল শক্ত করে বললেন,,

“যখন তুই তোর গ্রাম্য বউকে বিয়ে করে প্রথম এই বাড়িতে এনেছিলি, তখন তুই কি বলেছিলি? তোর শ্বশুড়ের দুটো রুম বিশিষ্ট একটা বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। জায়গা, জমি ও তেমন নেই। তাহলে তোর চাকরী পাওয়ার ১ বছরের মধ্যেই রাতারাতি কিভাবে তোর শ্বশুড় বাড়িতে নতুন করে মার্বেল টাইলসহ তিন তিনটে রুম উঠল? হঠাৎ করেই এতো জায়গা, সম্পত্তির উদ্ভব হলো কিভাবে? তারা এতো সচ্ছল ই বা হয়ে উঠল কিভাবে?”

ববি মাথা ঠান্ডা করে শান্ত স্বরে বলল,,

“দেখো আম্মু, আমি অস্বীকার করছি না যে একবার আমি খুব জোরাজুরি করে শ্বশুড় আব্বুর হাতে ৩০ হাজার টাকার মতো তুলে দিয়েছিলাম। এরপর থেকে বিগত ২ বছর যাবত আমি আর একটা টাকা ও উনার হাতে দেই নি। জায়গা জমি বিক্রি করে উনি বাড়ির কাজ ধরেছিলেন এবং নতুন ব্যবসার জন্য কিছু টাকা উদ্বুত্ত রেখছিলেন। সেই টাকা দিয়েই উনি ব্যবসাটাকে দাঁড় করিয়ে নিজের অবস্থার পরিবর্তন করছেন, এতোটা সচ্ছল হয়ে উঠেছেন। এছাড়া আমার কোনো ভূমিকা নেই। উনি অনেকবার বলেছিলেন অবশ্য, টাকাটা আমাকে ফেরত দিতে, কিন্তু আমিই ইচ্ছে করে নেই নি। খারাপ লাগছিলো আমার। উপকার করে সেই উপকারের মূল্য আমি শোধ করতে চাই নি আসলে।”

হেমা অট্ট হেসে বলল,,

“বাঃহ্। সত্যি কথাটা তাহলে এবার পেট থেকে বের হয়েই এলো। যে জিজু বছরের পর বছর তোর পড়ালেখার খরচ চালিয়ে গেছে, ভরণ পোষনের ভার নিযেছে, তোদের এতো যত্ন নিয়েছে, কই এই পর্যন্ত একবার ও তো সেই জিজুর উপকারের একটা ঢেকুর ও দিলি না। বোনের জন্য, জিজুর জন্য কিছুই ভাবলি না, ভাবার প্রয়োজন ও মনে করলি না! চাকরী পেয়েই প্রথমে শ্বশুড় বাড়িতে মোটা অঙ্কের টাকাটা ঢেলে দিলি। শ্বশুড়কে সচ্ছল হতে সাহায্য করলি। আবার বলছিস, উপকার করে উপকারের মূল্য ও নাকি শোধ করতে পারবি না!”

ববি ম্লান হেসে বলল,,

“চিন্তা করো না আপু। আমি যে ফ্ল্যাটটা কিনেছি তার পুরো দুতলাটা আমি তোমার নামেই লিখে দিয়েছি। জিজুর উপকার শোধ করতে একদমই না, ধরে নিতে পারো বোনের সুখের জন্য ছোট ভাইয়ের তরফ থেকে ক্ষুদ্র একটা উপহার। সত্যি কথা বলতে, লিলিই আমাকে আইডিয়টা দিয়েছিলো। ভেবেছিলাম তোমাদের বিবাহ বার্ষিকীতে দুই জনই তোমাদের এই সারপ্রাইজটা দিবো, তবে এর আগেই তুমি আমার মুখ থেকে কথাটা আদায় করে নিলে!

হেমা হতভম্ব হয়ে ববির দিকে তাকিয়ে আছে। ববি অশ্রুসিক্ত চোখে সাহেরা খাতুনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“ভাবতে পারি নি আম্মু৷ ভেতরে ভেতরে তুমি তোমার ছেলেকে নিয়ে এতো খারাপ চিন্তা ভেবে রেখেছ? এতো রাগ পুষে রেখেছ? আর অভিযোগের কথা না হয় বাদই দিলাম। ভীষণ আঘাত পেয়েছি আমি আম্মু, ভীষণ। ভাষায় প্রকাশ করে বুঝাতে পারব না। আসলে, কখনো ভাবতে পারি নি, অন্তত তুমি আমার বিরুদ্ধে এসে দাঁড়াবে।”

সাহেরা খাতুন প্রসঙ্গ পাল্টে তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,,

“কেঁদে কেটে আমাকে ভুলে পারবি না তুই। কথা তো কিছু ভুল বলি নি আমি। তুই তো সত্যিই শ্বশুড় বাড়িতে টাকা পাঠিয়েছিলি, গুনে গুনে ৩০ হাজার টাকা৷ শ্বশুড় বাড়িতে টাকা ও দিবি আবার এইদিকে বউয়ের পড়ালেখার খরচ ও চালাবি? এতোই কোটিপতি হয়ে গেছিস তুই? আমি তোকে অর্ডার করছি ববি, ঐ “বাজা” মেয়ের লেখাপড়ার সাবজেক্টটা তুই এখানেই বন্ধ কর। অনেক হয়েছে আর না। বিয়ের ছয় বছরে ও যে মেয়ে আমাকে নাতি নাতনীর মুখ দেখাতে পারল না, তাকে নিয়ে এতো মাতামাতির কোনো প্রয়োজনই নেই।”

ববি বসা থেকে উঠে সামনে থাকা টি টেবিলটা ফ্লোরে ছিটকে ফেলে চোয়াল শক্ত করে চেঁচিয়ে বলল,,

“খবরদার আম্মু৷ আর একবার ও যেনো তোমার মুখ থেকে আমি “বাজা” শব্দটা না শুনি। আমার লিলিকে নিয়ে কোনো রূপ অপমানজনক কথা আমি সহ্য করব না কিন্তু। আমার ওয়াইফের কোনো দোষ থাকলে সেটা আমি বুঝে নিবো। কিভাবে কি করা যায় সেই পথটা ও আমি নিজেই খুঁজে বের করব। যতোক্ষণ পর্যন্ত না লিলি তার লক্ষ্যে পৌঁছোচ্ছে, ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত সে লেখাপড়ায় বহাল থাকবে। আমি তার সমস্ত খরচের ভার বহন করব। স্বামী হয়েছি কেনো? যদি স্ত্রীর দোষ, ত্রুটিগুলো সাথে নিয়ে তার ইচ্ছে গুলোকে প্রাধান্য না দিয়ে কেবল তার থেকেই নিজের একান্ত চাহিদা গুলো এক্সেপ্ট করব? পরিবারের মন রাখতে কেবল তাকেই কেনো শারীরিক এবং মানসিক ভাবে প্রেশার ক্রিয়েট করব? তার ও তো একটা জীবন আছে তাই না? সেই জীবনে আমাদের মতো তার ও কিছু স্পেচেফিক শখ, আহ্লাদ আছে, ভালো লাগা, খারাপ লাগা আছে, বিভিন্ন চাহিদা ও আছে। কেনো আমরা প্রতিবারই নিজের চাহিদা গুলোকে বড় করে দেখব? কেনো তার দোষ, ত্রুটি গুলোকে বড় করে দেখব? একটা মেয়ে তো স্বভাবই চায়, “মা হতে।” একটা ফুটফুটে সন্তানের জন্ম দিতে। আমি আর লিলি ও চেয়েছিলাম। বরং আমার চে লিলি বেশি চেয়েছিলো। তোমার কথা রাখার জন্য মেয়েটা মন থেকে মা হতে চেয়েছিলো। তবে উভয় পক্ষের কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে দীর্ঘ দু বছরে ও কোনো ইতিবাচক ফল আসছে না। এই ক্ষেএে তো দোষ আমার ও থাকতে পারে তাই না? আমারো অক্ষমতা থাকতে পারে! তবে কেনো শুধু লিলির দোষটাই এখানে বড় করে দেখা হচ্ছে? কেনো আমার দোষটা তোমাদের চোখে পড়ছে না? কেনো আমার ওয়াইফকে “বাজা” বলা হচ্ছে? কেনো প্রতিবার তাকেই অপমান, অপদস্ত হতে হচ্ছে?”

ববি মেজাজ শিথিল করে সাহেরা খাতুনের অশ্রুসিক্ত দুচোখে তাকিয়ে পুনরায় বলল,,

“তোমার নাতি-নাতনী চাই তাই না? এর জন্যই তো তুমি লিলি এবং আমার সাথে রুড বিহেভ করছ? ওকে ফাইন! এই এক মাসের মধ্যেই আমি একটা সন্তান দত্তক নিবো। নিজের রক্তের সন্তান না হলে ও নিজের সন্তানের মতোই তাকে মানুষ করব। যদি আল্লাহ্ র হুকুম হয়ে থাকে তাহলে হয়তো এর দেখাদেখি লিলির গর্ভে ও আমার নিজের সন্তান আসতে পারে। ঐদিন হয়তো শান্ত হবে তুমি। শুধু তুমি না আমার আপু ও শান্ত হবে।”

হুড়মুড়িয়ে ববি রুম থেকে প্রস্থান নিলো। দরজা খুলে জিনিয়া আহমেদকে মুখোমুখি দেখে ববি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল। জিনিয়া আহমেদ ববির কাঁধে হাত রেখে হাসি মাখা স্বরে বললেন,,

“নিরাশ হযো না ববি। উপর ওয়ালা ঠিক তোমাদের মনস্কামনা পূরণ করবেন। ধৈর্য্য ধরে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করো। যতো দ্রুত সম্ভব একটা বাচ্চা দত্তক নাও। দেখবে বাচ্চাটাকে পেয়ে সাহেরার সমস্ত রাগ, জেদ শিথিল হয়ে গেছে।”

ববি মৃদ্যু হাসল। জিনিয়া আহমেদ ম্লান হেসে প্রস্থান নিলেন। বেড রুমে প্রবেশ করে ববি লিলির চেযারের ঠিক পেছনটায় দাঁড়ালো। লিলি খুব মনযোগ দিয়ে একাউন্টিং ম্যাথ করছে। রুমে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি সে এখনো অব্দি টের পায় নি। লিলির দিকে একটু ঝুঁকে ববি লিলির মাথায় দীর্ঘ একটা চুমো খেয়ে ছোট স্বরে বলল,,

“কি করছে আমার বৌ টা?”

লিলি ব্যস্ত স্বরে বলল,,

“একাউন্টিং ম্যাথ।”

ববি সরে দাঁড়ালো। তেলের কৌটো টা পুনরায় হাতে নিয়ে ববি লিলির চুলে বিলি কেটে তেল মাখিয়ে দিচ্ছে মাথায়। লিলি মৃদ্যু হেসে পেছন ফিরে ববির দিকে তাকিয়ে বলল,,

“মাথাটা খুব ধরেছিলো জানেন? মনে হচ্ছিলো একটু তেল মাখলে হয়তো ভালো লাগত। না বলতেই আপনি বুঝে নিলেন। এতো এতো ভালোবাসা আপনার জন্য ববি!”

ববি বাঁকা হেসে বলল,,

“মুখে মুখে ভালোবাসা আমার চাই না ওকে? আমি তো অন্য রকম ভালোবাসা চাই!”

লিলি লজ্জা রাঙ্গা হয়ে বলল,,

“পাবেন! আজ থেকে তো আমি সুস্থই!”

ঘোর লাগা চোখে ববি লিলির দিকে চেয়ে বলল,,

“তাহলে বিছানা গুছিয়ে নেই?”

“উহু, ১২ টার পর!”

মৌণ হেসে ববি লিলির পাশ থেকে সরে এসে ল্যাপটপে নিজের কাজে মনযোগ দিলো। ইতোমধ্যেই ববিদের বেড রুমের ভেজানো দরজাটা ঠেলে হেমা মাথা নিচু করে রুমে প্রবেশ করল। ববি এবং লিলি চোখ তুলে হেমার দিকে তাকালো। শুকনো মুখে হেমা লিলির দিকে দৃষ্টি ফিরেয়ে করুন স্বরে বলল,,

“স্যরি লিলি!”

#চলবে….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here