পূর্ণিমা সন্ধ্যায়
পর্ব-১৯
“ওর নাম জানতে চান?”
রক্তিমের এই কথায় ড্রইংরুমে উপস্থিত সবার নজর গেলো ওর দিকে। পীযূষ বাবু ভয়ার্ত চোখে রক্তিমের দিকে তাকলেন।উনি ভাবছেন রক্তিম আজকে কিভাবে এলো!ওর তো পরশুদিন আসার কথা ছিলো।
“কি হলো,ওর নাম কি শুনবেন না?আমার শ্রদ্ধেয় পিতা মনে হয় আপনাদের ওর নামটাই বলেনি।”
এই বলে রক্তিম ওর বাবার দিকে তাকালো।ওর চোখগুলো হয়ে আছে ভয়ংকর।
“তোমাকে তো বাবা ঠিক চিনতে পারলাম না?” রক্তিমকে জিজ্ঞেস করে একজন।
“আমায় তো চিনবেন।তার আগে ওকে চিনে নেন।ওর নাম হলো মিসেস.শক্তি রক্তিম সেনগুপ্ত। সি ইস মাই ওয়াইফ!ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড!!! ” চিল্লিয়ে বলে রক্তিম।
রক্তিমের চিৎকারে যেনো পুরো বাড়ি কেপে উঠলো।সবাই একে অপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো।
শক্তির এতোক্ষণ আটকে রাখা চোখের জলগুলো এবার যেনো নদীর স্রোতের মতো বইতে লাগলো।শক্তির ইচ্ছে করছে এক্ষুনি গিয়ে রক্তিমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে।
রক্তিম গটগটিয়ে হেটে শক্তির সামনে এসে দাঁড়ায়। দু’হাত দিয়ে শক্তিকে বসা অবস্থা থেকে দাঁড় করিয়ে দেয়। ।শক্তি এখনো অনবরত চোখের জল ফেলেই যাচ্ছে। রক্তিম তার সাথে কি করবে এসব ভেবে ভয়ে তার হাত-পা পেটের ভিতর সিধিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে রক্তিম তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল,
“হুঁশশ, ডোন্ট ক্রাই।আমি জানি তুই কিছু করিসনি।”
রক্তিমের কথায় শক্তির কান্নার বেগ আরও বেড়ে যায়।রক্তিম ওকে এক হাত দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে নিয়ে আরেক হাত দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
আর এদিকে একবাড়ি মানুষ ওদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। নিরবতা ভেঙে পাত্রের বাবা বলে,
“এ কি ধরণের তামাশা,পীযূষ বাবু?আপনি একটা বিবাহিত মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন আমার ছেলের জন্য? আর এসব কি অসভ্যতা হচ্ছে এখানে? ”
রক্তিমের এই কান্ড দেখে পীযূষ বাবুর লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। কোনো মতে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“ওকে ছাড়ো,রক্তিম। এগুলো কোন ধরণের অসভ্যতা? আর শক্তি তোমার বউ মানে,কবে বিয়ে হলো তোমার সাথে ওর?”
রক্তিম এবার শক্তিকে ছেড়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। তবে হাত ছাড়ে না।খুবই স্বাভাবিকভাবে বলে,
“ও,,বিয়ে হয়নি বুঝি!তবে সমস্যা নেই,এখন বিয়ে হবে।”
এই বলে শক্তিকে টানতে টানতে ঠাকুরঘরের দিকে নিয়ে যেতে থাকে।আর পেছন থেকে পীযূষ বাবুর হুংকার শোনা যায়,
“দাঁড়াও রক্তিম! কোথায় নিয়ে যাচ্ছো ওকে?”
কিন্তু রক্তিম তো আর কারো কথা শোনার বান্দা নয়।কোনো কথায় পাত্তা না দিয়ে সোজা ঠাকুরঘরে গিয়ে ঢুকলো।
পীযূষ বাবু তার স্ত্রীকে বলছেন,
“দেখেছো,তোমার আশকারা পেয়ে ও দিন কে দিন কেমন হয়েছে? ”
তবে জয়ার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, রক্তিমের এই কান্ডে অবাক হওয়া তো দূরে থাক!তিনি বরঞ্চ খুশিই হয়েছেন।
শক্তি তো ভয়ে শেষ। এবার কি হবে তার সাথে! রক্তিমের মতিগতি তার কাছে সুবিধের ঠেকছে না।
রক্তিম ওর হাত ছেড়ে সোজা ঢুকে যায় ঠাকুরঘরে। একটু পর বেরিয়ে আসে লক্ষীর আসনের সিঁদুর কৌটো হাতে নিয়ে।
কৌটো টা হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পীযূষ বাবুর দিকে তাকিয়ে বলে,
“তো কি যেনো বলছিলে,বউ হলো কেমন করে???এই যে এমন করে।”
বলেই কৌটো থেকে তর্জনী দিয়ে সিঁদুর নিয়ে শক্তির সিঁথিতে ভরে দেয়।
শক্তি বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের দিকে। আপনাআপনি তার হাত চলে যায় তার সিঁথিতে।তার মস্তিষ্ক এখনো ঠিকঠাক ভাবে কপি করতে পারছে না যে,আসলে তার সাথে হয়েছে টা কি!!!
“এমা,,,দাভাই তো শক্তি দিকে বিয়ে করে নিলো!!”
রুশার কথায় ওর দিকে ফিরে তাকায় শক্তি। আসলেই কি তার বিয়ে হয়ে গেলো!!!
“এসব কিধরনের অসভ্যতা রক্তিম?তোমার সাহস দেখে তো আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি ।” বললেন পীযূষ বাবু।
“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও যে,আমি এই পর্যন্ত এসেও চুপ আছি।আর এইতো দেখলে বিয়ে হয়ে গেলো।এখন মানে মানে এদের বিদায় করো।নয়তো আরও কি কি হতে পারে তা তুমি ভাবতেও পারো না।”
তার বাবার চোখে চোখ রেখে খুব শান্ত ভঙ্গিতে কথাগুলো বললো রক্তিম।
“তা বাড়িতেই পাত্র রেখে, আমাদের ডেকে এনে অপমান করার কি ছিলো পীযুষ বাবু? আপনাকে তো সজ্জন ব্যক্তি বলেই জানতাম।চলে আয় সবাই,এখানে দাঁড়িয়ে থেকে ওনাদের ফ্যামিলি ড্রামা দেখতে হবে না আর।”
এই বলে পাত্রপক্ষ হনহনিয়ে বেরিয়ে চলে গেলো।
“ছিঃ,,আজ একমাত্র তোমার জন্য এতোটা অপমানিত হতে হলো আমায় রক্তিম। কেনো তুমি মেয়েটার জীবনটা নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছো?সিঁদুর পরালেই কেউ বউ হয় না।আমি মানি না এই বিয়ে।”
এই বলে পীযূষ বাবু শক্তির সিঁথির সিঁদুর মোছার জন্য ওর দিকে এগিয়ে গেলেন।
শক্তি ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। এটা কি করছেন উনি!!!শক্তি ওনাকে বাঁধা দেয়ার আগেই পেছন থেকে বাঁধা অনুভব করেন। পেছনে তাকিয়ে দেখেন জয়া ওনার হাত আটকে আছে।জয়া চোখ মুখে স্পষ্ট রাগের অভিব্যক্তি নিয়ে বলেন,
“সারাদিন যে এতো চেচাও আমার ছেলে ওর জীবন নষ্ট করছে,একবারও শক্তিকে জিজ্ঞেস করে দেখেছো ও কি চায়?কথা নেই, বার্তা নেই কোথা থেকে এক পাত্রপক্ষ ধরে নিয়ে আসলে যে ওর বিয়ে দেবে।সব মাত্র সেকেন্ড ইয়ারে উঠলো ও।একবারও জিজ্ঞেস করেছিলে ওর বিয়েতে মত আছে কিনা?নাহ্,তোমার তো ওকে রক্তিমের থেকে দূরে করতে হবে।এটাই তোমার লক্ষ্য। ”
কথাগুলো একদমে বলে হাঁপাতে থাকে জয়া।
পীযুষ বাবুর কপালেও দেখা যায় সূক্ষ্ম চিন্তার ছাপ।
আসলেই তো, তিনি তো একবারও শক্তির মতামত জানতে চাননি।
পীযূষ বাবু একবার তাকালেন শক্তির দিকে।মেয়েটা রক্তিমের হাত জড়িয়ে ধরে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ।এখন উনার নিজেরই খুব আফসোস হচ্ছে। তিনি শক্তিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোর বিয়েতে অমত তা জানালি না কেনো, মা?”
পাশ থেকে রক্তিমের কাঠখোট্টা আওয়াজ,
“জানানোর সুযোগ দিয়েছো ওকে,যে জানাবে?”
“তুমি কোনো কথা বলো না রক্তিম। তুই বল,মা,তুই কি বিয়েতে রাজি ছিলিনা?”
শক্তি কি বলবে এবার। ভয়ে ভয়ে একবার জয়ার দিকে তাকায়। জয়া তাকে চোখ দিয়ে আস্বস্ত করে।
শক্তি হালকা করে মাথা নেড়ে বোঝায় যে,সে রাজি ছিলো না।
পীযূষ বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“তুই আমার ঘরে আয় একটু।আর আমি কিন্তু শুধু শক্তিকে ডেকেছি,তাই শুধু ও একাই আসবে।অন্যকেউ যেনো সাথে না আসে। ”
এই বলে উপরে নিজের রুমে চলে গেলেন তিনি।
(চলবে)