পূর্ণিমা সন্ধ্যায়,পর্ব-১২,১৩

পূর্ণিমা সন্ধ্যায়,পর্ব-১২,১৩
Tithee sarker
পর্ব-১২

অর্কের কথা শুনে আর ছাঁদে দাঁড়ায় নি শক্তি। এক ছুট্টে নিজের ঘরে চলে আসে।ঘরে এসে দেখে মুন্নি ওর দিকে চোখ পাকিয়ে আছে।

“কিরে,নবাবজাদী, নিচে গেলিনা কেনো?সেই যে উপরে এসেছিলি আর নিচে যাওয়ার নামই নাই।”

শক্তি ফুস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলে,

“কি করবো বল?যেতে মানা।”

“কোন শাহেন শাহ আসছেন রে,যে তার কথায় চলা লাগবো?তুই দাভাই রে এতো ডরাস কেন রে ভাই?”

“তোর দাভাইয়ের সামনে বলিস এসব।”

” হ্যা,আমায় তো পাগলা কুত্তায় কামড়াইসে তাই না?”

মুন্নির কথা শুনে শক্তি কিটকিটিয়ে হেসে দেয়।সত্যিই পুরো বাড়ির লোক রক্তিমকে দেখে ভয় পায়।আসলে সবাইকে ভয় পাইয়ে রাখার জন্যও ক্ষমতা লাগে।এই ক্ষমতা সবার থাকেনা।

সন্ধ্যার দিকে রিদ্ধির আশীর্বাদ হয়।তখন নিচে আসে শক্তি। রিদ্ধির শশুড়বাড়ি থেকে বেশি নয় মাত্র সাত জন মানুষ এসেছে।অর্কের মা বাবা, পিসি,মামা,মামি,কাকি আর অর্ক।অনেক সময় তো মেয়ে দেখতে একসাথে আঠেরো উনিশ জন মানুষ আসে।

যখন আশীর্বাদ হচ্ছিল তখন কি সুন্দরই না দেখা যাচ্ছিলো রিদ্ধিকে। মুখে লজ্জা আর খুশির মিশ্রিত অনুভূতি।

আসলে প্রায় দু’বছরের সম্পর্ক ছিলো অর্ক আর রিদ্ধির। রিদ্ধি যে ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করছে সেই একই ভার্সিটি থেকে অর্কও বেরিয়েছে। তাদের সম্পর্কে পুরোটাই জানতো রক্তিম। রিসেন্টলি অর্কের চাকরি হওয়ার সুবাদে ওর পরিবার থেকে বিয়ের চাপ দিচ্ছিলো।কিন্তু রিদ্ধি ভয়ে তার বাবাকে কিছু বলতে পারছিলো না।যদিও রক্তিম অনেক বার বলতে চেয়েছে।রিদ্ধির একটাই কথা,বাবা তাকে ভুল বুঝবে।হয়তো তার উপর আর বিশ্বাসই করবে না।

তাই পরে রক্তিম তাদের এলাকার ঘটককে টাকা খাইয়ে অর্কের সাথে রিদ্ধির বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়।এই বিষয়ে তারা তিনজন ছাড়া আর কেউই কিছু জানে না।রক্তিমের কাছ থেকে এসব শুনে তো শক্তি বেক্কল হয়ে যায়।শুধু একটা কথাই বের হয় মুখ দিয়ে, “কি বুদ্ধি রে বাবা!!”

এরই মাঝে একজন মহিলা হয়তো অর্কের কাকি বা পিসি কিছু একটা হবে এসে শক্তির পাশে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে গল্প জমাতে থাকে।একটু পর জয়াকে বলে,

“তা,দিদি এটি বুঝি আপনার মেজো মেয়ে? বেশ দেখতে কিন্তু। ”

ঠিক এই কারণেই রক্তিম কারো সামনে বেশি আসতে দেয়না শক্তিকে।কোনদিক থেকে কখন, কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দেয় শক্তির জন্য।যেই ওকে দেখে তারই পছন্দ হয়ে যায়।রক্তিমের কি জ্বালা!

রিদ্ধির বিয়ের দিন ঠিক হয় সামনের মাসের ত্রিশ তারিখ।মানে আর মাত্র এক মাস।এরই মাঝে করতে হবে অনেক আয়োজন। অর্কের পরিবার ওদের সবাইকে নিমন্ত্রণ দিয়ে যায় কিছু দিন পর গিয়ে অর্ককে আশীর্বাদ করতে আসতে।

তারা সবাই গেলো সন্ধ্যার পর।কারণ তাদের তো আর সন্ধ্যার চা জলখাবার না খাইয়ে ছাড়া যায় না।বিকেল থেকে সন্ধ্যে পুরোটা সময় শক্তি নিচেই ছিলো।যদিও রক্তিম এটা সেটাতে চোখ পাকাচ্ছিলো।

রাত দশটার দিকে সবাই একসাথে খাবার খেতে বসলে রক্তিমের মামাতো ভাই শান্ত বলল,

“কী ব্যাপার শক্তি? এসে থেকে তো তোমাকে দেখলামই না।কাল রিদ্ধি বললো তুমি নাকি ঘুমিয়ে গেছো।আর আজ সারাদিনও তো দেখলাম না।”

শক্তি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,

“আসলে আজ শরীরটা একটু খারাপ লাগছিলো তো তাই আরকি নিচে নামি নি।”

“শরীর খারাপ লাগছিলো নাকি রক্তিম আসতে নিষেধ করেছিলো?”বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করে শান্ত।

শান্তর কথা শুনে রক্তিম কঠোর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়।রক্তিমের তাকানো দেখে ও দাঁত কেলিয়ে বলে,

” উফফ, ভয় পেয়েছি।”

এবার শক্তি বিরক্ত হয়।শান্তর এই স্বভাবটা একদমই পছন্দ নয় তার।ছোটবেলা থেকেই দেখে শান্ত শুধু রক্তিমকে ঠেস দিয়ে কথা বলে পুরাই মেয়েদের মতো।আরও কিছু স্বভাবও ওর ভালো লাগে না।

রক্তিম বুঝতে পারছে যে শান্ত এই কাজটা করছে শুধু মাত্র তার বাবার সামনে তাকে ছোট করার জন্য।

রক্তিম টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে,

“আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আয়। দুধ বেশি আর আদা দিয়ে।”

“এই রাতের বেলা আবার কিসের চা খাওয়া রক্তিম?” জিজ্ঞেস করে পীযূষ বাবু।

“যাকে বলেছি সে জানে কিসের চা খাওয়া।তোমার না জানলেও চলবে।” এই বলে রক্তিম উপরে চলে গেলো।

“শক্তি একদম চা নিয়ে যাবি না ওর জন্য।”

“বাবু,,,আমার অভ্যেশ আছে এমন রাত বিরাতে চা বানানোর। আমি নিয়ে যাচ্ছি। ”

“তার মানে তুই কি আরও এমন চা করে খাইয়েছিস নাকি? ”

“ইয়ে,,না মানে,ওই আরকি,,,,” বলে কোনোভাবে রান্নাঘরে ছুট লাগায় শক্তি।

বেশ বাঁচা বেঁচে গেছে আজ শক্তি। নইলে বাবু যদি জানতে পারতো যে তার গুণধর ছেলেকে প্রায়ই রাতে চা করে দিতে হয়।আর শক্তিও কোনো উচ্চবাচ্য না করে চুপচাপ সব করে দেয় তাহলে তো খবর হয়ে গেছিলো।

কারণ পীযূষ বাবু আগেই বলেছিলো শক্তিকে যদি রক্তিম ওর সাথে কোনো রকম খারাপ ব্যবহার করে বা কোনো বাড়তি কাজ করায় তবে যেন সাথে সাথে ওনাকে বলেন।শক্তির আর বলা!এই ক’বছরে কত কাজ করতে হয়েছে ওকে রক্তিমের আর কত চড়-চাপড় খেয়েছে তার কোনো হিসাব নেই।

আশ্চর্য হলেও সত্যি যে শক্তির কোনো সময় মনেই হয়নি যে রক্তিমের ব্যাপারে বাবুকে জানানো দরকার।বাবুকে জানালে বাবু বিচার করবে, রক্তিমকে বকা খাওয়ানো যাবে।বরং যেদিন রক্তিমকে বকা খেতে হতো সেদিন পুরো সময়টা শক্তির মন খারাপ থাকতো।কেনো যেনো রক্তিমের বকা খাওয়া বা কারো সামনে ছোট হওয়া একদম দেখতে পারতো না সে।এখন বুঝতে পারছে হয়তো এটা ভালোবাসার কারণেই।

রক্তিমের প্রতি এই সুপ্ত অনুভূতি গুলো যে ভালোবাসা ছিলো,এটা হয়তো শক্তি কোনোদিন বুঝতেও পারতো না। যদি না রক্তিম সেদিন ওর মনের কথা বলতো।এটা ভেবে নিজের অজান্তেই মুচকি হাসে শক্তি।

রক্তিমের জন্য চা নিয়ে যাওয়ার সময় আরেকবার শান্তর মুখোমুখি হয় শক্তি। ওকে দেখে দাঁত কেলিয়ে বলে শান্ত,

“তা আমার জন্যও একটু চা করতে শক্তি। নাকি সব যত্ন আাত্তি শুধু রক্তিমের জন্যই তোলা।”

ওর এই কথা শুনে শক্তি চোখ মুখ কুঁচকে পাশ কাটিয়ে চলে আসে।এর আগেও শান্ত ওর পথ আটকে দাঁড়াতো। অসহ্য একটা লোক।এর জন্যই রক্তিম শক্তিকে ওদের মামাবাড়ি যেতে দিতে চাইতো না।কিন্তু কি আর করা!ছোটবেলায় মামনীর সাথে যেতেই হতো।কারণ মামনী তো আর ওকে একা রেখে নিজের বাপের বাড়ি যাবে না।জলদি এই ছেলে রক্তিমের হাতে শক্ত মার খেতে চলেছে।এটা শক্তি ভালোই বুঝতে পারছে।রক্তিমের কানে এসব গেলে ওকে আর দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থায় রাখবে না।

শক্তি রক্তিমের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে দরজায় নক করে।পুরো ঘরে রক্তিমকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।ব্যালকনি থেকে রক্তিমের আওয়াজ পাওয়া গেলো,

“ভেতরে আয়।”

শক্তি পা টিপে টিপে রুমে প্রবেশ করে।রক্তিম মনে হয় সিগারেট ফেলে এসেছে ব্যালকনিতে।কারণ ওর মুখ থেকে সিগারেটের মৃদু গন্ধ আসছে।চায়ের কাপটা শক্তির হাত থেকে নিতে নিতে বলে রক্তিম,

“আমার রুমে নক করে আসতে হবে না বলি নি?”

শক্তি কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।রক্তিম আবার বলে,”কিছু দিন পর এটা তোরও ঘর হবে।সো কি কি চেঞ্জ করবি করে নে।”

শক্তি মিনমিন করে বলে,
“অ্যাহ,,,আসছে আমার লাট সাহেব!তার ঘরে থাকতে আমার বয়েই গেছে।সারাদিন সিগারেটের গন্ধে দূর্গন্ধ হয়ে থাকে।”

“কি বললি?জোরে বলতো শুনি।”

“ক.ক,কিছু না।কিছু না।আমি যাই খুব ঘুম পেয়েছে।” (ইচ্ছে করে হাই দিতে দিতে)।

“আজ ওই মহিলার সাথে কি কথা বলছিলি এতো।বলিনি এসব কাকি মামিদের থেকে দূরে থাকবি।নিশ্চয়ই ওনার কোনো ছেলে আছে যার জন্য তোকে বউ করে নিতে চায়।”

“হ,পাগলের মাথা নষ্ট তো।সারা দুনিয়াতে আর মেয়ে নাই যে আমারে বউ করে নিবে।আর তোমার শুধু এটাই মনে হয় না যে ওরা শুধু বাড়ির বউ করার জন্যই আমার সাথে কথা বলে!হাও সিলি!সামাজিকতা বলেও একটা কথা আছে।”

“মুখে বেশি বুলি ফুটেছে মনে হচ্ছে। আর তোকে না বলেছি আমায় আপনি করে বলবি।”

“অ্যাহ্,,তার বাপকেই আপনি বলে ডাকি না আর উনি কোত্থেকে আসছে ভিস্তের নাগ!”

এই বলে শক্তি এক দৌড়।রুমে এসে হাপাতে থাকে আর ভাবে কপাল ভালো তাই জীবন নিয়ে ফিরেছে ওই ঘর থেকে।

(চলবে)

#পূর্ণিমা সন্ধ্যায়
পর্ব-১৩

“আচ্ছা রিদ্ধি দি?তোমার টেনশন হচ্ছে না?”

শক্তির এই কথায় ওর দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকায় রিদ্ধি। দুজনেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল ঘাটছিলো।ঘাটছিলো মানে রিদ্ধি অর্কের সাথে চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত আর শক্তি রিদ্ধির বিয়েতে কিভাবে সাজবে তা নিয়ে রিসার্চে।হঠাৎ করে শক্তির মুখে এমন কথা শুনে রিদ্ধি বলে,

“টেনশন হবে কেনো?কি হয়েছে?”

শক্তি সটান বিছানায় বসে বলে,

“তোমার টেনশন হচ্ছে না!আর কিছুদিন পর তোমার বিয়ে।একটা সম্পূর্ণ অজানা অচেনা পরিবেশ যাবে তুমি।কিভাবে মানাবে ওখানে???”

রিদ্ধি মুচকি হেসে বলে,”এই ব্যাপার!এটা নিয়ে এতো হাইপার হওয়ার কি আছে?”

এবার মুন্নিও এসে বলে,”সত্যি তোমার টেনশন হচ্ছে না?এটা কি তোমার রিলেশনের বিয়ে বলেই।”

রিদ্ধি এবার বেশ নড়েচড়ে বসে।পা দুটো ভাজ করে পাশের বালিশটা কোলে নিয়ে বলে,
“আমার যে কোনোরকম টেনশন হচ্ছে না বা হয়নি এটা কিন্তু পুরোপুরি ঠিকনা।যখন প্রথম বিয়ের আলাপ শুরু হয়েছিলো তখন প্রচন্ড চিন্তা হতো।প্রথমেই এটা মনে হতো যে বাবা মেনে নেবে কিনা।তারপর যখন প্রস্তাবটা বাবার মনপুত হলো তখন মনে হতো আমি কি ওদের পরিবারে গিয়ে মানিয়ে নিতে পারবো?ওর মা কি আমায় নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসবে?”

এতটুকু বলে রিদ্ধি ওদের দিকে তাকায়।দুজনের চোখেই বেশ কৌতুহল দেখা যাচ্ছে। যেনো চোখ দিয়ে বোঝাতে চাইছে,”তারপর? ”

রিদ্ধি আবার বলা শুরু করে,”তখন আমার সবচেয়ে বড়ো সাপোর্ট ছিলো তোদের জিজু।আমি প্রায়ই ওর সাথে এই বিষয়েই কথা বলতাম।জানিস,ও কোনো সময় বিরক্ত হতো না। আমার প্রতিটা কথা মনযোগ দিয়ে শুনতো।আর আমাকে সাহস জুগিয়ে যেতো।।আমিও শুধু ওর উপর বিশ্বাস রেখেছিলাম যে আমি সব সামলাতে পারবো।আমি যদি নাও পারি,আমার সাপোর্ট হয়ে একজন আছে।যাকে আমি নিজের লাইফপার্টনার হিসেবে বেছে নিয়েছি।”

“জিজু কতো ভালো তাই না?তোমার কত্ত কেয়ার করে!” বলে শক্তি।

“শোন শক্তি তোকে আগেও বলেছি ভালো খারাপ কখনো বাইরে থেকে বিচার করা যায়না।তুই একটা মানুষের যত কাছাকাছি থাকবি ততই মানুষকে বুঝতে পারবি।যেমন ধর তোর জিজুকে তো আর আমি একদিনে বিশ্বাস করিনি।এর জন্য তাকে প্রচুর খাটতে হয়েছে।”এই বলে হেসে দেয় রিদ্ধি।

————————————————

বিশ্বাস আর ভালোবাসা দুটো কি একসাথে পাওয়া যায় না?যে অনেক ভালোবাসে সে বিশ্বাস করতে চায় না কেনো?কোথায়? অর্ক তো রিদ্ধিকে বিশ্বাস করে, রিদ্ধি ও অর্ককে বিশ্বাস করে।তবে শুধু শক্তির ক্ষেত্রেই কেনো এমন হলো?আজ পর্যন্ত কোনোদিন শক্তি রক্তিমের কথার অবাধ্য হয়নি।যা বলেছে তা মুখ বুজে মেনে নিয়েছে।বাবুর কথার বিরুদ্ধে গিয়ে শুধু তাকেই ভালোবেসেছে।তা কি শুধুমাত্র আজকের এই অপমানের জন্যই!!!

নাহ্,আর ভাবতে পারছেনা শক্তি। বকাঝকা, রাগারাগি এমনকি গায়ে হাত তোলা পর্যন্ত ঠিক ছিলো।কিন্তু,, কিন্তু আজ রক্তিম তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।যেটা মেনে নেওয়া যায়না।আচ্ছা, বাবুর কথা গুলোই কি ঠিক ছিলো?এসব ভেবে চোখ মোছে শক্তি।

দরজা খোলার শব্দে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে রিদ্ধি হাতে খাবারের থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

” প্লিজ রিদ্ধি দি,,চলে যাও এখান থেকে। প্লিজ আমার একটু একা থাকতে দাও।”কথাগুলো বলে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় শক্তি। আজও বাইরে পূর্ণিমা।হা্,,,তার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা গুলো ঘটানোর জন্য কি ঈশ্বর এই পূর্ণিমা সন্ধ্যাকেই বেছে নিয়েছেন।

রিদ্ধি খাবারের প্লেটটা টেবিলের উপর রেখে শক্তির পাশে এসে দাঁড়ায়। একটা ছোট শ্বাস ফেলে বলে,

“শক্তি, তোর রাগ করাটা অস্বাভাবিক কিছু না।কিন্তু খাবারের উপর রাগ দেখিয়ে কি লাভ?”

এই বলে শক্তিকে সামনের দিকে ঘুড়িয়ে জড়িয়ে নেয় রিদ্ধি। শক্তির এতোক্ষণের জমে থাকা রাগ,অভিমান গুলো সব চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসে।

“আমি তোমার ভাইকে কক্ষনো ক্ষমা করবো না, দি।কক্ষনো না।এতোটা অবিশ্বাস কেউ কি করে করতে পারে?কি করে?আমি চলে যাবো,এই বাড়ি থেকে, ওনার জীবন থেকে। আমায় কি একটুও শান্তি দেওয়া যায় না!”

এসব বলতে বলতে রিদ্ধির পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে শক্তি। কাঁদতে কাঁদতে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে মেয়েটার।রিদ্ধিই বা কি বলবে ওকে।কিছু বলার মুখ রাখেনি আজ রক্তিম।

ফ্ল্যাশব্যাক**

দেখতে দেখতে একটা মাস কিভাবে কেটে গেলো!আর মাত্র দুদিন পর রিদ্ধির বিয়ে।এই একমাস খুব আনন্দ করে কেটেছে সবার।আশীর্বাদের পর রিদ্ধির মামি চলে গেলেও মুন্নি আর শান্ত থেকে গেছে একদম বিয়ে অব্দি। এরই মধ্যে সবার জন্য কেনাকাটা, ছোটখাটো অনুষ্ঠান এসব সেড়ে নেয়া হয়েছিলো।

আজ সকাল থেকেই বাড়িতে উৎসবের আমেজ। আত্মীয় স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশিদের আনাগোনায় বাড়ি একদম গমগমে।আজ থেকেই ডেকোরেশনের কাজ শুরু হয়ে গেছে।বড়ো মেয়ের বিয়ে বলে কথা!পীযুষ বাবু শহর থেকে নামি দামি ডেকোরেটর ভাড়া করে এনেছেন।সারাদিন সবার এটা সেটা কাজ করেই চলে গেলো।বিকেলের দিকে শুরু হলো সাজগোজ। রিদ্ধির অনেক দিনের আশা ছিলো তার বিয়েতে ফটোসেশান হবে।পুরো বিয়েটা সিনেমা স্টাইলে ভিডিও করা হবে।যেমনটা আজকাল হয়ে থাকে।
ফটোসেশান শেষে হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। ওদের এখানে নিয়ম আছে বিয়ের আগের দিন রাতে গায়ে হলুদ করিয়ে মেয়েকে স্নান করানো হয়।আর এই স্নানের জল আনতে হয় চুপিচুপি। আরকি বিয়ের দিন যেমন ব্যান্ড পার্টি নিয়ে নাচ গান করে জল ভরা হয় সেভাবে না।এটাকে বলে ‘চোর জল ভরা’।

তো সন্ধ্যার পর বাড়ির সব মহিলারা জল ভরতে যায়।মুন্নিও তাদের সাথে যায়।কিন্তু শক্তি সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত থাকায় রুমে এসে পরে রেস্ট নেয়ার জন্য।আর রিদ্ধিও নিচের রুমে কিছুক্ষণ রেস্ট নেয়ার জন্য শুয়ে থাকে কারণ স্নান তো তাকে বাইরেই করাবে।আবার নামতে পারবে না।

উপর তলাটা তখন শুনশান।কারণ রক্তিম বা বাবু কেউই বাড়িতে নেই।ক্যাটারিংয়ের লোকদের আনতে গেছে।বাড়িতে শুধু রিদ্ধি আর শক্তি। হঠাৎ করেই শক্তির রুমের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শোনা যায়।শক্তি ভাবে হয়তো রিদ্ধি হবে।তাই খুলে দেয়।কিন্তু দরজা খুলে সে বড় সড় একটা শক খায়।কারণ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে শান্ত।

“কিছু দরকার,আপনার?”

“হুম,দরকার তো।তার আগে ভেতরে আসতে বলবে না?” এই বলে শান্ত সটান করে শক্তির রুমে ঢুকে যায়।

শক্তি খুবই ভয় পেয়ে যায়।কারণ শান্তর মতিগতি কোনোদিনই তার ভালো লাগে নি।আজ বাড়িতে কেউ নেই।শান্তর এই রুমে আসার কারণ কি?

শক্তির ধ্যান ভাঙে শান্তর আওয়াজে,

“বাহ্,শাড়িতে তো তোমায় দারুণ লাগে। এর আগের বার যখন শাড়ি পরেছিলে তখন খুব হট লেগেছিল। রক্তিম তোমায় শাড়ি পরতে দেয়না,তাই না?আমি হলে কিন্তু সবসময় শাড়ি পরিয়ে রাখতাম।”
শক্তি কপাল কুঁচকে বলে,

“এসব কি ধরণের কথা?আর আপনি ঘরে ঢুকেছেন কেনো?এক্ষুনি বেরিয়ে যান।নয়তো খুব খারাপ হয়ে যাবে বলছি।”

“ভালোই তো কথা জানো দেখছি।তা রক্তিমের সামনে এভাবে থাকো কেনো যেনো ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানো না?”

শান্তর কথা শুনে শক্তির পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়।কোনোরকমে নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করে বলে,

“আপনি যাবেন নাকি আমি লোক জড়ো করবো?”

শান্ত ওর হাতটা খপ করে ধরে বলে,

“ভালোই তো তেজ আছে দেখছি।রুপের তেজের সাথে এটাও।তাই বুঝি রক্তিম তোমায় মজেছে?”
এই বলে শান্ত এক হাত দিয়ে আবার জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে,

“তা আমাকেও কিছু ভাগ দাও।সবই রক্তিমের এটা তো ঠিক না।”

আর এইদিকে শক্তি দাঁতে দাঁত চেপে বলতে থাকে, “ছাড়ুন আমায় বদমাশ লোক।”

সে জোরে চিৎকারও করতে পারছে না।কিন্তু এবার মনে হচ্ছে লোক জড়ো করতেই হবে।
শক্তি চিৎকার করার আগেই দরজার সামনে দেখা গেলো রক্তিমকে। ওকে দেখে শান্ত ভয়ে শক্তির হাত ছেড়ে দেয়।কিন্তু যা দেখার রক্তিম ততক্ষণে দেখে নিয়েছে।

রুমে গিয়ে শান্তর কলার ধরে বলে,”তোর সাহস তো কম না।তুই ওর দিকে হাত বাড়াস।”

এই বলে এলোপাতাড়ি ঘুসি পরে শান্তর গায়ে।

“তোর কলিজা কতো বড়ো।নিজের ভাই বলে এতোদিন তোকে স্পেয়ার করেছি।আজ তুই বুঝবি রক্তিমের জিনিসের দিকে হাত বাড়ানোর ফল কি হতে পারে।”

এই বলে মারতে মারতে ওকে রুমের বাইরে নিয়ে আসে।

পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে শক্তি ছুটে এসে রক্তিমকে থামানোর চেষ্টা করে। আর সেই সময়টাই হয় শক্তির কাল।

“থামুন,থামুন তো।ছাড়ুন ওকে।”

শক্তির এই কথা শুনে রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকায় রক্তিম ওর দিকে ওকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয় রক্তিম আর চিল্লিয়ে বলতে থাকে,

“তোর এতো দরদ কেনো?কোন সাহসে ও তোর রুমে ঢোকে।তুই ঢুকতে দিয়েছিস।তোর সাহস কি করে হয়?প্রেম করিস দুজনে?একজন আরেক জনকে ছাড়া থাকতে পারিস না?”

ততক্ষণে বাড়ির সবাই চলে এসেছে উপরে।এক বাড়ি লোকের সামনে এসব কথা শুনে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার ইচ্ছে করছিলো শক্তির। আর রক্তিম, তার তো কোনো হুঁশই নেই।পীযূষ বাবু আর অন্যরা এসে তাকে না থামালে আজ মেরেই ফেলতো শান্তকে।

(চলবে)

Tithee sarker

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here