পলাশ ফুলের বসন্ত,সূচনা পর্ব,প্রথম পর্ব
কলমে – দেবিকা_সাহা
অনেককালের চেনা মানুষটাকে এভাবে পালটে যেতে দেখে আজকাল আর খুব বেশি কষ্টও হয় না পৌষালির। অনিন্দ্যর সাথে সম্পর্কটা যদিওবা অনেক বছরেরই ছিলো। আর সেই সম্পর্কের শিঁকড়টা কেমন ভাবে যেনো আলগা হয়ে গেলো।প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো।আসলে অনিন্দ্য যে প্রতিদিনকার অভ্যাসের থেকেও বেশি অঙ্গাঙ্গীভাবে ওর জীবনের সাথে যুক্ত ছিলো।ভুল হয়তো কোনো দিক থেকেই ছিলো না।আবার বলা যেতে পারে ভুলটা দুজনেরই ছিলো।পরস্পর পরস্পরকে বোঝার ভুল।কিংবা অন্যকিছু।
অনিন্দ্যর সাথে পৌষালির দেখা হয়না তাও প্রায় একবছর হতে চললো।আগামী সপ্তাহে পৌষালির বিয়ে। নিজের বাড়ির ঠিক করা পাত্রের সাথেই। ছেলেটির নাম আকাশ। পেশায় একজন কলেজের প্রফেসর। এটুকুই জানে পৌষালী আকাশের সম্পর্কে। আর কোনো কিছুই জানা হয়নি।আসলে সত্যি বলতে ও নিজেই আর সেই ব্যপারে কোনো উৎসাহ দেখায়নি। কিন্তু এমন বললে তো আর চলে না!! পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি আর পরিবার বলেও একটা ব্যপার আছে।তাদের ইচ্ছেতেই তো এই বিয়েটা করা।
আজ আবার পৌষালি আর আকাশের দেখা করার কথা।আসলে ওর মায়ের এই ব্যপারে স্পষ্ট বক্তব্য —
” বিয়ের আগে পরস্পর পরস্পরকে অন্তত একটু হলেও চিনে নেওয়াটা খুব দরকার। ”
যদিওবা বিয়েটা ঠিকঠাক। পৌষালি ভেবেছিলো বিয়ে যখন করতেই হবে,তখন চুপচাপ বিয়েটা করে নেওয়াটাই বেটার।কিন্তু এই মুহূর্তে মায়ের কথাগুলো শোনার পর মনে হলো যে মা হয়তো ঠিকই বলেছে।
সত্যিই তো। কয়েকটা কথা বলে নেওয়া দরকার আমার আকাশের সাথে। এতোটাও উদাসীন থাকার কোনো মানে হয় না।আর সেই শর্তগুলো যদি না মেলে,তবে যাই হয়ে যাক না কেনো বিয়েটা হবে না।সে যতোই বিয়েটা পাকা হয়ে যাক না কেনো!!
এইরকম চিন্তা ভাবনা মাথায় নিয়ে আকাশের সঙ্গে দেখা করবে বলে মনোস্থির করলো পৌষালি।।
দেবিকা..
( চলবে)
#গল্প – #পলাশ_ফুলের_বসন্ত ( প্রথম পর্ব )
#কলমে – #দেবিকা_সাহা
কফিশপের চেয়ারটায় বসে না চাইতেই অনেক কথা,আর স্মৃতি এসে ভিড় করছিলো পৌষালির মনে।এইতো এখানেই কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে অনিন্দ্যর সাথে। শুধু কি এখানে? এতো বড়ো শহরের কতো কতো কোনাতেই তো স্মৃতির রেশটা আজও অমলিন।তিন বছরটা নিতান্তই কম নয়।অনেকগুলো মাস, অনেকগুলো দিনের হিসেব।
এতোগুলো দিনেও মানুষ চিনতে পারলাম না। মা ঠিকই বলে মানুষ চিনতে গোটা জীবনটাই কেটে যায়।সত্যিই তাই।আর সেখানে তিন বছর আর কি!!
এইসব ভাবতে ভাবতেই পৌষালির ফোনে একটা ফোন আসলো।স্ক্রিনে ভেসে আছে আকাশের নাম।
আসলে এই দেখা করার জন্যই আজ প্রথম আকাশের নাম্বারটা নিজের ফোনে সেভ করেছে পৌষালি। তাও আবার অনেক ভেবে নিয়ে। এই সাক্ষাতের জন্যই সুবিধা হবে বলে নাম্বারটা নিজের কাছে রাখা।এরপর ডিলিট অপশন তো রয়েইছে ফোনে। পৌষালি তো অনেক ভেবে চিন্তেই নিজের সাথে একপ্রকার যুক্তি করেই এখানে দেখা করতে এসেছে। আর ও এটা নিশ্চিতই ছিলো যে আজ আকাশের সাথে কথা বলার পর আর যাই হোক না কেনো আকাশ ওকে বিয়ে করবে কি না,, এটা নিয়ে একবার হলেও ভাববে।যেমন ভাবনা তেমন কাজ।পৌষালিও আকাশের ফোনটা দেখে চটপট আর দেরি না করে ফোনটা রিসিভ করলো।
— আমি আকাশ বলছি।©দেবিকা..
— হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি। বলুন।
— বলছি যে,, আমি কফিশপে চলে এসেছি।আপনি কোথায় আছেন বললে একটু সুবিধা হতো।না,, আসলে যতোদূর চোখ যাচ্ছে,,আপনাকে ঠিক দেখতে পাচ্ছি না।
— একদম ভিতরের দিকটাতে কর্নারের দিকে।
— ওকে ওকে। ওয়েট আমি আসছি।
কি অদ্ভুত মানুষ রে বাবা!! ভিতরের দিকে এসে একটু চোখ দিয়ে তাকালেই তো আমায় দেখতে পেতো।তা না করে ডিরেক্ট ফোন।এরকম একটা ছোটখাটো ব্যপারে ফোন করার যে কি মানে সেটাই বুঝিনা।যাই হোক,,দেখা যখন করতেই এসেছি তখন বুঝেশুনেই কথা বলতে হবে।
বসতে পারি??
হঠাৎ করে নিজের সামনে এরকম অপরিচিত একটা কন্ঠস্বর শুনে ভাবনার ঘোর থেকে বেড়িয়ে সামনের দিকে তাকালো পৌষালি। চশমা আঁটা চোখ আর শান্ত মুখের একটা ছেলে। বয়স খুব বেশি হলে সাতাশ কি আঠাশ।বেশ চুপচাপ আর শান্ত পরশ ঘিরে রয়েছে মুখটাতে।গাম্ভীর্যও আছে বেশ খানিকটা,, তবে সেটা হয়তো এই শান্তশিষ্ট স্বভাবের জন্যই।আপাতদৃষ্টিতে ছেলেটাকে দেখে এমনটাই মনে হলো পৌষালির।
— হাই আমি আকাশ। আকাশ মুখার্জি।
— নমস্কার। আমি পৌষালি মিত্র।আসলে আমার আপনাকে কিছু বলার আছে,,, তাই আজ দেখা করা।
— হ্যাঁ দরকার আছে সে তো বুঝতেই পারছি।যদি গল্প করার জন্যই দেখা করতেন তাহলে আমাদের বিয়ে ঠিক হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই আমাদের আরো বেশ কয়েকবার দেখা হয়ে যেতো।
বেশ শান্ত গলায় হাসতে হাসতে পৌষালিকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললো আকাশ।
হ্যাঁ বলুন কি কথা বলার জন্য আজ এই জরুরি তলব??©দেবিকা..
— ঠিক কিছু বলার জন্য নয়। একচুয়ালি কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার আছে আমার আপনাকে।
এতোদিন তো আমিই আমার ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে আসছি।আমার জন্যও কেউ আবার প্রশ্নপত্র রেডি করে রেখেছে!! বেশ ভালো তো ব্যপারটা।
নিজের মনেই কথাগুলো ভেবে নিয়ে পৌষালির দিকে তাকিয়ে একটা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালো আকাশ।
— আমার প্রথম প্রশ্ন,, আপনি রান্না করতে পারেন?
আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন,, আপনি জামাকাপড় কাঁচতে পারেন?
জানি আপনি খুব ব্যস্ত মানুষ তাই আমার তৃতীয় প্রশ্নটা আপনার কাছে মূল্যহীন মনে হবে।তাও বলছি আপনার হাতে উপযুক্ত সময় কি আছে নিজের পরিবারকে দেওয়ার মতো? নাকি আপনি সেই দায়িত্বটা আপনার স্ত্রীর হাতেই সমর্পন করতে চান?
— মানে??
— মানেটা খুব সিম্পেল।না বোঝার মতো তো কিছু বলিনি।ঠিক আছে,,বুঝতে যখন পারছেন না,,আমি আরো স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিচ্ছি।
আপনি কি আপনার ফ্যামিলির দায়িত্ব আর বাচ্চা মানুষ করার দায়িত্ব নিজের স্ত্রীর হাতে দিয়ে দায়িত্বমুক্ত হতে চান? বেসিক্যালি সেইজন্যই কি বিয়েটা করতে চান?
অবশ্য এই প্রশ্নটাও হয়তো বৃথা।কারন আজকাল একশোটা ছেলের মধ্যেই নব্বই জনই নিজের সংসার আর বাচ্চা সামলানোর জন্যই বিয়েটা করে। বাকি দশজন এক্সেপশনাল।আর এই নব্বইজন,, মানে আমি যাদের কথা মূলত বলছি তাদের আবার ওয়ার্কিং লেডি একদম পছন্দ নয়। তারা কিন্তু ওয়ার্কিং লেডির সাথে বন্ধুত্ব করতে পারে।এমনকি চুটিয়ে প্রেমও করতে পারে।
কিন্তু বিয়ে? নৈব নৈব চ। বউ তো হবে একেবারে ঘরোয়া। কি যেনো বলে তাদের ভাষায়!! ও হ্যাঁ মনে পড়েছে।বউ হবে একেবারে ওয়াইফ ম্যাটেরিয়াল।ওই ” বুক ফাঁটে তবু মুখ ফোঁটে না “।এরম হলে তো একেবারে সোনায় সোহাগা।ঘরোয়া,, সংসার আর বাচ্চা সামলানোর দায়িত্ব বহন করতে পারবে এমন উপযুক্ত বউ চাই। ভাবখানা এমন যেনো,,বিয়ে করে ঘরে বউ নিয়ে যাচ্ছে না।বরং নিজের সংসার সামলানোর জন্য পার্ট টাইম স্টাফ নিয়ে যাচ্ছে।আরো কতো কিছু যে ভাবে!! নাই বা বললাম আর সে কথা।©দেবিকা..
যাই হোক,,এবার আমার কথা বলি। আমি ম্যাথ নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি।তারপর মাস্টার্সও করেছি স্ট্যাটিস্টিক্স নিয়ে।এখন বর্তমানে একটা হাই স্কুলে পার্টটাইম জব করছি।তার সাথে পি এইচ ডি-র চেষ্টা মানে সেটার জন্য পড়াশুনো।এস.এস.সি-র অবস্থা তো এখন খুব ভালো। তাই স্কুলের পার্মানেন্ট জব কবে পাবো সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। আর আমি আপনার মতো ট্যালেন্ডেডও নই এতো কম বয়সে নিজের কেরিয়ারে সেটেল হতে পারবো।আসলে ভগবান এই প্রতিভাটা সবাইকে সমান দেন না কিনা!! তবে আমার ধৈর্য্য আর ইচ্ছে আছে ষোলোআনা। তবে ধৈর্য্যটা আমার থাকলেও আমার বাড়ির লোকের একটু হলেও কম।তাই তাদের আমার বিয়েটা নিয়ে না ভাবলেই হচ্ছিলো না।কি আর করার। বাড়ির কথা সবসময় শোনার চেষ্টা করি।এখনো তাই করছি।
তবে আমি কিন্তু এতোটাও মহান নই যে বিয়ের পর আমার স্বপ্নগুলোকে সব বিসর্জন দিয়ে মন দিয়ে লক্ষ্মীমেয়ের মতো একাগ্র চিত্তে সংসার করতে বসবো।
এতোক্ষন ধরে এভাবে নিজের বিপরীত দিকের ব্যক্তিটির থেকে ঝড়ের গতিতে কথাগুলো শুনে আকাশ প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে চুপচাপ বসে রইলো।আসলে এভাবে প্রথম দেখাতে কেউ যে গড়গড় করে জলের মতো এই কথাগুলো বলতে পারে,,সেটা একেবারেই এক্সেপ্ট করেনি আকাশ।ও শুধু পৌষালির কথাগুলো শুনে ওর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো।
— হ্যাঁ আমার এবারের বক্তব্য…..
— আরো কিছু আছে??
— হ্যাঁ অবশ্যই।আরো কথা তো অবশ্যই আছে। নাহলে আমি এভাবে খামোখা দেখা করতে আসতাম না।
— ওকে বলুন।
— আমি তাকেই বিয়ে করবো যার সাথে আমার ক্রাইটেরিয়া গুলো ম্যাচ করবে।
নাম্বার ওয়ান রান্না জানতে হবে।যেহেতু সংসারটা দুজনেরই। আমি একেবারেই নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে ওরকম বউ বউ হয়ে থাকতে পারবো না।তারপর…..
— জামাকাপড় কাঁচতে জানতে হবে,সংসার সামলাতে জানতে হবে আপনার হাতে হাত মিলিয়ে আর সর্বোপরি বাচ্চা মানুষ করতে জানতে হবে।
— হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছেন। ওরকম স্বামী স্বামী মেজাজ আর কাজের বেলায় ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকলে হবে না।©দেবিকা..
আপনিই ভাবুন কি সব অদ্ভুত যুক্তি। বাচ্চা মানুষ করতে হবে।আর তাও নাকি বাচ্চার মাকে শিখিয়ে দিতে হবে!! ভাবখানা এমন যেনো বাচ্চাটা ওর একারই।আর বাচ্চার মা উড়ে উড়ে এসেছে।যত্তসব।পিকিউলিয়ার পাবলিক।
এতো কিছু বলে একটু থামলো পৌষালি।
— নিন। জলটা খান।।
কথাটা বলে জলের গ্লাসটা পৌষালির দিকে এগিয়ে দিলো আকাশ।
এতোকিছু বলার পর আকাশের থেকে এমন ব্যবহার আশা করেনি পৌষালি।তাই একটু অদ্ভুতভাবেই ওর দিকে তাকিয়েছিলো মেয়েটা সেই মুহূর্তে।
— নিন আগে জলটা খেয়ে নিন।এতোগুলো কথা বলে হাঁফিয়ে গেছেন নিশ্চই। জলটা খেয়ে নিয়ে নাহয় আমাকে দেখবেন।
— কিহ্??
আকাশের কথাটা শুনে একটু ইতস্তত হয়েই ওর দিক থেকে চোখটা সরিয়ে নিলো পৌষালি।।
দেবিকা..
( চলবে )