পরিবর্তন,পর্বঃ ২

#পরিবর্তন,পর্বঃ ২
লেখাঃ মান্নাত মিম

৭.
পা যেন চলতে চায় না। এতই ধীরস্থির, মন্থর গতি কলির। বিদ্যালয় থেকে আজ অর্ধেক বেলাতেই ফেরত চলে এসেছে। কারণবশতই এই সময়ে সতর্কতা অবলম্বন ছাড়া ক্লাস করা সম্ভব ছিল না। ভাগ্য ভালো বলে ড্রেস নষ্ট হয়নি। নাহলে খবর হয়ে যেত। লজ্জা মুখ দেখাতে পারত না বিদ্যালয়ে। একপাশে ধানক্ষেত অন্যপাশে বাঁধা পুকুর। পুকুরের চারদিকে ফলাদি গাছের সমাহার। মাঝে চিকন মাটির রাস্তা। আগে এত উন্নত ছিল না। নৌকা বেয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হতো তাদের, এতটাই পানির বন্যা ছিল এখানে। এখন কত উন্নত হয়েছে! কিন্তু মানুষের মনের উন্নতি কেন হয়নি? ভাবে কলি কিছু সময়। ভাবনার মাঝে খেয়াল নেই যে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পেছন থেকে একটা হাত তার মুখ চেপে ধরল। তৎক্ষনাৎ খেয়াল করার সময় পেল না কলি যে, কে তাকে ধরে আড়ালে নিয়ে যাচ্ছে।

৮.
“কি রে ইসকুল তে ফিরত আইয়া সেই যে ঘরে হান্দলি আর বাইর অওনের নাম নাই। কী অইছে? কাজকাম আছে না একলা হাতে আর কত সামাল দিমু? কইছিলাম আর পড়ান লাগব না। নাহ, হের মাইয়ায় যতখান পড়তে চায় পড়াইব।”

কতক্ষণ যাবত কলির মা কলির কক্ষের দরজার সামনে ঘ্যানঘ্যান করলেন। অতঃপর কোনপ্রকার সাড়াশব্দ না পেয়ে চলে গেলেন বিড়বিড় করতে করতে।

রুমে কলি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। দেখার মতো কিছুই নেই। ছোটো থেকে বড়ো হওয়া পর্যন্ত কম তো জানলার বাইরে তাকায়নি সে। আম গাছ ছাড়া আরকিছু চোখে পড়ার মতো না। তবুও শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেদিকে। ভাবছে তখনকার কথা, মোড়ল রফিক মিয়া যে তাকে নজরে রেখেছে সেটা তার জানা কথা। তবুও করার নেই কিছু বাড়ি ফেরার ওই একটাই পথ। ভাগ্য ভালো ছিল, ছাড়া পেয়ে গিয়েছে তার পিরিয়ড হয়েছে বলে। কিন্তু কতদিন আর এভাবে চলবে? কথায় আছে, একবার দুইবার জমে ধরে তিনবার। এখন তার মনে হচ্ছে, মেয়ে হয়ে জন্মানোই অভিশাপ। সেই অভিশাপে তার জীবন আজ এমন।

৯.
কথায় আছে না, এক বাঘের মুখ থেকে বেঁচে আরেক বাঘের মুখে পড়ে। কলির হয়েছে সেই দশা। ছুতোনাতা দিয়ে কতদিন আর বাড়ি বসে থাকত সে। গণিতের মাস্টার মশাইয়ের বাড়িতে যাওয়ার কথা আরো আগে। অথচ একমাস ধরে বাহানা বানিয়ে যাচ্ছে না। আর স্কুলের কথা তো বাদই। একবার তো রাতে বাবা-মা’র খাওয়ার সময় আমতাআমতা করতে করতে বলেই দিয়েছে সে যে, আর পড়বে না। কিন্তু করিম মিয়া বলেছেন, অন্তত দশম ক্লাস শেষ করতে। এতদূর এসে বন্ধ না করতে। কলি নিজেরও পড়ালেখার তাগিদ অনেক। সে ভালোবাসে লেখাপড়া করতে। কিন্তু বাইরের হায়েনার দল, নরপশুরা তাকে সামনে এগিয়ে যেতে দেয় না। যৌন হয়রানির মাধ্যমে পায়ে শিকল বেঁধে রাখে। চুপচাপ, শান্ত মনোভাবের অন্তর্মুখী গ্রাম্য মেয়েটা নিজের ভেতরেই গুমরে মরে।

বাবার কথায় শেষমেশ দুরুদুরু কাঁপা বুক নিয়ে যায় গণিতের মাস্টার মশাইয়ের বাড়িতে। আর শুধু স্মৃতি রোমন্থন হয় সেদিনের দমবন্ধকর অবস্থার। মনে খারাপ সংকেত দেয়, সমুখে খারাপ কিছু হওয়ার উপায় নাই পিছু হটবার।

১০.
চৌচালা টিনের ঘর মাস্টার মশাইয়ের। পাশে আবার একচালা ছোটোখাটো টিনের ঘর আছে, সেটা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বরাদ্দকৃত। মাস্টার মশাই বয়সে চল্লিশ পেরিয়ে। অতটা লম্বাচওড়া নয়, মধ্যম। তবে গায়ের রং মনের রংয়ের সাথে খাপে খাপ। অর্থাৎ কালো, কুচকুচে কালো। স্ত্রী তাঁর বেশিরভাগই মা’য়ের বাড়ি গিয়ে থাকে, ছয় বছরের মেয়েকে নিয়ে। মাস্টার মশাই আর তাঁর বৃদ্ধা মা পড়ে থাকে বাড়িতে। বিকেলে পড়ার সময়। পড়তে পড়তে অনেক সময় সন্ধ্যেও পেরোয়। কলি এসে দেখে দুয়েক জন এসেছে স্কুলের। সকল শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রী পড়ান তিনি, তবে সময় ভেদে। তাঁর এদিকে সুখ্যাতি রয়েছে যে, তাঁর কাছে পড়া ছাত্র-ছাত্রীরা ভালো রেজাল্ট করে। এখন কথা হলো, যে সারাবছর ফেল করে, সে-ও ভালো রেজাল্টে উত্তীর্ণ হয়। কীভাবে? জানা নেই কলির। আপাতত চুপচাপ সারিবদ্ধ ভাবে থাকা টেবিলে গিয়ে সকলের সাথে বসে গেল এককোণে চুপটি করে। মুখ বরাবর কালো ব্ল্যাকবোর্ড টানিয়ে রাখা। কিছুক্ষণ পরে আসলেন মাস্টার মশাই। এখানে সবাই শুধু গণিতের বিষয়ে পড়তে এসেছে। অন্য বিষয় পড়ান না তিনি। তাই এসেই পাটিগণিতের অধ্যায় থেকে পড়ানো শুরু করে দিলেন। অংক বুঝিয়ে সকলকে করতে দিয়ে ঘুরে ঘুরে সকলের অংক করা দেখতে লাগলেন। অল্প কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী এসেছে আজ।

“কি রে কলি! আইছোস?”

“হ, স্যার।”

গলার স্বরের সাথে মৃদু কাঁপলো শরীর। গুটিয়ে বসে অংক করায় মন দেওয়ার চেষ্টা করল কলি। কিন্তু হলো না। শকুনের দৃষ্টি যে তার ওপর।

“কী হইছে করছ না কেন? বুঝতাছ না, না কি? ”

মাথা নেড়ে বলবে যে, বুঝছে। সেই সময়টুকুও তার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো। কলির পাশে থাকা এক ছাত্রকে পিছনে পাঠিয়ে দিয়ে মাস্টার মশাই পরনের লুঙ্গি গুটিয়ে বসে পড়লেন কলির পাশে। অতঃপর শিশু শ্রেণির ছোটো বাচ্চাদের মতো হাতে-কলমে শেখানোর মতো অংক বুঝিয়ে দেওয়ার নামে ছুঁয়ে দিলো সর্বত্র। অন্যসব ছাত্র-ছাত্রী’রা সেদিকে খেয়াল দিলো না। তবে মাস্টার মশাইয়ের বসে অংক বুঝিয়ে দেওয়ার হিসেব খানা কেবল ক’জন ছাত্রী বুঝল। বুঝেও করার কিছু নেই। নিজের মানসম্মান যতটুকু আছে ততটুকুর রক্ষার্থে চুপ থাকাই শ্রেয়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here