পঁচিশটা মোমবাতি,পর্ব:- এক (০১)

গল্প:- পঁচিশটা মোমবাতি,পর্ব:- এক (০১)
মো: সাইফুল ইসলাম

রূপা তার অসুস্থ বাবার বুকে হাত রেখে আস্তে আস্তে বললো,
– বাবা আমি যাকে ভালোবাসি সে আমার চেয়ে এগারো বছরের বড়। তার স্ত্রী আছে, তবুও কেন জানি সারাক্ষণ তার কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না।

রূপার বাবা ফ্যালফ্যাল করে মেয়ের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল। মেয়েটার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? বাইশ বছরের মেয়ে যদি তার চেয়ে এগারো বছরের বড় কাউকে পছন্দ করে তাহলে তার বয়স তেত্রিশ। কিন্তু মারাত্মক কথা হচ্ছে সেই ছেলের নাকি বউ আছে, কি সর্বনাশ।

রূপা বললো,
– বাবা তুমি কি রাগ করেছো?

– ছেলেটা কি তোর অফিসের সেই স্যার?

– কীভাবে বুঝলে?

– তুই প্রতিদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে গোসল করার আগে আমার সঙ্গে আধা ঘণ্টা গল্প করিস। সেই কথাবার্তার মধ্যে সবকিছুই তোর স্যারকে নিয়ে। অফিসে যাওয়া থেকে শুরু করে ছুটির আগ পর্যন্ত তার সঙ্গে কি কি ঘটে সেগুলো বলিস।

– বাবা তুমি চিন্তা করো না। তাকে আমার পছন্দ এটা ঠিক, কিন্তু সে আমাকে দুই চোখে দেখতে পারে না।

– তাহলে কি দিয়ে দেখে?

– জানি না বাবা। তবে সে আমার সঙ্গে সবসময় খারাপ ব্যবহার করে। মাঝে মাঝে চাকরি ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে বাবা। কিন্তু একটু আবার ডাক দিয়ে ভালো করে কথা বলে। পাঁচ মিনিট কথা বলে যখন তার রুম থেকে বের হই তখন মনে মনে বলি ” মানুষটা এতো ভালো কেন? ”

– তোর মাথা পুরোপুরি গেছে।

রূপা হাসলো, অসুস্থ বাবার কাছে বিদায় নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। হাতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রূপা, আজও তার অফিসে যেতে দেরি হবে।

রূপার চাকরির বয়স এক বছর হতে আর সামান্য কিছুদিন বাকি আছে। এই এক বছরের মধ্যে সে সবসময়ই দেরি করে অফিসে যায়। আর প্রতিদিন তাকে ঝাড়ি খেতে হয়। অফিসে গিয়েই সে প্রথমে যায় তার স্যার সফিকের কাছে। সফিক তাকে দেখে বিরক্ত হয়ে বলে,

– এরচেয়ে নিজে একটা অফিস খুলতে পারো না? লাঞ্চের পড়ে অফিসে তবুও কেউ কিছু বলবে না।

সফিক আর কিছু বলেন। রূপা চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শোনে, কখনো জবাব দেয় না। বকা শুনতে শুনতে তার কান্না আসে। তারপর নিজের ডেস্কে এসে বসে বসে সফিকের পরবর্তী ডাকের অপেক্ষা করে। দশ মিনিট পরেই সফিক তাকে ডাকবে, হাসিমুখে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করবে। তারপর কিছু ফাইল হাতে দিয়ে বলবে ” এগুলো চেক করে ম্যাডামের কাছে পাঠিয়ে দিও। ”

সফিক বাদে আর কেউ তাকে ঝাড়ি দিলে কিংবা উঁচু গলায় কথা বললেই সে প্রতিবাদ করে। কিন্তু সফিকের সঙ্গে পারে না। রূপার চাকরির ব্যবস্থা সফিক করে দিয়েছিল, হয়তো সেই কৃতজ্ঞতা হতেই সে প্রতিবাদ করতে পারে না।

বছর খানিক আগে রূপা যখন চাকরির জন্য খুব চেষ্টা করছিল তখনকার কথা তার সবসময় মনে পড়ে। প্রায় মাস খানিক ঘোরাঘুরি করে কোনো চাকরি হয়নি। একদিন বিকেলে ক্লান্ত হয়ে সে একটা পার্কে বসেছিল। হঠাৎ করে দেখতে পেল তার সামনেই একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে। একপর্যায়ে মেয়েটা রাগ করে চলে গেলে, ছেলেটা কিছুক্ষন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সেখানে সবুজ ঘাসের উপর বসে যায়।

রুপা দুর থেকে এসব দেখতে থাকে। একটা সময় সে নিজের মনের অজান্তেই ছেলেটার কাছে চলে যায়। ছেলেটা তাকে দেখে বিরক্ত হয়ে বলে,

– কে আপনি?

– আমার নাম রূপা।

– নাম দিয়ে কি করবো? পার্কে এতো যায়গা আছে তবু আমার কাছে কেন এসেছেন?

– আমার একটা চাকরির খুব দরকার, আমাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিবেন?

রূপা নিজের কথাতে নিজে বিরক্ত হয়ে গেল। এটা বলা হয়তো ঠিক হয়নি। আসলে যে মেয়েটি রাগ করে চলে গেছে সে ঝগড়ার সময় বলেছিল,
” এতবড় চাকরি করে লাভ কি? আমাকে নিয়ে যদি সামান্য বাইরে আসতে না পারো তাহলে বড় চাকরি আর টাকা দিয়ে কি হবে? ”

এই কথা শুনে রূপার মনে হচ্ছিল লোকটা ভালো চাকরি করে। তার মানসিক চাপ আছে এখন, করুন হয়ে চাকরির কথা বলা যায়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়ে গেছে। এই লোকটার মুখে কোন রসকষ নেই, তিতা তিতা কথা বলে।

লোকটা বললো,
– পার্কে এসে কেউ চাকরি খোঁজে? তোমার কি খারাপ কোনো উদ্দেশ্য আছে নাকি?

রূপার কান্না আসে, সে কোনকিছু না বলে পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে। রাত আটটার দিকে তার বাসায় একটা ছেলে আসে। ছেলেটা তাকে একটা ঠিকানা দিয়ে বলে আগামীকাল ঠিক সকাল দশটায় এই ঠিকানায় যোগাযোগ করতে হবে। তার একটা চাকরির ব্যবস্থা হতে পারে।

রূপা ভাবেনি যে পার্কের সেই লোকটা এভাবে কাউকে দিয়ে খবর দেবে। তাছাড়া সেই লোকটার তো তার বাসা চেনার কথা নয়।

পরদিন সে অফিসে গেল। দারোয়ানের কাছে সে কি বলবে বুঝতে পারছিল না। শুধু ঠিকানা দিয়ে ভিতরে ঢোকা যায় না, কার কাছে যাবে তার নাম বলা দরকার। সেই লোক অনুমতি দিলে তারপর প্রবেশ করতে দেওয়া হবে।

সমস্যা হচ্ছে রূপা তার নাম জানে না। সে কার সঙ্গে দেখা করবে তার নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি। দারোয়ান তাকে ঢুকতে দিল না। রূপা সারাদিন অফিসের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাটাহাটি করে পার করলো। বিকাল তিনটার দিকে পিছন থেকে একটা লোক বললো,

– তোমার নাম রূপা তাই না?

রূপা পিছনে ফিরে দেখে গতকাল পার্কের সেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ হাসিহাসি ভাব, রূপা কিছু বললো না তার মনটা খারাপ হয়ে আছে অনেক।

– তোমার না সকাল দশটার দিকে আসার কথা ছিল, তুমি এখানে কি করো?

রূপা তখন আনন্দে হাসতে ইচ্ছে করছিল। সে আনন্দে কিছু বলতে পারলো না। সফিক তার দিকে তাকিয়ে বললো,

– চলো আমার সঙ্গে।

সফিক গেইট দিয়ে ভিতরে যাচ্ছে। দারোয়ান তাকে সালাম দিল, তার সঙ্গে সঙ্গে রূপা প্রবেশ করলো ভিতরে। দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে রূপা মনে মনে বললো ” এবার পারলে আটকে রাখ। ”

রূপার সেদিনই চাকরি হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেদিনের পর থেকে রূপার নাম সফিক মনে রাখতে পারে না। সফিক সবসময় তাকে স্বর্না বলে ডাকে। রূপা তাতেই সাড়া দেয়। মাঝে মাঝে সফিক কাগজপত্র দেখে বলে,

– তোমার নাম তো স্বর্না তাহলে এখানে রূপা লেখা কেন?

– স্যার আমার নাম রূপা।

– তাহলে আমি স্বর্না বলে ডাক দিলে তুমি সাড়া দাও কেন?

– আপনি আমার নাম মনে রাখতে পারেন না তাই আমি স্বর্না ডাকলেই বুঝতে পারি। তাছাড়া এ-ই অফিসে স্বর্না নামে কেউ নেই।

– ঠিক আছে কাল থেকে রূপা মনে থাকবে।

কিন্তু সফিকের মনে থাকে না। পরদিন আবার অফিসে এসে স্বর্না বলে ডাক দেন রূপা দৌড়ে চলে যায় তার কাছে। বছর খানিক আগে সফিক সেদিন পার্কে যার সঙ্গে ঝগড়া করেছিল সেই মেয়েটা সফিকের স্ত্রী। একদিন সে অফিসে এসে সফিকের রুমে বসে ছিল। সেদিন রূপা তাকে দেখেই চিনতে পারে।

রিকশা থেকে নেমে রূপা গেইট দিয়ে ভিতরে যাচ্ছে। পনের মিনিট দেরি হয়ে গেছে। বাবার সঙ্গে সকাল বেলা বেশি কথা বলতে গিয়ে দেরি হয়েছে। সে জানে আজও তাকে বকা শুনতে হবে।

কোম্পানির মালিক সফিককে খুব পছন্দ করেন। সফিকের কর্মদক্ষতা অসাধারণ, সেজন্যই তাকে আরো বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। ব্যস্ততার জন্য তার নিজের ব্যক্তিগত জীবনে অশান্তি চলছে। তবে সফিকের ধারণা তার স্ত্রী হয়তো তার সঙ্গে থাকতে চাইছে না। সেজন্য সে টুকটাক বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে বেশি।

মালিকের নাম আমজাদ চৌধুরী। আমজাদ চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে। সাত বছর ধরে সে অস্ট্রেলিয়া তার মামার কাছে আছে। আমজাদ চৌধুরীর স্ত্রী আত্মহত্যা করে মারা গেছেন সাত বছর আগে। মেয়ে যখন জানতে পারে যে তার বাবার কারণেই তার মা আত্মহত্যা করেছে তখন থেকে বাবার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। মামার কাছে চলে গেছে অষ্ট্রেলিয়ায়। বিশাল কোম্পানি নিয়ে এই দেশে একা একা বাস করছেন আমজাদ চৌধুরী।

পঁচিশ মিনিট লেইট করার পরেও সফিক আজ রূপাকে কিছু বললো না। রূপা তার কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে সফিক বললো,

– রূপা কয়টা বাজে?

– জ্বি স্যার?

– সকালে নাস্তা করিনি, ওদেরকে বলো আমার জন্য নাস্তা দিতে। আর তুমি তোমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে এসো।

রূপা দ্রুত বেরিয়ে গেল। নাস্তা ও চা নিজের হাতে নিয়ে সফিকের রুমে গেল। সফিক চায়ের কাপে ভিজিয়ে ভিজিয়ে রুটি খাচ্ছে। রূপার চা খেতে লজ্জা করছে, মনে মনে ভাবছে স্যার তাকে যখন বলবে তখনই খাওয়া শুরু করবে। কিন্তু সফিকের খাওয়া শেষ হয়ে গেল তবুও রূপাকে সে খেতে বললো না। রূপা মন খারাপ করলো না।

সফিক বললো,
– আমি এখন বাইরে যাবো। আজকে আর হয়তো অফিসে আসবো না। তুমি জরুরি কোনো দরকার হলে আমাকে কল করবে।

– অফিস থেকে বের হয়ে কোথায় যাবেন?

প্রশ্নটা করে রূপা মনে মনে বললো, ” আমি কি একটা গাধা? স্যার কোথায় যাবে সেটা জিজ্ঞেস করে লাভ কি? ”

– আমার স্ত্রীকে চেনো?

– জ্বি স্যার, দুবার দেখেছি।

– আজ আমাদের ডিভোর্স হবে। সেজন্য আজ আর আসবো না, ডিভোর্সের কাজ শেষ করে আমি এক বন্ধুর কাছে যাবো।

রূপার চোখে পানি এসে গেল। সফিকের সামনে সে কখনো নিজের চোখে পানি আসতে দেখে নাই। আজ এসেছে। তার কি বলা উচিত?

– তোমার চা ঠান্ডা হয়ে গেছে, তুমি বরং আরেক কাপ চা নিয়ে নিজের ডেস্কে বসে খাও। আমি এখন বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে যাবো। তারপরই বেরিয়ে যাবো, আজ বিকেলে একটা মিটিং আছে। স্যারকে মনে করিয়ে দিও।

রূপা চলে গেল, সফিক মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো তার স্ত্রী মেসেজ দিয়েছে।

” তাড়াতাড়ি আসো, সবাই অপেক্ষা করছে। ”

★★

আমজাদ চৌধুরী মন খারাপ করে বসে আছেন। সফিক ইচ্ছে করে তার ব্যক্তিগত বিষয় এখানে বললেন না। মিটিংয়ে কি কি বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে সেগুলোর একটা ফাইল বুঝিয়ে দিল।

আমজাদ চৌধুরী বললো,
– তুমি কি জানো আজ আমার মেয়ের জন্মদিন?

সফিক জবাব দিল না, কারণ তার মনে নেই। সে এমনিতেই কিছু মনে রাখতে পারে না। অফিসের সব কাজ ঠিকমতো স্মরণ রাখার জন্য সে ব্যক্তিগত ভাবে রূপাকে নিয়েছিল।

– আমি আমার মেয়েকে সকাল থেকে এ পর্যন্ত অনেকবার কল করেছি সফিক৷ সে কল রিসিভ করে না, নতুন নাম্বার দিয়ে কল দিলাম আমার কণ্ঠ শুনে কেটে দিয়েছে।

সফিকের ভালো লাগছে না, মোবাইলে তার স্ত্রী কল দিচ্ছে। মেসেজ দিয়ে অপেক্ষা করে এখন কল দিচ্ছে। এখনই যাওয়া দরকার।

– তুমি যাও সফিক, রাতে আমার বাসায় এসো। আমরা একসঙ্গে ডিনার করবো।

সফিক উঠে গেল। আবারও নিজের ঘরে এসে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বের হয়ে গেল। অফিস থেকে বের হয়ে নিজের বাইকে করে রওনা দিল। কিছুদূর যেতেই মোবাইল বেজে উঠলো। মোবাইল বের করে দেখে রূপা কলে করেছে। সফিক কল রিসিভ করতেই রূপা বললো,

– বড় সাহেবকে কে যে খু/ন করেছে। স্যারের রুমেই তার লা/শ পড়ে আছে। আপনি তাড়াতাড়ি অফিসে আসুন স্যার, সবাই হৈচৈ করছে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here