পঁচিশটি_মোমবাতি #পর্ব:- ০২

#পঁচিশটি_মোমবাতি
#পর্ব:- ০২

আমজাদ চৌধুরীর লা-শ এখনো সেভাবেই পড়ে আছে। সফিক নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সফিক এর কাছেই দাঁড়িয়ে আছে রূপা। সে থরথর করে কাঁপছে, অফিসের সবাই যেন আতঙ্কে দিশেহারা অবস্থা।

ম্যানেজার বললেন,
– স্যারের মেয়েকে ফোন করা হয়েছে, তিনি দেশে আসবেন আজ রাতের মধ্যে নাহয় কালকে।

– একদিনের মধ্যে হুট করে আসবে কীভাবে?

– ওনার মামা ব্যবস্থা করবেন। তিনি তো বললেন যে সমস্যা হবে না চলে আসতে পারবো।

সফিক চুপ করে রইল। তার এখনো সম্পুর্ন ঘটনা বিশ্বাস হচ্ছে না। আজকে রাতে বাসায় একসঙ্গে ডিনার করার দাওয়াত দেওয়া লোকটা পরপারে চলে গেছে। পৃথিবীর সব ব্যস্ততা আজ থেকে তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। সারাজীবন নিজের ডে সম্পদ বৃদ্ধি করেছেন সবকিছু রেখে তিনি এখন একটা কবরের যাত্রী।

– সফিক…!

– বলেন ম্যানেজার সাহেব।

– স্যারের মেয়ে কোনরকম দুঃখ পাননি। আমি ফোন করলাম, তিনি রিসিভ করে বললেন ” লা-শ কি পুলিশ নিয়ে গেছে? ”

– তারমানে তিনি আগেই জানতেন?

– মনে হয় আমি কল করার আগে কেউ কল দিয়ে তাকে জানিয়েছে৷ নাহলে তিনি কীভাবে বলতে পারলেন তার বাবা মারা গেছে। তাছাড়া তার মধ্যে কোনো কষ্টের আঘাত দেখিনি।

– অদ্ভুত তো ম্যানেজার সাহেব।

– আরেকটা কথা।

– কি?

– তিনি পুলিশকে বলেছেন তার বাবার মৃত্যুর জন্য কোনো মামলা করা হবে না। পুলিশ এসে যেন অফিসের কাউকে গ্রেফতার না করে। জিজ্ঞেসা করতে পারে সমস্যা নেই কিন্তু কাউকে গ্রেফতার করে থানায় নিতে নিষেধ করেছে।

পুলিশ এসে গেছে, সবাইকে দুরত্বে রেখে লাশের তদারকি করতে লাগলো। ম্যানেজার সাহেব বলা শুরু করেন,

সফিক অফিস থেকে বের হবার পরে ম্যানেজার সাহেব ভিতরে ঢুকলো। কিন্তু চৌধুরী তখন বিরক্ত হয়ে ম্যানেজারকে পরে দেখা করতে বললেন। ম্যানেজার বেরিয়ে গেল, কিছুক্ষণ পর তিনি আবার অনুমতি চাইলেন। তার জরুরি কথা বলার ছিল তাই আবার নক করেন। কিন্তু তখনই তিনি আবিষ্কার করেন চৌধুরী সাহেবের কিছু একটা হয়ে গেছে।

আমজাদ চৌধুরীর ঘরে কোনো ক্যামেরা ছিল না। রুমে ঢোকার স্থানে দেয়ালে একটা ক্যামেরা আছে সেই ক্যামেরার ফুটেজ চেক করা হলো। সেখানে ম্যানেজার ছাড়া আর কাউকে রুমে সামনে আসতে দেখা গেল না। পুলিশ ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গি করলেন। ম্যানেজার সাহেব ঘামতে লাগলো।

অবশেষে আবারও আমজাদ চৌধুরী একমাত্র মেয়ে নিধির কাছে কল দেওয়া হলো। এবার কথা বললেন পুলিশ নিজে, কারণ তারা প্রাথমিকভাবে ম্যানেজারকে সন্দেহ করছেন। বেচারা ম্যানেজার অসহায় হয়ে চৌধুরীর মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

পুলিশের কাছেও নিধি বলেন যে কাউকে এরেস্ট করতে হবে না। যা করার সে দেশে এসে তারপর করবে। আর যদি পুরোপুরি প্রমাণিত হয় যে কে খু-ন করেছে, তাহলে পুলিশ তার কাজ করতে পারে। শুধু শুধু সন্দেহের কারণে কাউকে হয়রানি করার জন্য নিষেধ করেন নিধি চৌধুরী।

সফিক কিছু বললো না। সত্যি সত্যি যদি তাদের ম্যানেজার নির্দোষ হয়ে থাকে তাহলে তাকে না নিয়ে যাওয়া ভালো। একবার থানায় গেলে একটা সম্মানিত ব্যক্তির মানহানীর সীমা থাকে না। পৃথিবীতে সবকিছু টাকা দিয়ে পাওয়া যায় কিন্তু সম্মান পাওয়া যায় না।

নিধি চৌধুরী জোর গলায় বললেন ” বাবা তার সারাজীবনে মানুষকে জ্বালাতন করেছেন। আজ মরে গিয়েও সবাইকে বিপদে ফেলে গেছে, যেটা আসলেই দুঃখজনক ব্যাপার। ”

সফিকের স্ত্রী বারবার কল দিচ্ছেন। সফিক কল রিসিভ করে বললো,
– আমাদের অফিসার এমডি স্যার খু-ন হয়েছে আজ আসা সম্ভব না।

সফিকের স্ত্রীর ভালো নাম ফারজানা। ফারজানা চেচিয়ে উঠে বললো,
– সবসময় তোমার ঝামেলা কেন থাকে বুঝতে পারছি না। আমি পেপার পাঠিয়ে দিচ্ছি তুমি আমাকে মুক্তি দিয়ে দাও।

সফিক কিছু বললো না। লাশ নিয়ে পুলিশ চলে গেছে। দুজন রেখে গেছে আমজাদ চৌধুরীর রুম পাহারা দেবার জন্য। গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আসবে তদন্ত করতে। বিশিষ্ট শিল্পপতি আমজাদ চৌধুরী অফিসে নিজের রুমে খুন হয়েছে। সুতরাং সুষ্ঠু তদন্তের দরকার আছে।

সফিক নিজের রুমে এসে চোখ বন্ধ করে রইল। রূপা দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে, সে ভিতরে আসতে সাহস পাচ্ছে না। একটু পরে সফিক তাকে ডাক দিল। রূপা দরজা খুলে দাঁড়াতেই সফিক বললো ” এক কাপ চা দিতে বলো। ”

সন্ধ্যা বেলা অফিস থেকে বের সফিক সরাসরি তার বড়বোনের বাসায় গেল। অফিসে মোটামুটি ভালো অবস্থান তার ছিল কিন্তু সে কখনো গাড়ি চড়তে পারে না। মানে প্রাইভেট কারে চড়তে সে অভ্যস্ত নয়। নিজের বাইক নিয়ে সারা শহরের মধ্যে তার চলাচল। তাছাড়া গাড়ি ব্যবহার করার আরেকটা বিরক্তিকর কারণ হচ্ছে যানজট। সেই দিক দিয়ে বাইক অনেক ভালো।

সফিকের বাবাও মেয়ের বাসায় থাকে। সফিকের কাছে ছিলেন কিন্তু সফিকের বোনের অনুরোধে তিনি মেয়ের বাসায় থাকতে বাধ্য হয়েছেন। যখন জানতে পারেন সফিকের স্ত্রী বাসা থেকে চলে গেছে তখনই নিজের কাছে বাবাকে নিয়ে আসে। শফিককে সবসময় আসতে বললেও সে এখানে আসতে চায় না।

ড্রইং রুমে বসেই আকলিমা বললো,

– তোদের অফিসের মালিক খুন হয়ে গেছে তাই না? কীভাবে কি হলো?

– জানি না আপা। আমি অফিস থেকে বের হয়ে উকিলের কাছে যাচ্ছিলাম তখন খবর শুনে ছুটে যাই আবার।

– ফারজানা শেষ পর্যন্ত তোকে ডিভোর্স দিবেই তাই না?

– হ্যাঁ।

– সেদিন শপিং মলে দেখা হয়েছিল আমার সঙ্গে। হাসিখুশি মুখে জিজ্ঞেস করলো কেমন আছি। তারপর অনেক কথা হলো, আমি একসময় তাকে বললাম সবকিছু ঠিক করে নাও। সে কিছু বলে নাই, কথা এড়িয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে গেছে।

– বাবা কোথায়?

– বাইরে গেছে। সন্ধ্যার পরে সে হাঁটতে বের হয়। রাত নয়টার দিকে বাসায় আসে।

– এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?

– না না কি সমস্যা হবে? বরং আরো ভালো লাগে বেশি। ফাহিম তো সারাক্ষণ নানার সঙ্গে থাকে।

ফাহিম আকলিমার একমাত্র ছেলে। আকলিমা বললো,

– তুইও এখানে চলে আয়। ফারজানা যেহেতু কর থাকবে না তখন একা একা খাবি কি?

সফিক হাসলো।
– আপা আমার খাবারের চিন্তা করতে হবে না।
তুমি বাবার খেয়াল রেখো, টাকাপয়সার দরকার হলে আমাকে বলো।

– তোর কি শরীর খারাপ?

– আমি আজ উঠি আপা!

– সে কি? রাতে খেয়ে তারপর যাবি। বাবা আসুক বাবার সঙ্গে দেখা করে যা। বাসায় তো কাজ নেই তাই না?

সফিক চুপচাপ বসে রইল। রাতে তার দুলাভাই এসে তার সঙ্গে বসে আমজাদ চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে লাগলো। শফিকের বাবা এসে সেই আলোচনায় অংশ নিলেন। সকল আলোচনা শেষ করে খাবার খেয়ে সফিক যখন বাসা থেকে বের হয় তখন রাত একটা।

★★★

আমজাদ চৌধুরীর মৃত্যুর পনের দিন পেরিয়েছে। অফিসের সামনে বিশাল ব্যানারে শোক প্রকাশ করার চিত্র ঝুলছে।
” আমজাদ চৌধুরীর আকস্মিক মৃত্যুতে সবাই গভীরভাবে শোকাহত। ”

নিধি এখন তার বাবার অফিসে বসেন। সপ্তাহ খানিক ধরে তিনি সবকিছু দেখাশোনা করেন। বাবার মৃত্যুর অস্বাভাবিক ঘটনা সে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করেছে। পুলিশের তদন্তের দরকারে সে শুধু বলেছে “আমার কোনো অভিযোগ নেই।”

সফিকের চাকরি চলে গেছে। চারদিন আগে নিধি ম্যানেজারকে ডাকেন, তার সঙ্গে আরো দুজন ছিল। নিধি ম্যানেজারকে বলেন,

– অফিসের সবার কাজকর্ম মোটামুটি দেখলাম। সফিক সাহেবের তো কোনো কাজ নেই, তাকে রেখে আমাদের লাভ কি?

– আপনার বাবা তাকে খুব পছন্দ করতেন।

– বাবা নেই, তাই সেখানে তার পছন্দের মানুষ রেখে কি করবো? বাবা যাকে পছন্দ করতেন তাকে আমার পছন্দ নাও হতে পারে।

– আমাদের যতগুলো ব্যবসা আছে সবকিছুই সফিক সাহেব জানেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে সফিকের অনেক অবদান আছে। স্যার সবসময় সফিকের উপর ভরসা করতেন।

– বাবা সবসময় মানসিক সমস্যার মধ্যে থাকতেন তাই কাজকর্ম সবটা সফিক সাহেব দেখতো। আমি মানসিক সমস্যার মধ্যে নেই সুতরাং আমার তাকে দরকার নেই, বুঝতে পেরেছেন?

– জ্বি ম্যাডাম।

– কোম্পানির নিয়মানুযায়ী তাকে দুই মাসের বেতন দিয়ে বিদায় করুন। বাকি সবাইকে একটু সতর্ক হতে বলবেন, আরো অনেকে ছাটাই হতে পারে।

অফিসে এসেই সফিক ঘটনা জানতে পারে। সে তেমন কিছু বলে নাই, দুই মাসের বেতন নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। রূপা সেদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে না, তার সেদিন সারাক্ষণ মন খারাপ ছিল। বাসায় ফিরে নিজের বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে কেঁদেছিল।

সপ্তাহ খানিক পরের ঘটনা।
রূপা তার ডেস্কে কাজ করছে। আজকাল সে নিধি চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করে। সে সারাক্ষণ নিধির হুকুমের অপেক্ষা করে থাকে। চাকরিতে তার মন স্থির থাকে না, কিন্তু চাকরি না করে উপায় নেই।

– কেমন আছো রূপা?

রূপা তাকিয়ে দেখে সফিক তার দিকে তাকিয়ে আছে। রূপা হাসতে ইচ্ছে করছে, তার ইচ্ছে করছে সে বলে ” স্যার আমি ভালো নেই, আপনি চলে গেছেন তারপর থেকে আমি আর শান্তিতে কাজ করতে পারি না। রাতে ঘুমাতে গেলে আপনার কথা ভাবতে থাকি৷ সকালে অফিসে এসে আপনার কাছে বকা শুনতে ইচ্ছে করে। ”

রূপা কিছু বললো না, আজ সফিক তাকে রূপা বলে ডেকেছে। তারমানে স্যার এতদিন কাজের চাপে তার নাম ভুলে যেত মনে হয়।

– তোমার ম্যাডাম অফিসে আছে?

– জ্বি স্যার।

– তাকে গিয়ে আমার কথা বলো, বলো যে সফিক সাহেব এসেছে।

রূপা দৌড়ে গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গে আবার বের হয়ে এসে বললো,

– ম্যাডাম আপনাকে যেতে বলেছেন।

সফিক সামান্য হাসলো, তারপর নিধি চৌধুরীর রুমের দিকে গেল। যে রুমে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার বাবা আমজাদ চৌধুরী থাকতেন।

– কেমন আছেন সফিক সাহেব?

– জ্বি ভালো।

– আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আসবেন না। কিন্তু আপনি এসে আমাকে অবাক করেছেন, আমি সত্যি সত্যি অবাক হলাম।

– আসবো না কেন?

– বিনা নোটিশে আপনাকে বরখাস্ত করলাম। খানিকটা অপমানের মতো বটে, তাই রাগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আসার সম্ভাবনা কম।

– প্রয়োজন অপ্রয়োজন সবার জীবনে থাকে। আপনার বাবার কাছে আমি প্রয়োজনীয় ছিলাম, আপনার কাছে অপ্রয়োজনীয়। সুতরাং এখানে রাগ অভিমানের কিছু নেই। তাছাড়া আমাকে তো বিনা নোটিশে বরখাস্ত করা হয়নি, নোটিশ দিয়ে দুমাসের বেতন দেওয়া হয়েছে।

– মৃত্যুর তিনমাস আগে থেকে বাবা আমার নানা বাড়ির এলাকায় মায়ের নামে একটা হাসপাতাল করতে চেয়েছে তাই না?

– জ্বি। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল, এ মাসে কাজ শুরু হবার কথা ছিল।

– বাবা ভেবেছিলেন এরকম কিছু করলে আমি তাকে ক্ষমা করবো। খুশি হয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে তার কাছে চলে আসবো।

– আচ্ছা।

– আপনাকে আমি একটা কাজের জন্য ডেকেছি।

– বলেন।

– আমি হাসপাতালের কাজটা শুরু করতে চাই। সম্প্রতি আপনার ডিভোর্স হয়েছে, শুনলাম এখন একা একা থাকেন। তাই আমি চাই আপনি এই হাসপাতাল তৈরির সব দায়িত্ব গ্রহণ করুন।

– নতুন করে চাকরি করতে বলছেন?

– অনেকটা সেরকম, তবে আপনাকে সবসময় গ্রামের বাড়িতে থাকতে হবে।

– ঠিক আছে আমার আপত্তি নেই।

– একটা কথা বলি?

– বলেন।

– মৃত্যুর আগে আপনি বাবার রুম থেকে বের হবার পরই আমি বাবার কল রিসিভ করি। বাবা যখন মারা গেছে তখন আমি বাবার সঙ্গে কথা বলছিলাম।

সফিক তাকিয়ে রইল। নিধি অপলক দৃষ্টিতে সফিকের দিকে তাকিয়ে বললো,

– যে মানুষটা আপনাকে এতো পছন্দ করতেন তাকে এভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেন কেন? আপনার কি একটুও কষ্ট হয়নি তার জন্য?

সফিক যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। নিধি এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে, তার মুখে হাসিহাসি ভাব।

চলবে….

~~~ মো: সাইফুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here