তুমি শুধুই আমার,(২য় পর্ব অন্তিম পর্ব )

#তুমি শুধুই আমার,(২য় পর্ব অন্তিম পর্ব )
#মাকসুদা খাতুন দোলন

খাওয়ার পর্ব শেষ করে মৃদুল,দীপা ড্রইংরুমে গল্প করতে বসলো। মৃদুলের ইচ্ছে পাঁচ দশ মিনিট কথা বলে দীপাকে নিয়ে বের হয়ে আসবে। মৃদুলের মায়ের খালাতো বোন নাজনীন চৌধুরী দীপাকে ডেকে উনার বেডরুমের খাটে বসালেন। উনার শ্বশুরবাড়ির এক ঘটনা দিয়েই
কথা শুরু করলেন। বিয়ের পর গ্রামে উনার শ্বশুরবাড়িতে কাটানো দিনগুলোর স্মৃতি চারণ করছেন। দীপা মুগ্ধ হয়ে শুনছে। হাসির কথা শুনলে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। দীপার খুব ভালো লাগছে। সময় কীভাবে চলে যাচ্ছে দীপা টেরই পাচ্ছে না। মৃদুলের গল্প শুনতে ভালো লাগছে না। দু’বার এসে দীপাকে নিঃশব্দে ইঙ্গিত দিয়ে বুঝিয়ে গেছে ড্রইংরুমে চলে আসার জন্য। দীপা বুঝেও না বোঝার ভান ধরে থাকে। মৃদুল তার খালাকে খুব ভয় পায়। দীপাকে নিয়ে এখনি চলে আসার কথা বললে নির্ঘাত ধমক শুনতে হবে।
তাই কিছু বলছে না। মৃদুলের অস্থির লাগছে। মনে মনে দীপাকে বকা দিচ্ছে,

‘এই গাধিটা বুঝে না কেন আমি ডাকছি। নিজে তো কিছু বুঝেই না। আমি দু’বার ইশারা দিলাম। সেটাও বুঝে না।’

মৃদুল আবার বেডরুমে আসে। নাজনীন চৌধুরী
তার নিজের কথার রেশ ধরেই আওয়াজ তুলে হাসছেন। মৃদুলকে দেখেই বললেন,
‘তুই আমাদের সিক্রেট কথা শুনে কি করবি?
এখানে আমাদের মেয়েদের গল্প চলছে।
ড্রইংরুমে যা। তোর খালুর কাছ থেকে হাদীস শোন গিয়ে। মৃদুল বলল,
‘খালা,আজ চলে যাই। অন্যদিন আবার আসবো।’
‘রাতের খাবার খেয়ে তারপর যাবি। তোদের বাড়ি পাঁচশো মাইল দূরে না। বুঝলি? তোর বেশি কাজ থাকলে তুই চলে যা। দীপা থাকুক। খাবারের সময় হলে আসিস খেয়ে দীপাকে নিয়ে চলে যাবি। এখন খুব ইন্টারেস্টিং গল্প চলছে। দীপাকে কোনোভাবেই ছাড়া যাবে না।’
দীপা মৃদুলের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে মুচকি হাসছে।
মৃদুল আবার শান্তস্বরে বলল,
‘খালা বুঝই তো। এখন বাসায় অনেক কাজ। কাছের লোকজন আসবে বাড়ির বৌ দেখার জন্য। দীপাকেই এখন সবার প্রয়োজন।’
নাজনীন চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন,
‘তোর যে বেশি প্রয়োজন। সেটা বলছিস না কেন?’
‘সেটা বুঝলে তো দু’জনকে আটকে রাখতে না।’
কথাটা বলেই মৃদুল দীপার দিকে তাকিয়ে
হাসলো। নাজনীন চৌধুরী খাট ছেড়ে দেয়াল ক্যাবিনেট খুলে দুটো প্যাকেট বের করলেন। একটা প্যাকেট দীপার হাতে দিলেন। অন্যটি মৃদুলের হাতে দিলেন।
‘তোকে ব্লেজারে খুব সুন্দর দেখায়। ব্লেজারের কাপড় দিলাম। বানায়ে নিস। শীতে পরবি।’
মৃদুল এক গাল হাসি দিয়ে বলল,
‘খুব ভালো। বানানোর খরচাটা কবে দিবে খালা?
‘তুই আগে বানাতে দে। তারপর দেখছি।’
নাজনীন চৌধুরী আবার খাটের কোণায় দীপার কাছে বসলেন।
‘কালো মসলিন শাড়ির জমিনে,পাড়ে আর আঁচলে গোল্ডেন সূতার ভরাট কাজ। শাড়িটা তোমার পছন্দ হবে কিনা জানি না। আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’
দীপা খালা শাশুড়ির কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘খালাম্মা,শাড়িটা যেমনি হোক। যে দামেই কিনেন না কেন। আপনার ভালোবাসা মিশ্রিত এই উপহার আমার কাছে অনেক মূল্যবান।’
কথাটা শেষ করে দীপা মাথা নুইয়ে হাত বাড়িয়ে সালাম করতে নিলে খালা শাশুড়ি দীপাকে বুকে মিশিয়ে নিলেন।
‘অন্তরটা ভরে গেল মা! দোয়া করি সুখী হও। জীবনে সফলতা আসুক।’
খালা,খালুকে সালাম দিয়ে,দোয়া চেয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হলো মৃদুল,দীপা। দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মৃদুল দীপার হাত থেকে শাড়ির প্যাকেটটা নিজের কাছে নিল।
‘এখন হাঁটতে সহজ হবে। সন্ধ্যা হতে এখনও প্রায় একঘন্টা বাকি। সময়টা দু’জনে কাজে লাগাতে পারি।’
দীপা বলল,
‘কীভাবে?’
কাছেই ছোট্ট একটা লেক আছে। ঠিক লেক বলা যাবে না। খালের মতো কিছু একটা ছিল। বেশ নোংরা থাকতো। সিটি কর্পোরেশনের লোকজন সদয় দৃষ্টি দিলে খালটিতে নতুনত্ব আসে। এখন পানিও স্বচ্ছ,টলটলে। কিছু গাছপালাও আছে। বসার জায়গাও আছে। পাশেই খেলার মাঠ। ঝালমুড়ি, ফুচকা,চটপটি,সবই পাবে। বিকালে প্রকৃতির হিমেল হাওয়ায় খানিকটা প্রশান্তি পেতে অনেকেই এখানে আসে। মা দাদিজানকে নিয়ে হাঁটতে প্রায়ই এখানে আসেন। কথা বলতে বলতে লেকের কাছেই চলে আসে মৃদুল। দীপা চারপাশটা দেখেই বলল,
‘পরিবেশ মন্দ না।’
‘হুম।’
‘কি খাবে? চটপটি না ফুচকা?’
‘কিছুই না।’
মৃদুল আঙ্গুল দেখিয়ে বলল,
‘চলো ঐ জায়গাটায় বসি।’
দীপা কথা না বলে বসার জায়গায় এগিয়ে যাচ্ছে। পিছনে পিছনে মৃদুল হাঁটছে। দু’জনে দূরত্ব রেখেই পাশাপাশি বসেছে। চুপচাপ কিছু সময় চলে যায়। হঠাৎ দীপা শান্তগলায় বলল,
‘কিছু কথা ছিল।’
‘বলো।’
নারী পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। একজন ছাড়া অন্যজন পরিপূর্ণ না। প্রত্যেকেই চায় একজন মনের মতো জীবনসঙ্গী আসবে। যে কিনা হবে অনেক বেশি নির্ভরতার,বিশ্বস্ততার এবং ভালোবাসার। আমিও স্বপ্ন দেখেছি। এমনটাই প্রত্যাশা করেছি। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মিল হলেও কিছুদিন পর সবকিছু হারাতে হবে। অযথা কেন মিছে মায়া,ভালোবাসায় জড়িয়ে নিচ্ছেন। আবেগের স্রোতে ভাসাচ্ছেন।
আমার যে কতখানি কষ্ট হচ্ছে এবং পরে অনেক বেশি কষ্ট হবে সেটা বুঝেন আপনি??
দীপার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো মৃদুল।
এরপর বলল,
দীপা,আমি সবকিছুতে স্বচ্ছতা পছন্দ করি।
মানবিক মানুষদের শ্রদ্ধা করি,ভালোবাসি। নিজেও মানবিক হওয়ার চেষ্টা করি। কতটা পারি জানি না। ভুলত্রুটি সবার জীবনে থাকে। আমার জীবনে যা ঘটেছে তার সবকিছু তোমাকে বলেছি।
বিয়ের পর স্ত্রীর ভরণপোষণ,মানসিক,শারীরিক
সুস্থতা,সবদিক সার্পোট দেওয়া,তাকে সব সময় ভালো রাখা, হাসিখুশি রাখা,সুখে রাখা একজন স্বামীর দায়িত্ব,কর্তব্য। ন্যান্সির আর আমার সর্ম্পক গোপন রেখে স্বামীর অধিকার নিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে ভালো হতো?? ধর্মীয়,সামাজিক রীতিতে তুমি তো আমার বৈধ স্ত্রী। আমাদের বন্ধন পবিত্র। তোমার উপর আমার পূর্ণ অধিকার আছে। বলো ঠিক কিনা? অস্ট্রেলিয়া গিয়ে ন্যান্সিকে বিয়ে করে পরে তোমাকে জানালে অথবা তোমাকে না জানিয়ে ঐখান থেকে বিচ্ছেদ ঘটালে তুমি কতটা আঘাত পেতে বলো? এই সক্ট কীভাবে কাটিয়ে উঠতে? তুমি তো কোনো দোষ করোনি। আমি কেন তোমার সারাজীবনের কান্না হয়ে বেঁচে থাকবো? আমি কেন তোমার দীর্ঘশ্বাস হবো? আমি সেরা হতে না পারি কারো চোখে খারাপ হতে চাই না।
এই জন্য তোমার সাথে সবকিছু খুলে বলেছি।
বিয়ের প্রথম রাতেই আমার কাছ থেকে বড় একটা ধাক্কা খেয়েছো। আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা। তোমাকে হাসিখুশি রাখতে,একটুখানি আনন্দে রাখতে চেষ্টা করছি। বাড়ির প্রিয়,কাছের মানুষগুলোকে সব সময় সুস্থ ও ভালো রাখতে চেয়েছি এবং চাই। আমার কারণে কোনো কিছু ঘটে যাক তা চাই না। তোমার চোখে হয়তো অন্যায় করছি,ভুল করছি। ঠিক এই সময়ে আমার কি করা উচিত তুমিই বলো। এইজন্য প্রথম রাতেই তোমার পছন্দের কথা জানতে চেয়েছি। কাউকে ভালোবাসো কিনা। নিজের কথাগুলো অকপটে তোমাকে বলেছি।’
মৃদুল কথা শেষ করে চুপ করে থাকে। দীপার মুখেও কোনো কথা নেই। মৃদুল হেসে আবার বলল,
তোমার মতো সুন্দরী,শিক্ষিতা,মায়াবী,মিষ্টি মেয়ের যে পছন্দ ছিল না তা বিশ্বাস হতে কষ্ট হচ্ছে। সত্যিই কাউকে ভালোবাসতে না? কেউ তোমার প্রেমে পড়েনি?
দীপা স্মিত হেসে বলল,
‘একজন পড়েছিল।’
‘নাম কি তার?’
‘পলাশ। ক্লাসমেট ছিল।
‘তুমি পছন্দ করতে না?’
‘না। শুধু বন্ধু হিসাবে পছন্দ করতাম।’
দীপা খোলা আকাশের অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল,
‘এখন একজনের প্রেমে পড়েছি।’
‘কার?’
‘বলবো না।’
‘ঠিক আছে। শুনতে চাই না।’
বাদামওয়ালা দেখে মৃদুল জিজ্ঞেস করলো, ‘বাদাম খাবে?’
দীপা না সূচক মাথা নাড়লো।
‘মাগরিবের আযান দিয়ে দিবে। চলুন এবার উঠি।’ দীপা কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো।
দু’জনে নিঃশব্দে হাঁটছে। মসজিদ থেকে
মাগরিবের আযানের সুমধুর সূর ভেসে আসে কানে।

বাসায় ফিরে দীপা সব চেঞ্জ করে তাড়াতাড়ি ওযু করে দুটো জায়নামাজ বিছিয়ে নিজে একটিতে নামাজ পড়তে শুরু করলো। মৃদুল ল্যাপটপ হাতে নিয়েও রেখে দিল। দুটো জায়নামাজ বিছানো দেখে ওযু করতে ওয়াশরুমে গেলো।

দীপা নামাজ শেষ করে গিফটের প্যাকেট দুটো নিয়ে শাশুড়ির ঘরে গেলো। উনাকে দেখতে না পেয়ে দাদি শাশুড়ির ঘরে গেলো। কামরুন্নেছা বেগম চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। শাশুড়ি হাতেপায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছেন। দীপা প্যাকেট দুটো রেখে দাদি শাশুড়ির মাথার কাছে বসে কপালে হাত রাখলো।
‘মা,কখন দাদিজানের শরীর খারাপ করেছে?
ফোন দিলেই তো হতো। চলে আসতাম।’
মা’র শরীর খারাপ করে নি। সকাল আর সন্ধ্যায় হাতে পায়ে তেল মালিশ করতে হয়। স্ট্রোকের পর থেকে হাত পা ঝিমঝিম করে। শিউলির মায়ের গ্রাম থেকে এক কবিরাজ এই তেলটা দিয়েছে। সকালে শিউলির মা এসে মালিশ করে দেয়। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর আমি দেই। দীপা বলল,’মা,আমাকে দিন আমি মালিশ করে দেই।’ শাশুড়ি বললেন,’আজ আর দিতে হবে না।’ এর মধ্যে দীপার শ্বশুর মসজিদ থেকে আসলেন। দীপা দেখেই কাউকে কিছু না বলে চা করার জন্য কিচেনে আসে। চা করে বিস্কিটের কৌটা খুঁজে সবার জন্য ট্রে-তে চা,বিস্কিট নিয়ে
আসে। মৃদুলকে চা দিতে গিয়ে দেখে মৃদুল মোবাইলে কথা বলছে। সামনে চায়ের মগ রেখে আবার দাদি শাশুড়ির ঘরে চলে আসে দীপা।
চা শেষ করে প্যাকেট দুটো থেকে শাড়ি আর ব্লেজারের কাপড় বের করে দীপা বলল,
‘মা,নাজনীন খালা দু’জনকে এইসব গিফট করেছে। শাশুড়ি শাড়িটা মেলে বলল,’শাড়িটা খুব সুন্দর। বেশ গর্জিয়াস।’ দাদি শাশুড়ি চায়ে বিস্কিট ভিজিয়ে চা খাওয়া শেষ করলেন।
শাড়ি চোখের সামনে ধরে বললেন,’চশমা ছাড়া কিছুই তো দেখি না। দীপা বইন চশমাটা দে! কী শাড়ি কাপড় দিল বৌ’য়ের বইন।’ দীপা টেবিল থেকে চশমা নিয়ে দাদি শাশুড়ির চোখে পরিয়ে দিল। শাড়ি দেখে এবার উনি বললেন,’শাড়ি কাপড় ভালাই হইছে। তোরে মানাইবো।’

দীপা রাতে একবারের জন্যও মৃদুলের ঘরে যায় নি। তার খেতেও ইচ্ছে করছে না। একটু ঘুমাতে পারলে ভালো হতো। চুপচাপ দাদি শাশুড়ির খাটে শুয়ে ভাবতে থাকে। এই মূহুর্তে চাকরিটা ভীষণ প্রয়োজন ছিল। চাকরি নিয়ে আমার মতো করে সময় কাটাতে পারতাম। সরকারি হাই স্কুলে লিখিত পরীক্ষা দিলাম সেই কবে। রেজাল্ট কবে হবে কে জানে? কোনো বইপত্রও সঙ্গে আনিনি যে লেখাপড়া শুরু করবো। আল্লাহ তুমি আমার একটা সুখবর দিও। দাদি শাশুড়ি,শাশুড়ি কয়েকবার দীপাকে ডেকে উঠানোর চেষ্টা করছেন। দীপা উঠে নি। মৃদুল ভাবছে দীপা হয়তো তার দাদির সাথে গল্প করছে। খেতে এসে দীপার খোঁজ করলে তার মা বললেন,’দীপা সেই কখন তোর দাদির ঘরে ঘুমিয়েছে। কতবার ডাকলাম। উঠলোই না। ‘মৃদুল সাথে সাথে কামরুন্নেছার ঘরে আসলেন। মৃদুলকে দেখেই উনি বললেন,
‘তোর বউ বেভোর ঘুম দিছে। কোনো চেতন নাই।
কোলে করে তোর ঘরে নিয়ে যা। আমি তাহাজ্জুদ,ফজরের নামাজের জন্য ভোরে
ঘরের বাতি জ্বালাই। দীপার ঘুম হইবো না।’
মৃদুল দীপার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর বললো,
‘থাক। ও আজ তোমার কাছেই ঘুমাক। এখন ডাকলে মাথা ব্যথা করতে পারে। আমি বরং তোমার খাটের মশারি টাঙিয়ে দেই।’
মৃদুল মশারি টাঙিয়ে চারপাশে গুঁজে দিল।
দীপা কোনো সাড়াশব্দ না করে চুপ করে সবার কথাগুলো শুনলো। প্রতিদিন কোনো অজুহাতে দাদির ঘরেই ঘুমাবো। মৃদুলকে কষ্ট করে ডিভানে শুতে হবে না। মৃদুলের কেন জানি খেতে ইচ্ছে করলো না। টেবিলে বসেও উঠে গেলো। মা পিছন থেকে কয়েকবার ডাক দিলে বলল,
‘পেট ভরা আছে। খালার বাসায় অনেক খেয়েছি।’
সকালে দাদি শাশুড়িকে খাইয়ে দিয়ে নাস্তার টেবিলে সবার সাথে দীপা খেতে বসলে মৃদুল এক ফাঁকে কানের কাছে বলল,
‘রাতে না খেয়ে ঘুমালে কেন?’
‘এমনি’
‘আমিও খাইনি’
‘খুব ভালো।’

সংসারের টুকটাক কাজ,দাদি শাশুড়ির সেবা, যত্ন নিয়েই দীপার সময় যাচ্ছে। মৃদুল বাসায় নেই। বিকালে মলিন মুখে বারান্দার গ্রিল ধরে আনমনে ভাবছে দীপা। শাশুড়ি কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠে। শাশুড়ির দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই উনি বললেন,
‘ঘরে চলো। কথা আছে।’
‘কি কথা মা? এখানেই দু’জনে বসি। বিকালের হাওয়াটা আমার খুব পছন্দ।’
‘ঠিক আছে। সেই ভালো।’
উনি বসে কথা শুরু করলেন,
‘দীপা, বিয়ের আগে অনেক ছেলেমেয়ের পছন্দ থাকে। অস্বাভাবিক কিছু না। মৃদুল তার এক বান্ধবীর কথা বলছিল অস্ট্রেলিয়া লেখাপড়া করতে চলে গেছে। সে সম্ভবত ঐ মেয়েটাকে পছন্দ করে। মৃদুলও চলে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। মৃদুল আমার একমাত্র ছেলে। আমি চাই না,তোমার শ্বশুরও চায় না মৃদুল বিদেশ চলে যাক। লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে করে ঐখানেই থেকে যাক। মা,বাবার জন্য অনেক টাকা পয়সা পাঠাক। ব্যস্ততার জন্য মা,বাবাকে ভুলে যাক।আমরা খালিঘরে পড়ে মরে থাকি। আমার এত টাকা,খ্যাতির দরকার নাই। যতটুকু আছে তা নিয়ে খুব ভালো আছি। একটাই ইচ্ছে মরার পর ছেলেটা যেন মা,বাবা,তার দাদির লাশ কাঁধে নিয়ে কবরে শোয়ায়। নামাজ পড়ে সবার জন্য দোয়া করে। তুমি কোনোমতেই ওকে বিদেশ যেতে দিবে না। ওর মাথা থেকে বিদেশের ভূতটা দূর করে দাও। ধর্মীয় এবং আইন অনুযায়ী তুমিই তার স্ত্রী। তুমিই বর্তমান তুমিই ভবিষ্যত। তুমি তোমার মায়া,আদর,ভালোবাসার বন্ধনে আটকে রাখো। তুমি কষ্ট পেয়ে,অভিমানে মৃদুলের কাছ থেকে দূরে থাকবে না। এটা আমার রিকোয়েস্ট।
মৃদুলকে চোখের আড়ালে রাখবো না বলেই ওর দাদির সাথে পরামর্শ করে তড়িঘড়ি করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেই। এই পাঁচ ছ’মাস কি যে টেনশনের মধ্যে ছিলাম তোমাকে বুঝাতে পারবো না। তোমার শ্বশুর,দাদি শাশুড়ির অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। আল্লাহকে ডাকছি আর ডাক্তারের কাছে ছুটে গেছি। শোন দীপা,সামনে বৌভাতের অনুষ্ঠান। মৃদুলকে নিয়ে যা যা লাগে শপিং করে নিও। দীপা বলল,
‘না মা। বিয়ে তো হয়েই গেছে। হলুদ,বৌভাত এসব দরকার নাই। বিয়ের দিন যে গয়না,শাড়ি দিয়েছেন যথেষ্ট। প্রয়োজন হলে আমি মৃদুলকে নিয়ে কিনে নিব। দাওয়াত করে লোকজন খাওয়ানোর চেয়ে ঐ টাকা দিয়ে কোনো এতিমখানায় গরীব বাচ্চাদের দু’দুবার খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে দিলে খুবই ভালো হবে মা।’
‘খুবই ভালো আইডিয়া মা। তুমি মৃদুলের সাথে কথা বলো দেখো ও কি বলে। আবার মনে মনে আক্ষেপ করো না গায়ে হলুদ,বৌভাত হলো না।
বিয়ের অনুষ্ঠানগুলি তো বারবার হয় না। তোমরা ভেবেচিন্তে ঠিক করো।

দু’দিন পর দুপুরে দীপার বান্ধবী আনজু হঠাৎ ফোন দিয়ে বলল,’দীপা সরকারি হাই স্কুলের লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট হইছে। আমি টিকে গেছি। আজকের দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় দেখ। না হলে ইন্টারনেটে দেখ।

দীপার রোল কত ছিল ভুলে গেছে। তাড়াতাড়ি বাবার কাছে ফোন দিয়ে রোল নাম্বার সংগ্রহ করে দৌড়ে গেল মৃদুলের কাছে। মৃদুল শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। দীপা বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে মৃদুলের কাছে বসে শরীর ছুঁয়ে ডাকছে,এই মৃদুল উঠুন! একটা বিশেষ খবর আছে। দেরি সহ্য হচ্ছে না দীপার। আবার শরীর নেড়ে বলল, ‘ইশ্ উঠুন তো!’ মৃদুল সজাগ শুয়ে থাকে। মৃদুল চাইছে দীপা তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আরও কিছু সময় ডাকুক। কাছে থাকুক। দীপা মৃদুলের কপালে হাত রাখলো। এখন আর আওয়াজ করে মৃদুলকে ডাকছে না। আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে চুলে আঙ্গুল নাড়ছে। মৃদুস্বরে বলছে,
‘আজ কি হলো? ঘুম থেকে উঠছে না কেন?
শরীর খারাপ করে নাই তো? মৃদুলের মুখের কাছে নিজের মুখ নিয়ে গভীরভাবে দেখছে। মৃদুল চোখ বন্ধ রেখেই দু’হাতে দীপাকে জড়িয়ে ধরে। দীপা লজ্জায় নিজেকে ছাড়িয়ে খানিকটা সরে আসে। দু’জনেই কিছু সময় চুপচাপ।
নীরবতা ভেঙে মৃদুল বলল,’কি জন্য ডাকছিলে?’
‘আপনি সজাগ ছিলেন?’
‘হুম’
‘উঠেন নি কেন?’
‘প্রথমে উঠলে কি তুমি এতবার আদর করে ডাকতে?’
‘আপনি একটা…..’
‘কি?’
‘পাজি’
‘হুম,অনেক পাজি। বুঝতে পারবে। এখন বলো
কি দরকারে ডাকছিলে?’
‘ইন্টারনেটে একটা রেজাল্ট দেখতে হবে। এই যে রোল নাম্বার।’
‘কিসের রেজাল্ট?’
‘সরকারি হাই স্কুলে।’
‘ওও তাই নাকি? খুব ভালো।’
মৃদুল দ্রুত ল্যাপটপ বের করে খাটে বসে নেট ঘাঁটতে শুরু করলো। দীপা মৃদুলের পাশে বসে আছে। চোখে,মুখে টেনশনের ছাপ। মৃদুল দীপার নাম্বারটি বারবার মিলিয়ে দেখছে। নাম্বারটি দেখতে পেয়ে মুখ ভার করে জিজ্ঞেস করলো,
‘পরীক্ষা কেমন হয়েছিল?’
‘ভালো। আমি আশাবাদী। আমি লিখিত পরীক্ষায় টিকবো।’
‘খুঁজে পেলাম না তো’
দীপার মুখটা মলিন হয়ে যায়। চুপচাপ বসে থাকে। মৃদুল ল্যাপটপ বন্ধ করে চলে যায় ফ্রিজের কাছে। ছোট্ট প্লেটে দুটো মিষ্টি নিয়ে দীপার কাছে আসে।
‘হা করো। তোমাকে মিষ্টি খাইয়ে সুখবরটা দিব।’
দীপা চোখ বন্ধ করে হা করে। মৃদুল দীপার মুখে আধেক মিষ্টি পুরে দিয়ে দুটো চোখের পাতায় আলতো করে অধর ছুঁয়ে দেয়।
দীপা চোখ খুলে প্লেট থেকে বাকি আধেক মিষ্টি মৃদুলের মুখের সামনে ধরতেই মৃদুল দীপার হাত ধরে মিষ্টি মুখে নেয়।

মৃদুল,দীপা দু’জনেই সুখবরটা বাসার সবাইকে জানায়। শ্বশুর,শাশুড়ি খুব খুশি হন। সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া শেষ করে। দীপা দাদি শাশুড়িকে ঔষধ খাইয়ে নিজের ঘরে আসলো। মৃদুলের হাতে মোবাইল নেই। টিভি ছেড়ে শুয়ে গান শুনছে।
দীপা খানিকটা অবাক হলো। জিজ্ঞেস করলো,
‘ন্যান্সি কেমন আছে?’
‘অনেকদিন কথা হয় না।’
‘আপনার বিয়ের কথা জানে?’
‘হুম’
‘কি কথা হয়েছে চ্যাটে দেখো।’
মৃদুল ইনবক্স ওপেন করে মোবাইল দীপার হাতে দিল। দীপা সব পড়ছে,
‘ন্যান্সি,আমার কোনোকিছু তোর কাছে অজানা নয়। নিজের কথা,পরিবারের কথা আজ পর্যন্ত কোনোকিছু গোপন করিনি। দু’জনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকেই একে অপরের প্রতি দুর্বল হয়েছি। দু’জন দু’জনকে ভালোবেসেছি। প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেই। তুই তো জানিস দাদিজান প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। দাদি হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে যান। দাদির ইচ্ছে পূরণ করতেই বাবা আমাকে বিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত নেন। আমি গতকাল বিয়ে করেছি।’

‘অভিনন্দন। জন্ম,মৃত্যু,বিয়ে সৃষ্টিকর্তার হাতে। বিধাতা হয়তো দু’জনের মিল করবেন না তাই পড়ার সুবাধে দু’জন অনেক দূরে আছি। আমি ভাগ্যে খুব বিশ্বাস করি। মৃদুল,আমরা দু’জন যথেষ্ট এডাল্ট। টিএনজার বয়সটা পার করে এসেছি। একটা বয়সে মনে হতো আজই ভালোবাসার মানুষটাকে বিয়ে করে ফেলি। বড় হয়েছি,বাস্তবতা শিখেছি। স্বপ্ন দেখেছি জীবনে অনেক বড় কিছু হবো। প্রতিষ্ঠিত হতে হবে বুঝতে শিখেছি। আবেগকে প্রাধান্য দিলে,মা,বাবার অবাধ্য হলে প্রেমে পড়ার প্রথমেই বিয়ে করে ফেলতাম। আমি আর দেশে আসবো না মৃদুল। আমি ছাড়া তো আব্বু,আম্মুর কেউ নেই। আব্বু অবসরে গেলে দু’জনকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। আমার খুব কান্না পাচ্ছে মৃদুল। খুব কান্না পাচ্ছে। ভালো থাকিস। রাখছি…..

দীপা ন্যান্সির মেসেজ পড়ে চুপ হয়ে যায়। মৃদুলকে আর কোনো কথাই জিজ্ঞেস করেনি।
মৃদুলও চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে।
দীপা বাসায় ফোন করে মা,বাবাকে তার রেজাল্ট জানালো। বাসার সবার সাথে কথা বলল। মৃদুলকে ঘুমাতে দেখে দীপা দাদি শাশুড়ির ঘরে গেল। চুলে তেল দিয়ে পাকা চুলে বিনুনি করে দিল। কামরুন্নেছা বেগম বললেন,’কতদিন বাইরে যাই না।’ দীপা বলল,’দাদিজান চলেন আপনাকে বাইরে থেকে ঘুরিয়ে আনি।’
দীপা কামরুন্নেছা বেগমের হাত ধরে আস্তে আস্তে কিছু সময় হেঁটে চিপসের প্যাকেট
কিনে বাসায় আসলো।

সন্ধ্যায় দীপা চা করে মৃদুলকে খোঁজ করছে। বাসায় ছিল। এখন আর কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। ফোন দিবে মোবাইল হাতে নিতেই মৃদুলের নাম্বার স্কিনে ভেসে উঠলো। তাড়াতাড়ি কল রিসিভ করতেই মৃদুল বলল,
‘দ্রুত ছাদে আসো’
‘ঠিক আছে আসছি।’

দীপা ছাড়া চুল আচড়ে খোঁপা করে দুই মগ চা হাতে ছাদে চলে আসলো। চায়ের মগ এগিয়ে দিল। দু’জনে চা শেষ করলো। দীপা মগ দুটো পাশে রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃদুল দীপার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। মৃদুল ডানহাতে
দীপাকে নিজের দিকে টানলো। দীপা মৃদুলের কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে আছে। দু’জনেই চুপচাপ। বেশ কিছু সময় কেটে গেল অসীম নীরবতায়। মৃদুল শান্তস্বরে বলল,
‘দীপা,আমি অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি না। তোমাকে, মা,বাবা,দাদিজানকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না। এই মানুষগুলোকে ছাড়া আমি ভালো থাকবো না। দীপাকে ছাড়া মৃদুল অসম্পূর্ণ। দু’জনেই পুরোদমে লেখাপড়া শুরু করবো। দেশে থেকে প্রিয় মানুষগুলোর কাছে থেকে অনেক ভালো কিছু করবো। দীপা আবেগাপ্লুত হয়ে শুধু বলল,’তুমি শুধুই আমার। আর কারোর না’………..

————————সমাপ্ত—————

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here