নিরুদ্দেশ পর্ব ৩

নিরুদ্দেশ
পর্ব ৩

পুরুলিয়া জেলায় কুসুমগঞ্জ গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই সাঁওতাল সম্প্রদায়ের। হাতে গোনা মাত্র তিন-চারটি পরিবার রয়েছে যারা প্রাচীন ভারতের উত্তরাধিকারী এবং মধ্য-মধ্যবিত্ত। এক সময়ে এই তল্লাটে জমিদার হিসেবে শাসন শোষণ করে এসেছেন রায় পরিবার। তখন ঢের ধন-সম্পত্তির মালিক ছিলেন তাঁরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। আলসেমীময় জীবন যাপনের জন্য একটু একটু করে গৌরবময় ঐতিহ্যও হারিয়েছেন। এখন এ সমস্ত কিছু ধনসম্পত্তির মালিক শ্রী গৌরহরি রায়। যিনি সকলের কাছে রায়বাবু নামে পরিচিত। বয়স ষাট অতিক্রম হয়ে মাথায় সাদাকালো চুলে ভর্তি। বৃদ্ধ বেশ সহজ-সরল, কর্তব্যবিমূঢ়, দায়িত্ববান, ধৈর্যশীল এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী। পিতা ঈশ্বর সতীশ চন্দ্র রায়ের অতিরিক্ত ঢিলেমি এবং উৎশৃংখল ও অসংযত জীবনযাপনের জন্য প্রচুর সম্পত্তির বিনাশ হয়। পরবর্তী সময়ে গৌরহরি বাবু পরিশ্রমের জোরে পুরনো আধিপত্য আবার ফিরিয়ে আনেন। বর্তমানে তিনি কঠোর আশঙ্কায় ভুগছেন। তাঁর অবর্তমানে এই ধন-সম্পত্তির মালিক কে হবে? কোনো সন্তান যোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। বড়ো ছেলে অন্তিম সহজ-সরল উদাসীন হলেও ভীষণ মাদকতায় আসক্ত। জুয়ার নেশা নেই বললেও ভুল। এত সম্পত্তি শেষ করতে বেশি সময় নেবে না। বড়ো মেয়ে রূপা খুব উগ্র প্রকৃতির এবং অহংকারী। কারোর সাথে মিশতে চায় না। এত সম্পত্তির দায়িত্ব পেলে তার পা আর মাটিতে পড়বে না। মেজো মেয়ে কাজল এ সব টাকা পয়সা জমিদারি বোঝে না। তার নাচ-গান হলেই হল। সমস্ত ধন-সম্পত্তি তাকে দিলেও নেবে না সে। ছোট মেয়ে সাথী এখন চৌদ্দ বছরের কিশোরী। তাকে নিশ্চয়ই এ-সবের দায়িত্ব দেওয়া যায় না। একমাত্র এই পরিবারের যোগ্য উত্তরাধিকারী হতে পারে পুত্রবধূ অর্চনা। সে সৎ বুদ্ধিমতি পরিশ্রমী উগ্রতাশূন্য। কিন্তু সে সমস্ত কিছুর দায়িত্ব পেলে সন্তানদের মধ্যে যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এবার বর্ষা পেরিয়ে শরৎ আসতে ভুলে গেছে। উল্টে যেন গ্রীষ্ম ফিরে এসেছে। ছোট ছোট পাহাড় আর টিলা দিয়ে ঘেরা কুমুসগঞ্জের জনঘনত্ব খুব কম। লাল নুড়ি বিছানা পথে গাভী আর বাছুর নিয়ে বাড়ি ফিরছে সবুজ। সাথী জমিদার বাড়ির মেয়ে হলেও গরুর প্রতি আলাদা একটা ভালোবাসা রয়েছে। গরু প্রতিপালন করতে চাইলে সকলে বাধা দিলেও রায়বাবু বাধা দেননি। মেয়ের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে এই ভর দুপুরে মেয়ে মাঠে গরু আনতে আসবে তা শোভা পায় না। বাড়িতে দুজন কাজের লোক রয়েছে। তারা দেখে নেবে। তবে তাঁরা কেউ-ই জানে না সবুজ তাদের মতো জমিদার পরিবারের ছেলে। সবুজ নিজের পরিচয় লুকিয়েছে এ কথা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। সেদিন ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবে কোথায় থাকবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। ভোরের ট্রেনে উঠে পড়েছিল। তারপর পৌঁছে যায় পুরুলিয়ায়। পকেটে একটাও টাকা নেই অথচ খিদেতে পেট ছটফট করছে। খিদে খিদেই হয়। সে কখনও পকেটের সামর্থ্য বোঝে না। মাথার উপর ছাদ নেই। নিজেকে আশ্রয়হীন নির্বোধ অবোধ অসহায় লাগছিল। এইসময় ভগবান রূপে দেখা দেন রায়বাবু। বাড়িতে একটা কাজের লোকের প্রয়োজন ছিল। তিনি দোকানে দোকানে খোঁজ নিয়েছিলেন বাড়িতে কাজ জানে এমন সহজ সরল কোনো ছেলেমেয়ে রয়েছে কিনা! পাশের গঞ্জে এক ভুসিমাল দোকানি সবুজের সন্ধান দেয়। ছেলেটা গত পরশুদিন সকালে এই এলাকায় এসে কাজ খোঁজ করছিল। দেখে তো খুব সহজ সরল মনে হচ্ছিল। সমস্ত কাজ তার জানা।তার প্রতি খুব দয়া হয়েছিল তবে কাজ না থাকায় কোনো সুবিধা করে দিতে পারেনি। কথাটা শোনামাত্র বেশি দেরি করেননি রায়বাবু। ছেলেটিকে খুঁজে বার করেন। প্রথমে তার পরিচয় জানতে চায়। এত সুদর্শন কিশোর কেনই বা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে? সরল কৌতুক চোখের আড়ালে অসহিষ্ণুতা কোনো কিছু লুকিয়ে নেই তো? কিন্তু সবুজের সহজ-সরল কথাবার্তা স্পষ্ট জবাব রায়বাবুকে মুগ্ধ করেছিল। সবুজ বলেছিল, পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর বর্ণনা দিতে পারবে না সে। যদি দেয় তাহলে তারা কেউ-ই বিশ্বাস করবে না। তাকে মিথ্যা গল্প বানিয়ে বলতে হবে। যা কখনই সম্ভব নয়। কারণ, সে কখনও মিথ্যা বলে না। সে এও বলে,তার পরিচয়ে এমন কিছু নেই যে তাদের পরিবারে পরবর্তী সময়ে ক্ষতি হবে কিংবা কোনো ভাবে অসম্মানিত হবে। রায়বাবু ভীষণ খুশি হন। এটুকু ছেলের কথা শুনে মুগ্ধ হন। সে চাইলে অনেক খাস গল্প বলে মন ভোলাতে পারতো। কিন্তু তা করেনি। আর কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করে বাড়িতে রেখে দেন। মেদিনীপুরের সবুজ এই বাড়িকে মানিয়ে নিতে বেশি সময় নেয়নি। বাড়ির অন্য সদস্যদেরও বুঝতে দেয়নি যে সে একজন ধনী পরিবারের ছেলে। সাধারণ ভাবে থেকে গেছে।এত কাজে অভ্যস্ত ছিল না তবে কোনো কাজের প্রতি কার্পণ্যতা দেখায়নি। মাথা নিচু করে সমস্ত কাজ করে ফেলে। রায়বাবু সবুজকে পড়াশোনার কথা বলেন। এই বয়সে তার পড়াশোনা করা উচিত। চাইলে পড়াশোনা করতে পারে। সে রাজি হয়নি। বন্ধুকে দেওয়া প্রমিসের কথা বলে। তাই সে পড়াশোনা করতে পারবে না। সবাই হাসাহাসি করে। কেউ এই উদ্ভট কথা বিশ্বাস করেনি। তাতেও সবুজের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। যা সত্য তা সত্যই। অন্যের তাচ্ছিল্য তা কখনও মিথ্যা হয় না।
এত রোদে সবুজ কখনও বের হয় না। রোদে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। চারিদিকে ধু ধু পরিবেশ। কোথাও জনমানুষের সাক্ষাৎ নেই। যেন গ্রীষ্মকালের পড়ন্ত দুপুরবেলা। নির্জনতার গা ঘেঁষে বাড়ি পৌঁছালো। উঠোনের কিছুটা দূরে গাভী আর বাছুরকে গাছের সাথে বেঁধে দিল। এই সময় তরতর করে কমলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সবুজের সামনে দাঁড়ালো। তাকে দেখে করুনা হলো আবার হাসিও পেলো। বলল,’তোমায় কে বলেছিল মাঠে যেতে? অজানা রাস্তায় একা একা চলে গেছো? এ তো আমার কাজ।’ খুব সহজ হাসলো সবুজ। বলল,’এ বাড়িতে যা কাজ আছে তা তো দুজনের। আমার আর তোমার বলে কিছু হয় না। এতগুলো কাজ সারাদিনের মধ্যে দুজনকেই শেষ করতে হবে। কে বেশি করলো কে কম করলো তাতে আমি গুরুত্ব দেই না। তুমি বাড়ির সবাইকে খাবার দিচ্ছিলে তাই ভাবলাম আমি গরু নিয়ে চলে আসি।’
‘তুমি না সত্যি! তোমার বয়স কত? এত কাজ করার দরকার নেই। আমি তো আছি গুছিয়ে নেবো। এই বয়সে এত কাজ করা ভালো না।’ সবুজ মাথা নাড়ালো। কমলা তার ঘর্মাক্ত মুখমন্ডল দেখে ফিক করে হেসে ফেললো। এ অবস্থায়ও তাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এই বাড়িতে কাজ করে আসছে কমলা। এ বাড়ির সমস্ত সন্তানের চাইতে সে বড়ো। কাজের মেয়ে হলেও সবাই তাকে দিদির চোখে দেখে। সবাই সম্মান করে। কমলার হাতের রান্না সকলের পছন্দ। সে অনেক দিন ধরে থাকলেও তার সহকর্মীরা বারবার পরিবর্তন হয়েছে। হয়তো তার কাউকে পছন্দ হয়নি। তাই তার নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে। আবার কেউ কোনো কাজ না করে সব তার উপর চাপাতে চাইতো। আবার এমনও হয়েছে কেউ কোনো কাজ না জেনে চলে এসেছে। তবে এদের মধ্যে সবুজ সবচেয়ে আলাদা। দায়িত্ব সহকারে কাজগুলো শেষ করে। কোনো কিছুতে বেশি মাথা ঘামায় না। বাজার করতে গিয়ে দু-টাকা বেশি হলে সে-ই টাকাও ফেরত দেয়। বাড়িতে কত খাবার রয়েছে কিন্তু কাউকে না বলে একটুকরো খাবারও খায় না। বাড়ির জিনিস লুকিয়ে বিক্রি করে টাকা রোজগারের কথাও ভাবে না। অথচ কমলা এর ঠিক বিপরীত। বাড়িতে কাজ করে যত না টাকা রোজগার করে বাড়ির জিনিসপত্র লুকিয়ে বিক্রি করে কিংবা বাজার থেকে টাকা বাঁচিয়ে তার চাইতে অনেক বেশি রোজগার করে। সবুজ আসার পর একটু ভয় পেয়েছিল। হয়তো তার ভাগে ভাগ বসাবে। তাই সে সবকিছু সবুজকে বলে। লোকানো যা রোজগার হবে তা অর্ধেক অর্ধেক। কিন্তু সবুজ তার কথায় রাজি হয়নি। উল্টে বলেছিল,সে যাই করুক না কেন তাতে তার কিছু আসে যায় না। কিন্তু তার সামনে যেনে কোনো ভাবে অন্যায় কাজ না করে। যদি ভুলেও করে ফেলে তাহলে সে-ই সাংবাদ রায়বাবুর কাছে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবে না। সে নিজে অন্যায় করে না আর তার সামনে কোনো অন্যায় হতেও দেবে না। কারণ,সে রবি ঠাকুরকে বিশ্বাস করে। রবি ঠাকুর বলেছেন যে অন্যায় করে আর যে অন্যায় সয় দুজনেই সমান অপরাধী। প্রথম প্রথম কেমন একটা লাগছিল সবুজকে। তারপর হঠাৎ করে তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ওঠে। না ছেলেটা মন্দ নয়। সে তার মতো থাকতে চাইছে থাকুক। তার থেকে একটু সাবধান হলেই হলো। এখনো কমলা তার কুকর্ম চালিয়ে যায়। তবে সবুজকে বুঝতে দেয় না। ওর থেকে সতর্ক হয়ে চলে। কমলা তাকে পা-হাত ধুয়ে খাবার খেয়ে নিতে বললো। উভয়ই নির্দিষ্ট স্থান ত্যাগ করে নিজেদের গন্তব্যে উদ্দেশ্যে রওনা দিল। নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল সবুজ। কত ধুলো জমেছে পায়ে। বন্ধুদের সাথে বিকেলে খেলার পরে পায়ের অবস্থা এমন হতো। ছুটে কুয়োর কাজে পোঁছালো। জল তুলে পা-হাত ধুলো।

খাবার খাওয়ার পর নিজের ঘরে গিয়ে বসলো। কিছু ভালো লাগছে না। এই একগুঁয়ে জীবন অস্থির করে তুলেছে। এখানে গাছপালা কম। বাতাস নেই। ঘরবাড়িও অনেক দূরে দূরে। জলবায়ু পরিবর্তনের নাম নেই। প্রায় সময় একই আবহাওয়া। পাণ্ডববর্জিত এলাকা তাকে বিষণ্ণতায় ভোগাচ্ছে। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে। বন্ধুদের সাথে বসতে ইচ্ছে করছে। কত দিন হলো প্রিয় শরৎচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ পড়া হয়নি। এই তো ক’দিন আগে কাজল দিদির কাছ থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা বই এনে পড়লো। কিন্তু তা কতদিন? একটা বই খুব বেশি হলে তার দুদিন পড়তে সময় লাগে। তার মতো কাজল দিদিও বইপ্রেমী। তবে সে আনাড়ি বইপ্রেমী। বইয়ের প্রতি একটু খামখেয়ালি ভাব রয়েছে। তার মত সাহিত্যের প্রতি উন্মাদ পাগল নয়। ঘরে মধ্যে পায়চারি করল। কাজল দিদির ঘরে গেলে ভালো হয়। দু-একটা বই নিয়ে এসে পড়তে পারবে। কিন্তু এই ভর দুপুরে ওর ঘরে যাওয়া কি ঠিক হবে? ঠিক হবে কি জানে না তবে ভুলও হবে না। সে নিজেই বলেছে যখন-ই যেতে ইচ্ছে করবে তখনই যেতে পারে। অসুবিধা নেই। তার ঘরের সামনে পোঁছে থমকে গেলে। কেমন একটা লাগলো। তবুও ঘরের ভেতর গেলো। খুব বেশি অবাক হলো না। কাজল খাটের উপর বসে কলেজের নোট বানাচ্ছে। অনার্সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সে। সবুজ আগে থেকেই জানতো মেজদি দুপুরে কখনো ঘুমোয় না। তাই মনের সাহস একটু বেশি ছিল। তাকে দেখেই হেসে ফেললো সে।
‘এসো এসো, ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে কেন? ভেতরে এসো।’ সবুজ গুটি গুটি পায়ে মেজ দিদির কাছে পৌঁছালো। খাটের উপর উঠে সামনে বসলো।
‘কি ব্যাপার,আজ বড় দুপুরে ঘুমোয়নি যে?’
‘ঘুম আসছে না কিছুতেই। তাই তোমার কাছে এলাম।’
‘বেশ করেছো। আমারও একা বসে থাকতে ভালো লাগছিল না।’ একটা প্যারা লেখা শেষ হতেই কাজল মুখ তুলে সবুজকে দেখলো। আপাদমস্তক দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। একটা ঢিলেঢালা পোশাক পরে আছে। স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে খাতার দিকে তাকিয়ে আছে।অন্য কেউ এমন পোশাক পরলে তাকে খুব বিচ্ছিরি লাগতো। অথচ রূপের গুনে তাকে মানিয়ে গেছে। সমস্ত পোশাকেই তাকে মানায়।
‘তুমি এত সুন্দর কেন? তুমি শুধু সুন্দর নও মেয়ে মানুষের মত সুন্দর। এ রূপ তো মেয়েদেরকেই মানায়। গায়ের রং নেই, স্বাস্থ্যও খুব বেশি আহামরি নয়। তবুও তুমি সুদর্শন পুরুষ। কি করে সম্ভব? জানো, তোমার এই রূপ যেকোনো নারীর হৃদয়ে যৌবনের ঢেউ তুলতে পারে।’ একটু লজ্জা পেল সবুজ। খুশিও হলো। সংকেতও এমন কথা বলে। তার নাকি মানুষের রূপ নয়,ঈশ্বরের রূপ। সত্যি কি তাই? আদৌ কি মানুষ ঈশ্বরের রূপ ধারণ করতে পারে? তবে নিজের প্রশংসা শুনতে মন্দ লাগে না। একটা বিচিত্র ভঙ্গি মুখে ফুটিয়ে তুলল। সে নিজেও জানলো না এই ভঙ্গিতে তাকে কত সুন্দর দেখালো। তার মুখে নিস্পাপ নম্র হাসি কাজলকে মুগ্ধ করে। শুধু রুপ নয় ব্যাবহারও তাকে মুগ্ধ করে। সবুজকে কিছু বলতে না দেখে কাজল বলল,’তুমি আমার ঘরে কেন এসেছো আমি জানি।’
‘কেন?’
‘বই নিবে, তাই তো!’ সবুজ হাসলো।
‘এতে লজ্জার কি আছে? যখন যা দরকার তা নিয়ে যাবে।’ খাট থেকে উঠে গিয়ে নিজের সাজানো বইয়ের তাক থেকে অনেক গুলো বই এনে সবুজের সামনে রাখলো। এত বই দেখে তার মুখে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। সে বেছে বেছে শরৎচন্দ্রের বইগুলো সংগ্রহ করলো। কাজল বুঝলো সবুজের পছন্দের লেখক শরৎচন্দ্র।
‘তোমার শরৎচন্দ্রের পছন্দের বই কোনটা?’ সবুজ মুখ তুলে জবাব দিল,’দত্তা।’ সে-ই মূহুর্তে কাজলের মুখের ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল উত্তরটি খুব বেশি পছন্দ করেনি সে। তাই সেও কাজলদিকে একই প্রশ্ন করলো। তার পছন্দের বই ‘বিরাজ বৌ’। সবুজ এ বই এখনো পড়েনি। তাই কিছু বলতে পারলো না। কিছুক্ষণ থেমে বললো,’শরৎবাবুর ‘দেবদাস’,’দত্তা’,’পথের দাবী’,’পল্লীসমাজ’ এত সুন্দর সুন্দর বই থাকতে তোমায় ‘বিরাজ বৌ’ পছন্দ হলো?’
‘তুমি ‘বিরাজ বৌ’ পড়েছো?’
‘না’
‘তাহলে না পড়ে কি করে বলছো ওটা ভালো না। আগে পড়ে দেখো তারপর বিচার করো।’ সবুজ মাথা নাড়ালো। কাজলদিকে বললো ,আজ রাতেই বইটি পড়ে শেষ করবে। আরও কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে দুজন বসে গল্প করলো। তারপর সবুজ নিজের ঘরে ফিরে আসলো।হাতে বই না থাকাকালীন বই পড়ার প্রতি আগ্রহ ছিল হাতে পাওয়ার পর সে-ই আগ্রহ কোথায় হারিয়ে গেল। পড়ায় মন‌ বসাতে পারলো না।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো। বিকালে তার সাধারণত কোনো কাজ থাকে না। ঘুরে বেড়িয়ে সময় পার করে। ছোটবেলা থেকে সমবয়সী কম বেশি অনেক নারীর সাথে মিশেছে সবুজ। তবে কারোর প্রতি খুব বেশি আগ্রহ কিংবা কৌতুহল জন্মায়নি। এ বাড়িতে আসার পর কাজল দিদির সাথে খুব ভালো ভাবে মিসেছে। বয়সে বড়ো হলেও দু-একটি কথা ছাড়া খুব বেশি কথা মুখে আটকায়নি। সমস্ত বিষয়ে অকপট হতে পারে। দিনের বেশিরভাগ সময় তার কাছেই ঘুরে বেড়ায়। কাজল কোথাও গেলে তাকে সঙ্গে নিয়ে যায়। তার ভাবনার সাথে সবুজের ভাবনার অনেক মিল। তবুও তার প্রতি কোনো কৌতুহল নেই। অথচ সাথী! তার প্রতি কেমন একটা ভালোলাগা জন্মেছে। তার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে। তার সব কিছুই ভালো লাগে। কিন্তু কেন এমন হয়? অন্য কোনো মেয়ের প্রতি তো এত উতলা হয় না। শুধু কি নামের সাথে মিল বলে -এত কৌতুহল? না বয়সে ছোট বলে চঞ্চলা মনটা প্রিয়? না অন্য কিছু? এর উওর জানে না। তবে তাকে খুব ভালো লাগে। বয়ঃসন্ধির শুরুতে অসামান্য সুন্দরী হয়ে উঠেছে সাথী। বড়ো বড়ো চোখ, হাতের পায়ের আঙ্গুলের গড়ন বেশ সুশ্রী। মাথা ভর্তি চুল সবসময় কানকে আবদ্ধ করে রাখে। দেখলেই সবসময় দেখতে ইচ্ছে করে। এই অপরূপা বালিকা বড্ড চঞ্চলা। কথার ভঙ্গিতে মানুষকে মুগ্ধ করে। গলায় রয়েছে মুগ্ধময়ী ছন্দ। আজ সাথী বলেছিল বিকেলে তাকে তাদের এলাকায় ঘুরে দেখাবে। বিকেল তো হয়ে গেল, কিন্তু সে আসছে না কেন? তাকে না নিয়ে একা চলে গেছে? মন বারংবার উতলা হয়ে পড়ছে। তার সাথে কিছুক্ষণ একা থাকলে ভালো লাগবে। মন শান্ত হবে। কি করবে সহজে বুঝে উঠতে পারল না। রুপা দিদি কিংবা কাজল দিদির মত সাথীর নিজস্ব কোনো ঘর নেই। সে মায়ের ঘরে থাকে। ওই ঘরে যেতে সাহস হলো না। বর্ণালী দেবী নিশ্চয়ই রয়েছেন। কাজের ছেলের সাথে ঘুরতে ফিরতে বেশি পছন্দ করবেন না। যদিও কখনও কিছু বলেন না। তবুও যেতে সাহস পেল না। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সাথীর ঘরের সামনে উঁকি দিল। দরজা বন্ধ কিছুই দেখতে পেল না। কিছুক্ষণ পর বর্ণালী দেবীকে দেখতে পেল। মাকে দেখে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। তিনি কাছে এসে বললেন,’তুমি কাউকে খুঁজছো?’ আমতা আমতা করলো।
‘কি হলো বল? কিছু চাই?’
‘না,আসলে আমি সাথীকে খুঁজছিলাম।’
‘ওহ,ও তো দুপুরের ঘুম থেকেই ওঠেনি। যাও তো ডেকে তোলো। বেশিক্ষণ ঘুমানো ভালো না।’ তিনি সবুজের মাথায় আলতো স্পর্শ করে সরে পড়লেন। সবুজ জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো। প্রথমে কপালে তারপর বুকে হাত ঠেকিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালো। দরজায় একটু ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। পালঙ্কের উপর দেওয়ালের দিকে মুখ করে সুন্দরভাবে শুয়ে আছে সাথী। ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে বড্ড মায়াবী লাগলো। কৃত্রিম পাখার হাওয়ায় চুল গুলো উড়ে এসে মুখে পড়েছে। কি দারুন লাগছে তাকে। সবুজ ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে, কোনো ছেলে কিংবা মেয়ে মালিকের বাড়িতে কাজ করলে মালিকরা ভালো বিছানায় ঘুমোয় আর কাজের ছেলে-মেয়েদের জন্য তেমন একটা আহামরি বিছানা থাকে না। আবার অনেকের বাড়িতে শুধুমাত্র একটা মাদুর,গাঁথা আর বালিশ দিয়ে দায় শেষ করে। কিন্তু এই বাড়িতে এসে তার ধারণা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। সে যে ধরনের বিছানায় ঘুমোয় বাড়ির সবাই ওই ধরনের বিছানায় ঘুমোয়। কাউকে হীন চোখে দেখেন না রায়বাবু। সবুজ বিছানায় উঠে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে সাথীর পাশে বসলো। শরীরে নাড়া দিয়ে ডাকলো। বার-দু-একবার নাড়ানোর পর সাথী বিছানা ছেড়ে উঠে পরল। চোখ দুটো ঘুমে ভর্তি। কিশোরীর ঘুমন্ত চোখ কৃষ্ণচূড়ার ডাল খুঁজছে। সে-ই ডাল যেন সবুজ। তাকে দেখে ফিক করে হাসলো। ঘুমন্ত মুখে তাকে তন্নী সুন্দরী লাগছে। কি অপূর্ব রূপের ছটা! ঘুম ঘুম চোখে বলল,’তুমি!’
‘হু, তুমি না বলেছিলে বিকেলে মাঠে যাবে। কখন যাবে?’ সাথী মুখ থেকে চুল সরিয়ে জিভ কেটে বলল,’এ মা! আমি তো ভুলেই গেছিলাম। এখানে বসো আমি তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে আসছি।’ জবাব পাওয়ার আগে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। কিছু ভাবার আগেই আবার ছুটে চলে আসলো। মনে মনে খুব আনন্দ পেল সবুজ। কত চঞ্চলা! উতলা নদীর মতো বড় চঞ্চলা। যেভাবে বসে ছিল ওই ভাবে বসে রইল সে। আলমারি থেকে লাল রঙের একটা পোষাক বার করলো সাথী। তারপর দেওয়ালের দিকে মুখ করে পরনে থাকা সবুজ রঙের জামা খুলে ফেললো। মুহূর্তের ঘটনায় সম্পূর্ণ হতভম্ব হল সবুজ। তার সামনে এখন এক কিশোরীর সম্পূর্ণ উন্মুক্ত পিঠ। নগ্ন পিঠের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে মুখ ফেরাতে চাইল। পারলো না। এমনটা কেন হচ্ছে? শরীরের এ কি বেহায়াপনা? এর আগে তো এমন হয়নি। যৌবনের মহিমা তাকে বাধ্য করল সেদিকে তাকিয়ে থাকতে। সাথী লাল জামা শরীরে গলিয়ে নিয়ে তার নগ্ন মখমলে শ্বেতবর্ণের পিঠ আবার ঢেকে ফেলল। সে কি সবুজের উপস্থিতি টের করতে পারেনি? না, তা হতে পারে না। পরবর্তীতে এ বিষয়ে আরও নিশ্চিত হলো। সাথী মুখ ঘুরিয়েই বলল,’আমায় কেমন লাগছে?’ সবুজ কোনো জবাব দিতে পারল না। তাকে দেখে মনে হলো না এই ঘটনার জন্য লজ্জা পেয়েছে সে। সে যে কোনো পুরুষের সামনে জামা বদলেছে তা বুঝতেই চাইলো না। খারাপ লাগলো সবুজের। কত নিচু মানসিকতা তার। সাথী তো ছোট। অনেক ছোট। তার মনে এমন ভাবনা না আসাই স্বাভাবিক। সে এখন বালিকা। যৌবনের স্বপ্নজাল, নবকিশলয়, তৃপ্তি,অতৃপ্তি বোঝে না। আবার পরে ভাবে চৌদ্দ বছরের কিশোরীকে বাচ্চা বলে ঘটনাটিকে কি এড়ানো সম্ভব? সে তো ঋতুবতী। বয়ঃসন্ধির শুরুতে তার দেহের গঠনের পরিবর্তন এসেছে। মেনে নিলো সে অবোধ নির্বোধ অসহায় বালিকা। কিছু বোঝে না। কিন্তু সবুজ তো সব কিছু বোঝে। তবুও কেন যে বাধা দিতে পারলো না? কেন পারলো না নগ্ন পিঠে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে? এ কি প্রেম? প্রেম না অন্য কি জানে না সে। তবে বড়ো ভুল। তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। সাথীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,’আমায় ক্ষমা করে দাও?’ অদ্ভুতভাবে মুখ নাড়িয়ে সাথী বলল,’কেন? তুমি তো কোনো ভুল করনি যে ক্ষমা করবো।’
‘আমি ভুল করেছি।’
‘কোন ভুলের কথা বলছো?’
‘তুমি জানো আমি মিথ্যা বলি না। আর সত্যি বললে তোমার খারাপ লাগবে। আমি চাই না তোমায় সব কিছু বলতে। আমায় শুধু ক্ষমা করে দিলে হবে।’ খুব জোরে জোরে হাসলো সাথী।
‘তুমি না সত্যি! হোক যা তোমায় ক্ষমা করে দিলাম। এবার তো খুশি?’
মেদিনীপুরের বাড়িতে চারিদিকে তাকালে দেখা যায় নীল সমুদ্র, বিশাল সবুজ ধানের ক্ষেত, শতশত মাটির বাড়ির ভেতর হাতেগোনা দু-একটা পাকা বাড়ি,প্রচুর ছোট বড়ো গাছগাছালি। সবুজের ধারনা ছিল প্রকৃতি বলতেই এটুকু। এর বাইরে যে আরও অপরূপ সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে তা বুঝতে পারতো কিন্তু মন থেকে মানতো না। আজ তার সামনে অন্য এক প্রকৃতি দেখা দিয়েছে। তবে প্রকৃতি প্রেমিক সবুজকে তা মুগ্ধ করতে পারছে না। তার মন এখন অন্য জায়গায় আছে। মূহুর্তের জন্য চেনা কিশোরীর এলোমেলো খোলা চুল উলঙ্গ পিঠের উপর পড়ে থাকার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কি অপূর্ব সে-ই মুহূর্ত! সাথী যদি সব বুঝতে পারে তাহলে কেমন আচরণ করবে? রেগে যাবে? লজ্জা পাবে? রেগে যাওয়ার মূহুর্তে তো তাকে খুব ভালোলাগে। কিন্তু লজ্জা পাওয়ার মূহুর্তে? নিশ্চয়ই আরও বেশি সুন্দর লাগে। তার হুঁশ ফিরল যখন সাথী তার হাত ধরলো। এই প্রথম কোনো কিশোরী তার হাত জাপ্টে ধরেছে। ভালো লাগলো। তার মুখশ্রী দেখে বোঝা গেল সে কিছু বলতে চাইছে কিন্তু প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল। বলল,’তোমার হাত এত নরম কেন? তুমি মেয়ে মানুষ নাকি?’ সবুজ আনাড়ি ভাবে হাসলো। কোনো জবাব দিল না। সাথী আবার বলল,’তোমার বোন কোন ক্লাসে পড়ে?’ ঘুরে তার দিকে তাকালো। মেয়েটার বুদ্ধি আছে মানতে হবে। কথার ফাঁকে ফাঁকে কথা বের করতে চাইছে। কিন্তু সে জানে না,সে ভুল মানুষের পেট থেকে কথা বের করতে চাইছে। তার হাসি বুঝিয়ে দিল সে উওর দিতে পারবে না। একটু কুন্ঠা বোধ করলো। মানুষ কথায় হেরে গেলে যেমন চুপ হয়ে যায় তেমনই চুপ হয়ে গেল। আরও কিছুটা হাঁটার পর তারা একা ছোটো টিলার উপর গিয়ে বসলো। চঞ্চলা সাথী বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলো না। দাঁড়িয়ে পড়ে শূন্যের দিকে দু-হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে উঠল। কত খুশি লাগছে তাকে। মূহুর্তটা ঠিক সিনেমার মতো। সবুজ হাসলো। সেও দাঁড়ালো। উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে পড়ায় চোখ দুটো বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছালো। চারিদিকে শুধু মাঠ আর টিলায় ভর্তি। গাছপালা সামান্য। শরৎকালেও মাটি ফেটে আছে।অনেক দিন ধরে বৃষ্টি হয়নি। গাছপালা নেতিয়ে আছে। আশেপাশে তাকাতেই বোঝা যাচ্ছে খুব অনুন্নত এক গ্রাম। জলের অভাব স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে। সাথী তার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। আরও কাছে আসলো। মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,’তুমি কোনো দিন কাউকে ভালোবেসেছো?’ প্রশ্ন শুনে একটু বিব্রত বোধ করলো সবুজ। মুচকি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিল। এইটুকু মেয়ের কাছে ভালোবাসার মানে কি? ভালোবাসার কি-ই-বা বোঝে? এই কিশোরীর কাছে নিশ্চয়ই ভালোবাসার একটা সীমানা রয়েছে। একটা সীমাবদ্ধতায় থেমে যায়। কিন্তু বাস্তবে ভালোবাসার কোনো সীমানা হয় না। ভালোবাসা মুক্ত। ভালোবাসা সম্পূর্ণ স্বাধীন। ভালোবাসার কোনো কাঁটাতার নেই। এই কিশোরীর কাছে ভালোবাসা শুধু মাত্র বাবা-মা,ভাই-বোন, প্রেমিক-প্রেমিকা,স্বামী-স্ত্রী একটুতে থেমে যাবে। কিন্তু এ তো ভালোবাসার সামান্য অংশ। এর বাইরেও ভালোবাসার বড়ো একটা জগৎ আছে। মানুষের সাথে গাছে, গাছের সাথে পাখি,পাখি সাথে মানুষ…. সূর্য, চাঁদ, তাঁরা, আকাশ, পশুপাখি…. সবার সাথে ভালোবাসা হয়। এ ভালোবাসার কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। কোনো ঠিকানা থাকে না। শেষ পরিণতি থাকে না। তবুও এ সত্য ভালোবাসা। ভালোবাসা জাতি ধর্ম বর্ণ বয়স কাঁটাতার কিছুই মানে না। সাথী কি বোঝে ভালোবাসার এই বাস্তব কথা? বোঝে না। কিন্তু কেন? বয়সে ছোট, তাই? কই,সবুজও তো ছোট। তার চাইতে দুই থেকে তিন বছরের বড় হবে। আসলে বাস্তব জীবনে বয়সে কিছু যায় আসে না। নিজের ভাবনা চিন্তাধারাটাই নিজেকে বড় করে। নিজের অভিজ্ঞতা নিজেকে বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। নিজেকে সুন্দর করে তুলে। যা সবুজের মধ্যে প্রচুর রয়েছে। শুধু রুপে নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা আর সৎ মানসিকতা তাকে সুদর্শন বানিয়েছে। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ আর কলম বার করলো। তার পকেটের মধ্যে এগুলো সবসময় থাকে। চটপট কিছু লিখতে শুরু করলো। সাথী খুব হাসলো। সে জানে, সবুজ বড্ড উদাসীন আর ছেলেমানুষ। কখন কি করে নিজেও জানে না। সাথী কাছে গিয়ে বলল,’কি লিখছো?’
‘কিছু না।’
‘আমি তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কিছু লিখছো।’
‘তেমন কিছু নয়। আমি খুব স্বপ্ন দেখি। আমি বড় লেখক হবো। যখন কোনো নতুন ভাবনা মনে জাগে তখন ওটা নোট করে রাখি। পরে ঠিক কোথাও না কোথাও ব্যবহার হবেই।’
‘পরে লিখলে তো হয়। এখন একটু ঘুরে দেখো।’
‘পরে তো ভুলে যাবো। তখন কি হবে?’
সবুজের সম্পূর্ণ লেখা শেষ হতেই সাথী আবার বলল,’বলো, তুমি কাউকে ভালোবাসো?’
‘আমার কাছে তো ভালোবাসার মানে ভিন্ন। তুমি যেটাকে ভালোবাসা ভাবছো ওটা ভালোবাসাই। তবে তার মধ্যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসায় কোনো সীমাবদ্ধতা থাকে না। বয়স হলে বুঝবে।’
‘এত গভীরের যাচ্ছ কেন?’
‘তুমি তো তাই জানতে চাইলে।’
‘দূর বাবা, তুমি না সত্যি সত্যি বোকা। বোকা ছেলের কোনো প্রেমিকা আছে কিনা জানতে চাইছি। মানে ওই যে স্কুল ছুটি হলে গাছের আড়ালে লুকিয়ে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে গল্প করে। একে অপরকে দেখে মিটিমিটি হাসে। চোখ মারে। কত লাল নীল স্বপ্ন দেখে। পরীক্ষা খাতা দেওয়ার পর ওই খাতায় বাবার কাছ থেকে স্বাক্ষর করে নিয়ে যেতে বলেন মাস্টারমশাই। কিন্তু কম নাম্বার পেলে বাড়িতে বলে না ওই ছেলে কিংবা মেয়ে স্বাক্ষর করে দেয়। এমন কেউ আছে তোমার?’ সাথীর কথা শুনে না হেসে পারলো না। ঠিকই ধরেছিল এই মেয়েটা ভালোবাসার মানে বোঝে না।
‘এই বোকা ছেলে হাসছো কেন? বল, এমন কেউ আছে তোমার।’ সবুজ না বলায় খুশি হলো সে। দুচোখ জুড়ে সবুজকে দেখলো আর মিষ্টি হাসলো।

রাতের বেলায় সাথী একটা অঙ্ক কিছুতেই করতে পারলো না। কাজল দিদির কাছে নিয়ে গেল। সেও অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। সবাই তাকে নিয়ে মজা করলো। এত দূর পড়েও অষ্টম শ্রেণীর অঙ্ক পারছে না। কোনো জবাব দিতে পারলো না। রাগে কটমট করল। অনেকেই মজা করে অনেক কিছু বলল। তবে মজার বিষয়টি মজা হিসাবে নিতে পারলো না কাজল। সবুজও সেখানে ছিল। তবে সে কোনো কিছু বলল না। অঙ্কটা তার কাছে কিছুই না। তবুও নিরব রইল। এখানে বাহাদুরি দেখালে কাজলদিদি আরও বেশি কষ্ট পাবে। সে চায় না তার জন্য কেউ কষ্ট পাক। তা ছাড়া সব জায়গায় নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে নেই। বিশেষ করে যেখানে নিজের বুদ্ধিমত্তার জন্য অন্যকে অসম্মানিত হতে হয়। সে জানে, অঙ্কটি করে দিলে সবাই তার তারিফ করবে। বলবে, সবুজ না পড়েও অঙ্কটি করে দিলো অথচ সে পড়াশোনা করেও কিছু করতে পারলো না। সে চায় না তার জন্য কেউ কষ্ট পাক। কিছু সময় পর সবাই যখন ব্যস্ত হয়ে পড়ল তখন সবুজ চুপিচুপি সাথীর ঘরে গেল। রাতে হঠাৎ সবুজকে তার ঘরে দেখে একটু অবাক হলো। কৌতুহলী হয়ে বলল,’এখন আমার ঘরে?’ চুপচাপ সাথীর পাশে বসে পড়লো। তার খাতা পেন নিয়ে খুব দ্রুত অঙ্কটি শেষ করলো।সাথী শুধু অবাক হল,মুখ থেকে কোনো কথা বের করলো না। এই কি বিকালের সে-ই সবুজ? বিশ্বাস হচ্ছে না। সাথী তাড়াতাড়ি বই উল্টে উত্তর দেখে নিল। ঠিক মিলে গেছে। আশ্চর্য হল।
‘ও মা,বোকা ছেলে তুমি তো অঙ্কটা ঠিকই করেছো। তাহলে তখন করে দিলে না কেন?’
‘তাতে মেজদি খুব কষ্ট পেত।’ সাথী খুব খুশি। মন ভরে গেল। ছেলেটি সত্যি আলাদা। নিজের প্রশংসার জন্য কাউকে কষ্ট পেতে দেয়নি। চুপিচুপি এসে সমস্ত সমাধান করে দিল।
‘আমি জানতাম তুমি কোনো সাধারণ ঘরের ছেলে নও।’
‘তাহলে কি আমি রাক্ষস? মানুষ সেজে তোমাদের বাড়িতে আছি?’
‘তা নয়,তবে কেন জানি না আমার মনে হয় তুমি খুব সাধারণ নও।’
‘তুমি আমায় যতটা সাধারণ ভাবো আমি তার চাইতে আরও বেশি সাধারণ।’
‘তুমি সাধারণের মধ্যে অসাধারণ।’
সকালে খবরের কাগজে মোড়া একগাদা পুঁইশাক বাজার থেকে নিয়ে আসলো কমলা। খবর কাগজ থেকে শাক গুলো আলাদা করে কাগজ ফেলতে গিয়ে চমকে উঠলো। বর্তমানে রাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা। এই পল্লী গ্রামের কেউ-ই প্রতিদিনের পত্রিকা বিক্রি করে না। তাই এ-বাড়িতে পত্রিকা আসে না। না হলে এমন খবর আগে অবশ্যই চোখে পড়তো। দেড় মাসের পুরনো পত্রিকা। সবুজের ছবি দেওয়া রয়েছে সাথে রয়েছে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি। কেউ খোঁজ দিতে পারলে তাকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে পুরস্কৃত করা হবে। আজ আর টাকার লোভ হলো না কমলার। চোখ কপালে উঠে গেল। পত্রিকা হাতে নিয়ে সোজা রায়বাবুর কাছে পোঁছালো।

পর্ব ৪ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here