নিরুদ্দেশ,পর্ব ২

নিরুদ্দেশ,পর্ব ২

ঘন অন্ধকার। আকাশ কেন পরিষ্কার হচ্ছে না সেটাই ভাবাচ্ছে সূর্যময় আর সংকেতকে। তাদের বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরে সমুদ্র রয়েছে। সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত আছে তিন তিনটে খাল। সেখান থেকে সারাবছর কম বেশি মাছ ধরা সম্ভব। সূর্যময়ের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে দুইজন খুব ভোরে মাছ ধরতে চলে এসেছে। বাড়ি থেকে সেখানে পৌঁছাতে যথেষ্ট সময় ব্যয় হয়েছে। তবুও ভোর হচ্ছে না। খালের দু-পাশে সবসময় কাউকে না কাউকে মাছ ধরতে দেখা যায়। অথচ আজ কেউ নেই। খটকা লাগলো। আশেপাশের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে এখন গভীর রাত। থমথমে পরিবেশ। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ পর্যন্ত নেই। চারিদিকে নিস্তব্ধতা বাসা বেঁধেছে।
শরৎকাল হওয়ায় হালকা শীত রয়েছে। শিশির পড়ে ঘাস ভিজে গেছে। সংকেত একটু ভয় পেলো। এমন অভিজ্ঞতা তার নেই। মাঝেমধ্যে সূর্যময়ের বাবার সাথে সমুদ্রে মাছ ধরতে এসেছে;তবে বিকেলবেলা। তাছাড়া তিনি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ছিলেন। কোনো ভয় ছিল না। আজ তারা দুজনেই ছোট। ভয় করছে। আমতা আমতা করে বলল,’চলো ভাই পালিয়ে যাই। ভয় করছে।’ সূর্যময় ভয় পেলেও বাহাদুরি করে বলল,’ভয় কিসের? এত ভোরে নিশ্চয়ই ভূত বের হবে না।’
‘বলা যায় না। বেরোলেও বের হতে পারে। সাবধান হওয়া ভালো।’ সূর্যময় জবাব দিল না। নাহলে আবার প্রশ্ন করে বসবে সংকেত। হাফপ্যান্টের উপরে গামছা পরে নিলো দুজনে। কাঁধে জাল ঝুলিয়ে সামনে হাঁটতে রইল সূর্যময়। পিছনে সংকেত জেলেদের ব্যবহৃত মাছ রাখার ছোট্ট ঝুড়ি বাম হাতে এবং ডান হাতে টর্চলাইট ধরে সূর্যময়কে অনুসরণ করল। টর্চের আলো ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে এলো। এতক্ষণ পর্যন্ত টর্চ জ্বালানোর কথা ছিল না। ভোর হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভোর তো হচ্ছে না। কিছুটা হাঁটার পর সংকেতের পায়ে কিছু একটা ধাক্কা খায়। টর্চের আলো ফেলে দেখে একটা মাটির হাঁড়ি। খালের পাড়ে মাটির হাঁড়ি কী করছে? একটু বিস্মৃত হয়ে টর্চের আলোয় ভালো করে জিনিসটা দেখলো। সামনের দিকে আলো দেখতে না পেয়ে বিরক্ত হলো সূর্যময়। পেছনে ঘুরে কিছু বলার আগে সংকেতের সুকৌশল মুখমন্ডল বাঁধা দিল। মাটির দিকে তাকিয়ে কিছু খুঁজছে সে। সেখানে পৌঁছে সেও জায়গাটা দেখে বুঝে গেল সবকিছু। আশেপাশে পোড়া কাঠ আর কিছু অব্যবহৃত জিনিস পড়ে আছে। নিশ্চয়ই কিছুদিন আগে মড়া পোড়ানো হয়েছে। সংকেত কিছুই বুঝলো না। প্রশ্ন করল।
‘এ ভাবে সুন্দর নকশা করা মাটির হাঁড়ি অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে কেন?’
‘কিছু বুঝতে পারছো না?’ উত্তরটা প্রশ্নের মত দিল সূর্যময়।
‘না তো।’
‘সম্ভবত মড়া পুড়িয়েছে।’ সত্য কিছুটা চাপা দিতে চাইলো। নাহলে সংকেত ভয়ে কাঁপতে থাকবে। তার অর্ধসত্য কথা কাজে আসলো না। সে এমনিতেই ভয় পেয়ে ছিল। আরও বেশি ভয় পেয়ে গেল। তার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। তালপাতার মতো কাঁপতে লাগল। বলল,’এ তো অন্যায়। মড়া এখানে পোড়াবে কেন? সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে যেতে পারে না?’
‘ওরা খেটে খাওয়া মানুষ। এত আইনটাইন বোঝে না। যা সহজ হয় তাই করে।’ সংকেত কিছুতেই নিজের ভয় দূর করতে পারলো না। এবার আর সূর্যময়ের থেকে বেশি দূরে রইল না। কাছাকাছি রইল। বন্ধুকে ভয় পেতে দেখে নিজেও ভয় পেল। হিমশীতল বাতাসে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। এত নির্জন! এত ভয়ানক পরিবেশের সঙ্গে আগে পরিচয় হয়নি। এর আগে বহুবার ভোরে মাছ ধরতে এসেছে কিন্তু এমন পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। আজ যেন সম্পূর্ণ আলাদা এক পরিবেশ। ভয় হচ্ছে তবুও বুকে সাহস যুগিয়ে এগিয়ে গেল। কিছুটা যাওয়ার পর তারা দাঁড়ালো। সেখানে একবার জাল ফেলে দেখবে। একজন দক্ষ জেলের মতো জাল সাজিয়ে-গুছিয়ে জলে ফেলল সূর্যময়। একটা জোরালো শব্দ হলো। শব্দের জোরে পাশের ঝোপে লুকিয়ে থাকা শিয়াল দৌড়ে পালিয়ে গেল।কাছ থেকে দুর্গন্ধ নাকে ভেসে আসছে। সম্ভবত ছোটখাটো কোনো জন্তু কিংবা মাছ মারা গেছে। সংকেত জলে টর্চের আলো ফেলতেই বাধা দিল সূর্যময়। তাতে নাকি মাছ মানুষের উপস্থিতি টের করতে পারবে। সাবধানে হয়ে যাবে। একটু পর সুকৌশল ভাবে একা জাল টেনে তুললো। জালে সারি সারি মাছ দেখে দুজনের মন আনন্দে নেচে উঠলো। দশবার জাল ফেললে যত না মাছ উঠে আজ একবারে তার চাইতে অনেক বেশি মাছ উঠছে। সংকেত আর চুপ করে থাকতে পারলো না। তার আনন্দটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কি হাসি তার মুখে। বালকের মত মিষ্টি নিষ্পাপ হাসি। আবছা আলোয় তার মুখমন্ডল বেশ হালকা এবং খুশি দেখালো। কিছুক্ষণের আগে তৈরি হওয়া ভয় কোথায় উবে গেল। অনেক দিনের পর সংকেতকে হাসতে দেখা গেল। সবুজ চলে যাওয়ার পর থেকে সংকেত কেমন হয়ে গেছে। সবুজের দুর্দিনের জন্য সে নিজেকে দায়ী করে। কষ্ট পায়। তাকে হাসতে দেখে ভালো লাগলো সূর্যময়ের। অসংখ্য ছোট ছোট সামুদ্রিক মাছ জালে বিঁধেছে। খুলতে সময় লাগবে। সূর্যময়ের হাতে হাত লাগালো সংকেত। বেশ কিছুক্ষণ পর উভয়ই এক বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো। তিনি কিছুটা দূরে বিড়ি চাইছেন রুগ্ন কন্ঠে। দুজন আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখালো কেউ নেই। আবার মনের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার ঘটলো। বৃদ্ধটি দ্বিতীয়বার রিনরিনে কন্ঠে তাদের কাছে বিড়ি চাইলো। ভয় হলো। তাদের কাছে কে বিড়ি চাইছে? সূর্যময় ফিসফিস করে বলল টর্চের আলো নিভিয়ে ফেলতে। সঙ্গে সঙ্গে আলো নিভিয়ে ফেলল। গা হাত ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। জিভ শুকিয়ে গেছে। কথা বের হচ্ছে না। পা হাত নড়ছে না। যেন মাটিতে শিকড় গজিয়ে বদ্ধ হয়ে গেছে। বৃদ্ধটি তৃতীয় বার বিড়ি চাইলো। কণ্ঠস্বর শুনে দুজনেই অনুভব করতে পারল, মানুষটি ধীরে ধীরে তাদের কাছে এগিয়ে আসছে। গলার স্বর আরও স্পষ্ট। আরও শীতল ও কঠিন। কিন্তু ঘন অন্ধকারে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সংকেত আ আ আ বলে চিৎকার করে উঠল। কিচ্ছু না ভেবে সমুদ্রের দিকে দৌড় দিল। পেছনে পেছনে সূর্যময়ও ‘ভূত’ ‘ভূত’ ‘পালা’ ‘পালা’ বলে চিৎকার করে দৌড় দিল। একবারের জন্যও পেছনে ঘুরলো না। হাঁপিয়ে উঠলো তবুও দাঁড়ালো না। কতক্ষণ দৌড়ালো ঠিক জানে না। তবে অনেকক্ষণ। সমুদ্রের জোরালো গর্জনের শব্দ পেয়ে দাঁড়ালো সংকেত। সঙ্গে সঙ্গে সূর্যময়ও। জোরে জোরে বারকয়েক নিঃশ্বাস ছেড়ে শান্ত করলো নিজেদেরকে। সামনে টিপটিপ করে অনেক আলো জ্বলছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। এখানে অন্তত ভয় নেই। আশেপাশে ট্রলারে ঘুমন্ত কিংবা জাগ্রত মানুষ রয়েছে। সামনে বিশাল সমুদ্র। বাড়ির রাস্তা কোন দিকে অন্ধকারের মধ্যে অনুমান করতে পারলো না। টর্চ লাইট কোথায় ফেলেছে তাও জানে না। বালির চরের উপর দুজনে বসলো। হৃদস্পন্দন দিগুন বেড়েছে। সারা শরীর শীতল হয়ে আছে। চোখ মিটমিট করছে। কেউ কোনো কথা বলল না। মনের মধ্যে দিক নির্ণয় করে পূর্ব দিকে তাকালো সূর্যময়। না সূর্য মামা এখনও ওঠেনি। তারা যতক্ষণ থেকে এসেছে এতক্ষণে বেলা ছটা কিংবা সাড়ে ছটার অধিক হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে এখনও গভীর রাত। কিন্তু কেন? কেন ভোর হচ্ছে না? সমুদ্রের পাড়ে মনোরম বাতাসে বেশিক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকতে পারলো না। চঞ্চল দুই কিশোরের মস্তিষ্ক ঘুমের বার্তা পাঠালো।
ঘুম ভাঙতেই সূর্যময় দেখলো ঝাউ জঙ্গলের ওপারে সূর্য মামা উঠেছে। চতুর্দিকে কিরণ বিলিয়ে দিয়েছে। সদ্য ওঠা সূর্যের কিরণ বালিতে পড়ে চকচক করছে। জলও সৌন্দর্য ধারন করেছে। বালি আর সূর্যের আলো মেখে এখনও ঘুমন্ত অবস্থায় পড়ে আছে সংকেত। তাকে দেখে ভারি হাসলো সে। জেগে তুলল। আশেপাশের পরিবেশ কোলাহলময় হয়ে উঠেছে। রাতের কথা মনে করে শরীরটা শিরশির করে উঠল। কি একটা ভয়ানক রাত! সূর্যময় অন্য কিছু ভাবলো। এত দেরিতে কি জন্য ভোর হলো? বেশ অনেকক্ষণ ধরে ঘুমিয়েছে। প্রায় দু-আড়াই ঘন্টা। সময় কি থমকে গিয়েছিল? না, তা কখনও সম্ভব নয়। তাহলে? সে সংকেতের কাছে গিয়ে বসলো। বলল,’তুমি আজ কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলে?’
‘ঘড়ি তো দেখিনি। তবে ভোর হতে বেশি বাকি ছিল না!’
‘কি করে এত নিশ্চিত হচ্ছো? ভুল হতেও পারে না!’
‘আমার তেমন কখনও হয় না। সকালে কোনো বিশেষ কাজ থাকলে আমার ঘুম তাড়াতাড়ি ভেঙে যায়।’
‘এমনটাই হয়েছে। আজ সকালে সমুদ্রে মাছ ধরতে আসবে -এ বিষয় তুমি খুব এক্সাইটেড ছিলে। রাতে ঘুম ভাঙতেই তুমি ভেবেছো ভোর হয়ে গেছে। ঘড়ি না দেখে আমার বাড়িতে চলে এসেছো। আমিও খেয়াল করিনি। তোমার সঙ্গে বেরিয়ে এসেছি। কিন্তু তখন ভোর হয়নি গভীর রাত ছিল। একটা কিংবা দুটোর মতো হবে।’ ভয়ে কুঁকড়ে গেলো সংকেত। সত্যি কি তাই? তার এত বড়ো ভুল হয়ে গেল? কালকের রাতের কথা ভাবলো। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। এ-পাশ ও-পাশ ঘুরছিল। তারপর হঠাৎ করে ঘুম আসে আবার হঠাৎ করে ভেঙে যায়। ধড়মড় করে উঠে পড়ে। ভাবে ভোর হয়ে গেছে। বন্ধুর বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যেতে সময় লাগবে। বেলা হলে মাছ পড়ে না। বন্ধু রাগ করবে। চঞ্চল মন আর থেমে থাকেনি। গামছা নিয়ে দ্রুত বন্ধুর বাড়ি চলে যায়। তাকে ডেকে তুলে। সেও বুঝতে পারেনি তখন গভীর রাত ছিল। আনন্দ কৌতুক ছন্নছাড়া মন কোনো পিছুটান মানেনি।
‘খুব বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। কেউ সন্ধ্যা হলে ও-দিকে যেতে সাহস পায় না আর আমরা রাত দুটোর সময় চলে গেছি। এমন ভুল আর করবে না। ঘড়ি আগে দেখবে।’ সূর্যময়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সংকেত বলল,’তুমি কি করে এত নিশ্চিত হচ্ছো, আমরা রাতে এসেছি?’
‘পুরো ঘটনা তো তাই বলছে। আমরা এখানে আড়াই ঘন্টার কাছাকাছি ঘুমিয়েছি, খালের পাড়ে অনেক সময় কাটিয়েছি। আর ভোর হচ্ছে এখন। কিছু বুঝতে পারছো?’ মাথা নাড়ালো সংকেত। তার চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল হয়ে গেছে। এত সকালেও ঘামছে।
‘ভাগ্যিস সবুজ ছিল না। না হলে যে কি হতো কে জানে?’ সূর্যময় হাসলো। বলল,’সে জন্যই বেঁচে গেছি। সে নিশ্চয়ই বৃদ্ধ লোকটি বিড়ি চাওয়ার পরও ছুটে পালিয়ে আসতো না। তার কাছে যেতে ভয় পেত না। সঙ্গে আমাদেরও নিয়ে যেতে। আর বৃদ্ধটি ঘাড় বাঁকিয়ে রেখে দিত।’
‘সবুজ খুব সাহসী তাই না!’
‘সাহসী বলা ঠিক হবে না। ভূতকে ভয় পায় না ঠিকই কিন্তু সমাজকে তো ভীষণ ভয় পায়। যা তার জন্য খুবই নিকৃষ্ট একটা দিক। কেউ হালকা কিছু বললেই তা মন থেকে গ্রহণ করে। সহজে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। কষ্ট পায়। যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। সে যত বড় হবে সমাজে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন কথা আসবে। সে যদি সমস্ত কথাকে গুরুত্ব দেয় তাহলে জীবনে এক দন্ডও শান্তি পাবে না। খুব বিপদজনক হয়ে উঠবে। যেদিন সে সমাজকে ভয় পাবে না সেদিন আমি তাকে সাহসী বলবো তার আগে না।’ সংকেত সব কথা শুনলো। উঠে দাঁড়ালো। গা হাত থেকে বালি ঝেড়ে ফেলল। আকাশ বেশ পরিস্কার। সকালের সমুদ্রকে দেখতে ভালো লাগছে। বুক ভরে শ্বাস নিল। লম্বা একটা হাই তুলে বললো,’এখন কী করবে? বাড়ি ফিরে যাবে নাকি?’
‘কেন? বাড়িতে কিছু বলোনি?’
‘বলেছি ভোরে তোমার সাথে মাছ ধরতে সমুদ্রে আসবো। খোঁজ করবে না।’
‘তাহলে অসুবিধা কোথায়?’
‘অসুবিধা নেই তো। এখন কোথায় যাবে তাই জানতে চাইছি?’
‘ওখানেই যাই চল। জাল,ঝুড়ি,টর্চলাইট খুঁজতে হবে।’
‘মারবে নাকি আমায়? সেখানে আবার কেন?’ সংকেত যেতে চাইলো না। রাতের কথা মনে পড়তেই শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। ভয় পেল। কিন্তু সূর্যময় তাকে ঠিক বুঝিয়ে নিয়ে গেল। দিনের বেলা ভূত থাকে না। তাছাড়া, সে পুরুষ মানুষ। ভয় পেলে চলে না। সেখানে পৌছে আগের দিনের সমস্ত জিনিস পেয়ে গেল সহজে। ভয় কিছুটা কাটলো। কিছুক্ষণ পরে সংকেত কিছু একটা ভেবে বলল,’ আচ্ছা, ভূত তো আগুনকে ভয় পায়, তাই না?’
‘হ্যাঁ, কেন বলো তো?’
‘ভূত যদি আগুনকে ভয় পায় তাহলে কেন বিড়ি চাইছিল। বিড়িতে তো আগুন ধরাতে হবে।’
‘সত্যি তো। আগে কেন মনে পড়লো না এ কথা।’
‘আমার মনে হয় কোনো ভূত-পেত্নী নয়। মানুষই ছিল। আমাদের কাছে বিড়ি চাইছিল। কিন্তু রাতের অন্ধকারে আমরা তাকে দেখতে পায়নি। হয়তো সেও আমাদের মতো মাছ ধরতে এসেছিল। আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক ভেবেছে। রাতে আমাদেরকে চিনতে অসুবিধা হয়।’
‘এমন হতেও পারে।’ খুব বেশি জোর দিয়ে বললো না সূর্যময়। তার মন অন্য দিকে চলে গেছে। আশেপাশে ভালোভাবে নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করলো। ভিজে মাটিতে দুজনের পায়ের ছাপ ছাড়া অন্য কারোর পায়ের ছাপ নেই। যেগুলো রয়েছে সেগুলো চার পাঁচ দিনের পুরনো। তা স্পষ্টভাবে বোঝাও যাচ্ছে। যদি সত্যি কোনো মানুষ এখানে এসে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই তার পায়ের ছাপ পড়ার কথা। কিন্তু ছাপ পড়েনি। কেন? সংকেতকে এই কথাটা জানাতে সে আবার একবার ভয়ে কেঁপে উঠলো। সমস্ত যুক্তি কোথায় হারিয়ে গেল। সেখানে আর থাকতে চাইলো না।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর তারা সমুদ্রের তলদেশ পেরিয়ে রাস্তায় পোঁছালো। সূর্যের রশ্মি মুহূর্তের মধ্যে শরীর গরম করে দিল। আশেপাশে দু-একটা দোকান ছাড়া তেমন কোনো দোকান খোলেনি। দোকানের দিকে তাকিয়ে সংকেত বলল,’তুমি কখনও বিড়ি খিয়েছো?’
‘হ্যাঁ, কেন?’
‘কীভাবে?’ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল সংকেত।
‘বাবা সবসময় বিড়ি খায়। সেখান থেকে নিয়ে মাঝেমধ্যে লুকিয়ে….।’
‘আমায় খাওয়াবে?’
‘এক্ষুনি!’
‘অসুবিধা নেই।’ সূর্যময় ছুটে পাশের দোকান থেকে দুটো বিড়ি আর দেশলাই নিয়ে এলো। তারপর অভিজ্ঞ ব্যক্তির মতো টান দিলো। চোখাচোখি হতেই হেসে ফেলল। নিজেকে বড়ো মনে হলো। বড়ো হয়ে গেছে বাবার মতো। এ ভাবে যদি সবকিছু নিজের মতো হতো তাহলে মন্দ হতো না। দৈনন্দিন জীবনে উঠতে-বসতে যেন কারোর পরাধীনতায় বাঁচতে হয়। কারোর প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হয়। এই দায়বদ্ধতা যদি না থাকতো তাহলে মন্দ হতো না। একা নিজের মতো বাঁচতো। বিড়ি টানার পরে একটু ভয় পেলো সংকেত। আবার আনন্দও হল। এমনটা হলো কেন? কে বলতে পারবে?
আরও কিছু দূর হাঁটার পর থমকে দাঁড়ালো সংকেত। তার চোখ নলকূপ পাড়ে গিয়ে স্থির হয়েছে। যেখানে পনেরো-ষোল বছরের এক কিশোরী দুইহাতে নলকূপের ডান্ডা ধরে পাম্প করছে আর পা নলকূপের মুখের দিকে বাড়িয়ে রেখেছে। শ্বেতবর্ণ পায়ের উপর জলের ধারা ঝরে পড়ছে। দূর থেকে বোঝা গেল মেয়েটি বেশ রুচিশীল এবং শৌখিন। মাথায় দু-দিকে ঝুঁটি করে চুল বেঁধেছে। পা ধোয়ার পর সে একহাতে পাম্প করলো আর এক হাতে জল নিতে গেল। সামান্য জল পেলো। বাকি সব আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়লো। ওইটুকু জল দিয়ে মুখে ঝাপটালো। মুখ আধভেজা হতেই একা একা হেসে উঠলো। মাথা ঝাঁকালো। বোঝা যাচ্ছে সে ভেতর থেকে ভীষণ খুশি। বালিকার মতো খুশি। সূর্যময় কিছু বলার আগেই সংকেত চিৎকার করে বলে উঠলো,’এই তৃধা! এ-দিকে তাকাও। আমি সংকেত, সংকেত বলছি।’ সূর্যময় বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো সংকেত খুব খুশি এবং মেয়েটি তার পরিচিত। জলে মাখা মুখে খুব সুন্দর দেখালো তৃধাকে। সে সংকেতকে দেখে হাসলো। হাত নাড়িয়ে কাছে ডাকলো। এক মূহুর্তও অপেক্ষা করলো না -দৌড় দিল। বন্ধুর কথা ভুলে গেল। সূর্যময় পেছনে পেছনে গেল। সংকেত পাম্প করল আর মেয়েটি ভালো করে পা-হাত-মুখ ধুলো। তৃধা খুব কথা বলে। কয়েকটা মুহূর্তে মধ্যে অন্তত কুড়ি-পঁচিশটা প্রশ্ন করে বসলো। সংকেতও যথাযথ উত্তর দিল। তৃধা প্রশ্ন করল, ঝুড়িতে একটাও মাছ নেই কেন? সংকেত সঠিক কথা বলতে চাইছিল। সূর্যময় মাথা নেড়ে রাতের ঘটনা বলতে বারণ করল। সেও নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিল। ওরা ছোট মাছ ধরতে পারে না। শুধুমাত্র কৌতূহলবশত চলে এসেছিল। অবিশ্বাস করল না মেয়েটি। খুব হাসলো। তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলো। সংকেত যেতে চাইলো না। মেয়েটি তার হাত ধরে টেনে টেনে নিয়ে গেল। সূর্যময় এগোল না। এভাবে যাওয়া যায় না। তাকে একবারের জন্যও ডাকছে না। সংকেতও কিছু বলছে না। রাগ হলো। সেখান থেকে পালাবে ভাবলো। কিন্তু বন্ধুকে ফেলে যেতে ইচ্ছে করলো না। কিছুটা যাওয়ার পর মেয়েটি তার উপস্থিতি টের করতে পারে। তাকেও তাদের বাড়িতে ডাকলো। এবার শান্ত হলো সূর্যময়। একসাথে গেল। বাড়ি বেশি দূরে নয়। রাস্তা পেরিয়ে পড়তেই তাদের বাড়ি। গেট খুলে ঢুকলো। আগেই সংকেত আর তৃধার কথোপকথন শুনে বুঝতে পেরে গেছিল তারা শুধু পরিচিত নয় খুব ভালোভাবে পরিচিত। কিন্তু বন্ধু কথাগুলো লুকিয়েছে কেন? তাদের বাড়ির চত্বরে আসার পরে এও বুঝলো, তারা গরীব নয়। সামনে বড় একটা পুকুর রয়েছে। পরিষ্কার জল। সদ্য মাছেদের খাবার দিয়েছে। খাবার পেয়ে তারা উল্লাসে ফেটে পড়েছে। খেলা করছে। মেয়েটা সত্যিই রুচিশীল। না হলে এত বড়ো পরিস্কার পুকুর থাকার সত্তেও কেউ হাত মুখ ধুতে পাবলিক নলকূপকে যায়! বাড়িতে প্রবেশ করে দেখলো, একজন স্বাস্থ্যবান প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ খবরের কাগজ উল্টাছেন। তাঁকে দেখে সব কিছু পরিস্কার হয়ে গেল সূর্যময়ের কাছে। লোকটিকে চেনে সে। সংকেতের বাবা যে হোটেলে রান্না করেন,ওই হোটেলের মালিক। উনার একটা মেয়ে আর ছেলে রয়েছে জানতো কিন্তু কখনও মেয়েকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিছুক্ষণ ধরে গল্প করলো তারা। বেশ ভদ্র পরিবার। ধনী হলেও এদের মধ্যে কোনো অহংকার নেই। সহজ সরল ভাবে সবাই কথা বললেন। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলেন। শান্ত মস্তিষ্কে তারা উত্তর দিল। তাদেরকে খাবার খেতে বলল। কেউ খেলো না। তৃধা কিংবা পরিবারে কেউ-ই বেশি জোর করলো না। বাড়ির উঠোন থেকে সদ্য নেমেছে এমন সময় তৃধা এসে সংকেতের হাতটা ধরলো। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে হেসে ফেললো। তাদেরকে রাস্তা পর্যন্ত পোঁছে দিল। দুজনকে ছাল ছাড়ানো দুটো পরিস্কার শশা দিল। কিছু বুঝতে পারলো না তারা। খালি পেটে কেউ শশা খায় নাকি? একটু অবাক হয়ে কিছু বলার আগেই তৃধা সংকেতের কান ধরে টেনে বললো,’দ্বিতীয় বার যদি বিড়ি টানো তাহলে সোজা তোমার বাবার কাছে খবর পৌঁছে যাবে। এবারের মতো ছাড়। কলেজে উঠে খাবে এখন না।’ উভয়ই চমকে উঠলো। মেয়েটা কি করে বুঝলো? বিড়ি টানার সময় দেখেছে! না, আশেপাশে কেউ-ই ছিল না। সতর্ক ছিল। মুখের গন্ধ পেয়ে টের করতে পেরেছে। মেয়েটির বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। বাড়িতে যাতে আর কেউ বুঝতে না পারে,তাই তাদের বাড়িতে বেশিক্ষণ না রেখে নিজেদের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে। রাস্তা পর্যন্ত এসে মেয়েটি আর এগোল না। শশাটা খেতে বলল। ফলে মুখের গন্ধটা দূর হবে। দুজনে চুপচাপ রইল। হঠাৎ-ই মুখের কথা কাহিনী হারিয়ে ফেলেছে সংকেত। চুপিচুপি সেখান থেকে কেটে পড়লো। রাস্তা আড়াল হওয়ার কিছুটা আগে সূর্যময় পেছনে ঘুরে দেখল, মেয়েটি তখনো তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুব মায়া ভরা চোখে তাদেরকে দেখছে। একটা মোড় ঘোরার পর আর কিছুই দেখতে পেল না। সে বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে কাছে টেনে নিয়ে উল্লাসের সাথে বলল,’লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম! এত কিছু…’ খুব খুশি দেখালো সংকেতকে। মনের উৎফুল্লতা জাগ্রত হয়েছে। মুহুর্তের মধ্যে চেনা চোখ মুখ খুঁজে পাওয়া গেল না। এ যেন পুরোনো কোনো এক প্রেমিকের চোখ মুখ। কি হাসি লেগে আছে তার ঠোঁটে। বয়ঃসন্ধিকালে প্রথম প্রেমের উল্লাসের সাথে কোথাও যেন হারিয়ে যাওয়া রং বেলুনের কাহিনীও রয়েছে। হাসি দুঃখ দুটোই ফুটে উঠল মুখমন্ডলে। বন্ধুর চোখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল।
‘এ প্রেম নয়। শুধুমাত্র দায়বদ্ধতা আর কৃতজ্ঞতা। ছোটবেলা থেকে মাকে হারিয়েছি। আর তারা ভাবে আমি সুখে নেই। মা ছাড়া সুখী হওয়া যায় না। সুখ আমার জীবনে আসতে পারে না। তাই সামান্য কৃতজ্ঞতা। ব্যাস এটুকুই।’ সংকেতের হাসিমাখা মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। রাস্তার দিকে তাকিয়ে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে গেল। সূর্যময় কথা বাড়ালো না। সাতসকালে বন্ধুর মন খারাপ করতে চায় না। তবে এটুকু বুঝতে পেরেছে তৃধার পরিবারের মধ্যে তাদের প্রতি অন্য কারোর দায়বদ্ধতা কিংবা কৃতজ্ঞতা থাকলেও মেয়েটির চোখে কোনোরকম কৃতজ্ঞতা নেই। এ ভালোবাসা না অন্য কি জানে না সে। তবে এটুকু বলতে পারে মেয়েটি মন থেকে তাকে কাছে চায়। পাশে থাকতে চায়। তবে তা প্রেমিকা না বন্ধু না বোন হিসেবে তা বলতে পারবে না। তার চোখে সংকেতের প্রতি আলাদা একটা ভালবাসা রয়েছে। সম্মান ও বিশ্বাস রয়েছে। বন্ধুর চোখ দেখে এ ও বুঝতে পারল সেও মনে মনে তৃধাকে কমনা করে। রাতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা খুব সহজে কাটিয়ে উঠতে পারলো না সংকেত। উঠতে বসতে বারবার রাতের নির্জনতা আর ওই বৃদ্ধর রিনরিনে কন্ঠস্বর মনে পড়লো। গায়ে জ্বর উঠলো। সম্পূর্ণ সেরে উঠতে কয়েক দিন সময় লাগলো।

সবুজ হারিয়ে যাওয়ার পার সংকেত আর সূর্যময়ের কাছে সবচেয়ে বিরক্তকর হয়ে উঠেছে স্কুল জীবন। সূর্যময়ের চাইতে সংকেতের কাছে আরও বেশি বিরক্তিকর। আগে সবুজের বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যেতে হতো। এখন সূর্যময়ের বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যেতে হয়।রোজ রোজ এত দূর হাঁটতে ভালো লাগে না। সবুজ‌ থাকাকালীন প্রতিদিন স্কুলে যেতো। এখন সপ্তাহে তিন-চার দিনের বেশি যেতে পারে না। সবুজ ছাড়া কোনো কাজ ভালো লাগে না। একসঙ্গে তিন জন বসে কত গল্প করেছে। পাশে বসে কত সুন্দর সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বলে দিতো। হোমওয়ার্ক করে দিতো। ভয় থাকতো না। প্রতিদিন বাড়ি কিংবা দোকান থেকে ‌তিনজনের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতো। স্কুলে, গ্রামে আশেপাশে কত মানুষ তার তিন বন্ধুকে দেখে কত তারিফ করতো। আজ সেসব সোনালী দিন হারিয়ে গেছে। ভালো লাগে না কিছু। চুপচাপ ক্লাসে বসে ঢুলে পড়ল সংকেত। ঘুম পাচ্ছে তার। স্যার একবার দেখেও কিছু বললেন না। সূর্যময় বুঝতে পেরে বন্ধুকে সাবধান করলো। দ্বিতীয় বার দেখতে পেলে রক্ষে থাকবে না। কিছু একটা পড়িয়ে স্যার ক্লাসের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করলেন। সবুজের অনুপস্থিত টের করতে পারলেন। এর আগে বার কয়েক বার ক্লাস নিয়েছেন তবে খেয়াল করেননি। খেয়াল করতেই অবাক হলেন। আজকে একজনকে ছেড়ে এরা দুজন বড় চলে এসেছে যে! ঝগড়া হয়েছে? না সূর্য অন্য দিকে উঠেছে। তিনি সংকেতকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,’সবুজ কই?’ সংকেত কোনো উত্তর দিল না। চুপচাপ রইল। মনে মনে খুব দুঃখ পেলো। তাকে কিছু বলতে না দেখে স্যার একটু আগ্রহ প্রকাশ করলেন। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। তাই একই প্রশ্ন সূর্যময়কে করলেন। সে দাঁড়ানোর আগেই মাঝখানের বেঞ্চ থেকে কেউ একটা বলে উঠলো, সবুজ মেয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে। সারা ক্লাস জুড়ে একটা সোরগোল পড়লো। স্যারও খুব মজা পেলেন। সবাইকে শান্ত করে সমস্ত ঘটনা শুনলেন। তারপর হতাশায় চেয়ারে গিয়ে বসলেন। এই সামান্য কারণে কেউ বাড়ি ছাড়ে? পুরো ক্লাস নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেলো। সামনে থেকে পেছনে থেকে কেউ কেউ উঁকি মেরে সংকেতকে দেখলো। খারাপ লাগলো তার। মনের অপরাধবোধটা এরা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। এই সবুজ কোথায় তুমি? ফিরে আসো না! আমাদের আর কিছু ভালো লাগছে না। কথা তো ছিল সারাজীবন সাথে থাকবো। তাহলে মাঝপথে হারিয়ে গেলে কেন? এই দেখো আমারা ভালো নেই। তোমায় খুঁজে বেড়াচ্ছি। তুমি তো বলতে আমি খুব জেদী আর এখন উল্টো মনে হচ্ছে। সবাই চুপচাপ থাকলেও সূর্যময় রইল না। সে ওই ছেলেটা খুঁজলো যে বন্ধুকে নিয়ে মজা উড়িয়েছে। সফলও হলো। স্কুল ছুটি হওয়ার পর সংকেতকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে সাইকেল জোরে ছোটালো। একটু ভয় পেল সংকেত। সে এমন ভাবে সাইকেল চালাছে কেন? আগেতো কখনও এমন করেনি। সবার স্কুল ছুটি হওয়া রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড় রয়েছে। সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত কিন্তু…। চটপট বলল,’এত জোরে চালাছো কেন?’
‘তন্ময়কে ধরতে হবে।’
‘কেন? সে আবার কি করল?’
‘ও মা তুমি ভুলে গেলে? ও যে বন্ধুকে নিয়ে মজা করলো। ব্যাটাকে শাস্তি দিতে হবে না? সোজা ওকে ধাক্কা মেরে যদি জমিতে ফেলতে না পেরেছি তাহলে আমার নাম সূর্যময় নয়।’
‘না না, এমন কর না। আমার কথা একটি বার শোনো।’
‘তোমার কিছু হবে না। চুপটি করে বসে থাকো।’
‘আমি আমার কথা ভাবছি না। কিন্তু আমার পরিবার!’
সাইকেলের গতি কমালো। সুযোগ বুঝে কিছুক্ষণ পর দাঁড়িয়ে পড়লো। তাকে একটু হতাশ দেখালো। বুঝে গেছে আজ আর তন্ময়কে ধরতে পারবে না।
‘তোমার কি হয়েছে বল তো? ওকে ধরতে দিলে না কেন?’
‘ও তৃধার দাদা।’
‘তো? তোমার কাছে সবুজ আগে না তৃধা?’
‘সবুজ, কিন্তু ওর কিছু হলে নিশ্চয়ই তার বাবার কাছে বলবে। তখন আমার বাবার কাজ অনিশ্চয়তা উপর দাঁড়িয়ে থাকবে।’ সূর্যময় শান্ত হলো। পরিস্থিতি বুঝলো। মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সে কোনো ভাবে তন্ময়ের ক্ষতি করবে না। সংকেতের চোখ থেকে জলের ধারা ঝরে পড়লো। সামান্য কিছুতে ভেঙে পড়তে দেখে খারাপ লাগলো তার। বুকের মধ্যে অল্প বয়সে কত যন্ত্রনা পুষে রেখেছে একমাত্র সে-ই জানে। এত আবেগপ্রবন ছেলে আগে কখনও দেখেনি। দুঃখ কষ্ট যেন তার অজীবনের সঙ্গী। বন্ধুর চোখের জল মুছে দিল। হাসিমুখে বলল,’ও বন্ধু, এত সহজে ভেঙ্গে পড়লে হয় নাকি! তুমি না ক্লাসের ফার্স্ট বয়। তোমার কাছ থেকে সবাই শিখবে। আর তুমি…।’

পর্ব ৩ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here