নিরুদ্দেশ পর্ব ১৫

নিরুদ্দেশ
পর্ব ১৫

প্রথম বইতে কপির তোকমা খুব সহজে কাটিয়ে উঠতে পারল না সবুজ। পরবর্তী সময়ে যে প্রচুর সমস্যা হবে বুঝতে পেরেছিল। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও উঠে দাঁড়ানোর সাহস বুকের মধ্যে ছিল। আবার প্রথম থেকে শুরু করে। প্রথমে তার বই কেউ ছাপাতে সাহস করলো না। তার নামে নেগেটিভিটি ছড়িয়ে পড়েছে সব জায়গায়। তবে নিজের জেদ হারালো না। পর পর আবার দুটো বই বের হলো। তেমন কোনো সাড়া ফেলতে পারল না। তারপর বেরোলো তার প্রথম কবিতা সংকলন,”৭১ এর ৭১”। মোটামুটি ভাবে লাভবান হলো। অনেকে প্রশংসা করল। তারপর হঠাৎ করে সে কথাকাহিনী হারিয়ে ফেললো। এরপর কি লিখবে ভেবে পেল না। তবে কি তার কলম থেমে যাবে? এখানেই তার লেখক জীবন সমাপ্ত। আর কিছু করার নেই? সমস্ত কিছুর সমাপ্ত হয়ে গেছে? মনের মধ্যে অনেক ভাবনা এলো। ভাবনা গুলোকে গুছিয়ে গল্প আকারে তৈরি করে নিল। কিন্তু ভাবনা ভাবনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো। ভাষায় রূপান্তর করল না। এ যে ধরাবাঁধা লেখা। প্রেম-ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, মান-অভিমান, সাধারণ মানুষের কাহিনী, গোয়েন্দাদের কাহিনী পড়ে পড়ে বাঙালি পাঠকের মধ্যে একটা অরুচি চলে এসছে। তারা নতুন কিছু খুঁজছে। তাদেরকে নতুন কিছু দিতে হবে। সবুজ সে-ই নতুন কিছু খুঁজতে শুরু করলো। একঘেঁয়েমি সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ হতে চাইল না। একটি নতুন দিক দেখাতে হবে। অনেক পীড়াপিড়ির পর নিজের মনের মধ্যে তিনটা শব্দ এল। খাতা কলম খুলে লিখে ফেলল “ঈশ্বর যখন বন্দী”। বাহ্ নামটা বেশ দারুন। নিজের লেখা নিজেই প্রশংসা করল। কিন্তু নামকরণ দিয়ে কি হবে? উপন্যাসের বিষয়বস্তু কি হবে? ঈশ্বর মানে দেবতা। পৌরাণিক কোনো গল্প লিখতে হবে। যদিও বাঙালিরা ঐতিহাসিক কিংবা পৌরাণিক রূপকথার গল্প বেশ পছন্দ করে। তবে তাই হোক। এবার কোনো রূপকথার গল্প হোক। সবুজ লিখতে শুরু করলো। একমাস লেখার পর উপলব্ধি করলো, লেখাটি কেমন খাপছাড়া হয়ে গেছে। সে তো লিখতে চাইছিল রূপকথার গল্প। কিন্তু বাস্তবে লিখেছে সাধারণ মানুষের কাহিনী। সে-ই পুরনো একঘেঁয়েমি কাহিনী। কলম আবার থমকে গেল। গতানুগতিক ভাবে চলতে পারে না। নিজের মনের সাথে যুদ্ধে লিপিবদ্ধ হলো। অল্পদিনে যুদ্ধের সমাপ্তি হলো না। চলতেই রইল। যুদ্ধ সবুজকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেল। প্রায় ছয় মাস যুদ্ধ চলার পর নিজের উপন্যাসটি সমাপ্ত করলো। মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। নিজের উপন্যাস নিজে পড়ে অবাক হলো। এটা কি সবুজের আনাড়ি হাতের লেখা? মনে হচ্ছে না তো। সে তো রূপকথার গল্প লিখতে চাই ছিল। কিন্তু মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে অন্য কিছু লিখে ফেলেছে। গল্পের মূল কাহিনী বদলে ফেলেছে। গল্পের নামকরণ দেখে অনেকেই বুঝবে এটা কোনো পৌরাণিক গল্প। কিন্তু না…। এটা সমকালীন উপন্যাস। এখানে ঈশ্বর বলতে সবুজ রাজনীতিক নেতাদের বুঝিয়েছে। রাজনীতিক নেতাদের ঈশ্বর বলে আখ্যা দিয়েছে। তাদের বন্দী করে ফেললে কেমন হবে আমাদের দেশ? সাধারণ মানুষকে যখন কেউ সাহায্য করে তখন সাধারন মানুষগুলো সাহায্যকারী ব্যক্তিকে ভগবান হিসেবে গণ্য করে। কিন্তু ওরা বোঝে না সমস্ত সাহায্যকারী ব্যক্তি ভগবান হয় না। ওরা সাহায্যের মাধ্যমে একটা অধিকার ফলাতে শুরু করে। সাধারণ মানুষকে বোকা বানায়। সাহায্যকারী ব্যক্তি যদি ঈশ্বর হয় এবং তাদের যদি বন্দী করে ফেলা হয় তাহলে কেমন হবে? এটা নিয়েই উপন্যাস।
সবুজের দৃঢ় বিশ্বাস, বইটি তাকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। ভাগ্যের চাকা বদলে যাবে। সবুজ আশাহত হলো না। বইটি ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলল। বাঙালি পাঠক মহল নতুন কিছু একটা পেয়েছে। চতুর্দিকে বইটি প্রশংসায় ভাসতে শুরু করে। অনেক বড় বড় ব্যক্তি সবুজের সঙ্গে দেখা করে। সবুজের গুনোগান গাইলো। তার নামের পত্রিকায় আর্টিকেল বেরোলো। বাঙালি পাঠকের কাছে পরিচিত হতে বেশি সময় লাগল না। বইটি তাকে দুটো গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার এনে দিল। আর পিছনে ঘুরে দেখতে হলো না। লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে গেল। খুব শীঘ্রই আবার একটা বই বের হলো। সমানভাবে জনপ্রিয়তা না পেলেও মোটামুটি ভালোই বিক্রি হলো। পরিচিতির সংখ্যা বাড়তে-ই রইল। কিন্তু ধীরে ধীরে অনুভব করল তার সম্মান খ্যাতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার আর বন্ধুদের থেকে দূরত্ব বাড়তে শুরু করেছে। যে বন্ধুদের একসময় না হলে চলত না, তাদের কথা এখন খুব বেশি মনে পড়ে না। তারা ডেকে পাঠালেও সময় দিতে পারে না। অজুহাত দেখায় না সে। সত্যি সত্যি কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এত চাপের মধ্যে অবসর সময় খুঁজে পাচ্ছে না। আজ এই প্রতিষ্ঠানে তো কাল ওই প্রতিষ্ঠানে অন্যদিন কোনো বিদ্যালয় কিংবা কলেজ তারপরের দিন কোনো সাহিত্য সভায় বক্তৃতা দিতে দিতে তার সময় কেটে যায়। তার উপর রয়েছে পত্রিকায় সময়মতো লেখা জমা দেওয়ার চাপ। সব মিলিয়ে ব্যস্ত মুখর অবস্থা। একটু অবসর সময় পেতেই মনে পড়ল, সে প্রথম বই প্রকাশের জন্য প্রকাশনীর কাছে গেছিল তখন ওই প্রকাশনীর সম্পাদক বলেছিলেন, লেখক হওয়া সহজ নয়। লেখক হতে গেলে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়। আজ তাকে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়েছে। বাড়ি থেকে সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন বললেই চলে। আজ ছয় মাস ধরে বাবা-মা, দাদা-বৌদি কারোর সাথেই কথা হয়নি। শুধু খাবারের সময় বৌদিমণিকে খাবার দিতে বলে। দু- একটা কথা বলে বিদায় নেয়। সংকেত আর সূর্যময়ের সাথে বেশ অনেকবারই কথা হয়েছে। তবে পূর্বের সে-ই হাসি আড্ডা কৌতুক নেই। না না এভাবে সবকিছু হারাতে দিলে চলবে না। এবার অবসর সময় খুঁজে বার করতে হবে। বন্ধুদের ছাড়া চলতে পারবে না। তেমন কোনো কাজ না থাকায় তাড়াতাড়ি নতুন বাড়িতে গেল খাবার খাওয়ার জন্য। পার্বতী খাবারের ব্যবস্থা করল। তাকে খেতে দিয়ে পাশে বসলো। লোকের খাবারের দিকে নাকি তাকাতে নেই। কিন্তু পার্বতী কোনো কারণে চোখ ফেরাতে পারল না। সবুজ এত দ্রুত কি করে খাওয়া শেষ করে? মুহূর্তের মধ্যেই খেয়ে ফেলে। অল্প খায় কিন্তু তা বলে এত দ্রুত! একটু কৌতুক করে বলল,’কি ব্যাপার ভাই, আজ এত তাড়াতাড়ি খেতে চলে এলে? কোথাও যাওয়ার আছে নাকি!’
‘না নেই। বাড়িতে তেমন কোনো কাজ নেই। তাই চলে এলাম।’
‘ভুলেই তো গেছো সবাইকে।’
‘এমনটা বলো না। আমি দুঃখ পাবো। আমি সত্যিই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি তাই কাউকে সময় দিতে পারছি না। এখন অনেকটা হালকা হয়ে গেছি। এবার নতুন করে সবুজকে চিনবে।’
‘ও মা, তাই নাকি!’ সবুজ হাসলো। হাসিতে যোগ দিল পার্বতী। খাওয়া শেষ হতে সবুজ বলল,’একটা কথা বলি, বৌদিমণি!’
পার্বতীর সম্মতি জানাতে সবুজ বলল,’পুরনো বাড়িতে দাদা উপরের তলায় থাকতো। ওই ঘর কি তোমাদের দরকার? যদি দরকার না হয় তাহলে আমি ব্যবহার করতাম।’
‘ও মা,এ কি কথা! তোমার জন্য তো এ বাড়িতে দুটো ঘর রয়েছে। তুমি এখানে আসবে না?’
‘না।’
‘দাদার উপর রাগ করেছো? একসঙ্গে থাকতে চাও না?’
‘আমায় বার বার কেন ভুল বুঝছো? দাদার সাথে আমার কোনো ঝামেলা নেই। পুরনো বাড়িতে মায়া পড়ে গেছে। আমি ওই বাড়ি থেকে বের হতে চাই না। ছোটবেলার কত স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। আমি পারবো না চকচকে বাড়িতে থাকতে। আমি পুরোনো বাড়িতে মন্দ নেই।’
‘তোমার বয়স অল্প কিন্তু কথাগুলো বৃদ্ধের মত। তোমার বয়সের ছেলেদের চিন্তাধারা আর তোমার চিন্তাধারা সম্পূর্ণ আলাদা। তুমি ব্যতিক্রম মানুষ।’ সবুজ মৃদু হাসলো। বৌদিমণিও হাসল। তবে সে হাসি সুখকর নয়। সে মোটেও সবুজের ভাবনাচিন্তাকে সমর্থন করছে না। সে চায় সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকতে। তাদের একান্নবর্তী সুখকর এক পরিবার হোক। সবুজ এভাবে যদি আলাদা ঘরে থাকে তাহলে বিয়ের পর আর এই বাড়িতে খাবারের সময়ও আসবে না। একটু একটু করে দূরত্ব বাড়বে। তারপর সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাবে। বুকের সূক্ষ্ম ব্যথা গুলো লুকিয়ে রাখল। কৃত্রিম হাসলো। কিছু বলার আগেই সবুজ বলল,’কিছু বললে না তো? তোমাদের কি উপরের ঘরটা চাই?’
‘না, আমাদের দরকার নেই। তুমি ব্যবহার করতে পারো।’ সবুজ মহাখুশি। হাসিমুখে বেরিয়ে এলো। নিজের বাড়িতে এসে সোজা ওপরে চলে গেল। তালা বন্ধ ছিল। খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। অনেকদিন কোনো মানুষ এখানে আসেনি। ধুলো ময়লা জমে আছে। পরিষ্কার করে ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে। ঘরটা ভীষণ প্রয়োজন। লেখালেখির জন্য নিজের ঘরটা অনুপযুক্ত। পোশাক-আশাক বিছানাপত্র নিজের ঘরে পড়ে রয়েছে। ওই গুলা দেখলে মনের ভাবনা সব উঠে যায়। মন বিষন্নতায় ভরে ওঠে। লেখার জন্য উপযুক্ত হলো খোলা আকাশ আর সবুজ দিগন্ত। আর এই ঘর থেকে সহজে খোলা আকাশ দেখা যায়। হালকা বাতাস প্রবেশ করে। ঘরটিকে যদি ছোট্ট একটা লাইব্রেরি বানানো যায় তাহলে মন্দ হয় না। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ঘর ঝাড়া শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর উপলব্ধি করলো কেউ একজন সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে আসছে। এমন সময় আবার কে আসছে? যেই আসুক না কেন সোজা উপরে আসার কথা নয়। নিচ থেকে অন্তত তাকে ডাকতো। তাহলে পরিচিত কেউ হবে। বৌদিমণি নয়তো! পিছনে ঘুরে নিজের ভাবনাকে সঠিক হতে দেখে হা হা করে হেসে উঠলো। থতমত খেয়ে গেল পার্বতী। ছেলেটা তাকে দেখে হাসে কেন?
‘হাসছো কেন?’
‘আমি ভাবছিলাম তুমিই উপরে আসছো। আর আমার ভাবনার অবসান ঘটতে না ঘটতে তুমি এসে হাজির।’
‘আমি বুঝি আসতে পারি না?’
‘আমি তো তেমনটা বলিনি। এই বাড়িটা শুধু আমার নয় তোমাদেরও। আমার যেমন অধিকার রয়েছে তেমনি তোমাদেরও অধিকার রয়েছে। তাছাড়া আমার বাড়ি হলেও কি হয়েছে? তুমি আমাদের পরিবারের একজন সদস্য। তোমার আসা যাওয়া কে আটকাবে?’ ঠিক ভাবে কথাগুলো শুনল না পার্বতী। এই বাড়িতে অনেকবার এসেছে সে। উপরেও উঠেছে। তবে সব সময় তালা বন্ধ থাকায় এ ঘরে আসার সুযোগ হয়নি। রিপনের মুখে শুনেছিল, পূর্বে সে এই ঘরে থাকতো। তাই খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলো। কোনো স্মৃতি খুঁজে পায় কিনা! ঘরে মধ্যে কিছুক্ষণ ঘোরার পর সবুজকে প্রশ্ন করল।
‘এখনই এই ঘর পরিষ্কার করবে?’
‘ইতিমধ্যে আমি পরিষ্কার করা শুরু করে দিয়েছি।’
‘তা তো দেখতে পাচ্ছি। আমায় বললে কি আমি করে দিতাম না? না, তোমাদের কোনো কাজ করে দি না?’
‘এমন ভাবে বলছো কেন? তুমি সারাদিন কত কাজ করো। তোমাকে আগ বাড়িয়ে বলতে যাব কেন? সামান্য কাজ একা করতে পারব। তাছাড়া, নিজের কাজ নিজে করা ভালো।’
‘তোমাদের বাড়িতে কাজ! মনে হয় মাঝেমধ্যে আমি তোমাদের বাড়িতে কাজের মেয়ে হয়ে আছি। রান্নাবান্না ছাড়া তেমন কোনো কাজ নেই। আমি তো একটা মানুষ,তা স্বীকার করো! সত্যি করে বলতো, তোমরা কি আমায় গুরুত্ব দাও? তোমার দাদা কাজে ব্যাস্ত। আগে শুধু কোম্পানিতে চাকরি করতো। এখন নিজের নামে কম্পানি হয়েছে। কয়েকদিন আগে আরও দুটো কোম্পানিতে শেয়ারে যোগ দিয়েছে। নিশ্চয়ই সে খবর তোমার কানে পৌঁছেছে। সে টাকা কামাতে ব্যস্ত। ঘরে যে একটা মানুষকে রেখে গেছে সেটা ভুলে গেছে। মাঝেমধ্যে বাড়িতে এসে নিজের দায়িত্ব শেষ করে। শ্বশুরমশাই তো শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শাশুড়ি মা! তিনি তিন বেলা কি রান্না হবে শুধু সেটাই বলে যান। রাতে ঘুমানোর আগে বলেন, বেশি রাত পর্যন্ত টিভি দেখবে না তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে। নাহলে শরীর খারাপ করবে। আর কখনো কখনো জিজ্ঞেস করেন,ছেলে ফোন করেছে কিনা! আর বাকি থাকলে তুমি! তুমি তো আরও এক ধাপ এগিয়ে আছো। তিন বেলা ওই বাড়িতে গিয়ে বল, বৌদিমণি খেতে দাও। খাবার দিতে দেরি হলেও কিছু বলো না তাড়াতাড়ি দিলেও কিছু বলো না। খাবারে নুন বেশি হলেও একটাও কথা বলো না কম হলেও বলো না। চুপচাপ খাওয়ার পর ‘আসছি’ বলে আবার এ বাড়িতে চলে আসো। কখনো জিজ্ঞেস করেছো আমি খেয়েছি কিনা! আমার শরীর ঠিক আছে কিনা! একদিনও আমার সঙ্গে ভালোমতো কথা বলেছো? কথা বলবে কেন? আমিতো পরের ঘরের মেয়ে।’ পার্বতী আর কিছু বলল না। সবুজ সব কিছু ফেলে বৌদিমণির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ওর চোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ছে অথচ কাঁদছে না। অভিমান দুঃখ কষ্ট বেদনায় হৃদয় শুকিয়ে গেছে তবুও মুখে অনুপম ভঙ্গি। অন্তরের চরম বেদনায় ভেঙে পড়েছে। ওর দিকে কিছুতেই তাকাতে পারছিল না সবুজ। কেমন অকৃতজ্ঞ লাগছে। সত্যি তো, বৌদিমণির সাথে সে কিংবা তার পরিবার যা করছে, তা কি সঠিক? একটা মানুষকে এইভাবে ঘরে বন্দী করে রাখা ঠিক হচ্ছে না। সবুজের খারাপ লাগাটা অন্তরের মধ্যে থেকে গেল মুখ ফুটে কিছুই বলল না। পার্বতী আবার বলল,’তুমি তো এ-দিক ও-দিক কত জায়গায় ঘুরতে যাও। আমায় একবার ডেকেছো? আমায় নিয়ে গেলে বুঝি তোমার সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে? আমিও তো তোমাদের মত রক্তমাংসে গড়া একটা মানুষ। আমার কি কোনো ইচ্ছে নেই? আমার কি বাইরে বেরোতে ঘুরতে ফিরতে ইচ্ছে করে না?’ সবুজ তথাপি চুপ রইল। ছোটবেলা থেকেই খুব কম কথা বলে। পার্বতী পূর্বে বেশ কয়েকবার সবুজের সঙ্গে বাইরে বেরোনোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। সবুজ নিয়ে যায়নি। সমাজকে ভীষণ ভয় পায় সে।এখনো গ্রাম বাংলার মানুষ বৌদি আর দেওরের সাথে বেশি মেলামেশা পছন্দ করে না। বৌদি আর দেওর যে ভাই বোনের মত সুন্দর সম্পর্কে আবদ্ধ হতে পারে তা অনেকেই ধারণা করতে পারে না। মানুষের মাথায় উৎকট ভাবনা আসতে সময় লাগে না। কত মানুষ কত গল্প বানিয়ে ফেলে। সবুজ এসব ভয় পায়। এই সব কারণে বৌদিমণিকে এড়িয়ে গেছে বারবার।ঘন নিস্তব্ধতা। পার্বতী জোরে জোরে নিঃশ্বাস ত্যাগ করছে। সবুজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চায়নি। অস্বস্তি হচ্ছে।কোনো রকম ভাবে বিদায় নিতে পারলে শান্তি। কিন্তু পার্বতীর কথা বলার তাগিদ যেন বেড়েই চলেছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,’আজ তোমার স্কুলে আমন্ত্রণ রয়েছে, না!’ সবুজ চমকে উঠলো।আজ স্কুলের সুবর্ণ জয়ন্তী। সে এখন শুধুমাত্র স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র নয়, একজন প্রখ্যাত লেখক। স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রের গৌরবময় মহিমায় সমস্ত শিক্ষক আপ্লুত। স্কুলের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছে সে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রধান অতিথি হিসাবে আপ্পায়ন করেছে সবুজকে। সবুজ প্রত্যাখ্যান করেনি। যথা সময়ে পৌঁছে যাওয়ার সম্মতি জানিয়েছে। কিন্তু সে খবর বউদিমণির কানে কি করে পৌঁছালো? দৃঢ় স্বরে জিজ্ঞেস করল,’তুমি কি করে জানলে?’
পার্বতী হাসলো। বেশ হাসলো। বলল,’তুমি বাড়িতে সবসময় থাকো না। তোমার খোঁজ না পেলে বাড়িতে যে মানুষটা থাকে তাকে বলে যায়। আর বাড়িতে তোমার মা আর আমি ছাড়া কে থাকে?’ সবুজ মাথা নিচু করে ফেলল।
‘আমায় নিয়ে যাবে আজকে? আমিও স্কুলের অনুষ্ঠান দেখবো। কতদিন হলো বাইরে বের হইনি। অনুষ্ঠান দেখা হয়নি। বাইরের জগৎ থেকে আমি বিচ্ছিন্ন।’ সবুজ কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। একটা টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে গেল। বউদিমণির ব্যাকুল অনুরোধ কিছুতে ফেলতে পারছে না। চোখ দুটো জলে ভিজে রয়েছে। তার দিকে তাকাতেই বুকের ভেতর কেমন মমতা বেদনায় কেঁপে উঠল। লোকে যদি কু-কথা বলে! তখন কি হবে? লোকের কথা ভাবলে কি চলবে? তারা তো কিছু না কিছু বলতেই থাকবে। সে তো একজন লেখক। সমাজকে নতুন দিক দেখায়। তার মনেও যদি এমন নোংরা ভাবনা পুষে রাখে তাহলে তার মস্তিষ্কটা নষ্ট হয়ে যাবে। এমন ভাবনা কখনো সুস্থ মস্তিষ্কের হতে পারে না। শুধু খাতা-কলমে সমাজের নোংরা দিকগুলোর প্রতিবাদ করে লাভ নেই। বাস্তবেও করে দেখাতে হবে। তবেই সে হয়ে উঠতে পারবে একজন প্রকৃত মানুষ। হঠাৎ করে তার রক্তে সততা জেগে উঠলো। বলল,’নিয়ে যাবো। অবশ্যই নিয়ে যাব।’ পার্বতীর মুখে হাসি ফুটল। সবুজও হাসলো। দুজন মিলে পুরো ঘর পরিষ্কার করল। নিচ থেকে বইপত্র নিয়ে এসে উপরে রাখলো। বেশ কয়েকটা টপ জানালায় রাখল। সুন্দর করে ঘর সাজালো। অনেকটা সময় পার্বতীর সঙ্গে কাজ করার পর বুঝলো, মানুষটিকে বাইরে থেকে যতটা সুখী দেখাচ্ছে ভেতরে মটেও অতটা সুখী নয়। দুঃখের আগুনে দগ্ধ হয়ে আছে। সে এই জীবন নিয়ে মোটেও ভালো নেই। পৃথিবীটাকে যেন অন্য রকম দেখতে চেয়েছিল। পরিস্থিতির কাছে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু ভেতরের কল্পনার জগৎ এখনো সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে পারেনি। কখনো কখনো সে-ই সত্তা জ্বলে ওঠে। স্বপ্ন দেখে। খুশি হয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে। সবুজ কল্পনা করল তার জীবনটা যদি বৌদিমণির মতো হতো। তাহলে কেমন হতো? কল্পনা করতে পারল না। কল্পনা মানুষকে খুশি করে। কিন্তু এমন জঘন্য কল্পনা করতে চায় না সে। এটা তার পক্ষে অসম্ভব। সারাদিন বন্দী না থেকেও বন্দী আছে। একটা ঘরের মধ্যে সারাটা জীবন কাটানো যায় নাকি? পৃথিবীর অনেক রঙিন। পৃথিবীকে চিনতে হবে। সে কল্পনায় এত কষ্ট পাচ্ছে, তাহলে পার্বতী বাস্তবে কতটা না যন্ত্রণা সহ্য করছে? তার জীবনের প্রতি অনীহা চলে এসেছে। নিজের ব্যাকুলতাও কাউকে বলতে পারে না। ঘর গোছানো শেষ হওয়ার পর পার্বতী জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। খোলা আকাশের দিকে চোখ নিমজ্জিত করল। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘে আকাশকে বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছে। হালকা সূর্যরশ্মির তার মুখের ওপর এসে পড়েছে। একান্ত স্নিগ্ধ শান্তস্বভাব এবং সুনির্মম চরিত্র। তার মুখের উপর বসন্তের রাতে জ্যোস্না মত একটা সহজ হাসির আভা দেখা গেল। সবুজ পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বৌদিমণিকে ডাকলো। সে সাড়া দিতেই সবুজ বলল,’তুমি এখানে মিছামিছি বন্দী হয়ে আছো কেনো? তুমি চলে যাও। দাদার কাছে চলে যাও। সেখানে ভালো থাকবে। যদি দাদার কাছে যেতে ইচ্ছে না করে তাহলে তোমার যেখানে মন চায় সেখানে চলে যাও। নিজের মতো করে বাঁচো।’ আঁচল গুটিয়ে একটু ধীর স্থির হয়ে বলল,’মেয়ে মানুষ গুলো বড্ড জটিল হয়, সবুজ। ভালোবাসার আগে অনেক স্বপ্ন দেখে। কিন্তু ভালোবাসার পর যখন দেখে তার স্বপ্ন গুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। তখন সে আর প্রতিবাদ করে না। সবকিছু মেনে নেয়। নিজের জীবনটা শেষ হয়ে গেলেও ভালোবাসার মানুষটাকে ছাড়ে না। তোমরা পুরুষ মানুষেরা ওসব বুঝবে না। শুধু নারীদের দোষ দিয়ে যাবে। আর তোমার দাদার কথা বলছো! সেখানে গিয়ে আমি কি করবো? তোমার দাদা সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকবে। আমাকে সে-ই একটা রুমে বন্দী হয়ে থাকতে হবে। উনি টাকার মুখ দেখেছেন। টাকা ছাড়া কিছু চেনেন না। যে মানুষটার টাকার লোভ আছে ওই মানুষটাকে ভালোবাসা দিয়ে বদলানো যাবে না। টাকার লোভ ভয়ঙ্কর। তোমাদের পরিবারটা কেমন যেন! টাকা! টাকা! টাকা! টাকার জন্য তোমরা বাবা-মা দাদা-ভাই একে অপরের সাথে ঠিকঠাক কথা বলো না। সময় দিতে পারো না।’
পার্বতীর কথা খুঁটিনাটি শুনল সবুজ। তারপর শীতল কন্ঠে বলল,’আমার অনেক আগে তুমি পৃথিবীতে এসেছো। তোমার অভিজ্ঞতা অনেক। তবুও একটি কথা বলব, ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসা জয় করা যায়। ভালোবেসে দেখো সবকিছু জয় করতে পারবে।’

সূর্যমামা বিদায় নিয়েছে। একটু একটু করে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় বিদ্যুৎ চলে গেল। তৃধা ঠাকুর ঘরে সন্ধ্যা দিচ্ছিল। জোরে হাঁক ছেড়ে সংকেতকে বলল, ল্যাম্প জ্বালাতে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দিনের অন্তিম লগ্ন দেখছিল। স্ত্রীর ডাক শুনে ভেতরে চলে আসলো। ল্যাম্প জ্বালালো। গতকাল রাতে বাড়ি ফিরেছে। বন্ধুদের সাথে দেখা হয়নি। একবার দেখা করলে হতো। স্কুলের অনুষ্ঠান হচ্ছে খবর পেয়েছে। সেখানে একবার গেলে হয়। সূর্যময়কে ফোন করল। ঠিকমতো তার কথা শুনতে পেল না। বেশ চেঁচামেচি হচ্ছে। মাইক আর বক্সের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এত চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে সংকেত বলল,’কোথায় আছো তুমি? এত শব্দ কোথা থেকে আসছে?’
‘স্কুলে অনুষ্ঠান হচ্ছে এসেছি।’
‘একা একা চলে গেলে? আমাদের একবারও ডাকলে না?’
‘এ কেমন কথা? তুমিতো বাইরে আছো। আর সবুজকে আমি ডেকেছিলাম। সে বলল, তার বৌদি আসতে চাইছে। তাকে নিয়ে আসবে। স্কুলে দেখা করবে বলল। তাই লতাকে নিয়ে চলে এলাম।’
‘ঠিক আছে। তোমরা থাকো আমি আসছি।’
‘তুমি বাড়িতে এসেছো?’
‘হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি আসছি কথা হবে।’
সংকেত ফোন রেখে দিল। এমন সময় তৃধা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। সদ্য সন্ধ্যা দেওয়ায় তার শরীরজুড়ে লেগে রয়েছে ধূপ আর ধুনোর গন্ধ। সে-ই গন্ধ সারা ঘর জুড়ে মো মো করছে। সংকেতের মুখে স্নিগ্ধ এক হাসি ফুটে উঠল। বিদ্যুৎ নেই। ল্যাম্পের আলোয় তৃধাকে বেশ লাবণ্যময়ী লাগছে। কি অপরূপা নারী! দিব্য যৌবন ঝরে পড়ছে। গমগমে এক পরিবেশ। হৃদয়ের তরঙ্গ ওঠানামা করছে। নগ্ন পায়ে তার কাছে হেঁটে এল। শান্ত স্নিগ্ধ কন্ঠে বলল,’চা বানাবো?’ পৌড়ত্বে পৌঁছে গেলও তার কণ্ঠস্বরে এখনো বালিকার চাপল্য। সংকেত জবাব না দিয়ে বলল,’বসো। পাশে বসো।’ তৃধা হাসলো। অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে বসে পড়ল।
‘হাসতে গেলে কেন?’
‘এমনি এমনি। দরকারি কিছু বলবে?’
‘এমনি এমনি পাশে বসা যায় না বুঝি? পাশে বসতে বলছি মানে দরকারি কিছু বলবো, এমনটা সব সময় হবে কেন?’
‘তুমি তো দরকারি কথা বেশি বলো। অন্য কোনো কথা বলতে জানো নাকি?’
‘তৃধা!’ কন্ঠস্বর কেমন একটা শিশুর মতো শোনালো। আলতো করে স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।তৃধা হেসে উঠলো। এই পুরুষটাকে বড্ড ভালোবাসে সে। মানুষটাকে দেখলে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। হৃদয়ের তরঙ্গ গুলো বিশৃংখল হয়ে পড়ে। এই মানুষটার প্রতি অনুভূতি গুলো বড্ড এলোমেলো আর অস্থির। কিন্তু সংকেতের খামখেয়ালী ভাবে অনুভূতিগুলো একপ্রকার স্থির হতে চলেছে। সংকেত ভালো স্বামী। ভালো মানুষ। আদর করতে জানে। স্নেহ করতে জানে। সম্মান দিতে জানে। ভালোবাসতেও জানে। কিন্তু তার ভালোবাসার ধরন গুলো আনাড়ি। সে নিজের অনুভূতিগুলোকে বেশি প্রাধান্য দেয়। নিজের চাওয়া পাওয়াকে বেশি গুরুত্ব দেয়। কাছের মানুষটাকে বিন্দুমাত্র বোঝার চেষ্টা করে না। বিয়ের পর বেশ কয়েকবার বাড়িতে এসেছে। গভীর অনুভূতিতে ডুবে গেছে। কিন্তু কখনো জানতে চায়নি সে-ই সময় স্ত্রীর ইচ্ছা ছিল কিনা? সে কি চায়? বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর রোজ ফোন করতো। প্রচুর কথা হতো। কিন্তু বেশিরভাগ সময় নিজের কথা শোনাতে ব্যস্ত ছিল। স্ত্রীর কথা শুনতে চাইতো না। তাছাড়া তৃধা যা বলে সেটা বিশ্বাস করে নেয়। সে যে অনেক সময় রাগে অভিমানে মিথ্যা কথা বলতে পারে সেটা বুঝতে চায় না সংকেত। এখন তৃধা রাগ অভিমান করে মিথ্যা কথা বলে না। কারণ মিথ্যা কথা বললে সংকেত মিথ্যাটাকে বিশ্বাস করে নেবে। কাল রাতে সংকেত বাড়ি ফিরবে আগে থেকে জানতো তৃধা। কত স্বপ্ন দেখেছিল। অনেকদিন পর স্বামী বাড়িতে ফিরবে। তার জন্য ভালো ভালো রান্না করেছিল। চোখের নিচে কাজল লাগিয়ে ছিল। নতুন শাড়ি ব্লাউজ পরেছিল। খোপা করে চুল বেঁধে ছিল। অনেক কিছু ভেবে রেখেছিল। সারারাত ঘুমাবে না। বসে বসে গল্প করবে। চাঁদ দেখবে। সংকেত নিশ্চয়ই জানতে চাইবে, তার কথা মনে পড়ে কিনা? এতদিনে সে কী কী করেছে? তাকে ভালবাসে কিনা? এর অনেক উত্তরই সংকেত জানে। তবুও তো ভালোবাসা মানুষটির কাছে একই কথা বারবার শুনতে ভালো লাগে। সংকেত সঠিক সময় বাড়ি ফিরে ছিল। তার রূপে মোহিতও হয়েছিল। মনে মনে অনেক প্রশংসা করেছে। কিন্তু মুখ ফুটে একটাও শব্দ বলেনি। খাবার খেয়ে দুজনে শুয়ে পড়েছিল। এতটা পথ অতিক্রম করে এসেছে তবুও গভীর অনুভূতিতে ডুবতে ভুল করেনি। ক্লান্ত শরীরে বড্ড তাড়াহুড়ো করেছে। বিপরীত মানুষটার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দেয়নি। জানতে চায়নি তার ভালোলাগাটা কেমন? তৃধাও বাধা দেয়নি। ও তো নিজের স্বামী। তাকে কি বাধা দেওয়া যায়? সেও সুখ পেয়েছে। কিন্তু তা কোথাও মুহূর্তের জন্য। সে সুখ গুলোকে দীর্ঘ করতে চায়। দীর্ঘ সুখ কেবল অনুভূতি দিয়ে হয়। ভালবাসার একটা অংশ শরীর। কিন্তু শরীরের একটা অংশ ভালোবাসা নয়,-একথা সংকেতকে কে বোঝাবে। ভালোবাসা মানে এডজাস্টমেন্ট। আর এখানে তৃধা একতরফাভাবে এডজাস্টমেন্ট করে যাচ্ছে। এমনটা হতে পারে না। এ যেন পোষাকি প্রেম! খানিকক্ষণ নিঃশব্দে স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে রইলো। কোনো কথা বলল না। তৃধা আপন মনে আদর করলো। কোমল হাতের আদরের স্নিগ্ধতায় চুপটি করে পড়ে রইল সংকেত। কিছুক্ষণ পর দয়ালু কন্ঠে বলল,’কিছু খেতে দেবে? খিদে পাচ্ছে।’ একটু থেমে বলল,’তোমায় নিয়ে একবার স্কুলে যাব। যাবে তো?’
তৃধা মাথা দোলালো। তারপর ধীর পায়ে উঠে গেল।
বিদ্যুৎ চলে এসেছে। সংকেতের জন্য খাবার রেডি করতে অসুবিধা হলো না। একসঙ্গে খেতে বসলো। তবে একটা থালা দেখে একটু খটকা লাগল সংকেতের। জিজ্ঞেস করল,’তুমি খাবে না?’
‘বাবা আসুক তারপর খাবো। তুমি খিয়ে নাও।’
সংকেত আপন-মনে খেতে শুরু করল। তৃধা মৃদু হাসলো। এই হাসির মধ্যে কেমন একটা চটচটে ব্যাপার রয়েছে। লোক দেখানো হাসি। সংকেতের ব্যবহারে খুশি হয়নি। স্ত্রীর মুখের কথাটা বিশ্বাস করে নিল কিন্তু অন্তর থেকে কিছু বোঝার চেষ্টা করল না। বাবা তো এখন আসবে না। আসতে রাত হবে। তাছাড়া বাবা যখন আসবে ততক্ষণে তারা স্কুলে চলে যাবে। একটু জোর করতে পারল না? তাও মেনে নেওয়া যায়। মানুষটা তো পাশে বসে আছে। নিজের থালা থেকে খাবার তুলে ভালোবাসার মানুষটাকে খাইয়ে দেওয়া যায়। তৃধা ছোট ছোট জিনিস গুলো খুব করে পেতে চায়। কিন্তু সংকেত বোঝে না। তার দুঃখ এখানেই।
সংকেত একটুখানি খেয়ে উঠে চলে যাচ্ছিল। আর তখনই তৃধা অদ্ভুত এক কাজ করে বসলো। স্বামীর কান ধরে জোরে টেনে আনলো। নিজের ব্যবহারে নিজেই হতভম্ব হয়ে পড়ল। খুব হাসি পেল। হাসি কোনোরকম চেপে রেখে মুখে গাম্ভীর্য বজায় রাখল। ভারী কন্ঠে বলল,’পুরোটা খেয়ে নাও। তার আগে উঠতে পারবে না।’ সংকেত থতমত খেয়ে গেছে। এমনিতেই স্ত্রীকে ভয় পায়। তার উপর স্ত্রীর ভারী কণ্ঠস্বর আর বড়ো বড়ো চোখ দেখে আঁতকে উঠেছে‌। কিছু বলল না। চুপচাপ বসে পড়ে মাথা নিচু করে খেতে শুরু করল। তৃধা নিজেও জানে তার স্বামী তাকে খুব ভয় পায়। কিন্তু কেন ভয় পায় জানে না সে। ভয় পাওয়ার মতো কোনো ব্যবহারও করে না।
খুব মজা পাচ্ছিলো সে। একটু কৌতুক করার জন্য ভারাট কন্ঠে বলল,’তুমি আমাকে ভয় পাও?’চোখ তুলে তাকালো। পুরুষ মানুষ, হার স্বীকার করতে চাইল না। প্রতিবেশীরা যদি জানতে পারে সে একজন পুলিশ অফিসার হয়েও বউকে ভয় পায় তাহলে হাসাহাসি করবে। তবুও চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস পেলো না। কোনোরকম ভাবে একটু মুখ উঁচু করে আমতা আমতা করে বলল,’কেন ভয় পাব? তোমায় ভয় পেতে যাবো কেন?’
‘ভয় পাও না আমায়?’ বেশ জোর গলায় বলল।
‘না পাই না।’ বেশিক্ষণ মুখের গাম্ভীর্য বজায় রাখতে পারলো না তৃধা। হেসে ফেললো। হেসে হেসে বলল,’ঠিক আছে ভয় পেতে হবে না। চুপচাপ খেয়ে নাও। আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।’
এমন কৌতুক মজা বড্ড খুশি করে তাকে। স্বামীর ব্যবহারে মুগ্ধ। কিন্তু স্বামীর কিছু কিছু ব্যবহার তাকে নিঃস্ব করে দেয়। যদি সংকেত তাকে একটু বুঝতো তাহলে সে হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হতে পারতো। যাকে ভালোবেসেছে তাকে পেয়েছে‌। জীবনের বড় প্রাপ্তি। কিন্তু এই প্রাপ্তির মধ্যে যদি কোনো বিতর্ক না থাকতো তাহলে হয়তো আরও বেশি খুশী হতো। সংকেত কি কোনোদিন বুঝবে না? তৃধা বিয়ের বহু পূর্বে থেকে তাকে পছন্দ করে। এখনো সে কথা বলা হয়নি। অনেক সময়ই বলবে ভেবেছিল। কিন্তু স্বামীর কিছু খামখেয়ালি মনোভাব দেখে চুপ হয়ে গেছে। ইচ্ছেকে অন্তঃপুরে পুষে রেখেছে।

পার্বতীর সাথে লতার ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও তৃধার সাথে বেশ ভালো ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। একে অপরের বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি নয়। একা মানুষ। পথিক ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু পথ এক। তৃধা অনেকবারই সবুজের বাড়িতে এসেছে। একা বাড়িতে তো বসে থাকতে ভালো লাগে না। এখানে এসে পার্বতীর সঙ্গে গল্প করেছে। পার্বতীকেও তাদের বাড়িতে ডেকে ছিল। কিন্তু সে কোনো বিশেষ কারণে যায়নি। যদিও কারোর বাড়িতে যেতে পছন্দ করে না। পরচর্চা একদমই পোষায় না তার। লতার সাথে পরিচয় হতে খুব বেশি সময় লাগল না। তিনজন ভালো-মন্দ গল্প করল। দূরে দাঁড়িয়ে রইলো সূর্যময় আর সংকেত। সেখানে সবুজ নেই। সে আজ দর্শকদের মাঝখানে নয়, রয়েছে স্কুলে আগত অতিথিদের ভিড়ে। একে একে বরণ পর্ব শেষ হলো। সবুজের সামনে একগাদা বই জমা হয়েছে। অটোগ্রাফ দিতে ব্যস্ত সে। তার মুখে কাঁচা সোনার হাসি। বেশ আনন্দিত। একটা সময় তাকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য বলা হলো। সবুজ ধীর পায়ে স্টেজের উপরে এলো। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালো। উপস্থিত সবাইকে সম্মান শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানিয়ে বক্তব্য দিতে শুরু করলো,’……. জীবনে নিজের স্বপ্ন কিংবা ইচ্ছা পূরণ করতে হলে ছটফটে হলে চলবে না। শান্ত স্থির হয়ে ধৈর্য ধরতে হবে। একটা জায়গা থেকে লড়াই করতে হবে। মাথায় নোংরা ভাবনা নিয়ে কখনো লড়াই করা যায় না। নোংরা জিনিসকে কখনো নোংরা জিনিস দিয়ে ডাকা সম্ভব নয়। নোংরা জিনিস সবসময় পরিষ্কার জিনিস দিয়ে ডাকতে হয়। জীবনের স্বপ্নগুলোকে সত্য করতে হলে সৎ পথে চলতে হবে। আমার এখানে উঠে আসাটা সহজ ছিল না। আমি এক সময় এই স্কুলের ছাত্র ছিলাম।আমার সামনে যে আমার প্রিয় ছাত্র ছাত্রীরা বসে আছে। আমিও একদিন তাদের মতো সেখানে বসে ছিলাম। এখানে বলা মহৎ ব্যক্তিদের বক্তব্যগুলো মন দিয়ে শুনতাম। আমি যখন ওইখানে বসে ছিলাম তখন আমার পাশে অনেকেই বসেছিল।তখন কোনো স্যার কিংবা কোনো অথিতি দীর্ঘক্ষন বক্তব্য দিলে তাকে গালি দিতে ছাত্রছাত্রীরা পিছপা হতো না।জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে একজন শিক্ষক ক্ষুদ্র বক্তব্য দিচ্ছেন অথচ ছাত্র হিসেবে আমাদের এই ক্ষুদ্র বক্তব্য শোনার ধৈর্যটুকু নেই। তাহলে তুমি জীবনে লড়াই কি করে করবে? ধৈর্যের মানেটাই তো জানো না। জীবনের পথে অনেক বাধা আসবে। আমার জীবনেও এসেছিল। আমি পরিবার থেকে একদমই সাপোর্ট পাইনি। এখনো আমার পরিবার আমাকে সাপোর্ট করে না। তবুও আমি পিছিয়ে যাইনি। পেছনে ফিরে যাওয়ার নাম জীবন নয়। আমি ঈশ্বরের আগে প্রথমে নিজের বাবা-মাকে ধন্যবাদ দেবো। তাঁদের জন্য আমি জীবনটা পেয়েছি। জীবন উপলব্ধি করতে শিখেছি। আমি যা কিছু পেয়েছি সবটাই আমার বাবা-মা জন্য। আমি ঈশ্বর বলতে সত্যকে বুঝি। আর সত্য বলতে বাবা-মাকে বুঝি। আমি এরপর ধন্যবাদ দেবো আমার দুই বন্ধু সংকেত আর সূর্যময়কে। তারা না থাকলে আমি জীবনে সফলতা পেতাম না। তারা আমার জীবনের বড় একটা অংশে জড়িয়ে আছে। তাদের ছাড়া আমি অচল। আমার সব স্বপ্ন পূরণ করতে তারা এখনও মরিয়া। তারাও এই স্কুলের ছাত্র। এমন বন্ধু বড় বিরল। বন্ধুদের হারাতে দিওনা……’
সবুজের দীর্ঘ বক্তব্য শেষ হয়নি। এদিকে সূর্যময় আর সংকেত কখনো ভাবতে পারেনি তার বন্ধু তাদের নাম নেবে। সূর্যময় একটু খেয়াল করে দেখল। সংকেতের চোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ছে। তার বাহুতে ঠেলা দিয়ে বলল,’কি ব্যাপার, চোখে জল কেন?’ সংকেত হাসলো। বলল,’সাইকোলজি বলে, মানুষের বাম চোখ থেকে জল পড়লে সেটা হয় দুঃখের জল আর ডান চোখ থেকে পড়লে তা হয় আনন্দের। আমার কোন চোখ দিয়ে জল পড়ছে?’ সূর্যময় হেসে উঠলো। সে বুঝতে পেরেছে বন্ধুর কান্না আনন্দের। সশব্দে বলে উঠলো,’আমরা তিনটি পৃথক মানুষ কিন্তু প্রাণ একটাই। আমরা একজনের কষ্টে তিন জন কষ্ট পাই। একজনের আনন্দে তিনজন হাসি। আমরা তো কৃষকের ঘাম‌।’

পর্ব ১৬ আসছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here