নিরুদ্দেশ পর্ব ১৪

নিরুদ্দেশ
পর্ব ১৪

সফল হওয়ার তিনটি রাস্তা -অনুশীলনী, আত্মবিশ্বাস এবং সঠিক সময়ের অপেক্ষা অর্থাৎ ধৈর্য। এই তিনটি জিনিস মানুষের মধ্যে থাকলে একদিন সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছাবেই সে। সবুজ আজ থেকে পাঁচ বছর আগে নিজের বই প্রকাশ করার জন্য মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে শহরে গেছিল।আর বুঝতে পেরেছিল বাস্তবমুখী পৃথিবীত কতটা ভয়ানক। স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছিল। কিন্তু আত্মবিশ্বাস হারায়নি। অনুশীলনীতে খামতি রাখেনি। দীর্ঘ পাঁচ বছর পরিশ্রম করে গেছে। তারপর এক একটা প্রকাশনী থেকে তার বই প্রকাশের জন্য প্রস্তাব এসেছে। সবুজ তেমন কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেনি। সবগুলো ছোট প্রকাশনী। তেমন জনপ্রিয় নয়। তাছাড়া সে মনে করে তার লেখার মধ্যে অনেক ঘাটতি রয়েছে। সেগুলো মিটমাট করে তারপরেই মাঠে নামবে। নিরানব্বই শতাংশ সঠিক না হওয়া পর্যন্ত মাঠে নামবে না সে। কয়েক মাস আগে তার মনে হয় তার লেখালেখিতে অনেক উন্নতি ঘটেছে। এবার বই ছাপানো যেতে পারে। বড় প্রকাশনীর সঙ্গে দেখা করে। তারা আর ফিরিয়ে দেয়নি। তবে কোনো কথাও দিতে পারল না। পান্ডুলিপি জমা দিয়ে অপেক্ষা করতে রইল। সঠিক সময়ের পর তারা তা প্রত্যাখ্যান করে দিল। একটু হতাশ হলো সবুজ। তাদের দাবি, তার লেখা যথেষ্ট সুন্দর কিন্তু প্রচুর বানান ভুল রয়েছে এবং কিছু জায়গায় বাক্য সঠিকভাবে গঠন করা হয়নি। একটু ঝামেলায় পড়ল সে। কাউকে দোষারোপ না করে নিজেকে উপযুক্ত করার চেষ্টা করলো। ব্যাকরণ বই নিয়ে সঠিক ব্যাকরন জানার চেষ্টা করল। সূর্যময় পড়াশোনা না করলেও নিখুঁত বানান লিখতে পারে। তার কাছ থেকে সাহায্য নিল। যথাসম্ভব চেষ্টা করল বন্ধুকে সাহায্য করার। নিজেকে উপযুক্ত করার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পরলো। সময়ের সাথে সাথে প্রকাশ পেল বর্তমান সময়ে প্রখ্যাত লেখিকা আশালতা দাশগুপ্তের “সীমান্তের ওপারে” উপন্যাস। সবুজের প্রিয় এক লেখক। বইটি কিনে নিল। পড়ে শেষ করে ফেলল। কিন্তু এবার খুশি হতে পারল না। মনে একরাশ বিষণ্ণতা জন্মালো। তার লেখা উপন্যাস “পাহাড় দেশের ছেলেরা” উপন্যাসের কন্টেনের সাথে হুবহু মিল। এটা কি করে হতে পারে? একই ভাবনা দুজনের মধ্যে এসেছে? এতটা নিখুঁতভাবে মিল কি করে হতে পারে? সবুজ বুঝে উঠতে পারল না। সবুজ ভেবে রেখেছিল “পাহাড় দেশের ছেলেরা” উপন্যাসটি হবে তার প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস। কিন্তু এখন….।
প্রকাশনীর নাম খেয়াল হতে সবুজ চমকে উঠলো। এই প্রকাশনীতে কয়েক মাস আগে তার লেখা উপন্যাস পান্ডুলিপি আকারে জমা দিয়েছিল। এমনটা নয় তো, তার লেখা উপন্যাস প্রকাশনীর কেউ পড়েছে। বিষয়বস্তু খুব ভালো লেগেছে। চাইছিল বইটা ছাপাতে কিন্তু বই এর চাইতে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে ব্যবসাতে। সবুজের নামে যদি বই প্রকাশ পায়, তাহলে কত টাকা লাভ হবে? সবুজকে কতজন বা চেনে? তার বই খুব বেশি বিক্রি হবে না। তাছাড়া, বাক্য গঠনে ভুল আছে। অনেক বানান ভুল আছে। এত সুন্দর একটা উপন্যাসের মধ্যে কিছু বেমানান বাক্য আর শব্দের জন্য সকলের কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠবে। আর এই কনটেন্ট যদি অন্য কাউকে দিয়ে লেখানো যায় তাহলে তো মন্দ হয় না। তিনি সুন্দর করে বর্ণনা করতে পারবেন। উপন্যাসের মধ্যে অনেক ভালো ভালো লাইন থাকবে। বাক্য গঠনে ভুল কিংবা বানান ভুলের মত কোনো ছোটখাটো ভুল থাকবে না। নতুন নতুন শব্দ প্রয়োগ করবে। তাছাড়া লেখকের খুব জনপ্রিয়তা রয়েছে। খুব সহজে বিক্রি হয়ে যাবে। এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। “সীমান্তের ওপারে” উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু ঠিক আছে আর সমস্ত কিছু আলাদা। কাকতালীয়ভাবে কী মিলে গেছে,-না এর পেছনে রয়েছে কোনো চক্রান্ত? সবুজ কিছু ভেবে পেল না। কোনো অভিযোগ করল না। নিজের ভাবনা গুলোকে মাথায় বেশিক্ষণ স্থায়ী দিল না। এত বড় একটা প্রকাশনী এমনটা করতে পারে না। কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে।
সবুজ আরও বেশি পরিশ্রম করল। নিজেকে উপযুক্ত করল। তারপর ‘প্রজাপতি’ প্রকাশনী থেকে ঠিক করা হলো আগামী পহেলা ফাল্গুন “পাহাড় দেশের ছেলেরা” উপন্যাসটি প্রকাশ করা হবে। এতদিনের পর তার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে কিন্তু খুশি হতে পারল না। ওই দিন যে সংকেতের বিয়ে। তার বই প্রকাশ হলে তাকে প্রকাশনীতে উপস্থিত থাকতে হবে। অনেক ঝামেলা আছে। অন্যদিকে ছোটবেলার বন্ধুর বিয়ে! কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। অনেক আগে থেকেই বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সমস্ত কিছু গোছানো শেষ। হুট করে বিয়ের সময় পরিবর্তন করা যাবে না। আবার এদিকে তার প্রথম বই প্রকাশ পেতে চলেছে। প্রকাশনীকে কোনো ভাবে চাপ দিতে পারল না। নিঝুম হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। দুশ্চিন্তায় পড়লো।

দীর্ঘদিন পর জ্যোতির্ময় বাবুর বাড়িতে অনুষ্ঠান হচ্ছে। তা আবার নিজের একমাত্র সন্তানের বিয়ে। কোনো কিছুতে খামতি রাখতে চান না। পুরনো বাড়িটি ভেঙে নতুন বাড়ি হয়েছে। তবে আত্মীয়-স্বজন খুব বেশি নেই। উনার পরিচিত ছাড়া তেমন কেউ-ই নেই। সংকেতের বন্ধুর পরিধি অনেক তবে এখনো কেউ আসেনি। সবাই রাতে অনুষ্ঠানে আসবে। বিয়ে বাড়ি কিছুতে কোলাহল মুখরিত হয়ে উঠতে পারছে না। ভিড় জমছে না। লোকের অভাব রয়েছে। মা মারা যাওয়ার পর সংকেতের মামার বাড়ির সঙ্গে সু-সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। পরবর্তী সময়ে মামা দিদা আর দাদু মারা গেলে সম্পর্ক পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়। তাদের কখনো দেখেনি সংকেত। তবে একমাত্র ভাগ্নের বিয়েতে মামা-মামি আসতে ভুল করেনি। সম্পর্কের তিক্ততা ভুলে একটু মধু পড়েছে। বর্তমানে বিয়ে বাড়ির একমাত্র আত্মীয় তারাই। সূর্যময় পাঁচ দিন আগে থেকে বন্ধুর বাড়িতে এসে আছে। সময়ের অভাবে সবুজ আসতে পারেনি। মাঝেমধ্যে ফোন করে খবর নিয়েছে। দু-দিন আগে এসে কিছুক্ষণ ছিল তারপর ফিরে গেছে। এতে কেউ-ই অস্থির প্রকাশ করেনি। ওরা দুজন জানে, সবুজ এখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। নিজের স্বপ্ন পূরণ করে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলেছে সে। বাড়িতে অনেক চাপ রয়েছে। সবদিক সামলাতে হিমশিম খেয়ে উঠেছে। সূর্যময়ের বিয়ে খুব একটা ধুমধাম করে হয়নি। হট করে হয়ে যায়। অনেক কিছু মিস করেছে। বন্ধুর বিয়েতে তা আর করতে চায় না। সুদে আসলে উসুল করতে চায়। প্রচুর ফুর্তি করতে চায়। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। বিয়ে বাড়িতে কাজের সীমানা থাকে না। এত কাজ কে করবে? জ্যোতির্ময় বাবু সবদিক সামলাতে হাঁপিয়ে পড়েছেন। সংকেতের বিয়ে, তাকে তো আর কাজ করতে দেওয়া যায় না। তাই সূর্যময় নিজে হাতে সমস্ত কিছু সামলাচ্ছে। সে যেন হয়ে উঠেছে এ বাড়ির বড় সন্তান। কত দায়িত্ব তার! কোনো একটা কাজে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিল সংকেত। উঠনে সূর্যময়ের দৃষ্টিনন্দন এক কাজ দেখে চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কি জন্য বাড়ির বাইরে আসছিল মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গেল। দ্রুত হেঁটে সূর্যময়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। পিঠে হাত চাপড়ালো। সূর্যময় মুখ ফিরে হেসে বলল,’সবকিছু দেখতে পেয়ে গেছো, বুঝি!’
সংকেত কথা বলতে পারল না। আনন্দে কাঁপছে সে। একটু স্বাভাবিক হয়ে বলল,’খুব কি জরুরি ছিল? তোমার তো টাকার প্রচুর সমস্যা। কেন করছো এসব?’
‘ভাইয়ের বিয়ে। আমায় একটু খরচ করতে দাও।’
‘ভাই!’ভ্রু কুঁচকে বললো সংকেত।
‘জীবনে প্রথম অধ্যায়ে আমরা বন্ধু ছিলাম। আর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় আমরা ভাই হয়ে গেছি। তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা না হয় আবার বন্ধু হয়ে যাব।’
‘জানো সূর্যময়, আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওনা কি? তুমি আর সবুজ। ঈশ্বরকে আমি বারবার ধন্যবাদ দি তোমাদেরকে আমার জীবনে পাঠিয়ে আমার জীবনটাকে রঙিন করার জন্য।’
‘এখন আমার ইমোশনাল কথা শোনার মতো সময় নেই। কত কাজ। আমি আসছি।’ সূর্যময় স্থান ত্যাগ করল। তার চোখ দুটো জলে ভিজে গেছে। তবে প্রকাশ করতে পারেনি। সেখানে দাঁড়িয়ে একা একা অনেকক্ষণ হাসলো সংকেত। সূর্যময়ের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়। বিয়ের পর আরও খারাপ হয়েছে। রোজ আনে রোজ খায়। সঞ্চয়ের পরিমাণ খুব কম। বন্ধুর বিয়েতে দায়িত্ব নিয়েছে। সবদিক সামলাতে হচ্ছে। কিন্তু সে সবসময় সংকেত কিংবা জ্যোতির্ময় বাবুর কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজে থেকে টাকা মিটিয়ে দিচ্ছি। কত উদার মনের মানুষ সূর্যময়!
মনের মানুষের সাথে বিয়ে হচ্ছে সংকেতের। তবুও মনে অনেক দুঃখ বাসা বেঁধেছে। প্রথমত সে তৃধাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়নি, তৃধাও তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়নি। তবে তাদের বিয়ে কী করে হচ্ছে? রবিশংকর বাবু মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজছিলেন। কিন্তু উপযুক্ত পাত্র পাচ্ছিলেন না। তখনই উনার মাথায় সংকেতের কথা আসে। তার মেয়ের জন্য সংকেত কখনো অনুপযুক্ত হতে পারে না। তাছাড়া তারা ছোটবেলা থেকে পরিচিত। একে অপরকে ভালো বুঝতে পারবে। জ্যোতির্ময় বাবুর সাথে সম্পর্কটাও খুব গভীর। এই সম্পর্কের একটা নাম দিতে চাই ছিলেন। তিনিই প্রথমে জ্যোতির্ময় বাবুর কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখেন। জ্যোতির্ময় বাবু প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারেননি। তিনিও সম্মতি জানান। সংকেত আর তৃধা একে অপরকে পছন্দ করতো। দুজন চাইতো না কাউকে হারাতে। তারাও রাজি হয়ে যায়। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার পর সংকেত অনেকবার তৃধাকে কল করেছে। একবারও ধরেনি। বড্ড অভিমান করে আছে। তার অভিমান ভাঙ্গানো সহজ নয়। আজকে সকাল থেকে অনেকবার কল করেও কোনো সুবিধা করে উঠতে পারেনি। দ্বিতীয় সমস্যা সবুজ! তার বিয়ে অথচ সবুজ থাকবে না। এটা যেন মানতে পারছে না। সূর্যময় কোনো কাজে বাইরে যায়নি। নিজেকে শান্ত করতে আড়াল হয়েছিল। তাই দ্রুত ফিরে এলো। কিন্তু তখনও সংকেতকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক হলো। তাকে ঠেলা দিয়ে বলল,’কি ব্যাপার? এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
‘কিছু না। তোমার কাজ শেষ?’ সূর্যময় মাথা নাড়ালো। সংকেত একটু হেসে বলল,’সবুজ থাকলে ভালো হতো না?’
‘সে নেই, কে বলেছে? কাল সকালেই তো চলে আসবে। তারপর মজা হবে। কাজের জন্য ব্যস্ত আছে এটুকু মেনে নিতে হবে আমাদের।’
‘আজ সবুজও নতুন একটা জীবন শুরু করতে চলেছে। আমাদেরও তো উচিত তার পাশে থাকা। বড্ড খারাপ লাগছে, এত সুন্দর একটা দিনে আমরা তার পাশে থাকতে পারলাম না।’
‘এত ভাবলে চলবে না বন্ধু। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। একটু শক্ত হও। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’

প্রথম বই উদ্বোধন হয়েছে। প্রকাশনীতে কাজ একটু বেশি। সমস্ত কিছু সামলে উঠতে রাত দশটা বেজে গেল। বাসস্ট্যান্ডে ফিরে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। লাস্ট বাস বহু পূর্বে সাড়ে আটটায় চলে গেছে। শীতকাল হওয়ায় রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা খুব কম। যদিও এই রাস্তায় খুব একটা গাড়ি চলাচল করে না। শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার জন্য বাসই চলে। তবে অটো কিংবা টোটোর অভাব হয় না। কিন্তু তাদের যে এত রাতে পাওয়া সম্ভব নয় আগেই ভেবে বসেছিল। কিন্তু সে-ই ভাবনা মনের মধ্যে ছিলো না। ব্যস্ততায় মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ছিল। কি করে বাড়ি ফিরবে ভেবে পেল না। সময়মত পৌঁছালে সংকেতের বিয়েতে উপস্থিত হতে পারবে। তবে কি সূর্যময়কে ফোন করবে? বিয়ে বাড়িতে একটা মোটরসাইকেল ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে। এখান থেকে তাকে অনায়াসে তুলে নিয়ে যেতে পারবে। মন সায় দিলো না। অনেক ঝামেলা আছে। সূর্যময়ের বিয়ে বাড়িতে থাকা উচিত। তাহলে কি বৌদিমণিকে একটি বার ফোন করা উচিত? তার স্কুটার রয়েছে। শহরে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু এত রাতে একটা মেয়ে বাইরে বেরোনো কি ঠিক হবে? পরক্ষণে নিজের ছোট মনের জন্য অনুতাপ করল। সে না গল্প লেখে উপন্যাস লেখে। সে তো প্রত্যেক গল্পে কোনো না কোনো অংশে নারীদের অধিকারের কথা বলেছে। বার বার বলেছে নারীরা দুর্বল নয়। তাহলে বাস্তব জীবনে কেন মানতে পারছে না? লোককে বলে বেড়াতে পছন্দ করে অথচ নিজে করতে পারবে না। এটা তো নিজের দুর্বলতা। গল্পের মাধুর্যতা তো তখন বাড়ে যখন কোনো গল্প পড়ে নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। এবং সে-ই আত্মবিশ্বাস পরক্ষণে বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারে। সবুজ অপেক্ষা করল না। বৌদিমণিকে কল দিল। পার্বতী যথা সময়ে এসে ছোট ভাইকে বাড়ি নিয়ে গেল। বাড়ি পৌঁছে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে চলে গেল সংকেতের বাড়িতে। বরযাত্রী এখনো বেরিয়ে যায়নি। সঠিক সময়ে পৌঁছতে পেরেছে। তাকে পেয়ে আপ্লুত হয়ে উঠল সংকেত। যাইহোক, যার শেষ ভালো তার সব ভালো। জমে উঠলো গল্প-আড্ডা। কথায় কথায় সূর্যময় সবুজের দিকে তাকিয়ে বলল,’দেখো বন্ধু, আমি তো বিয়ে করে নিয়েছি। সংকেতেরও হয়ে গেল। আর বাকি থাকলে তুমি। শুভ কাজে দেরি করা কি উচিত?’ তার কথায় সম্মতি জানাল সংকেত। ঠোঁট টিপে হাসলো সবুজ। উত্তর দিতে পারল না।
‘এভাবে হাসলে হবে না। তোমার সময় হয়ে এসেছে।’ সংকেত বলল। সবুজ মাথা দোলালো। নারী সম্পর্কে সে বড্ড আনাড়ি। সে একটা সময় প্রচুর স্বপ্ন দেখতো, তার বিয়ে হবে,সংসার হবে,ছেলে-মেয়ে হবে। কিন্তু ওইসব স্বপ্ন আর দেখতে ইচ্ছে করে না। প্রথম প্রেম ভেঙ্গে যাওয়ার পর বড্ড উদাসীন হয়ে পড়েছিল। আর কোনো সম্পর্কে জড়ায়নি। ভয় করে। যদি আবার সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। বিচ্ছেদের অন্তঃকরণের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। সাথী যখন ছেড়ে চলে গেছিল তখন খুব কষ্ট হচ্ছিল। এখনো সে-ই কষ্ট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তৃপ্তি হাসির আড়ালে আজও বুক শূন্য হয়ে আছে। আজ পাঁচটা বছর তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। অথচ তার প্রতি অনুভূতি একই আছে। একটুও হারিয়ে যায়নি। তার দুটো মায়া ভরা চোখ ভুবন ভরা সুখ এনে দেয়। ওই কিশোরীর উলঙ্গ পিঠ আজও তাকে হাতছানি দিয়ে খুঁজে বেড়ায়। মাঝে মাঝে ভাবে, সাথীর প্রেমের হয়তো কখনো পড়তো না যদি না সে তার উলঙ্গ পিঠটা দেখতো। কারোর পিঠ দেখে কি কেউ প্রেমে পড়ে? সবুজ পরে নিঃশব্দে একা একা হাসে। বড্ড জটিল মানুষ সে। সাথীর কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে গেল। বন্ধুদের থেকে একটু দূরে সরে গেল। খুঁটিতে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। তার এসব ভাবলে হবে না। তাকে স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। স্বপ্নপূরণের দৌড়ে অনেক ভালো আছে। এখানেই ভালো থাকবে। সারা জীবন একা কাটিয়ে দিতে পারবে। কোনো নারীর প্রয়োজন নেই। সম্পর্কে জড়াতে চায় না। চোখ এ-দিক ও-দিক নাড়াতে নাড়াতে এক জায়গায় গিয়ে স্থির হলো। অবাক বিস্মৃত সম্ভ্রমে থমকে গেল। সে ঠিক দেখছে তো? হঠাৎ করে বুকের মধ্যে পুরনো স্মৃতি দুমড়ে-মুচড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। তার কিছুটা দূরে রুপাদি বসে আছে। আর সেও সবুজকে দেখতে পেয়েছে। দুজনেই একে অপরকে চিনতে পেরেছে কিন্তু মস্তিষ্ক মানতে পারছে না। একটা সময়ের পর রুপাদি পুরোপুরি নিশ্চিত হলো। হাত নাড়িয়ে কাছে ডাকলো। সবুজ যাবে কি যাবে না ভাবতে রইল। মন সায় দিচ্ছিলো না রুপাদির কাছে যেতে। কিন্তু অকৃতজ্ঞ হতে পারল না। না চাইতেও যেন একা একা পা চলতে রইল। রুপাদির সামনে পৌঁছতেই তাকে পাশে বসতে বলল। কলের পুতুলের মত সবুজ বসে পড়ল। কৃত্রিম হাসলো। রূপাদি সিঁদুর পরেছে। কোলে ছোট বাচ্চা মেয়ে আছে। হাসিমুখে রুপাদি বলল,’তুমি! এখানে কি করে? বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি আমার সামনে রয়েছো। এখানে এসে যে তোমার সঙ্গে দেখা হবে স্বপ্নেও ভাবিনি।’ সবুজ মৃদু হাসলো। একটুখানি চুপ থেকে বলল,’সংকেত আমার বন্ধু।’
‘সংকেত তোমার সে-ই বন্ধু না! যার জন্য তুমি পড়াশোনা ছেড়ে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলে।’
সবুজ সঠিক জবাব দিল। তারপর একটু নড়েচেড়ে সংযত হয়ে বসে সাহস নিয়ে বলল,’ তুমি সংকেতের কে হও? আগে বুঝতে পারিনি তুমি সংকেতের আত্মীয়?’
‘পূর্বে তো সংকেত আমার আত্মীয় ছিল না। আমার বিয়ের পর সংকেত আমার আত্মীয় হয়েছে।’
‘মানে?’
‘মানেটা খুব সোজা। তুমি যখন আমার বাড়িতে ছিলে তখন সংকেতের মামা বিয়ে করেনি। তুমি ফিরে আসার পর আমার বিয়ে সংকেতের মামার সাথে হয়। অর্থাৎ আমি বর্তমানে সংকেতের মামি।’ সবুজ হাসলো। পৃথিবীটা বড্ড ছোট। এভাবে যে দেখা হবে কখনো ভাবেনি সে। পাঁচটা বছরে কত কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। রূপাদি বিয়ে করে নিয়েছে। তার কোলে আবার সন্তানও চলে এসেছে। তার অনেক কিছুই জানতে ইচ্ছা করছিল। বাড়ির সকলে কেমন আছে? রায়বাবু কি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন? সাথী কিংবা কাজল দিদি… তারা কেমন আছে? কিন্তু সবুজ কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারল না। ইচ্ছে শক্তির কাছে হেরে গেল। শুধু মৃদু হেসে লীলার কথা জানতে চাইল। না, তাকে এখনো পাওয়া যায়নি। সে এখনো নিরুদ্দেশ। সবুজ কথা বাড়ালো না। রুপাদিও নিজে থেকে কিছু জানতে চাইল না। তার পূর্বের সে-ই অহংকার বড়লোকের হাবভাব বদলে যায়নি। সেগুলো অটুক রয়েছে।

কাজের জন্য শহরে গিয়েছিল সূর্যময়। ফেরার সময় স্বামীর হাতে দুটো বই দেখে অবাক হল লতা। দু’বছর ধরে সংসার করে আসছে কিন্তু স্বামীকে কখনো বই পড়তে দেখেনি। তবে আজ বই কিনে আনল কেন? শীতের মধ্যেও ঘেমে আছে। সে তাড়াতাড়ি জল নিয়ে ঘরের মধ্যে গেল। স্ত্রীকে ছুটে আসতে দেখে হাসলো সূর্যময়।
‘জল নাও।’ গ্লাস ধরে গটগট করে পান করে নিল। তবুও তৃষ্ণা যেন মিটলো না।
‘দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বসো!’ লতা স্বামীর পাশে এসে বসল। লাজুক মুখে বলল,’হ্যাঁ গো, তুমি বই কিনলে কেন? আগে তো কখনো তোমায় পড়তে দেখিনি।’ স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসলো। বলল,’বই দুটো আগে ভালো করে দেখো।’ লতা সঙ্গে সঙ্গে বই দুটো দেখল। এ তো তার বন্ধুর লেখা বই “পাহাড় দেশের ছেলেরা”। কিন্তু একটা বই দুবার কিনলো কেন?
‘বুঝেছি, সবুজদা তোমায় উপহার দিয়েছে না!’
‘না,না, আমি কিনেছি। সে উপহার দিলেও আমি নিতাম না।’
‘কেন নিতে না? উপহার না নেওয়া মানে বিপরীত মানুষটাকে অপমান করা।’
‘অন্য কোনো উপহার দিলে আমি নিশ্চয়ই নিতাম।আর সে নিজে পরিশ্রম করে যেটা বানিয়েছে সেটা আমি উপহার হিসেবে নিতে চাই না। ওর মূল্য অনেক। ওটা ওর সবচেয়ে দামি জিনিস। দামি জিনিস বিনামূল্যে কখনো নিতে পারি না।’
‘সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু একই বই দুবার কিনেছো কেন?’
‘আহ্! তুমি এখনো বুঝতে পারছো না? প্রথম বই বেরিয়েছে কেউ কিনতে চাইছে না। আমি বন্ধু হয়ে যদি তাকে সামান্য সাহায্য করতে না পারি তাহলে সে ভেঙ্গে পড়বে। তাকে এই সময় উৎসাহ দেওয়াটা খুব জরুরী। তাই দুটো বই কিনে আনলাম। একটা তোমার আর একটা আমার। ওকে কিছুতেই জানতে দিও না। তাহলে পরে মন আরও ভেঙ্গে যাবে।’
সূর্যময়ের সাথে যত বেশি সময় কাটাচ্ছে ততবেশি তাকে চিনতে পারছে। প্রতিদিন স্বামীর নতুন নতুন রূপ দেখতে পাচ্ছে। বড্ড ভালো মানুষ সে। বন্ধুদের জন্য কত কিনা করে। নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসে। বন্ধুদের যদি এভাবে ভালবাসতে পারে তাহলে পাশে বসে থাকা মানুষটাকে কতটা না ভালোবাসে। গর্বের সঙ্গে বাবা-মার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে দেখো বাবা আমি ভুল মানুষের হাত ধরিনি। একটা জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,’শুধুমাত্র বই কিনলে তো হবে না। পড়তেও হবে। না হলে তো বন্ধুর প্রতি শুধু কৃতজ্ঞতা দেখানো হবে ভালোবাসা না…।’
‘অবশ্যই পড়বো?’
‘তুমি বই পড়বে? বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।’
‘আমি সত্যি সত্যি বই পড়বো। তুমিও পড়বে তো?’
লতা মাথা নাড়ালো। সেও বই পড়ার জন্য প্রস্তুত।আদুরে কন্ঠে লতা বলল,’বন্ধুদের খুব ভালবাসো, তাই না?’
‘তোমার চাইতেও বেশি।’
‘কী!’
‘সত্যি, আমার হৃদয় তোমার জন্য যেমন বিশাল একটা জায়গা আছে তেমনি আমার দুই বন্ধুর জন্যও বিশাল একটা জায়গা রয়েছে। এই জায়গা গুলো কখনো কেউ নিতে পারবে না। যদি কোনোদিন শূন্য হয়ে যায় তাহলে সেগুলো কোনোদিন ভরাট হবে না। শূন্যই থাকবে। কারণ,পৃথিবীর কোনো কিছুর বিনিময়ে এই শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব নয়। আমার দু-চোখ বন্ধ হয়ে গেলেও আমার দুই বন্ধুর মুখ আমার চোখ থেকে মুছবে না।’
‘তোমায় যদি বলা হয় স্ত্রী আর বন্ধুর মধ্যে একজনকে বেছে নিতে। তখন তুমি কাকে বেছে নেবে?’
‘আমি তখন অপেক্ষা করবো।’
‘বুঝলাম না ঠিক।’
‘তুমি যে প্রশ্নটা করলে সে-ই প্রশ্নটা শুধুমাত্র ভুল বোঝাবুঝি থেকে আসতে পারে। এছাড়া কখনো আসা সম্ভব নয়। ওই সময় আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবো। আর একটা সময় দেখবে ভুল বোঝাবুঝি মিটে যাবে।’
লতা হেসে উঠলো। কথার মোহময়ে তাকে গভীর প্রেমে ডুবিয়েছে। সে নতুন করে স্বামীর প্রেমে পড়ছে কথার মাদকতায়। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একটু কষ্ট পেল সূর্যময়। লতার আগের মত লাবণ্যময় রূপ নেই। সুঠাম শরীর ঝরে পড়েছে। বড্ড পাতলা হয়ে গেছে। সারাদিন কত কাজ করতে হয়। সুন্দর শরীর কি করে থাকবে? এত পরিশ্রমের পর ভালো-মন্দ খাবার পায় না। মাথার মধ্যে কত চিন্তা নিয়ে রয়েছে। দু-বছর কেটে গেলেও লতার বাবা তাদের বিয়েটা মেনে নেয়নি। ওই বাড়ির সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। লতার নিশ্চয় বাবা-মার কথা মনে পড়ে। যেতে ইচ্ছে করে। উপায় খুঁজে পায় না। মুখ বুজে স্বামীর ঘরে পড়ে রয়েছে। সব পরিণতি মনের মত হয় না।যদিও এই বাড়িতে টাকার অভাব থাকলেও শান্তির অভাব নেই। মানসিক শান্তি তো জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। স্ত্রীর চোখের পানে তাকিয়ে বড্ড বেদনা হলো। লতার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল সূর্যময়। মায়া ভরা চোখে তার দিকে তাকাল। লতা স্বামীর চুলে বেলি কাটতে কাটতে বলল,’খুব ক্লান্ত বুঝি? ঘুমাবে? খাবার খেয়ে নাও তারপর ঘুমাবে না হয়।’
‘আমি ক্লান্ত নই। ঠিক আছি। তোমার খুব কষ্ট হয় না, লতা?’
‘এমন প্রশ্ন করছো কেন?’
‘জবাব দাও।’
‘কষ্ট হবে কেন? আমার তো কোনো কিছুর অভাব নেই।’
‘তুমি তো কখনো এত পরিশ্রমে অভ্যস্ত ছিলে না। এখানে কত কাজ করতে হয়। কষ্ট হয় না বুঝি! আমি অনেক মেয়ের মুখে শুনেছি,-তারা বিয়ে করতে চায় না শুধুমাত্র কাজ করার জন্য।’ লতা মৃদু হাসলো। পাতলা রাঙ্গা ঠোঁট দুটি ফুলের কুঁড়ির মত এক জায়গায় জড়ো করে বলল,’ও তো কথার কথা। বাস্তবে তেমন কিছু নয়। আসলে মেয়েদের কখন কষ্ট হয় জানো? যখন বাড়িতে ঘরভর্তি মানুষ থাকে অথচ তারা কোনো কাজ করে না। বাড়ির বউকে সমস্ত কাজ করতে হয়। তখন মেয়েটার কষ্ট হয়। অভিমান হয়, রাগ হয়। অভিমান রাগ কেউ ধরতে পারে না। সবাই ভুল বুঝে। আর ওই বাড়িতে সবাই যখন কাজ করতে শুরু করে তখন মেয়েটার আর কোনো ভয় করে না। সেও নির্বিধায় সমস্ত কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকে। মেয়েরা কখনো কাজকে ভয় পায় না,তারা ভয় পায় অবজ্ঞা আর অবহেলাকে। আর তুমি কিংবা তোমার বাবা-মা কেউ-ই বসে থাকে না। সারাদিন মাঠে পরিশ্রম করার পরও বাড়ি ফিরে এসে আমাকে কাজে সাহায্য করেন। আমি অনেক খুশি গো। এমন একটা পরিবারকে পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। সারাদিন পরিশ্রম করার পর আমার কোনো দুঃখ হয় না বরং এই বাড়িতে কাজ করতে ভালো লাগে আমার।’
‘তোমার বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে?’ লতার চোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ল। সূর্যময় তাড়াতাড়ি উঠে বসল। চোখ থেকে জল মুছে দিয়ে কাছে টেনে আনলো। সান্ত্বনা দিয়ে বলল,’ইস, এভাবে কেউ কাঁদে? সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো।’ লতা কোনো কথা বলল না। শুধু কেঁদে গেল।

বিয়ের পাঁচটা দিন পেরিয়ে গেলেও সংকেত আর তৃধার মধ্যে কোনো কথা হয়নি। সামনে লোক দেখানো অনেক কথাই বলেছে। কিন্তু ভেতরে একাকী নিজেদের মধ্যে একটাও কথা হয়নি। প্রথম রাত্রিতে এ-দিক ও-দিক মুখ করে ঘুমিয়ে গেছিল। তারপর রাত্রিগুলোতে ঘুমানোর সময় তৃধা একটা কথাই বলে, আলো নিভিয়ে দাও। বাচ্চা ছেলের মত সংকেত আলো নিভিয়ে দেয় কিন্তু স্ত্রীর সাথে কথা বলার সাহস পায় না। এমন লাজুক ছেলেও হয় নাকি! সংকেত তো এতটা লাজুক ছিল না। সে তৃধাকে ভয় পায়। ভীষণ ভয় পায়। তার জন্য কথা বলার সাহস হয় না। তাছাড়া তৃধাও নিজে থেকে কথা বলে না। তাহলে সে কেন নিজে থেকে কথা বলতে যাবে? প্রথমের দিকে মোটামুটি লাগছিল কিন্তু শেষের দিকে চরম বিরক্তি হচ্ছে। সংকেতের মনে অনেক সন্দেহের বাসা বাঁধে। ভাবতে শুরু করে, তৃধা হয়তো অন্য কাউকে পছন্দ করে। এই বিয়ে তার অমতে হয়েছে। তাই তার সাথে কথা বলতে চাইছে না। সংকেত কি করবে বুঝে উঠতে পারল না। বন্ধুদের সাহায্য নেবে? নিজেদের সম্পর্কের কথা বন্ধুত্বের মধ্যে না আনাই ভালো। নিজেকে সামলে নিতে হবে। কাজের সূত্রে তাকে কয়েকদিনের মধ্যে বাহিরে চলে যেতে হবে। বাবার বয়স হয়েছে কিন্তু তিনি বসে থাকতে চান না। কাজ করতে চান। তিনি শহরে চলে যাবেন। তাহলে তৃধা কোথায় থাকবে? এই বিষয় নিয়ে তো কথা বলা যেতে পারে। সংকেতের মন ফুরফুরে হয়ে উঠল। সে দৌড়ে রুমে চলে গেল। তৃধা পালঙ্কের উপর জড়সড় হয়ে বসে ছিল। পাশে গিয়ে বসল। চোখ বাঁকিয়ে প্রখর করল তৃধা। স্ত্রীর বড় বড় চোখ দেখে ঘাবড়ে গেল। কিছু বলতে গিয়ে আমতা আমতা করে উঠলো। তৃধা কড়া স্বরে বলল,’এভাবে কি বলছো? পরিষ্কার করে বল।’
‘না,মানে তুমি কোথায় থাকবে?’
‘কোথায় থাকবো মানে! কি যা তা বলছো!’
সংকেত ঢোক গিলল। একটু সংযত হওয়ার চেষ্টা করল। থেমে থেমে বললো,’আসলে অনেকগুলো দিন হল ছুটি নিয়েছি। এবার আমায় কাজে ফিরতে হবে। তাই বলছিলাম তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে না বাবার কাছে থাকবে?’
তৃধা তাচ্ছিল্য করে হাসলো। বলল,’আমি তোমার শুধু প্রয়োজনীয় স্ত্রী, আর কিছু না?’
‘এভাবে বলছো কেন?’
‘কেমন ভাবে বললে তোমার ভালো লাগবে, বল! আমি তেমন ভাবেই বলবো। পাঁচটা দিন হলো আমি তোমাদের বাড়িতে এসেছি। সবাইকে ছেড়ে এখানে চলে এসেছি, আমার মন খারাপ হয় না? তুমি আমার সাথে একটাও কথা বলেছো? আজ তোমার দরকার বলে কথা বলতে চলে এসেছো। তোমার যদি আমাকে পছন্দ না হতো তাহলে বিয়ের আগেই বলতে পারতে। বিয়ে কেন করলে?’
‘তুমিও তো আমার সাথে কথা বলনি।’
‘আমি বলিনি বলে তুমিও বলবে না?’ সংকেত চুপ করে গেল। কথা হারিয়ে ফেলল। তৃধা কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর একটু জোর গলায় বলল,’তুমি আমার বাড়িতে গেলে আমাদের বাড়িতে যদি কেউ তোমার সঙ্গে কথা না বলে,তাহলে তোমার কি ভালো লাগবে?’
‘আমার বাবা তো তোমার সঙ্গে সবসময় কথা বলছে।’ তৃধা ঠোঁট টিপে হাসলো। হাসির মধ্যে কেমন বিদ্রুপ আর শ্লেষ প্রকাশ পেল।
‘তোমার বাবা কথা বললেই হল। দারুন বলেছো।’
‘রাগ করছো কেন?’ তৃধা জবাব দিল না। যে মানুষটি পাশে বসে রয়েছে সে এখনো বুঝতে পারেনি তার পাশে বসে থাকা নারীটা তাকে কতটা ভালবাসে। কোনটা রাগ কোনটা অভিমান এখনো সে ধরতে পারেনি। তাকে বুঝিয়ে কি হবে? সংকেত মুখ তুলে স্ত্রীকে দেখল। চোখ দুটো ভীষণ লাল। যেন চোখে কিছু একটা আঘাত পেয়েছে। আঘাতের যন্ত্রণায় ফুলে গেছে। চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,’তোমার চোখ ওমন ভাবে লাল হয়ে গেছে কেন? আঘাত পেয়েছো?’
‘না তো। কালকে রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি মশা কামড়াচ্ছিল খুব।’
‘ওওও, তাহলে এখন একটু ঘুমিয়ে নাও।’
‘ঠিক আছে ঘুমিয়ে নেব। তুমি কি বলতে চেয়েছিলে বলো।’ সংকেত বলতে শুরু করল। কিন্তু একবারও স্ত্রীর ব্যথা বোঝার চেষ্টা করল না। তারা তো মশারী টাঙ্গিয়ে ঘুমিয়ে ছিল। তাহলে মশা কোথা থেকে আসবে? অভিমানে চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। সে স্নেহ আদর চায়। সংকেত তা বুঝতে পারছে না। সমস্ত কিছু শোনার পর তৃধা বলল,’আমি বাবার সাথেই থাকব। তুমি চলে যাও।’
‘আমার সঙ্গে যেতে ইচ্ছে করছে না বুঝে?’
‘যে দিন তুমি মন থেকে ডাকবে সেদিন আমি যাব।’
‘আমি মন থেকেই ডাকছি।’
‘এখন মন থেকে ডাকলেও আমি যাব না।’
‘কেন?’
‘সব উত্তর আমি তোমাকে দিতে বাধ্য নই।’
‘ঠিক আছে। তোমার যা মন চায় তাই করো।’
‘আর শোনো, তুমি চেষ্টা করো চাকরিটা টান্সফার করার জন্য। তাতে তোমার অসুবিধা হবে। বাড়ি ছেড়ে বাইরে কতদিন পড়ে থাকবে। বাবার বয়স হচ্ছে। ছেলে কাছে থাকলে খুশি হবে।’
‘চেষ্টা করব।’ সংকেত জবাব দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তৃধা চোখের জল আর লুকিয়ে রাখতে পারল না। এতক্ষণ অনেক কষ্ট লুকিয়ে রেখেছিল। এবার হু হু করে কেঁদে ফেললো।

প্রথম এক সপ্তাহে বেশ ভালোই বিক্রি হলো “পাহাড় দেশের ছেলেরা” উপন্যাসটি। তারপর একটু একটু করে কমতে শুরু করল। সবুজ হতাশ হলো না। এমনটা হওয়ার কথা ছিল। প্রথম বইতে বাজিমাত করতে পারবে না। তবে প্রথম দিকে যেভাবে বিক্রি হয়েছে তাতে অনেক খুশি সে। অনেক মানুষের অনেক ভালোবাসা পেয়েছে। অনেক ভালো রিভিউ এসেছে তার কাছে। একটু ব্যস্ততা কাটিয়ে শুরু করলো দ্বিতীয় উপন্যাস লেখা। আর এর মাঝেই একটা ঝড় উঠলো। যে ঝড়ে সবুজের টিকে থাকাটা অনেক কঠিন হয়ে পড়ল। কিছু কিছু মানুষ দাবি করছে,তার উপন্যাসটি নাকি আশালতা দাশগুপ্তের লেখা “সীমান্তের ওপারে” উপন্যাস থেকে ইন্সপায়ার। ইন্সপায়ার শব্দটা পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু সে-ই শব্দটা এক সময় পরিবর্তন হয়ে গেল কপিতে। সবাই বলতে শুরু করল এই উপন্যাস আসলে কপি। সবুজ ভেঙে পড়ল। সে কি করে বোঝাবে, কাকতালীয়ভাবে একই বিষয়বস্তু মিলে গেছে। তাছাড়া, “পাহাড় দেশের ছেলেরা” অনেক আগে লেখা। তারপর লেখা হয়েছে “সীমান্তের ওপারে” উপন্যাসটি। কিন্তু তার হাতে কোনো প্রমাণ নেই। অযথা মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া কোনো উপায় খুঁজে পেল না। দ্বিতীয় উপন্যাসটি আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারল না। প্রথম বইটি বিক্রি একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেল। প্রথম বই আর তাতেই পেল কপির তোকমা। এ যন্ত্রণা কোথায় রাখবে সে? নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারল না।

পর্ব ১৫ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here