নিরুদ্দেশ পর্ব ১৬

নিরুদ্দেশ
পর্ব ১৬

শেখরগঞ্জ এক নিরিবিলি গ্রাম। এখানকার সাধারণ মানুষ সহজ-সরল ভাবে জীবনযাপন করে। দিন আনে দিন খায়। বেশিরভাগ মানুষই কৃষির উপর নির্ভরশীল। শীতকাল, সারা বছরের চাল বানাতে ব্যস্ত গ্রামের বধূরা। নতুন ধান বাড়িতে এসেছে। এই সময় সকালবেলায় প্রায় প্রত্যেক ঘরের উঠোনে কিংবা কিছুটা দূরে কুণ্ডলী ভাবে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। এত ভোরে তারা রান্না করে না -ধান সেদ্ধ করে। শীতকালে দিন ছোট হয়। রোদ বেশিক্ষণ থাকে না। তাড়াহুড়ো করে কাজ সারে। এই কাজে বাড়ির ছেলে মেয়েরা অনীহা প্রকাশ করে না। উনুনের পাশে বসলেই আরাম। ঘুম থেকে উঠে পুকুর পাড়ে একটু দাঁড়িয়ে পড়েছে তোতা। পুকুর থেকে হালকা ধোঁয়া উঠছে। ফ্রিজ খুললে যেভাবে ধোঁয়া ওঠে ওভাবে। মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে। মাছ দেখে লোভ হলো। এমন সময় জাল ফেলতে পারলে গোটা কয়েক বড়ো মাছ জালে আটকে যাবে। কিন্তু জাল কে ফেলবে? বাবা সকালে কোথাও বেরিয়ে গেছেন। ও-দিকে মা ডেকেই চলেছেন। সেদিকে কর্ণপাত করলো না সে। বাবাকে কতবার বলেছে জাল ফেলা শিখিয়ে দিতে। তিনি শিখিয়ে দেননি। এটা নাকি মেয়ে মানুষের কাজ নয়। ইচ্ছে থাকলেও কিছু করতে পারলো না। বাধ্য হয়ে স্থান ত্যাগ করে মায়ের কাছে পৌঁছাল। তিনি মেয়েকে উনুনের পাশে বসে আগুনের জন্য শুকনো খড় একটু একটু করে দিতে বললেন। বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়িয়ে পিঁড়ির উপর বসে পড়ল। একটা সময় এমন কাজ করতে একদমই পছন্দ করতো না তোতা। খড়ের আঁচ উড়ে বেড়ায়। সেগুলো ফিরে এসে শরীরের উপর পড়ে। ধুলো-ময়লা ভালো লাগে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো আর গ্রাহ্য করে না। এখন চব্বিশ বছরের যুবতী সে। এম.এ -র শেষ বর্ষের পরীক্ষাও দিয়ে দিয়েছে। নিখুঁত জীবন যাপন করতে পারে না। একটু মানিয়ে নিতে শিখেছে। সব সময় নিজের কথা ভাবে না।
অরিন্দম হাতে পাঁচটা আলু নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে দিদির কাছে পৌঁছাল। আলুগুলো মা দিয়েছেন। হাঁড়ির মধ্যে ধানের সাথে সাথে সেগুলো ভরে দিতে বলেছেন। গরম ভাপে আলু সেদ্ধ হয়ে যাবে। ভাই এর কাছ থেকে আলু নিয়ে হাঁড়ির মধ্যে ভরে দিল। মনে একরাশ বিষণ্ণতা জমা হলো। আলু সেদ্ধ করতে দিয়েছেন মানে সকালে পান্তা খেতে হবে। শীতের সকালে পান্তা খাওয়া যে কতটা দুষ্কর, ভালো করে জানে সে। ভাইকে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,’দাঁড়িয়ে আছো কেন? পড়াশোনা নেই তোমার?’
‘ঠান্ডা করছে তো।’
‘শীতকালে ঠান্ডা করবে না তো গরম করবে!’
‘একটুখানি তো উনুনের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। এত রাগ দেখাচ্ছো কেন?’
‘দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। এখানে এসে বসো।’
‘তোমার পিঁড়িটা দেবে?’
‘তাহলে আমি কোথায় বসবো? আজব কথাবার্তা!’
‘আমি তোমার জন্য আসন এনে দিচ্ছি।’
‘আগে নিয়ে আসো যাও।’
অরিন্দম দৌড়ে গেল আবার দৌড়ে চলে এলো। দিদির কাছে চুপটি করে বসে পড়লো। একটু একটু করে কুয়াশার সাদা চাদর সরে রঙিন আভা দেখা গেল। মা নিজের কাজ শেষ করে চলে এলেন। ধমক দিয়ে ছেলেকে বললেন, উঠে যেতে। পড়তে বসতে বললেন। অরিন্দম নিচু মুখে সরে পরল। তারপর তিনি হাঁড়িতে কান পেতে কিছু একটা শুনলেন। বুঝে গেলেন ধান এখনো সেদ্ধ হয়নি। সময় লাগবে। অমন সময় দুজন পুরুষ মানুষের কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসলো। ঘুরে দেখলেন উনার স্বামী খোকন বাবু এবং তাঁর সঙ্গে রয়েছেন নিমাই বাবু। তাড়াতাড়ি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,’ভেতরে চলে যাও। আমি দেখে নেব।’ হঠাৎ করে মা এমন আচরণ করলেন কেন বুঝে উঠতে পারল না তোতা। দাঁড়িয়ে পড়ে বলল,’কেন? কিছু অসুবিধা হয়েছে?’
‘যা বলছি তা করো। এত প্রশ্ন করছো কেন? পরিষ্কার হয়ে নাও। তাড়াতাড়ি ভেতরে যাও।’ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মা তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর তিনি হাঁক ছাড়লেন অরিন্দমকে। ভেতর থেকে দুটো চেয়ার নিয়ে আসতে বললেন। অরিন্দম চেয়ার নিয়ে এসে রোদে রাখল। বাবা আর নিমাইবাবু সেখানে বসে গল্প করতে শুরু করলেন। কামিনী দেবী কিছুক্ষণ আগে ছেলেকে বকুনি দিয়ে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। এখন তিনি নিজেই ছেলেকে বললেন, পড়াশোনা পরে করতে। উনুনের পাশে বসে আগুনের সরঞ্জাম যোগাতে। মায়ের ব্যবহারের একটু হতভম্ব হলো অরিন্দম। মনে মনে খুশিও হল। তিনি ভেতরে গিয়ে মেয়েকে চা বানাতে বললেন। একটা নতুন পোশাক পরতে হবে। তখনো কিছু বোঝে
ওঠেনি তোতা। মায়ের কথা মত সমস্ত কাজ করলো। তারপর চা নিয়ে বাবার কাছে গেল। বাবার পাশে বসে থাকা মানুষটিকে চিনতে অসুবিধা হলো না। তিনি ঘটকালী করেন। পরিচিত এক মুখ। তাঁকে দেখে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। তিনি যে তার জন্য পাত্রপক্ষ নিয়ে এসেছেন -তা আর বলার অপেক্ষায় রইল না। চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো। দু-একটা প্রশ্ন করে তাকে ছেড়ে দিল। আরও কিছুটা সময় নিমাইবাবু বাবার সাথে কথা বলে উঠে গেলেন। তারপর তিনি নিজের মেয়েকে ডাকলেন। তোতা গিয়ে পৌঁছালো। নিমাইবাবুর বসা চেয়ারে বসলো। খামে মোড়া অনেকগুলো ছবি মেয়ের হাতে দিয়ে বললেন,’দেখতো মা, পছন্দ হয় কিনা! ছেলেটা একদম খাসা।’
‘বাবা, আমার পছন্দে কি আসে যায়! তোমরা যা বলবে তাই হবে।’
‘তাও দেখবে তো একবার। আমরা গিয়ে কিন্তু ওখানে থাকবো না। তুমি থাকবে তাই তোমার পছন্দটা সবার আগে প্রয়োজন।’
তোতা লজ্জা পেল। খামটি বাবার সামনে খুলতে ইচ্ছে করছিল না তবুও কোনো বিশেষ কৌতূহলবশত খুলে ফেলল। ছবি দেখেই খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসির কি আছে? মাথা খারাপ হয়ে গেলো?মেয়ে তো এমন নয়।
‘হাসছো কেন?’ বাবার দিকে তাকিয়ে আবার একবার ফিক করে হেসে ফেললো। ভ্রু কুঁচকে বললো,’ছেলেটাকে তুমি চেনো?’
‘না জেনে সম্বন্ধ করতে যাবো নাকি! বোকা বোকা কথা বলছো।’
‘তাহলে বলো ছেলেটা কে?’ মেয়ের মুখে লাবণ্যময়ী হাসি দেখে অবাক হলেন খোকন বাবু। মনে হচ্ছে তাঁর মেয়ে ছেলেটাকে চেনে। আর ছেলেটা যেন সাধারণ নয়। তার মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা নেই। তিনি ভরাট কণ্ঠে বললেন,’সবুজ সেনগুপ্ত, পিতা রাধাশ্যাম সেনগুপ্ত একজন বড় ব্যবসায়ী। দাদা রিপন সেনগুপ্ত বিখ্যাত বি.আর.এম.বি কম্পানির মালিক। আর ওই কোম্পানিতে সবুজ কাজ করে।’
‘এর বাদেও সবুজের আলাদা একটা পরিচয় রয়েছে।’
‘কীসের পরিচয়?’
‘তিনি একজন লেখক,বাবা।’
‘ওহহ, ওই যে শরৎচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের গল্প পড়ি, -ছেলেটা ওই সব গল্প কবিতা লেখে তো?’ তোতা একগাল হেসে জবাব দিল,’না বাবা, উনি অত বড় লেখক নন। তবে সমকালীন একজন জনপ্রিয় লেখক। তাছাড়া, উনি সুদর্শন এক পুরুষ মানুষ।ফটোতে যতটা সুন্দর দেখাচ্ছে বাস্তবে তিনি তার চাইতে অনেক বেশি সুন্দর। একবার আমাদের বইমেলায় এসেছিল। কিছু মনে পড়ছে তোমার?’ খোকন বাবু মাথা দোলালেন। সে-ই সময়ের কথা বেশ মনে আছে। তবে সবুজ যে সে-ই ছেলে সেটা তিনি মানতে চাইছেন না। বর্তমান বাংলা চলচ্চিত্রের নায়ক দের থেকেও অনেক বেশি সুদর্শন। খুব শান্ত,ধীর,উগ্রতাশূন্য। ওর ব্যক্তিত্বের ধারেকাছেও কেউ নেই। তোতা ছবিগুলো বাবাকে ফেরত দিল। প্রসন্ন মুখে বলল,’ওসব কথা বাদ দাও। লোকের ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতা আমাদের নেই। একটু ভেবে দেখো, ও আভিজাত্য পরিবারের ছেলে। নিজস্ব ভালো একটা ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে। তিনি নামকরা একজন লেখক। উনার পরিচিতির অভাব নেই। এতকিছু অবজ্ঞা করে তিনি পল্লীগ্রামের মেয়েকে বিয়ে করতে আসবেন? বিষয়টি কেমন কাকতালীয়, তাই না! হয়তো আমাদের কিছু ভুল হচ্ছে, নয়তো অসাধু ব্যক্তি উনাকে নিয়ে ফাজলামি করছে। আমি জানি আমাদের দৌড় খুব কম। কিন্তু তা বলে জেনেশুনে অপমানিত হতে যাবো!’ খোকন বাবু এবার থমকে গেলেন। মেয়ে কোনো অমূলক কথা বলেনি। ওরা যে ধরণের সোসাইটি থেকে বিলং করে, সেখান থেকে বাস্তবে কি এগুলো সম্ভব? কোথাও কি ভুল হচ্ছে? তাছাড়া নিমাইবাবু তো এমন মানুষ নন। তিনি দীর্ঘ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত। মানুষটির সম্বন্ধে কখনো খারাপ কিছু শোনেননি। বয়স হয়েছে। এমন সময় খারাপ কিছু করতে চাইবে না। পরক্ষণে ভাবলো, যতই ওরা ধনী হোক না কেন ওদের তো সবচেয়ে বড় পরিচয় ওরা মানুষ। হয়তো তাদের মনটা সুন্দর। ধনী-দরিদ্র্যের পার্থক্য বোঝে না। তারা মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করে। তবুও মনের সন্দেহ কিছুতে দূর করতে পারলেন না। তিনি নিমাই বাবুর সাথে আবার একবার কথা বললেন। তিনি পরিষ্কার করে জানালেন, কোথাও ভুল হচ্ছে না। সবুজের বাবা নিজে হাতে এই দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁর ছোট ছেলে একদম গ্রাম্য সাধারণ। সবার সাথে মিশতে পছন্দ করে। শহরে তাদের বেশ কয়েকটা বাড়ি থাকলেও সবুজ সেখানে থাকে না। এখনো গ্রামের পুরনো বাড়িকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে। অথচ সে শহরে থাকলে তার পক্ষে অনেক কাজ সহজ হয়ে যাবে। তবুও সে শহরে থাকে না। তাই রাধাশ্যাম বাবু ঠিক করেছেন, ছোট ছেলেকে এক গ্রাম্য মেয়ের সাথে বিয়ে দেবেন। তিনি সবুজের উপযুক্ত পাত্রী চান না,-তাকে বুঝবে এমন একজন পাত্রী চান। আর তোতা গ্রাম্য সুন্দর সুশীল মেয়ে। সবুজকে বুঝবে। ছোটবেলা থেকে নিমাইবাবু তোতাকে দেখে আসছেন। মেয়েটি ভারী সুন্দর। তার অনুপযুক্ত সবুজ হতে পারে না। সবকিছু ঠিক থাকলে তারা আগামী পরশু পাত্রী দেখতে আসবে।

সমস্ত কথা তোতার কানে পৌঁছানোর পর থতমত খেয়ে গেল সে। এও কি সম্ভব? গ্রাম্য কত মেয়েই তো রয়েছে! ঘুরেফিরে তাকে দেখতে আসতে হবে? মনে হঠাৎ করে শিহরণ জাগলো। কারণ ছাড়াই লজ্জা পেল। ঘর থেকে আর বেরলো না। সাধুভাষা একদমই পছন্দ নয় তোতার। বুঝতে পারে না এমন নয় -এই ভাষা কেমন একটা লাগে তার। তাই সে রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র বিভূতিভূষণকে পছন্দ করে না। সে সমকালীন এবং কিছুকাল আগে লেখকদের গল্প পড়তে পছন্দ করে। তার প্রিয় লেখকদের তালিকায় সবুজ অবশ্যই থাকবে। তার অনেক বই পড়েছে। সব বই কেনা সম্ভব হয়নি বন্ধুদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে পড়েছে। আজ সে-ই ছেলেটা তাকে দেখতে আসবে। কল্পনা করতে পারছে না। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। আবার বিশ্বাস না করে উপায় নেই। ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে ফেসবুকে সার্চ করল সবুজ সেনগুপ্ত। প্রায় তিন বছর আগে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল এখনো অ্যাক্টিভ করেনি। অথচ সব কিছু ঠিক থাকলে কিছুদিনের পর সে তার স্ত্রী হয়ে যাবে। ভাবতেই তার গা শিউরে উঠলো। ভীষণ লজ্জা পেল। সবুজ তাকে পছন্দ করবে কিনা ঠিক নেই। কিন্তু তারও তো পছন্দ-অপছন্দ রয়েছে। সে যদি না করে দেয় তাহলে তার বাবা জোর করবেন না। বিয়ে ভেস্তে যাবে। কিন্তু পারবে কি, সবুজকে না করতে? ওটুকু সাহস কি তার রয়েছে? সে তো তার মনের মানুষ। তার লেখা উপন্যাস পড়ে তাকে স্বপ্নে দেখেছে। সামনে থেকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। তা পূরণও হয়েছে। কিন্তু তার স্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন কখনো দেখেনি।

মেয়েটির নাম রাধারানী। সবুজের সাথে পরিচয় হয়েছে ফেসবুকে। মেয়েটি তার পাঠিকা হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু দেখা করতে এসে সামনাসামনি দু’চারটে কথা বলতেই সবুজ বুঝতে পারল মেয়েটি মোটেও তার পাঠিকা নয়। সবুজ সবকিছু বুঝতে পেরেও মুখের উপর কিছু বলল না। চুপ করে মেয়েটির কথা শুনে গেল। পাশাপাশি দুজনে বসে রয়েছে। রাধারানীর রেশমের মত নরম চুলগুলি সবুজের খোলা গায়ে লেগে গা শিরশির করে উঠল। সবুজ সরে আসতে চাইল। পারলো না। শরীরের এ কি বেহায়াপনা? মেয়েটির রূপ একদম খাসা। রূপে মোহিত হয়েছে একথা অস্বীকার করতে পারবে না। তাই মেয়েটির মিথ্যা কথাগুলোকে প্রশ্রয় দিতে রইল। সবুজ তীব্র চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। রাধারানী তা লক্ষ্য করে বদমাশি হাসি হেসে বলল,’কি দেখছেন মশাই?’
‘কিছু না।’ সহজ সরল উত্তর দিল। তবে চোখ ফিরিয়ে নিল না। এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন সে মেয়েটাকে দেখেই না। রাধারানী অপমান বোধ করলো। হাসিমুখে বলল,’আপনি বিয়ে করেছেন?’
‘এর উত্তর পূর্বে বহুবার দিয়েছি। আর দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হচ্ছে না।’ মেয়েটি সলজ্জ হাসলো। চোখ ফিরিয়ে নিল। সৌন্দর্য খাতিরে সবুজ জিজ্ঞেস করল,’আপনি বিয়ে করেছেন?’
মেয়েটি মৃদু হেসে জবাব দিল,’আমি প্রেম আর মোহর নিষ্ঠুরতায় জড়াতে চাই না। আমার যদি শুতে ইচ্ছে করে তাহলে শুয়ে যাব কিন্তু সম্পর্কে জড়াবো না। সম্পর্কে একবার জড়িয়ে গেলে সেখান থেকে বেরোনো সহজ না। কিন্তু শোয়াতো তো মাএ একটা রাত্রের ব্যাপার তারপর কেউ কাউকে চেনে না।’ একটু ঢোক গিলে আবার বলল,’অ্যাকচুয়ালি আমি লিভিং কে সাপোর্ট করি। দেখুন মশাই,আমার যদি কাউকে ভালো লাগে তাহলে তার সঙ্গে দশ দিন থেকে দেখলাম। যদি ইচ্ছে করে আরও কিছুদিন থাকতে, তাহলে থাকলাম, যদি ইচ্ছে না করে তাহলে চলে আসলাম। কেউ বাধা দিতে নেই। কিন্তু বিবাহ বন্ধনে জড়িয়ে গেলে এই সুযোগ আর নেই।’ মেয়েটির মুখে কাঁচা কাঁচা শব্দ শুনতে একদমই পছন্দ করছে না সবুজ। কিন্তু শরীরের অদ্ভুত বেহায়াপনায় সেখান থেকে সরে পড়তে পারল না। শুধু কৃত্রিম হেসে গেল। তাকে কিছু বলতে না দেখে মেয়েটি বলল,’আপনি কি পছন্দ করেন,বিয়ে না লিভিং! এখনো বিয়ে করেননি মানে লিভিং পছন্দ করেন।’ সবুজ হাসলো। আমাদের দেশে তিরিশের পরে বহু ছেলে-মেয়ে বিয়ে করে। আর সে এখনো তিরিশে পা দেয়নি। বিয়ের বয়স হয়েছে ঠিকই তবে পেরিয়ে যায়নি। সহাস্যে সবুজ বলল,’আমি যতই আধুনিক জীবন যাপন করি না কেন, আমার মাথায় যত আধুনিক চিন্তা ধারা আসুক না কেন, আমার অন্তঃকরণ এখনো সনাতন ধর্মের বিশ্বাসে মোড়া। আর সেখান থেকে আমি কখনই লিভিং কে সাপোর্ট করবো না।’ মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সে যেন ভুল মানুষকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। কথার ভঙ্গি কিংবা যৌবনের মোহ দেখিয়ে ফাঁসানো যাবে না। তবুও হাল ছাড়লো না। ঠোঁট টিপে হাসলো। ব্যাগ থেকে খাতা বের করে অটোগ্রাফ দিতে বলল। সবুজ অটোগ্রাফ দিল। মেয়েটি খাতা ব্যাগের মধ্যে ভরে উঠে দাঁড়ালো। সবুজকে দাঁড়াতে না দেখে বলল,’আপনি যাবেন না?’
‘কোথায়?’
‘আসুন আমার সাথে।’

কয়েকদিন ধরে বাড়িতে বিয়ের জন্য তোড়জোড় চলছে। তাই বাড়িতে খুব বেশি ফেরে না সবুজ। বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। তবে আজ সকালে বাবা বারবার বলে দিয়েছিলেন, সে যেখানেই থাকুক না কেন দুপুরের মধ্যে যেন বাড়ি ফিরে আসে। বিকেলে মেয়ে দেখতে যাওয়া হবে। বিয়ের প্রতি একদমই আগ্রহ নেই। বৌদিমণি থাকলে তাকে সাহায্য করতে পারতো। পার্বতীর সন্তান হবে। তাই এখন বাপের বাড়িতে রয়েছে। যদি সত্যি সত্যি এখন তার বিয়ে হয় তাহলে পার্বতী থাকতেও পারবে না। তাই বিয়ের প্রতি একটু বেশি অনীহা প্রকাশ করেছে সে। তবে বাবার অবাধ্য হওয়ার ছেলে নয় সে। এর আগে বহু কথায় অবাধ্য হয়েছে ঠিকই তবে পরে গভীর অনুশোচনা করেছে। কষ্ট পেয়েছে। বাবার সব কথা যেমন মানতে পারে না তেমনি সব কথা ফেলতেও পারে না। সারা সকাল কোথাও বের হয়নি। পরিবারের সাথে একা যাওয়া ঠিক হবে না। বন্ধুদের নিয়ে যেতে হবে। সংকেত এখানে নেই। সঙ্গী একমাত্র সূর্যময়। তাকে বলতেই না বলে দিল সে। কেন না বলল তা জানে সবুজ। তার বাড়িতে কেউই সূর্যময়কে পছন্দ করে না। জেনেশুনে অপমানিত হতে যাবে কেন? কিন্তু বন্ধুর বারবার পীড়াপীড়িতে শেষমেষ রাজি হলো সে।
বিকালে যথাসময়ে তোতাদের বাড়িতে পৌঁছে গেল। সবুজের সঙ্গে সূর্যময় রয়েছে। সে বেশ চুপচাপ। কোনো কথা বলছে না। বাড়িতে তাদের সাথে সূর্যময়ের যাওয়ার কথা বলতে কেউই বাধা দেয়নি। এমনকি দাদাও চুপ ছিল। হঠাৎ করে তাঁদের এত পরিবর্তনের হেতু বুঝে উঠতে পারেনি সবুজ। তবে অনুমান করেছে যে সে বন্ধুদের সাথে খুব সহজ-সরল হতে পারে। আর তার পাশে একজন বন্ধু থাকলে সুবিধা হবে। না হলে সবুজ বেঁকে বসবে। কথার অবাধ্য হবে। এর জন্যই তারা রাজি হয়েছে। সূর্যময়কে হীন চোখেও দেখেনি। ভেতরে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। তোতা যথাসময়ে তাদের সামনে পৌঁছালো। শরবত দিল। তারপর রাধাশ্যাম বাবু দু-একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। সে যথাযথ উত্তর দিল। তারপর ফিরে গেল। সূর্যময় সবুজকে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলো,তার মেয়ে পছন্দ হয়েছে কিনা! সে হাসলো। রূপ দেখে যদি অপছন্দ করা হয় তাহলে মেয়েটির সাথে সাথে স্বয়ং ঈশ্বরকে অপমান করা হবে। তার রূপ সে নিজে সৃষ্টি করেনি -ঈশ্বর করেছেন। ঈশ্বরের সৃষ্টি মন্দ হতে পারে না। মেয়েটি নিজের হাতে সৃষ্টি করেছে নিজের আচরণ। কিন্তু কয়েক মূহুর্তে কাউকে দেখে তার আচরণ কেমন, তা কি বলা সম্ভব? সবাই তো বাইরের মানুষের কাছে নিজেকে অসাধারণ ভাবে তুলে ধরবে। স্বাভাবিক বিষয়! পাত্রপক্ষ কিংবা কন্যাপক্ষ দেখা জাস্ট প্রথাগত নিয়ম ছাড়া আর কিছু নয়। বিয়ের পর সঠিক বোঝাপড়ার অভাবে খারাপ মানুষও ভালো হয়ে যেতে পারে আবার ভালো মানুষও খারাপ হয়ে যেতে পারে। কয়েক মিনিট তোতাকে দেখে চরিত্র বিচার করতে পারল না সবুজ। নিশ্চুপে বসে রইল। সূর্যময় ছটফট করছে। সে কিছু বলতে চায়। সাহস কুলাচ্ছে না। সবুজ সেটা বুঝতে পেরে গেল। তার দিকে একটু ঝুঁকে কান বাড়িয়ে দিতেই সে ফিসফিস করে বললো,’বন্ধু মেয়েটি দারুন আছে। না বলো না দয়া করে।’ সবুজ একটু কৌতুক করে ধীর কন্ঠে বলল,’কি করে বুঝলে দারুন আছে?’
‘ওর হাঁটার ভঙ্গি দেখে। আমি বলছি মন্দ হবে না। বিশ্বাস করো।’ সবুজ হাসলো। কোনো জবাব দিল না। মানুষের হাঁটার ভঙ্গি দেখে মানুষকে কি বিচার করা যায়? খেয়াল করলো দাদা আর বাবা কোনো বিষয় নিয়ে বেশ আলোচনা করছে। সে-ই আলোচনায় তার অংশগ্রহণ করা উচিত কিনা বুঝে উঠতে পারল না। বেশ অনেকটা সময় পর রাধাশ্যামবাবু বলে উঠলেন, তাদের মেয়ে এবং পরিবার উভয়ই পছন্দ হয়েছে। তাদেরও যদি ছেলে এবং তাদের পরিবার পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে আজই পাকাকথা সেরে ফেলতে চান। মেয়েপক্ষ বেশি সময় নিল না। সম্মতি জানাতেই পাকা কথা শুরু হয়ে গেল। সবুজ আশ্চর্য হল। বিয়ে সে করবে অথচ কেউ তার পছন্দ-অপছন্দকে একবারও গুরুত্ব দিলো না। কেউ সামান্য পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না, তার সবকিছু ঠিকঠাক লাগছে কিনা! এক ধরনের অপমান বোধ করলো। তবুও প্রতিবাদ করল না। কারণ,সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় ঠিক করে ফেলেছিল মেয়ে যেমনই হোক না কেনো ‘না’ বলবে না। সবার উপরে মানুষ সুন্দর এবং সত্য। কারোর বাহ্যিক দিক দিয়ে বিচার করতে পারবে না। আর ভেতরের সৌন্দর্য কয়েক মুহূর্তে জানা যায় না। সবুজের আর ভালো লাগলো না। এখান থেকে বের হতে পারলেই শান্তি। অস্বস্তি হচ্ছে। অপরিচিত কারোর বাড়িতে দীর্ঘ সময় থাকে না সে। অস্বস্তির মধ্যে মা আরও একটু অস্বস্তি বাড়িয়ে দিলেন। তিনি জানালেন, ছেলে আর মেয়েকে একটা আলাদা কক্ষে পাঠিয়ে দিতে। তাদের আলাদাভাবে কিছুক্ষণ কথা বলা উচিত। তাদের মতামত জানার খুব দরকার। সবাই সম্মতি জানালো। সবুজ এবার বিপদে পড়ল। তার মন কিছুতে সায় দিচ্ছে না অপরিচিত মেয়ের সাথে একটা পৃথক রুমে যেতে। আবার এতগুলো বয়স্ক মানুষের কথা অগ্রাহ্য করতে পারল না। মায়ের উপর চাপা রাগ উঠলো। উনি-ই কি সে-ই মা? যে মা ছোটবেলা থেকে ছেলেকে মেয়েদের সাথে মিশতে বারণ করতেন, পরিচিত মেয়েদের সাথে কথা বললেও ধমক দিতেন, বেশিক্ষণ মেয়েদের সাথে কথা বলতে দিতেন না, আজ সে-ই মা বলেছেন অন্য মেয়ের সাথে কথা বলতে পৃথক রুমে। আবার যে মেয়েকে পূর্বে কখনো দেখেনি। বাঙালি মায়েরা বড় অদ্ভুত! কয়েক মুহূর্তেই মেয়েটি তার আপন হয়ে গেছে। কত সোহাগ। মেয়েটির সাথে তার ছেলে কথা বলতে পারে; অসুবিধা নেই। আশ্চর্য হলেও শেষ পর্যন্ত উঠে যেতে হলো সবুজকে। আলাদা ঘরের ভেতর ঢুকতেই ভীষণ ঠান্ডা অনুভব করল। পাখা চলছে না তবুও এত শীতল! আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়েও ঘর শীতল হওয়ার কারণ খুঁজে পেল না। দেওয়ালে চোখ বিঁধে গেল। সে পাকা বাড়িতে মেঝেতে আলপনা দিতে দেখে এসেছে এতকাল। কিন্তু পুরো দেওয়াল জুড়ে আলপনা তাকে মুগ্ধ করল। আলপনা ঘরের সৌন্দর্য বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। বেশ সাজানো গোছানো। খাটের উপর বিছানা সাজানো। তার উপর মশারী চতুর্দিকে বাধা থাকলেও সুন্দর করে গোটানো। খাটের নিচে বেশ কয়েকটা আচারের জার রয়েছে। খাটের পাশে রয়েছে টেবিল, তার উপর বেশ কয়েকটা বই সঙ্গে এলোমেলো কিছু কাগজ আর ভাঁজ করা দুটো শাড়ি। ঘরভর্তি জিনিস আছে। ঘরের মধ্যে একটা আলমারি প্রয়োজন হলেও তার রুচিশীলতার কাছে কোনো কিছুই অগোছালো নেই। দূরে রয়েছে একটি তাক। সেখানে প্রচুর বই আর কিছু দরকারি জিনিসপত্র রয়েছে। বই গুচ্ছের মধ্যে নিজের লেখা বই দেখে মুখে সোনার হাসি ফুটে উঠল। এটা একজন শিল্পীর কাছে বড় ঐশ্বর্য। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষ তার শিল্প সত্তাকে ভালোবেসে সম্মান জানিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। চেতনাতীত মন তৃপ্তি অনুভব করল। চোখের পাতা কিছুক্ষণ আটকে গেল। ঘুরে দেখল মেয়েটি খাটের উপর চুপচাপ বসে রয়েছে। লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে আছে। তার দিকে তাকাচ্ছেই না। কি বলে প্রথমে কথা বলা শুরু করবে খুঁজে পেল না। অনেকক্ষণ নিস্তব্ধে কাটলো। তারপর সবুজ মিষ্টি কন্ঠে বলল,’আপনি আমায় চেনেন, তাই না!’ তোতা মাথা নিচু রেখেই জবাব দিল,’এমনটা কেন মনে হল?’
‘আপনার সংগ্রহের তালিকায় আমার বেশ কয়েকটা বই আছে। সে-ই থেকে অনুমান করলাম।’
‘বই থাকলেই যে চিনতে হবে তা তো নয়। এমনি থাকতেই পারে।’
‘এমনি এমনি কেউ এতগুলো বই রাখতে যাবে না। এমনি রাখতে গেলে একটা দুটোর বেশি রাখবে না।’ তোতা আর কিছু বলল না। অস্বস্তিতে পড়ল সবুজ। কতক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি বসে আছে অথচ বাইরের মানুষটিকে বসতে বলছে না। সৌন্দর্য বলে কি কিছু নেই? ঘরের সৌন্দর্য দেখলে বোঝা যায় মেয়েটি ভীষণ শৌখিন। কিন্তু ব্যবহার একটু কেমন যেন। তার অস্বস্তিটা বুঝে গেল তোতা। শান্ত কন্ঠে বলল,’আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বসুন।’ সবুজ ঘুরে দেখল বসার মতো কিছু নেই। বসতে হলে খাটের উপর মেয়েটির পাশে বসতে হবে। সে সেখানে বসতে চাইলো না। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে চায়। সেখানে বসলে চোখে চোখ রাখতে পারবে না। পাশে কাঠের চেয়ারের উপর কয়েকটা খাতা আর স্কুল ব্যাগ পড়েছিল। সেগুলো খাটের উপর তুলে দিয়ে তাতে বসে পড়ল। সবুজের এমন ব্যবহারে আত্মগ্লানিতে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো তোতার। লজ্জায় অভিভূত হলো। মনে হল সে মানুষটিকে যথাযথ সম্মান দিতে পারছে না। কোথাও যেন অবজ্ঞা করছে। এমন মনে হওয়ার সঠিক কারণটা খুঁজে পেল না। অপরিচিত মানুষের সাথে খুব তাড়াতাড়ি অকপট হতে পারে না। তাতে তার দোষ কি? বড্ড নার্ভাস ফিল করছে। সবুজ চেয়ারে বসে মেয়েটির দিকে প্রথমবারের মতো তাকালো। সে বেশ তন্নী সুন্দরী,বড়ো বড়ো চোখ, আঙুলের গড়ন ভারী সুন্দর, টিকালো নাক, দীর্ঘ অক্ষিপল্লব,গাঢ় ভুরু পরনে চওড়া পাড় শাড়ি,গলায় সরু চেন, দু-হাতে দু-গুচ্ছ চুড়ি, মাথায় চুল এত ঘন যে কানকে ঢেকে রেখেছে। বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,’আপনার নাম কি, জানতে পারি?’
‘আচ্ছা মানুষ তো আপনি। আপনি কোন মেয়েকে দেখতে আসছেন,তার নাম না জেনে চলে এসেছেন! তাছাড়া কিছুক্ষণ আগেই আমি সবার সামনে নিজের নাম বলেছি।’
‘খেয়াল করিনি, আর একবার বললে অসুবিধা আছে বুঝি!’
‘কোনো অসুবিধা নেই। আমার নাম তোতা, তোতা দত্ত।’
‘ওহহ, তোতাপাখি।’
‘তোতাপাখি নই, আমার নাম কুমারী তোতা দত্ত।
যদি সব কিছু ঠিক থাকে তাহলে বিয়ের পর আমার নাম হবে শ্রীমতি তোতা সেনগুপ্ত। বুঝেছেন? না আবার একবার বলবো?’ সবুজ অবাক হলো বটে তবে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারল না। কিছুক্ষণ আগে মেয়েটিকে বড়ো শান্ত স্নিগ্ধ লাগছিল। কিন্তু তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতেই আসল রূপটা ধরা পড়ে গেল। বড্ড চঞ্চলা মেয়ে। মুহুর্তের মধ্যে নিজের কন্ঠস্বরের ধীর-স্থির বিলিয়ে দিয়েছে। অচেনা মানুষের সাথে দ্রুত অকপট হতে পারে। সবুজের জবাব না পেয়ে তোতা বলল,’আমার কিছু জানার আছে।’ সবুজ ভাবল মেয়েটি হয়তো তার পরিবারের সম্বন্ধে জানতে চাইবে। কিংবা তার পছন্দ অপছন্দের খাবার বা রান্নাবান্না পারে কিনা, এছাড়া আর কি জানতে পারে? বর্তমানের মেয়েরা এগুলো জানতে চায়। খুব বেশি হলে সে জানতে চাইবে, লেখালেখির বাদে কোনো চাকরি করে কিনা! কিন্তু মেয়েটি অবাক করে দিয়ে এসব কিছুই জিজ্ঞেস করল না। সবুজ সম্মতি জানাতেই মেয়েটি বলল,’সংকেত আর সূর্যময় আপনার প্রিয় বন্ধু, তাই তো? যদি আমার অনুমান সঠিক হয় তাহলে আপনি সূর্যময়কে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন কিন্তু সংকেতকে আনেননি। কারণটা জানতে পারি?’ সবুজ অবাক হলো না। যদিও অবাক হওয়ার মতো কোনো কিছুই ঘটেনি। সে নিজের পাঠক মহলকে তার বন্ধুদের ব্যাপারে বারবার জানিয়েছে। ফেসবুকে প্রায় সময় বন্ধুদের সাথে ফটো আপলোড করে। চিনতে অসুবিধা হবে না। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এমন মুহূর্তে এমন প্রশ্নটা অস্বাভাবিক। সবুজের সঠিক উত্তরেও তোতার আগ্রহ কমলো না। সে বলল,’আপনার বয়স তো খুব বেশি হয়নি। এই বয়সে আপনার রোমান্টিক গল্প লেখার কথা। আমি আপনার সমস্ত উপন্যাস পড়েছি। কিন্তু একটাও রোম্যান্টিক নয়। প্রেমের একটু আঁচ রেখে এড়িয়ে গেছেন বারবার। সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা গুলোকেই আপনি স্থান দিয়েছেন। বারবার সাধারণ মানুষের কথা বলেছেন। তাদের বেঁচে ওঠার লড়াই করার পথ দেখিয়েছেন। এই বয়সে এত ভিন্নধর্মী লেখা কেন?’
‘আমার জন্ম গ্রামে। খুব কাছ থেকে সাধারণ মানুষদের দেখেছি। তাদের যন্ত্রণাগুলো সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে না পারলেও কিছুটা উপলব্ধি করেছি। আর যে বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারি সে-ই বিষয়ে তো আমি খুব ভালো করে বলতে পারব। তাই আমার গল্পে সাধারণ মানুষেরা বারবার ঠাঁই পেয়েছে।’
‘তাহলে আপনি কখনো প্রেমে পড়েননি?’
‘কৈশোর বয়সে একবার প্রেমে পড়েছিলাম।’ তোতা মুখ শুকিয়ে ফেলল। এমন উত্তর প্রত্যাশা করেনি। চঞ্চলা মন মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ এত পরিবর্তনের কারণ বুঝে উঠতে পারল না সবুজ। আবার ঘন নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। তোতা মুখ নিচু করে রেখেছে। একটু অপেক্ষা করে সবুজ বলল,’তোতাপাখি..’ কথা আটকে দিয়ে তোতা বলল,’তোতাপাখি নয় শুধু তোতা।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে তোতা। তুমি বিয়েতে রাজি না?’
সে মুখ নিচু করে ফেলল। মুখে আবার হাসি ফিরে এসেছে। মিটিমিটি করে হাসছে। তার নিস্তব্ধতা আর মুখের হাসি তার মনের কথা বলে দিল। আরও কিছুটা সময় স্তব্ধতা। নিস্তব্ধতার গভীরতা থেকে বেরিয়ে এসে তোতা বলল,’আমার না বিশ্বাস হচ্ছে না। সব কিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। আপনি আমার স্বামী হতে চলেছেন এটা ভেবেই কেমন লাগছে। মানুষ যা কল্পনা করে তা অর্ধেকও পায় না। আর আমি যা কল্পনা করিনি তা পেতে চলেছি। আমি কি এতটা লাকি? আমার কপালে কি এত সুখ সইবে? আমার কাছে এখনও সবকিছু স্বাভাবিক লাগছে না।’ তার চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো। বারবার নিঃশ্বাস ছাড়লো। হাতের আংগুল দিয়ে চটপট চোখের জল মুছেও ফেলল। সবুজ বুঝে গেছে এই চোখের জল খুশির। সবুজ তোতাকে আশ্বস্ত করে বলল,’নিজেকে ছোট ভাবাটা নিজের দুর্বলতা। নিজেকে কখনো দুর্বল ভাববেন না। এ এক ধরনের ব্যর্থতা। মানুষের বড়ো পরিচয় সে একজন মানুষ। ধনী-দরিদ্রটা এক ধরনের খেলা। সেই খেলায় কে কখন জিতবে কেউ জানে না। আমি দরিদ্র মানুষদের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করি। কিন্তু আমার বাবা একজন ধনী ব্যক্তি। তাহলে আমি কি নিজের বাবাকে অস্বীকার করবো?’
তোতা মুখ তুলে এবার সবুজকে দেখলো। আবার সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিল। তার চোখ এখনো জলে ভিজে আছে। চোখে আবার একবার আঙ্গুল বুলিয়ে হাসিমুখে বলল,’আপনি এই বিয়েতে রাজি না? আপনার সবকিছু ঠিকঠাক লাগছে তো? নিজের মধ্যে অস্বস্তি লুকিয়ে রেখে সম্মতি জানাবেন না। তাতে দুটো পরিবারে অশান্তি লাগবে। আমরা খুব সাধারন মানুষ। অশান্তির মধ্যে থাকতে পছন্দ করি না। আপনার সম্মতি চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।’ সবুজ মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। তার এই বিয়েতে অমত নেই। তোতা খুশিতে আত্মহারা হয়ে পরলো। লজ্জাও পেলো। কথা বলতে সাহস কুলালো না। নিস্তব্ধতার সময় বাড়লো। অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকায় সবুজের পায়ে ঝিঝি ধরেছে। তা বলতে পারল না। ঘাড় শক্ত হয়ে আসছে। এবার উঠতে হবে। ওঠার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে-ই সময় তোতা বলল,’আপনি কিছুক্ষণ আগে বললেন কৈশোর বয়সে আপনি প্রেমে পড়েছিলেন। আপনি এখনো মেয়েটাকে মনে করেন? এখনো ভালোবাসেন?’
‘জীবনে অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। সবাইকে কি ভুলে যাওয়া সম্ভব? আমার পক্ষে ভুলে যাওয়া কখন-ই সম্ভব নয়। ওরা কোথাও না কোথাও থেকে যায়। তবে আমি অতীত নিয়ে পড়ে থাকতে ভালোবাসি না। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাই। আপনাকে আমি এটুকু নিশ্চিত করতে পারি, আমার অতীত আপনাকে কখনো অসম্মান করবে না। আমার অতীত আপনাকে কখনো কিছু ভাববে না। এটুকু নিশ্চিত থাকতে পারেন।’ আশ্বস্ত হলো তোতা। একটু মুখ ফুলিয়ে বলল,’আপনি আমার অতীত জানতে চাইবেন না?’
‘না, মানুষের অতীত থাকতে পারে। থাকুক কিংবা না থাকুক আমি তা জানতে চাই না। তবে আমি চাইবো না আপনার পুরনো অতীত যেন কোনোভাবেই বর্তমানে ফিরে এসে আমায় অসম্মান করুক। তাতে আমার খারাপ লাগবে।’
‘চিন্তা করবেন না। আমার তেমন কোনো অতীত নেই। আমি কখনো প্রেমেও পড়িনি।’ আগ বাড়িয়ে কথা বলাটা সবুজ কখনো পছন্দ করে না। তাইতো তোতার কথায় কোনো আগ্রহ প্রকাশ করল না।তোতা একটু নড়েচড়ে সংযত হয়ে বসে বলল,’আপনি আমায় বিয়ে করলেন। সবকিছু ঠিকঠাক চলল। তারপর কোনো একদিন শুনলেন আপনার স্ত্রী অন্য কোনো পুরুষ মানুষের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ আছে। তার সঙ্গে সুন্দর যোগাযোগ রয়েছে। সঠিক অর্থ বোঝাতে গেলে অ্যাফেয়ার…। তখন আপনি কি করবেন?’ সবুজ এবার না চমকে পারল না। মেয়েটির সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে বুঝতে পেরেছিল, সে ভীষণ কথা বলে। মোটেও বোকা সাদাসিধে নয় -বেশ চালাক চতুর। কণ্ঠস্বর আর ব্যবহারে বালিকার লাবণ্য থাকলেও অভিজ্ঞতায় একজন পৌড়। কিন্তু তা বলে প্রথম দিনে এমন প্রশ্ন। জানার ইচ্ছে হতে পারে। পরে বললে সে নিশ্চয়ই উত্তর দিতো। এমন মুহূর্তে এমন প্রশ্ন মোটেও আশা করিনি। তাকেও ফিরিয়ে দিল না। মনের সংকোচন তোতাকে বুঝতে দিল না। হিমেল কন্ঠে জবাব দিল,’বোঝাবো।’
‘যদি না বোঝো সে?’
‘তাও বোঝাবো।’
‘তখনো যদি না বোঝে?’
‘আবার একবার বোঝাবো।’
‘আপনি আচ্ছা মানুষ তো, বার বার বোঝাবো বোঝাবো বলছেন কেন? সে কখনো না বুঝলে কি করবেন?’ তার কণ্ঠস্বরে বিরক্তির ভাব ফুটে উঠল। সবুজ দ্বিরুক্তি ভাবে তার দিকে তাকিয়ে বলল,’কোনো মানুষ ভুল করছে। আর যদি আঙ্গুল দিয়ে তাকে সঠিকটা বারবার দেখানো হয় তাহলে সে অবশ্যই নিজের ভুল বুঝবে। আর যদি তখনও না বোঝে, তাহলে কি তাকে মানুষ বলা যায়? সে সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করছে। ওই পথ থেকে তাকে কখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।’ তোতা খুশি মনে সবুজের দিকে তাকালো। বেশ পাতলা ঋজু শরীরের সুদর্শন পুরুষ। মাথায় ছোট ছোট চুল এলোমেলো করে বিলানো। দাঁড়ি ক্লিন করা। বড় বড় চোখ দুটো ভারী সুন্দর। ঠোঁটে নীলিমা ভঙ্গি। শ্যাম বর্ণ তার সৌন্দর্য বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষটার সম্বন্ধে বহু কথা শুনেছে। বহু লেখা পড়ে একটা কল্পনায় রূপ গড়েছিল। কিন্তু সামনা-সামনি কল্পনার থেকেও অনেক সুন্দর। মানুষটির রূপের সৌন্দর্য তো রয়েছে কিন্তু তার চাইতেও তার ব্যবহার এবং কথা বলার ভঙ্গি তাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। সবুজ এবার তোতাকে একই প্রশ্ন করল। সে মোটেও থতমত খেলো না। ঠোঁটের কোণে যেন উত্তর লুকিয়ে ছিল। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,’আমি তাকে ছেড়ে চলে যাবো।’
‘বোঝাবেন না?’
‘বোঝানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। যে মানুষটা আমাকে পাওয়ার পরও অন্য কাউকে ভাবতে পারে তার সঙ্গে আমি এক মুহূর্তও থাকতে রাজি নই।’
‘হতে পারে সে ভুলবশত করে ফেলেছে।’
‘অনেক ভুল মানুষ জেনেশুনেই করে। আর কিছু ভুলের কখনো ক্ষমা হয় না। আমি কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। মানুষটি যদি সত্যি সত্যি ভালো হয়ে যায় তবুও আমি ক্ষমা করতে পারবো না। আমার জীবন যদি দুঃখ যন্ত্রণা শেষ হয়ে যায় তবুও আমি সে-ই মানুষটার কাছে ফিরে যাবো না। আমার অসম্মান আমি কিছুতেই গ্রাহ্য করবো না।’ তোতার কণ্ঠস্বরে ক্ষোপ রাগ প্রকাশ পেল। বেশ অস্থির হয়ে পড়ল। সবুজ আর কিছু বলল না।
তাদের বিয়েতে সবাই সম্মতি জানালেও প্রথমে একটু বেঁকে বসলেন কামিনীদেবী। একমাত্র আদুরে মেয়েকে অত দূরে বিয়ে দিতে চান না। মুর্শিদাবাদ থেকে মেদিনীপুরের দূরত্ব অনেক। এত দূরে মেয়েকে পাঠানো কি ঠিক হবে? কিছু দিন পর তিনি মত বদলালেন। এত সুন্দর একটা পাত্র হাতছাড়া করতে চাইলেন না। দূরত্বটা কিছু নয়। মনের মিল থাকলেই হবে। তিনিও বিয়েতে সম্মতি জানালেন। বিয়ে নিয়ে আর কারোর কোনো আপত্তি রইল না।

পর্ব ১৭ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here