নিরুদ্দেশ পর্ব ১১

নিরুদ্দেশ
পর্ব ১১

ছোট্ট ট্রলার চলেছে সমুদ্রের বুক চিরে নতুন কিছু খুঁজতে। অতুল বাবু একজন দক্ষ মাঝি। তাঁর চেনা-পরিচিত বহু মানুষ রয়েছেন। তাই একদিনের জন্য ছোট্ট একটা ট্রলার জোগাড় করতে বেশি সময় লাগেনি। টাকাও দিতে হয়নি। শুধুমাত্র তেলের খরচ নিজেদের। সূর্যময় পড়াশোনায় অমনোযোগী হলেও অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি ভীষণ লোভ। নতুন নতুন জিনিস খুঁজতে ভালো লাগে। বাবার সাথে খালে কিংবা সমুদ্রের ধারে কাছে মাছ ধরতে গেলেও গভীর সমুদ্রে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। তবে খুব ইচ্ছে, একদিন গভীর সমুদ্রে যাবে। সমুদ্রের এ-পাড়ে তো বসতি রয়েছে কিন্তু ও-পাড়ে কি রয়েছে? ও-পাড়ে কি পৃথিবীর শেষ স্থান? না, অলৌকিক কিছু রয়েছে? কুড়ি বছর বয়সী তরুণের মনে এমন প্রশ্ন জেগে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই প্রশ্ন তার মাথায় সব সময় ঘুরপাক খায়। কোনো যুক্তি কাজ করে না। বাবা বলে, সমুদ্রের পাড়ে সমুদ্র যতটা ভয়ঙ্কর সমুদ্রের মাঝখানে সমুদ্র ততটা শান্ত। মাঝ সমুদ্রে নাকি কোনো ঢেউ থাকে না। পুকুরের জলের মতো শান্ত আর শীতল। বিশ্বাস করতে চায় না সূর্যময়। সমুদ্রের পাড়ে সমুদ্র যদি এত ভয়ঙ্কর হয় তাহলে মাঝ সমুদ্রে তো আরও ভয়ঙ্কর হওয়ার কথা। কিন্তু বাবার কথায় সম্পূর্ণ উল্টো। বিশ্বাস না করে উপায় নেই। তিনি একজন দক্ষ জেলে। সমুদ্র আর সমুদ্রের জল নিয়ে খেলেন। তিনি কেন মিথ্যা কথা বলতে যাবেন? বাবার সঙ্গে অনেকবার মাঝ সমুদ্রের যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। কিন্তু তিনি নিয়ে যেতে চাননি। সমুদ্রের যাওয়া সহজ নয়। অনেক দুষ্কর ব্যাপার। ভীষণ ভাবে শরীর খারাপ হয়। সহ্য করা যায় না। তবে সূর্যময় মনে মনে আশা সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে পারেনি। এবং একটা সুযোগও পেল। এখন বড় হয়েছে আবহাওয়া পরিবর্তন খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না তার শরীরে। তবে বাবাকে রাজি করানো মুশকিল। সে প্রথমে সবুজের কাছে প্রস্তাবটি রাখলো। সে জানে, সবুজও অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করে। তবে সমুদ্রের প্রতি তার খুব বেশি আগ্রহ নেই। সূর্যময় তাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালো। এবং তাকেই বলল তার বাবাকে রাজি করানোর জন্য। তাদের দুজনের পক্ষে সমুদ্রে যাওয়া সম্ভব নয়। সবুজের কথা প্রথমে শুনতে চাইলেন না অতুল বাবু। তবে তার মিনতি ফেলতেও পারলেন না। ঠিক হলো একদিনের জন্য সমুদ্রে যাওয়া হবে। তবে মাঝ সমুদ্রে নিয়ে যেতে পারবেন না। সেখানে অনেক বিপদ থাকে। বিপদ এলে একার পক্ষে সামলে ওঠা অসম্ভব। সমুদ্রের পাড় থেকে অনেকটা দূরে একটা দ্বীপ রয়েছে। ঠিক হলো সেই দ্বীপে যাওয়া হবে। এই দ্বীপ কারোর কাছে অজানা নয়। সমুদ্রের পাড় থেকে দেখা যায় না ঠিকই তবে এর উপস্থিতি অনেকেই স্বীকার করেছে। কারণ, দ্বীপটি খুব বেশি দূরে নয়। সামান্য গেলেই তার সন্ধান পাওয়া যায়। তাছাড়া এখানকার সমস্ত মানুষই জানে তারা আজ যেখানে বসবাস করছে সেখানে একটা সময় সমুদ্র ছিল। এ কথা বিশ্বাস করতে চায় না সবুজ। এ কি করে সম্ভব? কিন্তু সেও ছোটবেলায় দাদুর মুখে শুনেছে এই ভয়ঙ্কর ইতিহাসের কথা। শুধুমাত্র দাদুর বলা কুসংস্কারের নিয়তি নয় বিজ্ঞানের সাথেও মিল রয়েছে। ১৯৪৯ সালে এখানে ভয়ংকর বন্যা হয়। বন্যায় অসংখ্য মানুষ মারা যায়। বর্তমানে সূর্যময়ের বাড়ি যেখানে ওখানে নাকি একটা সময় জোয়ারের জল আসতো। অথচ আজ সেখানে বসতি গড়ে উঠেছে। বন্যার পর সমুদ্রের জল যে ঘুরে চলে গেল আর ফিরলো না। এদিকে জমাট বাঁধতে শুরু করে আর উল্টোদিকে ভয়ংকরভাবে ক্ষয় শুরু করে। বিপরীত দিকে বিস্তীর্ণ এলাকা এখন সমুদ্রের তলায়। যেখানে এক সময় বসতি ছিল সেখানে এখন সমুদ্রের ঢেউ উপচে পড়ে। বিস্তীর্ণ এলাকা সমুদ্রের তলায় চলে গেলেও মাঝখানের একটা বড় অংশ থেকে যায়। যেটা বর্তমানে দ্বীপ হয়ে রয়েছে। এই দ্বীপ নিয়ে মানুষের মধ্যে কুসংস্কারের অভাব নেই। সেখানে পূর্বে গঙ্গা মন্দির ছিল। বেশ জমজমাট করে অনুষ্ঠান হতো। সেই জন্য বিস্তীর্ণ এলাকা জলে মগ্ন হলেও ওই এলাকায় নাকি জলমগ্ন হয়নি। দিনের পর দিন পলি জমতে জমতে ওই এলাকা আরও উঁচু হয়ে যায়। মানুষের অনুপস্থিতিতে গাছগাছালি দারুন ভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ঘন জঙ্গলে ঢেকে যায়। কোনো নর মানুষের চিহ্ন নেই। এখন মানুষ সেখানে যেতে ভয় পায়। বড্ড অদ্ভুত ব্যাপার! এই কটা বছরে এত পরিবর্তন! এ যে বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু সবুজের দাদু সেই বীভৎস বন্যার সাক্ষী ছিলেন। শুধু তার দাদু নয়,বয়স্ক মানুষদের মুখে এমন ইতিহাস
এখনও শোনা যায়। আগে যেখানে সমুদ্র ছিল,এখন সেখানে বসতি গড়ে উঠেছে। আর সমুদ্র এখনও বিপরীত পাড়ে গ্রাস করে চলেছে। সমুদ্রের নিয়ম তো এমন, -এক পাড় ভাঙ্গে তো একবার বাঁধে। সবুজ লক্ষ করেছে, ছোটবেলায় সমুদ্রের জল যেখানে দেখতে পেতো এখন জোয়ারের সময়ও জল সেখানে আসে না। ধীরে ধীরে দূরে সরে গেছে। তাই এখানকার মৎস্যজীবীরা খুব অসুবিধায় পড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে খাল কেটে জল আনার অনেক চেষ্টা চলছে। তিন-চার বছর কাজ চালিয়ে মৎস্যশিল্পের কিছুটা উন্নতি ঘটিয়েছে। সবুজ আর সূর্যময় সমুদ্রে যাচ্ছে শুনে সংকেত লোভ সামলাতে পারেনি। একটু ভীতু বটে তবে বন্ধুদের সাথে যাওয়ার কৌতুহল হারাতে পারেনি। তিনজন মিলে বেরিয়ে পড়ে সমুদ্রে। তাদের সঙ্গী হয় অতুল বাবু আর তার সমকক্ষ একজন। কিছুদুর যাওয়ার পর গাছগাছালিতে ভরা উঁচু অংশ চোখে পড়ল। সূর্যময় আরষ্ট চোখে সে দিকে তাকালো। এটা নিশ্চয়ই সেই দ্বীপ। তাছাড়া এত অল্প সময়ে সমুদ্রের ওপারে যাওয়া সম্ভব নয়। কৌতুহলী হয়ে পড়ল। সে লক্ষ্য করলো সবুজও কৌতুহল সহিত ওই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মনে বেশ আগ্রহ জন্মেছে। এদিকে সংকেত কুঁকড়ে রয়েছে। মনে ভয়ের বাসা বেঁধেছে। বন্ধুদের কাছে তা প্রকাশ করতে পারছে না। বাহাদুরি দেখানোর চেষ্টা করছে। সবুজ হালকা হেসে উঠলো। সেদিন সারারাত ঘুমোতে পারেনি। তার আগের রাতটাও ভালোমতো ঘুম হয়নি। সারারাত খালপাড়ে শীতল বাতাস গায়ে লেগেছিল। তাই চোখ দুটো বীভৎসভাবে লাল হয়ে যায়। গাল গুলো ফুলে ওঠে। আর সে ইচ্ছে করেই বন্ধুদেরকে ভয় দেখিয়ে ছিল। কিন্তু তারা যে এতটা ভিতু কল্পনাও করতে পারেনি। সংকেত তো অজ্ঞান হয়ে গেছিল। তাকে সামলাতে বেগ পেতে হয়েছিল দুজনকেই। পরে অভিমান করে। যদিও তাড়াতাড়ি তা মিটিয়ে ফেলে। সে কথাগুলো ভেবে সবুজ আবার একবার হেসে উঠলো। ভয় আছে মনে তবুও নতুন জিনিস জানতে আগ্রহ হারায়নি। বেরিয়ে পড়েছে নতুন রহস্যের সন্ধানে।
প্রায় এক ঘন্টার মতো ট্রলার চলার পর গন্তব্যে পৌঁছে গেল। সূর্যময় নিরাশ হলো। এত তাড়াতাড়ি দ্বীপের দর্শন পাবে স্বপ্নেও ভাবেনি। মাঝ সমুদ্রে যাওয়া তো হলো না। আশেপাশে লক্ষ করে যা বুঝলো তাতে মন পরিতৃপ্তি পেল না। এ তো তাদের ও-দিকের মতো সাধারণ সমুদ্রের পাড়। অলৌকিক কিছু নেই। ট্রলারের গতি কমে এলো। সূর্যময় ভাবলো এবার হয়তো থেমে যাবে। জঙ্গলের কাছে চলে এসেছে। কিন্তু থামল না। ধীর গতিতে চলতে রইল। বাবার কাছে পৌঁছে বাবাকে বলল,’এখানটায় থামিয়ে দাও। এখান দিয়েও তো দ্বীপে যাওয়া যায়।’
অবশ্যই যাওয়া যায়। তবে বিপদ রয়েছে। তাই ধীরে ধীরে দ্বীপের বিপরীত দিকে চলল। সংকেত আর জড়ো হয়ে বসে থাকতে পারলো না। সেও দাঁড়িয়ে ওই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করল। বেশ ঘন জঙ্গল। কিছুক্ষণ পর ওখানে প্রবেশ করবে। কি আছে সেখানে? গুপ্তধন? অলৌকিক কিছু? না সাধারণ এক দ্বীপ? পাখি ছাড়া তেমন কোনো বন্য পশু পাখি চোখে পড়ল না। ট্রলার দ্বীপের বিপরীত প্রান্তে পৌঁছতে সম্পূর্ণ হতাশ হলো সূর্যময়। তাদের ট্রলার যে একটা খালে প্রবেশ করেছে। বাড়ির পাশে যে খাল রয়েছে ওই খালের চাইতে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি প্রশস্ত। এর আগে তারা কখনও এত বিশাল প্রশস্ত যুক্ত খাল দেখেনি। তবে খাল খালই তো। তাকে দেখার কি আছে? সে যে অন্য কিছু দেখতে এসেছিল। খালের ওদিকে সারি সারি নৌকো আর ট্রলার বাঁধা আছে। তারপর রয়েছে খুব কম ঘনত্বের জনবসতি। এ কি হলো? সে তো এমনটা ভাবেনি। সমুদ্রের দু-পাড়েই জনবসতি! এই দ্বীপটাকে ও-পাড় থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে সমুদ্র আর এ-পাড় থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে নিছক একটি খাল। এই খাল যদি না থাকতো তাহলে এখানেও জনবসতি গড়ে উঠতো। দ্বীপ বলে কিছু থাকতো না। খালের একটা অংশ তো সমুদ্রে মিশে আছে তাহলে আর একটা অংশ কোথায় গেছে? কৌতূহলবশত বাবাকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল। তিনি জানালেন, খালের আরেকটি অংশও এই সমুদ্রে মিশেছে। এটাকে ঠিক খাল বলা যায় না। সমুদ্রেরই অংশ।‌ পলি জমে যাওয়ায় এদিকে সমুদ্রের জল খুব বেশি আসতে পারে না। তাই এখানে ঢেউ হয় না। তাদের বাড়ি যে দিকে রয়েছে তা যদি উত্তর দিক হয় তাহলে এখন তারা যেখানে রয়েছে সেটা দক্ষিণ দিক। অর্থাৎ দ্বীপটির দক্ষিণ দিকে খাল রয়েছে। আর তিন দিকে রয়েছে সমুদ্র। সূর্যময় এতদিন ভেবেছিল সমুদ্র সমান্তরালভাবে বিস্তীর্ণ। কিন্তু এই জায়গায় দাঁড়িয়ে তার ভাবনা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। সে অনুভব করল সমুদ্র কখনও সমান্তরাল হতে পারে না। এবং নিজের চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পেল। ওদের বাড়ির কাছে দাঁড়ালে মনে হয় সমুদ্র সমান্তরালভাবে বিস্তীর্ণ। কিন্তু এখানে তো ভিন্ন। এখানে চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে দূরে ঘন জনবসতি। অর্থাৎ সমুদ্র এখানে বাঁক নিয়েছে। তার অ্যাডভেঞ্চারের ইচ্ছা দমে গেল। সত্যি কি সমুদ্রের শেষ বলে কিছু নেই? এক পাড়ে যেমন বসতি রয়েছে তেমনি আর এক পাড়েও বসতি রয়েছে। সূর্যময়ের শুকনো মুখ দেখে সবুজ বলল,’কি ব্যাপার, চুপচাপ হয়ে গেলে যে? পৌঁছেই কৌতুহল হারিয়ে ফেললে?’ তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সবুজ বুঝলো হাসিটা অনিচ্ছাকৃত। কিছু একটাতে কষ্ট পেয়েছে। তার পিঠে হাত চাপড়ে বলল,’বলো কি হয়েছে? দেখি সমাধান করতে পারি কিনা?’
‘আমি এতদিন ভেবেছিলাম সমুদ্রের বিপরীত দিকে অলৌকিক কিছু রয়েছে, কিন্তু… এ তো আমাদের… সাধারণ জনবসতি…।’
‘ও, এই ব্যাপারে তুমি মন খারাপ করে আছো? আমি তো আগেই বলেছিলাম এই পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই। সমস্ত অলৌকিক মানুষেরই তৈরি করা। বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। তুমি বরং সৌন্দর্য অনুভব করো। দেখবে অনেক কিছু খুঁজে পাবে। তোমার অনেক ধারণা বদলে যাবে।’ সূর্যময় জবাব দিল না। বন্ধুর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। অতুল বাবু ট্রলার থেকে নেমে পড়ে গাছের সাথে ট্রলার ভালো করে বাঁধলেন। তারপর সকলে মিলে খাওয়া শেষ করল। ঠিক হলো সকলে একসঙ্গে মিলে জঙ্গলের মধ্যে যাবে। তবে দুপুরের আগে ফিরে আসা হবে। দুপুরের রান্না সারতে হবে। সবুজ বেশ কৌতুহলী হয়ে পরলো। সে প্রস্তাব রাখল এত দূরে এসে, ট্রলারের মধ্যে রান্না করা কি শোভনীয় দেখায়? পাশেই বিশাল জঙ্গল রয়েছে। ওখানে গিয়ে তো বনভোজন করা যেতে পারে। সূর্যময় আবার কৌতুহল ফিরে পেল। সে সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানালো। সবাই রাজি হলো। জঙ্গলের ভেতরে ঘন অন্ধকার থাকতে পারে। টর্চ লাইট নিয়ে ভেতরে গেল। সূর্যময়, সবুজ, সংকেত একটা দলে আর একটা দলে অতুল বাবু আর বিক্রম বাবু রইলেন। ভেতরে ঢুকতেই সবুজ অবাক হলো। কয়েকটি মদের বোতল পড়ে রয়েছে। এখানে নাকি মানুষের আনাগোনা নেই। তবে মদের বোতল কোথা থেকে এলো? ঠোঁট টিপে হাসলো। মাতালদের ভয় ভ্রান্তি কিছুই থাকে না। তারা যেখানে খুশি অবাধে বিচরণ করতে পারে। নিশ্চয়ই ও-পাড়ের মানুষ এখানে মদ খেতে আসেনি। এ-পাড়ের মানুষই খাল পেরিয়ে চলে এসেছে। অস্বাভাবিক কিছু নয়। সবুজের বাড়ির দিকে এমন সুন্দর জায়গা থাকলে সেও সপ্তাহে অন্তত একবার ঘুরে যেত। কিছুটা যাওয়ার পর সবুজ অনুভব করল মাটি ভীষণ ভেজা। দু-তিন মাস ধরে বৃষ্টির দেখা নেই। তাহলে মাটি ভেজা কেন? উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল সূর্যালোক খুব ভালোভাবেই প্রবেশ করে। তবে কোনো আগাছা নেই। বুঝল, জোয়ারের সময় সমুদ্রের জল উঠে আসে। নোনা জলে মাটি ভিজে আছে। আর নোনা জলে তো উদ্ভিদ জন্মায় না। যে ভাবে বিশ্ব উষ্ণায়নের পরিমাণ বাড়ছে তাতে হয়তো কয়েকটা বছরের মধ্যেই এই দ্বীপটা জলের তলায় চলে যাবে। আরও কিছুটা যাওয়ার পর ভিজে ভাবটা কমে গেল। তবে টর্চের প্রয়োজন হলো না। সূর্যালোক ভেতরে মোটামুটি প্রবেশ করেছে। ভয়ের কোনো কারণ নেই। তেমন কোনো বন্য জন্তু আশেপাশে নেই। দু-একটা শিয়াল মোরগ খরগোশ লক্ষ্য করা গেল। অসংখ্য পাখি রয়েছে। সাপ থাকলে থাকতে পারে, এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি। এছাড়া আর কিছু নেই। শিয়াল আর মোরগের উপস্থিতি দেখে সবুজ আন্দাজ করলো দ্বীপটি নেহাতই ছোট নয়। ছোট হলে এমন প্রাণী থাকতো না। অনাহারে মারা পড়তো। বংশবৃদ্ধি সম্ভব হতো না। সে কাকামশাইকে জিজ্ঞেস করল,’আচ্ছা কাকামশাই, দ্বীপের এ-পাশ থেকে ও-পাশে যেতে কত সময় লাগবে?’
‘হেঁটে হেঁটে গেলে একদিনের বেশি লেগে যাবে।’
‘তাহলে তো খুব বড়!’
‘বড় নয়। কিছুদূর গেলেই বুঝবে এত সময় লাগবে কেন?’ সবুজ এ বিষয়ে আর কোনো প্রশ্ন করল না। উত্তরটা জানতে পেরে গেলে কৌতুহল হারিয়ে ফেলবে। তাই সে অন্য প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল,’এত বড় জঙ্গল। মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। এখানে অসাধু ব্যক্তিরা তো নির্বিধায় তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারে।’
‘তারা যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে?’ হেসে উঠলেন। সবুজ সেই হাসিতে যোগ দিলো না। হাঁটতে রইল। পাখিগুলো মানুষের উপস্থিতি টের করতে পেরেছে। তারা কিচিরমিচির করছে। তবে আরও কিছুটা যাওয়ার পর তাদের পায়ের গতি কমাতে হলো। জঙ্গলের ঘনত্ব বাড়ছে। চারিদিকে আগাছায় পরিপূর্ণ। সেগুলো না কাটলে এগোনো সম্ভব নয়। সবুজ বুঝতে পারল, কাকামশাই কেন বলেছিলেন শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে একদিনের বেশি সময় লেগে যাবে। জোয়ারের সময় হয়ে আসছে। আগেই বুঝতে পেরেছিল জোয়ার হলে দ্বীপের কিছুটা অংশ জলমগ্ন হয়ে যায়। ট্রলারের মধ্যে রান্না করলেও ফিরে যেতে হবে না করলেও ফিরে যেতে হবে। ঠিক হলো বাইরেই রান্না হবে। অতুল বাবু আর বিক্রম বাবু ফিরে এলেন। তারা রান্নার সামগ্রী তুলে আনা… রান্না করা… ইত্যাদি ইত্যাদি।
তারা ফিরে আসার পর সূর্যময়ের কৌতুহল আরও বেড়ে গেল। বাবা নেই নির্বিধায় যেখানে খুশি যাওয়া যাবে। আগাছা সরিয়ে ক্রমশ এগোতে লাগলো। এর আগে অনেক মানুষই এই জঙ্গলে এসেছে তবে এতদূর কেউ আসেনি। সংকেতও তাদের সাথে চললো। কিছুটা যাওয়ার পর একটা ভাঙ্গা বাড়ি দেখতে পেল। সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। সামান্য দূরে যেতেই অনেকটা সময় লেগে গেল। প্রচুর আগাছা রয়েছে। সে গুলোকে না সরিয়ে কিছুতেই এগোনো সম্ভব নয়। সংকেতও তাদের সঙ্গে হাত লাগালো। পৌঁছে লক্ষ করল একটা পুরনো পাকা বাড়ি। উপরে কিছু নেই। মাঝখানে একটা বটগাছ জন্মেছে। ভেতরে প্রবেশ করল। তিনজন আলাদা আলাদা হয়ে নিজেদের মতো করে ঘুরতে রইল। দেওয়ালে কিছু লেখা রয়েছে দেখে সবুজ সেখানে পৌঁছালো। একটু একটু করে নোংরা সরিয়ে দিতে লেখাটি স্পষ্ট হয়ে উঠল। লেখা রয়েছে ‘কাঁকড়া আরত’ তারপর লেখা রয়েছে ‘স্থাপিত ১৮’ তারপর আরও কিছু লেখা রয়েছে তবে সেগুলো স্পষ্ট নয়। সম্ভবত ১৮ -র কোনো এক সালে স্থাপিত হয়েছে। পরের দুটি সংখ্যা ক্ষয়ে গেছে। তাহলে ইংরেজদের আমলে এখানে কাঁকড়া আরত ছিল? সমুদ্রের পাশে মাছের আরত কিংবা কাঁকড়া আরত থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সামনে দিকে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। তার আগেই সূর্যময়ের ডাক পেল। সে কিছু একটা দেখতে পেয়েছে। সবুজ তাড়াতাড়ি সেখানে পৌছালো। আগে থেকে সংকেত এসে হাজির। সে একটা বড় লোহার ঢাকনা দেখতে পেয়েছে। সেটা তুলতে চাইলো। একার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনজন হাত লাগিয়েও সহজে পারল না। তবে বারবার চেষ্টা করার পর সক্ষম হলো। নীচে ভীষণ অন্ধকার। সিঁড়ি রয়েছে। সূর্যময় কাউকে তোয়াক্কা না করে টর্চ লাইট নিয়ে দ্রুত নীচে নেমে গেল। কারোর বাধা শুনল না। বড্ড ডানপিটে ছেলে। আগে পিছে কিছু না ভেবে চলে গেল। সংকেত ভয় পেয়ে গেছে। গুপ্ত ঘরের মধ্যে খারাপ কিছু থাকতে পারে। খারাপ কিছু না হোক, সাপ তো নিশ্চয়ই রয়েছে। তাকে বেশ কয়েকবার ডাকার পরও সাড়া দিল না। দুশ্চিন্তা হলো। সবুজও হন হন করে নেমে গেলো। নীচে সূর্যময় দিব্যি রয়েছে। সে টর্চের আলোতে কিছু খুঁজে চলেছে। অন্ধকারের মধ্যে তার মুখ সম্পূর্ণ দেখা গেল না। সবুজকে দেখে খুশি হলো। দুজন মিলে নতুন কিছু খুঁজতে রইল। কিছুই পেল না। পুরনো ভাঙ্গা বালতি,কাটারি,বটি ছাড়া কিছু নেই। বড্ড ধুলো ময়লা জমে আছে। হাঁচি পেল। খক খক করে কাশতে শুরু করলো। উপর থেকে সংকেত বারবার ডেকে চলেছে। ওরা হাঁক ছেড়ে বলল তারা ঠিক আছে। সে আসতে চাইলে আসতে পারে। এখানে তেমন কিছু নেই। সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজনও হবে না। সংকেত তবুও সাহস পেল না। উপরে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে রইল। ভেতরে বেশ গরম রয়েছে। অক্সিজেনের অভাবে দুজন হাঁপিয়ে উঠেছে। বেশ কিছুক্ষণ কিছু খোঁজার পর সূর্যময় বলল,’ এই গুপ্ত ঘর কোন কাজে ব্যবহৃত হতো? কিছু আন্দাজ করতে পারছো?’
‘সম্ভবত এখানে কাঁকড়া থাকতো।’
‘অন্য কিছুও তো হতে পারে।’
‘অন্য কিছু বলতে! কি বলতে চাইছো?’
‘আগেকার দিনে মানুষের অনেক কিছু চাহিদা ছিল এখন যে নেই তা নয়। হতে পারে এখানে লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু অসাধু কাজ চলত। অ্যালকোহল কিংবা নারী জাতীয় কিছু….।’
‘তোমার এমনটা মনে হওয়ার কারণ! হঠাৎ করে এমন ভাবনা জেগে ওঠার কথা তো নয়।’
‘মাছ ধরার পর মাছকে শীতল কক্ষে রাখার জন্য এমন ঘর ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এটা তো কাঁকড়ার আরত। কাঁকড়াকে শীতল কক্ষে রাখতে যাবে কেন? কাঁকড়া যে কোনো জায়গায় রাখা যেতে পারে।’
‘অমূলক কিছু বলনি,হলেও হতে পারে।সাধারণ মানুষকে বোঝানোর জন্য সামনে থেকে বলা হয়েছিল কাঁকড়া আরত পেছনে অন্য কিছু থাকলেও থাকতে পারে।’
সূর্যময় প্রসন্ন হেসে বলল,’তাহলে এখানে বেশিক্ষণ থাকা সুবিধা হবে বলে মনে হচ্ছে না। চলো ফিরে যাই।’
‘থাকলে অসুবিধা কোথায়?’
‘যেখানে পাপ কাজ থাকে সেখানে প্রতিশোধের ব্যাপারটাও থাকে। অলৌকিক কিছু তো রয়েছে।’ সবুজের খুব হাসি পেল। কোনো রকম ভাবে চেপে রেখে বলল,’তোমার মাথা থেকে কি কোনোদিন অলৌকিক ব্যাপারটা যাবে না?’
‘যতদিন না এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্পষ্ট হতে পারছি ততদিন পর্যন্ত বিশ্বাস করে যাব।’
‘বেশ তাই হোক। তাহলে চল ফিরে যাই। তবে আমি আবারও একবার বলে রাখলাম এই পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই।’ সূর্যময় তার দিকে তাকিয়ে হাসল। সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে উঠতে সবুজ বলল,’আমি ছোটবেলায় দাদুর মুখে শুনেছি এখানে নাকি গঙ্গা মন্দির ছিল। একটু খুঁজলে হয়তো পাওয়া যেতে পারে।’
সূর্যময় মাথা নাড়ালো। এই কথা সেও শুনেছে। কিন্তু খুঁজে বার করা কি সম্ভব? দ্বীপটি নিতান্ত ছোট নয়। তাছাড়া আগাছায় পরিপূর্ণ। সময় লাগবে। তবুও জেদ বজায় রাখলো। তিনজনে তন্ন তন্ন করে খোঁজার পর মন্দিরের সাক্ষাৎ পেলো। পুরনো ভাঙ্গা জিনিসপত্র ছাড়া কিছুই পেল না। বেশ কয়েকটা কাঁসার থালা পেলো। সেগুলো বাড়ি নিয়ে আসার জন্য ভাবলেও পরে সে আশাও ত্যাগ করল। ঠাকুরের জিনিস ঘরে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। পরিত্যক্ত জায়গায় পরিত্যক্তই থাকুক। সে স্থানে তারা অনেকক্ষণ রইল। গল্প করল। একসময় সূর্যময় সিগারেট বার করলো। একটা নিজে নিল আর একটা সংকেতকে দিল। সবুজকে ইশারা করে বললো নেবে কিনা! সবুজ জানতো না তার বন্ধুরা নেশায় আসক্ত। সে রুগ্ন কন্ঠে বলল,’কবে থেকে শুরু করলে?’
‘অনেকদিন থেকে।’
‘তোমরা খাও কিংবা না খাও আমার তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু আমার সামনে নয়। আমার সামনে খেলে আমি তোমাদের বাবাকে জানাতে বাধ্য হব।’
‘জানিয়ে কি হবে?’ সূর্যময় বলল।
‘এটা আমার কর্তব্য। আমি কখনও তোমাদের ভুল রাস্তায় যেতে দিতে পারি না। সর্বক্ষণ চেষ্টা করব সঠিক রাস্তা দেখানো। অন্তত আমার সামনে কখনও খারাপ কাজ করতে পারবে না। করলে আমি তো কিছু করতে পারবো না। তাই তোমাদের বাড়িতে জানাবো। আমার আড়ালে করলে আমার কিছু করার নেই।’ বাধ্য হয়ে সিগারেটগুলো আবার প্যাকেটই ভরে ফেলল। উঠে দাঁড়ালো সংকেত। সবুজের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,’আচ্ছা, বলতো এত ভালো মানুষ হয়ে কি হবে? একটু খারাপ হলে অসুবিধা কোথায়? জানোই তো জঙ্গলে সোজা গাছটা সর্বপ্রথম কাটা হয়। এ সব কথা না হয় বাদ দিলাম। আমরা তো উপন্যাস পড়ি না তুমি প্রচুর উপন্যাস গল্প পড়ো। নিশ্চয়ই অপু দুর্গার কাহিনী জানো। হরিহর, সর্বজয়া, দুর্গা,অপু এরা তো কত ভালো মানুষ ছিল। কিন্তু জীবনে কি পেয়েছে? সারা জীবন দারিদ্রতা অপমান লাঞ্ছনা অবজ্ঞা এগুলো ছাড়া আর কিছু পেয়েছে?’ সবুজ একটু থেমে জবাব দিল,’আমরা না জেনে অনেক খারাপ কাজ করে ফেলি। আর সেখানে দাঁড়িয়ে জেনেশুনে খারাপ করার উচিত নয়। এগুলো শুধুমাত্র পাপ-পুণ্যের ব্যাপার নয়, এগুলোতো শরীরকে অসুস্থ করে তুলে। আর তুমি উপন্যাসের কথা বললে! ঠিকই বলেছো ওরা সারা জীবন ধরে অপমান লাঞ্ছনা অবজ্ঞার স্বীকার হয়েছে। কিন্তু ওদের মৃত্যুটা ছিল খুব সহজ-সরল। কোনো রকম যন্ত্রণা পায়নি। মৃত্যুর পূর্বে তুমি শান্তি চাইবে। তুমি চাইবে না শেষ জীবনটা কষ্টে কাটাতে। চাইবে না শেষ নিঃশ্বাসটা কষ্টকর হোক। তুই যদি ভালো মানুষ হও ভালো কাজ করো সৎ পথে চলো তাহলে তোমার মৃত্যুটা কখনও কঠিন হবে না। শেষ নিঃশ্বাসটা বুক ভরে নিতে পারবে। মৃত্যুর পূর্বে নিজেকে স্বার্থপর ভাববে না। ভাববে, আমি সত্যি সত্যি একজন ভালো মানুষ ছিলাম। কাউকে ঠকায়নি। নিজের মতো করে বেঁচেছি। এর প্রতিদান কেউ না দিলেও ঈশ্বর দেবেন। মৃত্যুর সময় চোখের জল থাকবে না ঠোঁটের কোণে হাসি থাকবে। এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’ একটু থেমে আবার বলল,’যখন আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হবো তখন কিন্তু আমাদের মনে পড়বে না আমরা জীবনে কী কী পেয়েছি,কী কী পাইনি? তখন মনে পড়বে আমরা জীবনে কী কী পেতে চেয়েছিলাম আর কী কী পাইনি? যেগুলো পাইনি সেগুলো নিয়ে আফসোস করতে হবে। জীবনের শেষ মুহূর্তে কি আফসোস করতে চাও? যখন তুমি মনেপ্রাণে কোনো জিনিস চাইবে সেটা ঠিক ফিরে পাবে। আর যদি না পাও তখন মনে হবে আমি তো অনেক খারাপ কাজ করেছি ঈশ্বর কেন আমার সমস্ত চাওয়া পূর্ণ করবেন। হতাশ হয়ে পড়বে। আমি মনে করি, জীবনে খারাপ কিছু করলে জীবনে ভালো কিছু থেকে বঞ্চিত হতে হবে।’ সবুজের কথাগুলো তারা মন দিয়ে শুনল। কেউ কোনো শব্দ করল না। তবে মনে মনে একটু রাগ হল। এত জ্ঞান তারা সহ্য করতে পারে না। একটা মনোমালিন্য তৈরি হলো। নিঃশব্দে নিজেদের গন্তব্যে ফিরে এলো। রান্না শেষ হয়ে গেছে। খাবারের তোড়জোড় শুরু হলো। তবে পূর্বের কোলাহল হারিয়ে গেল। বেশিক্ষণ নয়। একটু একটু করে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে এলো। খাওয়া শেষ হওয়ার পর তিনজন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। সবুজ বুঝতে পেরেছে, তার কথাগুলো বন্ধুরা পছন্দ করেনি। তার ভাবনা যে একদম সঠিক তা তো নয়। তার ভাবনাও ভুল হতে পারে। তবে তার জন্য চুপচাপ হয়ে থাকবে? এমনটা তো নয়। স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার জন্য নতুন কিছু কৌশল খুঁজতে লাগল। কিন্তু কি দিয়ে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারল না। সে জলের দিকে ইশারা করে বললো,’এই জল দেখে কিছু মনে পড়ে? এক সময় আমরা তিনজন ন্যাংটো হয়ে এই জলে সাঁতার কেটেছি। গ্রীষ্মকালে এক-দু ঘন্টা ধরে স্নান করতাম। কারোর বাধা মানতাম না।মনে পড়ে সে-ই সব দিনগুলো? না ভুলে গেছো?’ সূর্যময়ের মুখে আবার হাসি ফুটে উঠল। বলল,’এত সহজে কি ভোলা যায়? শৈশবের দিনগুলি ছিল স্বর্ণ দিন।’
‘আজকের দিন গুলো তাহলে কি রূপো?’ সবুজের কৌতুকে হেসে উঠল দুজনে।
‘এমনটা নয়। তখন আমরা তিনজন চুল একসঙ্গে কাটতাম। বাথরুমে কখনও আলাদা আলাদা যেতাম না। এক সঙ্গে খাবার খেতাম। পুজোয় একই রঙের জামা পরতাম। তিনজন একসঙ্গে অনুষ্ঠান দেখতে যেতাম। একটা ঘুড়ি তিনজন ওড়াতাম। কিন্তু এখন কি আমরা তা করি?’
‘এখন বড় হয়েছি বাথরুমে তো আর তিনজনে একসাথে যাওয়া যায় না।’
‘কিন্তু একসঙ্গে চুল তো কাটতে পারি। একসঙ্গে মেলায় তো যেতে পারি। একই রঙের জামা তো পরতে পারি। একজনের দুঃখে বাকি দুজন কষ্ট তো পেতে পারি। একজনের আনন্দে বাকি দুজন আনন্দ উপভোগ করতে তো পারি।’ সংকেত হেসে বলল,’আমি তো এতদিন দেখে আসছি সবুজ কবি। আজ দেখছি, তুমিও কবিদের মতো কথা বলছো।’
সবুজ হেসে কয়েকটি শব্দ খুঁজে ছন্দ জুড়িয়ে বলল,’
তোমরা আমার ছোটবেলার ঝাল মুড়ির ভাগীদার হবে?
তোমরা আমার ব্যর্থতার নীলচে কষ্ট হবে?
তোমরা আমার হেরে যাওয়ার সঙ্গী হবে?
তোমরা আমার গোধূলি বেলার গল্প শুনবে?
তোমরা আমার বিকেলের কালবৈশাখীর ঝড় দূর করতে পারবে?’
সংকেত আর সূর্যময় একসঙ্গে বলে উঠলো, ‘পারবো, পারবো, অবশ্যই পারবো।’ তিনজন একসঙ্গে জড়ো হয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। চোখের কোণে জল জমে গেল। কোনো দুঃখের জল নয়। আনন্দে অশ্রুধারা বয়ে গেল। জীবনে সমস্ত বাধা বিপত্তি পেরিয়েও নিরুদ্দেশ না হওয়ার প্রতিশ্রুতি করল। সবুজ স্বীকার করল তার চার বছর নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া উচিত হয়নি। বন্ধুদের অনেক কষ্ট দিয়েছে। যদি সে-ই সময় উপস্থিত থাকতো তাহলে আরও অনেক সোনালী মুহূর্ত কাটাতে পারতো। এটা তার জীবনে বড় ভুল। মনে পড়ে গেল ছোট বেলা বনভোজনের কথা। তারা অনেকবার বনভোজনে গেছে। কিন্তু বনভোজনের মানে কি? একসঙ্গে অনেকে মিলে জঙ্গলে কিংবা কোনো নিরিবিলি জায়গায় নিজেরা রান্না করে খাবে। খাওয়ার চেয়ে আনন্দটাই বেশি। কিন্তু এদের বনোভজনটা আলাদা। এরা কখনও তিন জনের বেশি বনোভজন করতে যায়নি। যখনই গেছে তিনজন গেছে। রাগারাগি মারপিট কথা কাটাকাটি হয়েছে কিন্তু কেউ কাউকে ছেড়ে যায়নি। পেছনে কেউ একে অন্যের নামে মন্দ কথা বলেনি। স্কুলে অনেক বন্ধু বান্ধবীর সঙ্গে পরিচয় ছিল। কাউকে না কাউকে কেউ বনভোজন কিংবা কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্য বলেছে। কিন্তু এরা কেউই রাজি হয়নি। তিনজন ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেনি। বন্ধুর জন্য অনেক ভালো সুযোগও ত্যাগ করেছে ছোটবেলায়। সেই ত্যাগ স্বীকার কোনো মহৎ উদ্দেশ্য ছিল না, ছিল বন্ধুত্বের প্রতি গভীর ভালোবাসা আর ভক্তি। ভালো সুযোগ পাওয়ার পরও যারা পুরনো বন্ধুকে ছেড়ে যায় না তারাই তো প্রকৃত বন্ধু। কথায় কথায় সংকেত বলল, সবুজ আবার পড়াশোনা করুক। সে চাইলে এখন থেকে শুরু করে অনেক দূরে পৌঁছাতে পারবে। কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞা থেকে সরে আসলো না সংকেত। না মানে না। প্রসঙ্গ পাল্টে চলে গেল বিয়ে….। সূর্যময় হঠাৎ করে বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই অপরপক্ষে দুজন বেশ কৌতূহল হয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে সংকেত আর সূর্যময় সবুজের প্রেমের কথা শুনেছে। তারা যুক্তি দিয়েছে, সবুজের এভাবে ছেড়ে চলে আসা ঠিক হয়নি। সাথীর বয়স খুব বেশি নয়। এই বয়সে একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি। সবুজ কোনো মন্তব্য করেনি। সেও তৃধার ব্যাপারে কিছু কথা শুনেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে দুজন দুজনকে পছন্দ করে। কিন্তু এখনও কেউ কাউকে বলে উঠতে পারেনি। বাকি থেকে গেল সূর্যময়? তার জীবনে এখনও নাকি প্রেম আসেনি। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সবার আগে বিয়ে করে তাক লাগিয়ে দেবে। কিছুদিনের মধ্যে নাকি বিয়ে করছে সে। সংকেত একটু হেসে বলল,’তোমার বাবা জানে তো? না আমি এখনই বলে আসবো।’ হো হো করে হেসে উঠলো।
‘মিথ্যা নয়। সত্যি সত্যি বিয়ে করছি।’
‘আচ্ছা, আমাদের নেমন্তন্ন করবে না!’
‘তোমরা না থাকলে আমি বিয়েই করব না।’
‘আর রেখা ম্যামকে নেমন্তন্ন করবে না?’ সংকেতের এমন কৌতুকে হেসে লুটোপুটি খেলো। সূর্যময় বলল,’ না ভাই, তাঁকে নেমন্তন্ন করব না। উনি আবার বিয়ের মঞ্চে আমাকে ফ্রেজাল ভার্ব জিজ্ঞেস না করে বসেন।’ আবার একটা হাসির শোরগোল পড়ে গেল। রেখা ম্যান তাদের স্কুলে ইংলিশ শিক্ষিকা। তিনি ক্লাস সেভেনে ফ্রেজাল ভার্ব পড়িয়ে ছিলেন। তারপর থেকেই তিনি ক্লাসে গেলেই প্রত্যেক ক্লাসে কাউকে-না-কাউকে ফ্রেজাল ভার্ব জিজ্ঞেস করতেন। তাই তাঁকে ফ্রেজাল ভার্ব বলে সবাই মজা করে। আর তিনি সূর্যময়কে একদমই পছন্দ করতেন না। প্রায় সময় তাকে ধরতো। সংকেত কিছুতেই হাসি থামাতে পারলো না। হা হা করে হাসতে রইল। সবুজও তাদের হাসিতে যোগ দিল।

সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বে তারা তৈরি হয়ে নিল বাড়ি ফেরার জন্য। সমস্ত গোছানো শেষ। ইতিমধ্যে সংকেত ট্রলারের উঠে বসেছে। সারাদিন বড্ড খেটেছে ছেলেটা। এ-দিক ও-দিক দৌড়ানোর পর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আর শক্তি নেই। সে চুপচাপ বসে রইল। সবাই উঠে পড়লো। কিন্তু সূর্যময় আসতে চাইছে না। সে এখনও জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে এ-দিক ও-দিক কিছু খুঁজছে। সত্যি কি কিছু নেই? কত সাহিত্য কত উপন্যাস রচিত হয়েছে অলৌকিক ব্যাপার নিয়ে। কত মানুষের মনে কত ভাবনা। সব কি মিথ্যে? অনেক পীড়াপিড়ির পর সে ফিরে এল। মনটা দুঃখে ভরে গেছে। ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। ট্রলার চলতে শুরু করল। সূর্যময় খেয়াল করে দেখল সবুজ কাগজে কিছু লিখতে শুরু করেছে। মনে নতুন কিছু ভাবনা আসলে সে এমনটা করে। তাকে এই সময় বিরক্ত করে লাভ নেই। তাকে সৃষ্টি করতে দিল। সংকেত ঝিমুচ্ছে। নিজেকে আরও বেশি একা লাগলো। পিছনে এসে দাঁড়িয়ে খোলা সমুদ্র দেখল। মনে মনে স্থির করলো, এ পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু আছে কিনা জানে না। তবে সমুদ্রের শেষ সীমান্ত বলে কিছু নেই। পৃথিবীর যেমন গোল -কোন বিন্দু থেকে পৃথিবীত ভ্রমণ করা শুরু করলে আবার সে-ই বিন্দুতে ফিরে আসতে হবে। সমুদ্র ঠিক তাই। সমুদ্রের শেষ অংশ বলে কিছু নেই। এ-পাড়ে যেমন বসতি রয়েছে ও-পাড়েও তেমন বসতি রয়েছে। নয়তো আছে খাল‌ কিংবা নদী। ওই খাল বরাবর গেলে দেখা যাবে যে ওই খাল আবার কোনো নদী কিংবা সমুদ্রের সঙ্গে মিশেছে। আর নদীর ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম। নদীটি পূর্বে হয়তো কোথাও ভেঙ্গে গিয়ে সমুদ্রে মিশেছে নয়তো পুরো পাহাড় থেকে নেমে এসেছে, অর্থাৎ সমুদ্রের শেষ ঠিকানা সমুদ্রই।
কিছুক্ষণ পর সবুজ উঠে দাঁড়ালো। বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলল,সে তাদেরকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছে। সবাইকে একবার কবিতাটি পড়ে শোনালো। তারা মনে-মনে বার কয়েক বার পড়লো। বেশ লিখেছে। চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনজন একসঙ্গে চিৎকার করে বলে উঠলো,
‘টাকা আছে বাড়ি আছে,আধুনিক জীবন আছে।
না,না, ওসব পোষাকি জিনিস আমাদের চাই না।
আমরাতো কৃষকের ঘাম, মাটিতে পড়লেই অনেক দাম।
চিতার আগুনে শুয়েও বলতে পারি, বন্ধু তুমি কৃষকের ঘাম।’

পর্ব ১২ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here